1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৩৫

৩৫

‘ঠিক সময়ে ঠিক সাহসটি করতে পারলেই ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়।’

– থুকিডিডিস

***

সক্রেটিস এখন যোদ্ধা।

সে যুদ্ধ করতে এসেছে উত্তর গ্রিসে। জায়গাটির নাম পটিডিয়া[৯৩]। এত দূরে এসে তার মন হু হু করে। সক্রেটিস জীবনে এথেন্স ছেড়ে কোথাও যায়নি। তবে মন খারাপের আসল কারণ হলো জেনথিপিকে একা রেখে এসেছে। বউ কাছে থাকলে সারা দিন ঘ্যান ঘ্যান করত, তখন মনে হতো বাড়ির বাইরে থাকলেই ভালো। কিন্তু এখন দূরে এসে মনে হচ্ছে সেই ঘ্যান ঘ্যান আমার কত আপন! জীবনে এই প্রথম জেনথিপির জন্য মন কাঁদছে। যুদ্ধে যেকোনো সময় প্রাণ যেতে পারে, তখন মেয়েটি একেবারে অকূল সাগরে পড়বে। মেয়েটি একেবারে একা, তাদের সন্তান হয়নি এখনও।

সক্রেটিস হপলাইট। হাতে বর্শা আর ঢাল নিয়ে আটজন একসাথে গোল হয়ে যারা যুদ্ধ করে সেই সেনাদের বলে হপলাইট। হপলাইট হতে হলে নিজের অস্ত্র থাকতে হবে। সক্রেটিসের বাবার আমলের অস্ত্র আছে।

যুদ্ধে এসে তারা দিন-রাত জাহাজে থাকে। জাহাজ থেকে নেমে খোলা ময়দানে যুদ্ধ করে আবার জাহাজে ফিরে যায়।

তাদের সাথে আছে এলসিবিয়াডিস নামক এক তরুণ। সে পেরিক্লিসের ভাগ্নে। তার ভাবসাব একেবারে পেরিক্লিসের মতো। যুদ্ধেও নিপুণ, এই যুদ্ধে সে অশ্ববাহিনীর প্রধান। অন্য যত গুণই থাক, ছেলেটিকে এক নজরে চোখে পড়ে তার অপূর্ব রূপের জন্য। একেবারে দেবতা নিন্দিত মুখশ্রী। এথেন্সে অনেক সুন্দর মানুষ আছে, কিন্তু এই ছেলেটির মতো এত সুন্দর মুখ আর কারও নেই। এই যুদ্ধেও সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ এলসিবিয়াডিস।

এলসিবিয়াডিস জনপ্রিয় কিন্তু ভীষণ অহংকারী। তার রূপের দেমাগ আছে, বংশের গর্ব আছে, প্রতিভার ফুটানি আছে। সে কাউকে মানে না, নিজে যা ভালো মনে করে তা-ই করে। এখানে সে খুব ভালো যুদ্ধ করছে।

কিন্তু যুদ্ধে সুবিধা করতে পারছে না এথেন্স। এখানে স্পার্টানরা শক্তিশালী। একদিন যুদ্ধে হঠাৎ এথেন্স বিপদে পড়েছে। এথেন্সের সেনাপতি হুকুম করলেন, পিছে হটো, পালাও, যেভাবে পার জাহাজে গিয়ে ওঠো। সবাই ছুটছে। সক্রেটিসও জাহাজের দিকে যাচ্ছে। খুব দ্রুত ছোটা যায় না। তার হাতে বিশাল ঢাল। পরনে লোহার বর্ম। মাথায় অনেক ভারী হেলমেট। তবুও প্রাণপণে ছুটছে সক্রেটিস।

সবাই পালাচ্ছে। কিন্তু একজন পালাচ্ছে না। সে হলো এলসিবিয়াডিস। এই তরুণ ছেলের রক্ত খুবই গরম। সে মনে করে সে নতুন যুগের এসকিলিস। সে পালাবে না। সাহস দেখিয়ে সে হঠাৎ বিপক্ষের একজনকে বর্শা মেরে বসল। শত্রুরা দেখল, এ কোন্ চ্যাংড়া। ওর দলের সবাই পালাচ্ছে, আর ও একলা আমাদের মারছে? তবে দ্যাখ্ মজা! চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল তাকে।

সক্রেটিস পেছনে তাকিয়ে দেখে এলসিবিয়াডিসকে ঘিরে ফেলেছে শত্রুরা। চারদিকে শত্রু। এলসিবিয়াডিস একা। ছেলেটা বীরের মতো লড়ছে। কিন্তু এত লোকের সাথে কিছুতেই পারবে না। ছেলেটি মারা যাবে। এথেন্সের কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যাচ্ছে না। সবাই পালাচ্ছে। ছেলেটিকে বাঁচাতে হবে। হুংকার দিয়ে উঠল সক্রেটিস। আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।

এলসিবিয়াডিস ততক্ষণে মার খেতে শুরু করেছে। সে রক্তাক্ত। মনে হচ্ছে মৃত্যু খুব কাছে। যেকোনো সময় তার হৃদপিণ্ডে শত্রুর বর্শা বিঁধে যাবে। সে মাটিতে পড়ে গেল। তাকে মারতে বর্শা হাতে এগিয়ে আসছে শত্রু, সে চোখে অন্ধকার দেখছে। বর্শা উঁচিয়ে ফেলেছে একজন। এই তার মৃত্যুদূত। আর এক মুহূর্ত পরেই মৃত্যু। কিন্তু হঠাৎ লোকটা পিছে চলে গেল। তার সাথের শত্রুরাও দূরে সরে যাচ্ছে। এলসিবিয়াডিস ঘুরে দেখল ক্ষিপ্র বেগে সেদিকে আসছে সক্রেটিস। সে হাতে বর্শা নিয়ে ছুটে আসছে বুনো ষাঁড়ের মতো। তাকে অমন করে আসতে দেখে সামনের সবাই পালিয়ে যাচ্ছে। এলসিবিয়াডিসের সামনে গিয়ে সক্রেটিস বর্শা উঁচিয়ে ধরে দেখে শত্রুরা কেউ নেই। ততক্ষণে এলসিবিয়াডিস মাটিতে পড়ে গেছে। সে প্রায় অজ্ঞান। সক্রেটিস তাকে কাঁধে তুলে নিয়েই দৌড় দিল জাহাজের দিকে[৯৪]।

স্পার্টার জেনারেল ঘটনাটি লক্ষ করল। সে সক্রেটিসকে ডেকে বলল, এই যুবক, তোমার সাহস তো একেবারে স্পার্টানদের মতো। তোমার সাথে আমার কথা আছে। যুদ্ধ নয়, অন্য বিষয়ে কথা। বিকেলে দূত পাঠাব তোমাদের জাহাজে। তুমি এসো আমার শিবিরে

সক্রেটিসের উত্তর দেওয়ার সময় নেই। সে এলসিবিয়াডিসকে কাঁধে নিয়ে প্রাণপণে ছুটছে। সে কিছুই বলল না।

জাহাজে আসতে আসতে এলসিবিয়াডিস পুরোপুরি অজ্ঞান। তার জ্ঞান ফিরল কয়েক ঘণ্টা পরে। মাথা ঝিমঝিম করছে। কিছুই মনে পড়ছে না। শুধু মনে আছে সক্রেটিস তাকে কাঁধে নিচ্ছে। আর কিচ্ছু মনে নেই। সে সক্রেটিসের দিকে তাকাল। এই লোকটি তার জীবন বাঁচিয়েছে।

সক্রেটিস বলল, বিপদ কেটে গেছে। তুমি ঘুমাতে চেষ্টা করো।

এলসিবিয়াডিস ঘুমাতে পারছে না। চোখ বুজলেই দুঃস্বপ্ন দেখছে। শত্রুরা বর্শা নিয়ে আসছে। এই বুঝি তাকে মেরে ফেলল। সে থেকে থেকে জেগে ওঠে। দু’একবার সক্রেটিসকেও দেখেছে স্বপ্নে। সে সক্রেটিসকে চেনে। রাস্তা- ঘাটে ছেলেদের জ্ঞান দেয়, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। তার মামি আসপাশিয়া বলে, সক্রেটিস নাকি অনেক জ্ঞানী মানুষ। তার সাথে আলাপ করলে অনেক কিছু শেখা যায়। এলসিবিয়াডিস নিজেকে মনে করে বিরাট পণ্ডিত। সে নিজেই ওস্তাদ। কারও কাছে তার শেখার দরকার নেই। কিন্তু সক্রেটিস যেভাবে তার জীবন বাঁচিয়েছে, সেটি সবাই করবে না। অন্যের জন্য নিজের জীবনের এত বড় ঝুঁকি নিতে অন্য রকম কলিজা লাগে।

এদিকে জাহাজে সবাই সক্রেটিসের প্রশংসা করছে। সে চাইলে যুদ্ধেও নেতা হতে পারে।

সক্রেটিস বললেন, ছিঃ, ছিঃ, লজ্জা দিও না। অস্ত্রের সাধনা করতে আমার জন্ম হয়নি। আমি জ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করেই ভালো আছি। তোমরা যদি নেতা বানাতে চাও, তবে ভবিষ্যতে এলসিবিয়াডিসের কথা ভাবতে পার। ছেলেটা যুদ্ধ জানে, সাহসও আছে।

সন্ধ্যায় স্পার্টান দূত এলো এথেন্সের জাহাজে। এথেন্সের জেনারেল ভাবল, তার জন্য খবর পাঠিয়েছে বিপক্ষ, তিনি হাসি মুখে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু না, শত্রুরা কথা বলতে চায় সক্রেটিসের সাথে। জেনারেলের অপমান লাগল। তিনি সক্রেটিসকে যেতে দেবেন না। শুনে এলসিবিয়াডিস বলল, ‘ওকে যেতে দাও। ও আজ যা করেছে, সেটি একজন মহান বীরের চেয়ে কম নয়।

জেনারেল বললেন, শত্রুরা তো ওকে মেরে ফেলতে পারে।

সক্রেটিস বলল, স্পার্টানরা কাউকে শিবিরে ডেকে নিয়ে হত্যা করবে, তারা এত খারাপ বলে কেউ শোনেনি।

জেনারেল ক্ষেপে গিয়ে বললেন, বাহ, আমার সৈনিক আমার সামনে স্পার্টার প্রশংসা করছে। চমৎকার সক্রেটিস। তুমি যাও, স্পার্টার শিবির ঘুরে দেখে এসো তারা কত ভালো।

ঝামেলা দেখে সক্রেটিস শেষ পর্যন্ত আর গেল না স্পার্টান শিবিরে। তার মন খারাপ। জেনারেলের সাথে কথা কাটাকাটি তার ভালো লাগেনি। মানুষ আসলে খুবই ছোট মনের প্রাণী। সে ক্লান্ত। আজ যুদ্ধে ভীষণ ধকল গেছে। সে জাহাজে নিজের কক্ষে বসে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে। আঁধার রাতে সাগরের গর্জন তার ভালো লাগে। মনে হয় সাগর চিৎকার করে কাঁদছে। সে জাহাজে আছে, এখানে সব সময়ই সাগর এমন গর্জন করছে, এমন করেই কাঁদছে। কিন্তু অনেক দিন সে সাগরের কান্না শোনেনি। আজ মন খারাপ বলে সাগরের কান্না শুনতে পাচ্ছে। সাগর সারাক্ষণ কাঁদলেও মানুষ যখন সেই কান্নাকে নিজের কান্নার সাথে মিলাতে পারে, শুধু তখনই সাগরের কান্না শুনতে পায়।

সক্রেটিস সাগরের কান্না শুনতে শুনতে যুদ্ধের কথা ভাবছে। সে একজন দার্শনিক। তার জীবনের উদ্দেশ্য মানুষের জন্য সুন্দর জীবনের খোঁজ করা। অথচ সে এই যুদ্ধ ছে। তার সাথে যুদ্ধ ব্যাপারটা একেবারেই যায় না। সে গভীর জিনিসকে হালকা করে দেখে, সহজ করে দেখে। কিন্তু কিছু জিনিস আছে যেটিকে যতই সহজ করে দেখতে চাও না কেন, সেটি সহজ হয় না। তেমন একটি জিনিস হলো যুদ্ধ। যুদ্ধ বড় কঠিন জিনিস। এখানে মারতে হবে, না হলে মরতে হবে। এখানে চোখের বদলে চোখ নিতে হয়, রক্তের বদলে রক্ত। তো কী হবে তার সুন্দর জীবনের? সে কি জীবনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুৎ হচ্ছে? হঠাৎ মনে পড়লো সে আজ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এলসিবিয়াডিসকে বাঁচাল। এটি কি তার সুন্দর জীবনের অংশ নয়? যে জীবন সকল সময়ে মানুষের ভালো করার চেষ্টা করছে, সেটিই তো সুন্দর জীবন। আজ আমি একটি তরুণের প্রাণ বাঁচিয়েছি। যুদ্ধে এসেও আমার উদ্দেশ্য থেকে সরে যাইনি। তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। এই প্রথম যুদ্ধে সে আপন সত্তাকে ফিরে পেল। সে এথেন্সের জন্য যুদ্ধ করছে; কিন্তু সুন্দর জীবনের স্বপ্ন সাথেই আছে।

এমন সময় তার দরজায় কে যেন নক করল। দরজা খুলে সক্রেটিস অবাক। দাঁড়িয়ে আছে সৌম্যকান্তি এলসিবিয়াডিস। আহা বেচারা, এই ক্লান্ত শরীরে সে ছুটে এসেছে তার সাথে দেখা করতে। সক্রেটিস তার হাত ধরে তাকে বসাল। কিন্তু এলসিবিয়াডিস শুয়ে পড়ল, সে আসলেই ক্লান্ত।

এলসিবিয়াডিস উদ্ধত মানুষ, সে কাউকে মানে না। কিন্তু আজ সক্রেটিসের কাছে এসে তার কান্না পাচ্ছে। সে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। সক্রেটিস তাকে পরম মমতায় সান্ত্বনা দিচ্ছে। আহা রে, ছেলেটির বাবা-মা নেই। মামা পেরিক্লিসের কাছে মানুষ হয়েছে। এই তরুণ বয়সেই কেমন কঠিন যুদ্ধে এসে প্রায় মারাই যাচ্ছিল। ছেলেটির প্রতি ভীষণ মায়া হলো সক্রেটিসের। সে বলল, কান্না থামাও, এসো গল্প করি। তোমাকে মজার কিছু শুনাই। আমার বন্ধু চেরোফোনের গল্প শোনো। সে গিয়েছিল ডেলফিতে। ওরাকলের কাছে গিয়ে সে কী কাণ্ডটাই না করল!

আর গল্প করে লাভ নেই। এলসিবিয়াডিস ঘুমিয়ে গেছে।

সক্রেটিস তার গায়ে একটি চাদর তুলে দিল।

খুব সকালে ঘুম ভেঙে এলসিবিয়াডিস দেখে সে সক্রেটিসের খাটে ঘুমিয়ে আছে। সক্রেটিস তখনও ঘুমাচ্ছে। সে ঘুম থেকে উঠে গেল। সক্রেটিসের ঘর থেকে এলসিবিয়াডিসকে বের হতে দেখল জাহাজের কয়েকজন। দেখেই তারা ফিসফিস শুরু করল। এলসিবিয়াডিস চমকে উঠল। কেন ফিসফিস করছে? এরা কী ভেবেছে? আমি সক্রেটিসের ঘরে ঘুমিয়েছিলাম বলে কি এরা ফিসফিস করছে?

তার মনে পড়ল, এথেন্সে তরুণ ছেলেদের নিয়ে বুড়োদের ব্যাপারে ভয়ংকর বিশ্রী সব কেচ্ছা আছে। এই ব্যাপারে এথেন্সে খারাপ বুড়োর অভাব নেই। এরা কি তাই ভাবছে? তখন তার মনে হলো সক্রেটিস পরম মমতায় তার পাশে ঘুমিয়ে ছিল একজন বাবা বা বড় ভাইয়ের মতো। সক্রেটিস এসব ব্যাপারেও বড় মাপের মানুষ, এথেন্সের বিশ্রী বুড়োদের মতো নয়। অথচ সেই বুড়োরাই সক্রেটিসকে গালি দেয়।

কিন্তু ঘটনা হলো জাহাজে তাকে আর সক্রেটিসকে নিয়ে বিশ্রী কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। কী করা উচিত তার? ওদের ভুল ভাঙ্গানো উচিত? এলসিবিয়াডিস এবার নিজের কাছেই চিৎকার করে উঠল। আমি কেন বাজে লোকের কাছে ব্যাখ্যা দিতে যাব? আমি এলসিবিয়াডিস, আমি পেরিক্লিসের ভাগ্নে, সেরা যোদ্ধা, আমি যা করি নিজের ইচ্ছায় করি। আমি কেন ওদের কাছে ব্যাখ্যা করতে যাব? আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না। কাউকে কিছু বলা মানে সক্রেটিসের অসম্মান। যে মানুষটি সারা রাত আমাকে সেবা করেছে, তার নামে এসব কথা যারা বলে আমি তাদের খোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেব। আমি সক্রেটিসের কাছে যাওয়াও বন্ধ করব না। সে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। যুদ্ধে তো অনেকেই সেখানে ছিল। অন্য কেউ তো এগিয়ে আসেনি, নিজের জীবন তুচ্ছ করে এসেছিল একমাত্র সক্রেটিস। আমার জীবনের জন্য আমি তার কাছে ঋণী। যতদিন বাঁচব আমি এই ঋণ মনে রাখব। আজ থেকে আমার জীবনের একমাত্র গুরু হবেন সক্রেটিস।

সেদিন থেকে সক্রেটিসের আরেকজন অকৃত্রিম বন্ধু হলো। তার নাম এলসিবিয়াডিস। কিন্তু একই সাথে নতুন এক কানাঘুষা শুরু হলো তাদের দুজনকে নিয়ে। মানুষ রগরগে গল্প তৈরি করল।

.

যুদ্ধ থেকে এথেন্সে ফিরেছে সক্রেটিস।

পটিডিয়ার যুদ্ধে বীরত্বের জন্য এথেন্সের সরকার পুরস্কার দিল এলসিবিয়াডিসকে। সরকারের কেউ সক্রেটিসের কথা উল্লেখও করল না। সক্রেটিসকে পুরস্কার দিয়ে কী হবে! সে নেতা নয়, নেতার ছেলেও নয়; নেতাদের কোনো কাজেও আসে না, তার জন্য কেউ সুপারিশও করে না। সে খালি পায়ে ঘোরে আর ছেলেদের সুন্দর জীবনের কথা বলে। তার সুন্দর জীবন যুদ্ধে কোনো কাজে লাগে না। তাকে পুরস্কার দেওয়ার কিছুই নেই।

এলসিবিয়াডিস পুরস্কার গ্রহণ করল। সাহসিকতার পুরস্কার। পুরস্কার নিতে তার ভালোই লাগছিল, কিন্তু বারবার সক্রেটিসের মুখটা ভেসে উঠছিল। সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। যদি কোথাও সক্রেটিসকে দেখা যায়। কিন্তু সক্রেটিস তো পুরস্কারের মঞ্চের মানুষ নয়; সে রাস্তার মানুষ, তাকে মঞ্চে পাওয়া যাবে না, তাকে খুঁজতে নামতে হবে পথে।

.

বাড়িতে ফিরে এলসিবিয়াডিস খুব সুন্দর সাজুগুজু করেছে। তাকে দেখে আসপাশিয়া মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। কী সুন্দর লাগছে ছেলেটিকে! চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না। দেখতে দেখতে বিশ বছর হয়ে গেছে ছেলেটির।

এলসিবিয়াডিস বলল, মামি, দোয়া নিতে আসলাম।

‘দোয়া কী জন্য?’

‘আমি দীক্ষা নিতে যাচ্ছি। গুরুর কাছে দীক্ষা।’

‘মানে কী? কে তোর গুরু?’

‘সক্রেটিস।’

আসপাশিয়া খুব খুশি। এই অহংকারী ছেলেটার অনেক গুণ। যেমন রূপ, তেমনই গুণ। কেমন সুন্দর করে কথা বলে। কিন্তু দোষ একটিই। সে নিজে যা ভাবে, তাই করে; কারও কোনো কথা শোনে না। এমনকি পেরিক্লিসের কথাও শোনে না। তাকে নিয়ে পেরিক্লিসের অনেক চিন্তা। এ বাপ-মা মরা ছেলেটাকে অনেক আদরে বড় করেছেন পেরিক্লিস। কিন্তু লোকে বলে আদরে বাঁদর হয়ে গেছে। সে কাউকে মানে না। সে মনে করে পেরিক্লিস হলো এথেন্সের রাজা, আর সে নিজে হলো যুবরাজ।

তবে আর চিন্তা নেই। এখন এলসিবিয়াডিস সক্রেটিসের সাথে মিশবে। সক্রেটিসের চরিত্র খুবই উন্নত। এতদিনে সে কোনোদিন আসপাশিয়ার দিকে কামনার চোখে তাকায়নি। সে মানুষের জন্য সুন্দর জীবনের উপায় খোঁজে। এমন লোকের শিষ্য কোনোদিন খারাপ হতে পারে না।

আজ পেরিক্লিস বাড়ি ফিরলেই বলতে হবে এলসিবিয়াডিসকে নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই। সে এবার সঠিক জহুরির পাল্লায় পড়েছে। আর খারাপ হতে পারবে না।

.

এলসিবিয়াডিস সক্রেটিসকে খুঁজছে। কোথাও পাচ্ছে না। আজ কেউ তাকে দেখেনি। এমনিতে আগোরায় একটি চক্কর দিলে আর কাউকে পাও আর নাই পাও, সক্রেটিসকে পাবেই। কিন্তু আজ তার দেখা নেই।

তাকে খুঁজতে এলসিবিয়াডিস সক্রেটিসের বাড়ি চলে এলো।

সে অবাক। এমন ভাঙাচোরা বাড়ি। খুবই অল্প একটু জায়গা। পেছনে একটি জলপাই বাগান, এই বাগানই তার সম্বল। সে ঠিক করল সক্রেটিসকে এক টুকরা জায়গা দেবে। একেবারে মধ্য এথেন্সে। এক্রোপোলিসের পাশেই। সে সক্রেটিসকে বলছে, ‘শোনো, ঐ জায়গায় একটি বাড়ি করবে। সামনের ঘরটা করবে আকাশি। সেখানে আমরা বসব। ভেতরের ঘরটা বেগুনি। বেগুনি হলো স্নিগ্ধ রং। তোমার স্ত্রীর মন ভালো থাকবে। সে আর তোমার সাথে চ্যাঁচামেচি করবে না। তখন তোমার ঘরভরা শান্তি, আর মাথাভরা জ্ঞান।’

জেনথিপি ভেতর থেকে শুনছিল সব কথা। সক্রেটিসের বন্ধুরা তেমন কেউ বাড়িতে আসে না। সক্রেটিসই তো বাড়িতে থাকে না, বন্ধুরা আসবে কী করে!। জেনথিপি কান পেতে শুনছিল তারা কী বলে। এলসিবিয়াডিসের মতো উচ্চ ঘরের তরুণ তার বাড়িতে আসবে, সে ভাবতেও পারেনি। জেনথিপি মনে মনে খুশি। ছেলেটি বাড়ি করে দেবে। এই বাড়ি ভেঙে জলপাই গাছ লাগাবে। তাদের আর অভাব থাকবে না।

কিন্তু সক্রেটিস বলল, শোনো বউ, লোকে তোমাকে গরিবের বউ বলে। সেটি খারাপ। কিন্তু তুমি কি চাও লোকে তোমাকে ভিখারির বউ বলুক?

জেনথিপি কী উত্তর দেবে? সে জানে এই লোক প্যাঁচ দিয়ে কথা বলে সারা এথেন্সের মানুষকে নাচায়। তার মতো নারী তো তার কাছে নস্যি।

জেনথিপি কাঁদতে শুরু করল। একটি সুখের স্বপ্ন হাতের সামনে পড়ে আছে। তার স্বামী সেটি ধরছে না। কান্না ছাড়া আর কীই বা করতে পারে স্ত্রী?

সক্রেটিস আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বউয়ের কান্নাকে গুরুত্ব দিয়ে বসে থাকলে সে আর দার্শনিক হতে পারবে না। তার চিন্তা সারা এথেন্সের মানুষ নিয়ে। তাদের জীবন সুন্দর করতে হবে। একলা জেনথিপির জীবন সুন্দর করতে সব মানুষকে বঞ্চিত করলে সেটি খুবই স্বার্থপরের মতো কাজ হবে। সক্রেটিস আর যাই হোক, স্বার্থপর নয়।

সে হাল্কা পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

বাড়ি থেকে বের হলেও বিপদ। যুদ্ধ চলছে। স্পার্টার সেনারা এথেন্সের দেয়ালের বাইরে অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাই এথেন্সের কেউ দেয়ালের বাইরে যেতে পারে না। দেয়ালের ভেতর লোক আর লোক। এজন্য সক্রেটিসের ঘোরাঘুরি কমে গেছে। আড্ডার জায়গা কমে গেছে।

যুদ্ধ যেভাবে চলছে, তাতে মনে হয় এই যুদ্ধ অনেক বছর চলবে। ট্রয়ের যুদ্ধ চলেছিল দশ বছর। এথেন্সের সাথে স্পার্টার যুদ্ধ যে কত বছর চলবে কেউ জানে না। যুদ্ধ সারা বছর হয় না। যুদ্ধেরও গ্রীষ্মের ছুটি হয়। গরমের সময় যুদ্ধ বন্ধ থাকে। তখন সবাই অলিম্পিক খেলায় অংশ নেয়। অলিম্পিকের সময় গ্রিসের কোথাও কোনো যুদ্ধ হবে না। গরমকালে বীরত্ব দেখাতে চাইলে খেলার মাঠে গিয়ে পদক জিতে নাও। অলিম্পিক শেষ হলে শীতকালে যুদ্ধ শুরু, তখন মানুষ হত্যা করে বীরত্ব দেখাও। তাই যুদ্ধে মাঝে মাঝে বিরতি হয়। আবার শুরু হয়। নিয়ম-কানুন ভালো।

স্পার্টার সেনারা প্রতি বছর শরতের সময় বাড়ি ফিরে যায়। এই সময় তারা ফসল ফলায়। অলিম্পিক পদক জেতে। আমোদ-ফূর্তি করে। আনন্দ শেষ করে শীতের শুরুতে আবার এথেন্সকে আক্রমণ করে। স্পার্টা যখন আক্রমণ করে, তখন এথেন্সের সবাই বাড়ি-ঘর ফেলে শহরের মূল দেয়ালের ভেতর ঢুকে পড়ে। এই দেয়াল ভেঙে স্পার্টার সেনারা ঢুকতে পারে না। যুদ্ধের গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় সবাই যার যার বাড়িতে ফিরে যায়। এই সময় এথেন্সের লোকজন ফসল ফলায়, নাটক করে। শীতের শুরুতে স্পার্টার সেনা আসার আগেই ঘর-বাড়ি ফেলে আবার শহরের দেয়ালের ভেতরে ঢুকে পড়ে।

এটি পেরিক্লিসের যুদ্ধকৌশল। তিনি আশা করেন যে, কয়েক বছর এরকম করে স্পার্টানরা ক্লান্ত হয়ে যাবে। আর এথেন্সের দিকে আসবে না। এভাবেই একদিন যুদ্ধ শেষ হবে। অল্প রক্তপাতে যুদ্ধ শেষ করার জন্য তিনি এই কৌশল নিয়েছেন।

যুদ্ধে তরুণরা মারা যাচ্ছে। প্রতিদিনই লাশ আসছে। প্রতিটি পাড়ার কোনো না কোনো ছেলে মারা যাচ্ছে। এর মধ্যেই শহরের সব কাজ চলছে।

***

৯৩. উত্তর গ্রিসের পটিডিয়ায় (Potidaea) খ্রি. পূ. ৪৩২ অব্দে সক্রেটিস প্রথম যুদ্ধে গিয়েছিলেন।

৯৪. প্লেটোর Symposium ডায়লগে এলসিবিয়াডিস উল্লেখ করে যে সক্রেটিস পটিডিয়া যুদ্ধে তার জীবন রক্ষা করেছেন।

৯৫. সক্রেটিসের বিছানায় ঘুমানোর বিষয়টি প্লেটোর Symposium ডায়ালগে এলসিবিয়াডিস উল্লেখ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *