৩৪
‘There is nothing permanent except change.’
—Heraclitus
***
আজ পার্থেনন উদ্বোধন।
এথেন্সের সবচেয়ে গৌরবের দিন। পেরিক্লিসের স্বপ্ন পূরণের দিন। পনেরো বছর ধরে তারা এথেন্স নগরীকে সাজিয়েছেন। আজ সারা দুনিয়াকে দেখানোর সময় এসেছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সারা গ্রিসের সব গণ্যমান্য মানুষ এসেছেন। দেশ- বিদেশের হাজার হাজার মানুষে ভরে গেছে এথেন্স। কস দ্বীপ থেকে এসেছেন বড় চিকিৎসক হিপোক্রাটিস। থুরিল দ্বীপ থেকে এসেছেন হেরোডোটাস। গ্রিসের অনেক নগর থেকে রাজারা নিজে এসেছেন। অনেক নগরের রাজপুত্র এসেছেন, আর গণতান্ত্রিক নগরগুলোর নেতারাও এসেছেন। মনে হচ্ছে যেন চাঁদের হাট।
পেরিক্লিস, আসপাশিয়া আর ফিডিয়াস বিশিষ্ট অতিথিদের নিয়ে এক্রোপোলিসের উপর উঠলেন। পাহাড়ে উঠেই অতিথিদের চোখ নষ্ট হওয়ার জোগাড়। এখনও তারা শুধু পার্থেননের দুই পাশ দেখতে পাচ্ছেন। তাতেই বোঝা যাচ্ছে পৃথিবীতে এরকম ভবন আগে আর হয়নি। পার্থেননের বাইরের দেয়ালের ভাস্কর্য দেখে তারা চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এরকম জিনিস মানুষ বানাতে পারে!
অতিথিরা একবার পার্থেননের দেয়ালে তাকাচ্ছে, একবার শিল্পী ফিডিয়াসের দিকে তাকাচ্ছে। অতিথিদের মধ্যে যারা শিল্পী, তাদের ইচ্ছে করছে ফিডিয়াসের আঙুলগুলো ধরে চুমো খেতে। কীভাবে এই আঙুলগুলো দিয়ে তিনি পাথর খোদাই করে এরকম সুন্দর জিনিস করেছেন!
তারা পার্থেননের দেয়াল দেখেই মুগ্ধ। ভেতরে যে কী আছে, সেটি তাদের ধারণায়ই নেই।
দেবী এথিনার উদ্দেশ্যে পশু বলির পরে ধীরে ধীরে খুলতে লাগল পার্থেননের বিশাল দরজা। আর সেই সাথে ধীরে ধীরে উঁকি দিতে লাগল একটি অপার্থিব সোনালি আলো। সেই আলোয় ঝলমল করছে দেবী এথিনা। অতিথিরা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এর চেয়ে সুন্দর আর জমকালো জিনিস কেউ কোনোদিন দেখেনি। অতিথিদের মনে হচ্ছে— তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং দেবী এথিনা। চল্লিশ ফুট উঁচু সোনার এথিনা। তাঁর ত্বক হাতির দাঁতের আর পোশাক সোনার। প্রত্যেকের চোখে এক মহাসাগর বিস্ময়।
এই বিস্ময়ই চেয়েছিলেন পেরিক্লিস। তিনি অতিথিদের নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। অতিথিরা ভবনের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছেন। যেদিকে চোখ যায়, সবই অপূর্ব
অতিথিদের মধ্যে হিপোক্রাটিসও আছেন। বিস্ময়ে তার মুখও হা হয়ে গেছে। পেরিক্লিস যা করেছেন, তা অতুলনীয়। এথেন্স ঝলমল করছে। এক্রোপোলিস পাহাড়টি একেবারে মায়াপুরীর মতো লাগছে। পাহাড়টির উপরে এথিনার মন্দির পার্থেনন, তার উল্টোদিকে ইরেকথিওন, সামনে নাইকি বা বিজয়ের দেবীর মন্দির, এথিনার ব্রেঞ্জের মূর্তি, সোনার মূর্তি সব মিলিয়ে একেবারে অভূতপূর্ব ব্যাপার। এক্রোপোলিসের উপর থেকে দেখা যাচ্ছে— নিচে আগোরা, খুবই চমৎকার। সুন্দর সুন্দর ভবন, বিশাল রাস্তা। আর চারদিকে একেবারে মানুষের মতো সব মূর্তি। এথেন্সকে একেবারে দেবতাদের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে।
সক্রেটিস জেনথিপিকে নিয়ে পার্থেনন দেখতে এসেছে। তাদের সাথে বিশাল বহর। ক্রিতো ও চেরোফোন তাদের পরিবার নিয়ে এসেছে। সক্রেটিস একের পর এক ভবনের বর্ণনা দিচ্ছে। সে নিজে একজন পাথর শিল্পী, তাই ভবন বা মূর্তি সে ভালো বোঝে। সে আঙুল দিয়ে দিয়ে বোঝাচ্ছে।
জেনথিপি মনে মনে হাসছে। তার স্বামী এত কিছু জানে? একেই কি জ্ঞান বলে? সংসার জীবনে একটি জ্ঞানতত্ত্ব আছে। পুরুষেরা সারাদিন যার কাছে যা শোনে, রাতে এসে বউয়ের কানে কানে বলে— শোন বউ, ঘটনা হলো এটি। বউ ভাবে ঘটনাটা তার স্বামীই শুধু জানে; আর কেউ জানে না। তার স্বামী বিরাট জ্ঞানী। এই ভাবনা থেকে স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা জন্মে, সে স্বামীকে মান্য করে। আর বউকে কম জ্ঞানী প্রমাণ করে মনে মনে সুখ পায় স্বামী।
সক্রেটিস তার বিবাহিত জীবনে এসব কিছুই করেনি। তাকে বাইরের সবাই জ্ঞানী বলে, তাই বউয়ের কাছে জ্ঞান প্রমাণের কোনো দরকারই মনে করেনি। জেনথিপি কিছু জিজ্ঞেস করলেই শুধু উত্তর দিয়েছে, নিজে থেকে কিছুই বলেনি।
সক্রেটিস পার্থেননের সামনে দাঁড়িয়ে ধারাভাষ্য দিচ্ছে। এই মুহূর্তে সে ভ্রমণ গাইড। মূর্তি নিয়ে তার মতো আর কে বলতে পারে? জেনথিপি মুগ্ধ হয়ে শুনছে। স্বামীর গরবে গরবিনী হতে যে এত ভালো লাগে, তা সে এতদিন জানত না। সে ভাবছে এরকম কথা তো সক্রেটিস তার সাথে কোনোদিন বলেনি। এখন থেকে মাঝে মাঝে ঝগড়া বাদ রেখে অন্য আলাপের চেষ্টা করতে হবে।
ক্রিতো বলল, পৃথিবীতে এথেন্সই এখন সবচেয়ে সুন্দর শহর।
সক্রেটিস বলল, আমি এথেন্সের বাইরে কখনো যাইনি। আমি ঘরকুনো মানুষ না, এথেন্সকুনো মানুষ। পৃথিবীর অন্য কোনো শহরে এমন কিছু আছে কিনা সেটি জানে আমাদের বিখ্যাত পরিব্রাজক জনাব চেরোফোন।
চেরোফোন লজ্জা পেল না। পরিব্রাজক না হোক, সে যে জীবনে অনেক ঘুরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চেরোফোন বলল, আমি লিখে দিই, এই জগতে এত সুন্দর শহর আর কোথাও নেই। আমি মিশরে গিয়েছি, পারস্য, ব্যাবিলনে গিয়েছি; পিরামিড দেখেছি, উঁচু উঁচু দালান-কোঠা দেখেছি। এক্রোপোলিসের কাছে সেসব কিচ্ছু না, একেবারেই কিচ্ছু না।
পার্থননের উল্টো দিকে ইরেকথিয়ান ভবনটি দেখে মেয়েরা একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে। সুন্দর সুন্দর পাথরের মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মাথায় বোঝা। একটু লক্ষ করে দেখল এই মেয়েদের মাথায় সাধারণ কোনো বোঝা না, একেবারে পুরো দালানটি তাদের মাথায়। এগুলো মেয়ে নয়, এগুলো দালানের খুঁটি, বিশাল কলাম। কলামগুলোকে মেয়েদের শরীর আর মুখের আদলে বানিয়েছে। মনে হচ্ছে কয়েকটি মেয়ে পুরো ভবনকে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জেনথিপি বলল, এই ভবনের বুদ্ধি যে করেছে, সে খুবই বুদ্ধিমান মানুষ। সে জানে যে মেয়েরা সারাজীবন শুধু ভারই বহন করে।
সক্রেটিস বলল, এই কথাটা আমার সংসারের জন্য একশ ভাগ সত্য। আমার সংসারের পুরো বোঝা জেনথিপির মাথায়।
জেনথিপি দেবী এথিনার কাছে মানত করল, হে দেবী, সক্রেটিসকে একটু সুবুদ্ধি দাও, সংসারে একটু মন দাও। তোমাকে জোড়া-পাঁঠা বলি দেব।
সারা গ্রিসের মানুষ এথেন্সের সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলছে। সবাই এথেন্স দেখে একেবারে আহ্লাদিত। কিন্তু বড় চিকিৎসক হিপোক্রাটিস খুব খুশি হলেন না। এথেন্সের মানুষ এত বেশি খায়? এত বেশি খেলে মানুষ সুস্থ থাকে? আর চারপাশে নোংরা-আবর্জনা। এক্রোপোলিসকে কী চমৎকার করে সাজিয়েছে— একেবারে জিউসের সভার মতো। চোখ ঝলসে যায়। কিন্তু নগরের বাইরেটা অপরিষ্কার। এমন সুন্দর নগরের সামনে একটি বড় বিপর্যয় আসছে। এরা স্বাস্থ্য সচেতন নয়। অনেক বার মনে হয়েছিল পেরিক্লিসকে কথাটা বলবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বলা হয়নি। তারা আনন্দে মশগুল। সবাই এথেন্সের নামে বাক-বাকুম করছে। সবাই মধুর মধুর কথা বলছে। এ সময় নোংরা- আবর্জনা নিয়ে কথা বললে পেরিক্লিস খুশি হবেন না।
***
পার্থেনন উদ্বোধন হয়েছে। সারা গ্রিসে এথেন্সের নাম আরও ছড়িয়ে গেছে। অনেকেই খুশি হয়েছে। কিন্তু খুশি হয়নি স্পার্টা। এথেন্স শক্তিশালী হলে, তাদের জন্য ভয়ের। কিছুদিন ধরেই পেরিক্লিসের নানান কাজে ভয় পাচ্ছিল স্পার্টা। তারা ভাবছে এথেন্সকে দ্রুত আটকাতে না পারলে এমন শক্তিশালী হয়ে যাবে যে আর আটকানো যাবে না।
গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলো মোটামুটি দুটি দলে বিভক্ত। একদলের নাম ডিলিয়ান লীগ। এই দলের নেতা এথেন্স। ডিলস দ্বীপের নামে এই দলের নাম ডিলিয়ান লীগ। আর অন্য দল স্পার্টার নেতৃত্বে পেলোপনেশিয়ান জোট। এথেন্সের দক্ষিণ-পশ্চিমে গ্রিসের বিরাট এলাকাকে বলে পেলপোনেশিয়া। তাদের জোটের নাম পেলোপনেশিয়ান জোট। এই দুই জোটের মধ্যে একটি ঠাণ্ডা লড়াই সব সময়ই ছিল। শুধু যখন মহাশক্তিশালী পারস্য তাদের আক্রমণ করেছিল, তখন তারা বন্ধু হয়েছিল। একসাথে পারস্যের বিরুদ্ধে লড়েছে। পারস্য চলে যেতেই নিজেরা আবার শত্রু হয়ে গেছে। এখন এথেন্সের বাড়-বাড়ন্ত সহ্য হচ্ছে না স্পার্টার। তারা এথেন্সকে আটকাতে ছুঁতা খুঁজছে। যেকোনো উপায়ে যুদ্ধ শুরু করতে চাচ্ছে। তারা ছুঁতা খুঁজছে। তারা এথেন্সের ঠিক পাশের নগর মেগারাকে ঘুঁটি হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। এথেন্সকে উস্কে দিচ্ছে।
একদিন পেরিক্লিস বারান্দায় বসে সংসদের বক্তৃতা করছেন। এমন সময় খবর এলো মেগারার কিছু লোক এথেন্সে এসে দেবী দিমিত্রার পবিত্র ভূমিকে অপবিত্র করেছে। পেরিক্লিসের রাগ লাগলেও ধৈর্য ধরলেন। তার পরদিন আবার খবর এলো, আসপাশিয়ার শহরের দুটি মেয়ে এথেন্সে থাকত, তাদেরকে তুলে নিয়ে গেছে মেগারার কিছু যুবক। ছোট্ট নগর মেগারার পায়ে পা দিয়ে ঝামেলা করতে চাইছে? পেরিক্লিস দূত পাঠালেন মেগারাতে। দূত চিঠি নিয়ে গেল। মেগারার নেতারা যেন এথেন্সের দেবীর জমি অপবিত্র করার জন্য দোষীদের শাস্তি দেয়। আর যে দুটি মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে, তাদেরকে যেন অবিলম্বে ফিরিয়ে দেয়।
কিন্তু মেগারার নেতারা স্পার্টার বুদ্ধিতে তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। তারা পেরিক্লিসের কথা তো শুনলোই না, উল্টা এথেন্সের দূতকে হত্যা করল। এবার এথেন্সকে শক্ত ব্যবস্থা নিতেই হবে। এথেন্সের সবাই বলছে, এক্ষুনি মেগারা আক্রমণ করো, সেনা পাঠাও। কিন্তু পেরিক্লিস ভাবছেন, একটি নতুন কিছু করবেন। তিনি মেগারাকে শিক্ষা দিবেন একটু অন্যভাবে। তাদের হাতে মারবেন না, ভাতে মারবেন।
পেরিক্লিস সংসদে প্রস্তাব করলেন, আমরা অনেক নতুন নতুন জিনিস করেছি। তো আসুন, মেগারাকে শিক্ষা দিতেও আমরা নতুন একটা কিছু করি আমরা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেব। এথেন্সের জোটের সকল নগর মেগারার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেবে।[৯১] এথেন্সের মিত্র বন্দর ছাড়া মেগারাতে জাহাজ যেতে পারে না। আমরা মেগারার জন্য বন্দর বন্ধ করে দেব।
এটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা।
প্রথমে মেগারার নেতারা ভাবলো, এসব আবার কী জিনিস। এতে কী হবে? আমরা অতো সহজে মাথা নোয়াবো না। কিন্তু তারা যা ভেবেছিল, বিষয়টি তার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যার। বাণিজ্য বন্ধ মানে অন্য নগর থেকে খাদ্য আসা বন্ধ। কয়েক মাসেই এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, আর কোনো উপায় নেই। দুর্ভিক্ষ শুরু হলো। মানুষ মারা যেতে শুরু করল। মেগারাকে মেনে নিতে হলো এথেন্সের বশ্যতা।
মেগারা মানলেও, মানল না স্পার্টা। শীতের শুরুতেই তারা এথেন্সে সেনা পাঠিয়ে দিল। শুরু হবে যুদ্ধ। ভয়াবহ যুদ্ধ। পেরিক্লিস এই যুদ্ধের নাম দিলেন পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ[৯২]।
এথেন্সের সবাই হৈ হৈ করে উঠেছে। স্পার্টার ব্যাটাদের সাহস তো কম না! চলো ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু পেরিক্লিস বললেন, একটু রয়ে সয়ে আগাতে হবে। সাথে সাথে নেমে পড়া যাবে না। আসপাশিয়ার সাথে আলাপে বসেছেন তিনি। আসপাশিয়ার মনেও রাগ। মেগারা তাকে অনেক জ্বালিয়েছে। স্পার্টার শক্তিতেই জ্বালিয়েছে। এখন সময় আসছে, চলো স্পার্টাকে শিক্ষা দিই।
পেরিক্লিস বললেন, আসপাশিয়া, তুমি তো সামনে থেকে যুদ্ধ দেখোনি। যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। আর স্পার্টার সাথে যুদ্ধ! সে খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। স্পার্টানরা এক একজন ভীষণ যোদ্ধা। ওরা বাচ্চাদের বড় করে শুধুই যুদ্ধ করার জন্য। জন্মের সময় কোনো বাচ্চার শরীরে একটু মাত্র খুঁত থাকলেই তাকে সাথে সাথে মেরে ফেলে। একটি ছেলের সাত বছর হলেই মা-বাবার থেকে দূরে গুরুর কাছে পাঠিয়ে দেয়। শুরু হয় নির্মম জীবন। গুরু তাকে ভয়াবহ যুদ্ধ শেখায়। বানিয়ে তোলে ভয়ংকর খুনি। এমন করে বড় করে যেন মায়াদয়া বলতে কোনো জিনিসই না থাকে। আঠারো বছর হওয়ামাত্র ছেলেটিকে একজন শত্রুকে খুন করতে হবে। খুনি না হওয়া পর্যন্ত ঐ ছেলে স্পার্টার নাগরিকত্ব পাবে না।
আসপাশিয়া বলল, উফ, কী ভয়াবহ!
‘সেই ভয়াবহ খুনিদের সাথেই এখন যুদ্ধ করতে হবে আমার ছেলেদের।’
আসপাশিয়া বলল, ‘স্পার্টানরা তো লিওনিদাসের বংশধর।’
‘হুঁম, ওরা সবাই নিজেকে লিওনিদাস মনে করে। লিওনিদাস যেমন একা পারস্যের পথ আটকে ছিল, মৃত্যুর আগে পথ ছাড়েনি, সেরকম প্রতিজন স্পার্টান মরার আগে পথ ছাড়বে না। ‘
আসপাশিয়া ভয় পেয়ে বলল, তাহলে কী হবে?
‘আমদের কৌশল করতে হবে। আমরা শুধু নৌযুদ্ধ করব, কারণ পানিতে আমরা শক্তিশালী। আমরা মাটিতে যুদ্ধ করব না, স্থলে স্পার্টার সাথে পারা যাবে না। তাই ওরা আসার আগেই এথেন্সের সবাই নগর দেয়ালের ভেতরে ঢুকে পড়বে। ওরা এই দেয়াল ভেঙে আসতে পারবে না।’
‘এই লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে দেয়ালের মধ্যে চলে আসবে?’
‘এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সরকার থেকে খাবারের ব্যবস্থা করব।’
‘কত দিন দেয়ালের মধ্যে থাকবে?’
‘শীতের শেষে স্পার্টানরা চলে যেতে বাধ্য হবে। ওদের অস্ত্র আছে, কিন্তু টাকা নেই। বসন্তের শুরুতে ওদের জমি চাষ করতে যেতেই হবে।’
পেরিক্লিসের প্রস্তাব পাস হলো সংসদে। এর চেয়ে ভালো বুদ্ধি কেউ বলতে পারেনি। স্পার্টার সেনা আসার আগেই দলে দলে মানুষ ঢুকতে শুরু করল দেয়ালের ভেতরে। মানুষ কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘর বাড়ি ছেড়ে পোঁটলা-পুঁটলি মাথায় নিয়ে আসছে। তারা জানে না কোথায় থাকবে, স্ত্রী কন্যার কী হবে, দুধের শিশু কী খাবে। তবু পেরিক্লিস যখন বলেছেন, একটি ব্যবস্থা হবেই। জীবন বাঁচাতে আর তো কোনো উপায় নেই। রাস্তার দুপাশে লাইন ধরে ছোট্ট ছোট্ট ঘুপচি ঘর উঠতে লাগল। আড়াই লাখ লোক ঠাঁই নিল ছোট্ট দেয়ালের ভেতরে। সারা এথেন্স হয়ে গেল একটি বিশাল বস্তি।
এর ভেতরেই কয়েকটা ছোট্ট ঘুপচি বানিয়েছে ক্রিতো। তার একটিতে আছে সক্রেটিস আর জেনথিপি। বাড়ি ঘর নিয়ে সক্রেটিসের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু জেনথিপি কাঁদছে। তার কেবলই ছোট্ট সংসারের কথা মনে পড়ছে। জলপাইগুলো এখনও বিক্রি হয়নি, হাতে কোনো টাকা নেই। কীভাবে চলবে, বস্তিতে কী খাবে কিচ্ছু জানে না। তবুও ভালো যে তাদের এখনও কোনো সন্তান নেই। ক্রিতোর স্ত্রী দুটো দুধের শিশু নিয়ে খুব বিপদে আছে। তাদের টাকার অভাব নেই, কিন্তু এই ছোট্ট ঘুপচি শিশুরা সহ্য করতে পারছে না, থেকে থেকে কাঁদছে। নতুন বস্তিতে দুদিন যেতেই শুরু হয়েছে তীব্র গন্ধ, মল-মূত্র নিষ্কাশন নিয়ে খুবই ঝামেলা চলছে। কদিনে সেই ঝামেলা মিটলেও গরু, ছাগল, কুকুর নিয়ে বিপদে পড়েছে মানুষ। এদেরকে বাঁচিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে।
সক্রেটিসদের জন্য এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। গত পঞ্চাশ বছর এথেন্সে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি ছিল। পারস্য বাহিনী যাওয়ার পর আর এমন কিছু ঘটেনি। এখন নতুন করে অনেক কিছু করতে হচ্ছে। কোনো রকমে পরিবারের একটু ঠাঁই করেই যুবক পুরুষরা শুরু করেছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। সফোক্লিসের অস্ত্র কারখানায় চলছে অস্ত্র বানানো। যার ঘরে যা অস্ত্র আছে সব নিয়ে এসেছে। বর্শা, ঢাল সবকিছু চকচকে করে ফেলা হচ্ছে যাতে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে মানুষের দেহ।
স্পার্টার সেনারা এসে দেখে বাড়িঘর খালি। মানুষ সব দেয়ালের ভেতরে। মানুষ মারতে না পারার দুঃখে তারা ঘর-বাড়ি, শস্যক্ষেত সবকিছুতে আগুন দিয়ে দিল। মানুষ হাহাকার করে দেখতে থাকল লেলিহান আগুনে পুড়ে যাচ্ছে তাদের ঘর, ছাই হয়ে যাচ্ছে ফসলের মাঠ। লেলিহান শিখায় ঢেকে যাচ্ছে আকাশ, বাতাসে কালো ধোঁয়া। জেনথিপি চিৎকার করে কেঁদে উঠল, তার ছোট্ট সংসার পুড়ে যাচ্ছে। সক্রেটিসের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে ক্ৰিতো দেখছে, জ্বলে যাচ্ছে তার শত শত বিঘা জলপাই বাগান, ফসলের ক্ষেত। সন্ধ্যার আঁধারকে আলো করে ধিকিধিকি জ্বলছে ক্রিতোর সুন্দর ঘর। ক্ৰিতো নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে, শুধু তার দু’চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে।
সব ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে এথেন্সের দেয়ালের চারপাশে দাঁড়িয়ে রইলো স্পার্টার সেনা। কেউ বাইরে বের হতে পারবে না। কিন্তু পেরিক্লিসের বুদ্ধি কাজে দিয়েছে। এথেন্সের মানুষ মারা যাচ্ছে না। সাগরের যুদ্ধে এথেন্স সেরা, তাদের জাহাজ উন্নত। স্পার্টা সাগরে তাদের জাহাজ আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছে না। তাই খাওয়ার সাপ্লাইয়ে সমস্যা হবে না। অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে এই যুদ্ধে জলভাগ এথেন্সের, আর স্থলভাগ স্পার্টার দখলে। দিন যাচ্ছে। দেয়ালের মধ্যে আছে এথেন্সের মানুষ, অপেক্ষা করছে কবে স্পার্টার সেনারা চলে যাবে। সরাসরি যুদ্ধ হচ্ছে দূরে দ্বীপে। গ্রিসের নানা জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে। এথেন্সের মিত্র নগরগুলোর সাথে স্পার্টার মিত্র নগরগুলোরও যুদ্ধ হচ্ছে। গ্রিসের সব নগর দুই পক্ষে ভাগ হয়ে গেছে। এই যুদ্ধ থেকে কেউ দূরে থাকতে পারবে না।
সক্রেটিসও দূরে থাকতে পারবে না। সক্রেটিসের কাছে খবর এসেছে তৈরি থাকতে, তাদের যুদ্ধে যেতে হবে। সম্ভবত তাকে দূরের কোনো দ্বীপে যেতে হবে যুদ্ধ করতে।
***
৯১. পেরিক্লিস খ্রি. পূ. ৪৩২ অব্দে মেগারা নগরকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেন (Megarian Decree) যেটি ইতিহাসে প্রথম বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা।
৯২. খ্রি. পূ. ৪৩১-৪০৪ অব্দে স্পার্টার সাথে এথেন্সের যে দীর্ঘ যুদ্ধ হয়, সেটির নাম পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ (Peloponnesian War )