৩৩
‘ইতিহাস হলো আসলে দর্শন, শুধু পার্থক্য হচ্ছে-
ইতিহাসে দর্শনের কথা সরাসরি না বলে উদাহরণ দিয়ে বলা হয়।’
—থুকিডিডিস
***
হেরোডোটাস তার বই শেষ করে ফেলেছেন। পৃথিবীর প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ।
তিনি থুরিল নগরে বসে বই লেখা শেষ করেছেন। এথেন্সে এসেছেন বই প্রকাশ করতে। এথেন্স জ্ঞানী-গুণী মানুষের শহর। তাছাড়া এই শহরে তার সম্মান আছে। অনেক বছর আগে তিনি এথেন্সে এসেছিলেন এক দরিদ্র বেকার ছেলে হিসেবে, আর ফিরে গেছেন সম্মানিত হেরোডোটাস হয়ে। এখানের মানুষ তাকে কদর করে। এখানেই বই প্রকাশ করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। এখানে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। তার গল্প শুনতে থিয়েটার ভরে যেত। তাই এখানেই তার বই চলবে সবচেয়ে বেশি। বের হওয়ার আগেই কয়েক হাজার কপির ফরমায়েশ চলে এসেছে।
বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন পেরিক্লিস। সাথে ছিলেন সফোক্লিস। বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছে। বইয়ের নাম ‘হিস্টোরি’ বা ইতিহাস। মানুষের সত্যি ঘটনা নিয়ে এই বই। মানুষের ঘটনা নিয়ে এর আগে কোনো বই লেখা হয়নি।
বই প্রকাশ করে হেরোডোটাস চলে এসেছেন সফোক্লিসের বাসায়। সফোক্লিস তার পুরনো বন্ধু। এথেন্সে এলে হেরোডোটাস তার বাড়িতেই ওঠেন।
আজ বিকেলটা খুব সুন্দর। বসন্ত আসি আসি করছে। হিমেল হাওয়া বইছে। স্নিগ্ধ হাওয়ায় সফোক্লিস আর হেরোডোটাস জলপাই বাগানে গিয়ে বসলেন। দুজন মিলে নতুন বই ‘ইতিহাস’ পড়তে শুরু করলেন।
হেরোডোটাস বই শুরু করেছেন এভাবে—
‘হালকারনিসাস শহরে জন্ম হেরোডোটাস অনেকদিন ধরে যে তদন্ত আর অনুসন্ধান করেছেন, সেটির ফলাফল নিয়েই এই বই। বইটির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের ঘটনাবলিকে সময়ের আবর্তে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা এবং গ্রিক ও অগ্রিকদের উল্লেখযোগ্য অর্জনের স্মৃতি ধরে রাখা।’
হেরোডোটাস খুবই বুদ্ধির কাজ করেছেন। বইয়ের একেবারে শুরুতেই বইটি যে সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা, সেটি বলে দিয়েছেন। আবার এটি যে তার নিজের তদন্তের ফল, সেটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
মানুষ তার কথা বিশ্বাস করেছে। সবাই বলছে এমন কাজ আগে কেউ করেনি। আগে অনেকে কবিতা লিখেছে, মহাকাব্য, গান, নাটক এসব লিখেছে। কিন্তু মানুষের সত্য ঘটনা, মানুষের মহৎ অর্জন যাতে সময়ের অতলে হারিয়ে না যায়, সেজন্য কেউ বই লিখেনি। এই কাজ প্রথম করলেন হেরোডোটাস। গ্রিক ভাষায় তার বইয়ের নাম হিস্টোরিয়া মানে তদন্ত। তিনি তদন্ত করে মানুষের ইতিহাস বের করেছেন।
হেরোডোটাস গত কয়েক বছর থুরিল দ্বীপে বসে শুধু লিখেছেন, একেবারে নাওয়া-খাওয়া ভুলে লিখেছেন। শেষ করেছেন বিশাল বই। কয়েক বছর আগে এথেন্সে যে গল্প বলেছিলেন, সেটি পুরোটাই আছে তার বইতে। তবে এবার শুধু এথেন্সের কাহিনি লিখেননি। অনেক কিছু নতুন যুক্ত করেছেন। তিনি একটি নয়, আসলে নয়টি বই লিখেছেন। সবগুলো একত্র করে নাম দিয়েছেন ইতিহাস।
হেরোডোটাস দেবতাদের খুব বিশ্বাস করেন। তিনি মনে করেন দেবতারা অলিম্পাস পাহাড়ে বসে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি তদন্ত করতে গিয়ে যে যা বলেছে, সব কিছু বিশ্বাস করে নিয়েছেন। তাই মানুষ যেসব কথা মুখে মুখে বলে, সেগুলো তিনি সত্যি মনে করে তার ইতিহাস বইয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তাই তার ইতিহাস এলোমেলো ঘটনায় ভরা।
হেরোডোটাস অত্যন্ত সুচতুরভাবে একটি কাজ করেছেন। তিনি ইউরোপ আর এশিয়ার মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তার বইতে ইউরোপের মানুষ হলো ‘আমি’ আর এশিয়ার মানুষ হলো ‘তুমি’। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, আমি আর তুমি আলাদা, ইউরোপ আর এশিয়ার মানুষ পৃথক। ইউরোপ হচ্ছে পশ্চিমে আর এশিয়া পূর্ব দিকে। তার বইয়ের বিশাল অংশ জুড়ে পূর্ব আর পশ্চিমের পার্থক্যের কথা। তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন যে, ইউরোপিয়ানরা উন্নত আর এশিয়ানরা বর্বর। এই ধারণা গ্রিসে এমনিতেই ছিল। কিন্তু হেরোডোটাসের মতো বিশাল পণ্ডিত মানুষ যখন তার বইয়ের পাতায় পাতায় এশিয়া আর ইউরোপের পার্থক্যের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেন, তখন সেটি সবার মাথায় ঢুকে যায়। তার বই পড়ে ইউরোপের একটি ছোট্ট বাচ্চাও ভাবতে শুরু করবে যে, আমি ইউরোপের মানুষ, তাই এশিয়ার মানুষের থেকে সেরা। পাশ্চাত্যের সভ্যতা উন্নত আর প্রাচ্যের সভ্যতা জঘন্য— এই ধারণাটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল হেরোডোটাসের ‘ইতিহাস’ বইটির মাধ্যমে তার বই নয়টি। নয় খণ্ড বিরাট পেপিরাস কাগজে লেখা। কীভাবে ইউরোপ আর এশিয়ার মধ্যে শত্রুতা শুরু হলো সেটি নিয়ে হেরোডোটাস প্রথম বইটি শুরু করেছেন।
জলপাই বাগানের ছায়ায় বসে হেরোডোটাসের প্রথম বই পড়েছেন সফোক্লিস। তিনি মিটিমিটি হাসছেন।
সফোক্লিস বললেন, হেরোডোটাস, তুমি খুবই রসিক লোক। তোমার বই শুরু করেছ মেয়ে চুরি নিয়ে। তার মানে তুমি বলতে চাও— মানুষের প্রথম ইতিহাস হলো মেয়ে চুরির ইতিহাস?
হেরোডোটাস হাসলেন। প্রতিবাদ করার উপায় নেই। ঘটনা সত্য। বইতে তিনি লিখেছেন :
এশিয়া আর ইউরোপের শত্রুতা শুরু হয়েছে মেয়ে চুরি করা নিয়ে। অনেক অনেক বছর আগে এশিয়ায় একটি দেশ ছিল, নাম ফোনিসিয়া[৯০]। এই ফোনিসিয়ার লোকেরা ইউরোপের (গ্রিক) একটি মেয়েকে চুরি করে নিয়ে যায়, মেয়েটির নাম আইও। এর প্রতিশোধ নিতে গ্রিকরা ইউরোপা নামের একটি এশিয়ান মেয়েকে চুরি করে নিয়ে আসে। এই ইউরোপা থেকেই ইউরোপ নাম এসেছে। এভাবে একের পর এক মেয়ে চুরি চলতে থাকে। সেই ধারাবাহিক মেয়ে চোরদের একজন হলো এশিয়ার ট্রয় নগরের রাজপুত্র প্যারিস, যে গ্রিসের স্পার্টার মেয়ে হেলেনকে চুরি করে। তারপর ট্রয় যুদ্ধ হয়। আর সেই যে শুরু হয়েছে এশিয়া আর ইউরোপের ঝগড়া তা এখনও চলছে। সেজন্যই গ্রিস আর পারস্যের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে।
সফোক্লিস বললেন, এখানে একটু ঝামেলা আছে। তুমি যেভাবে লিখেছ, আমরা ইউরোপিয়রা কিন্তু এভাবে ভাবি না। আমাদের কাহিনিতে আছে দেবতা জিউস ইউরোপাকে চুরি করে গ্রিসের ক্রিত দ্বীপে নিয়ে আসে, আবার দেবতা জিউসই আইওকে গ্রিস থেকে মিশরে নিয়ে যায়। তুমি দেবতার কথা বাদ দিয়েছ। বলেছ ইউরোপা আর আইওকে চুরি করেছিল মানুষ। এই পার্থক্য কেন?
হেরোডোটাস বললেন, আমি এশিয়ার লোকদের সরাসরি জিজ্ঞেস করেছি। ওরা দেবতা জিউসের এই পাল্টাপাল্টি চুরি বিশ্বাস করে না। ওরা বলে চুরি মানুষই করেছে, দেবতা নয়।
সফোক্লিস বললেন, তার মানে তোমার এই বই এশিয়ার লোকদের মতামত, গ্রিকদের মতামত নয়।
হেরোডোটাস বললেন, সেটি নয়। আমি সবার মতামতই নিয়েছি। বইয়ের শেষের দিকে শুধুই এথেন্সের মানুষের কথা।
সফোক্লিস ভাবছেন, হেরোডোটাস খুবই চালাক। তিনি সবাইকে খুশি রাখতে বই লিখেছেন। এশিয়ার লোকেরা যেভাবে ইউরোপকে দেখেছে, হেরোডোটাস সেভাবে শুরু করেছেন।
সকোক্লিস পড়ছেন। এরপর হেরোডোটাস শুরু করেন লিডিয়া নামক দেশের কথা। লিডিয়া দেশটি আর এখন নেই। ট্রয় নগরী, মিলেটাস শহর এসব বিখ্যাত জায়গা লিডিয়ার মধ্যে ছিল। এই লিডিয়ার এক রাজা ক্রোয়েসাসের রাজসভায় গিয়েছিলেন এথেন্সের জ্ঞানী আইনপ্রণেতা সলোন। সলোন রাজাকে বলেছিলেন তার বিখ্যাত উক্তি : ‘মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কোনো মানুষকে সুখী বলা যায় না, সৌভাগ্যবান বলা যায় মাত্র।’ সলোনের এই ঘটনা এথেন্সে বিখ্যাত। হেরোডোটাসও মজা করে লিখেছেন—
সলোন গেলেন রাজসভায়। ততদিনে সলোন জ্ঞানী মানুষ হিসেবে বিখ্যাত। রাজা তাকে তার সব ধন-সম্পদ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহামতী সলোন, বলুন তো— পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ কে?’ রাজার মুখে অহংকারের হাসি। তার বিশ্বাস— এত সম্পদ দেখে সলোন তাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলবেন। কিন্তু সলোন বললেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী হলেন এথেন্সের টেলাস নামে এক লোক।’ রাজা অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন? তার কত সম্পদ আছে?’ সলোন বললেন, ‘তার খুব বেশি সম্পদ নেই। তিনি ধনীও নন, আবার গরিবও নন। তার সন্তানেরা সবাই ভালো ও সুচরিত্রের; তিনি নাতি-পুতিসহ সন্তানদের সুখী দেখে গেছেন এবং একজন শ্রদ্ধেয় মানুষ হিসেবে নিজের ইচ্ছায় দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছেন। এই লোকটিই সবচেয়ে সুখী।’ রাজা অনিচ্ছায় মেনে নিয়ে বললেন, ‘তাহলে পৃথিবীর দ্বিতীয় সুখী মানুষ কে?’ রাজা ভাবলেন, এবার অবশ্যই রাজার নাম বলবেন। কিন্তু না, সলোন বললেন, ‘সেটি হলেন আগলুস নামক এক মানুষ; তিনি নিজের খামারে কাজ করে এত সুখী ছিলেন যে, কোনোদিন সেই জায়গা ছেড়ে যাওয়ার দরকার মনে করেননি; তিনি পুরো পরিবারের সামনে মারা গেছেন এবং মরার সময় সবাই তার প্রশংসা করেছে।’ রাজা মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তাহলে পৃথিবীর তৃতীয় সুখী মানুষ কে?’ এবারও সলোন রাজার নাম বললেন না, অন্য একজনের নাম বললেন। রাজা ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘ওহে জ্ঞানী সলোন, আমার সাথে কি তোমার কোনো শত্রুতা আছে? এত সুখী লোকের নাম বলছো, তার মধ্যে আমি নেই?’ সলোন বললেন, ‘রাজা, তোমার আজকে যে সম্পদ আছে তাতে তুমি অবশ্যই সৌভাগ্যবান; কিন্তু দুদিন পরে কী হবে তা তুমি জানো না। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কোনো মানুষকে সুখী বলা যায় না।’ রাজা ভাবল, এই সলোন ব্যাটা একটি মিথ্যাবাদী অথবা মহামূর্খ। আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। কিন্তু কিছুদিন পরেই রাজা পারস্য আক্রমণ করে হেরে গেল, রাজ্য শেষ হয়ে গেল, সব ধন-সম্পদ নাই হয়ে গেল। তখন তার সলোনের কথা মনে পড়ল। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘ওহে সলোন, তুমি সত্যিই বিচক্ষণ মানুষ।’ এই রাজাকে পরাজিত করেই সাইরাস দ্যা গ্রেট বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
হেরোডোটাসের এই ঘটনা সফোক্লিস খুব পছন্দ করলেন। এথেন্সের মানুষও খুব পছন্দ করবে। এখানে এথেন্সের জ্ঞানী মানুষ সলোনের বিচক্ষণতা বলা হয়েছে। এথেন্সের মানুষের পছন্দ না করার কোনো কারণ নেই।
হেরোডোটাসের বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড মিশর ভ্রমণ নিয়ে। মিশরের ভূগোল, নীল নদ, ধর্ম, পশু-পাখি নিয়ে মজার মজার অনেক কথা লিখেছেন।
দ্বিতীয় বইটি পড়তে পড়তে সফোক্লিস বললেন, এখানে তুমি স্পার্টার হেলেনের কথা লিখেছ। তুমি লিখলে, হেলেন প্যারিসের সাথে ট্রয় শহরে যায়নি, সে পুরো সময়টা মিশরে ছিল। এটি কী করে হলো? হোমারের ইলিয়াড অনুযায়ী হেলেন ট্রয় নগরেই ছিল। হেলেন নিজের চক্ষে ট্রয়ের যুদ্ধ দেখেছে।
হেরোডোটাস বললেন, আমি যেটি লিখেছি, সেই কাহিনিই মিশরের লোকেরা বলে। তারা বলে হেলেন মিশরে ছিল। পারস্যের লোকজনও একথাই বিশ্বাস করে। গ্রিকরা যেভাবে ভাবে, হোমার সেভাবে লিখেছেন। আর আমি মিশর ঘুরে এসে মিশরের লোকেরা যা মনে করে সেভাবে লিখেছি। এখন আপনি কোনটা পছন্দ করবেন, সেটি আপনার বিবেচনা।
সফোক্লিস ভাবছেন, হেরোডোটাস কি তার বই মিশরে বিক্রি করতে চান? তা না হলে হেলেনের মতো একটি পরিচিত কাহিনিকে পাল্টে তিনি মিশরের মানুষের কথা বিশ্বাস করে লিখলেন যে, হেলেন কোনোদিন ট্রয়েই যায়নি। পুরো সময় সে মিশরে ছিল। সফোক্লিস মনে মনে হাসছেন। হেরোডোটাস তো নাট্যকার নন। নাট্যকার হলে দর্শকের মনের কথা বুঝতো।
হেরোডোটাস তার তৃতীয় বইতে লিখেছেন— পারস্যে কীভাবে বিশাল সাম্রাজ্য হলো, পারস্য কীভাবে মিশর দখল করল সেসব কথা। চতুর্থ বইতে লিখেছেন গ্রিসের আশেপাশের কিছু শহরের জীবনযাপন নিয়ে।
সফোক্লিস বললেন, এই যে তোমার চার নম্বর বইয়ে আমাজন নামে নারী যোদ্ধাদের কথা লিখেছ, এটি খুবই মজার। এটি ভালো লেগেছে।
হেরোডোটাস বললেন, পঞ্চম বই থেকে এথেন্সের কাহিনি এসেছে। এটি আপনার আরও ভালো লাগবে।
সফোক্লিস বললেন, কী আছে তোমার পঞ্চম বইতে?
‘পঞ্চম বইতে গ্রিসে বর্ণমালা আসার কথা লিখেছি। ফিনিশীয়দের কাছ থেকে লেখা শিখেছে গ্রিকরা। এথেন্স আর স্পার্টার ঝগড়ার কথা আছে। ক্লিসথেনিস কীভাবে এথেন্সে গণতন্ত্র আবিষ্কার করেন, সেই ঘটনা লিখেছি।
সফোক্লিস বললেন, গণতন্ত্রের জন্মের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ঐ অংশটা পড়, আমি শুনব। তোমার মুখে গল্পে গল্পে গণতন্ত্রের কাহিনি শুনি।
হেরোডোটাস গণতন্ত্র জন্মের অংশটা পড়লেন। ততক্ষণে সূর্য সাগরের মধ্যে ডুবি ডুবি করছে। আলো নিভু নিভু।
হেরোডোটাস বললেন, ষষ্ঠ বইতে ম্যারাথনের যুদ্ধ নিয়ে লিখেছি। আমি এথেন্সে যেভাবে গল্প বলেছিলাম, সেভাবেই লিখেছি।
সফোক্লিস বললেন, এবার আমাদের নিজের জীবনের কাহিনি চলে এসেছে। এবার মজা লাগবে। কিন্তু সময় নেই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পরের বইগুলোতে কী লিখেছ?
হেরোডোটাস বললেন, সবই আপনাদের জীবনের কথা। সপ্তম বইতে রয়েছে পারস্যের দ্বিতীয়বার এথেন্স আক্রমণ। থার্মোপিলাইয় স্পার্টার রাজা লিওনিদাস মাত্র তিনশো সেনা নিয়ে পারস্যকে আটকে রেখেছিল, সেই কথা। অষ্টম বইতে সালামিনা দ্বীপের যুদ্ধে পারস্য কীভাবে ফাঁদে পড়ে আর এথেন্সের কাছে হেরে যায়, সেই কথা। নবম বইতে গ্রিসের কাছে পারস্যের চূড়ান্ত পরাজয়।
সফোক্লিস বললেন, এগুলো তোমার কাছে অনেকবার শুনেছি। এগুলো পরে পড়ব।
হেরোডোটাসের বই এথেন্সে আলোড়ন তুলল। তবে তিনি যে ভেবেছিলেন, সবাই পছন্দ করবে, সেটি হয়নি। লোকে বলাবলি করতে লাগল, পুরো বইতে লেখক এশিয়ার দেশগুলোর কথা বেশি লিখেছেন। এথেন্স গুরুত্ব কম পেয়েছে।
এসব কথার উত্তর করেন না হেরোডোটাস। তিনি জানেন, তিনি এথেন্সকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বইতে এশিয়ার মানুষের কথা থাকতেই পারবে না, গ্রিকদের এই ভাবনাটা একেবারেই ঠিক নয়। পাঠকরা বড় স্বার্থপর। শুধু নিজের কথা শুনতে চায়।
কেউ পছন্দ করুক, আর নাই করুক এথেন্সের প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ অবশ্যই হেরোডোটাসের বই ‘ইতিহাস’ পড়েছে। ইতিহাস শব্দটি এখন সবার মুখে মুখে। এই বই থেকেই একটি নতুন বিষয় সৃষ্টি হলো। তার নাম— ইতিহাস। আর হেরোডোটাস হয়ে গেলেন ইতিহাস শাস্ত্রের জনক।
আর এই বই থেকেই শিখে গেল যে, ইউরোপ মানেই উন্নত আর এশিয়া মানেই বর্বর। জ্ঞানের জগতে শুরু হলো পূর্ব-পশ্চিম বিভেদ। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সংঘাত।
***
৯০. ফোনিসিয়া একটি প্রাচীন দেশ। বর্তমানের তুরস্ক, লেবানন, ইসরায়েল অংশ।