৩২
‘একটি মাত্র শব্দ আমাদের সকল ব্যথা মুক্ত করতে পারে, সেটি হলো ভালোবাসা।’
— সফোক্লিস
***
সক্রেটিস এখন চাচা।
তার সমবয়সী সব বন্ধুর ছেলেদের চাচা। তার বন্ধুরা বিয়ে-শাদি করে ফেলেছে অনেক আগেই। ক্রিতো, চেরোফোন, ইউরিপিডিস সবাই বিবাহিত। সবার ঘরে একের বেশি সন্তান। তাদের যে কারও বাড়িতে সক্রেটিস গেলেই, চাচা চাচা করে শিশুরা এগিয়ে আসে। ক্রিতো বলে, আর কিছু দিনের মধ্যেই সক্রেটিস হয়ে যাবে এথেন্সের সবার চাচা— গণচাচা।
গণচাচা হতে তার নিজের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা মা-বাবার। তার বাবা এখন খুব ভালো আছেন। এথেন্সের সব রাজমিস্ত্রি এখন ভালো আছে। তাদের হাতে অনেক কাজ। পেরিক্লিস শত শত ভবন বানাচ্ছেন। হাজার হাজার মূর্তি হচ্ছে ফিডিয়াসের কারখানায়। প্রতিদিন ঠিকাদাররা নতুন নতুন কাজ পাচ্ছে। সক্রেটিসের বাবাও বেশ কয়েকটি নতুন কাজ পেয়েছেন। তিনি পয়সার মুখ দেখেছেন। আর অভাব নেই। আর কদিন ভালো করে কাজ করলেই তিনি ধনী হয়ে যাবেন।
কিন্তু তার কপালে ধনী হওয়া নেই। বেশিদিন সুখ সইল না। বুড়ো বয়সে একসাথে অনেক কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ তিনি মারা গেলেন। সক্রেটিস পিতৃহীন হলো।
বাবা মারা যাওয়ার পর বিধবা মা প্রতিদিন কান্নাকাটি করেন। তিনি সক্রেটিসকে শুধু দুটি কাজ করতে বলেন। বাবার শুরু করা মূর্তিগুলো শেষ করতে হবে আর তাড়াতাড়ি একটি বিয়ে করতে হবে। সক্রেটিস ভাবল দুটির মধ্যে দ্বিতীয়টি সহজ। সে বিয়ে করতে রাজি হলো।
সক্রেটিসের জন্য পাত্রী পাওয়া সহজ নয়। তার পরিচিতি সে এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ। কিন্তু বাজারে জ্ঞানের কোনো দাম নেই, বিয়ের বাজারে তো কোনো দামই নেই। তবু মা হাল ছাড়ছেন না। মা যেখানে যান, সেখানেই পাত্রী খোঁজেন।
একদিন তিনি এক বাড়িতে গেছেন সন্তান প্রসব করাতে। সেই বাড়িতে একটি মেয়ে খুব চেঁচামেচি করছে। বড় ভাইদের ইচ্ছামতো বকাবকি করছে। ভাইয়েরা বেড়ালের মতো সুড়সুড় করে তার কথা শুনছে। তবে মেয়েটি খুব কাজের। একলা হাতে সবকিছু করছে। বাবাকে হুকুম দিচ্ছে। মাকে কাজ করে দিচ্ছে। দাসকে টাকা দিয়ে বাজারে পাঠাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা একটিই, মেয়েটির মুখ সারাদিন চলছে। সারাক্ষণ কাউকে না কাউকে বকা দিচ্ছে। আবার বাড়ির সবাই যখন আনন্দ করছে, মেয়েটি এক কোনায় গিয়ে চুপিচুপি কাঁদছে। কান্না শেষ করেই আবার কাজ শুরু করেছে। সাথে সাথেই শুরু করেছে বকাবকি একেবারে নারিকেল স্বভাব। ভেতরে টলটলে পানি, আর বাইরে ভীষণ শক্ত।
সক্রেটিসের মা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী, মা?
মেয়েটি বলল, জেনথিপি।
মা বললেন, সুন্দর নাম। জেনথিপি শব্দের মানে জানো?
‘হুঁম, জেনথিপি মানে হলুদ রঙের ঘোড়া।’
মা বললেন, বেশ, জীবনে গাধা হয়ে থাকার চেয়ে, ঘোড়া হয়ে বাঁচাই ভালো। ভালো থেকো মা, সুখে থাকো।
মেয়েটি কিছুই বুঝতে পারছে না, ঘোড়া আর গাধা কোত্থেকে এলো! সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
মা ভাবছেন— সক্রেটিসের জন্য এরকম একটি ঘোড়াই দরকার। শক্ত মেয়ে না হলে সক্রেটিসকে নিয়ে সংসার করতে পারবে না। যে মেয়ে শুধু কাঁদে, সক্রেটিস তাকে নিয়ে সাগরে পড়বে। যে মেয়ে সক্রেটিসকে ধমক দিতে পারবে, সেই মেয়েই পারবে তার সাথে সংসার করতে। মেয়েটিকে মায়ের পছন্দ হয়েছে। শুধু একটিই সমস্যা, মেয়েটির বয়স সক্রেটিসের চেয়ে অনেক কম। মেয়েটি তের বছরের, আর সক্রেটিস সাঁইত্রিশ পার হতে চলল। মেয়েটির বাবার নাম লেমপ্রক্লিস। ভালো মানুষ। এককালে টাকা-পয়সা ছিল, এখন অবস্থা পড়তির দিকে। সেটিই ভালো, বেশি পয়সাওয়ালা কেউ সক্রেটিসের কাছে মেয়ে দেবে না।
এখন একজন ঘটক দরকার। ঘটক হিসেবে এগিয়ে এলো সক্রেটিসের সব কাজের কাজি ক্ৰিতো।
এক সুন্দর বিকেলে ক্রিতো সক্রেটিসকে নিয়ে থিয়েটারের দিকে বের হলো। ক্রিতোর হাতে একটি আপেল। সক্রেটিস আপেলের মর্ম বুঝতে পারছে না। তারা জলপাই বাগানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বাগানের প্রান্তে গল্প করছে কয়েকটি মেয়ে। তাদের একজন ক্রিতোর স্ত্রী। অন্যদের সক্রেটিস চেনে না।
ক্রিতো বলল, ঐ মেয়েদের মধ্যে মাঝের মেয়েটির নাম জেনথিপি। ঐ মেয়েটিকে তুমি এই আপেলটা ছুড়ে মারবে।
এবার সক্রেটিস আপেল নেওয়ার মর্ম বুঝতে পারল।
আপেল হলো ভালোবাসার প্রতীক। একটি আপেলকে মাঝখানে কাটলে হৃদয়ের মতো দুই খণ্ড হয়। তাই আপেল হলো এমন জিনিস যেখানে দুটি হৃদয় এক হয়ে আছে। প্রেমের জন্য এর চেয়ে ভালো প্রতীক আর হয় না।
সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির প্রতীকও আপেল। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অন্য দেবীদের হারিয়ে মিস ইউনিভার্স হয়ে তিনি আপেল পেয়েছিলেন ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের কাছ থেকে।
সক্রেটিস আপেল হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছে জেনথিপির দিকে। জেনথিপি শব্দটার মানে হলুদ ঘোড়া। মেয়েটি ঘোড়ার মতোই, ঘাড়টা অনেক লম্বা। তবে দেখতে মন্দ নয়। মেয়েটি তাকে দেখেনি এখনও। সক্রেটিস ভাবছে কী করবে। আপেলটা ছুড়বে, নাকি ছুড়বে না।
গ্রিকরা প্রেমের প্রস্তাব দেয় আপেল দিয়ে। কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে, তার দিকের ছুড়ে দেয় একটি আপেল। যদি মেয়েটি আপেলটি ধরে মিষ্টি একটি হাসি দেয়, তার মানে মেয়েটি রাজি। আর আপেলটি না ধরলে মেয়েটি রাজি নয়।
সক্রেটিস এখনও ভাবছে— আপেলটি ছুড়বে, নাকি ছুড়বে না।
ক্রিতো বলছে, অনেক ফন্দি করে তোমার ভাবী মেয়েটিকে জলপাই বাগানে এনেছে। দেরি কোরো না, যাও, সামনে গিয়ে আপেলটা ছুড়ে দাও।
জেনথিপি এদিকে ফিরল। সে সক্রেটিসকে চেনে। শুনেছে এই লোক খুব জ্ঞানী। তবে কোনো কাজ করে না। শূন্য পকেটে জ্ঞান নিয়ে ঘোরে। কিন্তু সক্রেটিসের হাতে আপেল কেন? আপেল মানে তো অন্য জিনিস।
জেনথিপি বড় বড় চোখে তাকাল। তার বুক একটু একটু করে কাঁপছে। জলপাই বাগানে আপেল হাতে তার দিকে তাকিয়ে আছে সক্রেটিস! ঘটনা তো সুবিধার নয়। এই লোক তো জ্ঞানী, প্রেমিক নয়। তো এর হাতে আপেল কেন! তার বুকের কাঁপন বেড়ে গেল। জ্ঞানী লোক ভালোবাসতে পারে নাকি? জ্ঞান আর প্রেম কি এক ঘরে থাকতে পারে?
জেনথিপি কী করবে? দৌড়ে পালিয়ে যাবে? কিন্তু পা তো নড়ছে না। তার সারা শরীর কাঁপছে। কেন যেন কাঁপতে তার ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে মাথার মধ্যে একটি সুর শুনতে পাচ্ছে। খুব মিষ্টি একটি সুর। তার মন বলছে এই সুর যেন সারা জীবন চলে। কোনোদিন যেন বন্ধ না হয়। এই মুহূর্তটি যেন কোনোদিন শেষ না হয়। সে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।
ভেবেছে, চোখ খুলে দেখবে সামনে সক্রেটিস। কিন্তু না, চোখ খুলে দেখে কেউ নেই। সক্রেটিস পালিয়েছে।
সেই জলপাই বাগানে আপেল ছুড়তে পারেনি সক্রেটিস। তবু বিয়ে হলো। জেনথিপিকেই বিয়ে করল সক্রেটিস। ক্রিতো সব ব্যবস্থা করল। বসন্তের শুরুতে সক্রেটিসের বিয়ে হলো। অনাড়ম্বর বিয়ে। এক পাখি ডাকা সন্ধ্যায় ইমিতোস পাহাড়ের উপর তাদের চার হাত এক হলো। চাঁদের আলো গায়ে মেখে সক্রেটিসের জীবনে এলো জেনথিপি। জেনথিপি মানে হলুদ ঘোড়া। এই ঘোড়ার বয়স মাত্র তেরো বছর।
ছোট্ট ঘোড়াটি ঘুমিয়ে গেছে। সারাদিন বিয়ের অনুষ্ঠান করে তার ঘুম পাচ্ছে। সেই ঘুমন্ত মুখের দিকের চেয়ে সক্রেটিস প্রতিজ্ঞা করল, এই মেয়েটির সাথে সে কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করবে না। মেয়েটি কিছু বললে, সে রাগ করবে না। ওর সব রাগ-অভিমান মুখ বুজে সহ্য করবে। কিন্তু জেনথিপি বিয়ের রাতে কোনো প্রতিজ্ঞা করল কিনা সেটি জানা নেই। সে প্রতিজ্ঞা করার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
.
বিবাহিত জীবন মানুষের এক নতুন অভিজ্ঞতা।
এই জীবনের জন্য আগে কোনো প্রশিক্ষণ থাকে না। তাই এই জীবনের শুরুতে প্রত্যেক নারী-পুরুষ সমস্যায় পড়ে। যারা এই সমস্যা যত তাড়াতাড়ি মেটাতে পারে, তারা তত তাড়াতাড়ি সুখী হয়। কিছু মানুষ আছে, যারা এই সমস্যা সারা জীবনেও মেটাতে পারে না।
সক্রেটিসও সেরকমই। তার দাম্পত্য সমস্যা সারা জীবনেও মিটবে কিনা সে জানে না। বিয়ে করেই তার সমস্যা শুরু হয়েছে। বউ যা চায়, সেগুলোর কোনোটাই করতে তার ইচ্ছা করে না। বউ চায়, সে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরুক, বাজার করুক, খুনসুটি করুক। এর কোনোটাই তার পছন্দের কাজ নয়।
সে সারা জীবন রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিয়েছে, সিমনের দোকানে বসে জ্ঞানের আলাপ করেছে, জিমনেশিয়ামে গিয়ে ছেলেদের সাথে আড্ডা দিয়েছে। যেখানেই কোনো তরুণ পেয়েছে, শিক্ষা দিতে শুরু করেছে। যখন যার সাথে ভালো লেগেছে, রাতদিন তার সাথে কাটিয়েছে। ভালো না লাগলে নতুন জায়গা খুঁজে নিয়েছে। বাড়ির দিকে নজর না দিলেও কোনো সমস্যা ছিল না।
কিন্তু বিয়ে করে বিপদে পড়েছে। এখন তার জন্য একটি মেয়ে অপেক্ষা করে। সারাদিন তার কথা মনে করে সন্ধ্যা হলে একটু পর পর দরজার দিকে তাকায়। মেয়েটিকে সুখে রাখতে হবে। তার মন রেখে চলতে হবে। সেই মেয়েটির কিছু জিনিস পছন্দ হবে, আবার কিছু জিনিস পছন্দ হবে না। কিন্তু পছন্দ না হলেও মানিয়ে নিতে হবে। পালানোর উপায় নেই।
সিমনের দোকান ভালো না লাগলে অন্য কোথাও যাওয়া যায়। কিন্তু ভালো না লাগলেও জেনথিপির ঘর থেকে দূরে চলে যাওয়া যাবে না। সক্রেটিসের হাঁসফাঁস লাগে। সে সারা জীবন মুক্ত প্রাণী, যা খুশি তাই করে। বউয়ের কথার চেয়ে জ্ঞানের কথা শুনতে তার ভালো লাগে। সে বুঝে গেল— আদর্শ স্বামী সে হতে পারবে না। সেই যোগ্যতা তার নেই। সে ভালো স্বামী হতে চেষ্টাও করল না। তার জীবন খুব বেশি পাল্টাল না। সে আগের মতোই সারা এথেন্স ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুদের জন্য তার সময় কমেনি। তার কাছে বউয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো জ্ঞান।
তবে বিয়ের রাতে যে শপথ সে নিয়েছে, জেনথিপির সাথে কোনোদিন রাগ করবে না, সেটি সে মানে। সে জেনথিপির কথা মুখ বুজে শোনে। কথা ভালো লাগলে জবাব দেয়। ভালো না লাগলে চুপ থাকে। কোনোদিন জেনথিপির সাথে রাগ করে না। তার আশা জেনথিপি একদিন তাকে বুঝে যাবে।
জেনথিপি পড়েছে মহাবিপদে। স্বামীর যে ছবি সে ছোটবেলা থেকে কল্পনা করেছে, সক্রেটিস কোনোভাবেই সেরকম নয়। বিয়ের আগে আপেল হাতে সক্রেটিসকে দেখে যে মধুর সুর জেনথিপির মনে এসেছিল, সেই সুর সব সময় শুনতে চায় জেনথিপি। কিন্তু স্বামী সেই সুর শোনার মতো কোনো কাজই করে না। স্বামীকে পথে আনতে হবে। যে করেই হোক দুই জীবনকে এক করে সুখী দাম্পত্য চাই। সেই উদ্দেশ্যে জেনথিপি স্বামীর জন্য যে অস্ত্র ঠিক করেছে, সেই অস্ত্রের নাম— ঝাড়ি অস্ত্র। সে সারাদিন ঝাড়ি দেয়, উঠতেও ঝাড়ি দেয়, বসতেও ঝাড়ি দেয়। তার বিশ্বাস তার কথা মতো কাজ করলেই সক্রেটিস আদর্শ স্বামী হয়ে যাবে। ফলাফল হয়েছে সক্রেটিসও আদর্শ স্বামী হয়নি, জেনথিপিও হতে পারেনি আদর্শ স্ত্রী। সক্রেটিস হয়ে গেছে সংসারবিমুখ, আর জেনথিপির পরিচয় সে এক মুখরা নারী। জেনথিপি শব্দের মানে হলুদ ঘোড়া। ঘোড়ার মতোই তার মুখে এখন কোনো লাগাম নেই।
তারা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসে। কিন্তু কেউ কাউকে বোঝার চেষ্টাই করে না। তাই তাদের সংসারে সকাল বিকাল চিৎকার। চিৎকার জেনথিপি একাই করে। সক্রেটিস শুধু শোনে, টু-শব্দটিও করে না।
.
ভর দুপুরে জেনথিপি চিৎকার করছে। সক্রেটিস বারান্দায় বসে আছে।
জেনথিপি বলছে, আমার হলো রানির কপাল! কী সুন্দর কপাল নিয়ে যে পৃথিবীতে আসছি! মানুষের স্বামী হয় নেতা, কারও স্বামী কবিরাজ, কারও স্বামী ব্যবসায়ী। আর আমার স্বামী হলো বিরাট জ্ঞানী। তার জ্ঞানে চারদিক কাঁপে। ডেলফি শহরের ওরাকল তারে সনদপত্র দিয়েছে। সে নাকি পৃথিবীর সবার চেয়ে বড় জ্ঞানী। এই জ্ঞান দিয়ে আমার কী হবে? আমি কি জ্ঞান ধুয়ে ধুয়ে পানি খাব?
একটু থেমে জেনথিপি আবার শুরু করলেন— তিনি হলেন জ্ঞানের সাগর। না, ভুল বললাম। তিনি জ্ঞানের মহাসাগর। আর আমি হলাম পুকুর। না, এটিও ভুল বললাম। আমি হলাম কুয়া, পাতকুয়া। পাতকুয়া আর মহাসাগরের কি কোনোদিন মিলমিশ হয়?
সক্রেটিস ভাবছে, নারীরা তো স্নেহময়ী। কিন্তু আমার নারীভাগ্য এমন কেন? আমার মায়ের মতো এমন স্নেহময়ী মানুষ সারা দুনিয়ায় নেই। সেই স্নেহময়ীও সারাদিন আমার সাথে ঘ্যান ঘ্যান করে। জেনথিপিও মানুষ ভালো। তবু সেও সারাদিন আমাকে গালাগালি করে। সমস্যাটা কী?
সে ভাবছে জেনথিপিকে প্রশ্নটা করবে। কিন্তু সাহস হলো না। নীরবে শুনতে লাগল জেনথিপির গালাগালি।
জেনথিপি বলল, আপনি মেয়েদের বোঝেন?
সক্রেটিস বলল, না।
‘আপনি তো মানুষ নিয়া চিন্তা করেন। তো ঘরের মানুষের কথা, ঘরের মেয়েদের কথা কোনোদিন ভাবছেন?’
সক্রেটিস কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কথা সত্য। নারীদের সে বোঝে না। বোঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে হবে। কিন্তু এথেন্সে এই কথা আলাপ করার মতো লোক নেই। এখানে নারীদের অবস্থা দাসদের চেয়ে উনিশ আর বিশ। মেয়েদের মন নিয়ে কথা বললে সবাই হাসাহাসি করবে। যারা সক্রেটিসকে গুরু মানে, তারাও হাসাহাসি করবে। ইউরিপিডিস মেয়েদের মনের কথা নিয়ে নাটক লিখে বিপদে পড়েছে। সবাই তাকে বলে নারীবিদ্বেষী।
নারীর মন নিয়ে আলাপ করার জন্য এথেন্সে একজনই আছে। সে হলো আসপাশিয়া। কিন্তু আসপাশিয়ার কোলে ছেলে। ছেলে কোলে নিয়ে দর্শনের আলাপ করা খুবই কষ্টের। তাই আসপাশিয়া কিছুদিন ধরে লোকজনের সাথে দেখা করে না।
.
সক্রেটিসের বাড়িতে চেঁচামেচি এখন প্রতিদিনের ঘটনা।
এই চেঁচামেচিতে সক্রেটিসের মায়ের সমর্থন আছে। তিনি জানেন সক্রেটিসকে পথে রাখতে বউকে শক্ত হতে হবে। মা বউকে শক্ত হওয়া শেখাচ্ছেন। তিনি ছেলের বউকে অনেক কাজ শেখাচ্ছেন। সংসারের খরচ চালানোর কৌশল শেখাচ্ছেন। তিনি জানেন, সক্রেটিস যেমন এখন কাজ করে না, ভবিষ্যতেও করবে না। তাই তার বউকেই সব সামলাতে হবে। মা জেনথিপিকে জমিজমার হিসাব, টাকা-পয়সার হিসাব থেকে শুরু করে সবকিছু শেখাচ্ছেন।
কিন্তু মা বেশিদিন শেখাতে পারলেন না। সক্রেটিসের বিয়ের অল্পদিন পরেই মা মারা গেলেন।
এখন সংসারে শুধু দুইজন। ছেলেমেয়ে নেই। একা বাড়িতে জেনথিপির মন হু হু করে। সময় কাটাতে সে সারাদিন কাজ করে। নিজের হাতে কাপড় বোনে। কিন্তু সক্রেটিসের জন্য কাপড় বুনে কী হবে? শীত হোক, গ্ৰীষ্ম হোক— সে সারা বছর একটিমাত্র কাপড় পরে। পোশাকের প্রতি তার ধারণা হলো— কাপড়ের দরকার শুধুই লজ্জা নিবারণের জন্য, এছাড়া পোশাকের কোনো দরকার নেই। একটির বেশি পোশাক সে পরে না। তার জন্য পোশাক বুনে লাভ নেই।
জেনথিপি সারাদিন ধরে সক্রেটিসের জন্য রান্না করে। এক ঘর খাবার নিয়ে সারাদিন বসে থাকে, সক্রেটিসের দেখা নেই। বসে থাকতে থাকতে যখন তার মাথা ভীষণ গরম হয়ে যায়, তখন সক্রেটিস বাড়ি ফেরে। তখন আর সক্রেটিসের কপালে খাবার নয়, জোটে রাশি রাশি গালি। তখন সারা বাড়ি জুড়ে শুধু বকা আর গালি। গালি খেতে খেতে তারা বিছানায় যায়। ভোর রাতে জেনথিপির মনে হয় রাতে খেতে না দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে। তখন সেই ভোর রাতেই সক্রেটিসকে ঘুম থেকে তোলে। চোখ ডলতে ডলতে সক্রেটিস উঠে বসে। দুজনে মিলে ঠাণ্ডা খাবার খায়। আবার ঘুমিয়ে যায়। সকালে ঘুম ভেঙে জেনথিপি দেখে, সক্রেটিস তার আগেই উঠে বের হয়ে গেছে। সারাদিনে আর দেখা নেই। আবার গভীর রাতে বাড়ি ফেরে। এই হলো— সক্রেটিসের সংসার জীবন।
এই জীবনে সক্রেটিস সুখী। সে মোটামুটি একটি রুটিন করে নিয়েছে। হাসিমুখে সব মেনে নিয়েছে। সংসার নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই, কোনো কষ্ট নেই। কিন্তু জেনথিপি মানতে পারেনি। তাই সে কষ্ট পায় আর গালাগালি করে। তার গালির ভাণ্ডার অফুরন্ত। সক্রেটিস মনে করে গালির ব্যাপারে জেনথিপির মতো বিশেষজ্ঞ এথেন্সে আর কেউ নেই।
এথেন্সের সবাই একথা জানে। জেনথিপিকে নিয়ে বন্ধুরা সক্রেটিসকে ক্ষেপায়। কিন্তু সক্রেটিস জানে জেনথিপির ভালোবাসা তীব্র, তাই রাগও বেশি, সেজন্যই বকাঝকা মাত্রাহীন। সে বন্ধুদের হাসি-ঠাট্টায় বুঝিয়ে দেয় যে, জেনথিপিকে সে ভীষণ ভালোবাসে, অশেষ শ্রদ্ধা করে।
একদিন চেরোফোন বলল, জেনথিপি তো সারাদিন গালমন্দ করে, তুমি তাকে নিয়ে সংসার করো কীভাবে?
সক্রেটিস হালকা হাসি দিয়ে বলল, শোন, জেনথিপি মানে হলুদ ঘোড়া। ঘোড়া যদি আনতেই হয় তো এমন ঘোড়া আনলাম যে ঘোড়া সামলানো সবচেয়ে কঠিন। এখন নিশ্চিত করে বলতে পারি যে আমি যখন জেনথিপি নামের ঘোড়াটিকে সামলাতে পারছি, আমি দুনিয়ার যেকোনো ঘোড়াকেই সামলাতে পারব।
চেরোফন বলল, তা তো বুঝলাম। কিন্তু তোমার সংসার দেখলে তো তরুণ ছেলেরা বিয়ে করতে ভয় পাবে।
সক্রেটিস হেসে বলল, আমি তরুণদের বলব :
‘এক্ষুনি বিয়ে করে ফেলো, যদি বউ ভালো হয় তাহলে তুমি পাবে একটি সুখের জীবন, আর বউ খারাপ হলে তুমি হয়ে যাবে দার্শনিক।’