২৯
‘এথেন্স কাউকে অনুকরণ করে না,
এথেন্সই সবার জন্য উদাহরণ।’
— পেরিক্লিস
***
ফিডিয়াস আর পেরিক্লিস আবার এসেছেন এক্রোপোলিস পাহাড়ের উপরে। কাল রাতে যে মাপজোক করেছিলেন, সেটি দিনের আলোতে মিলিয়ে নিচ্ছেন ফিডিয়াস। ডিজাইন করার জন্য আলোর হিসাব খুব জরুরি।
পেরিক্লিস বললেন, শোন, তুমি তো শুধু পার্থেননের মাপ নিয়ে পড়ে আছ। আমি সারা এথেন্স নিয়ে ভাবছি। এই এক্রোপোলিস পাহাড়, ঐ আগোরা, ঐ দূরের পিরাউস বন্দর আমি সব নতুন করে করব। সব পাল্টে দেব।
ফিডিয়াস চুপ করে আছে। কী যেন ভাবছে।
পেরিক্লিস বললেন, কী শিল্পী, ভয় পেয়ে গেলে? ঝিম মেরে কী ভাবছ?
ফিডিয়াস বলল, আরও দুইজন লোকের কথা ভাবছি। তুমি যে বিশাল কাজের কথা ভাবছ, সেটি একজনে ডিজাইন করতে পারবে না। একটি টিম লাগবে।
‘তো, বানাও তোমার টিম। ঝটপট বানাও। কে কে থাকবে তোমার টিমে?’
‘খুব প্রতিভাবান একটি ছেলে আছে। ছেলেটি ভবনের নকশা খুব ভালো পারে। ওর নাম ইকটিনাস[৮৩]। আমার সাথে কাজ করেছে। কয়েকটি বড় বড় মন্দিরের ডিজাইন করেছে। স্পার্টার কাছে বাসাই নামে যে ছোট্ট শহর, সেখানে একটি এপোলোর মন্দির ডিজাইন করেছে। খুব সুন্দর হয়েছে। ছেলেটা আমার পছন্দের। সে বইও লেখে। একটি দালান কীভাবে ডিজাইন করে, সেটি সুন্দর করে লিখে ফেলতেও পারে।’
‘তুমি যদি ভাবো ছেলেটা কাজে আসবে, তাই সই। তাকে খবর পাঠাও।’
‘আর একজনের নাম কালিক্রাটিস। ওর জ্যামিতি জ্ঞান খুব পাকা। আমি পছন্দ করি। কাজে খুবই ভালো।’
‘তাকেও নিয়ে নাও। লাগলে আরও কয়েকজন নাও। সারা এথেন্সের মানুষকে নাও। কিন্তু কাজে নামো। ঝিম মেরে পড়ে থেকো না।’
ফিডিয়াস ঝিম মেরে থাকার লোক নয়। সেটি প্রমাণ করতে সে হঠাৎ পাগলের মতো দৌড় দিল। এক দৌড়ে গিয়ে থামল এক্রোপোলিসের সদর দরজায়। সেখানে থেকে চারদিকে তাকাচ্ছে। পাগলের মতো দৃষ্টি। চোখের খুব সামনে দুই হাত নিয়ে আঙুল দিয়ে ফোকাস করল। কী যেন মাপছে। কয়েকবার ফোকাস করেই আবার দৌড়ে চলে গেল পাহাড়ের উল্টো দিকে। সেখানে গিয়ে একইভাবে চোখের সামনে দুই হাত নিয়ে ফোকাস করল। ঘুরে ঘুরে চারদিকে ফোকাস করল।
বেশ কিছুক্ষণ তার পাগলামি দেখলেন পেরিক্লিস। পাগলামি শেষ হলে ফিরে এসে ফিডিয়াস বলল, আলোর হিসাব নেওয়া শেষ। ডিগ্রির মাপ, জ্যামিতির কোণের হিসাব খাপে খাপ মিলে যাবে। এবার বলো, এই পাহাড়ের কোথায় কী বানাতে চাও। তুড়ি মেরে সব করে দিচ্ছি। ফিডিয়াসের এক জবান। জবান দিছি তাই কাজ শেষ করে উঠব।
পেরিক্লিসের ভালো লাগল। শিল্পীরা তেতে না উঠলে কাজ করতে পারে না। এখন ফিডিয়াস ফুটছে, সে পারবে।
পেরিক্লিস বললেন, আমরা এখন সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। এই দরজা থেকে ডান দিকেই হোক পার্থেনন। মানে আগের জায়গায়ই। এখন যেখানে পোড়া আছে, সেখানেই।
ফিডিয়াস বলল, সেই ভালো। তাতে আগের পাথর যা আছে, সেগুলো কাজে আসবে। বিশাল করে আমরা এই মন্দির বানাব। এটিই হবে এথেন্সের মূল আকর্ষণ। এই মন্দিরের নকশা আমি করব না। করবে ইকটিনাস। এটি খুব মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। আমার তো অনেক কাজ। তাই এই মন্দিরের খুঁটিনাটি দেখবে ইকটিনাস। আমি দেখাশুনা করব।
পেরিক্লিস বললেন, এরপর পার্থেননের ঠিক বিপরীতে উত্তর দিকে চলো। কাহিনি অনুযায়ী এখানে দেবী এথিনা আর তার চাচা পোসাইডনের যুদ্ধ হয়েছিল। এখনও এখানে এথিনার দেওয়া জলপাই গাছ, আর পোসাইডনের দেওয়া ঝরনা আছে। ওগুলো থাকবে, কিন্তু সুন্দর করতে হবে। ওর সামনে ছোট সুন্দর একটি মন্দির করে দিতে পার। ওটার নাম দাও এথিনার ছেলের নামে। নাম ইরেকথিয়ন[৮৪]।
‘ঠিক আছে। এই ছোট্ট মন্দির নিয়ে আমার একটি প্লান আছে। অনেক দিন ধরে ভাবছি, একটি ছোট্ট ভবন বানাব যেটির খুঁটি হবে মেয়েদের মুখমণ্ডল দিয়ে।’
‘কী বলছ? মানুষ মারবে নাকি?’
হেসে উঠল ফিডিয়াস। বলল, আসল মেয়ে নয়, পাথরের মেয়ে। সামনের এক একটি খুঁটি হবে এক একটি মেয়ে। খুঁটিগুলোকে আমি মেয়েদের মুখ আর শরীরের মতো করে বানাব। মনে হবে কয়েকটি সুন্দর মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মাথার উপর পুরো ভবন।
পেরিক্লিস বললেন, চিন্তা ভালো, তবে খেয়াল রেখো, শিল্প বানাতে গিয়ে দালান যেন পড়ে না যায়। এরপর এই এক্রোপোলিস পাহাড়ের সদর দরজা বা প্রধান ফটক। এটি হতে হবে একেবারে চোখ ঝলসানো, দরজার নাম দাও প্রোপাইলিয়া।
ঠিক আছে, এই দরজাও আমি নিজে ডিজাইন করব। দরজা দিয়ে ঢুকেই মানুষের চোখ ঝলসে যাবে।
পেরিক্লিস বললেন, সদর দরজার সামনেই থাকবে এথিনার বিশাল এক মূর্তি। এই মূর্তির নাম দেব— এথিনা প্রোমাকোস মানে ‘সম্মুখ সমরে এথিনা’। এটি ব্রোঞ্জ দিয়ে করবে। পারস্য যুদ্ধের সময় পারস্য বাহিনী যত ঢাল, বর্শা ফেলে গেছে, সব আছে সালামিনা দ্বীপে। বিশাল সেই স্তূপ। ওইসব অস্ত্র গলিয়ে মূর্তি বানাবে। যত উঁচু পার করবে।
ফিডিয়াস বলল, ঐ অস্ত্রে তো কয়েক টন ব্রোঞ্জ হবে। সেগুলো সব দিয়ে একটি মূর্তি বানালে, সেটি ত্রিশ ফুট উঁচু হয়ে যাবে। বানাতে কয়েক বছর লাগবে।
পেরিক্লিস বললেন, দেখাও তোমার কেরামতি। যত উঁচু পার কর। কয়েক বছর লাগলে লাগুক, এই পুরো কাজ শেষ হতে কয়েক বছর তো লাগবেই।
ফিডিয়াস বলল, ঠিক আছে, কালই জাহাজ পাঠিয়ে সব অস্ত্র নিয়ে আসব। ‘আর ঢোকার মুখে ডান দিকের ঐ জায়গাটা। যেখানে ম্যারাথন যুদ্ধে জেতার খবর এক দৌড়ে নিয়ে এসে মারা গিয়েছিল ফিডিপিডিস, ঐ জায়গাটায় কী করা যায়।’
ফিডিয়াস বলল, ওখানে আগে বিজয়ের দেবী নাইকির একটি মূর্তি ছিল। তো ওখানে নাইকি দেবীর মন্দির আর মূর্তি করা যায়। এটির দায়িত্ব নেবে কালিক্রাটিস।
‘ঠিক আছে, মোটামুটি এই হবে আমার স্বপ্নের পাহাড় এক্রোপোলিস। এখন আসল কাজ বাকি। এথিনার মন্দিরের ডিজাইন করতে হবে। কাকে যেন দায়িত্ব দেবে বললে? ছেলেটার নাম কী যেন?
‘ইকটিনাস।’
পেরিক্লিস বললেন, যত তাড়াতাড়ি পার ওকে নিয়ে আসো।
পেরিক্লিস যত তাড়াতাড়ি ভেবেছিলেন, ফিডিয়াস তার চেয়েও তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। সেদিন সন্ধ্যায়ই ফিডিয়াস আবার চলে এসেছে পেরিক্লিসের বাড়ি। তার সাথে ইকটিনাস আর ক্যালিক্রাটিস। ফিডিয়াস খুবই কাবিল লোক। যাকে বলে করিৎকর্মা। সে এক বিকেলেই দুই স্থপতি ইকটিনাস আর ক্যালিক্রাটিসকে নিয়ে এক্রোপোলিস ঘুরে এসেছে। তিনজনে পার্থেননের একটি পরিকল্পনাও করে ফেলেছে। এখন পেরিক্লিসের সাথে আলাপ করবে। কেমন হবে নতুন পার্থেনন।
পেরিক্লিস বললেন, সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মন্দির হবে এটি। অলিম্পিয়া নগরে জিউসের যে মন্দির আছে, তার চেয়েও বড় করতে হবে।
ইকটিনাস বললেন, অবশ্যই।
ফিডিয়াস বলল, ঠিক কোথায় পার্থেনন করব, সেটি ঠিক করে ফেলেছি। এটি ইকটিনাস ভালো করে বুঝিয়ে বলুক।
ইকটিনাস উঠে দাঁড়াল। তার ভঙ্গি শিক্ষকের মতো। হাতে পেপিরাস কাগজ আর কলম। জীবনে এই প্রথম সে পেরিক্লিসের কাছে এসেছে। কিন্তু কোনো ভয়ডর নেই। এসেই পণ্ডিতের মতো বোঝাতে শুরু করেছে। সে পেপিরাস কাগজে লাইন টেনে টেনে বলতে শুরু করল—
ভবনের উপর সূর্যের আলো আর আমাদের চোখের অবস্থান এই দুটির মধ্যে মিল ঘটাতে আমরা গ্রিক স্থপতিরা অনেক দিন ধরেই কাজ করছি। আমরা একটি মজার জিনিস বের করেছি। আমাদের চারদিকে তিনশ ষাট ডিগ্রির একটি পেনোরামা আছে। বারো জন গ্রিক দেবতাকে এই তিনশ ষাট ডিগ্রি ভাগ করে দিলে প্রত্যেক দেবতা ত্রিশ ডিগ্রি পায়। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি এই ত্রিশ ডিগ্রি হলো একটি ভবন দেখার জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থান। একজন মানুষের চোখ থেকে ঠিক ত্রিশ ডিগ্রির মধ্যে ভবনটিকে থ্রি-কোয়ার্টারে রাখতে পারলে, ঐ মানুষটি ভবনের সবচেয়ে বেশি অংশ দেখতে পায়। তো পার্থেননের জন্য আমরা ধরে নেব— দর্শক আছে সদর দরজার ঠিক মাঝখানে। সেই মাঝের বিন্দু থেকে ডান দিকে ত্রিশ ডিগ্রির মধ্যে পুরো পার্থেনন থাকবে। মানুষ যখন সদর দরজা দিয়ে ঢুকবে, তখনই ‘থ্রি কোয়ার্টার ভিউ’ পাবে। তাতে সে ভবনটা সবচেয়ে ভালো দেখবে এবং সৌন্দর্য বুঝতে পারবে।
পেরিক্লিস বললেন, মজার জিনিস বললে তো। বারো জন দেবতা প্রত্যেকে ত্রিশ ডিগ্রি পায়। সেজন্য ত্রিশ ডিগ্রি হলো সবচেয়ে ভালো অবস্থান তোমরা তো ধর্ম আর জ্যামিতি মিশিয়ে একবারে খিচুরি বানিয়ে দিয়েছো।
ইকটিনাস হাসি দিল। বলল, ধর্ম আর জ্যামিতির খিচুরি আরও আছে। আমাদের গুরু পিথাগোরাস বলতেন, দেবী এথিনার জ্যামিতির প্রতীক হলো সর্বসম ত্রিভুজ। একটি সর্বসম ত্রিভুজের প্রত্যেক কোণ ষাট ডিগ্রি। পিথাগোরাস বলতেন, ষাট ডিগ্রি হলো দেবী এথিনার নিজের পছন্দের কোণ। তার মতে তিনটি জিনিস নিয়ে কাজ করলে— তাদেরকে ষাট ডিগ্রি কোণে সর্বসম ত্রিভুজের তিন কোনায় বসাতে হয়। তাতে দেবী খুশি হন। আর তিনটি জিনিসই দেখতে সবচেয়ে ভালো লাগে।
পেরিক্লিস অবাক। বললেন, ডিগ্রিতে প্যাঁচ লেগে যাবে। সদর দরজার মাঝখান থেকে পার্থেনন বসাবে ঠিক ত্রিশ ডিগ্রিতে। এটি চূড়ান্ত। এরপর পিথাগোরাস বলেছেন যদি তিনটি জিনিস থাকে, তাদেরকে সর্বসম ত্রিভুজের তিন কোনায় মানে ষাট ডিগ্রিতে বসাতে। তো আমাদের সেই তিনিট জিনিস কী কী?
ইকটিনাস প্যাপিরাসে লাইন টেনে বলল, আমাদের তিনটি জিনিস হলো সদর দরজা, ডানদিকে পার্থেনন আর বামদিকে ছোট্ট ইরেকথিয়ন। এই তিনটা জিনিস নিয়ে সর্বসম ত্রিভুজে করতে পারলে, পুরো পাহাড় চমৎকার লাগবে।
পেরিক্লিস হাসি মুখে ফিডিয়াসকে বললেন, এই ছেলে তো প্রতিভার ডিব্বা। হবে, আমার এথেন্স সুন্দর হবে। এরা পারবে।
মন্দির হবে পূর্বমুখী, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। গ্রিসের সব মন্দির পূর্ব-পশ্চিমে লম্বাটে। গ্রিকরা পথ চলার জন্য দেবতা এপোলোকে অনুসরণ করে। তারা মনে করে এপোলো প্রতিদিন চার ঘোড়ার রথ টেনে সূর্যকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে নিয়ে যায়। সেজন্য মন্দিরও হয় পূর্ব থেকে পশ্চিমে। শুধু এপোলোর নিজের মন্দির উত্তর-দক্ষিণে।
ফিডিয়াস বলল, এতক্ষণ কোথায় মন্দিরটি হবে, সেটি শুনলে। এবার আসো ভবন দেখতে কেমন হবে। এটি বলুক আরেক প্রতিভার ডিব্বা ক্যালিক্রিটাস।
ক্যালিক্রাটিস একটু লাজুক। বয়সও কম। সে মিনমিন করে শুরু করল— আমাদের আরেক দার্শনিক প্রোটাগোরাস একটি জটিল কথা বলেছেন, ‘মানুষই হলো সবকিছুর মাপকাঠি’। আমরা স্থপতিরা ভবন বানাতে গিয়ে তার কথাটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছি— মানুষের শরীরই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস। মানুষের শরীরের মাপে বানাতে পারলেই কোনো জিনিস সবচেয়ে সুন্দর হয়। শরীরের মাপ নিয়ে অনেক আগেই পিথাগোরাস খুবই আশ্চর্য একটি জিনিস বের করেছেন। সেটির নাম ‘গোল্ডেন রেশিও’ বা সোনালি অনুপাত। কোনো মানুষের পা থেকে মাথা পর্যন্ত উচ্চতাকে তার পা থেকে নাভি পর্যন্ত উচ্চতা দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় গোল্ডেন রেশিও। হিসাব করলে সংখ্যাটা মোটামুটি এক দশমিক ছয়ের (১.৬২) মতো হয়। পিথাগোরাস মনে করতেন, পৃথিবীর সবকিছু কোনো না কোনোভাবে এই অনুপাত মেনে চলে। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যের চাবিকাঠি এই মাপ। এই মাপে দিয়ে বানাতে পারলেই কোনো জিনিস সবচেয়ে সুন্দর হয়। আমরাও সেটি বিশ্বাস করি। আমরা পার্থেনন বানাতে এই সোনালি অনুপাতই ব্যবহার করব।
পেরিক্লিস আবার অবাক। গ্রিক স্থাপত্য যে এমন জায়গায় চলে গেছে সেটি তার ধারণাতেই ছিল না। এরা মানুষের শরীরের মাপ দিয়ে সৌন্দর্যকে সংখ্যার মধ্যে বেঁধে ফেলেছে। সেই সংখ্যা দিয়ে এরা ভবন বানায়! কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
তিনি বললেন, তো আমাদের পার্থেননের দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ হবে সোনালি অনুপাতের মাপে?
ক্যালিক্রাটিস বলল, হ্যাঁ, সোনালি অনুপাতেই হবে। তবে এক দশমিক ছয় নয়, অন্য একটু মাপে। সোনালি অনুপাতের মান আরও অনেক কিছুই হতে পারে। যেমন একটি হলো পাঁচের বর্গমূল, মানে দুই দশমিক দুই চারের মতো। আর একটি সোনালি অনুপাত হলো চার অনুপাত নয় (৪:৯)। আমরা আজকে এক্রোপোলিসের মাপ নিয়েছি। তাতে মনে হয়েছে পার্থেননের দৈর্ঘ্য আর প্রস্থের অনুপাত হবে পাঁচের বর্গমূল। একটি গোল্ডেন রেশিও। মানে প্রস্থ যতটুকু, দৈর্ঘ্য তার দুই দশমিক দুই চার গুণ। এতে মন্দির হবে লম্বাটে। আর যে লম্বা খুঁটিগুলো দেব, সেগুলোর প্রতিটি বসবে একটি সোনালি অনুপাতে।
পেরিক্লসি বললেন, বাহ, আমার তো এখনই চোখ বুজে দেখতে ইচ্ছে করছে।
ফিডিয়াস বলল, এখনও তো শেষ হয়নি। আরেকটা বড় ব্যাপার করব আমরা এই ভবনে।
পেরিক্লিস বলল, আরও বড় ব্যাপার?
ফিডিয়াস বলল, হ্যাঁ, সেটির নাম ‘অপটিক্যাল রিফাইনমেন্ট’। মানে মানুষ যাতে দেয়ালের কারুকাজ মাটি থেকে বুঝতে পারে, চোখের সাথে আলোর মিল ঘটানোর জন্য আরও কিছু খুবই মজার কাজ করবে ইকটিনাস। সেটি ইকটিনাসই বলুক।
ইকটিনাস বলল, মানুষ যখন চারকোণ উঁচু কিছুর দিকে তাকায়, চোখ দুই দিকে না তাকিয়ে মাঝখানে দৃষ্টি দেয়। আবার আড়াআড়ি লম্বা কিছু দেখলে মাঝের অংশটা আমাদের চোখে একটু ঝাপসা দেখায়। এসব সমস্যা দূর করতে হবে। এমন কিছু করতে হবে যাতে মাঝের সৌন্দর্য খুব ভালো করে নজরে আসে। আমরা তিনজন চিন্তা করে বের করেছি পার্থেননের প্রতি পাশে মাঝখানটা একটু উঁচু করে দেওয়া হবে। আর একটি কলামও পুরোপুরি সোজা নয়। প্রতিটি কলাম সূক্ষ্মভাবে একটু একটু বাঁকা করে দেওয়া হবে। এতে একটি পুরোপুরি খাড়া জিনিস দেখতে চোখ যে সমস্যায় পড়ে, সেটি দূর হবে।
পেরিক্লিস বললেন, আমি বুঝলাম যে উঁচু ভবন হলেও, মানুষের পার্থেননের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে, চোখ আলোর ঝামেলায় পড়বে না। কিন্তু তোমরা যে বলছো খুঁটিগুলো একটু বাঁকা করে দেবে, মাঝে একটু উঁচু থাকবে, এগুলো মুখের কথায় বোঝা যাচ্ছে না। আমার মডেল দরকার। শোনো আমাকে দুটি জিনিস দাও। পুরো নকশার একটি বই আর পার্থেননের একটি মডেল। তাতে মনে হয় পুরোটা বুঝতে পারব।
.
দুই সপ্তাহ দিন-রাত খাটলো তিন শিল্পী। ইকটিনাস ডিজাইনের উপর একটি বই লিখে ফেলল। আর ক্যালিক্রাটিস বানালো পার্থেননের মডেল। ফিডিয়াস সবকাজ দেখাশুনা করলেন। মডেল আর নকশা দুটোই পছন্দ করলেন পেরিক্লিস। এখন কাজ শুরু করা যায়।
.
শুরু হলো কাজ। সবকিছুই হবে পাথর দিয়ে। ম্যারাথনের দক্ষিণ-পশ্চিমে পেনতিলিস[৮৫] নামে একটি পাহাড় আছে। এক্রোপোলিস থেকে পনের মাইল দূরে, পেনিতিলিস পাহাড়ের পাথর সবচেয়ে সুন্দর। ভবন কিংবা ভাস্কর্য সব কাজেই এই পাহাড়ের সাদা পাথর অতুলনীয়।
শুরু হলো কাজ। সারা এথেন্স জুড়ে দিন-রাত পাথর কাটার শব্দ। কয়েক হাজার মানুষ কাজ করছে। এদের অনেকেই দাস। তবে সবাই দাস নয়। অনেক ব্যবসায়ী, ঠিকাদার কাজ পেয়েছে, তারা লোক লাগাচ্ছে। অনেক গরিব মানুষ অন্য কাজ বাদ দিয়ে রাজমিস্ত্রি হয়ে গেছে। পাহাড় কেটে পাথর বের করছে, বিশাল বিশাল পাথরের টুকরা আসছে ফিডিয়াসের কারখানায়। সেখানে সমান করে কাটা হচ্ছে। এক চুল এদিক সেদিক হলেই সেই টুকরা দিয়ে আর কাজ হবে না। সমান করা পাথর বিশাল ক্রেন দিয়ে উঠানো হচ্ছে এক্রোপোলিসের উপর। সেখানে পাথরের উপর পাথর বসে তৈরি হচ্ছে দেবী এথিনার মন্দির। নাম পার্থেনন মানে কুমারী দেবীর মন্দির।
ফিডিয়াস বলে, ভবন নয়, মন্দির নয়, এক্রোপলিসের উপরে একটি মহাকাব্য লিখছে এথেন্সের পাথর শিল্পীরা।
***
লোকটার গলায় তিন-চারটি মালা।
সবগুলোই অনেক দামি। একেবারে রত্নখচিত। দুই হাতের দশ আঙুলে এতগুলো সোনার আংটি যে গণনা করা যাচ্ছে না। পেরিক্লিস বারোটা পর্যন্ত গুনতে পেরেছেন। আরও দুই-একটি আংটি আঙুলের ফাঁকে থাকতে পারে। এই গরমের দিনে তার গায়ে রুপালি শীতবস্ত্র, তাতে হলুদ আর কমলা সুতার নকশা।
পেরিক্লিস লোকটার দিকে যতবার তাকাচ্ছেন, ততবার তার হাসি পাচ্ছে। জোর করে হাসি আটকে রেখেছেন। বেশিক্ষণ পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। এই রকম মানুষ এথেন্সে আছে, সেটি পেরিক্লিসের জানা ছিল না। জানা ছিল আসপাশিয়ার। কারণ লোকটি আসপাশিয়ার দেশের লোক। তার বাড়িও সাগরের ওপাড়ে মিলেটাস শহরে। আসপাশিয়াই তাকে খবর দিয়ে এনেছে। তাকে একটি রাস্তার নকশা করার দায়িত্ব দিয়েছে আসপাশিয়া। সেই নকশা নিয়ে পেরিক্লিসের কাছে এসেছে লোকটি
লোকটির নাম হিপোডেমাস[৮৬]।
সে এই মুহূর্তে পেরিক্লিসের বাড়ির বারান্দায় বসে আছে। তার সামনে পেরিক্লিস, আসপাশিয়া আর ফিডিয়াস। সে নকশাটি পেরিক্লিসের হাতে দিল। পেরিক্লিস হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। এখন নকশার দিকে তাকালেই হবে, লোকটির দিকে আর তাকাতে হবে না। এই লোক যে ভালো কিছু করতে পারে, সেটি তার বিশ্বাস হয় না। তবে নকশায় তাকিয়ে থাকলে অন্তত হাসিটা বন্ধ থাকবে। হাসি বন্ধ করার জন্য পেরিক্লিস খুব মনোযোগ দিয়ে নকশার দিকে তাকালেন।
কিন্তু নকশার কিছু বুঝতে পারছেন না পেরিক্লিস। তিনি জ্যামিতি ভালোই বোঝেন। আর কিছুদিন ধরে তিনি আর্কিটেক্টদের সাথেই আছেন, নানান নকশা দেখছেন। তিনি এখন মোটামুটি নকশা বিশেষজ্ঞ। কিন্তু এই নকশা ঐরকম নয়। একেবারে আলাদা। কেমন দাগ টেনে টেনে প্লটে প্লটে ভাগ করা, নানান সংকেত দিয়ে এঁকেছেন।
তিনি ফিডিয়াসের দিকে তাকালেন। সেও ভালো বুঝতে পারছে না। এরকম করে নকশা তারা করে না। পেরিক্লিস ভাবছেন, এই উড়াধুরা পোশাকের লোক না বুঝে হিজিবিজি এঁকেছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে।
হিপোডেমাস ভরাট গলায় বলল, আপনারা মনে হয় এরকম নকশা আগে দেখেননি। শুধু আপনারা কেন, এরকম নকশা আগে কেউই দেখেনি। দেখবে কী করে— এটি নতুন ধরনের এক নকশা। আমার বানানো। এরকম কাজ আর কেউ করতে পারে না।
তার গলার স্বরে অহংকার। এতক্ষণ পেরিক্লিস তাকে ভেবেছিলেন পাগল। এখন মনে হচ্ছে অহংকারী পাগল।
হিপোডেমাস বলল, এটি এই শহরের নকশা।
‘মানে?’
‘মানে আগোরা থেকে শুরু করে একেবারে পিরাউস বন্দর পর্যন্ত পুরো শহরের নকশা। এগুলো হলো প্লট। এই যে বড় লাইনটানা এগুলো হলো রাস্তা। এখানে বাড়ি, জলপাই বাগান, মন্দির সবকিছু দেখিয়ে দেওয়া আছে।’
পেরিক্লিস আর ফিডিয়াস বোঝার চেষ্টা করছেন পাগলটা বলছে কী! হিপোডেমাস আবার বলল, সেদিন আমার দেশের মেয়ে আসপাশিয়া আমাকে ডেকে বলল, আগোরার ভেতর থেকে একটি বিশাল রাস্তা করতে হবে। তারপর কথায় কথায় বলে ফেলল যে, আপনি নাকি পিরাউস বন্দরও নতুন করে করবেন। সব শুনে আমি ভাবলাম— আমি পুরোটার ডিজাইন করে ফেলি। নতুন রকমের ডিজাইন বুঝতে কষ্ট হবে। আমার কাছে দেন। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি।
হেপোডেমাস মেঝেতে নকশাটা ফেলে হাঁটু গেড়ে বসল। নকশা বুঝাতে শুরু করল, ‘এই যে এখানে একটি রাস্তা আরেকটা রাস্তাকে পার হয়েছে। ভালো শহর তখনই হবে, যখন রাস্তা হবে একেবারে সোজা, কোনোরকম বাঁকাতেড়া থাকবে না। দুটি রাস্তার সোজাসুজি একে অন্যকে পার হবে। একেবারে নব্বই ডিগ্রি। এই ব্যবস্থার নাম গ্রিড। আমি গ্রিডের মাধ্যমে সারা শহরের নকশা করেছি। এথেন্সে অনেক পাহাড়, তাই জায়গায় জায়গায় এরকম বাঁক, কিচ্ছু করার নেই। সোজা রাস্তার দুই পাশে যদি দোকান হয়, মানুষের বসতি হয়, তাহলে যোগাযোগ সুবিধা হয়, পরিষ্কার করতে সুবিধা হয়।’
পেরিক্লিস বললেন, এই বড়টাই তো আগোরার ভেতর থেকে প্রধান রাস্তা?
‘হুঁম, এটিই আপনার স্বপ্নের সেই রাস্তা। এথেন্স শহরের প্রধান রাস্তা। এটি দিয়েই এক্রোপোলিস থেকে আগোরা হয়ে বড় বড় শোভাযাত্রা সারা শহর ঘুরবে। সব অনুষ্ঠানের রাস্তা হবে এটি। এটি চলে গেছে একেবারে সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত। আর এখানে পুরো পিরাউস বন্দরের নতুন নকশা।’
পেরিক্লিস এবার ভালো করে তাকালেন লোকটার দিকে। এখনও লোকটাকে পাগলই মনে হচ্ছে। তবে গুণী পাগল। এথেন্সে গুণী পাগল অনেক আছে। আর একটি বাড়ল।
ফিডিয়াস এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। এবার বলল, এরকম শহরের নকশা ইউরোপে কেউ করেছে?
হিপোডেমাস বলল, না, ইউরোপে আমি দেখিনি। তবে দূরে ব্যাবিলনে নাকি আছে, ভারতের কোথায় কোথায় নাকি আছে। সেগুলো কেমন জানি না। আমি যেটি করেছি, সেটি আলাদা। এই কাজে আমিই প্রথম।
আসপাশিয়া বলল, তাহলে আপনাকে কী বলা যায়? আমাদের প্রথম নগর পরিকল্পনাবিদ।
হিপোডেমাস হাসল। অহংকারের হাসি।
পেরিক্লিস বললেন, আপনার এই সুন্দর পোশাক নকশা করে কে?
‘আমি নিজেই করি।’
পেরিক্লিস বললেন, আমিও সেটিই ভেবেছি। আপনার শহরের নকশা আমি নেব। আপনার ডিজাইন করা পোশাক দেখে যেমন আপনার দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না, আমি চাই তেমনই সবাই যেন আমার এথেন্স থেকে চোখ ফেরাতে না পারে। কিছু জিনিস আছে, যেগুলো বদলাতে হবে। আপনি এই নকশায় তিন শ্রেণির মানুষের জন্য মানুষের জন্য তিন ধরনের জায়গা ঠিক করেছেন। সৈনিক, শ্রমিক আর কৃষিজীবীদের জন্য আলাদা আলাদা মহল্লা। এসব এথেন্সে চলবে না। এথেন্স গণতন্ত্র। এখানে মানুষের শ্রেণিভাগ নেই। সবাই সমান। আপনি ফিডিয়াসের সাথে আলাপ করে বাকিটা ঠিক করে নেবেন। কোথায় কী থাকবে সেটি ফিডিয়াস জানে, সেভাবে আপনার গ্রিডে ফেলুন।
হিপোডেমাস বিদায় নিল। ভাবটা এমন যেন সে জানত, তার ডিজাইন পছন্দ হবেই।
হিপোডেমাস বের হতেই পেরিক্লিস উচ্চ স্বরে হাসতে শুরু করল। অনেকক্ষণ ধরে তিনি হাসি চেপে রেখেছিলেন, এখন সব একসাথে বের হচ্ছে। হাসি আর কাশি দুটোই ভীষণ সংক্রামক। পেরিক্লিসের সাথে এখন সবাই হাসছে।
হাসতে হাসতে আসপাশিয়া বলল, লোকটাকে দেখে এমন কেউ নেই যে না হেসে পারবে, তবে লোকটা গুণী, তোমার কাজে আসবে।
ফিডিয়াস একটু পিন দিয়ে বলল, নিজের এলাকার লোক বলে কথা! আসপাশিয়া ক্ষেপে উঠে বলল, আমার শহর মিলেটাস কি তোমাদের কম দিয়েছে? মিলেটাসে জন্ম নিয়েছে বিজ্ঞানের জনক মহান থেলিস। তার শিষ্যরা। এখন মিলেটাস তোমাদের দিল আরেক গুণীলোক প্রথম নগর পরিকল্পনাবিদ হিপোডেমাস।
পেরিক্লিস বলল, তুমি তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নামটাই বললে না। মিলেটাস আমাকে দিয়েছে পৃথিবীর সেরা নারী, তার নাম আসপাশিয়া।
আসপাশিয়া লজ্জা পেয়ে ফিডিয়াসের দিকে তাকাল। পেরিক্লিসের লজ্জাশরম নেই। বাইরের লোকের সামনেই যা খুশি বলে ফেলেন।
.
হিপোডেমাস চলে যাওয়ার পরে এলো ক্যালিক্রাটিস।
তাকে দেখে ফিডিয়াস অবাক। তার তো এখানে আসার কথা নয়। পার্থেননের কোনো কাজ নিয়ে ঝামেলা হয়নি তো!
ক্যালিক্রাটিস একটি নকশা বের করল। এথেন্সের চারপাশে একটি উঁচু দেয়ালের নকশা।
পেরিক্লিস এথেন্সের চারপাশ ঘিরে একটি বিশাল দেয়াল বানাবেন। কেউ যেন হঠাৎ আক্রমণ করে এই নগরে ঢুকতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। শত্রু মোকাবেলার আগাম ব্যবস্থা করে রাখতে চান তিনি।
এই মুহূর্তে এথেন্সে শান্তির সময় চলছে। সেই পারস্য যুদ্ধের পরে আর তেমন বড় যুদ্ধ হয়নি। তবে পেরিক্লিস জানেন এই শান্তি চিরস্থায়ী নয়। আছে তাদের চিরশত্রু স্পার্টা। যেকোনো সময় স্পার্টা আক্রমণ করতে পারে এথেন্সকে। স্পার্টানরা ভয়ংকর যোদ্ধা। তাদের সাথে সামনা-সামনি পারা যাবে না। তাই দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি থাকতে হবে। তাই পেরিক্লিস দেয়াল বানাচ্ছেন।
এই দেয়াল আগোরা, এক্রোপোলিসসহ এথেন্সের মূল ভূখণ্ড ঘিরে একেবারে এজিয়ান সাগরে পিরাউস বন্দর পর্যন্ত। বন্দরে আছে এথেন্সের শক্তিশালী নৌবাহিনী। তারা নগরকে রক্ষা করতে পারবে।
এই দেয়াল নকশা করেছে ক্যালিক্রাটিস। শীঘ্রই দেয়ালের কাজ শুরু হবে। কিছুদিনের মধ্যেই হিপোডেমাস পুরো আগোরার একটি নকশা করে ফেলল। শুরু হলো কাজ। ফিডিয়াস সব দেখাশুনা করে। হিপোডেমাসের নকশায় আগোরা আর পিরাউস বন্দরের কাজ চলতে লাগল। আর এই দুটিকে সংযোগ করে হচ্ছে বিশাল রাস্তা।
হিপোডেমাস প্রতিদিন আগোরায় কাজ দেখতে আসেন। তার পরনে সেই ঝলমলে পোশাক। সেই ঝলমলে অলংকার। তাকে দূর থেকে এক নজরেই সবাই চেনে। ঝলমলে পোশাকের গুণ আছে। সবাই এক বাক্যে জানে যে— এই নতুন আগোরার রাস্তা ডিজাইন করেছে হিপোডেমাস। সেজন্য এই রাস্তাকে অনেকে বলে হিপোডেমিয়া বা হিপোডেমিয়াসের রাস্তা।
.
সারা এথেন্সে শত শত কিছু তৈরি হচ্ছে।
পেরিক্লিস বলছেন, কাজ আগাতে হবে। এক জীবনে কত কাজ করা যায়, সেটি দেখিয়ে দিতে হবে।
এক্রোপোলিসের উপর কাজ চলছে, এত দ্রুত যে কাজ হতে পারে, সেটি কেউ কল্পনাও করেনি। পেরিক্লিস পাগলের মতো কাজ করছেন। ফিডিয়াস রাত-দিন পাথর ঘষছেন।
পার্থেননের কাজ অনেকটাই হয়ে গেছে। চারদিকের দেয়াল পর্যন্ত হয়ে গেছে। এখন পেরিক্লিস আর ফিডিয়াস আলাপ করতে বসেছে— মন্দিরের ভেতরে কী থাকবে আর বাইরের দেয়ালে কী ভাস্কর্য হবে সেটি নিয়ে।
পেরিক্লিস বললেন, আমাদের কাছে ডিলিয়ান জোটের অনেক স্বর্ণ আছে। স্বর্ণ দিয়ে কী করা যায়?
আসপাশিয়া বলল, স্বর্ণ দিয়ে এথিনার একটি মূর্তি বানিয়ে ফেলো। সেটিই হবে এথেন্সের ব্যাংক। যদি কোনোদিন দরকার হয়, স্বর্ণ গলিয়ে নিয়ে নেওয়া যাবে।
ফিডিয়াস বলল, উত্তম প্রস্তাব।
পেরিক্লিস বললেন, সোনার পরিমাণ কত, সেটি তোমাদের ধারণাও নেই। তাহলে আর এই কথা বলতে না। গতকালের হিসাব অনুযায়ী স্বর্ণ আছে চুয়াল্লিশ ট্যালেন্ট।
চুয়াল্লিশ ট্যালেন্ট মানে এগারো শত কেজি স্বর্ণ।
শুনে আসপাশিয়ার মুখ হা হয়ে গেল। সে বলল, এত স্বর্ণ! তাহলে কয়েকটা মূর্তি করতে পার।
ফিডিয়াস বলল, পেরিক্লিসের সাথে থেকে আমি বড় বড় চিন্তা করতে শিখে গেছি। আমি সব স্বর্ণ আর আইভরি দিয়ে একটি মূর্তিই বানাব। সেটিই হবে পার্থেননের প্রধান মূর্তি। সেই মূর্তির নাম ‘এথিনা পার্থেনস’[৮৭] বা কুমারী এথিনা। যুগে যুগেই জ্ঞানের দেবীরা কুমারী হন।
পেরিক্লিস ফিডিয়াসের দিকে তাকিয়ে আছেন। সে কি সত্যিই একা এত কিছু করতে পারবে?
পেরিক্লিস বললেন, ঠিক আছে, একটি মডেল বানাও।
ফিডিয়াস একটি পেপিরাস কাগজে কী যেন হিসাব করল। কিছুক্ষণ আঁকিবুকি করে বলল, আমার হিসাবে ঐ পরিমাণ সোনা দিয়ে মূর্তি বানালে সেটি ছত্রিশ ফুটের কম হবে না।
পেরিক্লিস বললেন, ঠিক আছে, তুমি চেষ্টা কর। আর এই মূর্তি এমন হবে যেন, এই মাত্র দেবী এথিনা যুদ্ধ জিতেছে। এক হাতে দাও বিজয়ের দেবী নাইকি। অন্য হাতে দাও একটি ঢাল।
ফিডিয়াস বলল, আচ্ছা, এথেন্সে তো এখন কাপড় ছাড়া মূর্তি হয়। তো এথিনার মূর্তি কি কাপড় বাদ দিয়ে করা যায়?
পেরিক্লিস বুঝলেন, ফিডিয়াস নিশ্চয়ই আজ নেশা করেছে। না হলে দেবী এথিনাকে নিয়ে এমন কথা বলার কথা নয়।
পেরিক্লিস বললেন, ছিঃ ছিঃ এসব বোলো না। এথেন্সের মানুষ এসব সইবে না। এসব উড়া-ধুরা আলাপ বাদ দাও। কাজে লাগো। এথিনাকে পোশাক পরিয়ে দিও।
ফিডিয়াস বলল, তাহলে এথিনার মূর্তিতে এমন কারুকাজে পোশাক দেব যেন কাপড় আছে না নেই, সেটি বুঝতেই মানুষকে অনেকক্ষণ ভাবতে হয়। তাহলেই সেটি অসাধারণ শিল্প হবে। জ্ঞানীরা যখন কিছু বোঝে না, তখন তার দিকে তাকিয়ে বলে— আহা, কত ভালো! তাই আধা-আধি কোরো। মানুষকে দোটানায় ফেলে দিতে হবে। মানুষ ভাববে— শিল্পী ফিডিয়াস কত খারাপ– দেবীকে কাপড় দেয়নি। আবার ভালো করে তাকিয়ে দেখবে— না, কাপড় তো দিয়েছে। তখন বলবে আহা, কাপড় দিয়েই ফেলল!
আসপাশিয়া বলল, এসব আলাপ বাদ দাও। ভদ্র মনে এথিনার মূর্তির কাজ শুরু করো।
ফিডিয়াস বলল, ঠিক আছে। দেবীর আলাপ বাদ। এবার আসি পার্থেননের দেয়ালে কী মূর্তি বানাব। আমি একটি ডিজাইন করে এনেছি।
সে বেশ কয়েকটা প্যাপিরাস টুকরা বের করল। একটি একটি করে দেখাচ্ছে সে। সে দেখাচ্ছে পার্থেননের কোথায় কোন ভাস্কর্য হবে।
পূর্ব দিকে একেবারে সামনের দেয়ালে হবে এথিনার জন্ম-দৃশ্য। এই দৃশ্যে জিউসের মাথা থেকে বেরিয়ে এলেন জ্ঞানের দেবী এথিনা। তার জন্মই হলো পূর্ণ যুবতি হয়ে, হাতে অস্ত্র, মাথা ভরা জ্ঞান। বামের দেয়ালে এক পাশে সূর্যের রথের ঘোড়াগুলো টগবগ করে ছুটছে, অন্য পাশে চাঁদ দেবী অস্ত যাচ্ছে, তার রথের ঘোড়া সারা রাত চলে ক্লান্ত, ঘোড়ার মুখ অবসন্ন। পশ্চিমের বাইরের দেয়ালে এথিনা আর পোসাইডনের যুদ্ধ। আর উত্তর দিকের দেয়ালের উপর দিকে সাতটা ঘোড়ার একটি বাহিনী। ঘোড়া ছুটিয়ে যোদ্ধা যাচ্ছে।
বাইরের কলামের ভেতরে মূল মন্দির। ভেতরে মূল মন্দিরের বাইরের দেয়ালের চারদিকে দিবে প্যান-এথেনিক শোভাযাত্রার ছবি। এথিনার জন্মদিনে সবাই শোভাযাত্রা করে। পাঁচ দিন ধরে চলে সেই মিছিল। সারা এথেন্স ঘুরে এখানে এসে শেষ হয় সেই শোভাযাত্রা। সেই শোভাযাত্রার ছবি হবে দেয়ালের চারদিক জুড়ে।
.
পরদিন সকালেই দেখা গেল ফিডিয়াস পাথরে ছুরি নিয়ে পার্থেননের দেয়াল খুঁড়ছে। ভাস্কর্য বানানো শুরু করেছে। এমন জিনিস পৃথিবীতে হতে পারে, সেটিই কেউ চিন্তা করেনি। কোনো ভাস্কর্যই পাঁচ সেমি-এর বেশি পুরো নয়। দেয়ালে এমন করে ভাস্কর্য করা যায়, এটি কেউ ভাবতেই পারেনি। আসলে পাথরের উপর কবিতা লিখছে ফিডিয়াস।
পাথর দিয়ে যে এমন সুন্দর কবিতা লেখা যায় ফিডিয়াসই সবার আগে করে দেখিয়েছে। পাথর দিয়ে এমন চমৎকার কবিতা আর কোথাও নেই।
***
৮৩. ইকটিনাস (Iktinos) ও কালিক্রাটিস (Callicrates) পার্থেননের মূল স্ট্রাকচার নকশা করেন।
৮৪. ইরেকথিয়ন (Erechtheion) নামে এই সুন্দর ভবনটি পার্থেননের ঠিক উল্টো দিকে এখনও আছে।
৮৫. পেনিতিলিস (Penteli) পাহাড়ের সাদা পাথর দিয়ে পার্থেনন নির্মাণ করা হয়েছে।
৮৬. Hippodamian Plan (grid plan) এর উদ্ভাবক হিপোডেমাস, অনেকে তাকে ইউরোপের নগর পরিকল্পনা শাস্ত্রের জনক বলেন।
৮৭. স্বর্ণ আর আইভরি দিয়ে তৈরি এথিনা পার্থেনস (Athena Parthenos) ছিল পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে সুন্দর ভাস্কর্যের একটি। যুক্তরাষ্ট্রের Nashville এর Centennial Park এ এই মূর্তির একটি প্রতিলিপি তৈরি করা হয়েছে।