1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ২৮

২৮

‘অসাধারণ নেতা হওয়াও দুর্ভাগ্যের,
তিনি সাধারণের কাছে অসাধারণ জিনিস প্রত্যাশা করেন।’

—খুকিডিডিস

***

এথেন্সের বাড়ির জানালা খুবই ছোট ছোট

কবুতরের খোপের চেয়ে একটু বড়। জানালায় কোনো দরজা নেই। একেবারে খোলা। খোলা জানালা দিয়ে যাতে চোর না ঢুকে পড়ে, সেজন্য খুব ছোট করে বানানো হয়।

সেই ছোট্ট জানালায় চোখ রেখে পেরিক্লিস একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন এক্রোপোলিসের দিকে। তার চোখে এক সাগর কষ্ট।

এমন দৃশ্য আসপাশিয়া আগে দেখেনি। তার প্রেমিকের চোখে বিষাদ মানায় না। তার প্রেমিক অহংকারী, সে দুর্বিনীত। প্রেমেও যেমন কোনো বাধা মানেন না, নেতা হিসেবেও নয়। গর্বিত হাসি মুখই পেরিক্লিসকে মানায়।

নিঃশব্দে পেছনে এসে পেরিক্লিসের কাঁধে মুখ রাখল আসপাশিয়া একেবারে কানের কাছে মুখ নিয়ে একটু আহ্লাদী গলায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ঝামেলা হয়েছে কোনো?

ধীরে ধীরে পেছন ফিরলেন পেরিক্লিস। আসপাশিয়ার মুখ দুই হাতে তুলে ধরলেন। আসপাশিয়ার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। সে একটা কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করছে।

কিন্তু সেই একটা কিছুর দিকে গেলেন না পেরিক্লিস। ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমার প্রেমিকাদের মধ্যে তোমার স্থান কিন্তু দুই নম্বরে। তোমার চেয়েও প্রিয় আমার একজন প্রেমিকা আছে।’

চোখ খুলল আসপাশিয়া। বড় আশায় চোখ বন্ধ করে তার ওষ্ঠ কাঁপছিল। কিন্তু দুষ্টু পেরিক্লিস কী শোনালেন? সে বড় বড় চোখে তাকাল।

তার মুখ দেখে মায়া লাগল পেরিক্লিসের। বেশি রহস্য না করে বললেন, ভয় নেই। আমার এক নম্বর প্রেমিকা আসলে তোমারও প্রেমিকা। তার নাম এথেন্স। এই নগরীটিকে আমি তোমার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। জ্ঞান সঞ্চারিণী, গণতন্ত্র প্রসবিনী আমার এথেন্স।

‘বুঝলাম। কিন্তু হে এথেন্সের মহান প্রেমিক, বলুন, আপনার প্রেমিকা এথেন্সের কী হয়েছে? সে বুঝি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে?’

‘হুঁম, কষ্ট দিচ্ছে, এথেন্স আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। এথেন্সের দিকে তাকালেই আমি কষ্ট পাই।’

পেরিক্লিসের গলা থেকে ভাষণের স্বর এখনও নামেনি। তিনি ভরাট গলায় বললেন, ওই জানালা দিয়ে তাকাও। এক্রোপোলিসের উপর ভালো করে দেখো। ঐ যে, দেবী এথিনার পোড়া মন্দির পার্থেনন। পারস্য বাহিনী পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। আমি যখনই পার্থেননের দিকে তাকাই, আমার বুকটা হু হু করে ওঠে। পার্থেননের পোড়া ছাই আমাকে কষ্ট দেয়।

আসপাশিয়া অবাক হয়ে বলল, পোড়া পার্থেনন কষ্ট দিচ্ছে? কিন্তু আমি তো জানতাম, এথেন্সের মানুষ ওই পোড়া ছাই দেখে শক্তি পায়। পারস্যকে হারানোর পরে থেমিস্টক্লিস পোড়া পার্থেনন দেখিয়ে বলেছেন, ‘দ্যাখো, এথেন্সবাসী দ্যাখো। আমরা হেরে গেলে কী হতো, দ্যাখো। আর একটু হলেই এই পার্থেননের মতো সারা এথেন্স পুড়িয়ে দিত। তাই আমরা ঠিক করলাম— আমরা আর পার্থেনন বানাব না। পোড়া চিহ্ন রেখে দিলাম। এই চিহ্ন দেখে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুঝবে, যুদ্ধে হেরে গেলে এথেন্সের কী অবস্থা হতে পারে।’ আর আজ ওই পোড়া চিহ্ন আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে?

‘হ্যাঁ, আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আর কত দিন আমরা ঐ পোড়া চিহ্ন দেখে যাব? যেদিন পুড়েছিল, সেদিন এথেন্স ছিল একটি দরিদ্র নগর। কিন্তু দিন পাল্টেছে। আজ আর এথেন্স শিশু রাষ্ট্র নয়। এথেন্স এখন সারা গ্রিসের নেতা। সে এখন সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র।’

আসপাশিয়া দেখল, পেরিক্লিসের অহংকারী চেহারা ফিরে এসেছে। সে মনে মনে খুশি হলো।

পেরিক্লিস বলে যাচ্ছেন— শুধু অর্থ সম্পদের দিকে নয়। তাকাও জ্ঞান, বিদ্যা, বিজ্ঞান আর সংস্কৃতির দিকে। এথেন্স জ্ঞানের জগতে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগর। সারা পৃথিবীর জ্ঞানী মানুষেরা এথেন্সের দিকে ছুটে আসছেন। এথেন্স হলো আলো। আলোর নেশায় দুনিয়ার আলোক পিপাসুরা আসছেন এই নগরীতে। হেরোডোটাসের কথাই ধরো। আহা, কী চমৎকার জ্ঞানী। কিন্তু কোথায় ছিল তার জ্ঞান? তার নগরী তাকে বিতাড়িত করেছে। আর এথেন্স তাকে বুকে তুলে নিয়েছে। এই এথেন্সে এসেই সে নতুন এক জ্ঞানশাস্ত্ৰ সৃষ্টি করে ফেলেছে।

‘হুঁম, সে জ্ঞানের জগতের নতুন একটি বিষয় সৃষ্টি করেছে। সেই বিষয়ের নাম ইতিহাস।’

‘আমি আর এথেন্সের পোড়া চিহ্ন নিয়ে গর্ব করতে চাই না। আমি আমার এথেন্সকে নতুন করে বানাতে চাই। এক্রোপোলিসের ওপর সবকিছু নতুন করে বানাব। পার্থেনন হবে দেখার মতো জিনিস। পৃথিবীর মানুষ এথেন্সের জ্ঞানের কথা জানতে পারছে, বিদ্যার কথা শুনতে পারছে। আমি চাই, এই শহরের সৌন্দর্য দেখে সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে। সবাই বলবে, হ্যাঁ, এই হলো এথেন্স। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নগরী।’

আসপাশিয়া বলল, না না, তারা বলবে, এই হলো পেরিক্লিসের এথেন্স।

এতক্ষণে হো হো করে হেসে উঠলেন পেরিক্লিস। বললেন, তোমার চেয়ে আমাকে আর কেউ বেশি বোঝে না। আমি তাই চাই। আমি সত্যিই চাই, এথেন্সে এসে বলবে, এই হলো পেরিক্লিসের সুন্দরীতমা এথেন্স। আমার কিছু চমৎকার পরিকল্পনা মাথায় এসেছে। তোমাকে সেগুলো বলতে চাই। তোমাকে না বলে আমি কোনো কাজ করি না।

কথাটা যে সত্য তা আসপাশিয়া ভালো করেই জানে। কিন্তু সেটি বুঝতে দিলে প্রেমের খেলা পানসে হয়ে যায়। সে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, আমাকে না জানিয়ে কিছুই করেন না? এথেন্সের পুরুষেরা মেয়েদের কী চোখে দ্যাখে তা পৃথিবীর মানুষ জানে।

পেরিক্লিস বললেন, এখন নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলব না। এখন আমি আমার স্বপ্নের এথেন্সের কথা তোমাকে বলব। আমার জীবনের স্বপ্নের কথা বলব। কিন্তু গলাটা যে বড় শুকিয়ে গেছে।

আসপাশিয়া উঠতে যাচ্ছিল।

‘তোমাকে উঠতে হবে না। দাসীকে ডাক দাও। তুমি এখানে এসে বসো।’ পেরিক্লিস গদগদ গলায় বলতে শুরু করলেন, আমি স্বপ্ন দেখি— আমি এথেন্সের ইতিহাসে এক নতুন দিন আনব। সারা দুনিয়ার মানুষ, এথেন্সের নামে বিস্মিত হবে। দুনিয়ার মানুষ বলবে পৃথিবীর কোথাও এমন সুন্দর নগরী আগে আর হয়নি। পারস্য, মিশর, ব্যাবিলন, ভারত কোথাও এথেন্সের চেয়ে সুন্দর নগরী নেই। আর সেই কাজটা আমি শুরু করব পার্থেনন দিয়ে। আমি নতুন করে দেবী এথিনার মন্দির পার্থেনন বানাব। আমার পার্থেনন হবে পৃথিবীর সুন্দরতম ভবন। সেই ভবনে প্রবেশ করতে দেবী এথিনাও গর্বিত হবে।

‘হুঁম, প্রস্তাব ভালো। কিন্তু এত বিশাল কিছু বানানোর টাকা কই?’

‘এথেন্সের ভাণ্ডারে এখন অনেক টাকা।’

‘সেই টাকা এথেন্সের টাকা নয়। এই টাকা ডিলিয়ান জোটের’[৮১] টাকা। কয়েকশ নগরী এই টাকা এথেন্সের কাছে জমা রেখেছে। আবার যদি পারস্যের মতো কোনো বড় শক্তি আক্রমণ করে, সেই সময় এই টাকা দিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া হবে।

‘সেটি আমার মনে আছে। এই টাকা ডিলিয়ান জোটের টাকা। কিন্তু আমি মনে করি এথেন্সের অধিকার আছে এই টাকা নিয়ে নেওয়ার। এই টাকায়ই নতুন পার্থেনন হবে।’

আসপাশিয়ার বুক দুরু দুরু করে। সে জানে, তার প্রেমিক যখন বলেছে, তখন পার্থেনন করবেনই। পেরিক্লিস পিছু হটার লোক নন।

কিন্তু এই হঠাৎ আবেগে যেভাবে পেরিক্লিস বলছেন, সে ডিলিয়ান জোটের টাকা দিয়েই পার্থেনন বানাবে, সেটি অত সহজে হবে না। সংসদে ভোট হবে। এটি নীতির দিক থেকে অন্যায়। এথেন্সের নাগরিকরা ন্যায়ের পক্ষে। এমন অন্যায় কাজের পক্ষে তারা ভোট দেবে না।

তাছাড়া যেসব নগর টাকা রেখেছে এথেন্সে, তারা এই সিদ্ধান্ত মানবে না। পার্থেনন দেবী এথিনার মন্দির। দেবী এথিনা এথেন্সের দেবী। অন্য শহরগুলো এথিনাকে মানে না, তাদের আলাদা দেবতা আছে। তাহলে সেইসব নগর তাদের টাকার দাবি ছাড়তে রাজি হবে না। পেরিক্লিস যত সহজ ভাবছেন, তত সহজ হবে না বিষয়টি।

পেরিক্লিস গুরু এনাক্সাগোরাস আর গায়ক ডেমনকে ডাকলেন।

গুরু বললেন, ডিলিয়ান জোটের টাকা তুমি ব্যবহার করতে পার না। ডেমন বললেন, এই টাকা নিলে অন্য শহরগুলো ঝামেলা করবে। যুদ্ধও লাগতে পারে।

পেরিক্লিস হতাশ। আসপাশিয়া ঠিকই বলেছিল। ঐ টাকায় পার্থেনন করা যাবে না। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। তার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। চাপা কষ্টে তার কান্না আসছে।

কিছুক্ষণ পরে এক দাসী বলল, আপনার একটি চিঠি আছে।

পেরিক্লিস বললেন, রেখে দাও ওখানে।

দাসী বলল, এখুনি পড়তে বলেছেন। খুব জরুরি চিঠি।

চিঠি খুলেই চমকে উঠলেন পেরিক্লিস। চিঠিতে লেখা :

‘কেন ডিলিয়ান জোটের টাকায় দেবী এথিনার মন্দির’

প্রিয় ভাইয়েরা আমার, আমি চাই এথেন্স হোক এই সারা দুনিয়ার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর নগর। মানুষ এসে তাকিয়ে বলুক, হ্যাঁ, আমরা এমন একটি জায়গায় এসেছি, যেখানে জ্ঞান আর সৌন্দর্য একসাথে মিশে গেছে। আমরা আবার দেবী এথিনার মন্দির বানাব। এবার এমন করে বানাব যেন এর চেয়ে সুন্দর ভবন পৃথিবীতে আর নেই। এটি বানাতে টাকা লাগবে। সেই টাকা আসবে ডিলিয়ান জোটের টাকা থেকে। কারণ আমরাই ডিলিয়ান জোটের সব শহরকে রক্ষা করেছি। যেকোনো শহরের বিপদে এথেন্সই সেনা দেয়, জাহাজ দেয়। আমরাই জোটের সকল নগররাষ্ট্রকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছি। সেই দায়িত্ব এথেন্স আগেও পালন করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।

পুনশ্চ :

১. চিঠি পাঠ শেষে আমাকে ডাক দেবে।

২. কাল সকালে ফিডিয়াসকে ডেকে পার্থেননের নকশা শুরু করবে।

ইতি-
আসপাশিয়া

পেরিক্লিস পড়ছেন। আসপাশিয়া বক্তৃতা লিখে ফেলেছে। সংসদে পার্থেননের বিল উঠানোর জন্য ভাষণ লিখে দিয়েছে। তার মানে হলো আসপাশিয়া বলছে পার্থেনন করা যাবে। যখন অন্য সব বন্ধুরা তাকে নিষেধ করছে, তখন আসপাশিয়া বলছে— এগিয়ে যাও। পেরিক্লিসের মনের দ্বিধা চলে গেল। তিনি পার্থেনন বানাবেন।

ফিডিয়াসকে খবর দিতে হবে। সেই হবে নতুন এথেন্স বানানোর শিল্পী।

.

পেরিক্লিস ফিডিয়াসকে বললেন, তুমি তো রাস্তাঘাটে মূর্তি বানিয়ে বেড়াচ্ছ। এসব বাদ দাও। ভালো কিছু করো।

ফিডিয়াস বলল, আমি রাস্তাঘাটে মূর্তি বানাই? আমি ডেলফিতে এপোলো মন্দিরে মূর্তি বানিয়েছি। ম্যারাথনের প্রান্তরে বানিয়েছি।

‘আমি যা ভাবছি সেটির তুলনায় ওগুলো রাস্তাঘাটের কাজই।’

‘তুমি কী ভাবছ? তোমার নিজের মূর্তি বানাতে হবে?’

‘আমার মূর্তিও বানাবে। তবে সেটি পাথরের নয়, আমার মূর্তি বানিয়ে দেবে মানুষের মনে। মানুষ এথেন্সকে দেখবে, আর আমাকে মনে করবে।’

আজ পেরিক্লিস একটু বেশি সুরা পান করেছেন। তিনি কোনোদিনই অতিরিক্ত পান করেন না। কিন্তু আজ তিনি খুব উত্তেজিত। পার্থেনন বানানোর উত্তেজনায় তিনি কাঁপছেন।

ফিডিয়াস বলল, তোমার মূর্তি তো এথেন্সের মানুষের মনে এমনিতেই আছে। তোমার মতো এই রূপ, এমন যুদ্ধবিদ্যা, এমন ভাষণ এথেন্সের কোনো বীরের কখনো ছিল? তুমি যুদ্ধের মাঠে একিলিস, নেতৃত্বে জিউসের মতো তোমার মূর্তির দরকার হবে না।

‘হবে, ফিডিয়াস, হবে। আমি এমন কিছু করব যাতে শুধু এথেন্স নয়, সারা দুনিয়ার মানুষ পেরিক্লিসের মূর্তি তাদের মনে রেখে দেবে।’

‘খুলে বলো। কী চাও? অনেকক্ষণ ধরেই এলোমেলো বলছো।’

‘আমি এথেন্সকে বদলে দেব। এথেন্স হবে শিল্পের নগরী। এখন সারা দুনিয়ার জ্ঞানী মানুষরা এথেন্সে আসে জ্ঞানের জন্য। এরপর থেকে সারা পৃথিবীর মানুষ আসবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শিল্পকর্ম দেখতে। আমি এথেন্সকে এমন সুন্দর বানাতে চাই, যা পৃথিবীর কোথাও নেই। আমার ইচ্ছা পূরণ করবে তুমি।’

ফিডিয়াস ভালো করে তাকাল পেরিক্লিসের চোখের দিকে। এটি মাতালের প্রলাপ নয়। এটি সত্যিকারের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পেরিক্লিসের কথা। ফিডিয়াস যেন চোখের সামনে এক সাগর আলোর ঢেউ দেখতে পেল। এমন একটা কিছু শোনার জন্য সে অপেক্ষা করছে।

সে স্বপ্ন দেখত একদিন কোনো এক সম্রাট তাকে ডেকে বলবে, ‘ফিডিয়াস, এসো, আমার নগরীটি তোমার মনের মতো করে সাজিয়ে দাও।’ সম্রাটের কথা শুনে ফিডিয়াস তার মনের শিল্পরস মিশিয়ে একটি নগর বানাবে। সারা দুনিয়ার মানুষ দেখে বলবে এটি বানিয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা শিল্পী ফিডিয়াস। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আজ তার বন্ধু পেরিক্লিস সম্রাটের বেশে দাঁড়িয়েছেন।

আনন্দে তাইরে নাইরে করে উঠল ফিডিয়াস। জড়িয়ে ধরল পেরিক্লিসকে। আনন্দে আরও সুরা পান করতে ইচ্ছে করছে। সে দাসের হাত থেকে বিশাল এক পাত্র নিল। কোনোদিকে না তাকিয়ে কয়েক পাত্র ঢেলে দিল গলায়।

হঠাৎ তার সুরার পাত্র নিয়ে গেলেন পেরিক্লিস।

তিনি বললেন, ফিডিয়াস, আমি তোমাকে মাতাল হতে এখানে ডাকিনি। ডেকেছি কাজের জন্য। তুমি ভালো করেই জানো, আমি কাজের সময় মাতলামি একেবারেই পছন্দ করি না। অনেক খেয়েছ। এবার কথা শোন।

পেরিক্লিস বলতে লাগলেন, ফিডিয়াস, আমি নতুন করে পার্থেনন বানাব। এক্রোপোলিসের উপরে আগের জায়গায়ই হবে সেই পার্থেনন। এটি হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভবন। তোমার প্রতি আমার অনেক আশা ফিডিয়াস। আমি জানি, তুমি পারবে।

চোখ ডলতে ডলতে ফিডিয়াস উঠে দাঁড়াল। বলল, চলো, এখুনি জায়গা ঠিক করে ফেলি। তুমি ফিডিয়াসকে মাতাল বলেছ। ফিডিয়াসের হাত থেকে মদ কেড়ে নিয়েছ। সেই ফিডিয়াসই তোমাকে কথা দিচ্ছে, এমন জিনিস বানিয়ে দেব যে, সারা পৃথিবী তাকিয়ে রইবে, যুগ যুগ তাকিয়ে থাকবে। ঠিক আছে চলো— আজ রাতেই নকশা বানাব।

তেতে উঠেছে ফিডিয়াস। তার তেতে ওঠা ভালো লাগছে পেরিক্লিসের। সত্যিকার শিল্পীর জন্য জেদ ভীষণ কাজের। জেদের মুহূর্তেই একজন শিল্পী তার জীবনের সেরা কাজ করে।

পেরিক্লিস বললেন, চলো, পোড়া পার্থেননের পেছন দিকটায় চলো।

রাতের আঁধারে এক্রোপোলিসের উপরে দুই অর্ধ-মাতাল বন্ধু। একজন নেতা, অন্যজন শিল্পী। একজন স্বপ্নবান, আরেকজন কারিগর। দুই বন্ধু মিলে পোড়া পার্থেননের চারপাশের জায়গা মাপছেন

তাদেরকে মাপতে দেখে তিনজন দাস দৌড়ে এলো। ছিঃ ছিঃ দাস থাকতে তাদের মালিকরা এমন কষ্টের কাজ করছেন! মাপার রশি নিতে তারা হাত বাড়াল।

কিন্তু রে রে করে উঠল ফিডিয়াস। বলল, খবরদার, আর আগাবি না। দূরে থাক। এটি আমার কাজ, আমাকেই করতে দে। আমিই মাপব

পেরিক্লিস বুঝলেন, শিল্পী ক্ষেপেছে। না হলে এই মাপামাপির কাজ সে নিজ হাতে করত না।

রাত গভীর হচ্ছে। আকাশের শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ এজিয়ান সাগরের দিকে নেমে যাচ্ছে। তবুও ভ্রুক্ষেপ নেই ফিডিয়াসের। দাগ টানছে পেপিরাসের উপর। কাল সকালেই পেরিক্লিসের হাতে নকশা তুলে দেবে।

পেরিক্লিস ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছেন। পাগল ফিডিয়াস যে এমনভাবে কাজ করতে পারে, সেটি তিনি জানতেন না। শিল্পের নেশা যে এমন মারাত্মক হতে পারে, তার ধারণা ছিল না।

তার ভালো লাগছে। তার স্বপ্নের পার্থেনন তৈরির কাজ তাহলে শুরু হয়ে গেল। ফিডিয়াস তো বলছে, কাল সকালেই সে ডিজাইন দিয়ে দেবে। কিন্তু ফিডিয়াস তো আর তার পরিকল্পনার কথা জানেন না। পেরিক্লিস এই মন্দিরকে এমন করবেন যে, এর চারপাশের দেয়ালে সকল গ্রিক বীরের ভাস্কর্য থাকবে। হোমারের প্রতিটি চরিত্র খেলা করবে পার্থেননের দেয়ালে। সেকথা এখনও ফিডিয়াসকে বলা হয়নি। পাগলটা আগে ডিজাইন দিক, ভেতর আর বাইরের ডিজাইন। রং, মূর্তি এসবের কথা সময় হলেই ফিডিয়াসকে বলা যাবে

ফিডিয়াসকে আর একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়নি। অর্থের বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি। সেই আলাপ পরেও করা যাবে। শিল্পীকে অর্থের চিন্তায় আনার দরকার নেই। সেই চিন্তা পেরিক্লিস একাই করবেন। আর যদি কেউ করে, সে হলো আসপাশিয়া। কালই সংসদে পেরিক্লিস পার্থেননের প্রস্তাব করবেন।

.

পরদিন খুব সকালে সক্রেটিসের কাছে খবর পাঠিয়েছে আসপাশিয়া। খুব করে অনুরোধ করেছে সক্রেটিসকে সংসদে যেতে। আজ সংসদে পেরিক্লিস নতুন করে পার্থেনন বানানোর প্রস্তাব করবেন। সক্রেটিস যেন তার বন্ধুদের নিয়ে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। আসপাশিয়া জানে, সক্রেটিস কোনোদিন ভোটাভুটিতে যায় না। এসব তার কাছে ছেলেখেলা মনে হয়। তবু আসপাশিয়ার বিশেষ অনুরোধ, আজ যেতেই হবে। সক্রেটিস যেন তার বাবাকেও বলে, বাবা যেন তার লোকজন নিয়ে ভোট দিতে আসে। সক্রেটিসের বাবা রাজমিস্ত্রি। আসপাশিয়া জানে— নতুন পার্থেনন বানানোর খবরে তাদের পরিবার খুশি হবে। নতুন কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সক্রেটিস ঠিক সময়ে পিনিক্স পাহাড়ের উপর সংসদে হাজির হলো। তার সাথে তাদের মহল্লার অনেকেই আছে।

খোলা আকাশের নিচে সংসদ লোকে লোকারণ্য। হাজার হাজার মানুষ। এরা সবাই ভোটার। চিৎকার চেঁচামেচিতে কথাই শোনা যায় না।

পেরিক্লিস দুটি প্রস্তাব করলেন। এক. নতুন করে পার্থেনন বানানো হবে, দুই. এথেন্স সরকারের এত টাকা নেই, সেজন্য ডিলিয়ান জোটের টাকা দিয়ে বানানো হবে।

মানুষ অবাক। কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি যে, এমন প্রস্তাব করবেন পেরিক্লিস। তারা জানে, পারস্য যুদ্ধের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, আর কোনোদিন পার্থেনন বানানো হবে না। পেরিক্লিস আগের নেতাদের সব সিদ্ধান্ত পাল্টে দিতে চাচ্ছেন। তিনি কাজটা ঠিক করছেন না। সব নেতা পেরিক্লিসের প্রস্তাবের বিপক্ষে। শুরু হলো বক্তৃতা। প্রস্তাবের বিপক্ষে বক্তৃতা।

পেরিক্লিস আবার মঞ্চে উঠলেন। আসপাশিয়ার লেখা বক্তৃতাটা তার মুখস্থ। অনেক দরদ দিয়ে তিনি বক্তৃতা করলেন। তিনি ভেবেছিলেন কাজ হয়ে গেছে। কিন্তু না, কাজ হয়নি। তার প্রথম প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। দ্বিতীয় প্রস্তাব মানছে না।

বিপক্ষের লোকজন বলল, নতুন পার্থেনন বানাবেন সেটি মেনে নিলাম। কিন্তু ডিলিয়ান জোটের টাকা নেওয়া যাবে না। এটি অন্যায়। অন্য শহরের টাকা জোর করে নেওয়া যাবে না। এথেন্স সাম্রাজ্য নয়, এথেন্স হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে অন্যায় করা যায় না।

সক্রেটিস দেখল, মানুষ যেভাবে না না করছে, তাতে ভোট হলে নিশ্চিত পেরিক্লিস হারবে। জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই। নতুন পার্থেনন হবে না। পেরিক্লিসের স্বপ্ন পূরণ হবে না।

হঠাৎ করে পেরিক্লিস হুংকার দিলেন, ভাইয়েরা আমার।

লোকজন সব চুপ। পেরিক্লিস এত জোরে কখনো কথা বলেন না। তিনি কাঁপছেন। এতদিন তিনি যা চেয়েছেন, মানুষ শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করেছে, আজ সবাই না না করছে। তিনি ‘না’ শুনতে অভ্যস্ত নন। তিনি কাঁপছেন।

পেরিক্লিস হাত উঁচিয়ে বললেন, কাউকে টাকা দিতে হবে না। ডিলিয়ান জোটের টাকা আমি নেব না। কিন্তু আমি পার্থেনন বানাব। আমি নিজে টাকা দেব। আমার যত সম্পদ আছে সব আজই বিক্রি করে দেব। আমার টাকায় পার্থেনন হবে। শুধু পার্থেনন নয়, আমি নিজের টাকায় এথেন্সের চেহারা বদলে দেব। সারা এক্রোপোলিস আর আগোরা নতুন করে বানাব। মানুষ এসে দেখবে এথেন্স কত সুন্দর। তবে একটি শর্ত : আমার নিজের টাকায় সবকিছু বানাব, সেজন্য সবকিছু হবে আমার নামে। সব ভবনের গায়ে লেখা থাকবে পেরিক্লিস। বলুন আপনারা রাজি কিনা?

সারা পিনিক্স পাহাড় চুপ। নিশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে না।

হঠাৎ বিরোধী পক্ষের একজন মঞ্চে এসে বলল, এথেন্স কারও একলার সম্পত্তি নয়, কারও নিজের নামে এখানে কিচ্ছু হবে না। ঠিক আছে ডিলিয়ান জোটের টাকা দিয়েই সব কাজ হোক। চলুন, আমরা নতুন এথেন্স বানাই।

পেরিক্লিস হাসি দিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন। ভোটে পেরিক্লিসের প্রস্তাব পাস হয়ে গেল‍।[৮২]

সক্রেটিস অনেকক্ষণ পেরিক্লিসের দিকে তাকিয়ে থাকল। সে পেরিক্লিসের এই রূপ আগে দেখেনি। লোকটির মাথায় যে বুদ্ধি আছে, আর দরকার হলে তিনি কীভাবে ব্যবহার করতে পারেন ভেবে অবাক হলো সক্রেটিস। নেতা হতে আলাদা যেসব গুণ দরকার, সেটি পেরিক্লিসের আছে।

সারা এথেন্সে খবর ছড়িয়ে গেল পার্থেনন হবে। আবার পার্থেনন হবে। দেবী এথিনার জন্য মন্দির হবে। বিশাল করে হবে। মানুষ খুব খুশি।

সবচেয়ে বেশি খুশি ভাস্কর ফিডিয়াস।

***

৮১. পারস্যের আক্রমণ রুখতে এথেন্সের নেতৃত্বে গ্রিসের অনেকগুলো নগররাষ্ট্র ৪৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একটি জোট করে। এর সদর দপ্তর ছিল দেবতা এপোলোর জন্মস্থান ডিলস দ্বীপে। তাই এই জোটকে ডিলিয়ান জোট (Delian League) বলা হয়। সব নগরী প্রতি বছর চাঁদা দিত, সেই টাকা এই দ্বীপে জমা থাকত।

৮২. ৪৫৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স ডিলিয়ান জোটের (Delian League) অর্থ ডিলস দ্বীপ থেকে এথেন্সে নিয়ে আসে। সেই অর্থেই এথেন্সের বিখ্যাত পার্থেনন মন্দির বানানো হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *