২৬
‘Contentment is natural wealth, luxury is artificial poverty.’
—Socrates
***
হেরোডোটাস এথেন্স থেকে চলে যাচ্ছেন।
তিনি থুরিল নগরে বাড়ি করেছেন। সেখানেই স্থায়ী হবেন। সেখানে বসে বই লিখবেন। তার বিদায় উপলক্ষে পেরিক্লিস ডিনারের আয়োজন করেছেন। ডিনার শেষ হয়ে গেছে। অতিথিরা চলে গেছেন। কিন্তু সফোক্লিস উঠছেন না। তার জন্য হেরোডোটাসও উঠতে পারছেন না।
সফোক্লিস বসে বসে পান করছেন। এক চুমুকে এক পাত্র সুরা শেষ করছেন। শেষ হওয়ামাত্রই মাটির পাত্রটা ছুড়ে ফেলে আরেক পাত্র ধরছেন। ঢালতে একটু দেরি হলেই দাসদের ধমক দিচ্ছেন। পেরিক্লিসের বাড়িতে এমন কেউ করে না। দাসেরা সবাই ভয়ে কাঁপছে। কিন্তু সফোক্লিসের কোনো হেলদোল নেই। মনে হচ্ছে দাসদের ভয় দেখিয়ে তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। নিষ্ঠুর আনন্দ। তার চোখ লাল টকটকে। মাথা ঝিমুচ্ছে। পা টলছে। তবু থামছেন না।
পেরিক্লিস একবার বলেছিলেন, নেশায় আকাশে উঠে যাচ্ছ। আর একটু হলে আকাশ থেকে আর নামতে পারবে না।
সফোক্লিস মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছেন, কী বললে, আমি বেশি খাচ্ছি? তোমার জিনিস শেষ করে দিচ্ছি? কয় গেলাস বেশি খাচ্ছি হিসাব রাখো। তোমাকে পই পই করে পয়সা দিয়ে যাব। বাড়িতে দাওয়াত করে শেষে খোটা দিচ্ছ!
পেরিক্লিস লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে গেছেন। আসপাশিয়া ঘরের ভেতরে সরে পড়েছে। হেরোডোটাস এখনও সফোক্লিসের বাড়িতে থাকেন, তার যাওয়ার উপায় নেই। অপেক্ষা করতেই হবে।
সফোক্লিস পান করছেন আর রক্ত চোখে হেরোডোটাসের দিকে তাকাচ্ছেন।
হেরোডোটাস ভয় পেয়ে বলল, জনাব, ভুল-চুক কিছু করেছি?
সফোক্লিস বললেন, তুমি বই লিখবে? ম্যারাথনের কাহিনি লিখবে? পারস্যকে হারানো নিয়ে লিখবে?
হেরোডোটাস আরও ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি নিষেধ করলে লিখব না। তবু আপনি রাগ করবেন না।
হাতের পাত্রটা এক চুমুকে খালি করে চেঁচিয়ে উঠলেন সফোক্লিস, শোন হেরোডোটাস, তুমিই প্রথম নও। ম্যারাথন আর পারস্য যুদ্ধের কাহিনি নিয়ে আমরা অনেক কিছু লিখেছি।
হেরোডোটাস আগ্রহ নিয়ে তাকাল।
সফোক্লিস বললেন, পারস্য যুদ্ধের কাহিনি নিয়ে খুব চমৎকার একটি নাটক লেখেন নাট্যকার এস্কিলাস, নাম দেন ‘পারস্য’[৭৭]। এটিই আমাদের প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি। এটি লেখার জন্যই আমরা এস্কিলাসকে বলি গ্রিক ট্র্যাজেডির জনক।
হেরোডোটাসের চোখ চকচক করে উঠল। সে নতুন কিছু শুনছে।
সফোক্লিস জড়ানো গলায় বলছেন, এস্কিলাস ছিলেন যোদ্ধা। ম্যারাথন ও সালামিনাসের যুদ্ধে পারস্যের বিরুদ্ধে সে লড়াই করেছেন। তার ভাই মারা যান ম্যারাথনের ময়দানে। সেজন্য এস্কিলাসের মনে এই যুদ্ধ আনন্দের স্মৃতি আবার বেদনারও স্মৃতি। তার ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতো’ এই কাহিনি। তাই পারস্য বাহিনী যখন গ্রিস থেকে পালিয়ে গেল, তখনই এস্কিলাস লিখে ফেললেন ট্র্যাজেডি নাটক ‘পারস্য’। সেই নাটক অভিনয় করার ব্যবস্থা করেছিলেন আমাদের পেরিক্লিস। তখন ও এক্কেবারে তরুণ। নেতা হওয়ার বয়সও হয়নি। সে নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে নাটকটা মঞ্চে আনলো।
পেরিক্লিসের দিকে মুখ করে সফোক্লিস জড়ানো গলায় বললেন, পেরিক্লিস, তুমি সেই ঘটনা বলতে পার।
পেরিক্লিস মুখ খুললেন না। হাসি দিয়ে চুপ করে রইলেন। নিজের সুখ্যাতি অন্যের মুখে শুনতেই বেশি ভালো লাগে।
বাইরে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইউরোপে গরমের দিনে বৃষ্টি হয় না। কিন্তু আজ শুরু হয়েছে। বাইরে রিমঝিম শব্দ, ভেতরে বীণার টুংটাং। মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দে বাতাস বইছে। রহস্যময় পরিবেশ। নেশা নেশা লাগছে। সফোক্লিস মনে হয় জানতেন, একটু পরে বৃষ্টি হবে। তাই তিনি ইচ্ছে করেই অমন নেশা করেছিলেন।
আসপাশিয়াও এসে বসেছে পেরিক্লিসের পাশে। বৃষ্টি আরও বেড়েছে। তুমুল বৃষ্টিমাখা রাতে আবছা আলোয় তিনজন যুবক-যুবতির কাছে এথেন্সের ট্র্যাজেডি শুরুর কথা বলছেন সফোক্লিস। তিনি নিজে নাট্যকার। গল্প বলতে একেবারে নাটকের পরিবেশ বানিয়ে নিয়েছেন। ফিসফিস করে বলছেন—
তখন গ্রিস আর পারস্যের যুদ্ধ শেষ হয়েছে কয়েক বছর হলো। আজকের মতো এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল এস্কিলাসের। তিনি স্বপ্ন দেখছেন, যুদ্ধের স্বপ্ন। তিনি ছটফট করছেন। তাঁর মনে হচ্ছে তিনি ম্যারাথন যুদ্ধের কথা মনে করতে পারছেন না। বারবার মনে করতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ধরফর করে বিছানা ছেড়ে উঠে চোখে পানি দিলেন, ধীরে ধীরে সব মনে পড়ল। কিন্তু এই স্বপ্ন তাকে চিন্তায় ফেলল। তার মনে হলো— মানুষ সত্যিই ম্যারাথন যুদ্ধের কথা ভুলে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের অমন বিস্ময়কর দিনের কথা কেউ মনে রাখছে না। তিনি তক্ষুনি পেপিরাস নিলেন। ঘচাঘচ লিখতে আরম্ভ করলেন। সারা রাত লিখলেন। ভোর হতেই এক দৌড়ে চলে এলেন তরুণ পেরিক্লিসের কাছে। পেরিক্লিসকে ভীষণ পছন্দ করতেন এস্কিলাস। তরুণ পেরিক্লিসও আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বলল, ‘আপনি লিখে ফেলুন। ঝাক্কাস করে লিখুন। সামনের ডিওনিসাসের উৎসবে অভিনয় হবে। যত টাকা লাগে, আমি দেব।’ এস্কিলাস বললেন, ‘এথেন্সের নাটক তো সব দেব-দেবীর কাহিনি। মানুষের কাহিনি নিয়ে নাটক করলে লোকে সেটি মানবে?’ পেরিক্লিস বলল, ‘অনেক হয়েছে দেব-দেবী আর পুরনো রাজাদের কাহিনি। এবার নিজেদের কথা লিখুন। সেটিই হবে আমাদের নাটক।’ সেই রাতে ঘুমালেন না এস্কিলাস। সারা রাত জেগে লিখলেন। আবেগে উত্তেজনায় কয়েক দিনে লিখে ফেললেন নতুন নাটক, নাম ‘পারস্য’। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের ঘটনা নিয়ে সেই হলো প্রথম নাটক। এটিই প্রথম গ্রিক ট্র্যাজেডি।
হেরোডোটাস মুগ্ধ হয়ে শুনছে। সে এথেন্সে থিয়েটার শুরুর ঘটনা জানে, কিন্তু প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি কীভাবে লেখা হয়, সেটি জানে না।
হেরোডোটাস বলল, বাহ, এই ঘটনা তো জানতাম না। আমি তো ভাবতাম আমি এথেন্সের সবকিছু জানি। এখন তো দেখছি, অনেক কিছুই জানি না। তো বুঝলাম, গ্রিস-পারস্য যুদ্ধ নিয়ে এস্কিলাস লেখেন প্রথম সার্থক গ্রিক ট্র্যাজেডি ‘পারস্য’! তো কী আছে ঐ নাটকে?
সফোক্লিস বললেন, নাটকটি এস্কিলাস একেবারে নতুন ঢঙে সাজিয়েছিলেন। শুরু করেছেন অন্যরকম করে। কাহিনি এরকম :
পারস্য দ্বিতীয়বার এথেন্স আক্রমণে গেছে। রাজা জেক্সি দেশের সব ছেলেকে নিয়ে যুদ্ধে গেছে। দেশ খালি। তার মা পারস্যের রানি আতোসা ছেলের জন্য কষ্ট পাচ্ছেন, মায়ের মন হুঁ হুঁ করছে। তিনি সভাসদদের ডেকে আলাপ করছেন। এখানে রানির মুখে দিলেন বিখ্যাত সংলাপ–
‘ভোগ করার মানুষ না থাকলে দুনিয়া ভরা সম্পদও কোনো কাজে আসে না— তখন সম্পদ আর আবর্জনায় কোনো তফাৎ নেই। আবার পর্যাপ্ত ধন- সম্পদ না থাকলে, শুধু যোগ্যতা দিয়ে ভাগ্যদেবী সহায় হতে পারেন না।’
সংলাপটি খুব গভীর, মনকে নাড়া দেয়। সেদিন থিয়েটারের দর্শকদের মনকেও নাড়া দিয়েছিল। তারা চিৎকার করে বলছিল— আহা, কী শোনালে! মন যে জুড়িয়ে গেল।
এরপর নাটকে একটি স্বপ্নের দৃশ্য। পৃথিবীতে কোনো নাটকে স্বপ্ন-দৃশ্য এটিই প্রথম। রানি সভাসদদের বললেন, আমি চারদিকে কুলক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। রাতের পর রাত স্বপ্ন দেখছি, আজেবাজে সব কুস্বপ্ন। কাল রাতে যেটি দেখলাম, সেটি খুবই ভয়ংকর। দেখলাম দুটি খুব সুন্দর মেয়ে ঝগড়া করছে, একটি মেয়ে পারস্যের, অন্যটি গ্রিক। তাদের ঝগড়া থামাতে আমার ছেলে তাদেরকে তার রথ চালাতে বলল। একটি মেয়ে কথা শুনল, অন্য মেয়েটি শুনল না। হঠাৎ দ্বিতীয় মেয়েটি খুব জোরে রথের রশি নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল, এত জোরে যে, রথের দড়ি ছিঁড়ে গেল, আমার ছেলে রথ উল্টে পড়ে গেল, জামা-টামা ছিঁড়ে একাকার। রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে, তার বাবা বড় রাজা তার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছেন। এরকম স্বপ্ন দেখে আমার মনে খালি কু-ডাক ডাকছে। কেন এমন হচ্ছে? তোমরা এর কারণ বের করো। এমন স্বপ্নদৃশ্যের পরে নাটকে এথেন্সের গণতন্ত্রের কথা নিয়ে এলেন নাট্যকার। রানি আর কোরাসের দল গানের ছন্দে ছন্দে বলছে এথেন্সের গণতন্ত্র কেমন চমৎকার :
রানি বললেন, আচ্ছা— এথেন্স কোথায়?
‘ঐ পশ্চিমে দেখা যায়,
যেখানে আকাশের সূর্য সাগরের জলে দোল খায়।’
‘আমার ছেলে কি এথেন্স কব্জা করতে চায়?’
‘জি, হ্যাঁ, রানিমাতা, এথেন্সকে পেলেই পুরো গ্রিস তার হয়।’
‘এথেন্সের কি অনেক সৈন্য?’
‘না, সেনা সংখ্যা খুবই নগণ্য।’
‘ওরা কি তীর চালায়?’
‘তীর নয়-
এক হাতে বর্শা, অন্য হাতে ঢাল নেয়।’
‘তাহলে এত ভালো যুদ্ধ করে কেমনে?
কে চালায় সেনা- রাজা কে?’
‘ওদের নেই কোনো রাজা,
কেউ নয় কারও প্রজা।’
‘মানেটা কী হলো তাহলে!
দেশটা কীভাবে চলে?’
‘ওরা সবাই রাজা, নিজের কথা নিজেই বলে।’
‘আর একটু বলবে নাকি খুলে?’
‘ওরা-
নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেয়
লড়াই করে নগর বাঁচায়
ওদের নেই ভাড়াটে সৈন্য
নিজের যুদ্ধে নিজেই অনন্য
কেউ নয় রাজা, নয়তো প্রজা, সবাই নাগরিক
এক আইন দিয়ে চলছে নগর, শান্তি চারিদিক।’[৭৮]
এই পর্যন্ত বলে থামলেন সফোক্লিস।
আর এক পাত্র সুরা নিয়ে ঢুলুঢুলু চোখে বললেন, লক্ষ করো হেরোডোটাস, এখানে এস্কিলাস কেমন চমৎকারভাবে এথেন্সের গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। এখানে কেউ কারও প্রজা নয়, সবাই সমান। এই নাটকের আগে সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারেনি— কোন জাদুবলে এত অল্প সেনা নিয়েও এথেন্স হারিয়ে দিল বিশাল পারস্যকে। এস্কিলাস বুঝেছিলেন, কারণ হলো গণতন্ত্র। এথেন্সের মানুষ নিজে ভোট দিয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে লড়েছে, তারা পারস্যের বাহিনীর মতো টাকায় ভাড়াখাটা সৈনিক নয়। সেজন্য জিতেছে। এই কথাটা এস্কিলাস ভরা থিয়েটারে নাটকের সংলাপে বললেন। মানুষ বুঝতে পারল গণতন্ত্রের শক্তি কী! হেরোডোটাস, তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না, মানুষের সে কী মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া! এই নাটক থেকেই এথেন্সের লোকের মনে ঢুকে গেছে যে, আমাদের গণতন্ত্র একটি মহান জিনিস, আমরা যে করেই হোক গণতন্ত্র ধরে রাখব।
হেরোডোটাস বলল, আমি আমার বক্তৃতায় সেটিই বলেছি। আমার বইতেও একথাই লিখব।
সফোক্লিস বললেন, আবার ‘পারস্য’ নাটকের কাহিনিতে ফিরে যাই। রানি এথেন্সের কথা শুনছিলেন। এমন সময় দূত এসে খবর দিল— ‘পারস্য হেরে গেছে, সব জাহাজ ডুবে গেছে, পারস্যের হাজার হাজার সেনা সাগরে ভেসে গেছে। রাজা ড্রেক্সি কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে’। সবাই বলছে, ‘কেন এমন হলো? কেন আমরা হারলাম? আমাদের এমন বিশাল বাহিনী কীভাবে হারল?’ রাজসভার লোকজন ঠিক করল, এর ব্যাখ্যা দিতে আমরা পরলোকগত বড় রাজা দারিয়ুসের আত্মাকে ডাকব। তার আত্মাই পরাজয়ের কারণ বলতে পারবে। মন্ত্রের জোরে বড় রাজা দারিয়ুসের আত্মা এলো। আত্মা বললেন ‘হারের কারণ আমার ছেলের অহংকার। কোথায় থামতে হবে, সেটি ও জানে না। সেজন্যেই হেরে গেছে। পরাজয়ের কারণ রাজার হুব্রিস’।
হেরোডোটাস বলল, হুব্রিস[৭৯] বা সীমাহীন অহংকার! সবাই বলে, ট্র্যাজেডির মূল বিষয় হলো হুব্রিস, ট্র্যাজেডিতে নায়কের পতনের কারণ হুব্রিস। এখন যত ট্র্যাজেডি লেখা হচ্ছে, সবগুলোর মূল থিম হুব্রিস। এটি কি এস্কিলাসই ঠিক করে দেন?
সফোক্লিস বললেন, মোটামুটি তাই। তার আগে হোমারের লেখায়ও কিছু কিছু হুব্রিস ধরনের কাহিনি পাওয়া যায়। তবে এই ‘পারস্য’ নাটকটিকেই আমরা বলি প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি। এই নাটকের সংলাপে নাট্যকার সরাসরি বলে দিলেন, পারস্যের পতনের কারণ হুব্রিস। সেই থেকে আমরা সবাই নায়কের হুব্রিসকে কেন্দ্র করে নাটক লিখি। দর্শকরাও খুবই পছন্দ করে। হুব্রিস ব্যাপারটা বোঝাতে এস্কিলাস চমৎকার কথা বলেছেন। হুব্রিস নিয়ে তার চেয়ে ভালো করে অন্য কেউ বলতে পারেননি। অপূর্ব শিল্পমাখা কথায় তিনি বললেন :
‘একদিন যাকে মরতে হবে, সে যেন সীমা ছাড়িয়ে না যায়। মানুষের সীমাহীন অহংকারের ফুল একদিন আত্মপ্রবঞ্চনার ফল হয়ে ওঠে, আর সেই ফল কুড়াতে গেলে কান্না ছাড়া অন্য কিছুই পাওয়া যায় না।’
হেরোডোটাস বলল, চমৎকার।
সফোক্লিস বললেন, ‘পারস্য’ নাটকে হুব্রিসের উদাহরণ দিতে পারস্যের রাজা দারিয়ুসের আত্মা বললেন, আমার ছেলে হেলেসপন্ট[৮০] পার হয়েছে, বসফোরাস প্রণালির উপর সেতু তৈরি করেছে, পানির দেবতা পোসাইডন রাগ করেছে, তাই সাগরের যুদ্ধে আমাদের সব জাহাজ ডুবে গেছে।
নাটকে রাজা দারিউসের আত্মা তার ছেলেকে বলছেন, জীবনে আর যাই করো— কোনদিন এথেন্সের দিকে তাকিও না। কথাটা মনে রেখো, যদি কোনোদিন কোনো দেবতা এসেও বলে, তবু গ্রিস দখল করতে যেও না। পৃথিবী দেবী ওদের পক্ষে
হেরোডোটাস বলল, এই সংলাপ শুনে এথেন্সের দর্শকদের হাততালিতে ফেটে পড়ার কথা। দেশপ্রেম জেগে ওঠার কথা। এথেন্স নিয়ে গর্বে বুক ফুলে ওঠার কথা।
সফোক্লিস বললেন, সেটিই হয়েছে। তো নাটকের শেষটা শোন, সেখানে আরও বেশি দেশপ্রেমের কথা। নাটকের শেষ দৃশ্যে পারস্যের পরাজিত রাজা ড্রেক্সি দেশে ফিরে এলো ছেঁড়া পোশাকে। সে কাঁদছে। বিলাপ করে কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে বলছে ‘কষ্ট, ভীষণ কষ্ট! আমার হাতের মুঠোর জয় ছিনিয়ে নিয়েছে গ্রিকরা। আমি যতবার এথেন্সের দিকে তাকাই, ততবারই আমার কান্না পায়। বেদনা, আমার চারিদিকে বেদনা! বেদনায় বুক ফেটে যায়।’
সফোক্লিস বললেন, ভেবে দেখো হেরোডোটাস, মঞ্চে পারস্যের রাজা শোকে মাতম করছে, আর সকল দর্শক হাসছে, তারা চিৎকার করে বলছে, কাঁদো, আকাশ ফাটিয়ে কাঁদো। আর কোনোদিন এথেন্স আক্রমণে এসো না। ট্র্যাজেডির সমাপ্তিতে দর্শকরা হাসে, এমন জিনিস খুব কম হয়। এই নাটকের কাহিনির স্থান গ্রিস নয়, পারস্যের রাজদরবার। আমরা খুব পছন্দ করলাম নাটকটি। একটি সত্যিকারের শিল্পকর্ম আমরা পেলাম। আমরা তরুণরা সবাই এস্কিলাসের মতো লিখতে চাইলাম। তিনি হয়ে গেলেন ট্র্যাজেডির গুরু। আমাদের নাটকের কাহিনিতে নতুনত্ব এলো। দেব-দেবীর জায়গায় মানুষ নিজে হয়ে গেল মূল চরিত্র। সেই মানুষ গভীর দুঃখ পাচ্ছে, লোভের কারণে তার পতন হচ্ছে।
.
এতক্ষণ একটি কথাও বলেননি পেরিক্লিস। হঠাৎ বললেন, মজার কথা হলো— এই নাটকের কয়েক বছর পরেই এথেন্সের থিয়েটারে এলো আরেক মহা প্রতিভাধর নাট্যকার। সে হারিয়ে দিল এস্কিলাসকে। বলো তো সে কে?
আসপাশিয়া বলল, তিনি আমাদের সামনে বসে আছেন, এথেন্সের মধুকর সফোক্লিস।
সফোক্লিস লজ্জা পেলেন। তিনি বললেন, তো সেই শুরু, এরপর একের পর এক সুন্দর সুন্দর ট্র্যাজেডি লিখতে শুরু করলাম আমরা। আমি লেখা শুরু করলাম। আমি এস্কিলাসকে হারিয়ে প্রথম হয়ে গেলাম। আমি তাকে হারালেও তিনিই আমাদের নাট্যগুরু।
রাত এগিয়ে চলছে। বাইরে বৃষ্টি আরও বেড়েছে। সবার চোখ ঢুলুঢুলু। ঘুমে আর নেশায় টলমল।
হেরোডোটাস জড়ানো গলায় বলল, তা এস্কিলাস এখন কোথায়? তিনি এলেন না?
সফোক্লিস বললেন, তার আসা সম্ভব নয়। তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। হেরোডোটাস দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, আমার কপাল মন্দ। এথেন্সে এলাম আর এমন একজন মানুষকে দেখতে পেলাম না।
বাইরে বৃষ্টি আরও বেড়েছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ জ্বলে উঠছে পুব আকাশে। হঠাৎ মৃদু স্বরে আসপাশিয়া বলল, এস্কিলাসের অনেক কথাই বললেন। কিন্তু আসল কথাটা বাদ দিলেন।
সফোক্লিস রক্ত চোখে তাকালেন আসপাশিয়ার দিকে।
আসপাশিয়া বলল, এস্কিলাসকে যে মেরে ফেলতে চেয়েছিল এথেন্সের মানুষ, সেই কথা।
সফোক্লিসের মুখ থমথমে। তিনি দুঃখের কথা বলতে চান না।
আসপাশিয়া বলল, এথেন্সের মানুষের অমানবিক দিকটাও হেরোডোটাসকে জানতে হবে।
হেরোডোটাস বলল, হ্যাঁ, সবটাই তো জানতে চাই। বই লিখতে হলে আগা-গোড়া জেনেই বসতে হবে। বলুন, আমার জানা দরকার।
সফোক্লিস বললেন, ঠিক আছে। শোনো তাহলে :
লেখার জন্য মরতে বসেছিলেন এস্কিলাস। এথেন্সের মানুষ তাকে মঞ্চেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমাদের গণতন্ত্র অনেক ভালো, অনেক মহান কিন্তু এক জায়গায় বড় খারাপ। বড় অসহিষ্ণু। দেবতাদের নিয়ে কিছু বললেই ভয়ংকর রকম ক্ষেপে যায়। তাতে ধর্ম নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে কোনো মানবতা নেই, ভীষণ অমানবিক। তো ঘটনা হলো— এস্কিলাস একটি নাটক লেখেন, দেবী দিমিত্রার উদ্দেশ্যে এথেন্সের মেয়েদের গোপন একটি আচার নিয়ে কাহিনি। মেয়েদের এই অনুষ্ঠান নিয়ে এথেন্সে কথা বলা নিষেধ। তাতে দেবতাদের অপমান হয়। কিন্তু দুঃসাহস করে সেই গোপন অনুষ্ঠান নিয়েই নাটক লিখে ফেললেন এস্কিলাস। মঞ্চে অভিনয় করছিলেন তিনি। দেবীর কাছে মেয়েরা যেসব হাস্যকর আচার করে, মেয়ে সেজে মজা করে সেসব দেখাচ্ছিলেন। হঠাৎ ক্ষেপে উঠল পুরোহিতরা। বলল, ‘নাট্যকার অধর্ম করছেন। পবিত্র গোপন অনুষ্ঠান নিয়ে মশকরা করছেন। ধর্ ওরে।’ দর্শকরা হুংকার দিয়ে উঠল। নাট্যকারকে পাথর মারতে শুরু করল। ধব্ ধর্ বলে উঠে এলো মঞ্চে। সেখানেই তাকে খুন করে ফেলবে। দৌড়ে গিয়ে দেবীর মূর্তির পেছনে আশ্রয় নিলেন নাট্যকার। পেরিক্লিস অনেক কষ্টে তাকে রক্ষা করেন। বলেন, ‘আমরা তার বিচার করব। এক্ষুনি বন্দি করা হোক নাট্যকারকে।’ বিচার হলো এস্কিলাসের। কঠিন শাস্তি হওয়ার কথা। কিন্তু আদালতে তিনি আর তার ভাই অনেক কেঁদে কেঁদে এথেন্সের জন্য তাদের পরিবারের ত্যাগের কথা বললেন। তার পরিবার ম্যারাথন আর সালামিসের যুদ্ধে এথেন্সের জন্য লড়েছে। তার এক ভাই শহিদ হয়েছে। তারা এথেন্সকে সেবা করেছেন আজীবন। আদালতে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পান নাট্যকার
।
হেরোডোটাসের মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, তিনি ট্র্যাজেডির লেখক। তার নিজের জীবনও তো বিরাট ট্র্যাজেডি।
আসপাশিয়া বলল, এর চেয়েও বড় ট্র্যাজেডি তার মৃত্যু।
সফোক্লিস বললেন, হুঁম, শোনো তাহলে। ডেলফির ওরাকল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন— নাট্যকারের মৃত্যু হবে উপর থেকে কিছু একটা মাথার উপর পড়ে। সেজন্য তিনি ঘরে থাকা বাদ দিলেন। যদি ঘরের ছাদ মাথায় ভেঙে পড়ে, এই ভয়ে সব সময় খোলা আকাশের নিচে থাকতেন। রাতে ঘুমাতেনও খোলা আকাশের নিচে। তো একদিন একটি ঈগল পাখি মুখে কচ্ছপের খোল নিয়ে অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পাখির মুখ থেকে সেই খোল সরাসরি পড়ল নাট্যকারের মাথায়। সাথে সাথেই মৃত্যু হলো মহান কবি ও নাট্যকারের। ভয়ংকর ট্র্যাজিডি দিয়েই জীবন শেষ হয় ট্র্যাজেডির জনকের।
এমন মহান লেখকের এরকম করুণ মৃত্যুতে সবার মুখ বেদনায় অন্ধকার হয়ে উঠেছে। হেরোডোটাস দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পেরিক্লিসের চোখ ছলছল করছে। তার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন এস্কিলাস।
তখনও আকাশ কাঁদছে। মেঘের রাজ্য থেকে ধীর লয়ে নামছে কান্নার ঝুমঝুম শব্দ। আসপাশিয়া আকাশের দিকে তাকাল। বৃষ্টিস্নাত রাতের নিকষ কালো মেঘে ঢাকা আকাশে তারা হয়ে জ্বলে ওঠেননি এস্কিলাস। শুধু তার জন্য কষ্টের পদাবলি হয়ে আকাশ থেকে ঝরঝর করে নামছে বিন্দু বিন্দু দুঃখ।
***
৭৭. প্রথম সার্থক গ্রিক ট্রাজেডির নাম ‘পারস্য’ (The Persians), খ্রি. পূ. ৪৭২ অব্দে গ্রিক ট্রাজেডির জনক এস্কিলাস এটি রচনা করেন। স্পন্সর করেন পেরিক্লিস।
৭৮. ‘The Persians’ নাটকটিকে ইংরেজিতে Janet Lembke & C. J. Herington যে অনুবাদ করেন, আমি সেটি থেকে অনুবাদ করেছি। এই অধ্যায়ে নাটকটির যে হুবহু সংলাপ আছে, সবগুলোই এই অনুবাদ থেকে নেওয়া।
৭৯. হুব্রিস (Hubris) মানে মানুষের লাগামহীন অহংকার, যা প্রথমে অন্যের জীবনে দুঃখ আনে, কিন্তু শেষে তার নিজের জীবনে আনে ভয়ংকর পরিণতি। গ্রিক ট্র্যাজেডির মূল থিম হুব্রিস।
৮০. হেলেসপন্ট (Hellespont): দার্দানেলিস প্রণালি (Dardanelles)-এর প্রাচীন গ্রিক নাম হেলেসপন্ট। এই প্রণালি তুরস্কের এশিয়া অংশ আর ইউরোপ অংশকে আলাদা করেছে, আর যুক্ত করেছে এজিয়ান সাগর ও মর্মর সাগরকে। হেরোডোটাসের ‘ইতিহাস’ গ্রন্থ অনুসারে, এই প্রণালি পার হয়েই পারস্য বাহিনী গ্রিস আক্রমণ করে।