1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ২৫

২৫

‘পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো নিজেকে জানা
আর সবচেয়ে সহজ কাজ হলো অন্যকে উপদেশ দেওয়া।’

— থেলিস

***

সক্রেটিস আর চেরোফোন ডেলফি শহরে যাচ্ছে। চেরোফোন শুরু করেছে তার বিশেষ মিশন। সক্রেটিস পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি— এইকথার স্বীকৃতি আদায়ের মিশন।

এথেন্স থেকে ডেলফি অনেক দূরের পথ। সেখানে পাহাড়ের উপর এপোলোর মন্দির। সেই মন্দিরের ওরাকলের কাছে যাচ্ছে তারা।

গাধার গাড়িতে পুরো একদিন লাগবে। ক্রিতো দুটি গাধায় টানা গাড়ি আর দুজন দাস দিয়ে দিয়েছে। একটি গাড়িতে সক্রেটিস আর চেরোফোন। অন্যটিতে মালামাল। এই মালামাল পিথিয়ার জন্য উপহার।

চেরোফোন তালিকা করে মিলিয়ে মিলিয়ে উপহার গাড়িতে তুলেছে। দশ এমফোরা জলপাই তেল, দুই হাঁড়ি কাঁচা জলপাই, পাঁচ বৈয়াম খাঁটি মধু, দুই মটকি আঙুরের রসের সুরা। পঁচিশখানা কাপড় এবং একশো রুপার মুদ্রা। এছাড়াও আছে দুটি ভেড়া, একটি ছাগল।

ছাগল আর ভেড়া উৎসর্গ করা হবে দেবতা এপোলোর উদ্দেশ্যে। পুরোহিত এসে বলবেন, দেবতা উৎসর্গ গ্রহণ করেছেন কিনা। দেবতা গ্রহণ করলেই শুধু পিথিয়ার কাছে প্রশ্ন করা যাবে।

উঁচু-নিচু সরু পাহাড়ি পথে চলা খুবই কষ্টের। পথের কষ্ট কমাতে চেরোফোন ব্যবস্থা নিয়েছে। সে আনন্দ করতে করতে যাবে। সম্প্রতি সে জাদু শিখেছে। এক ঘণ্টা পর পর যাত্রা বিরতি। গাড়ি থামিয়ে জাদু দেখায়। জাদুর দর্শক সক্রেটিস, দুজন দাস, দুটি গাধা, দুটি ভেড়া আর একটি ছাগল। এরা সবাই জাদুর মর্ম বুঝেছে। শুধু ভেড়া দুটিই বেরসিক। তারা জাদুর মর্ম বোঝে না। জাদু শুরু করলেই, ভেড়া দুটি ব্যা ব্যা করতে করতে গাড়ি থেকে নেমে যেতে চায়। তাতে ভয় পেয়ে গাধাগুলোও অন্যদিকে হাঁটা ধরে।

চেরোফোনের জাদুতে কেউ মজা পায়নি। কিন্তু জাদু দেখে ভেড়া আর গাধা যা কাণ্ড করছে তাতে অনেক মজা হচ্ছে।

গভীর রাতে তারা ডেলফিতে পৌঁছল। মন্দিরের পাশেই রাত কাটানোর হোটেল আছে, কিন্তু ঘর খালি নেই। অনেক চেষ্টা করে চেরোফোন একটি ব্যবস্থা করল। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা মন্দ নয়। শুধু পয়সা একটু বেশি। তাতে কোনো সমস্যা নেই। ভালো কাজে ব্যয় তো একটু হবেই। ক্ৰিতো যথেষ্ট পয়সা দিয়ে দিয়েছে।

সক্রেটিসের চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। সারাপথ চেরোফোনের জাদু দেখেছে। এখনও শেষ হয়নি। পথে ছিল পথ-জাদু। আর এখন ঘরে হচ্ছে ঘর-জাদু।

সক্রেটিস বলল, এই ঘর-জাদুটা কাল দেখালে হয় না?

চেরোফোন বলল, কাল তো জাদু দেখাতেই হবে। এখানে যে ভিড়, তাতে জাদু ছাড়া কাল প্রশ্ন করার সুযোগ পাওয়া যাবে না। পিথিয়া মাসে একবার মাত্র প্রশ্নের উত্তর দেয়। সেটি আগামীকাল। আগামীকাল প্রশ্ন করতে না পারলে এক মাস বসে থাকতে হবে। তাই জাদু দিয়েই কাল সুযোগ নিতে হবে।

সক্রেটিস বলল, দরকার নেই। চলো ফিরে যাই।

চেরোফোন বলল, নিজের বিয়ে বাদ দিয়ে ডেলফিতে এসেছি। তুমি যে সেরা জ্ঞানী সেটি প্রমাণ করব। চেরোফোন পারে না, এমন কাজ এই জগতে নেই। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। কাল সত্যিকার জাদু দেখবে। পিথিয়া- জাদু। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

সকালে দেখা গেল কথা সত্য। চেরোফোন সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। সে এখানের লাইন-ঘাট খুবই ভালো জানে। সক্রেটিস এখানের কিছুই জানে না। সে মাত্র একবার ডেলফিতে এসেছিল। তাও অনেক বছর আগে। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখছে। এপোলোর মন্দিরের সামনের দেয়ালে বড় করে উজ্জ্বল কালিতে লেখা ‘নিজেকে জানো’[৭৪]। সক্রেটিস অনেকক্ষণ প্রতিটি অক্ষরের দিকে তাকিয়ে রইল। এটি তার সবচেয়ে পছন্দের কথা। ঠিক তার পাশেই লেখা ‘প্রয়োজনের অধিক কিছু নিও না’[৭৫]। এটিও তার মনের কথা

সকাল সকাল ভেড়া আর ছাগল বলি দেওয়া হলো। পুরোহিত জানালেন- সুসংবাদ। দেবতা এপোলো চেরোফোনের বলি গ্রহণ করেছেন। আজই পিথিয়ার কাছে প্রশ্ন করা যাবে। সময় বেশি নেই। এক্ষুনি পবিত্র গোসল দিতে হবে। তারপর শুদ্ধ কাপড়ে ঠিক দ্বিপ্রহরের সময় যেতে হবে পিথিয়ার গৃহে। প্রধান মন্দিরের নিচতলার ঘরটি পিথিয়ার। ঘরটি অন্ধকার। কোনো জানালা নেই। শুধু একটি ছোট্ট দরজা। চারদিকে ধোঁয়া উড়ছে। এই ধোঁয়া কোথা থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে মাটির নিচ থেকে আসছে। ঘন ধোঁয়ায় সামনের জিনিসও ভালো করে দেখা যায় না। সবকিছু ধোঁয়াশা, সবকিছু অস্পষ্ট। চারদিকে একটি অদ্ভুত গন্ধ। গন্ধটায় পবিত্রতা আছে। আবার একটু ভয়ও আছে। কেমন যেন নেশা নেশা লাগছে। সক্রেটিসের মনে হলো— এখানে কিছুক্ষণ থাকলে নেশা ধরে যাবে। সে চেরোফোনের হাত ধরে আছে।

ঘরের এক কোণে ছোট্ট একটি বেদির উপরে বসে আছেন ওরাকল- পিথিয়া। বৃদ্ধা মহিলা। এই বৃদ্ধা নারী সব জানেন, সারা পৃথিবীর সব রহস্য তিনি অবগত। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত এখানে পিথিয়া থাকবেন। মারা গেলে নতুন পিথিয়া হবে। সেও হবে বৃদ্ধা। আগে অল্প বয়সের কুমারীদের পিথিয়া বানানো হতো। কিন্তু খারাপ লোক সবখানে আছে। মন্দিরেও আছে। দু’একজন কুমারী পিথিয়া নাকি বিপদে পড়েছে। তাই এখন পিথিয়া বানানো হয় শুধু বুড়িদের। সক্রেটিস অবাক হয়ে দেখতে চাইছেন পিথিয়াকে। কিন্তু ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। সবকিছু ধোঁয়াশা, সবকিছু আবছা, সবকিছু রহস্যে ঘেরা।

পিথিয়া বৃদ্ধা, কিন্তু তাঁর পোশাক বাচ্চা মেয়ের মতো। সোনালি এলোচুল। ঝিরঝির উড়ছে। সক্রেটিসের মনে হচ্ছে, ঘরে ধোঁয়া এখন আরও বেড়ে গেছে। ধোঁয়ায় পিথিয়া একবার হারিয়ে যাচ্ছেন, মাঝে মাঝে হালকা করে একটু ভেসে উঠছেন, আবার হারিয়ে যাচ্ছেন। এই আছেন, এই নেই। এক গভীর রহস্যে তিনি আবদ্ধ। ঘরের ঝাঁঝালো গন্ধটা মাঝে মাঝে তীব্র হচ্ছে। মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। হঠাৎ পিথিয়া দুলছেন, সারা ঘর দুলছে। সক্রেটিস কিছুই বুঝতে পারছে না। তার পায়ের নিচে মেঝে কাঁপছে। বেশিক্ষণ এখানে থাকলে সে নিশ্চিত জ্ঞান হারাবে। চেরোফোন তাকে সাহস দিচ্ছে।

পিথিয়াকে সরাসরি প্রশ্ন করা যায় না। খাদেমদের মাধ্যমে করতে হয়। সাদা পোশাক পরা দুজন খাদেম। তারা ভীষণ ব্যস্ত। তারা একই সাথে প্রশ্ন বাহক, আবার উত্তর বাহক।

একজন খাদেম এসে হুকুম করল, তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করেন। জনপ্রতি মাত্ৰ একখান প্রশ্ন। বেশিও না, কমও না।

চেরোফোন বলল, আমরা দুইজন মিলে মাত্র একটি প্রশ্ন করব। তাতে কোনো সমস্যা আছে?

খাদেম বলল, বাড়তি কথা বলেন কেন? এটি বাড়তি কথার জায়গা না। শুধু প্রশ্নটা বলুন। স্পষ্ট কথায় এক লাইনের প্রশ্ন।

চেরোফোন কোনো ভুল করবে না। ঠিকভাবে প্রশ্ন করবে। আসপাশিয়ার কাছে মুখস্থ করে এসেছে। মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়েও এসেছে। সে শান্তভাবে প্রশ্ন করল, পৃথিবীতে সক্রেটিসের থেকে জ্ঞানী মানুষ কি কেউ আছে?

খাদেম বলল, সক্রেটিসটা কে?

চেরোফোন আঙুল দিয়ে সক্রেটিসকে দেখাল। খাদেম সক্রেটিসের দিকে তাকাল। তার চোখে অবিশ্বাস। এই জোয়ান ছেলে দুনিয়ার সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ? এরা সত্যি এটি জানতে এসেছে? সে নিশ্চিত হতে বলল, ভালো করে প্রশ্নটা আবার বলেন। একটি মাত্র সুযোগ। সুযোগ শেষ হয়ে গেলে, আমার কাছে শত কান্নাকাটি করলেও কোনো কাজ হবে না।

চেরোফোন আবার প্রশ্নটা বলল, পৃথিবীতে সক্রেটিসের থেকে জ্ঞানী মানুষ কি কেউ আছে?

খাদেম আবার অবজ্ঞা নিয়ে সক্রেটিসকে দেখল। শেষে বিরক্ত মুখে পিথিয়ার কাছে গেল। সে পিথিয়ার কানে কানে ফিসফিস করে প্রশ্নটা বলল।

পিথিয়া কোনো উত্তর দিচ্ছে না। শুধু তার চোখ থরথর করে কাঁপছে। মাঝে মাঝে একটি অদ্ভুত আওয়াজ আসছে, কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ হয়ে যাচ্ছে। আর ধৈর্য রাখা সম্ভব নয়।

চেরোফোন একটু এগিয়ে গিয়ে নিজেই পিথিয়াকে জিজ্ঞেস করল, পৃথিবীতে সক্রেটিসের থেকে জ্ঞানী মানুষ কি কেউ আছে?

কোনো উত্তর নেই। সক্রেটিস হতাশ, ফিরে যাওয়া দরকার। হঠাৎ পিথিয়ার মুখ নড়ে উঠল। তার মাথা দুলছে। হাত-পা কাঁপছে। চুলগুলো পতপত করে উড়ছে। খাদেম ইশারা করল, এখুনি উত্তর আসবে।

চেরোফোনের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় স্কুলের পরীক্ষায় বা যুদ্ধ ক্ষেত্রেও সে এত উত্তেজনা পায়নি। সক্রেটিসও তাকিয়ে আছে পিথিয়ার দিকে।

পিথিয়া অস্ফুট উচ্চারণে বললেন, না, সক্রেটিসের থেকে জ্ঞানী কোনো মানুষ পৃথিবীতে নেই।

চেরোফোন এক লাফে সক্রেটিসকে জড়িয়ে ধরে বলল, বিশ্বাস হলো? চেরোফোন ফালতু কথার লোক নয়।

তার চিৎকারে পিথিয়া ভয় পেয়ে গেল। খাদেম চেঁচিয়ে উঠল, কী করছো উজবুক? ওরাকল অভিশাপ দিবে। তখন কিন্তু জ্ঞান-ফ্যান সব হাওয়ায় উড়ে যাবে।

তারা তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলো। চেরোফোনের চোখে মুখে আনন্দ। যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। যে স্বপ্ন নিয়ে তার এত আয়োজন, সেটি সার্থক হয়েছে। ওরাকল ঘোষণা দিয়েছে যে সক্রেটিসই পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি। এখন চেরোফোন মনের সুখে বিয়ে করতে পারবে। সে পাঁচ হাঁড়ি মিষ্টি কিনল। দুই হাঁড়ি মন্দিরে দিল। ডেলফিতে সব নগরের একটি করে ভবন আছে। এথেন্স ভবনে দুই হাঁড়ি মিষ্টি দিল। একটি বড় হাঁড়ি নিয়ে বসল সক্রেটিসের সামনে। আজ সে প্রাণ ভরে মিষ্টি খাবে। সারা রাত খাবে। পেট টুম্বুর হয়ে গেলে তখন জাদু দেখাতে শুরু করবে। আজকের জাদুর নাম আনন্দ-জাদু।

কাল সকালে তারা এথেন্সের দিকে যাত্রা করবে।

.

পরদিন খুব সকালে বাজনার প্রচণ্ড শব্দে সক্রেটিসের ঘুম ভাঙল। একদল বাজনদার তুমুল বাদ্য বাজাচ্ছে। চেরোফোন বাজনা ভাড়া করেছে। সক্রেটিসের বিজয়-বাদ্য বাজছে। বাদ্য বাজাতে বাজাতে তারা ডেলফি থেকে এথেন্সে যাবে। আজ দিনের মধ্যেই ডেলফি থেকে এথেন্স সবখানে সবাই জানবে যে সক্রেটিসই পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ।

সক্রেটিস কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে বলল, কী করছো এসব?

চেরোফোন বলল, কেন? বাজনা পছন্দ হয়নি? এরা খুব সুন্দর বাজায়। ভাড়াও বেশি নয়। একটি গাধার গাড়ি খালি আছে। সেই খালি গাড়িটায় এরা এথেন্সে যাবে। বাজনা শুনে সারা এথেন্সের মানুষ ছুটে আসবে। এসে দেখবে গাড়ির সামনে বড় সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ড দেখেই সবাই ঘটনা জেনে যাবে।

সক্রেটিস লাফ দিয়ে গাড়ির সামনে গেল। গাড়িতে বিশাল পেপিরাস কাগজে সাইনবোর্ড ঝুলছে। তাতে লেখা :

‘প্রিয় নগরবাসী, অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানানো যাচ্ছে যে, গতকাল ডেলফির ওরাকল ঘোষণা করেছেন যে— এই পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হলেন এথেন্সের সক্রেটিস। এই শুভ সংবাদে এথেন্সের সকলকে অভিনন্দন। ‘ লেখার নিচে জলরঙে আঁকা সক্রেটিসের একটি ছবি।

সক্রেটিসের মনে হলো, এক্ষুনি চেরোফোনকে ভস্ম করে দেওয়া দরকার। সে যা শুরু করেছে, এবার আর মান-সম্মান কিছুই থাকবে না। সে ভয়ংকর রাগে তীব্র চিৎকার করে ডাক দিল, চেরোফোন!

চেরোফোন রাগ বোঝার মতো অবস্থায় নেই। সে হাসি মুখে বলল, সাইনবোর্ড পছন্দ হয়েছে? সাইনবোর্ডে লেখাটি আমার। আর ছবিটি এঁকেছে ডেলফির বিখ্যাত একজন চিত্রকর।

চেরোফোনের মুখের দিকে তাকিয়ে সক্রেটিস দেখল, বেকুব চেরোফোন বুঝতেও পারছে না, সে কী করছে। আজ চেরোফোনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। তার অনেক দিনের আশা পূরণ হয়েছে। এমন অবস্থায় তাকে বকা দিয়ে মনে কষ্ট দেওয়া যায় না।

অনেক চেষ্টায় নিজেকে শান্ত করে সক্রেটিস বলল, লেখা ও ছবি ভালো হয়েছে। এবার যাও, নাস্তা করে নাও। আমি আসছি।

চেরোফোন চলে যেতেই সক্রেটিস সাইনবোর্ড খুলে ফেলল। আর বাজনাদারদের টাকা-পয়সা মিটিয়ে বিদায় দিয়ে দিল।

.

ফেরার সময় চেরোফোন ভিন্ন গাড়িতে উঠেছে। সে সক্রেটিসের সাথে এক গাড়িতে যাবে না। সক্রেটিস তার সব আনন্দ ভেস্তে দিয়েছে। সাইনবোর্ড ফেলে দিয়েছে, বাজনদাররা চলে গেছে। মন খারাপ করে চেরোফোন শুয়ে আছে। কিন্তু বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারল না। তার মাথায় জাদু এসে গেছে। মন-খারাপ জাদু।

পাহাড়ের নাম পারনাসোস। শীতকালে পাহাড়টি বরফে ঢেকে যায়। এখন শরৎকাল, বরফ নেই। পাহাড়ের সরু পথ দিয়ে গাধার গাড়ি চলছে। আকাশ ঝকঝক করছে। শরতের আকাশ এত ঝকঝকে হয় না। সাদা মেঘ থাকে। কিন্তু আজকের আকাশ আশ্চর্য রকম পরিষ্কার। পাহাড়ের সবুজ গাছগুলো যেন কথা বলছে। মিষ্টি স্বরে পাখি ডাকছে। চমৎকার পরিবেশ। কিন্তু সেদিকে মন নেই সক্রেটিসের। সে চুপচাপ ভাবছে।

তার মাথায় পিথিয়ার কথাগুলো ঘুরছে। ওরাকল কি সত্যিই বললেন, তার চেয়ে জ্ঞানী কেউ নেই? সে নিজের কানে শুনেছে। তবু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দেবতারা তো মিথ্যে বলেন না। ওরাকলের কথা দেবতার মুখের কথা। সব সময় সত্য। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? সে কি সত্যি পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ?

সক্রেটিসের মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে ভাবছে আমি তো তেমন কিছুই জানি না। এই পৃথিবীতে এত কিছু আছে, তার কী আমি জানি। নিশ্চয়ই কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। হয়তো ওরাকল গড়বড় করে ফেলেছেন। নিশ্চয়ই আমার থেকে জ্ঞানী লোক আছে। এটি আমায় বের করতে হবে। পরীক্ষা করতে হবে।

এতদিন বন্ধুরা লোক ধরে আনত পরীক্ষা করতে। এখন আমি নিজেই পরীক্ষা করব।

আমি দার্শনিকদের কাছে যাব। কবি-লেখকদের কাছে যাব। নেতাদের কাছে যাব। তারা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে জ্ঞানী। আমি ওরাকলের এই কথা পরীক্ষা করব। এখন থেকে এটিই হবে আমার গবেষণা। যতদিন না এর উত্তর পাব আমি থামব না।

শুরু হলো সক্রেটিসের নতুন মিশন। মানুষকে পরীক্ষা করার মিশন

***

সক্রেটিস দিন-রাত ছুটছে। মানুষের পিছে ছুটছে।

ছুটে ছুটে তাদের জ্ঞান পরীক্ষা করছে। ডেলফির ওরাকল বলেছেন, পৃথিবীতে সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী কেউ নেই। কথাটি পরীক্ষা করতে সে রাত দিন মানুষকে প্রশ্ন করছে। যাকে সামনে পায় তাকেই ধরছে। কবি, রাজনীতিক, দার্শনিক, শিল্পী কেউ বাদ যাচ্ছে না। সে খুঁজছে, নিশ্চয়ই আমার চেয়ে জ্ঞানী মানুষ আছে।

আজ সক্রেটিস এসেছে লিকাবিথোস পাহাড়ে। তার সাথে ক্রিতো। এথেন্স শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের নাম লিকাবিথোস। সেখানে একজন কবির সাথে দেখা। কবির বয়স অল্প। নাম মেলিতাস’। সে সক্রেটিসকে চেনে। সে জানে যে সক্রেটিস মানুষকে নানা প্রশ্ন করে। মেলিতাস তৈরি। আসুক সক্রেটিস। আজ একটি জ্ঞান-যুদ্ধ হবে। মেলিতাস ভালো কবিতা লেখে, ভালো বক্তৃতাও করে। তাকে হারানো অত সহজ নয়।

ঠিক তখনই পশ্চিম আকাশে একটি তারা খসে পড়ল। কবি মেলিতাস দেখল, এই সুযোগ। সে গদগদ কণ্ঠে বলল,

‘মিটিমিটি নিভুনিভু-প্রদীপে আকাশ ভরা
দিনের বেলা সূর্য হাসে- রাতে কাঁদে তারা।’

কবিতা বলে কবি ব্যাপক খুশি। তার প্রতিভার ঝলক দেখুক সক্রেটিস।

কবি আবার বলল, দেখেছো, আকাশ হতে তারাটি কেমন কাঁদতে কাঁদতে নেমে এলো।

সবাই বলল, আহা, তারাটি কাঁদল। আমরা তো তারাটির চোখের পানিও দেখতে পেলাম।

কবি বলল, এই তারা খসে পড়া, এই নিশুতি রাত, এই আধো আলো ঘেরা পাহাড়— সব কেমন মায়া। এই মায়ার টানে আমি এখানে ছুটে আসি।

সবাই বলল, আহা, আমরা মায়াটাকে একেবারে চক্ষে দেখতে পাচ্ছি।

কবি মেলিতাস খুব খুশি। সবাই তার বুদ্ধির ঝিলিক টের পাচ্ছে।

সক্রেটিস মৃদু স্বরে বলল, কবি, মায়া কী জিনিস?

মেলিতাস ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। মায়া?

সে বলল, এটি কেমন প্রশ্ন? মায়া কী— সেটি কেন বলতে হবে?

সক্রেটিস বলল, একটু আগে আপনি কবিতার মতো বললেন, সব কেমন মায়া! আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। তাই মায়া কী জিনিস— সেটি বুঝতে চাচ্ছি।

মেলিতাস রেগে গেল। বলল, কী সুন্দর কবিতা বললাম, সবাই খুশি হলো। আর তুমি আসছো সেই কবিতার অর্থ বুঝতে! ঢং করে বলছো, মায়া কী জিনিস?

সক্রেটিস হতাশ। এই কবি না বুঝেই কবিতা লেখে। তার কবিতা তার থেকে অন্যরা ভালো বোঝে। এ আর যাই হোক, কিছুতেই জ্ঞানী নয়। এমনকি সে জানেও না যে, সে কবিতা বোঝে না। এর সাথে আর কথা বলে লাভ নেই। তাকে পরীক্ষা করা শেষ।

সক্রেটিস হাঁটা শুরু করল।

মেলিতাস বুঝল, আশেপাশের সবাই বুঝে গেছে যে, সে না বুঝেই কবিতা লেখে। তার খুব রাগ হলো সক্রেটিসের উপর। খামোখা নিজে থেকে এসে তাকে অপমান করে গেল।

চিৎকার করে সক্রেটিসকে ডাক দিয়ে মেলিতাস বলল, এই জ্ঞানী, যেও না, দাঁড়াও। এই তারা খসা নিয়ে আমি তো কবিতা লিখলাম। তো এই তারা খসা দেখে তুমি কী বুঝলে?

সক্রেটিস হাসি দিল। বলল, এই তারাটিকে ঝরে পড়তে আমরা দেখেছি। আমাদের কাছে এটি খুবই আশ্চর্য ঘটনা। কিন্তু এই মুহূর্তেই হয়তো আমাদের পেছনে আরও একটি তারা খসে পড়ল, যেটি আমরা দেখিনি। সেই না দেখা খসে পড়া তারাটাও নিশ্চয়ই আশ্চর্য ঘটনা?

মেলিতাস বলল, নিশ্চয়ই।

সক্রেটিস বলল, কিন্তু সেই না দেখা তারাটার কথা আমরা বলছি না কেন?

মেলিতাস কিছুই বলতে পারছে না।

ক্রিতো উত্তর দিল, কারণ এই তারাটাকে আমরা ঝরে পড়তে দেখেছি, আর অন্যটাকে দেখিনি। যেটি আমরা দেখেছি, আমরা শুধু সেটির কথাই বলছি।

সক্রেটিস বলল, একেবারেই ঠিক। আমাদের কাছে একটি তারা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমরা সেটিকে খসে পড়তে দেখেছি। অন্যটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ আমরা দেখিনি। তাহলে কোনটি জরুরি— আকাশের তারা, নাকি আমাদের দেখা?

ক্রিতো বলল, আমাদের দেখা।

সক্রেটিস বলল, আমরা কারা?

ক্রিতো বলল, আমরা মানুষ।

সক্রেটিস বলল, তাহলে কী দাঁড়াল?

ক্রিতো বলল, মানুষই সবচেয়ে জরুরি বিষয়। আকাশে তারা খসে পড়ুক, আর চাঁদ ঝরে পড়ুক— মানুষ যদি বুঝতে পারে, তাহলেই সেটি বিষয়। না হলে সেটি কোনো বিষয়ই নয়।

সক্রেটিস বলল, ব্রাভো ক্ৰিতো।

ক্রিতো লজ্জামাখা একটি হাসি দিল।

সক্রেটিস বলল, তাহলে আমাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো মানুষ। মানুষের মন। আমার নিজের মন। নিজেকে জানতে হবে। মনকে জানতে হবে। মন যদি সঠিক পথ খুঁজে পায়, তবেই জীবন সুন্দর হবে। তাই জীবনকে সুন্দর করার জন্য মনকে সঠিক পথ দেখানো দরকার। মন যদি বুঝতে পারে, কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ, তবেই জীবন সুন্দর হবে।

মেলিতাসের মাথা ভনভন করছে। এ যে একেবারে নতুন কথা। এমন কথা আগে তাকে কেউ কোনোদিন বলেনি। কবি বুঝতে পারছে মানুষ যদি সক্রেটিসের কথা বুঝতে পারে, তাহলে একদিন জ্ঞানের মূল বিষয় হবে মানুষের মন। কীভাবে আরও সুন্দর জীবন যাপন করা যায়— সেটি নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা করবে মানুষ।

তবে ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন, কবির বর্তমানকে খারাপ করে দিয়েছে সক্রেটিস। কবি বুঝতে পেরেছে, সক্রেটিসকে ডেকে আনা দ্বিতীয় ভুল হয়েছে। আশেপাশের সবাই একেবারে স্পষ্ট দেখেছে যে, কবির চেয়ে সক্রেটিস কত বেশি জ্ঞানী। মেলিতাসের ভীষণ অপমান লাগছে। কিন্তু অপমানের শোধ নেওয়ার ক্ষমতা নেই। সে ঠিক করল, যেদিন সুযোগ পাবে সেদিনই সক্রেটিসকে উচিত শিক্ষা দেবে।

.

পাহাড় থেকে নেমে আগোরার দিকে আগালো সক্রেটিস আর ক্রিতো।

আগোরা থেকে বের হচ্ছেন একজন সৌম্যকান্তি প্রৌঢ় মানুষ। তার হাতে একটি পেপিরাসের বই। কানের উপর স্টিলো কলম। দেখলেই বোঝা যায় তিনি অনেক পড়ালেখা করেন। জ্ঞান নিয়েই তার কারবার।

ক্রিতো গিয়ে তাকে বলল, শুভ সন্ধ্যা। আপনাকে নতুন দেখছি। আপনি কী করেন?

লোকটি বললেন, আমি একজন সফিস্ট।

‘আমি তো একজন সফিস্টকেই খুঁজছি। আমার ছোট ভাইকে একটু জ্ঞান দিতে হবে। ভাইটা একেবারে গর্দভ হয়ে গেল।’

সফিস্ট লাফ দিয়ে বললেন, গর্ভদদের মানুষ বানানোই তো আমার কাজ। ভাইকে কী বানাতে চান বলুন। নেতা না অভিনেতা? কবি না শিল্পী?

‘আপনি সবকিছু বানিয়ে দিতে পারবেন?’

‘পারব মানে? এই হাতে কত জনকে কত কিছু বানালাম। বলুন, ভাইকে কী বানাতে চান?’

‘নেতা।’

‘নিয়ে আসুন ভাইকে। নেতা হতে হলে প্রথমে শিখতে হবে ঝাঁঝাঁলো বক্তৃতা। এমন বক্তৃতা শিখিয়ে দেব যে সংসদ কাঁপিয়ে দেবে। ছয় মাস প্রশিক্ষণ দেব, মূল্য মাত্র ছয় মিনা। যদি আপনার তাড়াহুড়া থাকে, তাহলে তিন মাসেই শেষ করা সম্ভব। সেজন্য দিতে হবে আট মিনা।’

ক্রিতো বলল, দামটা একটু বেশি হয়ে গেল যে!

‘এর চেয়ে কমে আমি জ্ঞান দেই না। জ্ঞানের দাম এত কম নয়। এর চেয়ে কম দামে কোথাও পাবেন না।’

‘দাম দিয়ে কি জ্ঞান ক্রয় করা সম্ভব?’— হঠাৎ সামনে এসে বলল সক্রেটিস।

সফিস্ট সাহেব সক্রেটিসকে চেনেন। তিনি ভয়ে চুপ করে গেলেন। আর কথা বলা যাবে না।

সক্রেটিস আবার বলল, জনাব, বলুন না— জ্ঞান কি বিক্রি করার জিনিস? প্যাকেটে করে দোকানে সাজিয়ে রাখার বস্তু?

এই প্রশ্নের উত্তর সফিস্টের কাছে নেই। তিনি কিছুই বলছেন না। চলে যাওয়ার উপায় খুঁজছেন।

সক্রেটিস বলল, আপনি ক্রিতোর ভাইকে যেটি শেখাবেন, সেটি হলো কথা বলার কৌশল। সেটি জ্ঞান নয়। জ্ঞান বেচা যায় না। জ্ঞানের কোনো দোকান নেই। পয়সা দিয়ে কেউ জ্ঞান কিনতে পারে না।

সফিস্ট সাহেব দৌড় দিয়ে অন্ধকারের ভেতর হারিয়ে গেলেন। তিনি ভাবছেন, এই ছেলে তো সাংঘাতিক। এর কথাবার্তা মানুষ শুনলে জ্ঞান নিয়ে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এই ছেলেকে শায়েস্তা করার একটি উপায় খুঁজতে হবে। শাস্তি দিতে হবে। কঠিন শাস্তি দিয়ে ওর মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে।

সক্রেটিস বুঝল, যারা সফিস্ট, যারা নিজেদের জ্ঞানী বলে, তারা আসলে জ্ঞান কী, সেটিই জানে না।

.

ক্রিতো বাড়ি যাবে। তার বাগানের জলপাই কিনতে বেপারী এসেছে। সে চলে গেল। সক্রেটিস একাই আগোরায় ঢুকল। কাঁচা বাজারের পাশে একটি খাওয়ার দোকান হয়েছে। সেখানে কয়েকজন যুবক গল্প করছে। এরা এথেন্সের তরুণ নেতা। মাত্র রাজনীতি শুরু করেছে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এদের হাতে। এদেরকে সক্রেটিস অল্প-স্বল্প চেনে। শুধু একজনের নাম জানে। তার নাম এনিতাস। সক্রেটিস তাদের সামনে গেল। সবাইকে একসাথে জিজ্ঞেস করল, পৃথিবীর কোন জায়গা আপনাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়?

এই তরুণরা সক্রেটিসকে চেনে। তারা জানে এই লোকটির পাগলামি আছে। সে মানুষকে জ্বালায় কিন্তু মজার মজার কথা বলে। তরুণরা নেশা করে মজা করছিল। নেশার ঝোঁকে উত্তর করতে শুরু করল। একজন বলল, আমি প্রতি গ্রীষ্মের শুরুতে ডেলফিতে যাই। পাহাড়ের উপর ডেলফির এপোলো মন্দির। একেবারে চোখ জুড়ানো। কিছু জানার দরকার হলেই আমি ডেলফিতে ছুটে যাই। ডেলফিই আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থান।

এনিতাস বলল, যেখানে অলিম্পিক খেলা হয়, সেই অলিম্পিয়া শহর আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমি ভালোবাসি বীরদের লড়াই। সভ্য মানুষের লড়াই দেখতে অলিম্পিকের চেয়ে ভালো অন্য কিছুই হতে পারে না। আমি অলিম্পিয়া শহরকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।

আরেকজন বলল, আমি গত বছর স্পার্টায় গিয়েছি। স্পার্টার লোকজন সব ভয়ংকর যোদ্ধা, ছোটবেলা থেকেই ওরা সবাই যুদ্ধ শিখে। বড় বড় চুল রাখে। কী সুন্দর দেখতে স্পার্টানরা! এক-একজন একেবারে হোমারের একিলিস। তবে পুরুষরা যেমন তেমন, স্পার্টার মেয়েদের দিকে তাকালে চোখ আর সরে না। যেন ট্রয় যুদ্ধের সেই হেলেন। বিশ্বাস করতে পারবে না— আমি এখনও চোখ বুজলেই দেখতে পাই। আহা, আমার শুধু স্পার্টায় যেতে ইচ্ছা করে।

এনিতাস সক্রেটিসকে জিজ্ঞেস করল, এবার তোমারটা শুনি। পৃথিবীতে তোমার প্রিয় জায়গার নাম কী?

অতি মৃদু স্বরে সক্রেটিস উত্তর করল, এথেন্স।

সব যুবক একসাথে চমকে উঠল। আরে আমাদের মাতৃভূমি এথেন্সের কথাই তো আমরা ভুলে গেছি। দূরের কথা মনে করতে গিয়ে আমাদের এই সুন্দর জন্মভূমির কথা মনেই নেই।

সক্রেটিস মৃদু স্বরে বলছে, এথেন্সই আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থান। এই নগরীটিকে আমি ভালোবাসি। একেবারে প্রেমিকার মতো ভালোবাসি। এই নগর ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে আমি থাকতে পারি না।

এনিতাস বলল, ভালোই তো চাল দিলে। আমরা সবাই নানান জায়গার নাম বললাম, আর তুমি বললে এথেন্স। এটি ঠিক করেই ভাব নিতে আসছ— তাই না?

সক্রেটিস বলল, যেকোনো রাজনীতিকের সবচেয়ে প্রিয় হবে তার নিজের শহর। নিজের শহরকে ভালো না বাসলে রাজনীতি হয় না।

এনিতাস চেঁচিয়ে উঠল, তুমি কি জানো আমরা এথেন্সকে ভালোবাসি না? খালি কথার প্যাঁচ দিয়ে সত্যকে মিথ্যা বানাও, আর মিথ্যাকে সত্য বানাও। এখান থেকে যাও, ভাগো।

সক্রেটিস সেখান থেকে চলে গেল। বুঝতে পারল—এরা রাজনীতি বোঝে না। রাজনীতির প্রথম শিক্ষা হলো দেশপ্রেম। সেটিই এদের নেই। এদের কোনো রাজনীতি জ্ঞানই নেই। শুধু তাই নয়— জ্ঞান যে নেই, সেটিও এরা জানে না।

সক্রেটিস চলে যেতেই এনিতাস বলল, সক্রেটিসের সাহস দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ওকে একটি উচিত শিক্ষা দিতে হবে।

অনেক দিন ধরে সক্রেটিস এই পরীক্ষা করল। ওরাকলের কথার পরীক্ষা। তারপর সিদ্ধান্তে এলো যে ওরাকল সঠিক বলেছেন।

‘আমি জ্ঞানী, কারণ আমি জানি যে— আমি আসলে কিছুই জানি না। আর যারা নিজেকে জ্ঞানী বলে, তারা এটিও জানে না যে, তারা তেমন কিছুই জানে না।

আমার অজ্ঞানতার খবর আমি জানি। সেজন্যই আমি জ্ঞানী।’

***

৭৪. মন্দিরে গ্রিক ভাষায় লেখা ছিল ‘Gnothi Seauton’এর মানে ‘Know Yourself.

৭৫. ‘Meden Agan’এর মানে ‘Nothing in Excess’.

৭৬. মেলিতাস (Meletus) কবি তিনি সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অফিসিয়ালি মামলা করেন। তাকে প্ররোচিত করে মামলাটি করান এনিতাস নামের একজন রাজনীতিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *