1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ২২

২২

‘Understanding a question is the half of the answer.’

—Socrates

***

পেরিক্লিসের বাড়িতে সিম্পোজিয়াম।

গ্রিকদের সন্ধ্যাকালীন আড্ডার সাথে ডিনারের নাম সিম্পোজিয়াম। তবে হেঁজিপেঁজি লোকজন গোল হয়ে আড্ডা দিলেই সিম্পোজিয়াম হবে না। সিম্পোজিয়ামের শর্ত হচ্ছে দাওয়াতিরা সবাই হবে বিশেষভাবে জ্ঞানী। আড্ডার বিষয় হবে ওজনদার।

সূর্য ডোবার পরেই জ্ঞানীরা চলে আসে। তাদের পরনে বাহারি পোশাক। হাতে সুরা আর মুখে জ্ঞান। তখন একসাথে দুটি নেশা হয়— সুরার নেশা আর জ্ঞানের নেশা। কে কত ভারী ভারী কথা বলতে পারে, সেই নেশা। রাত যত বাড়ে, নেশাও বাড়ে। সেই সাথে বাড়ে ওজনদার কথা। যুক্তি, যুক্তির পিঠের যুক্তি। বিপুল রকম খাওয়া-দাওয়া। আনন্দী-দাসীরা মৃদু লয়ে নাচ-গান করে। জ্ঞান, আনন্দ, সুর, সুরা সবকিছু নিয়ে এগিয়ে চলে রাত। এর নামই গ্রিক সিম্পোজিয়াম।

যেকোনো বড় খুশির ঘটনায় এথেন্সের ধনীরা সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে। অলিম্পিয়ায় সুনাম হওয়ায় পেরিক্লিস ভীষণ খুশি। সেই খুশিতে এথেন্সে ফিরেই হেরোডোটাসের সম্মানে সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছেন। পেরিক্লিসের বাড়িতেই হচ্ছে সিম্পোজিয়াম। আসপাশিয়া দিন রাত খেটে সব আয়োজন করেছে।

দাওয়াতির সংখ্যা পঞ্চাশ জনের মতো। তার মধ্যে আসপাশিয়ার অতিথি তিনজন— সক্রেটিস, চেরোফোন আর ক্রিতো। তারা এক কোণে পাশাপাশি তিনটা গদিতে হেলান দিয়ে আছে। আধো-শোয়া আধো-বসা। তারা ফিসফিস করে কথা বলছে।

চেরোফোন আবার শুরু করল হেরোডোটাসের প্রশংসা। বলল, অলিম্পিয়ায় হেরোডোটাস ব্যাপক দেখাল। মানুষ অলিম্পিক জিতে মাঠের খেলায়। কিন্তু হেরোডোটাস মাঠে না নেমে শুধু মুখের কথায় জিতে গেল। তার চাপার জোর আছে।

ক্রিতো বলল, তার চাপাবাজিতে তার সাথে এথেন্সও জিতেছে।

চেরোফোন বলল, হুঁম, হেরোডোটাস জিতেছে, এথেন্সও জিতেছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি জিতেছেন পেরিক্লিস। এখন নেতা হিসেবে পেরিক্লিসের গদি এক্কেবারে পাক্কা। সামনের কয়েক বছর ভোটে কেউ তাকে টেক্কা দেওয়ার আশা করতেও পারবে না।

তারা হেরোডোটাসের দিকে তাকাল। হেরোডোটাসই আজকের সিম্পোজিয়ামের মধ্যমনি। বসেছেও একেবারে মাঝখানে। হাসি হাসি মুখে আসপাশিয়ার সাথে কথা বলছে।

হেরোডোটাস বলল, আসপাশিয়া, আপনার কথা ফেলতে পারলাম না। কথা রাখলাম।

আসপাশিয়া বলল, কথা রাখলেন? কোন কথা? আমি কোন কথা রাখতে বলেছি?

‘আপনি আমাকে বই লিখতে বলেছিলেন।’

‘ও, তাই তো। লিখবেন?’

‘লিখব। আমি এথেন্সের কথা লিখব। যেখানে যেখানে ঘুরেছি সব লিখব। অলিম্পিয়া থেকে ফিরে অনেক ভেবেছি। সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম। লেখা শুরু করব। বইয়ের কথা আপনিই আমাকে প্রথম বলেছিলেন। তাই সিদ্ধান্তটা প্রথমে আপনাকেই জানালাম।’

আসপাশিয়া দাঁড়িয়ে সুরার গ্লাসে চামচ দিয়ে শব্দ করল। এর মানে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। সে বলল, প্রিয় অতিথিরা, সবাইকে একটি খুশির খবর দিতে চাই। ইয়া বড় খবর। আমাদের হেরোডোটাস সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে এথেন্সের কাহিনি নিয়ে বই লিখবে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এথেন্সের কথা।

সবাই হাততালি দিয়ে বলল, ব্রাভো, অভিনন্দন।

আসপাশিয়া বলল, হেরোডোটাস, কী নাম হবে বইয়ের?

হেরোডোটাস বলল, হিস্ট্রি[৭১] বা ইতিহাস।

‘কেন, এই নাম কেন? এটি তো গল্পের বই।’

‘হিস্ট্রি মানে খোঁজ। অনুসন্ধান। আমি গল্পের মতো বানিয়েছি। কিন্তু এটি আসলে গবেষণা। আমি খোঁজ করেছি। খোঁজ করে যা পেয়েছি, তাই হবে আমার হিস্ট্রি। এতে অবশ্যই এথেন্সের কথা বেশি থাকবে। সাথে অন্য অনেক কিছুই থাকবে। আমি সারা জীবন ঘুরেছি, ঘুরে ঘুরে খুঁজেছি। বের করতে চেয়েছি মানুষ কোথা থেকে এলো। ইউরোপ কোথা থেকে এলো। দেবতা জিউস ইউরোপাকে চুরি করেছিল। ইউরোপার নাম থেকে এসেছে ইউরোপ। একেবারে সেখান থেকে শুরু করব। সেই ইতিহাস চলতে থাকবে এক নগর থেকে অন্য নগরে। শেষ হবে এথেন্সে এসে। এথেন্সেই মানুষের জ্ঞান চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। সেখানেই শেষ হবে আমার বই।’

সবাই আবার হাততালি দিল।

আসপাশিয়া বলল, চমৎকার। এমন কাজ পৃথিবীতে এই প্রথম হবে। আপনি একেবারে নতুন কিছু করতে যাচ্ছেন।

আসপাশিয়া তাকে একগুচ্ছ পেপিরাস কাগজ দিল। এই পেপিরাসেই শুরু হবে হেরোডোটাসের বই ‘হিস্ট্রি’।

.

সিম্পোজিয়ামে খানাদানা শুরু হলো। সুন্দর পোশাক পরা দাসেরা খাবার দিচ্ছে। কিথারা বাজছে। আনন্দী-দাসীরা মৃদু ভঙ্গিতে নাচছে। সিম্পোজিয়াম জমে উঠেছে

পেরিক্লিস বললেন, আসপাশিয়া, তুমি কিন্তু ঝামেলা করলে। তুমি আসল কথাই ভুলিয়ে দিলে।

আসপাশিয়া বলল, আসল কথা কোনটা?

আসল কথা হলো হেরোডোটাসকে পুরস্কার দিতে হবে।

সবাই বলে উঠল, তাই তো। এক্ষুনি পুরস্কার দেওয়া হোক।

পেরিক্লিস বললেন, পুরস্কার কি মুখের কথায় দেওয়া যায়? এটি গণতন্ত্র। কী দেওয়া হবে, সেটি সংসদে ভোটে ঠিক হবে।

গায়ক ডেমন বললেন, সংসদে কি পুরস্কারের প্রস্তাব দেবে সেটা। আমাদের বললে একটু শান্তি লাগত।

পেরিক্লিস বললেন, ঠিক আছে এই সিম্পোজিয়ামই হোক ছোট সংসদ। আমাদের এখানে সবাই যা বলবে, আমি সেই কথাই সংসদে তুলব।

সফোক্লিস বললেন, হেরোডোটাস যা করেছে, সেটি অলিম্পিক পদক জেতার সমান। আমার মনে হয় অলিম্পিক পদকের চেয়েও বেশি। অলিম্পিক জয়ীদের যে পুরস্কার দেওয়া হয়, সেটিই দেওয়া হোক। তাকে আগোরার ভেতরে প্রিটারিয়ামে থাকতে দেওয়া হোক। থাকা-খাওয়া ফ্রি। সারা জীবন সরকারি ভাতার ব্যবস্থা।

ডেমন বললেন, সমস্যা হলো অলিম্পিক বিজয়ীর সমান পুরস্কার দিলে অন্য নগরের লোকেরা হাসাহাসি করবে। এথেন্সের অলিম্পিক পদক পাওয়া লোকেরাও গোস্বা করবে।

দাওয়াতিরা বলল, ঠিক, ঠিক। এক জনের সম্মানে অন্য লোকের গোস্বা ব্যাপারটা ভালো হয় না। অন্য কিছু দেওয়া হোক।

পেরিক্লিসের গুরু এনাক্সাগোরাস বললেন, হেরোডোটাস তো অলিম্পিক জিতেনি। সে অলিম্পিকের চেয়ে অনেক বেশি কিছু জিতেছে। তাকে স্বর্ণ দেওয়া যায়। আপনারা স্বর্ণমুদ্রা প্রস্তাব করেন। কত টেলেন্ট সোনা দেওয়া যায়।

এথেন্সে সোনা মাপা হয় টেলেন্ট হিসেবে। এক টেলেন্ট সোনা অনেক টাকা। এক টেলেন্ট সোনার দামে একটি বিরাট যুদ্ধ জাহাজ হয়ে যায়।

দাওয়াতিরা ফিসফাস করছে। কত সোনা দেওয়া যায়। একজন বলল, দুই টেলেন্ট স্বর্ণমুদ্রা। লোকজন সমস্বরে বলল, বেশি, আরও বেশি দিতে হবে। আরেকজন বলল, তিন টেলেন্ট। চেরোফোন বলল, চার টেলেন্ট। পাঁচ টেলেন্টে গিয়ে অতিথিরা থামল।

আসপাশিয়া পেরিক্লিসকে দুই হাতের আঙুলগুলো দেখাল। পেরিক্লিস বললেন, ভায়েরা, আমার প্রস্তাব দশ টেলেন্ট।

সবাই হই হই করে উঠল, বহুত আচ্ছা। সে এথেন্সের জন্য যে কাজ করছে, তাতে দশ টেলেন্টই ন্যায্য।

পেরিক্লিস বললেন, কাল সকালেই আমি সংসদে প্রস্তাব করব। ভোটে পাস হলে কালই পুরস্কার। সব কিছু গরম গরম হোক।

সবাই হাততালি দিল। জোরে কিথারা বেজে উঠল। বাজনদাররাও পুরস্কারের কথায় খুশি হয়েছে। তাদের জোস এসে গেছে।

আসপাশিয়া বলল, এথেন্সের মানুষরা তো বিদেশিদের পাত্তাই দেয় না। যত জ্ঞান, বুদ্ধি সব নাকি এথেন্সের মানুষদের। বাকিরা সব ফাঁটা বাঁশ। এবার হেরোডোটাস দেখিয়ে দিল।

কথাটা বলে আড়চোখে পেরিক্লিসের দিকে তাকাল আসপাশিয়া। সবাই বুঝল কথাটার উদ্দেশ্য হেরোডোটাস নয়। উদ্দেশ্য পেরিক্লিস। পেরিক্লিস মৃদু হাসলেন। ডেমন বললেন, পেরিক্লিস দেখো, সুযোগ পেয়েই এক বিদেশিনী কেমন করে আর এক বিদেশির পক্ষে চলে গেছে।

আসপাশিয়া বলে চলল, ম্যারাথন আর সালামিনার যুদ্ধ নিয়ে যেমন করে হেরোডোটাস বলল, আমি বাজি ধরতে পারি এথেন্সের কেউ এমন করে বলতে পারত না। হেরোডোটাস এথেন্সের জন্য চিরকাল মনে রাখার মতো কাহিনি বানিয়ে দিল। অপূর্ব কাহিনি: এথেন্সে গণতন্ত্র এলো। সেই নবীন গণতন্ত্রে পারস্য আক্রমণ করল। এথেন্সের মানুষ যুদ্ধের পক্ষে ভোট দিল। প্রাণপণ যুদ্ধ করল। ম্যারাথনে জিতল এথেন্স। কিন্তু পারস্য ছাড়ল না। তারা আবার এলো এথেন্সে। পার্থেনন জ্বালিয়ে দিল। কিন্তু সাগরের যুদ্ধে পারস্যকে হারিয়ে দিল এথেন্স।

পেরিক্লিস বললেন, এর পরের ঘটনা আরও অদ্ভুত। যুদ্ধ শেষ হলো। সালামিনাস দ্বীপ থেকে সবাই এথেন্সে ফিরে এলো। এসে দেখে সারা এথেন্স পুড়ে গেছে, শহরের দেয়া ভেঙে ফেলেছে। নতুন করে ঘর বানানো হলো, শহরের দেয়াল তৈরি হলো। এর মধ্যে আর একটি কাজ হলো। পারস্য তো আবার যেকোনো সময় আসতে পারে। তাই গ্রিসের সব দ্বীপের একটি জোট দরকার। বানানো হলো জোট। ঠিক হলো সব দ্বীপ প্রতি বছর টাকা দেবে, সেই টাকা রাখা হবে ডিলোস দ্বীপে। ডিলোস দ্বীপে দেবতা এপোলোর বাড়ি। খুব পবিত্র জায়গা। তাই সেখানেই টাকা থাকবে। ডিলোস দ্বীপে প্রধান অফিস, তাই এই জোটের নাম ডিলিয়ান জোট। ডিলিয়ান জোটের নেতা হলো এথেন্স। এভাবে সারা গ্রিসের প্রধান নগরী হয়ে উঠল এথেন্স।

দার্শনিক প্রোটাগোরাস[৭২] এই সিম্পোজিয়ামে আছেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছেন। এতক্ষণে সুযোগ পেলেন।

প্রোটাগোরাস বললেন, সেই যুদ্ধের পরে অন্য নগরের সবাই ভাবলো- এথেন্স তো পুঁটি মাছের মতো ছোট্ট একটি নগরী, সেই নগরী দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সম্রাটকে হারিয়ে দিল? একবার না, দুই দুই বার। সারা দুনিয়ার মানুষ কারণ খুঁজতে শুরু করল। কারণটি হলো এথেন্সের গণতন্ত্র। যারা বুদ্ধিমান, তারা বুঝতে পারল পার্থক্যটা কোথায়। এথেন্সে কোনো রাজা-রানি নেই। সারা দুনিয়ায় রাজা আছে। রাজারা মুখের কথায় দেশ চালায়। রাজার ইচ্ছাই আইন। রাজা যখন যা মনে করে, তাই করে। কিছু চাটুকার তাকে খবর দেয়। সেই খবর শুনে রাজা আজ একে ধরে, কাল ওকে জেলে আটকে রাখে। রাজাদের হেরেমে হাজার হাজার মেয়ে থাকে। কোনো সুন্দর মেয়ে সৈনিকদের নজরে পড়লে আর রক্ষা নেই। তাই সবাই সেখানে ভয়ে থরথর করে কাঁপে। সেখানে একজন হলেন রাজা আর বাকি সবাই তার প্রজা। সবাই রাজার দাস। সেখানে জ্ঞানীরা থাকেন সবচেয়ে বিপদে। তারা রাজার আর সৈনিকদের অকাজ-কুকাজ বুঝতে পারে। কিন্তু কিচ্ছু বলতে পারেন না। বলতে গেলেই কল্লা যাবে। কিছু চাটুকার শুধু রাজার গুণগান করে। তার মধু খায়। বাকি সবাই ডরে ভয়ে জীবন কাটায়। আর উল্টো দিকে এথেন্সের গণতন্ত্রে সবাই সমান। দেশ চলে আইন দিয়ে। কারও একজনের কথায় কিচ্ছু হয় না। মানুষ ভোট দিয়ে এক বছরের জন্য কয়েকজনকে দায়িত্ব দেয়। সব সিদ্ধান্ত সবার ভোটে হয়। এখানে রাজার জুলুম নেই। সৈনিকদের ভয়-ভীতি নেই। মানুষ সত্যিই স্বাধীন। সারা পৃথিবীর জ্ঞানীরা টের পেল— এথেন্সে রাজার জুলুম নেই, সেখানে যা খুশি বলা যায়। লেখকরা শুনতে পেল— এথেন্সে সত্য কথা লেখা যায়। দার্শনিকরা শুনল, সেখানে বাচ্চাদের নতুন নতুন জিনিস শিখানো যায়, কেউ বাধা দেয় না। চিত্রকররা যা খুশি আঁকতে পারে। আর বিস্তর টাকা আছে এথেন্সে। বড় বড় দালান-কোঠা হচ্ছে। হাজার হাজার মূর্তি বানাচ্ছে। তাই ভাস্কর, প্রকৌশলী সবাই এথেন্সে আসতে শুরু করল। দেশ-বিদেশের মেধাবী মানুষ আসতে শুরু করল। যে নিজের দেশে ভয় পায়, সেই চলে আসে এথেন্সে। যার আয় নেই, জ্ঞান আছে; সেও চলে এলো এথেন্সে। কয়েক বছরের মধ্যে এথেন্স হয়ে গেল পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণীদের আখড়া। সব বিষয়ে সারা দুনিয়ার সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ এখন এথেন্সে। আজকের এই সিম্পোজিয়ামের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এমন চাঁদের হাট পৃথিবীর কোথাও নেই।

সবাই চারদিক দেখছে। প্রোটাগোরাস এক বিন্দুও মিথ্যা বলেনি। এই ঘরেই পৃথিবীর সেরা জ্ঞানী-গুণীরা বসে গল্প করছে।

চেরোফোন এবার সক্রেটিসকে গুঁতা মেরে বলল, কী, শুধু আমি নাকি একাই গণতন্ত্রের গুণগান করি? এখন দেখো— পৃথিবীর সব জ্ঞানীগুণী বলছে, গণতন্ত্রই এথেন্সের জীয়নকাঠি। এর জন্যই এই শহর দুনিয়ার সেরা শহর।

সক্রেটিস কিছু একটি বলতে যাবে, এমন সময় একটি ছেলে তাকে ধাক্কা দিল। বলল, এই সরো, ফালতু লোকজনে আলগা ভিড় করে। সরো, জায়গা দাও।

ছেলেটি সক্রেটিসকে ধাক্কা মেরে সামনে এগিয়ে গেল।

সক্রেটিস অবাক। সিম্পোজিয়ামের মতো অনুষ্ঠানে এমন কিছু আশা করা যায় না।

চেরোফোন বলল, ওর নাম এনিতাস[৭৩]। চামড়ার ব্যবসা করে। ট্যানারি আছে। গণতন্ত্রের চ্যাংড়া নেতা। নতুন নতুন নেতা হয়েছে তো, মাথা ঠিক নাই।

ক্রিতো বলল, কিন্তু সক্রেটিসের সাথে ওর কী শত্রুতা?

চেরোফোন বলল, ও নাকি পথে-ঘাটে সক্রেটিসকে গালি দেয়। আজে- বাজে কথা বলে।

সক্রেটিস বলল, আমাকে অনেকেই সুযোগ পেলেই গালি দেয়। এ আর নতুন কী!

সক্রেটিসের মৃত্যুর জন্য প্রত্যক্ষভাবে কোনো একজন ব্যক্তি দায়ী হলে তার নাম এনিতাস।

চেরোফোন বলল, ওর গালি একটু আলাদা। ও খুব পাজি লোক। বিশাল মামলাবাজ। মানুষকে বিপদে ফেলতে ওস্তাদ।

সক্রেটিস বলল, কেউ যদি আমাদের সাথে খারাপ কিছু করে, সেটি তার সমস্যা। আমাদের সমস্যা নয়। তার জ্ঞান নেই। ভালো-মন্দ বোঝে না। তাই সে খারাপ জিনিস করে। আমরা তার সাথে ভালো কাজ করলেই ধীরে ধীরে সে জানবে, জ্ঞানী হবে। জ্ঞানী হলেই সে একজন সুন্দর মানুষ হবে। আসো, আপাতত ওকে ভুলে যাই।

কিন্তু ভুলে যাওয়া গেল না। একটু পরেই সফোক্লিস একটি ঘোষণা দিলেন। তিনি সবার সামনে এনিতাসকে নিয়ে গেলেন। বললেন, ভাইসব, আমার সামনে আছে এথেন্সের তরুণ নেতা এনিতাস। সিদ্ধান্ত হয়েছে, কাল সকালে সংসদে হেরোডোটাসের পুরস্কার প্রস্তাব করবে এই এনিতাস।

সকলে একটু অবাক। পেরিক্লিস প্রস্তাব করবেন না?

পেরিক্লিস হাত তুলে বললেন, আমরা তরুণদের সুযোগ দিতে চাই। এনিতাস তরুণ, সে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। কাল পুরস্কারের প্রস্তাব করবে এনিতাস।

সবাই হাততালি দিল। এনিতাস নেতার মতো সবার দিকে হাত তুলল। চেরোফোন ফিসফিস করে বলল, এনিতাস খুব ধড়িবাজ লোক। পশ্চিম পাড়ায় বাড়ি, মহল্লার নাম ইউনিমন। ঐ মহল্লায় অনেক মানুষ, অনেক ভোট। ও অনেক লোকজন নিয়ে পিনিক্স পাহাড়ে যায়, একসাথে ভোট দেয়। তাই ওর কথা রাখতে হয়। ও সফোক্লিসকে দিয়ে পেরিক্লিসকে ম্যানেজ করেছে। কাল সকালে পিনিক্স পাহাড়ে সংসদে হাজার হাজার লোকের সামনে সে নেতা হয়ে যাবে।

সক্রেটিস চুপ করে দেখছে, গণতন্ত্রে কেমন করে অসভ্য মানুষও নেতা হয়ে যায়! অন্যদের সেটি মেনে নিতে হয়।

ক্রিতো বলল, চলো, আমার আর এখানে ভালো লাগছে না। এর চেয়ে আমাদের খোলা আকাশের নিচের আড্ডা অনেক ভালো।

সক্রেটিস, ক্রিতো আর চেরোফোন বের হয়ে গেল। বের হওয়ার সময় শুনল, আসপাশিয়া পেরিক্লিসকে বলছে, এ কেমন লোককে তোমরা সামনে ঠেলে দিচ্ছ? ঐ এনিতাসের চোখ দেখেছ? ওর চোখে হিংসা, ওর মধ্যে আক্রোশ। এমন মানুষ গণতন্ত্রের নেতা হলে, এথেন্সের বিপদ আছে।

***

৭১. হেরোডোটাসের বইয়ের ইংরেজি নাম ‘The Histories’, গ্রিক ভাষায় Historía, যার অর্থ inquiry

৭২. দার্শনিক প্রোটাগোরাস (Protagoras) গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক। তার বিখ্যাত উক্তি : ‘Man is the measure of all things’. প্লেটো তার Protagoras ডায়ালগে সক্রেটিস ও প্রোটাগোরাসের সংলাপে গণতন্ত্র সম্পর্কে সক্রেটিসের ধারণা প্রকাশ করেছেন।

৭৩. এনিতাস (Anytus): এথেন্সের গণতন্ত্রী নেতা, সক্রেটিসের বিরুদ্ধে মামলার বাদী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *