1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ১৯

১৯

‘শুধু সুন্দর নামের কোনো মূল্য নেই, যদি নামের যোগ্য প্রতিভা না থাকে।’

— হোমার

***

আজ বিকালে বিশাল অনুষ্ঠান।

সক্রেটিস আর ক্রিতো চলেছে সেই অনুষ্ঠানে। এক্রোপোলিসের দক্ষিণ কোণে একটি নতুন ভবন তৈরি করেছেন পেরিক্লিস। বিশাল ভবন। এখানে গান, নাচ, থিয়েটার হয়। কিন্তু আজ সেখানে নাচ-গান নয়, আজ গল্প বলা হবে। গল্প বলবে হেরোডোটাস।

ভবনের চারদিকে অর্ধ-গোলাকার গ্যালারি। গ্যালারির যেখানেই বসুন না কেন, শব্দ শোনার জন্য আছে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা। অডিও ভালো শোনা যায় বলে এই ভবনের নাম অডিওন। এই অডিওনই এখন এথেন্সের প্রধান বিনোদন কেন্দ্র।

আজকের বিনোদন অন্য রকমের। মানুষ তো প্রথমে বিশ্বাসই করেনি যে গল্প বলার জন্য অনুষ্ঠান হতে পারে। তবে আয়োজনের বাহার দেখে মনে হচ্ছে বড়ো কিছু একটিই হবে। বিশাল কাণ্ড চলছে। সাত দিন ধরে সারা এথেন্সে ঢোল- নাকারা পিটিয়ে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। বিকেল হতেই লাইন দিয়ে মানুষ আসছে।

আসপাশিয়া বিশেষভাবে খবর দিয়েছে সক্রেটিসকে। সে যেন অবশ্যই আসে। আজকের অনুষ্ঠানে নাকি পেরিক্লিস একটি নতুন চমক দেবে।

ক্রিতো বলল, পেরিক্লিস অডিওনের অনুষ্ঠান সবার জন্য বিনামূল্যে করে দিয়েছেন। আগে অনুষ্ঠান দেখতে টিকেট লাগত। সে একটি ঝানু লোক।

সক্রেটিস বলল, গণতন্ত্রের নেতাকে সব সময় প্রেমের অভিনয় করতে হয়। মানুষকে ভালোবাসার অভিনয়।

গ্যালারি এর মধ্যেই প্রায় ভরে গেছে। তারা পেছনের দিকে বসল। প্রথম সারি পেরিক্লিস ও অন্য নেতাদের জন্য। দ্বিতীয় সারিতে বসবে সৈনিকরা।

সফোক্লিসের সাথে অডিওনে প্রবেশ করল হেরোডোটাস। তার হাতে কয়েক টুকরো পেপিরাস। সে কিছু কিছু অংশ লিখে এনেছে। সবার দৃষ্টি তার দিকে। গ্যালারি টইটুম্বুর। তিল ধারণের জায়গা নেই কোথাও।

একটু পরেই উত্তরের গেইট দিয়ে ঢুকলেন পেরিক্লিস। তিনি ঢোকার সাথে সাথে সারা গ্যালারিতে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সবাই বলছে, কে এসেছে? কে এসেছে? সবাই দাঁড়িয়ে কাকে যেন দেখার চেষ্টা করছে। না, তারা পেরিক্লিসকে দেখছে না। পেরিক্লিসের সাথে এসেছে আসপাশিয়া। তাকেই দেখছে।

ক্রিতো বলল, আসপাশিয়াকে নিয়ে এসে পেরিক্লিস ভীষণ সাহসের কাজ করেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো আসপাশিয়ার জন্য হেরোডোটাস তো বিপদে পড়ে গেল। সবাই আসপাশিয়াকেই দেখছে। কেউ হেরোডোটাসকে দেখছে না। আজ আর কেউ তার কথা শুনবে না। সে ডাব্বা মারবে।

অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে। হেরোডোটাসকে নিয়ে মঞ্চে গেলেন সফোক্লিস। তিনি বললেন, প্রিয় এথেন্সবাসী, দেবী এথিনার কৃপায় আমাদের মাঝে এখন হাজির হবে হালিকারনাসস শহর থেকে আগত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার নাম হেরোডোটাস। সে গল্প বলবে। আমাদের গল্প। এথেন্সের গল্প। তো আর দেরি নয়-এক্ষুনি মঞ্চে আসছে অসাধারণ গল্পকার, অদ্ভুত কাহিনিকার হেরো… ডোটাস।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন হেরোডোটাস। তার পা কাঁপছে। মনে হচ্ছে গলা দিয়ে স্বর বের হবে না। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে শুধু তার কথা শোনার জন্য এত বড় অনুষ্ঠান? সামনে পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী গুণী মানুষেরা বসে আছেন। শুধু তার গল্প শুনবে। ভীষণ ভয় করছে হেরোডোটাসের। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। লোকজন ফিসফিস শুরু করেছে। আরও দেরি করলে হাসি ঠাট্টা শুরু হয়ে যাবে।

হেরোডোটাস মনে মনে দেবী এথিনাকে বলল, ‘দেবী, গরিবের ইজ্জত রেখো।’ তারপর গভীর নিশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর সবচেয়ে মহৎ মাটির উপর। সারা পৃথিবীর মানুষ যে মাটির কাছে ঋণী, সেই পুণ্যভূমি এথেন্সের মাটিতে দাঁড়াতে পেরে আমি ধন্য।

আপনারা আমার সালাম গ্রহণ করুন।

চারিদিকে তুমুল করতালি। চমকে উঠেছেন পেরিক্লিস। চমকে উঠেছেন সফোক্লিস। সংকোচে গুটিসুটি হয়ে ছিল আসপাশিয়া। সেও অবাক।

ক্রিতো চিৎকার করে বলল, সক্রেটিস, হেরোডোটাস তো মাৎ‍ করে দিল একটু আগে সবাই আসপাশিয়াকে দেখছিল। এখন সব চোখ হেরোডোটাসের দিকে। এই ব্যাটা তো কথার জাদুকর।

হেরোডোটাস চোখ বন্ধ করে করতালির শব্দ শুনছে। এত মধুর শব্দ! প্রতিটি করতালি যেন শক্তি হয়ে তার মধ্যে ঢুকছে। ভেতর থেকে বের হচ্ছে নতুন এক হেরোডোটাস। সে ভাবছে আজই সুযোগ। এথেন্সবাসী যদি তার কথা পছন্দ করে, সেও হয়ে যেতে পারে নতুন একজন হোমার।

হেরোডোটাস বলে যাচ্ছে এথেন্সের কাহিনি। তার গলা ভরা আবেগ। এই হাসছে, এই কাঁদছে। তার সাথে দর্শকরাও হাসছে আবার কাঁদছে। একটু পর পর পড়ছে করতালি। হেরোডোটাস গণতন্ত্র আবিষ্কারের কথা বলল। মহামতি সলোন আর ক্লিসথেনিসের কথা বলল। এরপর বলল, আমাদের সামনে এই মুহূর্তে একজন নেতা বসে আছেন। এই নেতা যখন তার মায়ের পেটে ছিলেন, তখন একদিন মা স্বপ্নে দেখলেন— তিনি সিংহ প্রসব করেছেন। মায়ের স্বপ্ন সত্য হয়েছে। আমাদের সামনে এখন সত্যিই বসে আছেন এক সিংহ। তিনি আর কেউ নন; আমাদের সবার প্রিয় নেতা, এথেন্সের সিংহ পুরুষ পেরিক্লিস।

বিশার হাততালি। পেরিক্লিস লজ্জা পেলেও উপভোগ করছেন।

সফোক্লিস চোখ বাঁকা করে হেরোডোটাসকে দেখছেন। ছেলেটা একেবারে জায়গামতো আঘাত করেছে। পেরিক্লিসের এমন প্রশংসা করতে অন্য কেউ পারেনি। হেরোডোটাস তো মহা ধুরন্ধর। তার পেটে বহুত গুড়া প্যাঁচ। সময় মতো প্যাঁচগুলো কাজে লাগাচ্ছে। সে উন্নতি করবে।

হেরোডোটাস বলে চলেছে, এবারে এথেন্সের সবচেয়ে বড় বীরত্বের কথায় আসি। এখন বলব— সেই যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে এথেন্স গ্রিসকে বাঁচিয়েছে সে যুদ্ধের নাম— ম্যারাথনের যুদ্ধ।

লোকজন সব নড়েচড়ে বসল। এখানের অনেকেই ম্যারাথন যুদ্ধ করেছেন। প্রায় সবার ঘরেরই কেউ না কেউ সেই যুদ্ধে গিয়েছিল। এখন সবাই চুপ। একেবারে পিন পতন নীরবতা।

হেরোডোটাস গম্ভীরভাবে বলছে ম্যারাথন যুদ্ধের কথা—

তখন এথেন্সে মাত্র গণতন্ত্র এসেছে। মানুষ নিজেই রাজা হয়েছে। মানুষের অনেক সাহস। অনেক আনন্দ। আনন্দে সবাই দিন রাত কাজ করছে। পড়াশুনা করছে। গবেষণা করছে। মানুষ জ্ঞানী হচ্ছে। ধনী হচ্ছে। এথেন্স হয়ে উঠছে সুন্দর থেকে সুন্দরতম। সেই সময় এই সুন্দরী এথেন্সের উপর নজর পড়ল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য পারস্যের

পারস্যের রাজা দারিউস। দারিউসের নামে চারদিক থরথর করে কাঁপে। এথেন্সের লোকজন দারিউস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। তারা জানে তার নাম ‘বড় রাজা’। সেই বড় রাজার এমনই প্রতাপ যে তার সামনে কেউ চোখ তুলে তাকায় না। মন্ত্রীরাও তার সামনে কাপড়ে মুখ ঢেকে কথা বলে যেন তাদের নিশ্বাসের বাতাসটাও বড় রাজার আশেপাশে না যায়। এশিয়া আর আফ্রিকা জুড়ে তার রাজত্ব। মিশর, ব্যাবিলন থেকে ভারত পর্যন্ত। তিনি অগ্নি উপাসক। আগুনই তার দেবতা।

তো পারস্যের বড় রাজা দারিউস সাহেবের খায়েস হলো এবার ইউরোপে রাজ্য বাড়াবেন। সেনা পাঠালেন। বসফরাস প্রণালি পার হয়ে তার সেনারা আসতে থাকল এশিয়া মাইনরের ছোট ছোট দ্বীপে। অনেক দ্বীপই পারস্যের কাছে হার মানল। শুধু আইওনিয়ান সাগরের কয়েকটা দ্বীপ হার মানল না। তারা একজোট হয়ে পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল। তারা অন্য সকল গ্রিক দ্বীপের কাছে সাহায্য চাইল। কিন্তু পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে কেউ সাহস পেল না। শুধু একটি নগর সাহস দেখাল। সেই সাহসী নগর হলো আমাদের এই এথেন্স।

অডিওনের দর্শকরা আবার হাততালি দিল।

হেরোডোটাস বলে চলেছেন :

এথেন্সে তখন গণতন্ত্রের বয়স তখন মাত্র আঠারো বছর। সংসদে তর্ক হলো পারস্যের বিরুদ্ধে গ্রিক দ্বীপগুলোকে সাহায্য করা হবে কিনা। নেতারা বললেন, গণতন্ত্র মানে মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো। দুর্বলের পক্ষে দাঁড়ানো। সংসদে পাস হলো, হ্যাঁ, এথেন্স পারস্যের বিপক্ষে আইওনিয়ান দ্বীপগুলোকে সাহায্য করবে। তারা যুদ্ধ জাহাজ পাঠাল। এথেন্সের এই স্পর্ধার কথা শুনল বড় রাজা দারিউস। পুঁচকে এথেন্সের এই দুঃসাহস তার অসহ্য লাগল। সে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠাল এথেন্স দখল করতে।

নতুন গণতন্ত্রের জন্য এ এক অগ্নিপরীক্ষা। কী করবে তারা? সবাই ছুটে এলো পিনিক্স পাহাড়ে। আবার ভোট হবে— যুদ্ধ নাকি আত্মসমর্পণ? মুক্তি নাকি দাসত্ব? মুক্তি চাইলে যুদ্ধ করতে হবে। এথেন্সের প্রতিটি নাগরিক জেনে বুঝে ভোট দিল— তারা যুদ্ধ করবে। তারা বলল, আমরা বীরের জাতি। আমরা প্রত্যেকে এক-একজন একিলিস। এক-একজন হারকিলিউস। আমরা হার মানব না। নিজেদের বাঁচাতে যুদ্ধ করব।

পৃথিবীতে সেদিন একটি নতুন ঘটনা ঘটল। এই প্রথম সাধারণ জনগণ তাদের নিজের ইচ্ছায় যুদ্ধের জন্য ভোট দিল। তাদের যুদ্ধ কোনো রাজার জন্য নয়, রানির আদেশে নয়। নিজেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ। পরিবারকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ। মুক্তির জন্য যুদ্ধ। এথেন্সের গণতন্ত্র সেদিন মাতৃভূমিকে বাঁচাতে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক হলো এজিয়ান সাগরের তীরে ম্যারাথন[৫৭] নামক জায়গায় তারা পারস্যবাহিনীর মুখোমুখি হবে।

যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলো। প্রত্যেক বয়স্ক পুরুষ যুদ্ধ করবে। যার যা আছে, তাই নিয়েই যুদ্ধ করবে। সব চেষ্টার পরেও দেখা গেল, এথেন্সের সেনাসংখ্যা পারস্যের অর্ধেকেরও কম। এথেন্সের সাহায্য দরকার। মিত্র দরকার। এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী নগর হলো স্পার্টা। এই বিপদে স্পার্টা যদি সাহায্য করে, তাহলে পারস্যের মোকাবিলা করা সম্ভব। স্পার্টায় খবর পাঠাতে হবে। হাতে কোনো সময় নেই। দু’এক দিনের মধ্যেই পারস্যের সেনারা এসে পড়বে। তাই কালকের মধ্যেই স্পার্টার সেনাদের নিয়ে আসতে হবে।

পাহাড়ি এলাকা। কোনো রাস্তা নেই। ঘোড়াও যেতে পারে না। খবর দিতে হলে কাউকে দৌড়ে যেতে হবে। এগিয়ে এলো একজন। তার নাম ফিডিপিডিস। সে এক দৌড়ে স্পার্টায় গিয়ে খবর দেবে। সে হলো নতুন খবরি।

ফিডিপিডিস শুরু করল দৌড়। জীবন বাঁচানোর দৌড়। এথেন্সকে বাঁচানোর দৌড়। মাতৃভূমি রক্ষার দৌড়। সে একশ পঁচিশ মাইল দৌড়ে স্পার্টার রাজার দরবারে পৌঁছল। কিন্তু লাভ হলো না। স্পার্টা সাহায্য করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে নয়। এখন স্পার্টায় উৎসব চলছে। এই উৎসবের সময় তাদের যুদ্ধ করার নিয়ম নেই। আগামী পূর্ণিমার পরের দিন তাদের সেনারা এথেন্সের দিকে যাত্রা করবে।

হতভম্ব হয়ে গেল ফিডিপিডিস। যুদ্ধ তো কালকে। এথেন্সের মানুষ আশা নিয়ে বসে আছে। ফিডিপিডিস স্পার্টার সেনাদের নিয়ে ম্যারাথনের ময়দানে উপস্থিত হবে। এখন সে ফিরে গিয়ে কী বলবে? তবু এই খবরটাই এথেন্সে দ্রুত পৌঁছাতে হবে। তারা অন্য পরিকল্পনা করবে। সে আবার দৌড় শুরু করল। এবার স্পার্টা থেকে সরাসরি যেতে হবে ম্যারাথনের ময়দানে।

এথেন্সের সব পুরুষ এখন ম্যারাথনে। তাদের সেনাপতি দশজন আর দশজনের প্রধানের নাম মিলটিয়াডিস[৫৮]। তারা যুদ্ধের নতুন এক কায়দা বের করেছে। মাঝারি পর্যায়ের একদল সেনা আছে যাদের নাম হপলাইট। তাদের এক হাতে বর্শা আর অন্য হাতে বিশাল ঢাল। তারা পরীক্ষা করে দেখেছে একসাথে আটজন হপলাইট গোল হয়ে ঢালগুলো কোনাকুনি উঁচু করে ধরতে পরলে চারদিক ঢেকে যায়। তাতে কারও গায়ে আর বিপক্ষ দলের তীরের বা বর্শার আঘাত লাগতে পারে না। সেজন্য তারা আটজন করে হপলাইট একসাথে গোল হয়ে এগোয়। বিপক্ষে ঢুকে একসাথে আক্রমণ করে টপাটপ কয়েকজনকে মেরেই আবার একসাথে গোল হয়ে যায়। একটু পর পর একসাথে আক্রমণ করে আবার একসাথে গোল হয়ে যায়। এই যুদ্ধ কায়দার নাম হপলাইট যুদ্ধ।

পারস্য সেনারা এসে পৌঁছল। তাদের সংখ্যা এথেন্সের সেনার দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হতেই এথেন্সের কৌশলে পারস্য বিপদে পড়ে গেল। হপলাইটদের কায়দায় বেঘোরে মরতে শুরু করল পারস্য বাহিনী।

টানা দুই দিন দৌড়ে ফিডিপিডিস ম্যারাথনে পৌঁছে দেখে অর্ধেকের কম সেনা নিয়ে কী প্রাণপণ যুদ্ধ করছে এথেন্সবাসী। সে জীবনে অনেক যুদ্ধ দেখেছে, কিন্তু এমন প্রাণপণ সংগ্রাম দেখেনি। সে ভাবছে এমন করে কীভাবে লড়ছে এথেন্সের মানুষ? তার মনে পড়ল— এথেন্সের যারা যুদ্ধ করছে তারা সাধারণ নাগরিক, ভাড়াটে সৈনিক নয়। তারা ভোট দিয়েছে যুদ্ধ করার জন্য। তারা টাকার জন্য নয়; লড়াই করছে নিজেকে বাঁচাতে, পরিবারকে বাঁচাতে।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না এথেন্সের সেনারা। এথেন্স জিতে যাচ্ছে। বিশাল পারস্য বাহিনী জাহাজে উঠে পালাচ্ছে। আনন্দে তারা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছে। চিমটি কেটে দেখছে আসলেই কি জিতে গেছি! তারা চিৎকার করে বলল— জয় এথিনা। কিন্তু খবর এলো যুদ্ধ শেষ হয়নি। পারস্য বাহিনী ফন্দি করেছে। তারা জাহাজ নিয়ে ম্যারাথন থেকে ঘুরপথে এথেন্সের দিকে যাচ্ছে। সরাসরি এথেন্স দখল করবে।

আবার শুরু হলো দৌড়। এবার ম্যারাথন থেকে এথেন্সের দিকে। সবাই একসাথে দৌড়। শত্রুর আগে এক্রোপোলিস পৌঁছাতে হবে। বাঁচাতে হবে এথেন্সকে।

ফিডিপিডিস সবার আগে। তার গতি অনেক বেশি। সবাইকে পিছে ফেলে সে এগিয়ে যাচ্ছে। এথেন্সের কাছাকাছি এসে গেছে ফিডিপিডিস। একজন খবর দিল আর দৌড়াতে হবে না। পারস্যের জাহাজ আর এথেন্সের দিকে আসেনি। তারা পালিয়ে গেছে।

তবু ফিডিপিডিস থামছে না। এখন দৌড়াতে ভালো লাগছে। এই দৌড় জয়ের দৌড়। সে সবাইকে জানাবে এথেন্স জিতে গেছে। সে থামতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে দৌড়ের মতো এত সুন্দর জিনিস আর হয় না।

ফিডিপিডিস এথেন্সে এসে গেছে। ঐ তো এক্রোপলিস! ঐ তো দেবী এথিনা। দেখা যাচ্ছে। পৌঁছে গেছি দেবী এথিনার মন্দিরে। এক্ষুনি দেবীকে গিয়ে বলব, দেবী, আমরা জিতে গেছি। সত্যি জিতে গেছি। কিন্তু তার পা যে চলছে না! মনে হচ্ছে পায়ের পেশি ছিপে যাচ্ছে। গত দুদিনে সে দুইশ মাইলের বেশি দৌড়েছে। এখন ম্যারাথন থেকে এথেন্স পর্যন্ত একটানা ছাব্বিশ মাইল। আর পারছে না। তার বুক ফেটে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে গেছে। তীব্র কষ্ট হচ্ছে। তবু ছুটছে। এথেন্সের লোকজন ছুটে আসছে। তাদের চোখে ভয়। ফিডিপিডিস একা কেন? তাহলে কি এথেন্স হেরে গেছে?

ফিডিপিডিস এখন পা তুলতেও পারছে না। তবুও আগাচ্ছে। মনের জোরেই আগাচ্ছে। তার মাথা ঘুরছে, নিঃশ্বাস টানতে পারছে না, চোখে অন্ধকার দেখছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি লুটিয়ে পড়বে। তবুও সে অবস্থাতেই কোনোমতে পৌঁছল এক্রোপলিসে। এথিনার মূর্তি ছুঁয়ে হাত তুলে চিৎকার করে উঠল— আমরা জিতে গেছি। আমরা জিতে…

শেষ করতে পারল না কথাটা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ফিডিপিডিস[৫৯]। মন্দিরের লোকেরা ধরাধরি করে তুলতে গেল। কিন্তু না, তার দেহে সাড়া নেই। প্রাণও নেই। শুধু চোখে কয়েক ফোঁটা পানি। ডান হাত মুঠো করে উপরে তোলা। মুখটা হাঁ করে আছে। ‘আমরা জিতে গেছি’ কথাটা শেষ করতে পারেনি। ফিডিপিডিস পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে দেবী এথিনাকে জয়ের খবর দিয়ে গেছে। গত দুই দিন সে কেবল দৌড়েছে। একটি বিজয়ের খবরের জন্য ছুটেছে। যে খবরের জন্য সে ছুটেছে, সেই খবর সে এনেছে। এথেন্স জিতেছে। ম্যারাথন ময়দান থেকে জেতার খবর নিয়ে এসেছে ফিডিপিডিস। কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়ে নিজে চলে গেছে চিরকালের জন্য।

হেরোডোটাস বলে চলছে—

ফিডিপিডিস নেই। এথেন্স আছে। ম্যারাথনের বিজয় আছে। ঐ যে,

দেবী এথিনা। দেবী আজও বলছেন, আমরা জিতে গেছি। এথেন্সের বাতাস বলছে, আমরা জিতে গেছি। এথেন্স জিতে গেছে।

শুধু খবরটা আর একবার বলার জন্য ফিডিপিডিস আর নেই। সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। চিরতরে চলে গেছে।

বলতে বলতে হেরোডোটাস থামল। তার চোখ পানিতে ভরে গেছে। ফিডিপিডিসের জন্য সে কাঁদছে। বুক ভাসিয়ে কাঁদছে। প্রতিটি দর্শকের চোখে পানি। তারাও কাঁদছে। সবাই ফিডিপিডিসের জন্য কাঁদছে।

আসপাশিয়া ইশারা করল। পেরিক্লিস ধীরে ধীরে মঞ্চে উঠলেন। জড়িয়ে ধরলেন হেরোডোটাসকে।

অশ্রুভরা গলায় পেরিক্লিস বললেন, ভাইয়েরা আমার। আমরা ফিডিপিডিসকে ভুলিনি। তার স্মরণে প্রতি বছর ম্যারাথন থেকে এথেন্স পর্যন্ত একটি দৌড় হয়। সে দৌড়ের নাম ম্যারাথন দৌড়। আমরা সবাই এই যুদ্ধের কাহিনি জানি। কিন্তু আজ হেরোডোটাস যেভাবে বলল, তেমন করে কেউ বলতে পারেনি। বিদেশি হয়ে সে এথেন্সের জন্য কাঁদছে। তার সাথে আমরা কাঁদছি। এই কান্না সুখের। এই কান্না গর্বের। এই কান্না এথেন্সের বীরত্বের। আসুন, আমরা হেরোডোটাসের জন্য একটি বড় হাততালি দিই।

মুহূর্তেই সারা ঘর করতালিতে ফেটে পড়ল। তালি চলছেই। মনে হচ্ছে আজ রাতে এই করতালি থামবে না। পেরিক্লিস বললেন, বন্ধুরা, হেরোডোটাসকে আমরা সম্মানিত করব। আমরা তাকে পুরস্কার দেব। আপনারা বলুন, কী পুরস্কার দেব? সোনা নাকি রুপা?

দর্শকরা চিৎকার করে বলল, সোনা।

‘ঠিক আছে। পাস হলো স্বর্ণ মুদ্রা দেব। আমার ইচ্ছা করছে তাকে দু হাত ভরে সোনা দিই। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত এখানে নয়। কত মুদ্ৰা দেওয়া হবে সেটি সংসদে ভোটে ঠিক হবে।’

দর্শকরা বলল, তাই হোক।

পেরিক্লিস বললেন, আজ থেকে হেরোডোটাস আমাদের সম্মানিত অতিথি। তিনি যতদিন ইচ্ছা এথেন্সে থাকবেন। সব দায়িত্ব এথেন্স সরকারের।

তুমুল করতালি পড়ছে চারদিকে। পেরিক্লিস বললেন, ‘আরও আছে। হেরোডোটাস এই কাহিনি নিয়ে বই লিখবে। আমরা এথেন্সের পক্ষ থেকে সেই বই প্রকাশ করব। সব খরচ আমাদের। শেষ কথা : আমাকে আসপাশিয়া একটি বুদ্ধি দিয়েছে।’

দর্শকরা চমকে উঠল। মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল— কে বুদ্ধি দিয়েছে?

‘আসপাশিয়া। সে বলেছে দুই সপ্তাহ পরে অলিম্পিক প্রতিযোগিতা। অলিম্পিকে সারা পৃথিবীর মানুষ আসে। সেখানে আমরা হেরোডোটাসকে নিয়ে যেতে পারি। সবার সামনে হেরোডোটাস এথেন্সের কথা বলবে। আপনারা কী বলেন?’

সবাই রাজি। এরচেয়ে ভালো প্রস্তাব আর হয় না। পেরিক্লিস বললেন, হেরোডোটাস যদি রাজি থাকে, আমরা তাকে অলিম্পিয়ায় নিয়ে যাব।

হেরোডোটাস বলল, এথেন্সের মানুষ যদি চায়, আমি সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে এথেন্সের কথা বলব। আর অলিম্পিকের ময়দান তো আমার জন্য বিরাট সুযোগ। আমি যাব, অবশ্যই যাব।

এবার উঠে দাঁড়ালেন সফোক্লিস। তিনি মজা করে বললেন, কিন্তু বাপু পেরিক্লিস। তুমি তো অলিম্পিয়ায় যাও না। সেখানে নাকি স্পার্টার সাথে এথেন্সের খেলোয়াড়রা পারে না। তুমি সত্যি সেখানে যাবে?

পেরিক্লিস বললেন, যাব। এই বছর আমি অলিম্পিকে যাব। কারণ এবার আমার সাথে আছে একজন গল্পবাজ খেলোয়াড়। তার নাম হেরোডোটাস। অলিম্পিকে এথেন্সের খেলোয়াড়রা জিতুক আর নাই জিতুক, হেরোডোটাস জিতবে। এথেন্সও জিতবে।

গ্যালারিতে বসে সক্রেটিস আর ক্রিতো সব দেখছিল। সক্রেটিস ক্রিতোকে বলল, পেরিক্লিসের কূটনীতিটা দেখেছো! আসপাশিয়াকে কেমন করে সবার সামনে নিয়ে এলেন। সবাই আসপাশিয়াকে মেনে নিলো। আসপাশিয়ার বুদ্ধিতে সিদ্ধান্ত নিল এথেন্সের মানুষ। তার কথাতেই হেরোডোটাসকে নিয়ে যাচ্ছে অলিম্পিকে। পেরিক্লিস এক ঢিলে দুই পাখি নয়, অনেকগুলো পাখি মারলেন।

ক্রিতো বলল, যাবে নাকি এবার অলিম্পিকে? চলো— তুমি, আমি আর চেরোফোন সবাই মিলে হই হই করে অলিম্পিকে যাই।

***

৫৭. ম্যারাথন : ম্যারাথন যুদ্ধ হয়েছিল খ্রি.পূ. ৪৯০ সালে, ম্যারাথনের প্রান্তর এথেন্স শহর থেকে ৪২ কি.মি. উত্তর-পূর্ব দিকে (প্রায় ২৬ মাইল)।

৫৮. ম্যারাথন যুদ্ধে এথেন্সের সেনাপতি ছিলেন মিলটিয়াডিস (Miltiades), পারস্যের বিরুদ্ধে ম্যারাথন প্রান্তরে তার যুদ্ধকৌশলেই এথেন্স জয়লাভ করেছিল।

৫৯. ম্যারাথন প্রান্তর থেকে জয়ের খবর নিয়ে ৪২ কিলোমিটার দৌড়ে এথেন্সে এসে মৃত্যুবরণ করেন এথেন্সের দৌড়বিদ ফিডিপিডিস (Pheidippides)। তার এই দৌড়ের স্মরণেই এখনও ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *