১৩
‘রক্ত-রাঙা মিষ্টি একটি আপেল
রয়ে গেছে সবচেয়ে উঁচু ডালে
চেয়েছে অনেকে, পায়নি নাগালে
আজও অনাঘ্রাত, নিবে কি তুলে?’
***
আসপাশিয়া মিষ্টি করে কবিতাটি বলল। এটি লিখেছেন লেসবস দ্বীপের নারী কবি শাপো[৪৮]। আসপাশিয়া খুবই আবেগ দিয়ে কবিতাটি বলছে। পেরিক্লিস যেন বুঝতে পারেন কবিতার এই অনাঘ্রাত আপেল সে নিজে।
পেরিক্লিস বোঝার চেষ্টা করছেন। এটি একটি বিখ্যাত কবিতা। প্রেমের জন্য খুবই ভালো। যুবকদের মুখে প্রায়ই শুনা যায় কবিতাটি। তবে এই মুহূর্তে কবিতটি নিয়ে ভাবছেন না পেরিক্লিস। তিনি ভাবছেন কবিকে নিয়ে। এই কবিতার নারী কবি শাপোকে নিয়ে অনেক কানাঘুষা আছে। তাকে নিয়ে গুজবের শেষ নেই। মেয়েরা কিছু লিখলে সেটি নিয়ে এমনিতেই আলোচনা, সমালোচনা হয়। আর কোনো মেয়ে যদি প্রেম নিয়ে লিখে, সেটি নিয়ে পুরুষের কেমন যেন লাগে। তারা কানাঘুষা শুরু করে, কানাঘুষা থেকে তৈরি হয় গুজব। এই কথা কবি শাপো জানতেন না। তিনি মেয়ে হয়েও প্রেমের কবিতা লিখেছেন। একটি দুটো নয়, পুরো এক বই প্রেমের কবিতা।
শাপোর কবিতার বই প্রকাশের সাথে সাথেই শুরু হলো আক্রমণ। একটি মেয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছে। মেয়েরা প্রেমের কবিতা কেন লিখবে? প্রেমের কবিতা লিখবে পুরুষেরা। পুরুষেরা মেয়েদের দেখে প্রেমের কবিতা লেখে। প্রেমের কবিতা হলো মেয়েদের উদ্দেশ্যে লেখা। তো কবি শাপো প্রেমের কবিতা লিখেছে, মানে সে মেয়েদের উদ্দেশ্যেই লিখেছে। তার মানে তার কবিতা হলো মেয়ের প্রতি মেয়ের প্রেম। ছিঃ ছিঃ, শাপো এত খারাপ? সে মেয়ে হয়ে মেয়েদের উদ্দেশ্যে প্রেমের কবিতা লেখে? সে মেয়েদের ভালোবাসে? কেউ জানতে চাইল না, শাপো কার জন্য এই কবিতা লিখেছে। সবাই বলল, কবি শাপো ছেলেদের ভালোবাসে না, সে মেয়েদের ভালোবাসে। কবি শাপোর যেখানে বাড়ি, সেই দ্বীপের নাম লেসবস। লেসবস দ্বীপের নাম থেকে মেয়ের সাথে মেয়ের প্রেম বিষয়টির নাম দিল লেসবিয়ান।
ব্যাপারটা ভাবতেই মাথা ধরে যাচ্ছে পেরিক্লিসের। মানুষ এত খারাপ? তারা মেয়েদের কবিতা লিখতেও দেবে না। মেয়েরা কবিতা লিখলেই গ্রিসে নিন্দা হয়। সেই ভয়ে আজ পর্যন্ত গ্রিসে কোনো মহিলা কবি নেই। ভদ্র মেয়েরা কবিতা থেকে দূরে থাকে। তারা কবিতাকে ভয় পায়।
আসপাশিয়ার এই ভয় নেই। সে কেমন সুন্দর করে কবিতাটি আবৃত্তি করছে। পেরিক্লিস যখন শাপোকে নিয়ে ভাবছিল, সেই ফাঁকে আরও একবার কবিতাটি আবৃত্তি করে ফেলেছে সে।
আসপাশিয়া বলল, কবিতার অনাঘ্রাত আপেল কে জানেন?
‘কে?’
‘এথেন্স। আপনার ভালোবাসার এথেন্স। আমি জানি আপনি এথেন্সকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। গণতন্ত্রকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।’
কথা মিথ্যা নয়। পেরিক্লিস এথেন্স আর গণতন্ত্রকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। পেরিক্লিস এবার গণতন্ত্র নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন এই মেয়ে তাকে নাচাচ্ছে। কিন্তু কেন যেন নাচতে তার ভালো লাগছে।
আকাশে অনেক তারা। পেরিক্লিস জানালা দিয়ে আকাশে তাকিয়ে আছেন। রাতটা বড়ো সুন্দর। একটু আগেই আসপাশিয়া এই রাতকে বলেছে ‘গণতন্ত্রের চাদরের উপর নির্ঘুম রাত।’
একটি মেয়ে খাবার দিয়ে গেছে। ভুট্টার স্যুপ আর ছাগলের পা। হাল্কা মশলা দিয়ে ছাগলের পা কড়া করে ভাজা। এই খাবারের নাম পাইদাকি আসপাশিয়ার খুব প্রিয় খাদ্য। সে নিজে আজ অনেক মমতা দিয়ে রান্না করেছে। পেরিক্লিস ভুট্টার স্যুপ দিয়ে পাইদাকি খাচ্ছেন।
খাওয়া শেষ হলে আসপাশিয়া বলল, গণতন্ত্রের গল্প ভুলে যেতে নাহি দেব। বলুন, আপনার দাদু কীভাবে গণতন্ত্র আবিষ্কার করলেন।
পেরিক্লিস আবার বক্তৃতার মতো করে শুরু করলেন—
সলোনের আইনে অনেক দিন ধনী-গরিব মিলেমিশে ভালোই চলছিল। কিন্তু সেই সময় ভালো কোনো নেতা ছিল না। যেকোনো ব্যবস্থা সুন্দরভাবে চলতে ভালো নেতা চাই। নেতার অভাবে আবার শুরু হলো অশান্তি। সেই অশান্তির ঘোলা পানিতে ক্ষমতা দখল করলেন এক একনায়ক। তিনি অনেক বছর এথেন্স শাসন করেছেন। তিনি ছিলেন মহাধুরন্ধর। সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারতেন। কিন্তু একনায়কদের নিয়মই হলো কয়েকজনে সব লুটে-পুটে খায়। এথেন্সেও তাই হলো। গরিবরা আবার ধীরে ধীরে দূরে চলে গেল। সলোনের সুন্দর আইন একে একে বাতিল হয়ে গেল।
অনেক বছর শাসন করে একনায়ক মারা গেলেন। তার ছেলে হলো নতুন শাসক। কিন্তু ছেলে অত চতুর ছিল না। সে সামলাতে পারেনি। আবার ঝগড়া শুরু হলো। ক্ষমতা দখলের ঝগড়া। এবার ঝগড়ায় কোনো গরিব মানুষ নেই। ধনীরা কয়েক দলে ঝগড়া করছিল। ঝগড়ায় হেরে গেলেন এথেন্সের সবচেয়ে উচ্চ বংশের ধনী মানুষ ক্লিসথেনিস।
হেরে গিয়ে ক্লিসথেনিস প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেলেন। ক্ষমতা না থাকলে প্রাসাদ আর কারাগার সমান। তিনি গেলেন এক্রোপোলিস থেকে অনেক দূরে যেখানে কামার, কুমার, চাষি, মজুররা থাকে। তারা দরিদ্রের চেয়েও দরিদ্র। দিন আনে আর ঐ দিনই খায়। তারা কোনোদিন শাসন-টাসন নিয়ে ভাবে না। ভাবার সময় কোথায়? ভরপেট খাদ্য জোগাতেই দিন শেষ। তাদের কাছে গেলেন ক্লিসথেনিস। সভা ডাকলেন।
হাত তুলে বললেন, ভাইয়েরা আমার।
গরিবরা অবাক। এথেন্সের সবচেয়ে উঁচু বংশের উঁচু মানুষ তিনি। তার মতো মানুষ কোনোদিন এই পাড়ায় আসেন না। আর তিনি তাদের বলছেন, ‘ভাইয়েরা আমার’। মিষ্টি করে আপনজনের মতো বলছেন। তার চোখে আবেগ। কণ্ঠে মায়া। ক্লিসথেনিস বললেন, আর কত দিন তোমরা কলুর বলদের মতো খাটবে? তোমরা খাটো আর সব খাটুনির ফসল চলে যায় ধনীদের ঘরে। তোমাদের লাভের চিনি পিঁপড়ায় খায়। তোমাদের কি ইচ্ছা করে না এই ব্যবস্থা বদলাতে?
সভায় উপস্থিত এক বৃদ্ধ বললেন, ব্যবস্থা বদলাতে রাজা হওয়া লাগে। আমাদেরকে রাজা করবে কে? আপনি?
‘চাচা, আমি আপনাকে রাজা করতে পারব না। কিন্তু এমন একটি উপায় করতে পারি যেখানে সবাই রাজা।’
‘সবাই রাজা? তাইলে প্রজা কে? যতসব আজগুবি কথা!’
‘আজগুবি নয়। সম্ভব। আমরা চাইলেই সম্ভব। সলোনের আইনের কথা আপনারা ভুলে গেছেন?’
সলোনের নামটা টনিকের মতো কাজ করল। সলোনের নামে বৃদ্ধের চোখে পানি চলে এলো।
বৃদ্ধ বললেন, সলোনকে আমরা ভুলে যাব? এটি কী বলেন? কালকেও আমার নাতিকে তার গল্প বলেছি। ওই একটি মাত্র লোকই আমাদের মতো গরিবের কথা ভাবছিল। তারপর আর কেউ ভাবেনি। কেউ কিচ্ছু করেনি।
বৃদ্ধ ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন। গরিবের আবেগ সরল হয়। তারা অল্পতেই কাঁদে, অল্পতেই হাসে। বৃদ্ধের কান্না দেখে খুশি হলেন ক্লিসথেনিস। চোখে যখন পানি আছে, সাগর বানানো যাবে
তিনি বললেন, মহান সলোনের আইন দিয়েই আমরা নতুন এথেন্স বানাবো। তিনি যা করতে পারেননি, আমরা এবার তাই করব। আমরা এমনভাবে এথেন্স চালাবো যেন আমরা সবাই সমান।
বৃদ্ধ বললেন, বাবা, আপনি বারবার বলছেন ‘আমরা’। এই আমরাটা কে? ধনীরা নাকি গরিবরা?
‘আমরা মানে সবাই। আমরা মানে আপনি। আমরা মানে তুমি। আমরা মানে আমি। আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেব। সবাই কিছুদিন পর পর নেতা হবো। এক বছর এই দিকের কয়েকজন, পরের বছর অন্য কয়েকজন নেতা হবে। এভাবে সব নাগরিক নেতা হবে। কেউ বাদ যাবে না। আমরা সবাই মিলে আমাদের শাসন করব।
‘এটি সম্ভব?’
‘সম্ভব। সলোনের আইন দিয়েই সম্ভব। আমরা নতুন এথেন্স বানাব যেখানে সবাই সমান। কেউ বড় নয়, কেউ ছোট নয়। সব নাগরিক একেবারে সমান।’
‘কামার আর বিচারক সমান? চাষি আর সৈনিক সমান?’
‘সমান হবে। আমরা চাইলে অবশ্যই সমান হবে।’
সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। এই লোকের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু তাদের চোখ কথা বলছে। চোখে সম্মতি। খুশি হলেন ক্লিসথেনিস। তার উদ্দেশ্যে সফল হবে। এই জনতাকে আর একটু উস্কে দিলেই তারা যুদ্ধে নামবে।
তিনি বললেন, এখন আমরা যদি এক থাকি, তাহলেই মুক্তি। অত্যাচারীর হাত থেকে মুক্তি। অন্যায় থেকে মুক্তি। গরিবি থেকে মুক্তি। ঋণের থেকে মুক্তি।
সবাই ফিসফিস করছে, মুক্তি, মুক্তি …।
সভা শেষে সবাই ঘরে গিয়ে বউয়ের কাছে বলল, শোন বউ। মুক্তি আসতেছে। কাল সকালেই আসতেছে মুক্তি।
বউয়েরা অবাক—’কিসের থেকে মুক্তি?’
‘কিসের আবার? গরিবি থেকে মুক্তি।’
‘মুক্তি কীভাবে আসবে? হেঁটে হেঁটে?’
‘সবুর করো, সকাল হলেই দেখতে পাবে।
পরদিন সকালে ক্লিসথেনিসের সাথে ছুটে এলো চাষি, মজুর, কামার, কুমারের বিশাল দল। আক্রমণ করল এক্রোপলিস। অত্যাচারী চিরকালই ভীরু। মানুষের স্রোত দেখে ধনী, অভিজাত, একনায়ক সব পালিয়ে গেল। সাধারণ মানুষ দখল করল এথেন্স।
সাধারণ মানুষদের নিয়ে এগিয়ে চলল ক্লিসথেনিস। এক্রোপোলিসের উপরে দেবী এথিনার মূর্তির সামনে দাঁড়াল। বিকেলের রোদে দেবীর মূর্তি ঝকঝক করছে। মূর্তির ছায়ায় দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে বললেন, ডিমোক্রেসি। গণতন্ত্ৰ।
মজুর, চাষি, কামারসহ সবাই অস্ত্র উঁচিয়ে বলল, ডিমোক্রেসি বা গণতন্ত্ৰ[৪৯]।
সেই মুহূর্তে এথেন্সে জন্ম নিলো গণতন্ত্র। মানুষের শাসন। ক্লিসথেনিস ঘোষণা করলেন, মানুষ বিজয়ী হয়েছে। এখন থেকে সব সিদ্ধান্ত নেবে মানুষ। এথেন্সে মানুষ মানে ডিমোস। তাই নতুন শাসনের নাম ডিমোক্রেসি।
ক্লিসথেনিস নেতা হলেন। নেতৃত্বের স্বভাব হলো নেতারা প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। কিন্তু তিনি ভুললেন না। গরিবদের পক্ষে আনতে সেদিন কথায় কথায় অনেক কিছু বলে ফেলেছেন। সব মানুষ সমান হবে। ধনী-গরিব ভেদাভেদ থাকবে না। কিন্তু কীভাবে? সেটি কি সম্ভব?
অনেক ভেবে উপায় বের করলেন। উপায় হলো লটারি। নেতা হবে লটারি করে। তাহলে সবাই সমান সুযোগ পাবে।
নতুন গণতন্ত্রের জন্য দুটি বিষয় আবিষ্কার হলো ভোট আর লটারি। সকল পদে মানুষ বসবে লটারি করে। আর সকল সিদ্ধান্ত হবে সংসদের ভোটে।
তিনি সলোনের করা সব আইন ফিরিয়ে আনলেন।
এথেন্সের সকল নাগরিক সংসদের সদস্য। প্রতি মাসে দুই দিন সংসদের সভা বসবে। সেদিন যার ইচ্ছা আসবে, ভোট দেবে। কিন্তু সংসদ চালাতে তো পরিষদ লাগবে। সেটি করবে মহামতি সলোনের বানানো নগর পরিষদ (বোলি)। কিন্তু তার সদস্য অন্যভাবে হবে। সলোন নিয়ম করেছিলেন যার টাকা বেশি, সে উচ্চপদে বসবে। এখন আর সেভাবে নয়। এখন সবার জন্য সমান সুযোগ।
এথেন্সে বারো মাসে বছর না, দশ মাসে বছর। প্রতি মাস ছত্রিশ দিন। দশ মাসে দশটি দল যদি নগর পরিষদ চালায় তাতে সুবিধা হয়। সেজন্য এথেন্সের চারটি জাতি বাতিল করে দশটি জাতি করা হলো। প্রতি জাতি থেকে পঞ্চাশজন করে মোট হয় পাঁচশ জন। এই পাঁচশ জন নগর পরিষদের সদস্য। বছরের শুরুতে লটারি করে সবাইকে বাছাই করা হবে।
এতে যেটি দাঁড়াল—পঞ্চাশ জন মানুষ ছত্রিশ দিন নগর চালাবে। এরা সবাই লটারি করে বাছাই করা। এই পঞ্চাশ জনের মধ্যে প্রতিদিন লটারি করে একজন বাছাই করা হয়। সেদিন সে নগর পরিষদের প্রধান। আবার সংসদেরও প্রধান। এই পঞ্চাশ জনই ঠিক করবে কোনোদিন সংসদে কী নিয়ে আলোচনা হবে, কী নিয়ে ভোট হবে। ছত্রিশ দিন পর নতুন পঞ্চাশ জন দায়িত্ব নেবে। তারাও লটারিতে বাছাই করা। নগরের সব কাজে সবগুলো জাতির সমান কোটা। যুদ্ধ লাগলে সবাই সমান সেনা দেবে। যেকোনো কাজে সবাই সমান খরচ দেবে। আদালত, সরকারি পদ সবখানে সবকয়টি জাতি থেকে সমান মানুষ আসবে। এমনকি সামরিক বাহিনীর জন্য সব জাতি একজন করে সেনাপ্রধান দিবে। দশজন সেনাপ্রধান সবসময় উচ্চপদে থাকবেন। সেনাপ্রধান পদটি শুধু লটারি করা হবে না। এটি যোগ্যতা দিয়েই হতে হবে।
এই গণতন্ত্র যাতে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় সেজন্যও ব্যবস্থা হলো। সারা এথেন্সকে একশ ঊনচল্লিশটি এলাকায় ভাগ করা হলো। প্রতি টুকরার নামও ডিমোস। এই ছোট ছোট ডিমোসেও নগরের মতো সংসদ থাকবে, নগর পরিষদ থাকবে। তারা আবার এথেন্সের প্রধান পরিষদে যোগ দেবে। একেবারে কেন্দ্রীয় সরকার আর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। এভাবে নগরের প্রতিটি নাগরিক গণতন্ত্রের সাথে যুক্ত হবে। কেউ বাইরে থাকবে না।
প্রথমে সংসদ বসত নগরের কেন্দ্র আগোরাতে। বাজারের পাশের ঘাসের উপর লাইন দিয়ে বসত মানুষ। কিন্তু নতুন জিনিসে মানুষের আকর্ষণ বেশি থাকে। এছাড়া নতুন ক্ষমতা পেয়ে গরিব মানুষরা দলে দলে সংসদে আসতে লাগল। আগোরাতে আর জায়গা হয় না। তখন একটু দূরে এক্রোপোলিসের উল্টোদিকে পিনিক্স পাহাড়কে ঠিক করা হলো। পাহাড় থেকে এক্রোপোলিসের উপর দেবী এথিনার মূর্তিও দেখা যায়। দেবীকে সাক্ষী করে নগরের সিদ্ধান্ত হয়। পিনিক্স পাহাড়ের ঢাল কেটে কেটে পাথর বসিয়ে থিয়েটারের মতো বসার জায়গা বানানো হলো। এটিই পৃথিবীর প্রথম সংসদ।
গণতন্ত্র এথেন্সে সুদিন এনেছে। সবাই মনে করছে এই নগর আমার। আমি এই নগরের নেতা। সবাই নেতা। তাই সবাই উৎসাহে কাজ শুরু করল। এথেন্স উন্নত হতে শুরু করল। রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি সবকিছু বদলে যেতে থাকল। যে দেখে সেই বলে এথেন্সে জোয়ার এসেছে। গণতন্ত্রের জোয়ার। এথেন্সের গণতন্ত্র দেখে পাশের শহর মেগারার এক কবি লিখলেন,
‘নগর নগরই আছে, বদলে গেছে মানুষ
আলো এসেছে, মানুষের ফিরেছে হুঁশ।
যারা ছিল অদ্ভুত, যাদের তোমরা বলতে বুৰ্বক
তারা পেয়েছে অধিকার, তারা হয়ে গেছে শাসক।
যাদের বলতে অভিজাত, মূর্খসব- চলে গেছে দূর-বহুদূর
আজ হতে সবাই সমান, খোল দ্বার, এসেছে নতুন ভোর।’
এত কিছু করা হলো তবু মন ভরে না গণতন্ত্রের।
নতুন নেতারা ভয় পায় এই বুঝি তাদের গণতন্ত্র হারিয়ে যাবে। কে যেন এসে সব বন্ধ করে দেবে। ভয় কাকে? বাইরের কাউকে নয়। নিজেদের মানুষকেই ভয়। যদি নেতাদের মধ্যেই আবার কারও রাজা হওয়ার খায়েশ হয়? ক্ষমতাশালী কেউ যদি গণতন্ত্রকে ছুড়ে ফেলে! এত সাধের গণতন্ত্র হারিয়ে যাবে? সেটি হতে দেওয়া যাবে না। কোনো নেতাকে এত বেশি ক্ষমতাবান হতে দেওয়া হবে না। সেজন্য আরেক উপায়— নির্বাসন[৫০]। মানে নগর থেকে বহিষ্কার। নির্বাসনও দেওয়া হবে গণতান্ত্রিক পথে। মানুষের ভোটে। এর নাম বহিষ্কার ভোট। প্রতি বছর এক বার আয়োজন করা যাবে বহিষ্কার ভোটের। সেদিন নাগরিকরা ভোট দিয়ে কাউকে নগর থেকে বহিষ্কার করবে। পোড়া মাটির উপর যে কারও নাম লিখে একটি পাত্রে ফেলবে। যার নাম সবচেয়ে বেশি উঠবে সে এথেন্স থেকে বহিষ্কার হবে। সারা জীবনের জন্য নয়। দশ বছরের জন্য। এই দশ বছরের মধ্যে সে এথেন্সে ফেরার চেষ্টা করলে, শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
আসপাশিয়া তাকিয়ে দেখে, গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে পেরিক্লিসের চোখ পানি এসে গেছে। এই তো কত অহংকার নিয়ে বক্তৃতার মতো বলছিলেন। হঠাৎ চোখে পানি! সে ছুটে গিয়ে পেরিক্লিসের হাত ধরলো। পেরিক্লিস বললেন, তুমি ব্যস্ত হয়ো না। নির্বাসনের কথা মনে পড়লে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারি না। এখানে গণতন্ত্র বড় নির্মম
আসপাশিয়া বলল, আমি জানি। এই নির্বাসনের প্রথম শিকার হয়েছিলেন গণতন্ত্রের পিতা ক্লিসথেনিস নিজে। এথেন্সের মানুষ খুব ভালো প্রতিদান দিয়েছে তাকে। সে বৃদ্ধ চোখের জলে এথেন্স থেকে চলে গেছেন। আর ফিরতে পারেননি এথেন্সে।
‘আরও আছে আসপাশিয়া।’
‘আর কে?’
‘এই নিয়মের শিকার হয়েছে আমার বাবা। তাকেও বহিষ্কার করেছিল দশ বছরের জন্য। আমি এতিমের মতো বড় হয়েছি। এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, ছোট্ট আমি পিরাউস বন্দরের দিকে আছি। মা বলছেন, কেঁদো না। একদিন ঐ বন্দর দিয়ে তোমার বাবা ফিরে আসবেন। আমি সুযোগ খুঁজতাম। স্কুল থেকে পালিয়ে বন্দরে চলে যেতাম। সাগরে তাকিয়ে থাকতাম। জাহাজের পর জাহাজ আসত। আমার বাবা আসতেন না।’
আসপাশিয়া শক্ত করে পেরিক্লিসের হাত ধরল। মানুষটি এত নরম। একেবারে নারিকেলের মতো। বাইরে শক্ত, ভেতরে টলটলে। একটু আগেও বোঝা যায়নি।
আসপাশিয়া বলল, সেই কঠিন সময়ই আপনাকে কঠিন বানিয়েছে। তাই আপনি কঠিন নেতা।
‘কঠিন নেতা কি এমন করে কাঁদে? দশ বছর পথে পথে ঘুরেছেন আমার বাবা। তাও তিনি এথেন্সকে ভোলেননি। ফিরে এসে আবার এথেন্সের জন্য যুদ্ধ করেছেন।’
আসপাশিয়া চুপ করে আছে। পেরিক্লিসের নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, গণতন্ত্রের লম্বা কাহিনি শুনতে শুনতে তুমি নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে গেছো।
‘না না, মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। যত ভালো লাগবে ভেবেছিলাম, তার চেয়েও বেশি ভালো লেগেছে। তবে কাহিনি আসলেই অনেক লম্বা। আপনি নাকি এথেন্সের সবচেয়ে লম্বা মানুষ। কিন্তু আপনার কাহিনি আপনার থেকেও লম্বা।’
‘তোমাকে এটুকু সময়ে একশ বছরের কাহিনি বলেছি। তবে এটি নিশ্চিত এর চেয়ে মজা করে আর কেউ বলতে পারবে না। ‘
আসপাশিয়া বলল, ‘মজা করে বলেছেন? কই, আপনি তো বক্তৃতা করলেন।’
‘ঠিক আছে, ভুল হয়েছে। আর কোনোদিন বক্তৃতা করব না।’ বলেই তিনি আবার বক্তৃতার মতো শুরু করলেন :
‘শোন আসপাশিয়া, গণতন্ত্রের চেয়ে মহৎ কোনো জিনিস মানুষ আজ পর্যন্ত বের করতে পারেনি। পৃথিবীর সবখানে যার অস্ত্রের জোর আছে, সেই রাজা। শুধু আমরাই বের করেছি যে অস্ত্র নয়, অর্থ নয়, মানুষের ভোটে আমরা নিজেদের শাসন করি। গণতন্ত্রে সবাই সমান। অন্তত একজন চাষির ছেলেও দেশের শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। এটি আর কোথাও পারে না। আর একটি মজা আছে। সেটি হলো গণতন্ত্রে যে কাউকে যা খুশি বলা যায়। কথা বলার অধিকার আছে। এথেন্সে আমাকে কত মানুষ গালি দেয়। আমাকে নিয়ে ছড়া বানায়। ব্যঙ্গ করে। গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোথাও এটি সম্ভব নয়। অন্য কোনো দেশে রাজার নামে কিছু বললে, তক্ষুনি ঘচাৎ করে মুণ্ডু কেটে নেবে।
সমাজে শৃঙ্খলা রাখতে শাসন তো লাগবেই। সেজন্য রাজনীতি করতেই হবে। আর রাজনীতির জন্য গণতন্ত্রের মতো এমন সুন্দর জিনিস আর হয় না। গণতন্ত্রে সবাই সমান। গণতন্ত্রে আমি নেতা, রাজা নই। কেউ আমার প্রজা নয়। তারা ভোট দিয়ে আমাকে নেতা বানায়। আগামী কালই আমাকে বাদ দিয়ে সে নিজেই নেতা হতে পারে। এথেন্সে আমরা সবাই রাজা। এমন জিনিস পৃথিবীর আর কোথাও নেই। গণতন্ত্র সবকিছু থেকে সেরা।
আসপাশিয়া হাসতে হাসতে বলল, এর আগে তবু গল্পের মতো বলছিলেন। এবার যেটি বললেন, সেটি একেবারে রাস্তার বক্তৃতা। জনসভার ভাষণ
পেরিক্লিস রাগে নাক ফোঁস ফোঁস করে বললেন, ঠিক আছে আর কোনোদিন গণতন্ত্রের কথা বলব না।
আসপাশিয়া বলল, পেরিক্লিস শুধু দুটি কাজ জানে। ‘কোন দুটি কাজ?’
‘এক. বক্তৃতা দেওয়া। দুই. মেয়েদের সাথে রাগ করা।’
‘আর কিছুই জানি না?
‘না।’
এবার পেরিক্লিস রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেললেন।
একটি কথা পেরিক্লিস বলেননি। এই গণতন্ত্রে নারীদের কোনো স্থান নেই। এতে দাসদের কোনো স্থান নেই। বিদেশিদেরও কোনো জায়গা নেই। শুধু আঠারো বছরের চেয়ে বেশি পুরুষরাই এথেন্সের নাগরিক। শুধু তারাই গণতন্ত্রের অংশ।
আসপাশিয়া ভাবছে পেরিক্লিস মনে হয় ইচ্ছে করে মেয়েদের কথা বললেন না। নাকি এটি এমন তুচ্ছ বিষয় যে, বলার দরকার নেই? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আজ থাক। জিজ্ঞেস করলে ঝগড়া লাগতে পারে। যতটুকু ঝগড়া দরকার ছিল, সেটি হয়ে গেছে। কিছু ঝগড়া থাকুক অন্য দিনের জন্য।
পেরিক্লিস বের হওয়ার সময় আসপাশিয়া তার হাতে একটি পেপিরাস কাগজ দিয়ে বলল, এখন খোলা যাবে না।
***
৪৮. প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে বিখ্যাত নারী কবি শাপো (Sappho), এই কবিতাটি Edwin Marion Cox এর ‘The Poems of Shappo’ থেকে বাংলা করেছি।
৪৯. ক্লিসথেনিস গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন খ্রি. পূ. ৫০৮ অব্দে। কিন্তু ডিমোক্রেসি শব্দটির তখনও ব্যবহার হয়নি। তখন মানুষ ‘মুক্তি, ho demos, 1 the people’ বলে স্লোগান দিয়েছিল। Democracy শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন নাট্যকার এস্কিলাস তার ‘Supplant Women’ নাটকে খ্রি. পূ. ৪৬৪/৪৬৩ অব্দে।
৫০. প্রতি বছর পোড়া মাটির টুকরার উপর নাম লিখে একটি ভোট দেওয়া হতো। যার নাম সবচেয়ে বেশি উঠবে সে নির্বাসনে যাবে। পোড়া মাটির টুকরাকে বলে Ostracon, সেটি থেকে এই ব্যবস্থার নাম হয় Ostracism বা নির্বাসন।