হেমনলিনী

হেমনলিনী

বৈদ্যনাথবাবু বর্তমানে যে শহরটিতে বাস করিতেছেন তাহার নাম উহ্য রহিল। বৈদ্যনাথবাবুর নামও বৈদ্যনাথ নয়। অজ্ঞাতবাস করিতে হইলে নাম-ধাম সম্বন্ধে একটু সতর্কতা প্রয়োজন।

শহরটি খুব বড় নয়, মহকুমা শহর। বাঙালীর সংখ্যা মুষ্টিমেয়। এইখানে একটি ছোট বাসা লইয়া গত ছয় মাস বৈদ্যনাথবাবু একাকী অজ্ঞাতবাস করিতেছেন।

বৈদ্যনাথবাবুর বয়স ছাপ্পান্ন বছর, মাত্র এক বছর তিনি সরকারী চাকরি হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। শুষ্ক নীরস গোছের চেহারা; মাথার চুল ছোট করিয়া ছাঁটা; নাকের নীচে গোঁফের প্রজাপতি সাদা হইয়া গিয়াছে। কিন্তু তাঁহার শরীর এখনও বেশ সতেজ ও সমর্থ আছে।

বৈদ্যনাথবাবুর সংসারে গৃহিণী, এক পুত্র এবং পুত্রবধূ ছিল। পুত্রটি ভাল চাকরি করে, পুত্রবধূও শান্তশিষ্ট মেয়ে, কিন্তু গৃহিণীর স্বভাব ছিল প্রচণ্ড। তবু, যতদিন বৈদ্যনাথবাবু চাকরিতে ছিলেন ততদিন যুদ্ধবিগ্রহের অবকাশ বেশী ছিল না। কিন্তু তিনি যখন অবসর লইয়া গৃহে আসিয়া বসিলেন, তখন রণরঙ্গ প্রায় অষ্টপ্রহরব্যাপী হইয়া উঠিল। বৈদ্যনাথবাবুর হৃদয়ে যথেষ্ট তেজ থাকিলেও রসনার প্রাখর্যে তিনি গৃহিণীর সমকক্ষ ছিলেন না। প্রতি খণ্ডযুদ্ধে তাঁহার পরাজয় ঘটিতে লাগিল।

এইরূপ পরিস্থিতি বৈদ্যনাথবাবু ছয় মাস সহ্য করিলেন, তারপর একদিন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিলেন। চুপিচুপি ব্যাঙ্কের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া তিনি ফেরারী হইলেন। ব্যাঙ্কের সহিত ষড়যন্ত্রের কারণ, পেন্সনের টাকা যথাস্থানে পৌঁছানো চাই।

তদবধি বৈদ্যনাথবাবু শান্তিতে আছেন। জগবন্ধু নামক এক ভৃত্য পাইয়াছেন, সে রন্ধন করিয়া খাওয়ায়; ক্ষুদ্র বাড়ির চারিপাশে ক্ষুদ্র বাগান আছে, সকাল বিকাল তাহার পরিচর্যা করেন, দ্বিপ্রহরে খবরের কাগজ পড়েন; সন্ধ্যার সময় পার্কে বেড়াইতে যান; এবং রাত্রিকালে একাকী শয্যায় শয়ন করিয়া নিদ্রা যান। তাঁহার মনে কোনও খেদ নাই; কেবল একটি আশঙ্কা মাঝে মাঝে তাঁহার মনে উঁকিঝুঁকি মারে : গৃহিণী সন্ধান করিয়া এখানে না আসিয়া জোটেন!

যাহোক, এখানে নিরুপদ্রবে ছয় মাস কাটিয়া গিয়াছে; বৈদ্যনাথবাবু অনকেটা নিশ্চিন্ত হইয়াছেন। একদিন শীতের সন্ধ্যায় তিনি বেড়াইতে বাহির হইলেন। তাঁহার বাড়ি হইতে পার্ক মাইলখানেক দূরে; বেশী লোকের ভিড় নাই। প্রত্যহ এখানে গিয়া বৈদ্যনাথবাবু একটি বেঞ্চিতে বসিয়া বিশ্রাম করেন, তারপর পকেট হইতে দুটি বিস্কুট বাহির করিয়া ভক্ষণ করেন। তারপর সন্ধ্যা ঘনীভূত হইলে বাড়ি ফিরিয়া আসেন।

আজ শীতটা বেশ চাপিয়া পড়িয়াছে, পার্কে লোক নাই বলিলেই হয়। বৈদ্যনাথবাবু একটি বিস্কুট শেষ করিয়া দ্বিতীয়টিতে কামড় দিতে যাইবেন এমন সময় পায়ের গোড়ালির কাছে বরফের মতো সিক্ত-শীতল স্পর্শ অনুভব করিয়া চমকিয়া উঠিলেন। হেঁট হইয়া বেঞ্চির তলায় দেখিলেন—

একটি ময়লা হল্‌দে রঙের কুকুরছানা তাঁহার পায়ের পিছনে বসিয়া আছে এবং ঠুকঠুক করিয়া কাঁপিতেছে। কুকুর শাবকের বয়স তিন চার মাসের বেশী হইবে না; অস্থিসার ক্ষুধার্ত চেহারা, শীর্ণ ল্যাজটি অল্প অল্প নড়িতেছে। বৈদ্যনাথবাবুর সঙ্গে চারি চক্ষুর মিলন হইতেই সে গলার মধ্যে কুঁই কুঁই শব্দ করিল।

বৈদ্যনাথবাবু একটু বিব্রত হইলেন। কুকুরের সঙ্গে তাঁহার কোনও প্রকার ঘনিষ্ঠতা ছিল না, কখনও কুকুর পোষেন নাই। রাস্তার দুই চারিটা কুকুর দেখিয়াছেন, এই পর্যন্ত। তবে এই কুকুরটা তাঁহার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করিতে চায় কেন? পা চাটিয়া দিল কোন্ উদ্দেশ্যে?

তিনি কুকুরকে একটা ধমক দিলেন এবং কাছে আসিতে বলিলেন। কুকুর কিন্তু নড়িল না, বেঞ্চির তলায় বসিয়া কুঁই কুঁই করিতে লাগিল। বৈদ্যনাথবাবু তখন তাহাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া আবার বিস্কুট মুখে দিবার উদ্যোগ করিলেন।

অমনি কুকুরটা আবার তাহার পা চাটিয়া দিল। ভিজা জিভের স্পর্শে তিনি শিহরিয়া পা টানিয়া লইলেন। কি আপদ!

তাঁহার সন্দেহ হইল ক্ষুধার্ত কুকুর তাঁহাকে বিস্কুট খাইতে দেখিয়া লুব্ধ হইয়াছে। তিনি বিস্কুট অর্ধেক ভাঙিয়া কুকুরের সামনে ফেলিয়া দিলেন। পলকের মধ্যে কুকুর বিস্কুট গলাধঃকরণ করিল এবং বেঞ্চির তলা হইতে বাহিরে আসিয়া বাকি বিস্কুটের পানে নিষ্পলক চাহিয়া রহিল।

বিরক্ত হইয়া বৈদ্যনাথবাবু বিস্কুটের অর্ধাংশ কুকুরের সামনে ফেলিয়া দিলেন এবং উঠিয়া গৃহে ফিরিয়া চলিলেন। রাত্রি হইয়া গিয়াছে, রাস্তার আলো জ্বলিয়াছে। নির্জন রাস্তায় কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া যেন আক্রমণ করিবার লোক খুঁজিয়া বেড়াইতেছে।

বৈদ্যনাথবাবু পশমের গলাবন্ধ ভাল করিয়া মাথায় জড়াইয়া লইলেন। কিছু দূর গিয়া একটা আলোকস্তম্ভের কাছে আসিয়া তিনি পিছু ফিরিয়া চাহিলেন। কুকুরটা তাঁহার অনুসরণ করিয়াছে। দশ গজ পিছনে আসিতেছে।

তিনি ফিরিয়া দাঁড়াইয়া দুই হস্ত আস্ফালন করিয়া তর্জন করিলেন। কুকুর দাঁড়াইয়া পড়িল, কিন্তু পলায়ন করিল না। তিনি আবার চলিতে আরম্ভ করিলেন। কুকুর দূরত্ব রক্ষা করিয়া পিছনে চলিল। বিস্কুট তাহার ভাল লাগিয়াছে সন্দেহ নাই।

গৃহে পৌঁছিয়া ফটক খুলিতে খুলিতে তিনি পিছনের অন্ধকারে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। দশ গজ দূরে একটা কিছু নড়িতেছে। ঠাহর করিয়া দেখিলেন, কুকুরের ল্যাজ। তিনি চট্‌ করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া ফটক বন্ধ করিয়া দিলেন।

ঘরে গিয়া বসিতেই ভৃত্য জগবন্ধু গরম চায়ের পেয়ালা আনিয়া সম্মুখে রাখিল। তিনি এক চুমুক চা খাইয়া ভারি আরাম অনুভব করিলেন। বলিলেন, ‘জগবন্ধু, একটা বিস্কুট এনে দে। আজ একটা বৈ বিস্কুট খাওয়া হয়নি।’

‘আজ্ঞে’— বলিয়া জগবন্ধু একবার প্রভুর মুখের পানে সপ্রশ্ন দৃষ্টিপাত করিল। বৈদ্যনাথবাবু বলিলেন, ‘একটা কুকুর। এমন জ্বালাতন করল—’

জগবন্ধু প্লেটে করিয়া বিস্কুট আনিয়া দিল। তিনি চা সহযোগে খাইতে খাইতে ভাবিতে লাগিলেন— কুকুরটা বোধ হয় এখনও ফটকের সামনে দাঁড়াইয়া ল্যাজ নাড়িতেছে। কিংবা হয়তো ফটক বন্ধ দেখিয়া চলিয়া গিয়াছে।

রাত্রে আহারাদি করিয়া তিনি শয়ন করিলেন। তাঁহার অভ্যাস, রাত্রে শয্যায় শুইয়া তিনি একটি রহস্য কাহিনী পাঠ করেন। দু’একটা খুন-খারাপি রক্তারক্তি না হইলে তাঁহার ঘুম আসে না।

লেপের মধ্যে শরীর বেশ গরম হইয়া আসিয়াছে। চোখের সামনে রহস্য কাহিনীর পাতা ঝাপ্‌সা হইয়া যাইতেছে, এমন সময় তাঁহার তন্দ্রাজড়িত চেতনায় একটি ক্ষীণ শব্দ অনুপ্রবিষ্ট হইল— কুঁইকুই কুঁইকুঁই—

তন্দ্রা ছুটিয়া গেল। বৈদ্যনাথবাবু কান খাড়া করিয়া রহিলেন। হ্যাঁ, কুকুরই বটে। কোনও অজ্ঞাত উপায়ে ফটক পার হইয়াছে এবং তাঁহার শয়নকক্ষের দরজার কাছে বসিয়া কুঁইকুই করিতেছে।

জ্বালাতন! বৈদ্যনাথবাবু পাশ ফিরিয়া কানের উপর লেপ চাপা দিলেন, কিন্তু কুকুরের কাকুতি লেপ ভেদ করিয়া তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিতে লাগিল। কোথাকার আপদ আসিয়া জুটিল। একটা কিছু করা দরকার, নহিলে সারারাত ধরিয়া হয়তো কুঁইকুঁই শব্দ চলিতে থাকিবে।

শয্যায় উঠিয়া বসিয়া বৈদ্যনাথবাবু ডাকিলেন, ‘জগবন্ধু!’ কিন্তু জগবন্ধুর সাড়া পাওয়া গেল না। সে রান্নাঘরে শোয়, সম্ভবত কানে কম্বল চাপা দিয়া ঘুমাইতেছে।

তিনি তখন নানা প্রকার বিরক্তিসূচক শব্দ করিতে করিতে লেপ ছাড়িয়া উঠিলেন। বাহিরের দরজা খুলিতেই এক ঝলক হাড়-কাঁপানো হাওয়া তাঁহাকে অভিষিক্ত করিয়া দিল। তিনি দেখিলেন, সেই কুকুরটা অদূরে দাঁড়াইয়া ঘন ঘন ল্যাজ নাড়িতেছে। তাঁহার যেমন রাগ হইল তেমনি একটু দয়াও হইল। আহা, এই শীতে একটা প্রাণী তাঁহার আশ্রয় চায়। কিন্তু তিনি তিরিক্ষিভাবে বলিলেন, ‘কি চাস্?’

কুকুরটা বোধ হয় তাঁহার কণ্ঠস্বরে করুণার আভাস পাইয়াছিল, সে বাক্যব্যয় না করিয়া ঘরে ঢুকিয়া পড়িল। বৈদ্যনাথবাবু ত্বরিতে দ্বার বন্ধ করিয়া ঠাণ্ডা হাওয়ার পথ রোধ করিলেন।

কুকুরটা দেয়াল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া আড়চোখে তাঁহার পানে চাহিতে লাগিল, তাহার ল্যাজটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নাড়িয়া চলিল। বৈদ্যনাথবাবু ভাল করিয়া তাহাকে দেখিলেন। মাদি কুকুর, সরু ছুঁচোলো মুখ, কানদুটা তীক্ষভাবে উঁচু হইয়া আছে, গায়ের হলদে লোম স্থানে স্থানে উঠিয়া গিয়াছে, একেবারে খাঁটি লেড়ি কুত্তা। ইহারা রাস্তায় জন্মগ্রহণ করে, রাস্তায় জীবন যাপন করে এবং অন্তিমে রাস্তায় প্রাণ বিসর্জন করে। ইহাদের গৃহ নাই।

বৈদ্যনাথবাবু বিরাগপূর্ণ স্বরে বলিলেন, ‘আজ থাকো। কাল সকালেই বিদেয় করে দেবো।’

শয়ন করিতে গিয়া তিনি থামিয়া গেলেন। কুকুরটা হয়তো সারা দিনে ওই একটা বিস্কুট ছাড়া আর কিছুই খায় নাই। আশ্রয় যখন দিয়াছেন তখন তাহার পেটের জ্বালা নিবারণ করিলে দোষ কি? তিনি রান্নাঘরে গিয়া এক টুক্‌রা পাঁউরুটি আনিয়া কুকুরটার সামনে ফেলিয়া দিলেন। সে পাঁউরুটির উপর লাফাইয়া পড়িয়া খাইতে লাগিল, তাহার ল্যাজটা উন্মত্তভাবে নৃত্য শুরু করিয়া দিল।

বৈদ্যনাথবাবু লেপ মুড়ি দিয়া শয়ন করিলেন। তাঁহার খাটের পাশে একটা হরিণের চামড়ার পাপোষ ছিল, আলো নিভাইবার পূর্বে তিনি লক্ষ্য করিলেন, কুকুরটা আহার সম্পন্ন করিয়া দ্বিধাজড়িত পদে আসিয়া হরিণের চামড়ার উপর কুণ্ডলী পাকাইয়া শয়ন করিল।

দুই

কুকুরটাকে কিন্তু তাড়ানো গেল না। বৈদ্যনাথবাবুর মনে বোধ হয় তেমন লৌহকঠিন দৃঢ়তা ছিল না, উপরন্তু দেখা গেল জগবন্ধুর কুকুরের প্রতি বিশেষ আসক্তি আছে। সে বলিল, ‘বাড়িতে একটা কুকুর থাকা ভাল বাবু, বাড়ি পাহারা দিতে পারবে। আজকাল যা চোরের দৌরাত্ম্যি হয়েছে।’

বৈদ্যনাথবাবু দোনা-মনা হইয়া সম্মতি দিলেন, ‘বেশ থাক। কিন্তু আমি কুকুরের তরিবৎ করতে পারব না। যা করবার তুই করবি।’

জগবন্ধু বলিল, ‘আজ্ঞে। তরিবৎ আর কী, এঁটো-কাঁটা খাবে আর বাড়িতে থাকবে। চারটে পয়সা দিন বাবু, একটা কারবলিক সাবান কিনে আনি।’

সেদিন দুপুরবেলা কুকুর কারবলিক সাবান মাখিয়া গরম জলে স্নান করিল। বৈকালে জগবন্ধু কুকুরের গলায় দড়ি বাঁধিয়া আনিয়া বৈদ্যনাথবাবুকে দেখাইল। তিনি দেখিলেন সাবান দিয়া স্নান করিয়া কুকুরের শ্রী ফিরিয়াছে, গায়ের হল্‌দে লোমে সোনালী ঝিলিক খেলিতেছে। তিনি প্রশ্ন করিলেন, ‘ওকে দড়ি দিয়ে বেঁধেছিস কেন?’

জগবন্ধু বলিল, ‘দিনের বেলা বেঁধে রাখলে রাত্তিরে কুকুরের রোক বাড়ে বাবু।’

বৈদ্যনাথবাবু ভাবিলেন, ‘হুঃ, লেড়ি কুত্তার আবার রোক!’

সেদিন সন্ধ্যাবেলা বেড়াইতে বাহির হইয়া তিনি পার্কে গেলেন না, বাজারের দিকে গেলেন। বাজারের রাস্তায় ঘুরিতে ঘুরিতে তাঁহার চোখে পড়িল, একটা দোকানের সামনে লম্বা লম্বা শিকল ঝুলিতেছে। একটু ইতস্তত করিয়া তিনি একটা শিকল কিনিয়া ফেলিলেন, দোকানিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ইয়ে—কুকুরের বকলস আছে নাকি?’

‘আজ্ঞে আছে’—দোকানি চামড়ার চকচকে বকলস বাহির করিয়া দিল। বৈদ্যনাথবাবু বকলস কিনিলেন। এই সময় তাঁহার পিছন হইতে ভারী গলায় একজন বলিল, ‘এই যে বদ্যিনাথবাবু! কার জন্যে বকলস কিনছেন?’

বৈদ্যনাথবাবু ফিরিয়া দেখিলেন— শঙ্করাচার্য। এ শহরে আসিয়া বৈদ্যনাথবাবুর কেবল এই ব্যক্তিটির সহিত সামান্য হৃদ্যতা জন্মিয়াছিল। তাঁহার নাম শঙ্করনাথ আচার্য। শহরের ফাজিল ছেলেরা তাঁহাকে শঙ্করাচার্য বলিত। বিপুল চেহারা, মাথায় প্রকাণ্ড টাক; শঙ্করবাবু সকল বিদ্যার পারঙ্গম ছিলেন। পৃথিবীতে এমন প্রশ্ন নাই যাহার উত্তর তিনি জানিতেন না। এবং তাঁহার মন্তব্য যত বিস্ময়করই হোক তাহা খন্ডন করিবার সাহস কাহারও ছিল না।

বৈদ্যনাথবাবু থতমত হইয়া বলিলেন, ‘এই—একটা কুকুর পুষেছি—তাই—’

শঙ্করবাবু প্রশ্ন করিলেন, ‘কী কুকুর পুষেছেন? অ্যাল্‌সেশিয়ান ড্যাল্‌মেশিয়ান স্পেনিয়েল পিকেনিজ পুড্‌ল—?’

‘ওসব নয়। রাস্তার কুকুর।’

শঙ্করবাবু গম্ভীর র্ভৎসনার কণ্ঠে বলিলেন, ‘রাস্তার কুকুর বলে কোনও কুকুর নেই, সব কুকুরই কুকুর, সব কুকুরেরই কুকুরত্ব আছে। চলুন দেখি গিয়ে।’

দু’জনে ফিরিয়া আসিলেন। চা পান করিতে করিতে শঙ্করবাবু কুকুর পরিদর্শন করিলেন। কুকুরের নখ দেখিলেন, কান ধরিয়া টানিলেন, ল্যাজ মাপিলেন। তারপর বলিলেন, ‘জাতের ঠিক নেই বটে কিন্তু ভাল কুকুর। অন্তর্তেজা কুকুর।’

বৈদ্যনাথবাবু বলিলেন, ‘অন্তর্তেজা!’

শঙ্করবাবু বলিলেন, ‘বাইরে থেকে বোঝা যায় না কিন্তু ভেতরে তেজ আছে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি এর বাপ ছিল গোল্‌ডেন ককার আর দাদামশাই ছিল অ্যাল্‌সেশিয়ান। আপনি পুষতে পারেন।’

বৈদ্যনাথবাবু বলিলেন, ‘ওর একটা নাম দরকার, কি নাম রাখি বলুন তো?’

শঙ্করবাবু কুকুরের সোনালী লোম দেখিলেন, কিছুক্ষণ ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া ভাবিলেন, তারপর বলিলেন, ‘হেমনলিনী।’

তিন

হেমনলিনী বৈদ্যনাথবাবুর গৃহে শশিকলার মতো বাড়িতে লাগিল। শীত গিয়া বসন্ত আসিল, বসন্তের পর গ্রীষ্ম, হেমনলিনী সাবালিকা হইয়া উঠিল।

জগবন্ধু তাহার পরিচর্যা করে, স্নান করায়, খাইতে দেয়। কিন্তু হেমনলিনীর সমস্ত ভালবাসা পড়িয়াছে বৈদ্যনাথবাবুর উপর। সে দিনের বেলায় সামনের বারান্দায় বাঁধা থাকে, সন্ধ্যার সময় তাহাকে খুলিয়া দেওয়া হয়। কিন্তু সে ফটকের বাহিরে পদার্পণ করে না। বৈদ্যনাথবাবু খবরের কাগজ পড়িতে বসিলে সে অপলক নেত্রে তাঁহার পানে চাহিয়া থাকে। তিনি বেড়াইতে বাহির হইবার উপক্রম করিলে সে ল্যাজ নাড়িতে নাড়িতে তাঁহার আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়ায়, কিন্তু বৈদ্যনাথবাবু তাহাকে সঙ্গে লইয়া যান না। রাস্তার কুকুরগুলা ভারি বজ্জাত, হেমনলিনীকে কামড়াইয়া দিতে পারে।

রাত্রে বৈদ্যনাথবাবুর খাটের নীচে পাপোষের উপর হেমনলিনী শয়ন করে; সে অন্য কোথাও শুইবে না। তিনি যতক্ষণ রহস্য কাহিনী পড়েন ততক্ষণ সে মিটিমিটি চাহিয়া থাকে, তিনি আলো নিভাইয়া শয়ন করিলে সেও তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া নিদ্রা যায়।

হেমনলিনী তেজস্বিনী কিনা এ বিষয়ে এখনও কোনও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। সামনের রাস্তা দিয়া প্যান্টুলুন-পরা মানুষ যাইলে সে একটু বকাবকি করে, এই পর্যন্ত। বাড়িতে অপরিচিত লোক প্রবেশ করে ইহাও সে পছন্দ করে না। নচেৎ তাহার মেজাজ ভারি ঠাণ্ডা।

বৈদ্যনাথবাবু আনন্দে আছেন। হেমনলিনীর প্রতি তাঁহার স্নেহ জন্মিয়াছে। কী একটা অভাব তাঁহার জীবনে ছিল, তাহা যেন পূর্ণ হইয়া গিয়াছে।

কিন্তু অলক্ষিতে আকাশের ঈশান কোণে যে মেঘ সঞ্চিত হইতেছে তাহার খবর তিনি জানিতেন না। হঠাৎ কালবৈশাখীর ঝড় আসিয়া পড়িল।

সন্ধ্যাকালে বৈদ্যনাথবাবু যথারীতি ভ্রমণে বাহির হইয়াছিলেন। পার্কের দিকে অর্ধেক পথ যাইবার পর তিনি পকেটে হাত দিয়া দেখিলেন বিস্কুট আনিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। তিনি ফিরিয়া চলিলেন।

চারিদিক ঘোর-ঘোর হইয়া আসিয়াছে, তিনি নিজের বাড়ির পঞ্চাশ গজের মধ্যে আসিয়াছেন, এমন সময় দেখিতে পাইলেন, একটা ছ্যাকড়া গাড়ি বিপরীত দিক হইতে আসিয়া তাঁহার বাড়ির সামনে থামিল। গাড়ির মাথায় কয়েকটা বাক্স প্যাঁটরা রহিয়াছে। বৈদ্যনাথবাবুর বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করিয়া উঠিল। তিনি রাস্তার পাশে একটা গুলমোর গাছের তলায় দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন।

গাড়ি হইতে একটি মহিলা অবতরণ করিলেন। গাছতলায় বৈদ্যনাথবাবুর নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিল। কি সর্বনাশ—গৃহিণী! গুপ্তগৃহের সন্ধান পাইয়াছেন! নিশ্চয় ব্যাঙ্ক বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। বাক্স প্যাঁটরা লইয়া গৃহিণী কায়েমীভাবে বসবাস করিবার জন্য আসিয়াছেন। এখন উপায়?

গলদঘর্ম বৈদ্যনাথবাবু দেখিতে লাগিলেন, গাড়ি দাঁড়াইয়া রহিল, গৃহিণী গজেন্দ্রগমনে ফটক খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার তীক্ষ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কিন্তু কথাগুলা বোঝা গেল না। বোধকরি ভৃত্য জগবন্ধুকে তিরস্কার করিতেছেন। এক মিনিট কাটিয়া গেল।

তারপর—তারপর হেমনলিনীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ঘেউ—ঘেউ—ঘেউ। হেমনলিনীর এমন ভয়ঙ্কর ডাক বৈদ্যনাথবাবু পূর্বে কখনও শোনেন নাই। তাঁহার সর্বাঙ্গ কণ্টকিত হইয়া উঠিল।

এবার হেমনলিনীর কণ্ঠস্বরের সহিত গৃহিণীর কণ্ঠস্বর মিশিল— ‘ওরে বাবা রে! মেরে ফেললে রে!’ তারপর গৃহিণী তীরবেগে ফটক দিয়া বাহির হইয়া আসিলেন, পশ্চাতে কালরূপিণী হেমনলিনী। গৃহিণী গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলেন, হেমনলিনী শেষবার তাঁহার গোড়ালিতে কামড়াইয়া দিল।

গাড়ি ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল।

শঙ্করাচার্যই ঠিক বলিয়াছিলেন— হেমনলিনী অন্তর্তেজা কুকুরই বটে। তাছাড়া সে বৈদ্যনাথবাবুকে ভালবাসে। যতদিন হেমনলিনী আছে ততদিন বৈদ্যনাথবাবুর ভয় নাই।

ঘটনাক্রমে সেইদিন উপরোক্ত ব্যাপারের ঘণ্টাখানেক পরে শঙ্করবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আসিয়া দেখিলেন, বৈদ্যনাথবাবু হেমনলিনীকে কোলে লইয়া বসিয়া আছেন। তিনি বলিলেন, ‘কাণ্ডটি কী? কুকুর কোলে করে বসে আছেন যে!’

বৈদ্যনাথবাবু গদ্‌গদ কণ্ঠে হাসিয়া বলিলেন, ‘শঙ্করবাবু, আমি হেমনলিনীর বিয়ে দেব। আপনাকে একটি সৎপাত্র জোগাড় করে দিতে হবে।’

৩ চৈত্র ১৩৬৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *