হেডমাস্টার
সংসারে তো সেঁধিয়ে গেছি, এখন কি করলে কি হবে! বেরবার পথ? ঠাকুর, বেরব কেমনে?
“কোথায় বেরোতে চাও?”
‘সংসারের বাইরে। মুক্তি চাই।’
“মুক্তি চাও!” তাহলে শোন-
“আমি মুক্তি দিতে কাতর নই
শুদ্ধাভক্তি দিতে কাতর হই।
আমার ভক্তি যেবা পায়, তারে কেবা পায়,
সে যে সেবা পায়, হয়ে ত্রিলোকজয়ী।”
তোমার মনে যে মুক্তির বাসনা, সে কিন্তু পলায়নের মনোবৃত্তি। তুমি কর্তব্য ছেড়ে পালাতে চাইছ। বেহিসাবী, অলস হতে চাইছ। পায়রার গলায় মটরের দানার মতো সংসার গজগজ করছে, তুমি চাইছ মুক্তি! তুমি কি জান, সংসারীর কর্তব্য কি কি! গৃহস্থের কর্তব্য আছে, ঋণ আছে, দেব-ঋণ, পিতৃ-ঋণ, ঋষি- ঋণ আবার পরিবারদের সম্বন্ধে ঋণ আছে। সতী স্ত্রী হলে তাকে প্রতিপালন; সন্তানদিগকে প্রতিপালন যতদিন না লায়েক হয়।
“প্রতাপের ভাই এসেছিল! এখানে কয়দিন ছিল। কাজকর্ম নাই। বলে, আমি এখানে থাকব। শুনলাম, মাগ- ছেলে সব শ্বশুরবাড়িতে রেখেছে। অনেকগুলি ছেলেপিলে। আমি বকলুম, দেখ দেখি ছেলেপিলে হয়েছে; তাদের কি আবার ও-পাড়ার লোক এসে খাওয়াবে-দাওয়াবে, মানুষ করবে? লজ্জা করে না যে, মাগছেলেদের আরেক জন খাওয়াচ্ছে, আর তাদের শ্বশুরবাড়ি ফেলে রেখেছে। অনেক বকলুম, আর কর্মকাজ খুঁজে নিতে বললুম। তবে এখান থেকে যেতে চায়।”
সার কথা শোন বাপু-
“মনে বাসনা থাকিতে কি হবে বল না
জপিলে তুলসী মালা।
চিতে কামনা থাকিলে নাকে তিলক কাটিলে
ভোলে কি চিকন কালা।।”
আগে বেশ করে বস, স্থির হও, এইবার বল তো, তুমি কোন্ মুক্তি চাও? প্রতাপের ভাইয়ের মুক্তি! সংসারের ধাক্কায় বেসামাল, তাই একটু হাত-পা ছড়িয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে বাঁচার বাসনা! খাব দাব ফূর্তি করব! মনে যার সংসার, মনে যার ভোগবাসনা তার মুক্তি কোথায়! ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙবে, বাবা!
বিজয়কৃষ্ণকে আমি বলেছিলুম, মনে পড়ছে! সংসারীর সংসার প্রতিপালন করতে হয়। তাই সঞ্চয়ের দরকার হয়! পন্হী আউর দরবেশ সঞ্চয় করে না। কিন্তু পাখির ছানা হলে সঞ্চয় করে। ছানার জন্যে মুখে করে খাবার আনে।
আবার সাধু হলেই কি হয়, বিজয়!
দেখ বিজয়, সাধুর সঙ্গে যদি পুঁটলি-পাটলা থাকে, পনেরটা গাঁটওয়ালা যদি কাপড়-কুঁচকি থাকে তাহলে তাদের বিশ্বাস করো না।
ঐ দেখ বটতলায় সব বসে আছে। যাও গিয়ে শুনে এস কি আলোচনা করছে!
আমি দেখেছি। কেউ ডাল বাছছে, কেউ কেউ কাপড় সেলাই করছে, আর বড়মানুষের বাড়ির ভাণ্ডারার গল্প করছে—’আরে ও বাবুনে লাখো রূপেয়া খরচ কিয়া, সাধু লোককো বহুৎ খিলায়া, পুরি, জিলেবী, পেড়া, বরফী, মালপুয়া, বহুৎ চিজ তৈয়ার কিয়া।’
তাহলে মুক্তিটা কি হলো বাপু! গেরুয়া নিয়ে লাভটা কি হলো! সার কথাটি শোন—মনটি দুধের মতো। সেই মনকে যদি সংসার-জলে রাখ, তাহলে দুধেজলে মিশে যাবে। তাই দুধকে নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। যখন নির্জনে সাধন করে মনরূপ দুধ থেকে জ্ঞান-ভক্তিরূপ মাখন তোলা হলো, তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার-জলে রাখা যায়। সে মাখন কখনো সংসার-জলের সঙ্গে মিশে যাবে না—সংসার-জলের ওপর নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে।
এই ভাসমানতাই হলো মুক্তি। একধরনের সাঁতার। ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে স্কুলের ছুটি নয়। ওরে! সবেতেই আছি অথচ নেই, এই তো মুক্তি।
রামপ্রসাদ বলছেন :
“অহঙ্কার অবিদ্যা তোর পিতামাতায় তাড়িয়ে দিবি।
যদি মোহগর্তে টেনে লয়, ধৈর্য খোঁটা ধরে রবি।।
ধর্মাধর্ম দুটো অজা, তুচ্ছ খোঁটায় বেঁধে থুবি।
যদি না মানে নিষেধ, তবে জ্ঞান খড়ো বলি দিবি।।”
কোস্তাকুস্তি করলে মুক্তি আসে না। মুক্তি হলো ম্যাথামেটিক্স। দুই আর দুইয়ে চার, আবার দুই দু-গুণেও চার। ক-এর সঙ্গে খ-এর গ-এর মাধ্যমে যোগ, তারপরেই ঘ—ঘরসংসার, তারপরেই দোমড়ানো মোচড়ানো! তখন চ- এর চলচল, ছ-এর এত কিসের ছল! জ-এর ভীষণ জ্বালা, ঝ-এর যেমন ঝড়ের দাপট। ঞ-র কী ভীষণ গোঁসা। ট-এর টাকার ঠ-এ এসে ঠনঠনানি, ড এসে ভয় দেখাচ্ছে ডাকাতির। ঢ কেন পেটায় অহঙ্কারের ঢাক! ণ-এর যতেক খোঁচা। ত বলছে তবে রে, থ তোর এমন থাবা, দ বলছে দান করে দে ধ-এর যত ধন-দৌলত। ঐ দেখ ন বলছে ‘নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু।’
তাই বলছি, ঈশ্বরের প্রতি প্রেম আসলে কর্মত্যাগ আপনি হয়ে যায়। যাদের ঈশ্বর কর্ম করাচ্ছেন, তারা করুক। আগে প্রেম, আগে ভক্তি, পরে মুক্তি। প পেরিয়ে ফ। সব ফক্কিকারি। তারপর ব–বন্ধনে টান, ভ-এ পড়ল অভী, ম বাজাল ঘণ্টা। আমার হেডমাস্টার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ চৌকি থেকে হাঁক মারলেন, যাও তোমার ছুটি। কালী-কল্পতরুমূলে এইবার বেড়াতে যাও।