হুঁকো
০১. মীরণ বনাম মিড়ন
বাবা, হুঁকো কী?
ব্যাপারটা আরম্ভ হয়েছিল এই রকম অতি সাধারণ ভাবে। কিন্তু সেটা যে শেষ পর্যন্ত এত জটিল আকার ধারণ করবে সেরকম কিছু সমীরণ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি।
সেটা কোনও এক রবিবারের সকালবেলা। সমীরণ সদ্য বাজার থেকে এসে দিনের দ্বিতীয় পেয়ালা চা নিয়ে খবরের কাগজ খুলে বসেছে।
সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকালবেলায় অফিস যাওয়ার তাড়া থাকে। রবিবারে সে ঝামেলা নেই। রবিবারে সকালের দিকে এই বাজার যাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কোথাও যায় না সমীরণ। ইংরেজি বাংলা দুটো খবরের কাগজ খুব মন দিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে আর যতটুকু সম্ভব ছেলেকে পড়ায়, ছেলের পড়াশুনো দেখে।
সমীরণের একই ছেলে, মেয়ে-টেয়ে নেই। ছেলের নাম আগে ছিল মীরণ, এখন হয়েছে মিড়ন।
প্রথমটা কায়দা করে সমীরণ থেকে ছেলের নাম মীরণ রাখা হয়েছিল। এ নামটা সমীরণ কোথায় যেন শুনেছিল এবং ছেলে জন্মানোর আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল ছেলে হলে তার নাম রাখবে মীরণ। বাপের নাম সমীরণ, ছেলের নাম মীরণ বেশ জুৎসই হবে ব্যাপারটা।
কিন্তু বাদ সাধল সমীরণের ইতিহাসবোধের অভাব। মীরণ নামটা ইতিহাস কুখ্যাত মিরজাফরের ছেলের নাম, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলাকে সে হত্যা করেছিল, যা তা হত্যা নয় রীতিমতো গলা কেটে হত্যা এবং সেই মীরণ নিজেই একদিন বজ্রাঘাতে মারা গিয়েছিল।
তবে এসব কূট প্রশ্ন প্রথম দিকে ওঠেনি। সমীরণ-মীরণ ভালই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বছর কয়েক আগে পুজোর সময় সপরিবারে দিল্লি বেড়াতে গিয়ে খুড়শ্বশুরের বাড়িতে উঠেছিল সমীরণ, সেখানে প্রশ্নটা ওঠে; খুড়শ্বশুর মানে সমীরণের স্ত্রী তথা মীরণের মা শ্যামলীর কাকা।
খুড়শ্বশুর ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ প্রাচীনপন্থী, দিল্লির একটা কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। তিনি নাতির নাম মীরণ শুনে পৌঁছানোর দিনই সন্ধ্যাবেলা সমীরণ ও শ্যামলীকে বাংলার ইতিহাসের কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা করলেন। এবং বললেন, কোনও ভারতীয়ের নামই মীরণ রাখা উচিত নয়।
কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে সময় মীরণের বয়েস সাত। চার বছর বয়েসে মীরণকে স্কুলে নার্সারিতে ভরতি করা হয়েছে, তখন থেকে মীরণ নীমটা চলেছে। নামটা চালু হয়ে গেছে, স্কুলের খাতায় নাম রেকর্ড হয়ে গেছে। এরপর নাম পালটানো খুবই ঝামেলা।
যথাসময়ে সমীরণ শ্যামলীরা ছুটির অবসানে কলকাতায় ফিরে এল। কিন্তু দুজনের মনের মধ্যেই ছেলের নাম নিয়ে একটা খুঁতখুঁতানি ভাব। অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে সমীরণ তার কলেজের সহপাঠী বন্ধু অনিমেষকে ধরল।
অনিমেষ খবরের কাগজের অফিসে কাজ করে। একসময় ভারী ভারী প্রবন্ধ লিখত, এখন শুধুই চাকরি করে আর আড্ডা দেয়। তবে বাংলাটা মোটামুটি জানে।
অনিমেষকে গিয়ে সমস্যাটা বলতে সে প্রথমে একচোট খুব হাসল, তারপর বলল, এই আধুনিক নাম রাখার ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। লোকেরা নবজাতকের নাম ওঁর কাছে চেয়ে পাঠাত। এখন তো যে কেউ নামকরণ করছে। অর্ধেক সময় তো নামের কোনও মানেই করা যায় না।
সমীরণ বলল, কিন্তু কী করা যাবে?
অনিমেষ বলল, আর রবীন্দ্রনাথ যে নামকরণগুলো করেছিলেন সেগুলোর তো মানে ছিল, অর্থ ছিল। তার মধ্যে কাব্যও ছিল।
এভাবে কিছুক্ষণ আলোচনা চলার পর অনিমেষ বলল, দাঁড়া, দুচারদিন সময় দে। আমি একটু ভেবে দেখি।
কয়েকদিন পরে অনিমেষ সমীরণকে অফিসে ফোন করে বলল যে, সে একটা সমাধান পেয়েছে, খুব সহজ সমাধান। সেদিনই বিকেলে ছুটির পরে অনিমেষের সঙ্গে সমীরণ দেখা করল।
অনিমেষ যে পরামর্শ দিল সেটা বেশ গ্রহণযোগ্য। মীরণ নামটা বদলাতে হবে না, শুধু বানানটা বদলাতে হবে। মীরণ বদলিয়ে মিড়ন হয়ে যাবে।
এবার সমীরণ জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু মিড়ন মানে কী?
অনিমেষ বলল, সংগীতের সেতারের মিড় আছে না, স্বর ওঠে নামে, সেই মিড় থেকে মিন,কম্প থেকে যেমন কম্পন।
বিনা বাক্যব্যয়ে সমীরণ অনিমেষের এই সমাধান মেনে নিল। তবে অনিমেষ বলে দিল, মিড়ন বানানে প্রথমে হ্রস্ব ইকার হবে, দীর্ঘ ঈকার নয়। আর শেষেরটা দন্ত্য ন, মূর্ধন্য ণ নয়।
অতঃপর মীরণ মিড়ন হয়ে গেল।
.
এখন মিড়নের বয়েস নয়। তার নাম সবার অলক্ষ্যে সংশোধন করা হয়েছে। ক্লাসে কেউ টের পায়নি, টের পাওয়ার কথাও নয়, বাচ্চা ছেলের নামের বানান নিয়ে কেই বা মাথা ঘামায়।
তা না ঘামাক। এ গল্প মোটেই মিড়নকে নিয়ে নয়। এ গল্প হুঁকো নিয়ে। আর হুঁকো, অর্থাৎ তামাক সেবনের সেই প্রাচীন যন্ত্র, সে তো প্রাপ্তবয়স্কের ব্যাপার, তার মধ্যে নয় বছর বয়েসের দুধের শিশুকে ডেকে আনা কেন?
০২. হুঁকোমুখো হ্যাংলা
যদিও ক্লান্তি আর একঘেয়েমির প্রশ্নটা আছে, থেকেই যায়, তবু হাসির গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিখলে ভাল হয়, কিছু রাখাটাকা করতে নেই।
সেই জন্যেই গল্পের গোড়াতে মীরণ-মিড়ন উপকাহিনিটি বলে নিলাম। তা ছাড়া একটু পরেই বোঝা যাবে এই হুঁকোকাহিনির মূল নায়ক হল ওই নয় বছর বয়েসি মিড়ন, যে মিড়ন একটি আধুনিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে।
মিড়নের পড়াশুনোর দিকে নজর রাখছিল সমীরণ, আজ এই ছুটির দিনের সকালে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে।
একদিনের ম্যাচে সদ্য নির্বাচিত ভারতীয় ক্রিকেট টিমের সর্বশেষ তালিকাটি খুঁটিয়ে দেখছিল সমীরণ, বিশেষ মনোযোগ সহকারে। আজাহারউদ্দিন আর শচীন তেন্ডুলকার, দুজনের ওপরেই সমীরণের প্রচুর আস্থা, কিন্তু হাজার হলেও খেলাটা ক্রিকেট, কখন কীসে কী হয় কিছুই বলা যায় না।
এমন সময় ক্রিকেট তালিকায় সমীরণের মনোযোগ ও একাগ্রতা ছিন্ন করে মিড়ন জিজ্ঞাসা করল, বাবা, হুঁকো কী?
হঠাৎ এই প্রশ্নের ধাক্কায় বাংলা সিনেমার নায়কের মতো অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সমীরণ বলতে যাচ্ছিল, হুঁকো, ওই হুঁকো আর কী?
এবং সেই মুহূর্তেই তার খেয়াল হল তার ছেলে মিড়ন হয়তো হুঁকো জিনিসটা কখনও দেখেনি।
কিন্তু হুঁকো, হুঁকো নামক সনাতন নেশার দ্রব্যটি ইস্কুলের নিচু ক্লাসের পাঠ্যতালিকায় কী করে আসছে? দিনে দিনে কী যে হচ্ছে সব। সমীরণের বয়েস যদিও এখন মাত্র আটত্রিশ সে ধরে নিল নয়ানীতির পাঠ্যরীতির দোষ এটা, সব গোলমেলে জিনিস শেখানো হচ্ছে শিশুদের, বালক বালিকাদের; দেশটা তুফানমেলে জাহান্নমের দিকে দ্রুত এগোচ্ছে।
আসলে ঘটনাটা কিন্তু ঠিক তা নয়। ঘটনাটা মিড়ন ও তার সহপাঠীদের পক্ষে অনেক বেশি জটিল। ও বিপজ্জনক।
সমীরণ খবরের কাগজের বোঝা টেবিলের ওপরে ফেলে টেবিলের ওপ্রান্তে সোফায় ছেলের পাশে বসে তার হাতের বইখানা তুলে নিল।
বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর বাংলার পাঠ্যপুস্তক সেটা। তারই কবিতাংশে রয়েছে হুঁকোমুখো হ্যাংলা নামক সেই অত্যাশ্চর্য, অবিস্মরণীয় ছড়াটি। শ্যামাদাস নামে আফিঙের থানাদার মানে একসাইজ সাব ইন্সপেক্টরের সে ভাগ্নে, সে হুঁকোমুখো, সে হ্যাংলা, সে বাঙালি কারণ বাড়ি তার বাংলা, সব চেয়ে বড় কথা তার দুটো লেজ, কিন্তু মানুষের তো লেজ নেই, পশুদের লেজ থাকলেও মাত্র একটা করে লেজ, পাখিদের, সাপেদের, টিকটিকিদের, মাছেদেরও মাত্র একটাই লেজ, সেদিক থেকে হুঁকোমুখো হ্যাংলা সকলের চেয়ে এক ডিগ্রি অথবা একশো ডিগ্রি ওপরে।
দু-লেজের একটা কিস্তৃত জন্তু, যে কখনও হাসে না, যার শুধু এক আবগারির দারোগামামা ছাড়া কেউ নেই শিশুচিত্রের কল্পনার জন্যে অসামান্য, অতি, অতিশয় চমৎকার একটি জানোয়ার।
কিন্তু আধুনিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পাঠক্রমে কোনও কল্পনাবিলাসের অবকাশ নেই, অতএব হালকা জিনিস চলবে না।
হুঁকোমুখো হ্যাংলা ছড়াটির ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত, সামাজিক ভূমিকা, নান্দনিক গঠনরীতি, আর্থ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এমনকী সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের পটভূমিকায় ছড়াটির যৌক্তিকতা– চতুর্থ শ্রেণীর শিশুদের সবই জানতে হবে। আর শুধু তাই নয়, ব্যাকরণগত যা কিছু প্রশ্ন ওই ছড়ায় নিহিত রয়েছে সেটাও অনুধাবন করতে হবে।
সেই অনুধাবন করতে গিয়েই ছড়াটির প্রথম শব্দেই ব্যাকরণের ধাক্কায় আটকে গেছে শ্রীমান মিড়ন।
হুঁকোমুখো সমাসবদ্ধ পদ, ঠিক আছে মেনে নিয়েছে মিড়ন, ব্যাসবাক্য হল হুঁকোর মতো মুখ যাহার বা যাহাদের, তাতেও আপত্তি নেই মিড়নের। কিন্তু হুঁকো জিনিসটা কী?
তাই তার সরল ও স্বাভাবিক প্রশ্ন, বাবা, হুঁকো কী?
সমীরণ সে জাতের বাবা নয় যে, হুঁকো জিনিসটা কী তা তোমার না জানলেও চলবে, এই রকম গুরুগম্ভীর জবাব দিয়ে প্রশ্নটার পাশ কাটিয়ে যাবে। সুতরাং সে একটু ভেবে চিন্তে সমঝিয়ে তারপর উত্তর দিল, হুঁকো দিয়ে তামাক খায়, তামাক খাওয়ার জিনিস একটা।
মিড়ন বলল, সিগারেটের মতো?
সমীরণ বলল, আরে না। না। মোটেই সিগারেটের মতো নয়। হুঁকো অনেক বড়, হুঁকোর মধ্যে জল থাকে। সিগারেটে তামাক কাগজ দিয়ে জড়ানো থাকে। আর হুঁকোয় তামাক এমনিই থাকে। কোর তামাকের গন্ধ খুব ভাল হয়।
এ কথা বলতে বলতে সমীরণের স্মৃতি তিরিশ বছর পিছিয়ে গেল। তখনও দেশের বাড়িতে ঠাকুরদা বেঁচে। বিকেলে বাইরের বারান্দায় জলচৌকিতে বসে গড়গড়া টানতেন, উঠোনের এক প্রান্তে গন্ধরাজ লেবুর পুরনো ঝাড়ে সাদা ফুলে আর কলিতে থই থই করছে সৌরভ, বারান্দায় উঠে আসছে সেই গন্ধ তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে দাকাটা তামাকের ধোঁয়ার ঘ্রাণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুক ভরে একটানা হাওয়া টানল সমীরণ, সুখস্মৃতির সঙ্গে পুরনো দিনের সৌরভ যদি একটু ফিরে পাওয়া যায়।
বাদ সাধল মিড়ন, সে তো আর তার পিতৃস্মৃতির অংশীদার নয়, এটা তার জিজ্ঞাসার বয়েস, তার জিজ্ঞাসা অফুরন্ত, সে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, তাহলে কি সিগারেটের মতো হুঁকো দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়?
স্মৃতিজাল ছিন্ন করতে করতে সমীরণ বলল, তা বেরোবে না কেন?
মিড়ন বলল, কিন্তু বাবা তুমি যে বললে হুঁকোয় জল থাকে।
সমীরণ বলল, থাকে তো, কিন্তু তাতে কী হয়েছে?
মিড়ন বলল, জলে আগুন নিবে যায় না? তাহলে ধোঁয়া বেরোয় কী করে?
সমীরণ বুঝতে পারল হুঁকো জিনিসটা যে দেখেনি তার পক্ষে বোঝা কঠিন, বিশেষ করে একটি শিশুর পক্ষে। কলকে থেকে নলচে পর্যন্ত সে এক এলাহি কারবার। উঠে গিয়ে ছেলের টেবিল থেকে একটা খাতা পেনসিল নিয়ে এসে হুঁকোর ছবি আঁকতে বসল সমীরণ। তার পাশে মিড়ন উগ্রীব হয়ে তাকিয়ে।
সমীরণ প্রথমে আঁকল ধোঁয়া, নীচে থাকবে কলকে, কলকের ভেতর থেকে তামাকের ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
ধোঁয়া আঁকা খুব সোজা, খুব সহজেই ধোঁয়া আঁকার ব্যাপারটা সেরে ফেলল সমীরণ, তবে মিড়নের প্রতিক্রিয়া সুবিধের নয়, সে বলল, বাবা, মেঘ আঁকছ? ওই মেঘের জল দিয়ে হুঁকো হবে?
সমীরণ কিছু বোঝানোর আগেই সকালবেলার স্নান সেরে এলোচুল ঝাড়তে ঝাড়তে বাইরের ঘরের পাখার নীচে সিক্ত কেশরাজি শুকোনোর জন্যে শ্যামলী প্রবেশ করল অকুস্থলে।
বাইরের ঘরে ঢুকেই সে চেঁচামেচি শুরু করল, সর্বনাশ! ছেলের ইস্কুলের খাতায় এসব কী হাবিজাবি কাটাকুটি করছ? এ খাতা নিয়ে কাল ইস্কুলে যাবে কী করে?
হুঁকোর ধোঁয়ার ছবি আঁকা থামিয়ে ছেলের সরল প্রশ্নের আগে স্ত্রীর কঠিন প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিল সমীরণ, হুঁকোর ছবি আঁকছি।
শ্যামলীর চুল ঝাড়া বন্ধ হয়ে গেল, চোখ বিস্ফারিত হল।
ইস্কুলের পবিত্র খাতায় হুঁকোর ছবি! তা ছাড়া এই হাসিস, চরস, ড্রাগের দুর্দিনে বাপ নিজে কিনা ছেলেকে, একমাত্র ছেলেকে, হুঁকোর ছবি এঁকে দেখাচ্ছে। বিয়ের পর থেকেই শ্যামলীর কোনও এক অনির্দিষ্ট কারণে মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল একদিন তার স্বামী সমীরণ তার সমূহ ক্ষতি, চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটাবে। আজ এই মুহূর্তে শ্যামলী এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হল।
এক ছোঁ মেরে সে স্বামীর হাত থেকে ছেলের ইস্কুলের খাতা ছিনিয়ে নিল। সর্বনাশ, এ যে ভূগোলের খাতা, সাধারণ খাতা নয়, ল্যাবরেটরি নোট বুক। ভূগোলের অবশ্য ল্যাবরেটরি নেই কিন্তু ওই নোটবুকটা লাগে। বাঁয়ে সাদা পৃষ্ঠা, ডাইনে লাল মার্জিনে নীল রুল টানা পৃষ্ঠা। এই পৃষ্ঠায় মানচিত্র, প্রয়োজনীয় ছবি আঁকতে হয়, ওই পৃষ্ঠায় আক্ষরিক বর্ণনা।
কী ভয়ানক! এই রকম দরকারি খাতায় ছেলের মনোরঞ্জনের জন্যে সমীরণ ছবি আঁকছে, তাও কি হুঁকোর ছবি। এরপর অধঃপতনের অতল সলিলে ডুবে যেতে ছেলের আর কয় ধাপ নামতে হবে?
শ্যামলী এতই উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে সমীরণ তাকে কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারল না যে ভূগোল না হোক সে ছেলেকে অন্তত ব্যাকরণ শেখাচ্ছিল। আর ওটা ঠিক হুঁকোর ছবি নয়, হুঁকোর ছবি সে এখনও আঁকেনি এবং তার সন্দেহ হচ্ছে সে হয়তো ভাল ভাবে এঁকে উঠতে পারবে না।
শ্যামলী চেঁচিয়ে জানতে চাইল, তবে যে তুমি বললে হুঁকো?
সমীরণ বলল, ঠিক হুঁকো নয়, ছবিটা ভাল করে লক্ষ করো, ওটা হল ধোঁয়ার ছবি, হুঁকোর কলকের ধোঁয়ার ছবি।
সে যে আরও খারাপ ব্যাপার। শ্যামলী আর্তনাদ করে উঠল। প্রত্যেকদিনই স্নান করার পর শ্যামলীর গলা কিছুক্ষণের জন্য একটু বসে যায়, ফলে আর্তনাদ তেমন জমল না কিন্তু এতে সে দমল না, সমীরণের কাছে জানতে চাইল, হুঁকোর কলকের ধোঁয়ার সঙ্গে ব্যাকরণের সম্পর্ক কী? এর মধ্যে ব্যাকরণ কোথা থেকে আসে?
এই দাম্পত্যকলহের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লাভ নেই। ব্যাপারটা রুচিসম্মত নয়, এর মধ্যে কোনও অভিনবত্বও নেই।
সুতরাং সংক্ষিপ্ত করে বলি, সমীরণ এরপর হুঁকোর ছবি আঁকা থেকে নিবৃত্ত হল।
০৩. হুঁকোর সন্ধানে
আজকের সকালের ঘটনার আকস্মিকতায় বহু অভিজ্ঞ শ্রীমান মিড়নও কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল।
ভূগোলের খাতা থেকে ধূমজাল কলঙ্কিত পৃষ্ঠাটি পরিচ্ছন্নভাবে নিশ্চিহ্ন ও কুচিকুচি করে ফেলে শ্যামলী যখন পাশের ঘরে অন্য একটা পাখা খুলে চুল শুকোতে গেল মিড়ন থতমত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, হুঁকো জিনিসটা খারাপ?
সমীরণ এ প্রশ্নের আসল উত্তর না দিয়ে ছেলেকে সান্ত্বনার ভাষায় বলল, আমি তোমাকে হুঁকো দেখাব। দেখলেই বুঝতে পারবে জিনিসটা ভাল কি খারাপ?
মিড়ন বলল, মা দেখলে বুঝতে পারবে?
সমীরণ বলল, তোমার মা-র হুঁকো দেখার দরকার নেই। তোমার মায়ের মামারা ছিলেন এক নম্বরের হুঁকোখোর। সারাদিন তিন মামা গুড় গুড় গুড় গুড়, লম্বা নলে গড়গড়ায় টান দিয়ে যাচ্ছেন আর টান দিয়ে যাচ্ছেন।
এই রকম তিক্ত কথা বলার পরে সমীরণের যৌবন-বেদনা ফিরে এল। মনে পড়ল নববিবাহের সুখস্মৃতি। দ্বিরাগমনের অব্যবহিত পরে এক রবিবারে বারুইপুরে শ্যামলীর মামার বাড়িতে যেতে হয়েছিল। সে বাড়িতে গিয়ে তার মনে হয়েছিল এ বাড়িতে তামাক সাজা আর তামাক পান করা, পান সাজা আর পান খাওয়া ছাড়া কারও কোনও কাজ নেই।
মনে আছে, পৌঁছানোর পরে চা-জলখাবার শেষ করে সে উঠল গিয়ে দোতলায় চিলেকোঠা ঘরে। একতলা বাড়ির দোতলায় চিলেকোঠা বিরাট ব্যাপার, বিরাট লম্বা-চওড়া ঘর, অনন্ত ছাদ। ছাদের পাশে নারকেলের গাছের সারি, ছাদের কার্নিশে অফুরন্ত কচি নারকেলের বোঝা নামিয়ে গাছগুলো বিশ্রাম করছে। কোনও কোনও নারকেল গাছের বুকে মঞ্জরী এসেছে, ঈষৎ সাদা হলদেটে কুসুমগুচ্ছ, কেমন যেন মনে হয়েছিল ক্ষীণ গন্ধও আছে সেই সব মঞ্জরীতে।
চিলেকোঠার ছাদে আসার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জনৈক নবকিশোরী শ্যালিকা এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল, জামাইবাবু, হাবল বাবল?
হাবল বাবল শব্দটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল সমীরণের কিন্তু সে কিছু বলার আগেই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এল ধূমায়িত অম্বুরী তামাকের নল-গড়গড়া হাতে এক সোমত্তা, সুরসিকা দাসী।
সেই মুহূর্তে সমীরণের মনে পড়ছিল, হুঁকোর ইংরেজি হল হাবল বাবল। তখন কড়া চার্মিনার সিগারেট খায় সমীরণ। তার বদলে সেই অম্বুরী তামাক, কী যে ভাল লেগেছিল সমীরণের।
কিন্তু এসব কথা ভেবে এখন লাভ নেই। তার চেয়ে বড় কাজ হল ছেলেকে একটা হুঁকো দেখানো, যেটা দেখলেই মিড়ন বুঝতে পারবে হুঁকোমুখো মানে কী। সেটাই হবে হাতে কলমে শিক্ষা। মিড়নের ক্লাসের অন্য কোনও ছেলেই জানতে পারবে না হুঁকোমুখো কী রকম। এই প্রতিযোগিতার বাজারে সেটা কি কম কথা।
সুতরাং সমীরণ মিড়নের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল সে তাকে হুঁকো দেখাবে।
এইখানেই সমীরণ ভুল করে বসল। তার ধারণা হয়েছিল আশেপাশে, নিশ্চয়ই পাড়ার মধ্যেই এখনও কেউ না কেউ হুঁকো খায়; একটু চেষ্টা করলেই মিড়নকে নিয়ে গিয়ে সে হুঁকো দেখিয়ে আনতে পারবে। হয়তো ঠিক হুঁকো যাকে বলে তা হবে না সেটা, গড়গড়া হওয়াই সম্ভব।
কিন্তু কার্যত দেখা গেল হুঁকো দর্শন এখন আর সহজ নয়। শুধু নিজের পাড়াতেই নয়, চার দিকে দু-চার-দশ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও কোপায়ীর সন্ধান পেল না সমীরণ। সকলের অগোচরে কবে যে হুঁকো-গড়গড়া অবলুপ্ত হয়ে গেল।
অথচ সমীরণের প্রথমে মনে হয়েছিল এই তো সেদিনও যেন কোনও বাড়ির বারান্দায় কোনও এক বুড়োকে সে হুঁকো খেতে দেখেছে। কিন্তু বোঝা গেল এটা মনের বিভ্রম মাত্র। সেই সব কোসেবী মানুষেরা পৃথিবী থেকে কবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
প্রথম কয়েকদিন সমীরণের আশা ছিল হয়তো পথেঘাটে, এখানে ওখানে সহসা তেমন কাউকে দেখতে পাবে যে কিনা হুঁকো হাতে প্রসন্নচিত্তে একগাল ধোঁয়া ছাড়ছে।
তা হলেই, কেল্লা ফতে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ছুটে গিয়ে মিড়নকে নিয়ে এসে হুঁকোটা দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
কিন্তু, তা কি আর হয়। একটা হুঁকোও সতত সন্ধানী সর্তক সমীরণের দৃষ্টিগোচর হল না।
গলির মোড়ে পাড়ার ক্লাবে কয়েকজন প্রৌঢ় অফিস-কাছারি থেকে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যার সময় তাস খেলেন। তাঁরা অভিজ্ঞ, প্রবীণ ব্যক্তি। সমীরণ ভাবল এঁদের কাছে হুঁকোর খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।
সমীরণ এ ক্লাবের সদস্য নয়, কোনওদিনই এই ক্লাবে যায় না; আর ওই যাঁরা সন্ধ্যার পর ক্লাবে বসে তাস খেলেন তাদের সঙ্গে পাড়াপ্রতিবেশী সূত্রে যাকে বলে মুখচেনা আলাপ। এঁদের কারও নাম ভাল করে জানে না সে।
তবু ছেলের জন্যে সমীরণ এর মধ্যে একদিন অফিসফেরতা ক্লাবে ঢুকল। চারজন গভীর অভিনিবেশ সহকারে তাস খেলছেন, কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। টিমটিমে একটা পঁচিশ পাওয়ারের বালবের আলোয় পুরনো ছেঁড়া শতরঞ্চির ওপরে জমে উঠেছে খেলা। যতক্ষণ খেলা চলছিল তারা একজনও সমীরণের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন না। তাস খেলার সময় বাইরের লোকের অনুপ্রবেশ তাপুড়েরা মোটেই বরদাস্ত করতে চায় না।
যা হোক খেলা এক হাত শেষ হওয়ার পর এঁদের মধ্যে একজন সমীরণের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। ভরসা পেয়ে সমীরণ জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কেউ হুঁকো খান কি না?
ততক্ষণে পরের দানের তাস বাটা হয়ে গেছে। ভদ্রলোক বাঁ হাত তুলে ইঙ্গিতে সমীরণকে মৌন থাকতে বলে তাস তুলে সাজাতে লাগলেন। প্রথমে থেমে থেমে গভীর চিন্তা করে টু হার্টস, টু নো ট্রামপস… ইত্যাদি ডাক চলল, তারপর তাস পেটাপেটি। আরেক ডিল খেলা শেষ হতে দশমিনিট লাগল। সমীরণ আর কী করবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
ডিল শেষ হতে সেই ভদ্রলোক সমীরণকে তার প্রশ্নের খেই ধরে বললেন, হুঁকো? তিনি এর বেশি বলতে পারলেন না, কারণ এবারে তাঁর তাস বাটার পালা পড়েছে।
ফলে ওই প্রশ্নের মুখে সমীরণের আরও দশ মিনিট দাঁড়াতে হল। অবশেষে প্রায় দেড়ঘণ্টা পরে ওই চারজনের পক্ষে সমীরণকে যা জানানো হল তার সারমর্ম হচ্ছে, না আমরা হুঁকো খাই না। কোনওদিন খাইনি। আমাদের চোদ্দোপুরুষে কেউ কোনওদিন খায়নি৷তাসের লোকদের বাঁকা হাসি টপকিয়ে অপমানিত সমীরণ ক্লাবঘর থেকে বেরোতে বেরোতে শুনতে পেল চারজনের মন্তব্য,
(ক) হুঁকো?
(খ) খুব গরম পড়েছে।
(গ) ছেলে ছোকরাদের মাথা খারাপ হচ্ছে।
(ঘ) ভাগ্যিস কামড়ায়নি৷…
০৪. কোথাও পাবে না তাকে
হুঁকোর ব্যাপারটা যে এত গোলমেলে তা সমীরণ মোটেই বুঝতে পারেনি। আন্দাজ করতেও পারেনি। ক্রমশ সে অভিজ্ঞ হতে লাগল। অফিসে, পাড়ায়, আড্ডায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলোচনা করে হুঁকো বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারল সে, যদিও কেউ তাকে হুঁকো দেখাতে পারল না।
জানা গেল, হুঁকো একরকম নয়, নানা রকম।
যথা থেলো হুঁকো, ডাবা হুঁকো, আলবোলা, গড়গড়া, ফরাসি, সটকা। একেক হুঁকো একেক রকম দেখতে। সমীরণ সমস্যায় পড়ল, তা হলে মিড়নের হুঁকোমুখো হ্যাংলা ঠিক কী জাতের হুঁকোর মতো দেখতে ছিল?
অবশ্য এটা একটা কাল্পনিক সমস্যা। কারণ কোনও রকম হুঁকোই এ পর্যন্ত তার চক্ষুগোচর হয়নি, যেটা দেখিয়ে শ্রীমান মিড়নকে বলা যায়, দ্যাখো, এই হল হুঁকো, তোমার বইয়ের ছড়ার হ্যাংলা লোকটার মুখ এই রকম দেখতে।
সে ধরনের পজিটিভ কিছু অদ্যাবধি বলার সুযোগ হয়নি সমীরণের কিন্তু শ্রীমান মিড়ন প্রতিদিন, প্রত্যহ সমীরণ অফিস থেকে ফিরে আসামাত্র জিজ্ঞাসা করছে, বাবা, হুঁকো?
মিড়নের মা, ওই শ্যামলী আজকাল আর এ ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। বোধহয় সয়ে গেছে কিংবা বুঝে গেছে।
কিন্তু সমীরণের তো সয়ে যায়নি। ছেলেকে হুঁকো দেখাবে সে বলেছে, সুতরাং তাকে দেখাতেই হবে। সে কোনও যা-তা বাবা নয়।
এর মধ্যে একটা অসামান্য সুযোগ জুটে গেল।
সমীরণের অফিসের এক সহকর্মী, প্রায় তারই সমবয়সি, দুজনে একই বছরে কাজে ঢুকেছিল, পাশাপাশি টেবিলে বহুদিন কাজ করেছে সেই অরুণকান্ত, সম্প্রতি একটু মোটা হয়ে পড়েছিল, এই বয়েসেই একটু থপথপে। অফিসে আসার মুখে সে সিঁড়ির ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গেল। অফিসের ডাক্তার বললেন, ম্যাসিভ হার্ট স্ট্রোক (Massive Heart Stroke)।
সেদিনই বিকেলে অরুণের শেষকৃত্যে যেতে হল নিমতলায়। নিমতলা শ্মশানঘাট থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তায় একটু ঘোরাঘুরি করছিল সমীরণ। সাধারণত শ্মশানে সে আসে না, শ্মশানঘাটের দৃশ্য তার ভাল লাগে না। কিন্তু সামাজিক জীব হিসেবে বাধ্য হয়ে আসতেই হয়। তা ছাড়া পুরনো সহকর্মীর মৃত্যু, একটা দায়িত্বও তো আছে!
শ্মশানের বাইরের রাস্তায় সন্ন্যাসী, ভিখিরি আর ভবঘুরেরা ইতস্তত বসে রয়েছে। মিষ্টির দোকান, চায়ের দোকান, ফুল-বেলপাতার দোকান এরই মধ্যে একটা মুদিখানা, শ্মশানেও। মুদিখানা, খুব দুঃখের হাসি পেল সমীরণের এবং তখনই তার চোখে পড়ল পাশে পরপর দুটো কলকের দোকান।
একেবারে হাতে চাঁদ পেল সমীরণ। বন্ধু অরুণকান্ত মরে তাকে বাঁচিয়ে গেল। কলকের দোকানে নিশ্চয়ই হুঁকো থাকবে, হুঁকো না থাকলেও হুঁকোর খোঁজ পাওয়া যাবে।
কিন্তু, হায় হতভাগ্য, এবারেও সমীরণকে নিরাশ হতে হল।
দোকানদার বলল, না হুঁকো নেই। এগুলো তামাক খাওয়ার কলকে নয়। এগুলো হাসিস, চরস, গাঁজা খাওয়ার কলকে। ওসব খাওয়ার জন্যে হুঁকো লাগে না। কলকে থেকে সরাসরি টানতে হয়।
দোকান ভর্তি কলকে আর কলকে। শুধুই কলকে। সেদিকে তাকিয়ে সমীরণ বলল, আপনারা শুধু কলকে বেচেন। শুধু কলকে বেচে দোকান চলে?
এর উত্তরে দোকানদার বলল, জানেন আমাদের নিমতলা ঘাটের নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। সারা পৃথিবী থেকে সাহেব-মেম, নিগ্রো-জাপানি সবাই গাঁজা খেতে আসে মাঝরাত্তিরের নিমতলায়। তারা বড়লোকের জাত এক কলকে দুবার ব্যবহার করে না। এক রাতে একশোটা কলকে বিক্রি হলে পঞ্চাশ টাকা লাভ থাকে। তার ওপরে আছে বখশিশ, গাঁজার লাভের বখরা।
আর কিছু জানার ছিল না সমীরণের। শ্মশানঘাট থেকে সে আশাহত হয়ে বাড়ি ফিরে এল।
কিন্তু এই সূত্রেই সমীরণের মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি এল। জগুবাবুর বাজারে তো তামাকের দোকান আছে; সহজে নজরে আসে না কিন্তু মাংসপট্টির ঠিক পিছনে একটা ছোট দোকান বেশ কিছুকাল আগেও সমীরণ দেখেছে। এখনও হয়তো আছে। সেখানে হুঁকোর খোঁজ পাওয়া যাবে। না পাওয়া গেলে সোজা কাজ হবে দোকানের সামনে প্রতীক্ষা করা, যেই কেউ তামাক কিনতে আসবে, কিনে ফিরে যাওয়ার সময় তাকে অনুসরণ করলেই হুঁকোর কাছে পৌঁছে যাবে।
তবু চিন্তা হল সমীরণের। যদি সেই তামাকের দোকান উঠে গিয়ে থাকে।
পরের রবিবার সকালে দুরুদুরু হৃদয়ে জগুবাবুর বাজারের শেষ সারিতে মাংসের পট্টিতে গিয়ে পাঁচশো পাঁঠার মাংস কিনল সমীরণ। পাঁঠার মাংস কদাচিৎ খায় সমীরণ, বয়েস চল্লিশের দিকে এগোচ্ছে। সঙ্গে রক্তচাপ বাড়ছে, রক্তে শ্যাওলা বাড়ছে, মেদ বাড়ছে। ডাক্তার বলেছে লাল মাংস খাবেন না, শুয়োর বা গোরু নয়, নিতান্ত পাঁঠা-খাসির মাংস খায় সমীরণ কিন্তু ডাক্তারের বক্তব্য হল সেটাও লালমাংস, শরীরে মেদ ও রক্তে শ্যাওলা বাড়ায়।
তবু আজ মরীয়া হয়েই সমীরণ মাংসের দোকানে এল, আসল কারণ হল সেই হুঁকো। মাংসের দোকানের এক পাশ দিয়ে সরু গলির শেষ প্রান্তে উঁকি দিয়ে সমীরণ যুগপৎ পুলকিত ও আশ্বস্ত হল। দোকানটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বহুকালের পুরনো মলিন, ভাঙা সাইনবোর্ড একটু ঝাঁপসা, ঝুরঝুরে হয়ে গেছে, কিন্তু পড়া যাচ্ছে:
খাঁটি তামাকের দোকান
প্রোঃ বিপুলবিহারী
পাল
মিহিমোটা,
তাম্বুরী দা-কাটা
রংপুর, দিনাজপুর, দিনহাটা স
কল প্রকার খাঁটি সুপেয় তামাকুর
একমাত্র বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান।
সাইনবোর্ডের দুপাশে তামাকপাতার ছবি। সে ছবির সবুজতা এতকাল পরে বিবর্ণ কিন্তু চেষ্টা করলে, বুদ্ধি করে তাকিয়ে দেখলে ভাঙা ফ্রেম, মরচে ধরা সাইনবোর্ডের মধ্যে বাঁয়ে ডাইনে দুদিকে দুপাশে দুটো তামাকপাতা অনুমান করা যাচ্ছে।
তার চেয়েও সুখবর হল এতদূর থেকে দেখা যাচ্ছে ওই সাইনবোর্ডের অন্তর্গত দোকানটিও খোলা রয়েছে।
.
কিন্তু আরেকবার স্বপ্নভঙ্গ হল সমীরণের।
মাংস কেনা হয়ে যাওয়া মাত্র সে দ্রুতপদে হেঁটে খাঁটি তামাকের দোকানের সামনে গেল, তারপর একটা সংক্ষিপ্ত চালাকি করল, সেই দোকানের অতিবৃদ্ধ দোকানিকে সম্বোধন করে বলল, দাদু একশো গ্রাম দাকাটা তামাক দিন।
দোকানদারের পাশে বসে এক যুবক তখন সত্যিই দা দিয়ে তামাকপাতা কাঠের ওপরে ফেলে কুচিকুচি করে কাটছিল। কিন্তু বাদ সাধলেন বৃদ্ধ, এই বয়েসেও তার কান মানে শ্রুতিশক্তি খুব খরখরে। তিনি সমীরণকে বললেন, কী বললেন, দাকাটা তামাক?
সমীরণ বললেন, হ্যাঁ।
বৃদ্ধ দোকানদার বললেন, দাকাটা তামাক কেন, আজ পনেরো বছর, শ্যামাদ ব্যানার্জি লেনের গুরুপদ ডাক্তার মরে যাওয়ার পরে আমরা কোনও তামাকই বেচিনি, বেচতে পারিনি, ওই গুরুপদ ডাক্তারই ছিল আমাদের শেষ খদ্দের।
বিভ্রান্ত সমীরণ জিজ্ঞাসা করল, তাহলে এগুলো কী? এই যে দা দিয়ে কুচিকুচি করে কাটছে?
বৃদ্ধ বললেন, এগুলো হল খইনি।
সমীরণ বলল, এগুলো হুঁকো দিয়ে খায় না?
মলিন হাসি হেসে বৃদ্ধ দোকানদার বললেন, কতদিন পরে হুঁকো কথাটা শুনলুম। হুঁকো কোথায়? খইনি খেতে হুঁকো লাগে না। স্রেফ চুন দিয়ে ডলে ঠোঁট আর দাঁতের ফাঁকে ঢেলে দিলেই হল।
অতঃপর সমীরণ বাড়ি ফিরল।
কিন্তু সে এখনও হাল ছাড়েনি।
সেদিন মধ্যাহ্নে অসম্পূর্ণ দিবানিদ্রা সেরে সে হুঁকোর কথা ভাবতে বসল। কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর তার মনে পড়ল সোনাকাকার কথা।
সোনাকাকা সমীরণের বাবার সেজভাই। ঠাকুরদার মৃত্যুর সময় তিনি দেশেই ছিলেন। ফলে ঠাকুরদার মৃত্যুর পরে দেশের শূন্য বাড়ির যা কিছু জিনিসপত্র সোনাকাকাই সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং সবই নিজে রেখে দেন, অন্য ভাইদের কোনও ভাগ দেননি। এ নিয়ে সমীরণের বাবা বেঁচে থাকতে সমীরণের বাবা এবং অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে সোনাকাকার বেশ বাদবিসম্বাদ হয়েছে।
সমীরণেরও একটা ব্যাপার আছে এর মধ্যে। ঠাকুরদার একটা সোনার পার্কার কলম ছিল। ঠাকুরদা বেঁচে থাকতে সমীরণকে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পরে এই কলমটা তুই পাবি। তোকে দিয়ে যাব।
অবশ্য সেই কলমটাও সোনাকাকা সমীরণকে দেননি। নানা ভাবে কৌশল করে এড়িয়ে গেছেন। এক সময়ে সেই কলম পাওয়ার জন্যে অনেক হাঁটাহাঁটি করেছে সে। তখন সমীরণ সোনাকাকার বাসায়। গেলেই ও বাসার সবাই ভাবত সমীরণ কলম চাইতে এসেছে, এমনকী বিজয়া বা নববর্ষের পরে হলেও, ফলে অভ্যর্থনা তেমন মধুর হত না।
আজ প্রায় দশ-পনেরো বছর সমীরণ সোনাকাকার বাসায় যায় না। কিন্তু এবার কলমের জন্যে নয়, সে ভাবল ঠাকুরদার হুঁকো-গড়গড়া হয়তো সোনাকাকার কাছে থাকতে পারে।
অনেকে দোনামনা করে অবশেষে সাহসভরে সমীরণ একদিন অফিস ফেরতা সোনাকাকার ওখানে চলে গেল। সোনাকাকা এখন অনেক নরম হয়েছেন, বুড়ো হয়েছেন। বিগতদার, দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে, একই ছেলে, সেও প্রবাসী, আমেরিকায় লস এঞ্জেলসে থাকে। দু-চার বছরে একবার বাড়ি আসে। শূন্যগৃহে সোনাকাকা একা।
একথা ওকথার পর গড়গড়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে সোনাকাকা বললে, গড়গড়ার কথা আর বোলো না। সেটা নিয়ে অমু যা বিপদে পড়েছিল। অমু মানে অমরজ্যোতি, সোনাকাকার ছেলে।
জানা গেল, অমু সেই গড়গড়াটা আগেরবার আমেরিকা নিয়ে যাচ্ছিল, সে দেশে এসব ধরনের জিনিসের খুব কদর।
কিন্তু যাওয়ার পথে ওই গড়গড়া নিয়ে দুবার বিপদে পড়ে। প্রথমত নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে শুল্ক অফিসারেরা গড়গড়াটাকে মোগল শিল্পের প্রাচীন নমুনা বলে আটকিয়ে দেয়। বহু ধরাধরি করে এবং সেই সঙ্গে গোপনে এক শিশি কিঞ্চিৎ ব্যবহৃত বিলিতি অডিকলন উপহার দিয়ে সেটা উদ্ধার করে।
কিন্তু লস এঞ্জেলসে সেটা সম্ভব হয়নি। সেখানে দুই কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গিনী অফিসারের সেটা নজরে পড়ে। তারা সেটাকে ছাড়েনি। মারাত্মক কিছু ভেবে তারা অমরজ্যোতিকে রসিদ দিয়ে গড়গড়াটাকে নাসায় পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছে, আর ফেরত পাওয়া যায়নি।
নিরাশ হয়ে সমীরণ উঠছিল, তখন সোনাকাকা দেরাজ খুলে একটু হাতড়িয়ে ঠাকুরদার সোনার পার্কার কলমটা বার করে সমীরণকে দিয়ে বললেন, কলমটা হারিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ সেদিনই খুঁজে পেয়েছি। এটা তুই রাখ। বাবার জিনিস যত্ন করে রাখিস। আর মাঝেমধ্যে আসিস, বুড়ো কাকা একা থাকি। একটু খোঁজখবর তো নিতে হয়!
এরপর প্রায় আর কিছুই করার ছিল না। তবু উদ্যোগী সমীরণ দুটো কাজ করল।
সে শুনেছিল পুরনো বাংলা সিনেমায় অনেক হুঁকো খাওয়ার দৃশ্য আছে। নন্দনে সপ্তাহব্যাপী প্রাচীন বাংলা ছায়াছবির উৎসব দেখল। তিন শো-তে একুশটা টিকিট কেটে স্ত্রী-পুত্রকে কিছু বুঝতে না দিয়ে পরপর সাতদিন পুরনো ছবি দেখে সপরিবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল সমীরণ। কিন্তু কোনও ছবিতে একটাও হুঁকো সেবনের দৃশ্য দেখা গেল না।
এরপরে যাত্রা। কে যেন বলল, যাত্রায় নাকি পৌরাণিক কাহিনিতে বিশ্বামিত্র, নারদ ইত্যাদি মুনিঋষিরা ঘটনার পুরাণত্ব বোঝানোর জন্যে হুঁকো হাতে স্টেজে আসেন।
পৌরাণিক যাত্রা এ বছর খুব কম হচ্ছে। তবু সমীরণ অনেক খোঁজখবর নিয়ে মেমারিতে এক বন্ধুর বাড়িতে থেকে পাশের গ্রামের মণ্ডপে জায়া নই, কন্যা নই, মাতা নই, আমি দ্রৌপদী, এই রকম রোমাঞ্চকর নামের পৌরাণিক পালা দেখে এল। কিন্তু সেখানেও হুঁকোর দেখা মিলল না।
শেষ. শ্রীধর চৌধুরী
অবশেষে উদ্ধার করলেন শ্রীধর চৌধুরী।
শ্রীধর চৌধুরী অতিশয় পাকা লোক। তেল চুকচুকে পাকানো বাঁশের মতো চেহারা, কলপ দেওয়া কালো চুল। পায়ে নাগরা জুতো। এখনও সময় সময় গলায় উড়ুনি জড়ান।
শ্রীধর চৌধুরীর বয়েস কত কেউ জানে না। অফিসও না। সাতচল্লিশ সালে পার্টিশানের পর অপশন দিয়ে সমীরণদের অফিসে আসেন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ থেকে। সেও চার দশক হয়ে গেল। হিসেবমতো অনেক আগেই রিটায়ার করা উচিত ছিল। তার সার্ভিসবুক হারিয়ে গেছে, নাকি সেই পাকিস্তান থেকে আসেইনি। কিছু প্রশ্ন করলে শ্রীধরবাবু বলেন, রিটায়ার করতে এখন পাঁচ বছর বাকি আছে। এই দ্যাখো মানিকগঞ্জের তারক পণ্ডিতের নিজের হাতে করা ঠিকুজি।
কেউ যদি বলে, কিন্তু এ হিসেবে আপনি যখন চাকরিতে ঢোকেন তখন আপনার বয়েস ছিল বড় জোর পাঁচ কি ছয়। সেটা কী ব্যাপার?
গম্ভীর হয়ে শ্রীধর চৌধুরী বলেন, তখনকার মানিকগঞ্জে ওরকম হত।
সেসব যা হোক শ্রীধরবাবু ত্রিকালজ্ঞ মানুষ। অনেক কিছু জানেন, বোঝেন, খবর রাখেন। নানা রকমের ভাল ভাল দোষ আছে। এটা সেটা পান-ভোজন, এই বয়েসেও এদিকে ওদিকে যাতায়াত, এই সব আর কী!
সমীরণ হুঁকোর প্রসঙ্গ অনায়াসেই সর্বপ্রথমে শ্রীধরবাবুর কাছে তুলতে পারত কিন্তু এটা তার খেয়াল হয়নি।
একই অফিসে পাশের সেকশনে কাজ করেন শ্রীধর চৌধুরী। বয়েসের তফাত থাকলেও শ্রীধরের সঙ্গে অফিসের প্রায় সকলেরই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কাজ-টাজ বিশেষ কিছু করেন না, প্রায় সারাদিনই আড্ডা দিয়ে, গালগল্প করে কাটিয়ে দেন। সেদিন টিফিনের সময়ে ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিল সমীরণ। পাশের টেবিলে শ্রীধরবাবু জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সব সময় রসের গল্প তাঁর মুখে।
হঠাৎ বিচ্ছিন্নভাবে তামাক শব্দটা কানে আসতে সমীরণ একটু সতর্কভাবে শোনার চেষ্টা করল শ্রীধরবাবু কী বলছেন; ধোঁয়া, নেশা এসব শব্দও কানে গেল।..
ক্যান্টিনের জটলা ভাঙতে শ্রীধরবাবুকে একটু আলাদা করে সমীরণ জিজ্ঞাসা করলে, শ্রীধরদা টিফিনের সময় তামাক, ধোঁয়া এসবের কথা কী বলছিলেন। হুঁকোর ব্যাপার নাকি?
শ্রীধর বললেন। হুঁকো? হুঁকো শুনলে কেমন হাসি পায়। আমরা দেশে বলতাম হুক্কা, এটাই আসল আরবি শব্দ।
তারপর একটু থেমে বললেন, সাধারণ হুক্কা নয়। আমি বলছিলাম পঞ্চমুখী হুক্কার কথা, ওই যাকে বলে পাঁচরং। পাঁচ মুখে পাঁচটা কলকে, এক সঙ্গে তামাক, গাঁজা, ভাং, হাসিস, চরস। এক টানেই মাথা সাফ।
এতদিন হাজার চেষ্টা করেও একটা একমুখো হুঁকোর দেখা পায়নি সমীরণ আর এখন শুনছে পাঁচমুখো হুঁকোর কথা।
কোথায় দেখতে পাওয়া যাবে এই দুর্লভ বস্তুটিকে? শ্রীধরবাবুর কাছে সমীরণ জানতে চাইল।
শ্রীধর বললেন, এখন আর ও জিনিস কোথায় পাওয়া যাবে? ওসব সাবেকি দিনের জিনিস, সে কি আজকের কথা। পঞ্চরঙ খেতেন মাইকেল, বঙ্কিম, শরৎ চাটুজ্যে। কতকাল হয়ে গেল।
আবার সমীরণের নিরাশ হওয়ার পালা। তবু সে দায়ের খাতিরে জিজ্ঞাসা করল, কোও কি কেউ খায় না আজকাল?
শ্রীধর বললেন, খাবে না। আমাদের হরিই হুক্কা ছাড়া কিছু খায় না।
উত্তেজিত সমীরণ জিজ্ঞাসা করল, হরি? হরি কে? কোথায় থাকে?
শ্রীধর বললেন, হরি আমার পুরনো বন্ধু, ওল্ড চাম, মানিকগঞ্জ থেকে দুজনে একসঙ্গে এই শহরে আসি। এই তো কাছেই বউবাজারে থাকে।
সমীরণ বলল, আচ্ছা শ্রীধরদা একদিন আপনার ওই বন্ধুর ওখানে গিয়ে হুঁকো খাওয়া দেখতে পারি।
শ্রীধর বললেন, হুঁকো খাওয়া আবার দেখার কী আছে? তবে যেতে চাও চল। কবে যাবে?
মিড়নের কথা স্মরণ করে সমীরণ বলল, আমার সঙ্গে কিন্তু একজন থাকবে।
শ্রীধর বললেন, তাতেও আপত্তির কিছু নেই। এসব ক্ষেত্রে লোকে দল বেঁধেই আসে৷
শ্রীধরের কথায় একটু হেঁয়ালি লাগলেও তখনই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাকা করে ফেলল সমীরণ। সামনের শনিবার সেকেন্ড স্যাটারডে, অফিস ছুটি। সন্ধ্যা ছয়টার সময়ে বউবাজারের মোড়ে বহুদিনই বন্ধ হয়ে থাকা সিনেমাহলের গেটের সামনে সমীরণের জন্য শ্রীধরবাবু প্রতীক্ষা করবেন।
রাস্তায় রাস্তায় সাংঘাতিক যানজট। তবু একটা মিনিবাসে করে ছয়টা বাজার কয়েক মিনিটের মধ্যে মিড়নকে নিয়ে সমীরণ এসে দেখল শ্রীধরবাবু পঁড়িয়ে আছেন।
শ্রীধরবাবু সমীরণের সঙ্গে মিড়নকে দেখে একটু যেন বিব্রত হলেন। তিনি বোধহয় ভেবেছিলেন সমীরণের সমবয়সি কোনও বন্ধু আসবে।
সমীরণ মিড়নকে দেখিয়ে শ্রীধরবাবুকে বলল, আমার ছেলে।
শ্রীধর বললেন, বাবাজীবনকে সঙ্গে এনেছ তা কী আর করা যাবে, চলো।
কোথায় যাচ্ছে তারা? শ্রীধরবাবুর বাক্যভঙ্গি কেমন গোলমেলে মনে হল সমীরণের। তা হোক, এসে যখন গেছে হুঁকোটা মিড়নকে দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
মিড়নও বাবার হাত ধরে শ্রীধরবাবুর সঙ্গে সামনের একটা গলির মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে সমীরণকে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, সত্যি সত্যি হুঁকো দেখতে পাওয়া যাবে?
সমীরণের আগেই শ্রীধর জবাব দিলেন, হ্যাঁ, নিশ্চয় দেখতে পাবে। আর একটু এসো।
কিন্তু গলির মধ্যে ঢুকে সমীরণের কেমন খটকা লাগল। এটা কেমনতর জায়গা। দরজায় দরজায়, সিঁড়িতে রাস্তায় মেয়েরা মুখে রং মেখে হল্লা করছে, সিগারেট ফুকছে। এটা তো খারাপ পাড়া মনে হচ্ছে! এ কোথায় এল সে ছেলেকে নিয়ে! রাস্তায় দাঁড়ানো রমণীদের মধ্যেও কেউ কেউ মিড়নকে দেখে অবাক হচ্ছে, এইটুকু ছেলেকে নিয়ে কেউ তো এসব জায়গায় আসে না।
বাধ্য হয়ে থমকে গিয়ে সমীরণ শ্রীধরকে বলল, শ্রীধরদা এ কোথায় যাচ্ছি আমরা?
অমিত শ্রীধর বললেন, অস্বস্তি হলে চোখ বুজে চলে এসো। ওই তো মোড়ের বাড়ির দোতলায় হরিমতী থাকে।
অবাক হয়ে সমীরণ বলল, হরিমতী?
শ্রীধর বললেন, কাল হরির কথা বলছি না, সেই হরি, হরিমতী, আমার ওল্ড চাম। হরিই তো হুক্কা খায়। তারপর একটু থেমে সামনের দোতলায় জানলার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ওই দ্যাখো দোতলার জানলা দিয়ে তামাকের ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তামাক তো আজকাল সব জায়গায় পাওয়া যায় না, এই তামাক আমিই সপ্তাহে একদিন বরানগর বাজার থেকে এনে ওকে দিই।
দোতলার জানলায় সত্যিই ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। তামাকের গন্ধও একটু নাকে আসছে। সেই ধূমায়িত জানলার দিকে লক্ষ্য রেখে দরজায় দাঁড়ানো বিস্মিত কুলটাকুলের পাশ কাটিয়ে শ্রীধরের পিছু পিছু নয় বছরের ছেলের হাত ধরে জীবনে এই প্রথমবার নিষিদ্ধপল্লির কোনও গৃহে প্রবেশ করল সমীরণ।