2 of 3

হিপিরা এসেছিল

হিপিরা এসেছিল

কাল রাতের বুলেটিনে বি বি সি বলেছিল আজ আকাশ মেঘলা থাকবে। চাই কি, কয়েক পশলা বৃষ্টিও নামবে। অথচ সামার এসে গেছে ক্যালেন্ডারে। বছরের এই কটা মাস একটু হালকা হয়ে রোদ পোয়ানো, লিজা ঠিক থাকলে গাড়ি নিয়ে ব্ল্যাকপুলে চলে যাওয়ার মজা পাওয়া ববের অনেকদিনের অভ্যেস। কনকনে বাতাসটা নেই, টিপটিপ বৃষ্টি বন্ধ, বরফ পড়ছে না, তার বদলে চারধার সবুজে চমৎকার, ভরদুপুরে সোয়েটারের তোয়াক্কা করতে হয় না, এক-একদিন কী সুখের ঘাম বের হয় শরীর থেকে। কেডস হাফ প্যান্ট আর মোটা গেঞ্জি পরেও পার্কে গিয়ে বসা যায়। মানুষের শরীরটায় যাতে রোদ হাওয়া লাগে তাই তো ঈশ্বর সামার তৈরি করেছেন। মাস দুয়েক, তাই যথেষ্ট। সত্তর বছরের জীবনে যোগ করলে তা অনেক বছর। অথচ এবার মার্চ এসে। গেলেও সামারের চরিত্র আসছেনা প্রকৃতিতে।

বয়সের অনেক দোষ। কথা বলার ইচ্ছে বাড়ে অথচ লোক কমে যায়। এই গ্রামে তিনটে ক্লাব। আছে। একটু বড় ধরনের পাব আর কী। তা সেখানে রাত এগারোটা পর্যন্ত ছেলে-ছোঁকরাদের। ভিড়। বুড়োরা কেউ ধারে কাছে যায় না। বর্ষা বা শীতে তো কারও দেখাই পাওয়া যায় না। সামারে তবু পার্কগুলোর মুখোমুখি হওয়া যায়। জন অবশ্য তাঁকে বলে মাঝে-মাঝে ক্লাবে যেতে। এক বছরের ছোট কিন্তু এখনও টগবগে আছে। নইলে ক্লাব চালায় কী করে। বব জানেন ওখানে। গেলে তিনি স্বস্তি পাবেন না। না, ছেলেমেয়েগুলো টকাস-টকাস চুম খাচ্ছে কিংবা মদের ঘোরে এ ওকে জড়িয়ে ধরছে বলে নয়, ওদের দেখলেই নিজেকে খুব অশক্ত মনে হয়। শরীরের অনেক কিছুই হঠাৎ-হঠাৎ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। জনের ক্লাবে গেলে সেটা বড় বেশি মনে হয়।

কথা বলার মানুষ নেই। লিজার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বললেই ও চোখ বন্ধ করে হাত তোলে, ও বব, একটু চুপ করে থাকতে পারো না?ইন্ডিয়ান ফিলসফিতে বলে, যে চুপ করে থাকে সে বেশিদিন বাঁচে।

কি লাভ? বব জানেন লিজার প্রতিক্রিয়া হবে এবার। চুপচাপ উঠে যাবে। হাসি পায় ববের। যত বয়স হচ্ছে তত দুজনের মধ্যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছে। কেউ যেন কাউকে আগে মরতে দেবে না। প্রথমে যাওয়ার কৃতিত্বটা নিজেরই। কারণ যে পড়ে থাকবে তার অবস্থা অনুমানেও আনা যাচ্ছে না। অবশ্য এখন মরার মোটেই বাসনা নেই ববের। যে পৃথিবীতে সামার আসে, টিউলিপ ফোটে সেই পৃথিবীতে অনেকদিন থাকার ইচ্ছে তাঁর। এই খামার, এই ছবির মতো বাড়ি, লিজা, এই বসার ঘর, আরাম চেয়ারে আর রঙিন টিভিতে বি.বি.সি-র দুটো চ্যানেল। বিজ্ঞাপনসংস্থার সিরিয়ালগুলো–এসব ছেড়ে চট করে চলে গেলেই হল!

ঝটপট ব্রেকফাস্ট তৈরি করব ভেবেছিলেন বব। লিজা এখনও ওপরে। বয়স বাড়লে মেয়েদের ঘুম বাড়ে একথা জানতেন না। ঘুম বাড়ে আর খিটখিটে হয়ে যায়। অটোমেটিক কেটলির সুইচ অন করে বেসিনের কাছে আসতেই তাঁর বিরক্তি বাড়ল। কাল রাতের ডিনার প্লেট তিনি ধুয়ে। গিয়েছিলেন কিন্তু কারির বাটিগুলো বেসিনে রেখে জলে ভিজিয়ে চলে গেছে লিজা। খুব বেশি ঘুম পেয়েছিল, নাকি জানে ভোরে বব আসবে কিচেনে! নোংরা ফেলে রাখতে পারলেন না বব। শীত। হলে গ্লাভস পরতে হত। এখন গরম জলের কল খুলে সব ধুয়ে পরিপাটি করে রেখে ডিমের পোচ আর দুটো রুটি সেঁকে নিলেন। একবার মনে হল অ্যাপল পাই উইদ হট ক্রিম নেবেন নাকি সঙ্গে? আজকাল বড় খেতে ইচ্ছে করে তাঁর! কিন্তু সেদিন উইল বলল, নো বব, আমাদের এখন খাওয়া কমানো উচিত। যা কিছু এতদিন ভালো ছিল তাই এখন শরীরটাকে খারাপ করার জন্যে নখ বের করে বসে আছে। উইলি অনেকদিন লন্ডনে ডাক্তারি করেছে। এখন গ্রামে ফিরে এসে সেসব। পাটে তুলে দিয়েছে। তবু দেখা হলে ওসব উপদেশ দিতে কার্পণ্য করে না। চা ডিম আর রুটি নিয়ে বব কিচেন থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে চলে এসে ট্রেটা টেবিলে রাখলেন। তারপর জানলার পরদা সরিয়ে কাঁচের আড়ালে আকাশে তাকালেন। রোদের কোনও লক্ষণই নেই অথচ ঘড়িতে এখন সাড়ে আটটা। সূর্য ওঠার সময় অন্তত আড়াইঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। বাগানটায় ঘন ছায়া জড়ানো। এবার আগাছাগুলোকে হাত দেওয়া দরকার। কিন্তু একটু রোদের জন্যে অপেক্ষা করছেন তিনি।

খুব মন দিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করলেন বব। তারপর প্লেটগুলো বেসিনে নিয়ে গিয়ে ভালো করে ধুয়ে আবার আরামকেদারায় ফিরে এলেন। লিজার সাড়া এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। কাল রাত্রে লিজা বলছিল এবার মাদার্স ডে-তে টেড আসতে পারে। দু-বছর আসেনি কেউ। এবার মাদার্স ডে-তে টেলিগ্রামের বদলে যদি ও আসে তো ভালো। নিশ্চয়ই বউ মেয়ে নিয়ে আসবে না। টেডের মেয়ে, একমাত্র নাতনি ডেফনি আছে ম্যাঞ্চেস্টারে। সে তো এ তল্লাটে আসেই না। সিঙ্গল মাদার হয়েছে জানার পর লিজা একদিন গিয়ে দেখে এসেছিল তাকে। ফিরে এসে বলেছিল ডেফনি। নাকি খুব গর্বিত। এসব ভাবনা বড় অন্যমনস্ক করে দেয় ববকে। এগিয়ে গিয়ে টিভি খুললেন তিনি। বি বি সি-ওয়ান ওয়েদার ফোরকাস্ট করছে লিখে-লিখে। সারাদিন মেঘলা থাকবে তবে বিকেলের দিকে আকাশ পরিষ্কার হতে পারে। কেন যে বিকেলে আকাশ পরিষ্কার হয়! কি লাভ তাতে? অন্য চ্যানেলগুলোতে এখন তেমন কিছু হচ্ছে না। সকালবেলায় বাচ্চাদের পড়াশুনা নিয়ে থাকে টিভির চ্যানেলগুলো। গ্রানাডা খুললেও কোনও লাভ হবে না। বৃষ্টি পড়লে অথবা কোনও কাজ হাতে না থাকলে বব এই আরামকেদারায় বসে বি বি সি-র বদলে গ্রানাডার দিকেই তাকিয়ে থাকেন। ওদের বিজ্ঞাপনের ছবিগুলো বেশ মজার হয়। আগে ব্রিটিশ টিভির বেশ কনজারভেটিভ মানসকিতা কাজ করত টেলিকাস্টের ব্যাপারে। আমেরিকানদের মতো মেয়েদের শরীর দেখাত না ওরা। মাঝে-মাঝে রাত বাড়লে ওভার এইট্রিন-এ যেসব ছবি আসত তাতে সেক্স নেই বললেই চলে। মহিলা প্রধানমন্ত্রী নানান কাজকর্ম করেছেন বলে শুনেছেন বব। লন্ডনের। সোহো থেকে রাস্তার মেয়েদের প্রায় তুলে দিয়েছেন বললেই চলে। কিন্তু টিভিকে অপার ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন। গতরাত্রেই যে ছবিটা তাঁরা দেখেছেন দশ বছর আগে তা টিভিতে ভাবা যেত না। লিজা আর তিনি ডিনারের পর পাশাপাশি বসে টিভি দেখছিলেন। বিজ্ঞাপনের পর একটি সজ্জা সিরিয়াল শুরু হল। মডেল মেয়েটিকে চার-পাঁচজন ক্যামেরাম্যান বিভিন্ন ভঙ্গিতে বসিয়ে। ছবি তুলছে। ক্রমশ মেয়েটির ওপরের পোশাক খুলে ছবি তুলল ওরা। কিন্তু সে ব্যাপারে একজন অল্পবয়স্ক ক্যামেরাম্যান নার্ভাস হয়ে পড়ায় পোড়-খাওয়া আর একজন বিভিন্নরকম লাস্যময়ী ছবি তুলতে-তুলতে মেয়েটিকে আরও নগ্ন হওয়ার অথচ সামান্য আবরণ রাখার ইঙ্গিত করতেই মেয়েটি খেপে গেল। সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ওই ধাষ্টামির বিরুদ্ধে গালাগাল দিতে লাগল। এই দৃশ্য দেখামাত্রই লিজা উঠে গেল ওপরে। বব-এরও অত্যন্ত অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু যাওয়ার আগে যখন লিজা রাবিশ বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল তখন তিনি বলে ফেললেন, কোনও-কোনও ছবি আন্ডার এইটিন এবং অ্যাবাভ সিক্সটির মেয়েদের দেখতে নেই।নেহাতই রসিকতা কিন্তু শোওয়ার ঘরে পৌঁছে দেখেন লিজা ঘুমিয়ে পড়েছে। এটা তাঁর ওপরে অভিমান থেকেই বুঝতে অসুবিধে হয়নি। আজকাল সময় কাটানোর অদ্ভুত ভালো বন্ধু টিভি! বব-এর অবশ্য এইসব ছবি মন্দ লাগে না। কেমন একটা নস্ট্যালজিক ফিলিংস হয়।

বোতাম টিপে চ্যানেল ঘোরাতেই খবর পড়া শুরু হল। যে মেয়েটি এই সময় পড়ে সে সত্যিই সুন্দরী। মুখখানা যদিও বড় কিন্তু অদ্ভুত আদুরে ভঙ্গি আছে চোখের পাতায়, ঠোঁটের কোণে। শিক্ষা দপ্তরের নবনিযুক্ত সেক্রেটারি একটা প্রাইমারি স্কুলে হাজির হয়েছেন সাতসকালে। হিথরো এয়ারপোর্টে গত রাতে সত্তর হাজার পাউন্ডের মাদকদ্রব্য ধরা পড়েছে। তারপরেই পাঠিকা বললেন, হিপিস আর কামিং।

বব দেখলেন হাইওয়ে দিয়ে একটা বিশাল কনভয় যাচ্ছে। ধারাভাষ্যকার জানাচ্ছেন আড়াই হাজার হিপি তাদের ক্যারাভান এবং গাড়ি নিয়ে ইংলন্ডের শেষ প্রান্তে চলেছে। এইসব হিপিদের মধ্যে যুবক-যুবতী এবং শিশুও আছে। পুলিশ তাদের রুট বদলাতে বললে তারা হাইওয়ে বন্ধ করে দেয় গাড়ি দিয়ে। ফলে হাজার-হাজার গাড়ি জ্যামে পড়ে যায়। পুলিশের সঙ্গে হিপিদের আলোচনা চলছে। হিপিরা কোনওভাবেই রুট বদলাতে রাজি নয়। পুলিশ এই মিছিলকে বেআইনি ঘোষণা করতে চলেছে। হিপিরা তাদের বক্তব্য থেকে সরতে মোটেই রাজি নয়।

বব সোজা হয়ে বসলেন। দাড়িওয়ালা নোংরা পোশাকের একটি হিপি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলছিল, রুট বদলালে আমাদের পেট্রল থাকবে না, খাবার থাকবে না। এমনিতেই খুব টাকার অভাবে আছি আমরা। আমি ভেবে পাই না সাধারণ মানুষ কেন আমাদের বন্ধু বলে ভাবে না। পুলিশের কর্তা তাদের আধঘণ্টা সময় দিয়েছেন।

হিপিগুলোকে দেখামাত্র ববের শরীরে অস্বস্তি শুরু হল। কোনও-কোনও হিপি আবার পাঙ্কদের মতো খোঁচাছাঁট চুলে রং বুলিয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব বলে মনে হচ্ছিল ববের। ওরা আছে এই গ্রাম থেকে একশো মাইল উত্তরে। ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিজেদের রুটে চললে ওদের। দেখতে হবে না। বব ভেবে পাচ্ছিলেন না পুলিশ কেন ওদের এত খাতির করছে! নিশ্চয়ই বেকারভাতা হিসেবে ষাট পাউন্ড ডোল পায় ওরা। ষাট পাউন্ড ফালতু পেলে গাঁজা কিংবা ট্যাবলেট খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে একটা সপ্তাহ। তার মনে হল এখনই খবরের কাগজে একটা চিঠি লেখা উচিত। বব উঠে তাঁর লেখার কাগজ এনে বসলেন। টেলিগ্রাফের সম্পাদককে তিনি লিখলেন, ব্রিটেনের একজন নাগরিক হিসেবে তিনি এবং তাঁর মতো যাঁরা নিয়মিত ট্যাক্স। দিয়ে থাকেন তাঁদের নিশ্চয়ই জানবার অধিকার আছে কেন তাঁদের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায়। হিপিদের পোষা হচ্ছে। ওরা কেন বেকার ভাতা পায়। এরা যদি সবাই জন্মসূত্রে ব্রিটিশ হয়েও থাকে তাহলে সেই অধিকার অবিলম্বে কেড়ে নিয়ে ওদের এমন একটা দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত যেখান থেকে কখনই সভ্যজগতে ফিরে আসতে পারবে না। পুলিশ যে কেন ওদের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের সম্মান দিয়ে ব্যবহার করছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না।

চিঠিটা শেষ করে খামে পুরে উঠে দাঁড়াতেই লিজা ঘরে ঢুকলেন, গুড মর্নিং।

বব সেটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি তো খুব ঘুমাচ্ছ, এদিকে হিপিরা রাস্তা জুড়ে বসে আছে।

হিপি? কোথায়? এখানে? আমাদের গ্রামে? লিজা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

আঃ। এখানে হতে যাবে কেন? বেশবিরক্ত হলেন, এমন অলক্ষুণে কথায়, ওরা হাইওয়েতে আছে। একশো মাইল উত্তরে। এদিকে আসবে কেন ওরা? ও হ্যাঁ, তুমি কারির বাটিগুলো কাল রাত্রে ধুয়ে যাওনি। অথচ এখানে বসে টিভি দেখলে। তোমার চেয়ে আমি পাঁচ বছরের বড়। অথচ আমাকে সব কাজ করতে হচ্ছে। এটা ভালো কথা নয়।

লিজা বললেন, পাঁচ নয় চার। বব, তোমার আকজাল হিসেবের খুব ভুল হয়ে যাচ্ছে।

কী করে হল, যখন তোমাকে বিয়ে করেছিলাম তখন আমার বয়স ছিল বাইশ আর তুমি সতেরো!

তুমি বিয়ে করনি, আমরা করেছিলাম। তোমার বয়স তখন একুশ। কত বছর বিয়ে হয়েছে। একবার গুনে দ্যাখো। বড় বাজে কথা বলো তুমি। হ্যাঁ, হিপিদের কথা তোমাকে কে বলল? লিজা কিচেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

টেলিভিশন। তুমি তো কখনও নিউজ শুনতে সময় পাও না। পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে তার খবর রাখো? চোখ বুজে পৃথিবীতে বেঁচে আছ কি করে তুমিই জানো। বব দেখলেন টিভি-তে এবার খেলার খবর দেখাচ্ছে। মেক্সিকোয় ইংল্যান্ড খুব দুরবস্থায় আছে। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল রাউন্ডে উঠতে পারে কিনা সন্দেহ। নর্দান আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড-এর অবস্থা তো আরও শোচনীয়। ব্রিটেনের খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। বব মগ্ন হয়ে গেলেন গতরাত্রে কেন ইংল্যান্ড হারল তার ব্যাখ্যা শুনতে।

লিজা তাঁর ব্রেকফাস্ট তৈরি করে এসে উলটোদিকের টেবিলে বসলেন। বৃদ্ধা হলেও তাঁর মুখ চোখে তেমন আঁচড় পড়েনি। যদিও শরীরের চামড়া ঢিলে হয়েছে, চশমার শক্তি বেড়েছে আর বেশিক্ষণ হাঁটলে বড় হাঁফ ধরে। কিছুক্ষণ টিভির দিকে তাকিয়ে থেকে লিজা বুঝতে পারছিলেন না ও নিয়ে এত মাতামাতি করার কী আছে। আজকাল ক্রিকেট টিম তো খেলতে নামলেই হেরে যাচ্ছে অথচ তাতে কারও দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। অথচ ফুটবলে হারলেই গেল-গেল রব উঠছে। বব

তো জীবনে ফুটবল মাঠে যায়নি, কিন্তু দ্যাখো, এমন মুখ করে বসে আছে যেন ওই টিমের কোচ। লিজা জিজ্ঞাসা করলেন, এই হিপিগুলোকে দেখতে কেমন?

বব হাত তুলে কথা বলতে নিষেধ করলেন।

লিজা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, রাবিশ!

বব বললেন, যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। এত টাকা খরচ করে টিম করা হল আর একটা ড্র একটা হেরে বসে আছে। এটা আমাদের জাতীয় অপমান।

হিপিরা কেমন দেখতে?

হিপিদের মতন। বব অন্যমনস্ক গলায় জবাব দিলেন।

আঃ বব! লিজা চোখ বন্ধ করতে টিভির পর্দায় আবার হাইওয়ের ছবি ফুটে উঠল। বব বললেন, আবার দেখাচ্ছে। এত গুরুত্ব দিচ্ছে কেন ওরা?

লিজা চোখ খুললেন।  ছেঁড়া জিনসের প্যান্ট জ্যাকেট পরা দাড়ি-মুখো একটা লোক টিভির প্রতিনিধিকে বলছে, পুলিশ আমাদের বলছে রুট পালটাতে। কিন্তু আমাদের যা টাকা আছে তাতে ঘুরপথে তেল যা লাগবে কিনতে পারব না। তা ছাড়া হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার অধিকার আছে আমাদের, তাই না?

পুলিশ অফিসার বললেন, এই হাইওয়ে সবসময় খুব বিজি থাকে। হিপিরা তাদের ক্যারাভান নিয়ে যেভাবে যাচ্ছে তাতে রাস্তা আটকে থাকছে। ওরা যেখানে ইচ্ছে সেখানে থেমে আরও

সমস্যা তৈরি করছে। আমরা ওদের আটকাতে চাইছি না, শুধু বলছি যাওয়ার পথটা পালটাতে। যে সময় দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ওরা যদি কথা না শোনে তাহলে অ্যাকশন নিতে বাধ্য হব।

বব বললেন, বেশি ভদ্রতা করে আমাদের জাতটা শেষ হয়ে গেল।

লিজা বললেন, ওরা এত কষ্ট করে কেন? চাকরি-বাকরি করে ভালোভাবে বাঁচতে পারে তো!

আহা দ্যাখো-দ্যখো, দুধের বাচ্চাটার পায়ে মোজা পর্যন্ত নেই। ইস!

বব উঠে পড়লেন, আর ইস টিস বলতে হবে না। ক্যারাভান অফ বাস্টার্ডস। হিপিরা কেমন দেখতে জিজ্ঞাসা করেছিলে না? এখন প্রাণভরে দেখে নাও। আমি একটু ঘুরে আসছি।

এই ওয়েদারে বাইরে যেতেই হবে? কার্পেটগুলো পরিষ্কার করার কথা ছিল আজ।

চিঠি পোস্ট করতে যাচ্ছি। ওটা আরও জরুরি।

মর্নিং জ্যাকেটটা পরার পর ছাতা নিলেন বব। তারপর দরজা টেনে দিয়ে বাইরে এসে চারপাশে তাকালেন। রাস্তাঘাটে লোকজন নেই। ববের বাড়িটা গ্রামের একপাশে। ঠিক উলটোদিকে টেডের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স। তার পাশে নতুন জামাপ্যান্টের দোকান খুলেছে ওস্কার নামের একটা ছোঁকরা। বব আকাশের দিকে তাকালেন। এখনই বৃষ্টি নামবে মনে হয় না। রাস্তাটা পার হয়ে তিনি টেডের দোকানে ঢুকলেন। দুটো মেয়ে কাজ করে এখানে। টেড শুধু ঘুরে-ঘুরে দ্যাখে। বুড়ি আর্নল্ড তখন জিনিসপত্র ট্রলিতে নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে আসছিলেন। ববকে দেখে। বললেন, কি দিন এল বব! সামার বলে একে?ভগবানের কি ইচ্ছে বলো তো?

বব মাথা নাড়লেন, এ কথাই আমি ভাবছিলাম।

ভাববেই তো। আমাদের যাদের বয়স হয়েছে তারা তো এই সময়টুকুর জন্যে হাঁ করে বসে থাকি। ববের কথাটা খারাপ লাগল। অন্তত কুড়ি বছর তিনি মিসেস আর্নল্ডকে এই চেহারায় দেখে আসছেন। লোকে আর মিসেস বলে না এখন। বুড়ি আর্নল্ড আজ তাকেও নিজের দলে টানল! তিনি তো অত বৃদ্ধ হননি। দাম মিটিয়ে জিনিসপত্র ব্যাগে ঝুলিয়ে বুড়ি আর্নল্ড জিজ্ঞাসা করলেন, লিজা কেমন আছে? অনেকদিন দেখিনি মেয়েটাকে। তোমাদের নাতনি শুনলাম সিঙ্গল লাইফ কাটাচ্ছে? লিজাকে বলো তো একদিন আসতে, ওর কাছে গল্প শুনব।

টেড এল। ঠান্ডা গলায় বলল, হ্যালো বব। দিনটার চেহারা দেখেছ? সামারের অবস্থা যদি এইরকম হয় তাহলে বেঁচে থাকার কোনও মানে থাকে না। চললে কোথায়?

চিঠিটা পোস্ট করব বলে বেরিয়েছিলাম। আজ টিভিতে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। হিপিরা ক্যারাভান নিয়ে হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস পথটা আমাদের গ্রামের উলটোদিকে। কি চেহারা, ভয়ঙ্কর। আর পুলিশের অবস্থা দ্যাখো, ওদের তোয়াজ করছে। বব উষ্ণ গলায় খবরটা দিলেন। অথচ টেডের এদিকে মনই নেই। তার চোখ কাউন্টারে বসা একটি মেয়ের দিকে। সে ফোনে হেসে-হেসে কথা বলছে। টেড বলল, আজকালকার মেয়েরা প্রেমের অর্ধেকটা টেলিফোনেই শেষ করে দেয়। তুমি বেশ আছ বব। কাজকর্ম তেমন করতে হয় না, টিভি দেখে বেশ সময় কাটিয়ে দিচ্ছ।

একটু বিরক্ত হয়েই বব দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন। টেডের সঙ্গে আজকাল বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না। সব সময় অন্যদের সুখী দ্যাখে ও। ওই সময় কানে এল ওস্কার তাকে ডাকছে, হ্যালো বব, চললে কোথায়?

ওস্কারের মুখের দিকে তাকালেন বব। ছোঁকরা কথা বলার সময় এমন একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখে যে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, হ্যালো ওস্কার। তারপর আর কথা না বলে পা বাড়ালেন। গ্রামটা মোটামুটি একটি রাস্তার দু-ধারে বাড়িঘর নিয়ে। বাইলেনগুলো আছে কিন্তু সে দিকটা জমাটি নয়। পোস্টঅফিসে যাওয়ার পথেই তিনটে ক্লাব কাম পাব। জনের ক্লাব। এখন বন্ধ। নির্ঘাত ঘুমাচ্ছে সে। শনি রবি তো রাস্তায় লোক থাকেই না বলতে গেলে। রাত তিনটে পর্যন্ত ক্লাবে-ক্লাবে হইচই করলে কি পরের দিন জেগে থাকা যায়?

ঝকঝকে পিচের রাস্তার দুপাশে দোতলা বাড়িগুলো। বব জন্মইস্তক এমন দ্যাখেনি। বাড়িগুলো পরে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু মানুষ আসেনি পাকাঁপাকি বাইরে থেকে থাকতে। তবে দুটো ব্যাঙ্কে কাজ করতে যারা বদলি হয়ে আসে অথবা অন্য সরকারি অফিসগুলোতে যারা কাজের জন্যে এসেছে তাদের কথা আলাদা। এই গ্রামের যাবতীয় ব্যাবসা গ্রামের মানুষেরাই করে থাকে। এদের প্রত্যেককেই তিনি চেনেন। হ্যালো বব।

বব ঘুরে দাঁড়ালেন। ওপরের জানলায় ঝুঁকে মেয়েটা তাকে ডাকছে, কাম হিয়ার।

বব একটু ইতস্তত করলেন। চিঠিটা পোস্ট করা দরকার। নইলে বিকেলেও লন্ডনে পৌঁছাবে না। তিনি হাত নাড়লেন, আমি আসছি, অ্যান। একটা জরুরি চিঠি পোস্ট করার আছে।

পোস্ট অফিসে গিয়ে বাক্সে নয়, একদম মিস্টার জোন্সের হাতে খামটা দিলেন বব। মিস্টার জোন্স খুব ঠান্ডা লোক। ব্ল্যাকপুলের দিকে বাড়ি। লাল দাড়ি সুন্দর করে ছাঁটেন। চিঠিতে ছাপ। মেরে মিস্টার জোন্স বললেন, একটা খবর দিচ্ছি বব। আমাকে ট্রান্সফার করেছে। ম্যাঞ্চেস্টারে জয়েন করতে হবে কাল। ইনি হচ্ছেন তোমাদের নতুন পোস্টমাস্টার মি:হ্যারল্ড স্মিথ।

উলটোদিকের চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে একটা ছোঁকরা পাইপ খাচ্ছিল। মিস্টার জোন্স তাকে বললেন, মিট মিস্টার রবার্ট। এখানকার পুরনো মানুষ।

আলাপ করে খুশি হলাম। মিস্টার স্মিথ বলল, কিন্তু জোন্স তুমি এখানে তিন বছর থাকলে কি করে? একটা ভালো ক্লাব নেই, ফুর্তি করার জায়গা নেই।

মিস্টার জোন্স বললেন, এঁরা ছিলেন তাই ওসবের দরকার হয়নি।

বব বললেন, জোন্স, তুমি চলে যাচ্ছ বলে খারাপ লাগছে। পৃথিবীর নিয়মটাই হল ভালোমানুষরা বেশিদিন থাকে না। আমার ঠিকানা তো তুমি জানো, মাঝে-মাঝে চিঠি দিলে খুশি হব।

বাইরে বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে তাকালেন বব। মেঘ নেমে এসেছে নিচে। একটা ছোঁকরাকে ওরা পোস্টমাস্টার করে পাঠাল? ছোঁকরা এখানে এসেই নালিশ করছে ফুর্তি করার জায়গা না পেয়ে! বিয়ে-থা করেছে কিনা কে জানে। যদি উলটোপালটা কাজ করে তাহলে আবার চিঠি লিখতে হবে। ব্রিটিশ সরকার এখনও অভিযোগ করলে বিচার করে।

ওপাশে একটা ক্যাসিনো। জুয়ো খেলার একটা চমৎকার আড্ডা। তবে আঠারো বছরের নিচের ছেলেদের ওখানে ঢোকা নিষেধ। বব নিজেও মেম্বার। কিন্তু হেরে যাওয়ার মতো পয়সা নেই বলে তিনি সচরাচর যান না। বব দেখলেন ক্যাসিনোর দরজা খোলা। একটু বিস্মিত হলেন তিনি। আজ সারা গ্রাম যখন রাত জেগে ঘুমাচ্ছে তখন ক্যাসিনো কি করে খোলা থাকছে? সিঁড়ি ভেঙে দরজা ডিঙিয়ে ঢুকতেই ম্যাথুজকে দেখতে পেলেন। ম্যাথুজ এখানকার একজন ডোরম্যান। এই গ্রামে এটা একটা লোভনীয় চাকরি। পাব কাম ক্লাব, রেস্টুরেন্ট এবং ক্যাসিনোর জন্য ডোরম্যানদের রাখা হয়। কিছু ছেলে যাদের স্বাস্থ্য ভালো, নিয়মিত শরীরচর্চা করে, তারা বক্সিং শিখে নিয়ে এই চাকরিতে যোগ দেয়। ডোরমেন অ্যাসোসিয়েশন আছে একটা, তারাই জোগান দেয়। কিন্তু। যেহেতু ওদের চাকরির জায়গা কম তাই বেচারাদের অন্য গ্রামে যেতে হয়। ম্যাথুজ মাথা নাড়ল, গুড মর্নিং বব।

বব জিজ্ঞাসা করলেন, আজ তোমাদের খোলা?

ম্যাথুজ হাসল, মিসেস হোমস সব সময় খোলা রাখতে পারলে খুশি হন।

খাতায় সই করে ভেতরে ঢুকলেন বব। পুরো ক্যাসিনো ফাঁকা। তিনটে মেয়ে একটা জায়গায় বসে গল্প করছে। আঠারো থেকে কুড়ি ওদের বয়স। বাপ-মাকে তিনি নিশ্চয়ই চিনবেন। ওঁকে দেখে একটি কালো মোটা মেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি খেলবে তুমি?

বব চারপাশে তাকালেন। ওপাশে একটা ডিস্ক ঘুরছে। তার পাশেই লম্বা বোর্ডে ঘর কাটা। প্রত্যেক ঘরে একটা করে নম্বর। সেই নম্বরের একটায় পেনি কিংবা পাউন্ড রাখলে মেয়েটা গিয়ে ডিস্কের মধ্যে একটা সীসের বল ফেলে দেবে। ঘুরতে-ঘুরতে বলটা ডিস্কের সঙ্গে যেখানে থামবে সেখানে একটা নম্বর পাওয়া যাবে। সেই নম্বরের সঙ্গে বোর্ডের নম্বর যদি মেলে এবং তাতেই। তোমার পয়সা থাকে, তাহলে তুমি নম্বর অনুযায়ী কয়েকগুণ বেশি ফেরত পাবে। তার পাশে। কয়েন বক্সে পয়সা ফেলে হাতল ঘোরালে যদি একই নম্বর পাশাপাশি তিনটে ওঠে তাহলে দশ পেনিতে আড়াই পাউন্ড পেতে পারো। এদিকে একটা রেসবোর্ড আছে। দশটা প্লাস্টিকের ঘোড়া নিজেদের ট্রাকে সুইচ টিপলে দৌড়ায়। তোমাকে একটায় দশ পেনি বাজি ধরতে হবে। যত নম্বর ঘোড়া প্রথম উইনিং পোস্ট ছোঁবে ততগুণ পয়সা পাবে ফেরত। বব হিসেব করে দেখেছেন। একশো পাউন্ড খেললে পাঁচ পাউন্ড ফেরত পাওয়া যায়। তবু লোকে খেলে। একবার হারতে আরম্ভ করলে আরও নেশা চেপে যায়। এই সময় বার কাউন্টার থেকে মিসেস হোমস চেঁচিয়ে বললেন, হাই বব! হোয়াট এ সারপ্রাইজ! তুমি তো জুয়ো খেলার পাত্র নও। এখানে চলে এসো।

বব সেদিকে এগিয়ে যেতে-যেতে দেখলেন মিসেস হোমসের চোখমুখ এখনও ফোলা। বোঝা যাচ্ছে সবে ঘুম থেকে উঠেছেন। বেশ মোটাসোটা হয়ে পড়েছেন এখন। লিজারই বয়সি কিন্তু অনেক চটপটে। এক সময়ে এই গ্রামের সেরা সুন্দরী ছিলেন। সেসব সোনার দিন ছিল। হোমসটা ছিল বদমেজাজি। এই ক্যাসিনো করে গোল্লায় গিয়েছিল। ও মরতে যখন মিসেস হোমস দায়িত্ব নিলেন তখনই চব্বিশ পেরিয়েছেন। তারপর থেকে ক্যাসিনোটা স্টেডি চলছে।

ফাঁকা ক্যাসিনো, বার আরও ফাঁকা। একা মিসেস হোমস পা ছড়িয়ে বসে টিভি দেখছেন। বব যেতেই একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন, আকাশের অবস্থা দেখেছ? একেই কি সামার বলে?

বব বসতেই দেখতে পেলেন মোটা শরীরে ফুলতোলা যে রঙিন গাউন পরেছেন মিসেস হোমস তার বুকের কাছটা আজকালকার মেয়েদের মতো কাটা। সেটা ববের চোখে পড়েছে দেখে। মিসেস হোমস বললেন, আবার উপদেশ দিও না। ঘরোয়া হয়ে বসো। এককালে তোমরা, তুমি আমার দিকে হাঁ করে তাকাতে, বিলের জন্যে ঘেঁষতে পারোনি, মনে আছে?

সেসব কথা মনে করে কি লাভ?

যাই বলো বাপু, আমার মনে করতে ভালো লাগে। তোমাকে দেখেই আমার ভালো লাগল।

আচ্ছা আমি না হয় বুড়ি হয়েছি তাই বলে একটু চুমু আশা করতে পারি না?

বব উঠে ঝুঁকে মিসেস হোমসের গালে একটা চুমু খেয়ে ফের ফিরে বসলেন। মিসেস হোমস গলা তুলে বললেন, ম্যাগি, ববের জন্যে একটা জিন উইদ টনিক দাও।

না-না, এই সকালে–।

আঃরাখো তো! বব, তুমি চিরকালই ভিজে রয়ে গেলে। ইটস অন মি।

কালো মেয়েটা অকারণে হেসে কাউন্টারে ঢুকে মদ ঢালতে লাগল। এই একটা ব্যাপার হয়েছে। এখন ইংলন্ডের আনাচে-কানাচে কালো ছেলেমেয়ে ছেয়ে গেছে। বব শুনেছেন ছেলেগুলোর বেশির ভাগ পড়তে এসে থেকে যায়। আর ওদের ওপর নাকি ব্রিটিশ মেয়েদের প্রচণ্ড টান। কালোগুলোর মতো ডিস্কো নাকি সাদা ছেলেরা নাচতে পারে না। রাবিশ।

জিন উইদ টনিক হাতে নিয়ে বব বললেন, তুমি কালো মেয়ে রেখেছ?

আঃবব। যুগ পালটেছে। এখন যেসব ছোঁড়া এখানে খেলতে আসে তারা ম্যাগিকে বেশি পছন্দ করে। ওরকম বেঢপ হিপ আর ব্রেস্ট নিয়ে যখন তখন তো আর কেউ হাসতে পারে না। দিন। পালটাচ্ছে বব। উই মাস্ট অ্যাকসেপ্ট দ্যাট। মিসেস হোমস শরীরটাকে তুলে এগিয়ে গিয়ে। ক্যাসিনোটা দেখতে লাগলেন, কাল খুব ভালো বিজনেস হয়েছে। চারটে পর্যন্ত লোক ভরতি ছিল। এখন আমার টাকা-পয়সার অভাব নেই বব কিন্তু শরীরটার দিকে তাকালেই বুকের ভেতরটা জ্বলে যায়। খাওয়া ছাড়া কোনও আরাম আমার জন্যে নেই, ভাবতে পারো? সেক্স-এর কথা বলছি না, একটা পুরুষমানুষকে মনের মতো ভালোবাসার কথা ভাবলেই ঘুম পেয়ে যায়। আমার অবস্থাটা বোঝো বব। কি জন্যে বেঁচে আছি? কি হবে টাকা জমিয়ে?

গ্লাস শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন বব, মনটাকে ঝেড়ে ফেল। তোমাকে দেখতে এখনও যে। আমাদের ভালো লাগে, আমরা যে আসি এটা কম কথা নয়। ষাট বছর পর্যন্ত মানুষ নিজের জন্যে বেঁচে থাকে, তারপর বাঁচতে হয় অন্যের জন্যে। বাই মিসেস হোমস।

বাই বব।

আবার রাস্তায় নামলেন বব। আজ আর রোদ উঠবে না। নির্জন রাস্তায় একা-একা হাঁটছিলেন তিনি। আজ একবার গাড়ি নিয়ে বেরুতে হবে। হাইওয়ের ধারে বাগানটায় এই সপ্তাহে যাওয়া হয়নি। একটু আগে শোনা কথাগুলো মনের মধ্যে এখনও টলটল করছে। নিজের উত্তরটাও। তিনি কার জন্যে বেঁচে আছেন? অন্যজন কে? লিজা? তিনি না থাকলেও লিজার ঘুমের অসুবিধে হবে না, আর্থিক অভাব হবে না। এখন রাত্রে শোওয়ার আগে অথবা মেজাজ ভালো থাকলে। কোথাও বেরুবার আগে লিজা ওঁকে চুমু দিয়ে যায়। কোনওদিন বলেননি তিনি। করমর্দনে যে উত্তাপ তা চুম্বনেও পান না এখন। ঠোঁটে ঠোঁট ঘষলে শরীরের কোথাও উত্তেজনা জন্মায় না। বুকের ভেতর কোনও বল ড্রপ খায় না। শরীরের মধ্যে যে শরীর পনেরো বছর বয়সে জেগে উঠেছিল সে কবরে শুয়েছে কবে, শুয়ে মাটি হয়ে গিয়েছে। মিসেস হোমসের তবু খেতে ভালো লাগে তাঁর তো তাও লাগে না। এখন শুধু দেখার জন্যে বেঁচে থাকা। এই গ্রামের মানুষ, বাড়িঘর, প্রকৃতি যা আজন্ম দেখে এসেছেন তাই রোজ চেয়ে-চেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। যেন তিনি বেঁচে থাকা পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকে।

হাঁটতে-হাঁটতে তিনি টু-লেট ঝোলানো বাড়িটার সামনে দাঁড়ালেন। অ্যানরা ওদের নিচের ঘরটা ভাড়া দিতে চায়। এখন অফিস ব্যাঙ্কের দৌলতে ভাড়াটে পেতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হবে না। বব কাঠের সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে বেল টিপলেন। দরজা খুলে অ্যান ঠোঁট ফোলালো, না, তোমার সঙ্গে কথা বলব না। আমি ডাকলে সমস্ত গ্রাম ছুটে আসে আর তোমার সময় হয় না। এসো, খুব জরুরি পরামর্শ আছে।

বব হাসলেন, আমার কাছে সুন্দরী নারী আর ফুলের মধ্যে কোনও তফাত নেই।

খুব কথা শিখেছ। অ্যান ওঁর হাত ধরে এসে সোফায় বসাল। তারপর একবার ভেতরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, মা ঘুমোচ্ছে। আচ্ছা বুড়োরা এত ঘুমায় কেন বলো তো?

ঘুমোয় না, ঘুমের ভান করে। এটাই কি তোমার সমস্যা?

না-না। শোনো, সাইমনকে ডিভোর্স করার পর ঠিক করেছিলাম এখন তিন বছর আর কোনও পুরুষকে পাত্তা দেব না। গ্রামে ফিরে এসে মাকে সাহায্য করছি জমিজমার ব্যাপারে। কিন্তু তুমি তো জানো কেন্ট ছেলেটা কি ভালো। অত ভালো ছেলে চাইলে কি প্রেম না দিয়ে পারা যায়? চারমাস পরে আমরা বিয়ে করব। তুমি এমন করে তাকিয়ে আছ যেন কিছু জানোনা! চোখ ছোট করল অ্যান।

জানি। কেন্ট চমৎকার ছেলে। চাষবাসে ভালো মন। তুমি ছাড়া কোনও মেয়েকে মন দেয়নি। ওর সঙ্গে তোমার ভালোবাসাবাসির কথা শোনার পর ভারি ভালো লেগেছিল।

লাগবেই তো। আমি কি খারাপ মেয়ে? সাইমনকে বিয়ে করে ভুল করেছিলাম, তাই বলে খারাপ কেউ বলতে পারবে না! অ্যান মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, যে সমস্যাটার কথা বলছিলাম, তুমি তো চার্লসকে চেনো! আরে চার্লস হল ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার। কি সুন্দর দেখতে বলো! তা চার্লস আমাকে প্রেম নিবেদন করেই চলেছে। আমি যত বলি ওর প্রেম নেওয়া আমার দ্বারা সম্ভব নয় কারণ আমি কেন্টের বাগদত্তা, তো কানেই নেয় না। তোমাকে কি বলব, অতবড় লোকটা কান্নাকাটি পর্যন্ত করেছে। আমি বাবা কেন্টকে ভালোবাসি, ওসব ঝামেলায় যেতে চাই না। একটু আগে লোকটা ফোন করেছিল। আমার সঙ্গে একবার, মানে আমাকে অন্তত একবারের জন্যে। পেতে চায়, না হলে আত্মহত্যা করবে। আমি কেন্টকে বিয়ে করলে ওর তো কিছু করার নেই কিন্তু তার আগে একবার আমাকে পেতে চায়। আর এইটেই আমার সমস্যা। অনেকবার ভেবেছি কাটিয়ে দেব। তোমাকে ভালোবাসি না, তোমার সঙ্গে শাব কেন? কিন্তু তারপরই মনে হচ্ছে, যদি আত্মহত্যা করে? ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাবে, ক্যাশিয়ার নেই। তা ছাড়া অত যখন ভালোই বেসেছে তাহলে একবারের জন্যে আশা মিটিয়ে দিই। একবারই তো! আমি কেন্টের জন্যে যেমন। মনটাকে রেখেছি তেমনই থাকবে অথচ চার্লসকেও দুঃখ দেওয়া হবে না। কিন্তু কথাটা আমি কেন্টকে বলব কিনা বুঝতে পারছি না। আমরা শরীর-মনের ওপর, যদিও স্বামী হয়নি এখনও তবুও ওর অধিকার আছে, একটা অনুমতি নেওয়া দরকার। তুমি কি বলো?

পায়ের ওপর পা রেখে দুটো হাত হাঁটুর ওপরে নিয়ে বব চুপচাপ শুনছিলেন। প্রশ্নটার পর চোখ বন্ধ করলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন অ্যান উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছে। চোখ না খুলে তিনি বললেন, এরকম জটিল প্রশ্নের উত্তর তো চট করে দেওয়া যায় না। সময় লাগবে।

দিচ্ছি সময়। চুপচাপ বসে ভাবো। দ্যাখো, তোমার মতো অভিজ্ঞ মানুষকেই যখন ভাবতে হচ্ছে তখন আমার কি দোষ! আর কাউকে তো বলা যায় না এসব কথা তোমাকে ছাড়া। ভাববা, আমি ততক্ষণে টিভি দেখি। অ্যান উঠে টিভি খুলে দিল। চোখ না খুলে বব শুনলেন বি বি সি ওয়ানের সংবাদ পাঠক বলছেন, এই ঘটনার পর হাইওয়ে পরিষ্কার করা হয় এবং হিপিরা তাদের। যাওয়ার রুট বদলায়। কিন্তু হিপিরা যাতে পরের গ্রামে আশ্রয় না নেয় রাত কাটাতে সেইজন্যে গ্রামের মানুষ পুলিশের কাছে আবেদন করলে পুলিশ জানায় কোর্টের হুকুম ছাড়া তাদের পক্ষে হিপিদের নিষেধ করা সম্ভব নয়।

বব চোখ খুললেন। তৎক্ষণাৎ ছবিটা সরে গিয়ে ওয়েদার চার্ট ফুটে উঠল। যেটুকু চোখে এল। তাতে দেখলেন হিপিদের ক্যারাভান এগোচ্ছে। ওরা এখন কোন রাস্তায় যাচ্ছে? আহা, যে গ্রামে রাত কাটাবে তাদের কি দুর্দশা। এখন তো কোর্ট থেকে অর্ডার আনার সময় নেই। তাঁকে তাকাতে দেখে অ্যান জিজ্ঞাসা করল, ভাবা হল?

হুঁ। তুমি বরং চার্লসকেই বিয়ে করো। বেচারা কেন্টের একটু কষ্ট হবে, কিন্তু বাকি জীবনটা ভালোই কাটবে। আমি বলছি, চার্লস আর তুমি খুব সুখী হবে। বব উঠে দাঁড়ালেন।

হাঁ হয়ে গেল অ্যান, তুমি কি বলছ? কেন্টকে আমি যে ভালবাসি।

ভালোবাসো। ভালোবাসলেই যে বিয়ে করতে হবে তার কোনও মানে নেই। চার্লস কি পাত্র হিসেবে মন্দ?

না, তা অবশ্য নয়। তবে ওর তো বদলির চাকরি।

ভালোই তো। অনেক জায়গা দেখতে পাবে ওকে বিয়ে করলে। চলি। বব আর দাঁড়ালেন না। তাঁর মনে হল কেন্ট ছোঁকরাকে একটা ফোন করে সর্তক করে দেওয়া দরকার। এই মেয়েটার বুদ্ধি একটুও বাড়েনি। বাড়বেও না।

অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের একটু-আধটু ফষ্টিনষ্টি সবকালেই থাকে। বিয়ে না করেও একসঙ্গে থাকার নিয়মটা এই গ্রামেও চালু। তার নিজের নাতনি তো মা হয়েছে বিয়ে না করেই। কিন্তু। সেসব ক্ষেত্রেই একটা সাধারণ শোভন মানসিকতা কাজ করে। যে যাকে ভালোবাসে তাকে না হারানো পর্যন্ত সৎ থাকে। অথবা কি করছি সেটা নিজের কাছে স্পষ্ট থাকলে অন্য কাউকে বিরক্তও করা হয় না। বব নিজে খুব একটা কনজারভেটিব নন। তাঁর যৌবনে লিজা আসার আগে অন্তত দুটো ক্ষেত্রে তিনি নরম হয়েছিলেন। কিন্তু তার একটা শোভন চেহারা ছিল।

কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে বব চট করে সরে এলেন বাস স্ট্যান্ডের ছাউনির তলায়। আর তখনই তিনশো এগারো নম্বর বাসটা এসে দাঁড়াল। এই দোতলা বাসটা তিনটে গ্রামের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। আজ কোনও যাত্রী নেই, কোনও নামার লোকও নেই। কিন্তু না, একটু ভুল হয়। মাথায় ফুলের ছবি আঁকা টুপি, পরনে জিনসের প্যান্টের ওপর জ্যাকেট, হাতে বড় সাদা ব্যাগ নিয়ে একজন নামল। তাকে প্রথমে চিনতে পারেননি বব। কিন্তু বাসটা চলে যাওয়ামাত্র ববের মনে হল খুব চেনা-চেনা মানুষটি। যদিও জিনসের প্যান্টে নিতম্ব বড় ভারী দেখাচ্ছে আঁট হয়ে কাপড় সেঁটে থাকায়, কিন্তু একটু আগের চিন্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডোরা যে এখানেই এসে নামবে কে জানত! ষাট বছর তো অবশ্যই, লিজার সমবয়সিও হতে পারে অথচ লিজার থেকে কী স্মার্ট! শরীর মাঝে মাঝে ভুল হয়েছে বটে কিন্তু এখনও চমৎকার চটপটে। আর সেই সময় বব ধরা পড়ে গেলেন। ডোরা ওঁকে দেখে ব্যাগ রাস্তায় নামিয়ে ছুটে এল, আঃবব। তোমাকে এখানে দেখতে পাব ভাবিনি। মাই সুইট বব।

কিছু করার আগেই দু-হাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল ডোরা। একটু সামলে নিয়ে বব বললেন, যাক, চিনতে পারলে তাহলে!

চিনব না? পঞ্চাশ বছর হল, না? পঞ্চাশ বছর আগে তুমিও আমাকে প্রথম নারীত্বের আনন্দ দিয়েছিলে। এই পঞ্চাশ বছরের সব ভুলতে পারি কিন্তু ওই দুপুরটা? অসম্ভব। ডোরার হাত তখনও ওঁর কাঁধে। দাঁতগুলো কি বাঁধানো? পঞ্চাশের হিসেবটা যদি ঠিক থাকে তাহলে ডোরার বয়সটা তিনি ভুল হিসেব করেছিলেন।

বব বললেন, তোমাকে কিন্তু এখনও চমৎকার দেখাচ্ছে। এখনও অ্যাট্রাকটিভ।

রিয়েলি? এই নতুন প্যান্টটা বানাতে সাজেস্ট করল আমার নাতনি। ও, তুমি যদি ওকে দেখতে! ঠিক আমার পনেরো বছর! যাক, সাতদিন এখানে থাকব বলে এসেছি লিজার খবর কী?

ভালো আছে। তবে বয়স হলে যা হয়।

ওঃ বয়স। ভাবলেই বয়স নইলে কি! লিজা কিন্তু চিরকালই ঘরকুনো, তোমার ওকে বিয়ে করা উচিত হয়নি বব, একথা তোমাকে চিরকাল বলে এসেছি। আমার স্বামীটির সঙ্গে ওকে চমক্কার মানাত। তা তিনি গেলেন এমন সময়ে যে পাত্র খুঁজে পাব না আমি। খিলখিলিয়ে হাসল ডোরা।

চেষ্টা করলে পারতে। বব কেমন যেন নার্ভাস বোধ করছিলেন।

মুখ-চোখে কিশোরী হয়ে গেল ডোরা, সেকথা কি আর বলব। অন্তত তিনজন সত্তর পার হওয়া বুড়ো আমাকে অ্যাপ্রোচ করছে। কিন্তু ওদের দিকে তাকালেই নিজেকে কেমন বুড়ি মনে হয়। তোমার মতো স্মার্ট মানুষ একটাও দেখলাম না। আমার ভাইটির খবর কী?

ভালো। ও তো গত বছর আর একটা ফলের বাগান কিনেছে। নেশাও কম করে।

তাহলেই ভালো। ঠিক আছে, আমি চলি। তোমার সঙ্গে কখন দেখা হবে?

আমার বাড়িতে এসো।

না-না, ওখানে যাব অন্য সময়ে। আমাদের খামারবাড়িতে যাব কাল সকালে। ওখানেই চলে এসো। বাই বব। হাত নেড়ে চলে গেল ডোরা। কিছুক্ষণ নেশাগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন। বব। যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ যেন সমানে ঝড় তুলল। এবং হঠাৎ বব আবিষ্কার করলেন শরীরের রক্ত যেন স্রোত পালটাচ্ছে। এখনও যে জোয়ারভাটা খেলে, খেলতে পারে তা জেনে চমকিত। হলেন তিনি। যে মেয়ের বিয়ে হয়েছে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে, এবার হিসাবটা ঠিক, তিন ছেলে আর নাতি-নাতনি নিয়ে অন্য গ্রামে যার সংসার সে এসে ওই আঁটো প্যান্ট আর কথার দোলায় এখনও তাকে দুলিয়ে দিল। সে ছিল না পঞ্চাশ বছর আগের এক উজ্জ্বল দুপুরে খামারবাড়ির। খড়ের গাদায় শুয়ে থাকা পনেরো বছরের তেজি মেয়েটা? এই গ্রামে ডোরা যখন আসত তখন কদাচিতই দেখা হত। ওর স্বামী মারা যাওয়ার পর দু-তিনবার দেখা হয়েছে। তখন হয় লিজার সঙ্গে ছিল নয় ওর ছেলেরা। আজ একা-একা কেমন যেন করে দিয়ে গেল মেয়েটা। বাড়ির দরজায় এসে বব হেসে ফেললেন। পঁয়ষট্টি বছরের কোনও বৃদ্ধাকে কি মেয়ে বলা যায়?

তন্ময় হয়ে হিচককের ছবি দেখছিলেন লিজা। এটা সেই গল্প যার শেষে খুনি ওষুধ খাচ্ছে ভেবে ভুল করে কেমিস্টের দেওয়া বিষের পুরিয়া মুখে ঢালবে। অন্তত দুবার দেখেছে লিজা অথচ টিভির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন এর চেয়ে বিস্ময় আর কিছু নেই। বব পাশের সোফায় বসে বললেন, একটু আগে ডোরার সঙ্গে দেখা হল।

ও। লিজার ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হল কিনা বোঝা গেল না।

তুমি এই ছবিটা দুবার দেখেছ।

ওঃ, ডোন্ট টক। হোয়েন ইউ টক রাবিশ। এটা হিচককের ছবি। হাত নাড়লেন লিজা। অতএব ছবির শেষ দৃশ্য পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন বব। ল্যাংড়া হয়ে যাওয়া খুনি প্লেনের সিটে বসে হোস্টেসের কাছে জল চাইল। হোস্টেস জল দিতে সে ওষুধ ভেবে তৃপ্ত মনে সেটা মুখে দিয়ে পুরিয়া ঢালল গলায়। ছবিটা শেষ হতেই লিজা বললেন, কার কথা বলছিলে?

ডোরা! ভাই-এর বাড়িতে থাকবে বলে এসেছে। তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিল।

ডোরা? ও, তোমার ডোরা! ইউ স্লেপ্ট উইদ হার ফিফটি ইয়ার্স ব্যাক! ইজ ইট, হাউ ইজশী? নির্লিপ্ত মুখে প্রশ্ন করলেন লিজা। ঠোঁট কামড়ালেন বব। এটা প্রশ্ন করার ধরন হল? বউ-এর কাছে কিছুই লুকোবেন না ভেবে কত বছর আগে বিয়ের পরে ঘটনাটা স্বীকার করেছিলেন। আজ যেন আলমারি খুলে গাউন বের করল। তিনি উত্তর দিলেন না। লিজা সেটা লক্ষ্য করে বললেন, যে। বয়সের যা। তোমার ডোরাকে বলো একটু যেন আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ওর ভঙ্গি দেখে বাইশ বছরের ছোঁকরারাও রাত্রে ঘুমায় না। কিন্তু ও হল মরুভূমির আলেয়া। ভঙ্গিটুকুই সার।

চমকে গেলেন বব। এই বাড়ি এবং এই গ্রামের বাইরে জীবনে যায়নি লিজা। অথচ ডোরার হালফিল খবর রাখছে কেমন করে? মেয়েরা কি সবসময় একটা গোপন সূত্র রেখে দেয় স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকাদের জন্যে?

টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছিল। চাঁদে চকোলেট ফেলে এসেছিল একদল নভোচারী। ফলে সেই চকোলেটের লোভে অ্যামিবা এল, তা থেকে পিপড়ে জন্মে গেল। পিপড়ে থেকে পতঙ্গ, পতঙ্গ থেকে পাখি, পাখি থেকে মুরগি, মুরগি থেকে খরগোশ, খরগোশ থেকে বাঁদর, বাঁদর থেকে শিম্পাঞ্জি এবং শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষ। পরের ট্রিপে নতুন নভোচারীরা যেতেই সেই মানুষটি হাত। বাড়িয়ে চকোলেটের মোড়ক দেখিয়ে আর একটা চাইল।

তারপরই বি বি সি-র নিউজ বুলেটিন শুরু হল। মার্গারেট থ্যাচার বলেছেন লিবিয়ার সঙ্গে এখন কোনওরকম কথা শুরু করার সময় হয়নি। সিংহলে তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘাতে দশজন রাষ্ট্রীয় সেনা মারা গেছে। ওয়ার্ল্ড কাপে ব্রাজিল এখন বুকিদের কাছে ফেবারিট। হিপিরা পুলিশের আদেশ মেনে রুট পালটেছে। কিন্তু যেসব গ্রামের ওপর দিয়ে তারা যাবে এবং রাত কাটাবে তারা শঙ্কিত। হিপিরা বলছে তাদের টাকা ফুরিয়ে আসছে, গাড়ির তেলও নেই। বব খবরটা শুনছেন। মন দিয়ে। লিজা উঠে গেলেন কিচেনে। সব খবর শেষ হওয়ার পর হিপিদের ছবি এল। বাচ্চাগুলোর পায়ে মোজা নেই। লোকগুলো যেন শয়তানের সন্তান। ববের মনে হল এদের এখনই দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। তারপরেই তিনি সোজা হয়ে বসলেন। টিভি-র পরদায় হিপিদের যাওয়ার পরিবর্তিত রুট লিখে দেওয়া হবে। প্রথমে এল হিপিদের প্রতিবাদের ছবি। একটা অল্পবয়সি হিপিনি করুণ গলায় বলল, কাল সারাদিনে আমি মাত্র দু-পিস রুটি খেয়েছি। বিজি হাইওয়ে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে পুলিশ আমাদের যে রাস্তায় যেতে বলছে সেখানে খাবার দেবে কে? আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে আকাশে তলায় থাকতে পারি না। আমি আমাদের বাচ্চাদের জন্যে আপনাদের সহানুভূতি প্রার্থনা করছি। আমরাও মানুষ।

মানুষ! বব মাথা নাড়লেন, মানুষ কাকে বলে? ওই সঙের মতো সাজ, নোংরামির জন্যে যাদের কাছে যাওয়া যায় না তারা মানুষ। এই সময় টিভির পরদায় ম্যাপটা আঁকা হল। পরিবর্তিত পথ ধরে হিপিরা কীভাবে যাবে। এবং তখনই তাঁর গলায় চিৎকার ছিটকে উঠল। লিজা ছুটে এলেন, কী হল বব? শরীর খারাপ লাগছে?বব!

বব কোনওরকমে আঙুল তুলে টিভিটাকে দেখালেন। লিজা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে? কি দেখেছ ওখানে? কেউ মারা গেছে?

ততক্ষণে বব লাফিয়ে উঠেছেন। একেবারে টিভি-র পরদার কাছে চলে গেলেন তিনি। যাচ্চলে! ওয়ার্ল্ড কাপের প্রস্তুতি দেখাচ্ছে। তারপর সেখান থেকে ঘুরে উত্তেজিত ভঙ্গিতে জানালেন, সর্বনাশ হয়ে গেল লিজা। হিপিস আর কামিং।

কোথায়? কখন? কবে?

ওঃ। তুমি কি বুঝতে পারছ আমি বলছি হিপিরা আসছে। এই গ্রামের পাশ দিয়ে ওরা যাবে। এখন কি হবে?উঃ, আমি ভাবতে পারছি না। বব ছটফট করছিলেন।

লিজা একটু অবাক, তাতে হয়েছে কি? হাইওয়ে দিয়ে যেযার মতো যাবে তাতে তোমার উত্তেজিত হওয়ার কি আছে? ও বব, দিস ইজ টু-মাচ!

বব দৌড়ে এলেন, যা বোঝে না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। এরা কারা? পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা জীব। ওরা প্রকাশ্যে সেক্স করে, চুরিচামারি, ছিনতাই ওদের হাতের ময়লা। সবরকমের ড্রাগস ওরা খেয়ে থাকে। স্নান করে না। তার চেয়ে বড় কথা কোনও সামাজিক নমস মানে না। এরা যে কি শুধু ওরাই জানে। এই লোকগুলো যদি গ্রামে ঢুকে যায়? সমস্ত গ্রামটা বিষাক্ত হয়ে যাবে তাহলে। উই মাস্ট ডু সামথিং।

বব উত্তেজিত হয়ে আবার ছাতা নিয়ে, বেরিয়ে পড়লেন। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্সের সামনে টেড দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল। বব চিষ্কার করলেন, হেই টেড। শুনেছ? খবরটা শুনেছ?

কী খবর বব? নির্লিপ্ত চোখে তাকাল টেড।

দে আর কামিং। হিপিস। ওরা এই গ্রামের পাশ দিয়ে যাবে। ওরা যদি গ্রামে ঢুকে পড়ে। ভাবতে পারছ ব্যাপারটা? আড়াই হাজার হিপি। বব ওর কাছে চলে এলেন।

এবার টেডের চোখ কপালে উঠল, মাই গড। কিন্তু কে তোমাকে খবরটা দিলে?

টিভি! টিভিতে এইমাত্র বলল। আমাদের গ্রামের নামও লিখে দিয়েছিল।

কিন্তু ওরা যদি আসে কি করতে পারে বলো তো?

তুমি জানো না? তোমার দোকান থেকে জিনিস নিয়ে দাম না দিয়ে চলে যেতে পারে। তোমার ছোট ছেলেটাকে ট্যাবলেটের নেশা ধরিয়ে দিতে পারে। তা ছাড়া ওরা যে এইডসের জার্ম ক্যারি করছে না তা তুমি জানোনা।

দেন উই মাস্ট স্টপ দেম। লেটস গো টু শেরিফ। দোকান খোলা রেখে পারতপক্ষে বের হয় না টেড। পা বাড়াতে গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। তারপর দোকানটার দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মাঝে-মাঝে মানুষকে বিশ্বাস করা উচিত, তাই না বব?

বব বললেন, মাঝে-মাঝে।

এখনও রাস্তা ফাঁকা! টেড জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার লাঞ্চ হয়ে গেছে বব?

বব মাথা নাড়লেন, না। আমি সাধারণত লেট লাঞ্চ করে থাকি। ববের খুব খারাপ লাগল। এইরকম সমস্যা যখন ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে তখন টেড খাওয়ার কথা ভাবছে।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই সমস্ত গ্রাম জেনে গেল হিপিরা আসছে। একা বব নয় অনেকেই টিভির পরদায় খবরটা দেখেছে। তবে বেশিরভাগ রাতজাগা মানুষ তখনও ঘুমিয়ে থাকায় খবরটা তাদের শুনতে হল। বব এবং টেডের উত্তেজনার অনেকটাই তখন ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামের মানুষদের মধ্যে। শেরিফের অফিসের সামনে বেশ ভিড় জমেছে। রুটির কারখানার মালিক। ফিলিপ চিৎকার করে বলছিল, হাইওয়ে দিয়ে ওদের ক্যারাভান যদি যায় যাক কিন্তু আমাদের গ্রামের মধ্যে যেন না ঢোকে।

আলোচনারত শেরিফের কানে কথাটা পৌঁছাতে তিনি মাথা নাড়লেন, ঠিক কথা। বব, কেউ যদি হাইওয়ে দিয়ে কোথাও যায় তাহলে আমরা তার যাওয়া বন্ধ করতে পারি না। হাইওয়ে সরকারের সম্পত্তি। কিন্তু ওরা যদি গ্রামে ঢুকতে চায় তাহলে আপত্তি জানাতে পারি। দরকার হলে আমরা। কোর্টে যেতে পারি।

ইলিংওয়ার্থকে এই গ্রামের সবচেয়ে বিষয়ী মানুষ বলা হয়। হাইওয়ের ধারে তাঁর বিশাল ফলের বাগান আছে। বৃদ্ধের কৃপণ হিসেবেও ভালো নাম। শেরিফের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, কোর্ট?

হ্যাঁ। কোর্ট থেকে আমরা ইনজাংশন আনতে পারি। আমাদের এলাকায় কেউ যেন ঢুকতে না পারে। পুলিশ তো ওদের সঙ্গেই আসছে। কোর্টের অর্ডার ওদের দেখালে পুলিশ সেটা মানতে বাধ্য করবে। বাট, স্টিল এসব করার কোনও দরকার নেই বলে আমার বিশ্বাস। আপনারা। অনর্থক উত্তেজিত হচ্ছেন। শেরিফ বললেন।

অনেক তর্ক-বিতর্কের পর সর্বসম্মত একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, আমরা এই গ্রামের শান্তিপ্রিয় ব্রিটিশ নাগরিকরা আশঙ্কা করছি যে হিপিদের ক্যারাভানটি যদি এই গ্রামে প্রবেশ করে তাহলে আমাদের শান্তি বিপন্ন হবে। তাই মহামান্য আদালতের কাছে আবেদন করছি যাতে তিনি অগ্রিম আদেশ জারি করে ওদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করেন।

ইলিংওয়ার্থ বললেন, কিন্তু কোর্টে গেলে তো খরচ আছে। গ্রামের স্বার্থে সবাই চাঁদা দিক। একটা ফান্ড তৈরি হোক। শেরিফ প্রেসিডেন্ট, আমি ক্যাশিয়ার।

ফিলিপ প্রতিবাদ করল, কেন বাবা? হাইওয়ের কাছাকাছি আমার কোনও সম্পত্তি নেই, আমি চাঁদা দিতে যাব কেন? আর চাঁদা দিলে কে ক্যাশিয়ার হবে তা ভাবার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে।

ডোরম্যান ম্যাথুজ বলল, হিপিদের এত ভয় পাওয়ার কি আছে! ওদের চেহারা তো দেখেছি। একটা ঘুষি মারলে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না।

শেরিফ বললে, না-না, কোনও মারামারি নয়।

ওস্কার ছোঁকরা বলল, শেরিফ। এই গ্রামের লোকগুলো কি পাগল? কোথায় রইল হিপিরা আর এখানে বসে সবাই আকাশ-পাতাল ভাবছে। ওরা একটু নোংরা বটে কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি ওদের আমার খুব রোমান্টিক লাগে। ঘর ছাড়া বাঁধন হারা–।

সঙ্গে-সঙ্গে সম্মিলিত প্রতিবাদ উঠল। বব বললেন, ওস্কার একথা বলতেই পারে। দূরে দাঁড়িয়ে অন্যের বাড়িতে আগুন লাগতে দেখে কেউ-কেউ তো খুশি হয়। সে এই গ্রামের ছেলে নয়, তাই গ্রামের মানমর্যাদা সেন্টিমেন্ট সে বুঝবে কি করে! বলতে-বলতে ঘড়ি দেখলেন বব। তারপর বললেন, তিন মিনিট বাদেই টিভিতে খবর শুরু হবে। উই মাস্ট ওয়াচ দ্যাট।

শেরিফের হুকুমে সেখানেই একটা সেট আনানো হল। সবাই উন্মুখ হয়ে দেখল নিউজ বুলেটিন, আজ একটু আগে হিথরো এয়ারাপোর্টে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে বোমা রাখার খবর আসায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বথামের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। হিপিরা হাইওয়ের পাশে একটি গ্রামে আশ্রয় নেওয়ায় গ্রামবাসীরা আদালতের শরণাপন্ন। হয়েছেন।

বব চিৎকার করে উঠলেন, লুক, শুধু আমরাই নয় অন্য গ্রামের মানুষেরাও আদালতে যাচ্ছে। ওরা আগে থেকে ইনজাংশন না চেয়ে যে ভুল করেছিল আমরা তা করব কেন?কী হে ওস্কার, এখনও কি ওদের রোমান্টিক বলে মনে হচ্ছে তোমার?

ওস্কার নীরবে মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল। টেড বলল, আসলে যে এই গ্রামে জন্মায়নি, বড় হয়নি, সে কি করে বুঝবে গ্রামের সেন্টিমেন্ট!

শেরিফ বললেন, ও. কে! চাঁদা তোলার কোনও প্রয়োজন নেই। হাইওয়ের পাশে যার জমি অথবা ফলের বাগান আছে সে এখনই কোর্টে যাক। এ ব্যাপারে আমার পক্ষে যতটা সম্ভব সাহায্য করব। ছুটির দিন হলেও স্পেশ্যাল অর্ডার বের করতে অসুবিধে হবে না। এটা করলেই হিপিরা আর গ্রামে ঢুকতে পারবে না।

বিকেলের মধ্যে এগারোটা আবেদন জমা পড়ল আদালতে। এবং ইনজাংশন পাওয়া গেল। হাইওয়ে বরাবর প্রতিটি বাগান এবং জমি এখন আইনের দ্বারা সুরক্ষিত। কোনও ব্যক্তি বা দল মালিকের বিনা অনুমতিতে সেখানে পা দিতে পারবেন না আগামী এক মাসের মধ্যে। মোটামুটি একটা নিশ্চিতভাব এসে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। শেরিফ জানিয়ে দিয়েছেন হিপিরা যখন হাইওয়ে দিয়ে যাবে তখন গ্রামের কেউ যেন সেখানে না যায়। এর ফলে হিপিদের উপেক্ষা করা হবে। সারা বিকেল বব আর টেড যার সঙ্গে দেখা হল তাকেই বললেন ওই সময় যেন অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের বাড়িতেই আটকে রাখা হয়। কিন্তু এটা অত্যন্ত আন্তরিক ইচ্ছে হলেও সবাই বলল, আজকালকার ছেলেমেয়েদের তো তুমি জানো। তারা কোনও উপদেশই শুনতে চায় না। হিপিরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত তাই শান্তি পাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই।

রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি। হিপিরা এখন এই গ্রাম থেকে মাত্র নব্বই মাইল দূরে আছে। তার মানে ইচ্ছে করলে দুপুরের অনেক আগেই ওরা এই এলাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইচ্ছেটা কি করবে? যেভাবে ওরা পুলিশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে?

ঘুম না হওয়ার আর একটা কারণ লিজা। হঠাৎ কাল রাত্রে শুয়ে-শুয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি আজ। ক্যাসিনোয় গিয়েছিলে?

বব সরল মনে উত্তর দিয়েছিলেন, হ্যাঁ।

তুমি তো জুয়া খেলো না, তাহলে ওখানে যাওয়ার কি দরকার?

বব হেসে ফেলেন, মিসেস হোমসের সঙ্গে একটু গল্প করতে ইচ্ছে হল।

আমার সঙ্গে তো কথা বলতে গেলে তোমার মুখে হাসি ফোটে না।

এই তো হাসছি।

শোনোবব। ডোরার সঙ্গে দেখা করবে না আলাদা।

কী আশ্চর্য, কথা হচ্ছিল হোমসকে নিয়ে, এর মধ্যে ডোরা আসছে কোত্থেকে?

আসছে। আমি সব আগাম টের পাই।

তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমার কবরে যাওয়ার বয়স হয়ে গেছে।

পুরুষমানুষের স্বভাব যা তাতে কবরে শোওয়ার পর পাশের কফিনে কোনও মেয়ে থাকলে নিশ্চিন্ত হওয়া বোকামি। ধীরে-ধীরে শব্দগুলো উচ্চারিত হয়েছিল। প্রতিবাদ করেননি বব। কোনও লাভ হত না। মেয়েরা যখন বাঁকা কথার স্রোত বইয়ে দেয় তখন তাতে যুক্তির বাঁধ। দেওয়া বোকামি। কিন্তু তারপর থেকেই মন খারাপ হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর দেখলেন আকাশের অবস্থা একটুও পালটায়নি। কিন্তু ওয়েদার ফোরকাস্টে বলল দুপুরের পর রোদ উঠবে। হিপিদের খবরটা আগ্রহ নিয়ে দেখলেন বব। একই অভিযোগ, আমাদের তেল নেই, খাবার নেই, টাকা নেই। কিন্তু কখন তারা বিদেয় হবে তা বলল না ওরা। বব ইলিংওয়ার্থকে ফোন করলেন, তুমি কি একবার বাগানটা দেখে আসবে?

ইলিংওয়ার্থ বলল, আমি কাল রাত্রে ওখানে ছিলাম বব। সব ব্যবস্থা করে এসেছি। আবার লাঞ্চের পর যাব। তবে তোমার জমি আর হাইওয়ের মাঝখানে বাউন্ডারির তার একটু নিচু হয়ে গেছে দেখে এলাম।

খবরটা শোনার পর আর দেরি করলেন না বব। লিজা ঘুমাচ্ছে এখনও। তিনি দরজা টেনে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হলেন। আজও সকালে রাস্তায় লোক নেই। অনেক ঘুরে-ঘুরে জমিতে পৌঁছতে হয়। বুড়ো জন ওকে দেখে এগিয়ে এল, গুড মর্নিং, বব। হঠাৎ সাতসকালে–শরীর ঠিক আছে ত?

বুড়ো জন হল কেয়ারটেকার। অনেককালের লোক। এমন ভালোমানুষ বড় একটা দেখা যায় না। বব জিজ্ঞাসা করলেন, সব ঠিক আছে তো জন?

আমি যদ্দিন না মাটিতে যাব তদ্দিন সব ঠিক থাকবে বব। কাল মিস্টার ইলিংওয়ার্থ এসেছিলেন। তাঁর কাছেই হিপিদের খবর পেলাম। ষাট বছর আগে একবার পঙ্গপালের খবর হয়েছিল। তোমরা সেইরকম ভয় পাচ্ছ দেখছি।

ভয় নয় জন। তুমি টিভি দেখলে বুঝতে পারতে। বব ভেতরে ঢুকলেন। ছোট বাংলো। ফলের বাগান। আর তারপর জমি। তিনি জনকে নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে হাইওয়ের সামনে পৌঁছে গেলেন। মাঝখানে খানিকটা ঢালু জমি আর একটা তারের বেড়া ব্যবধান তৈরি করেছে। এখন ফসল শেষ। তবু এখানে এলেই বুক জুড়িয়ে যায় ববের। ছেলে কিংবা নাতনি এসবের মর্ম বুঝল না। তিনি চলে গেলে এদের কি করে সামলাবে লিজা! এত সবুজ এত নরম মাটি। বব চারপাশে তাকালেন। ইলিংওয়ার্থ বলেছে সে দেখেছে তার ঝুলে পড়েছে। কিন্তু কোথাও তেমন চোখে পড়ল না। অনেক খুঁটিয়ে দেখার পর একটা জায়গায় সামান্য নিচু মনে হওয়ায় তিনি জনকে বললেন ওখানকার তারটা যেন এখনই ঠিক করে দেওয়া হয়।

জন বলল, হোয়াট ফর? ওখান দিয়ে কোনও জন্তু ঢুকতে পারবে না।

হিপিরা ঢুকতে পারে জন।

মাই গড। কেউ যদি ঢুকতে চায় তো তারটা টপকেও ঢুকতে পারে। জন্তুরা সেটা পারবে না। মানুষ এলে অবশ্য মামলা করতে পারো।

বব স্বীকার করলেন কথাটা। তারপর বললেন, তুমি এখানে একটা বোর্ড টাঙিয়ে দাও জন। বিনানুমতিতে প্রবেশ করলে শাস্তি পেতে হবে। আদালতের আদেশে সুরক্ষিত এলাকা। আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না।

জনকে ওখানে রেখে খামারবাড়িতে ফিরে এলেন বব। কাঠের দুটো ঘর আছে। একসময় লিজাকে সঙ্গে নিয়ে এখানে দু-তিন দিন থেকে যেতেন। এখন আর আসা হয় না। জন সব ব্যবস্থা অবশ্য ঠিকঠাক রেখেছে। ঘুরে-ঘুরে দেখলেন বব। শৈশবের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। এবং তখনই তার মনে পড়ল ডোরার কথা। ডোরা বলেছিল আজ সকালে সে ওদের খামারবাড়িতে আসবে। পঞ্চাশ বছর আগে এক দুপুরে ওদের সেই খামারবাড়িতে তার যৌবনের স্মৃতি রয়েছে।

লিজার কথা মনে পড়ল। ওর আপত্তির কথাও। এবং সেইসঙ্গে প্রতিক্রিয়া হল। তিনি কোনও অন্যায় করছেন না তবু লিজার অন্যায় আপত্তিতে যুক্তি থাকলে অস্বীকার করার প্রশ্নই উঠত না। তিনি আবার গাড়িতে উঠলেন। অন্তত একবার হ্যালো বলে যাওয়া ভদ্রতা, লিজা যাই মনে করুক।

নেশাভাং করে ডোরার ভাই সম্পত্তির অনেকটাই ইলিংওয়ার্থকে বিক্রি করে দিয়েছিল, কিন্তু এখনও যা আছে তা যথেষ্ট। ওদের খামারবাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে বব ডোরার ভাই-এর গাড়িটাকে দেখতে পেলেন। অর্থাৎ ওরা এসেছে।

পা বাড়াতেই ডোরার ভাই-এর সঙ্গে দেখা। ষাট ছুঁয়েছে কিন্তু ডোরার চেয়েও বয়স্ক দেখাচ্ছে। তাঁকে দেখে বলল, গুড মর্নিং বব। তুমি এসে ভালোই হল। আমাকে এখনই একটা কাজে যেতে হবে কিন্তু ডোরা চাইছে আর একটু থেকে যেতে। আশা করি তুমি ওকে একটা লিফট দিতে আপত্তি করবে না।

কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করে সে চলে গেল। ওর গাড়ির আওয়াজ মিলিয়ে গেলে বব চারপাশে তাকালেন। এদের এখানে এত পাখি আসে কোত্থেকে। তাঁর খামারেও পাখি ডাকে কিন্তু এত একসঙ্গে নয়। বব এগিয়ে গাছপালার মধ্যে দাঁড়ালেন। এদের খামারবাড়িটায় তিনটে ঘর। ওপাশে খানিকটা কৃত্রিম জঙ্গল। ওখানেই পঞ্চাশ বছর আগে। বব নিশ্বাস ফেললেন। মানুষের জীবনটা এত ছোট আর তার চেয়ে দ্রুত ফুরিয়ে যায়। পঞ্চাশ বছর আগের এই চামড়া দুই আঙুলে টানলেন বব। একটু টান-টান হল কিন্তু তাতে অজস্র সাদা ফাটা দাগ। ছেড়ে দিয়ে এবার আঙুল বোলালেন জায়গাটায়।

কিন্তু ডোরা কোথায়? বব চারপাশে তাকালেন। এখন রোদ নেই কিন্তু উত্তাপ বেড়েছে, বৃষ্টি খুব জলদি আসবে না। বব খামারবাড়িতে ঢুকলেন। নিচের দুটো ঘরে কেউ নেই। সেখানকার আসবাবও খুব সামান্য। জন তার বাড়ি অনেক ভালো সাজিয়েছে। ডোরা গেল কোথায়?বব কাঠের সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতেই ডোরার গলা শুনতে পেলেন, কে আসছে?

আমি বব।

মাই গড! তুমি অনেকদিন বাঁচবে হে। এতক্ষণ তোমার কথা ভাবছিলাম আমি। সোজা ছাদে চলে এসো। সিঁড়িটা একটু দেখে এসো। বাঁ-দিক ঘেঁষে। ডোরার উৎসাহী গলা শুনে তিনি সিঁড়িটার দিকে তাকালেন। ডান দিকে কোনও হাতল নেই অথবা ঘেঁষবার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। খুব। সাবধানে তিনি উঠে এলেন ছাদে। একঘরের ছাদ। তার মাঝখানে একটা আরাম চেয়ারে মাথায় টুপি চাপিয়ে শুয়ে রয়েছে ডোরা। ছোট প্যান্টি আর ব্রেসিয়ার ছাড়া অঙ্গে কিছু নেই। ওকে দেখে ডোরা বলল, সূর্য কখন উঠবে বলতে পারো? এটাকে কি সামার বলে? শরীরে একটু রোদ লাগাতে এখানে এলাম। ভাই চলে গেছে?

হ্যাঁ।

যাক। তোমার গাড়িতে ফিরব আমি। বসো। দাঁড়িয়ে দেখছ কি?তুমিই বলতে পারবে, এই শরীরটাকে তো পঞ্চাশ বছর আগেও দেখেছ, এখন কি পরিবর্তন হয়েছে বলো তো? ডোরা আবার শুয়ে পড়ল মাথা হেলিয়ে।

বব তাকালেন। সত্তরের কাছাকাছি যার বয়স তার এমন শরীর থাকা সত্যি গুণের কথা। যদিও কোমরের চর্বি একটু ঝুলছে, বুকের ধার ভোঁতা হয়ে স্কুপে পরিণত হয়েছে কিন্তু ডোরার পায়ের গড়ন এখনও চমৎকার। এবং কোনওমতে যে বাঁকগুলো বেঁচে আছে তাকে সময় নষ্ট করতে পারেনি। তিনি হেসে বললেন, ডোরা, তোমার মনে নেই।

ননসেন্স। সেটাও তোমার ওপেনিং ছিল, না?

হলেও। পঞ্চাশ বছর কম কথা নয়। নিজের মুখই মনে পড়ে না। ববের কথা শেষ হওয়ামাত্র ডোরা উঠে একটা চাদর ছাদে বিছিয়ে দিল। তারপর ববের হাত ধরে বলল, আমি তোমার বুকের মাথা রেখে একটু শোব বব। একদম পবিত্র শোওয়া।

বব বললেন, সেই অর্থে আমাদের তো অপবিত্র হওয়ার কোনও ক্ষমতাও নেই।

হঠাৎ সজোরে চড় মারল ডোরা। বব এমনটা আশা করেননি। তিনি আচমকা আঘাতটা কোনওমতে সামলালেন। গাল জ্বলছে। ডোরা তখন চিৎকার করছে, ইউ কাওয়ার্ড। পঞ্চাশ বছর ধরে তুমি আমায় জ্বালিয়েছে।

আমি, আমি জ্বালিয়েছি?

অফকোর্স। যাকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করব না ঠিক করেছিলাম। কিন্তু যখনই ওই দিনটার কথা মনে পড়ত তখনই তুমি জ্বালাতে।

ববের শরীরে ক্রোধ এল। তিনি দু-হাতে ডোরাকে ধরেও ঠিক করতে পারলেন না কীভাবে আঘাত করবেন। ডোরা কোনও আপত্তি করল না। হঠাৎ তার বুকে মুখ ঘষে বলল, তোমার লেগেছে বব?

হ্যাঁ। নিজের গলা ফ্যাসফেসে শোনাল ববের।

তুমি আমাকে মারো। আমাকে রক্তাক্ত কর। আমাকে শেষ করে দাও। এইভাবে মৃতের মতো বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমার মনে সমুদ্র কিন্তু শরীরটা কেন কালাহারি হয়ে গেল বব? আমাকে বাঁচাও তুমি। পাগলের মতো আচরণ এখন ডোরার এবং সেই মুহূর্তে ববের মনে হল উঠে দাঁড়ানোর পর ডোরার এই লাস্যময়ী পোশাকে চেহারাটা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তিনি ধীরে-ধীরে ডোরার শরীরে হাত বোলাতে লাগলেন। সেই স্পর্শে বোধহয় স্নেহ একটু বেশিমাত্রায় ছিল নইলে ছিটকে সরে যেত না ডোরা, লুক বব, আমি ছয় বছরের মেয়ে নই। তুমি আমায় স্নেহ করছ? আমি ফসিল হয়ে গেছি তাই অনুকম্পা দেখাচ্ছ? আই ডোন্ট মিন ইট। আর। কিছু না থাক তোমার ঠোঁট দুটো তো আছে, দাঁত আছে, আমাকে শুষে নিতে পারছ না? কামড়াতে পারছনা? এগিয়ে এসো, আমি তোমাকে বলছি বব। তোমার এলিজার পঁয়ষট্টি বছর বয়সে এই শরীর আছে?কাম অন–।

আর তখন বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে উঠল। বব চট করে বুক চেপে ধরলেন, মুখে একটু ভাঁজ পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে পকেট থেকে কৌটো বের করে একটা ট্যাবলেট জিভে ফেলে দিলেন। ডোরা দেখছিল ব্যাপারটা। তার গলায় স্বর বদল হল, তুমি কি বুকে ফিল করছ?

বব চারপাশে তাকালেন। তারপর মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন। অন্তত দশ মিনিট লাগবে ট্যাবলেটটার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে। অবশ্য জিভে পড়া মাত্র আর বাড়বে না ব্যথাটা। যেন সাপের ফণা নামবার শেকড় নিয়ে চলাফেরা। কদিন আগেই বি বি সি একটা সাপুড়েদের ওপর তথ্যচিত্র দেখাচ্ছিল। সাপটা ফণা তুলছে কিন্তু যেই শেকড় দেখছে অমনি নুয়ে পড়ছে। আরামচেয়ারে শুয়ে চোখ বন্ধ করতে ধীরে-ধীরে শরীর স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। এবং তখনই তিনি ডোরার গলা পেলেন, বব, আই অ্যাম সরি। তিনি চোখ খুলে দেখলেন ছাদে বসে আছে ডোরা। তার নিশ্বাস পড়ছে ঘন-ঘন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে তোমার?

আই ডোন্ট নো। আজকাল একটু টেনশন বাড়লেই বুকের মধ্যে লোহার বল ড্রপ খায়, দম বন্ধ হয়ে আসে। ডোরা কোনওমতে বললেন।

ই সি জি করিয়েছ কখনও?

না।

করিয়ে ফেল। ঠিক আছে, তুমি এই ট্যাবলেটটা জিভে রাখো। ইট উইল হেল্প ইউ। কাম অন বেবি। যে বয়সের যা। ইউ মাস্ট নট ফরগেট দ্যাট। পরম স্নেহে বব ডোরাকে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিলেন, গিলে ফেলোনা, লজেন্সের মতো ব্যবহার করো।

তারপর অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বললেন না। খোলা আকাশের নিচে দুজনে পাশাপাশি। একজন আরামচেয়ারে চোখ বন্ধ করে অন্যজন ছাদের ওপর বিছানো চাদরে টানটান। দুজনের শরীরে ওষুধের কাজ শুরু হয়েছে এবং শিগগির অশান্ত হৃদয় আরও জখম হওয়ার বদলে শান্ত হয়ে এল। এই সময় অত্যন্ত ক্লান্তি লাগে। ঘুমোতে পারলে আরও ভালো হত। উঠতে একটুও। ইচ্ছে করছিল না ববের। তিনি আবার চোখ বন্ধ করলেন। হাওয়া দিচ্ছে। ঈশ্বর! নিজেই জানেন এখন শুধু অন্যের জন্যে বেঁচে থাকা। কার জন্যে? কীসের জন্যে?

ঘুম ভাঙতে কিছুক্ষণ ঘোরে রইলেন বব। এ কোন জায়গা, সময়টা কি বুঝতে-বুঝতে সময় গেল। তারপর ধড়মড় করে উঠে পাশে তাকালেন। ডোরা নেই, চাদরটাও। চট করে কবজি ঘোরালেন, লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। লিজা নিশ্চয়ই খুব খেপে গেছে এতক্ষণ। চিন্তিত না হওয়ার কোনও কারণ নেই। তিনি ধীরে-ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই ডোরাকে দেখতে পেলেন, শরীর ঠিক আছে?

হ্যাঁ। বব হাসলেন, তোমার?

সাফোকেশন এখনও যায়নি। এসোলাঞ্চ রেডি। ডোরা ডাকল।

লাঞ্চ? আমি তো এখানে লাঞ্চ করব না।

কেন? ও, লিজা বসে আছে বুঝি? আমি এতক্ষণ কষ্ট করে–!

ও.কে। ঠিক আছে। চলো।

না, তোমাকে এখানে খেতে হবে না। লাঞ্চের প্যাকেটগুলো আবার বন্দি করে ডোরা বলল, আশা করি তুমি আমাকে একটা লিফট দেবে।

উইদ প্লেজার।

খামার এলাকা ছেড়ে অনেকটা ঘুরে আসতে হয়। পথে কেউ কোনও কথা বললেন না। বাড়ির কাছাকাছি এসে ডোরা বলল, আমাকে এখানে নামিয়ে দিলেই চলবে।

আর ইউ সিওর? বব গাড়ি থামালেন। ডোরা ওঁর দিকে তাকাল। হঠাৎ বব ওর হাত ধরলেন, আমাকে একটু চুমু খেতে দেবে?

ডোরা সঙ্গে-সঙ্গে হাত ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল, নো!

কেন?

আজ চুমু খেলে এটাই আমাদের জীবনের শেষ চুমু হয়ে যাবে। বাই বব।

বাড়িতে ফিরে বব লিজার চিরকুটটি পেলেন। তিনি মিসেস আর্নল্ডের বাড়িতে গিয়েছেন। যদি বব লাঞ্চ খায় তাহলে সেটাকে তৈরিই পাবে। বুড়ি আর্নল্ডের বাড়িতে এই গ্রামের গুজব তৈরি হয়। ওখানে আজ যাওয়ার কি দরকার ছিল! বব খেয়ে নিলেন। তারপর টিভির সামনে পা ছড়িয়ে। বসলেন। হিচককের ছবি দেখাচ্ছে। ছবিটা তিনি এর আগেও দেখেছেন। একটু ঝিমুনি এল দেখতে-দেখতে। বব চোখ বন্ধ করলেন। এরপর কতটা সময় গিয়েছে তিনি জানেন না। হঠাৎ হিপি শব্দটা কানে যেতেই ধড়মড়িয়ে উঠলেন। খবর হচ্ছে। হিপিদের কনভয়টা এগিয়ে আসছে টিভির পরদায়। ওটা কোন জায়গা? রাস্তার নাম পড়তে তিনি চমকে উঠলেন। তাদের গ্রাম থেকে মাত্র কুড়ি মাইল দূরে আছে ওরা। যেখানেই ওরা থামতে চেয়েছিল সেখানকার গ্রামবাসীরা কোর্ট থেকে নেওয়া আগাম হুকুম ওদের দেখাচ্ছিল। পুলিশ সেটা পরীক্ষা করে হিপিদের গ্রামের মাটিতে পা রাখতে দিচ্ছিল না!

এখন হিপিরা আসছে।

বব এবার ওভারকোট, কোর্টের কাগজপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন।

শেরিফের অফিসের সামনে বেশ ভিড়। হিপিরা এসে পড়ল বলে। শেরিফ নির্দেশ দিলেন যের জায়গায় যেন চলে যায় কোর্টের অর্ডার নিয়ে। শেরিফ থাকবেন হাইওয়েতে। তিনি পুলিশকে সাহায্য করবেন। সঙ্গে-সঙ্গে যেযার গাড়ি নিয়ে রওনা হল জমি-বাগান হাইওয়ের দিকে। ববের মনে হল এটা একটা যুদ্ধের মতো ব্যাপার। এইরকম উত্তেজনাতে তাঁর বুকে কোনও যন্ত্রণা হয় না। আশ্চর্য!

দূর থেকে ওদের দেখা যাচ্ছিল। বিশাল কনভয়টা এগিয়ে আসছে। সামনে পুলিশের একটা গাড়ি। বব ঠোঁট কামড়ালেন, এটা একটু খাতিরের মতো হয়ে যাচ্ছে না?ইলিংওয়ার্থের জমির সামনে কনভয়টা দাঁড়িয়ে গেলে সে চিৎকার করতে লাগল কোর্টের অর্ডার হাতে নিয়ে, ট্রেসপাসার্স উইল বি প্রসিকিউটেড বাই দা অর্ডার অফ ল। শেরিফ এবং একজন পুলিশ অফিসার অর্ডারটা পরীক্ষা করে হিপিদের লাউডস্পিকারের মাধ্যমে জানিয়ে দিতেই একটি মেয়ে চিৎকার করে উঠল, আমরা কি পাগলা কুকুর? আমি আর পারছি না!

বব উত্তেজিত, এবার তাকে অর্ডার দেখাতে হবে। জন তার পাশে দাঁড়িয়ে। দেখতে-দেখতে জন বলল, দে নিউ শেলটার, দে মে গো টু পলস প্লেস। এখন তাঁর চোখের সামনে দিয়ে কনভয়টা যাচ্ছে। কি নোংরা পোশাক।! রুগ্ন দলাপাকানো নেশাগ্রস্থ মানুষের গাড়িগুলোর ওপর বসে। আছে। ওরা কি বাচ্চাদের নেশা করায়? হঠাৎ কনভয়টা থেমে গেল। পুলিশ আর হিপিরা কথা বলছে। টিভির ক্যামেরা চলছে পাশ থেকে। আলোচনার বিষয়টা বুঝতে পারছিলেন না বব। এই সময় জন তার টপকে এগিয়ে গেল। শেরিফ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কিছু বলবে জন?

ওরা কি চাইছে?

ওরা বলছে ওদের কাছে যা গ্যাস আছে তাতে আর মাইল পাঁচেক যেতে পারবে। পুলিশের কাছে ওরা একটা জায়গা চাইছে রাত কাটাবার। কারণ সরকারি সাহায্য কাল সকালের আগে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আবার গ্রামের কোনও জায়গা কোর্টের অর্ডারের বাইরে নেই, তাই না জন?

একটু ভুল হয়ে গেছে শেরিফ। বিনীত গলায় বলল। পলের জমিটার অর্ডার আনা হয়নি। পল মারা যাওয়ার পর থেকেই তো একটা ঝগড়া চলেছে ছেলেদের মধ্যে। কেউ মালিক হতে চায় না। ওটার কথা আপনারা খেয়াল করেননি।জন যেন অনুযোগ করল।

লাল দাড়ির একটি হিপি জনের কথাগুলো শুনে সঙ্গে-সঙ্গে সিটি মারল। খবরটা ছড়িয়ে পড়ল তৎক্ষণাৎ। এই হাইওয়ের পাশে একটি জায়গা পাওয়া যেখানে আদালতের হুকুম নেই। কিন্তু কোন জায়গাটা?

বব চিৎকার করলেন, হেই জন। কাম ব্যাক!

জন ফিরে তাকাল। তারপর সুড়সুড় করে নেমে এল হাইওয়ে থেকে। সে ভেতরে ঢোকার পর বব প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তোমার কি দরকার ছিল ওদের খবরটা দেওয়ার। বদমাস।

জন মাথা নাড়ল, ওদের তো বলিনি। শেরিফ জিজ্ঞাসা করায়–তা ছাড়া, ওই মেয়েটাকে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। পাঁচ বছরের বাচ্চা অথচ পায়ে মোজা নেই। ওর কি দোষ? ও যে কষ্ট পাচ্ছে ঈশ্বর কি দুঃখিত হচ্ছেন না?

ততক্ষণে হিপিরা এসে জড়ো হয়েছে সামনের হাইওয়েতে, এই যে ওল্ডম্যান, সেই খালি জায়গাটা কোথায় দেখিয়ে দাও। উই উইল বি গ্রেটফুল টু ইউ। এই যে, এইদিকে তাকান, আমাদের দেখে কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না? খবরটা অর্ধেক দিলেন কেন? জমিটা কোথায়?

ক্রমাগত এইরকম অনুরোধ হতে দেখে বব বললেন, জন, ভেতরে যাও, জলদি। সেই সময় একটি হিপিনি ছুটে এল তাদের কাছে, এই যে, তুমি যদি আমাদের জমিটার খবর দাও তাহলে আমি তোমার সঙ্গে শুতে রাজি আছি।

কথাটা কানে যাওয়া মাত্র জন দৌড়তে শুরু করল খামারবাড়ির দিকে। সঙ্গে-সঙ্গে পৃথিবীর অশ্রাব্য শব্দগুলো ছুঁড়তে লাগল ওরা। এমনকী মেয়েটিও। বব কানে হাত দিলেন। ক্যারাভান আবার চলা শুরু করল।

কিন্তু ওরা জমিটা খুঁজে পেয়ে গেল। গ্রামের শেষপ্রান্তে পলের জমিতে কেউ কোর্টের আদেশ নিয়ে দাঁড়িয়ে না থাকায় ওরা ধরতে পেরে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে পিলপিল করে নেমে এল ওরা হাইওয়ে থেকে। গাড়িগুলো এমন করে সাজাল যাতে দেওয়াল হয়ে যায়। তারপর ত্রিপল তুলে ঘর। বানাল। মুহূর্তেই পলেদের সুন্দর মাঠ আর বাগান নরক হয়ে গেল। মাঠে নামবার সময় অবশ্য পুলিশ এবং শেরিফের সঙ্গে হিপিদের শেষবার ঝগড়া হয়ে গেল। যেখান সেখানে ক্যারাভান। রাখার নিয়ম নেই। তার জন্যে নির্দিষ্ট পার্কিং লট আছে। কিন্তু পুলিশ আইনত একটা সময় ঠিক করে দিতে পারে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে। হিপিরা স্পষ্ট বলে দিল যতক্ষণ না সরকারি সাহায্যে ওরা তেল কিনতে পারছে ততক্ষণে ওরা এখানে থাকছে। টিভির লোকেরা এখন ছবি তুলছে। ওপরতলায় খবর পাঠিয়ে পুলিশ খানিকটা দূরে অপেক্ষা করছে। হিপিরা রাত কাটাবার আয়োজনে ব্যস্ত।

যে ভয় করা হচ্ছিল তাই হল। শেরিফ বললেন, এখন আর জনকে কিছু বলে লাভ নেই। বুড়ো মানুষ, মুখফসকে বলে ফেলেছে।

পলেদের এক ছেলে বলল, কিন্তু ওরা আমাদের জমি নোংরা করে ফেলেছে এর মধ্যে। শুকনো ডালপালা ভেঙে আগুন জ্বালছে।

বব রেগে গেলেন, এখন এসব বলে কি হবে? ভাই-এ ভাই-এ ঝগড়া করার সময় খেয়াল ছিল না? কাল সকালে দেখবে ওখানে কিছুই পড়ে নেই।

ইলিংওয়ার্থ বলল, দেখতে হবে ওরা যেন গ্রামের মধ্যে না আসে। তবে জিনিসপত্র কিনতে চাইলে প্রবলেম হবে। কীসের প্রবলেম? বব জিজ্ঞাসা করলেন, কেউ কিছু বিক্রি করবে না। আজ গ্রামের সব দোকান বন্ধ করে দাও।

ওস্কার ছোঁকরা বলল, দেখছেন ওদের পয়সা নেই আর খামোকা আপনারা ভয় পাচ্ছেন। তবে দেখতে হবে ওদের কাছে এল এস ডি আছে কিনা! আমি কোনওদিন জিনিসটা দেখিনি।

শেরিফ বললেন, নো ওস্কার। কখনও ওসব করো না। তাহলে আমি কঠোর হতে বাধ্য হব। ওদের আজকের রাতটা কাটাতে দাও। পুলিশ কাল সকাল ছটার মধ্যেই ওদের তেল দেবে। ততক্ষণ আমরা ওয়াচ রাখতে পারি।

সঙ্গে-সঙ্গে একটা পাহারাদার বাহিনী তৈরি হয়ে গেল। ঠিক হল হিপিদের দৃষ্টির বাইরে জঙ্গলের আড়াল থেকে নজর রাখা হবে।

ছোট-ছোট তাঁবুও পড়েছে। খোলামাঠটায় আড়াই হাজার মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মাঝে-মাঝে উনুন জ্বলছে। কুৎসিত চেহারার লোকগুলো কাঁদছে। গাছের আড়ালে টেডের পাশে দাঁড়িয়ে বব দেখলেন সন্ধে হয়ে আসছে। আলো জ্বলল। অনেকটা বেদুইনদের মতো দেখাচ্ছে দূর থেকে। তিনটে হিপি মাটিতে বসে গাড়িতে হেলান দিয়ে ওটা কি খাচ্ছে? টেড বলল, গাঁজা। মেয়েগুলোর স্বাস্থ্য এককালে ভালো ছিল। এখন সবাই টলছে। সন্ধের হাওয়া বইবার পর থেকেই ঠান্ডা নেমেছে। কিন্তু ওই মেয়েটাকে দ্যাখো, পাতলা একটা লুজ খাটো প্যান্ট আর নাভি অবধি। নামা শার্ট পরে চোখের তলায় রং বোলাচ্ছে। মেয়েটার থাই ও পায়ে বেশ ময়লা। মোজা দূরের কথা একটা হাওয়াই চটি ছাড়া পায়ে কিছু নেই। অথচ কানে বাহারি গয়না ঝুলছে। বিকট সাজ। শেষ হলে মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে গান ধরল। গানের কথা শুনে চমকে উঠলেন বব। মেয়েটির গান ধরা মাত্র ওপাশ থেকে লিকলিকে রোগা একটা দাড়িওয়ালা হিপি চলে এল গিটার হাতে। মেয়েটা গাইছে, পুরুষজাতটার ওপরেই আমার ঘেন্না। পৃথিবীর সব পুরুষের শরীরের। ওপর পা ফেলে আমি জীবনটা কাটিয়ে দিই। আমরা পয়দা করি আর ওরা কৃতিত্ব নেয়। আমাকে একটা পুরুষ দাও যার মুখে প্রথমবার থুতু ফেলার সুখ পাব।

বব ফিসফিস করে বললেন, হরিবল!

টেড বলল, লুক বব, ওরা গাছগুলোর পেছনে প্রাকৃতিক কাজ শেষ করছে। আড়াই হাজার লোকের আবর্জনায় কাল গ্রামে থাকা যাবে না! তারপর হেসে বলল, পলেরা ভালো সার পাবে অবশ্য।

বব দেখলেন ক্যারাভানগুলোর ওপর বিচিত্র লেখা, আই অ্যাম কেয়ার অফ মি। আই অ্যাম ট্রাভেলিংফ্রম হেয়ার টু এটারনিটি। হোম ইজ মেড ফর হোমোস। জয়েন টু সি দ্য ওয়ার্ল্ড।

রাত বাড়লে একসময় সব শান্ত হয়ে গেল। সমস্ত মাঠ, চরাচরের সঙ্গে-সঙ্গে হিপিরাও ঘুমিয়ে পড়ল। মাঝে-মাঝে আগুনের কুণ্ডের পাশ থেকে অবশ্য বাচ্চাদের কান্না উঠছে। জড়ানো গলায় তাদের থামানোর চেষ্টা চলছে। কখনও-কখনও কোনও পুরুষকণ্ঠ চিৎকার করে কিছু বলল। ব্যস আর কিছু নয়। পুলিশের গাড়ি দূরে দাঁড়িয়ে। বব আর পারছিলেন না। তিনি বললেন, মনে হয় এবার আমরা যেতে পারি। ওরা সকালের আগে উঠবে না।

কিন্তু তখনই একটা ঘটনা ঘটল। ম্যাথুস দুটো ছেলেকে ধরেছে। তাদের বয়স বড়জোর সতেরো আঠারো। একজন কালো। চোরের মতো কখন হিপিদের আড্ডায় ঢুকে পড়েছিল। বেরুবার সময় ধরা পড়ে গেছে। ওদের কাছে পাউডার পাওয়া গেল। স্বীকার করল তিরিশ পাউন্ডে ওরা একটা হিপির কাছ থেকে তিনটে পুরিয়া কিনেছে। এর আগে কখনও নেশা করেনি, শুনেই এসেছে। কৌতূহলী হয়ে আজ এসেছিল। কালো ছেলেটা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয়জন এখানকার স্কুলমাস্টার মিস্টার গাওয়ারের ছেলে। শেরিফ বললেন, এ নিয়ে জল ঘোলা করে লাভ নেই। ওদের ছেড়ে দেওয়া হল। পুরিয়া দুটো নষ্ট করে ফেলে স্থির করা হল ব্যাচ বাই ব্যাচ পাহারা দেওয়া হবে। টেড বলল, বব, তোমার খামারবাড়িতে রাত্রে থাকা যাবে? বব আপত্তি করলেন না। তাঁর একবার মনে হল লিজাকে জানানো উচিত। তারপরেই স্থির করলেন, কোনও প্রয়োজন। নেই। গ্রামের সবাই জানে তাঁরা কি করছেন।

বারোটা পর্যন্ত বব পাহারায় ছিলেন। এর মধ্যে তিনি অনেকবার অসুস্থ বোধ করলেন। তাঁর মনে হল সেক্সকে এরা হাত ধোওয়ার চেয়ে সহজ করে ফেলেছে। হিপিনিদের তুলনায় হিপিরা সেক্স। সম্পর্কে অত্যন্ত নিস্পৃহ। নিজেদের কষ্ট দিতে এদের বেশ আরাম লাগে। ডিনারে যা ওরা খেয়েছে তা কোনও মানুষ খেতে পারে বলে ধারণায় ছিল না। কিন্তু সব ব্যাপারে ওরা বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়। সেই সাজুন্তি হিপিনি তিনজন পুরুষের সঙ্গে শোওয়ার চেষ্টা করে থুতু ছড়িয়ে এখন আগুনের পাশে চিত হয়ে পড়ে আছে। বারোটার সময় খামারবাড়িতে ফিরে এলেন তিনি টেডকে নিয়ে। জন খাবার করে রেখেছিল। তাই খেয়ে ওয়াইন নিয়ে বসে বব টেলিফোন করলেন বাড়িতে। এর মধ্যেই লিজা ঘুমিয়ে পড়েছে?

মিনিট দুয়েক পরে লিজার গলা পাওয়া গেল, হ্যালো বব।

বব বললেন, আজ আমি খামারবাড়িতে থেকে গেলাম ডার্লিং।

লিজা প্রশ্ন করলেন, তুমি খেয়েছ?

হ্যাঁ। জন বোকামি করে হিপিদের জায়গা বাতলে দিয়েছে।

একটু চুপ করে থেকে লিজা বললেন, কখনও-কখনও মানুষের মনে দয়ামায়া উঠে আসে, কি করবে বলো।

কথাটা খুব খারাপ লাগল ববের। তিনি বললেন, দে আর রিয়েল বিসট। তার চেয়েও অধম। একটা হিপিনি তিনটে লোকের সঙ্গে শোয়।

লিজা বললেন, ওটা রুচির ব্যাপার। বার্ধক্যেও অনেকে যুবতী হতে চায়, তাই না?

বব আবার হোঁচট খেলেন। লিজা কি ডোরার কথা বলছে? তিনি বললেন, যা হোক তুমি চিন্তা করো না। ও হ্যাঁ, আজ ডোরার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

জানি। তোমার বুকের ব্যথাটা কেমন আছে ডার্লিং?

এবার সত্যি ধক করে লাগল ববের বুকে। তিনি কোনওমতে বলতে পারলেন, এখন নেই, ডার্লিং, গুড নাইট।

গুড নাইট বব। লিজার গলার স্বর কি শীতল!

সকাল আটটায় হিপিরা চলে গেল। সরকারি সাহায্যে তেল কিনে, কিছুটা খাবার পেয়ে ওরা আবার হাইওয়েতে উঠে গেল। শেরিফ, বব, ইলিংওয়ার্থ, টেড, ম্যাথুজ, ওস্কাররা ওদের চলে। যাওয়ার পর বিষণ্ণ হয়ে পলেদের মাঠের দিকে তাকালেন। নরক হয়ে গেছে ওটা। মাঝে-মাঝে পোড়া ছাই, নোংরা এমনকী মলমূত্র ছড়ানো। বব বললেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ওরা গ্রামে ঢোকেনি। এই গ্রামের পবিত্রতা ওরা রাত্রে নষ্ট করে দিয়ে যেত তাহলে।

শেরিফ বললেন, তবু প্রত্যেককে চেক করো, অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা সবাই ঠিকঠাক আছে কিনা!

না, গ্রামের কারও গায়ে আঁচড় পড়েনি একমাত্র গাওয়ারের ছেলেটার ঘটনা ছাড়া। ওরা দুজনেরই শেরিফের কাছে গ্রামের সবার সামনে ক্ষমা চাওয়াতে ব্যাপারটা মিটেও গেল।

অত্যন্ত ক্লান্ত লাগছিল ববের। দশটা নাগাদ বাড়িতে ফিরলেন তিনি। লিজা এখনও ঘুমাচ্ছে। টিভি খুললেন। বি বি সি হিপিদের দেখাচ্ছে। দেখাক। এখন ওদের দায় পরের গ্রামের। ব্রেকফাস্ট তৈরি করে খেয়ে নিলেন বব। তারপর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে লিজার ঘরে উঁকি মারলেন। লিজা নেই। সাতসকালে কোথায় গেল?হয়তো আর্নল্ডের বাড়িতে।

নিচে নেমে বব আবার টিভি খুলে পা ছড়িয়ে বসলেন। ঘুম পাচ্ছে। কাল রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি। বিজ্ঞাপনের পালা শেষ হলে সেই সুন্দরী সংবাদ-পাঠিকা আবার পরদায় এলেন, এখন আপনারা একটি স্পেশ্যাল ইন্টারভিউ দেখতে পাবেন।

সঙ্গে-সঙ্গে টিভির পর্দায় হাইওয়ের ছবি ভেসে এল। হিপিদের কনভয় চলছে। পাশের গ্রামের লোকরা তাদের জমির সামনে আদালতের আদেশ হাতে দাঁড়িয়ে। হিপিদের নেতা সেই লাল

দাড়ির সঙ্গে টিভির প্রতিনিধি কথা শুরু করল। নেতা বলল, মনে হচ্ছে আপাতত আমাদের কোনও অসুবিধে হবে না। আমরা দু-হাজার পাঁচশো একজন ঠিকঠাক যেতে পারব।

সংখ্যাটা ঠিক আছে? একজন বাড়ল না?

হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। আমাদের দলে একজন এসেছেন।

সঙ্গে-সঙ্গে একটা ক্যারাভানের দরজায় টিভির ক্যামেরা। আর চমকে সোজা হয়ে বসলেন বব। নিজের চোখকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছিল।

এবার বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। কাঁপা হাতে কৌটোটা খুলে ট্যাবলেট জিভে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন বব। পরদায় তখন ক্যারাভনের ভেতরে ছবি ফুটেছে। একটি কিশোরী হিপিনি লিজাকে সাজিয়ে দিচ্ছে একটু-একটু করে হিপিনির চেহারা পাচ্ছেন লিজা। টিভির প্রতিনিধির প্রশ্ন ভেসে এল, আপনার নাম যদি অনুগ্রহ করে বলেন।

লিজার কুঁচকে যাওয়া মুখে হাসি ফুটল, আমি লিজা ছিলাম। এখন কি নাম হবে জানি না।

আপনি কি এখন জয়েন করলেন?

হ্যাঁ। রাত চারটের সময়।

আপনি এতকাল কি করতেন?

হাউসওয়াইফ ছিলাম। স্বামীর সংসার দেখেছি, তার বাচ্চাদের মানুষ করেছি, তিনি যত কষ্ট দিয়েছেন সয়েছি, যা আনন্দ দিয়েছেন তা ভোগ করেছি। আপনি কখনও গ্রামের বাইরে যাননি?

না, কখনও না। যাও বা গিয়েছি স্বামী নিয়ে গেলে তার সঙ্গে। আটচল্লিশ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। মেয়েদের যা হয়, ক্রীতদাসীর মতো তাঁর ইচ্ছে নিজের ইচ্ছে বলে জেনেছি।

তিনি কি অত্যাচার করতেন আপনার ওপর?

না। তিনি মানুষ হিসেবে ভালোই ছিলেন। সরাসরি কষ্ট দিতেন না।

গ্রামের সবাই তো হিপিদের ঘেন্না করে, তাই না?

করে। কিন্তু ওরা ভয় পায় বলেই করে।

আপনি কেন হিপিনি হলেন?

বললাম তো, বিয়ের পর সংসার আর স্বামী ছাড়া আর কিছুই আমাকে দেখতে দেওয়া হয়নি। এরা লিখেছে এদের গন্তব্য ফ্রম হেয়ার টু এটার্নিটি। কত ঘুরে বেড়ায় এরা। পৃথিবীটাকে দেখব বলে এদের সঙ্গে চলে এলাম।

আপনার স্বামী কিছু বলবেন না?

লিজার মুখ শক্ত হল, আটচল্লিশ বছরে অনেক সুখ দিয়েছি তাঁকে। আমার আর কোনও দায় নেই তাঁর কাছে।

শেষ প্রশ্ন, আপনার বয়স কত?

ফিক করে হেসে ফেলল লিজা, মেয়েদের বয়স জিজ্ঞাসা করতে নেই, জানেন না? আমি আমার স্বামীর চেয়ে চার বছরের ছোট ছিলাম।

সেই সময় কিশোরীটি লিজার চোখের তলায় কালো রং বুলিয়ে দিল। কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় রং বসাতে বেচারার কষ্ট হচ্ছিল।

বব এক হাতে বুক ধরে অন্য হাতে আবার কৌটোটাকে খুঁজছিলেন। ক্রমশ এই ঘর, ঘরের দেওয়াল তাঁর কাছে অস্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছিল। শুধু তীব্র একটি চৌকো আলো সমানে জ্বলছে কিন্তু সেটা টিভি কিনা এমন বোধ তাঁর ছিল না। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে তিনি বলতে চাইছিলেন, লিজা, আমাকে ট্যাবলেটটা খুঁজে দাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *