হাসি কোথায় হারিয়ে গেল
সাহিত্য জীবনেরই ছবি। জীবন থেকে হাসি উবে গেছে সাহিত্য ক্রমশ হয়ে উঠছে গোমড়ামুখো। সাহিত্যের চরিত্র তো আমরাই। আমরা হাহা করে হাসতে ভুলে গেছি, সাহিত্যও হাসতে ভুলেছে। শুধু এদেশ নয় সারা দুনিয়ার জীবন ও সাহিত্যের একই অবস্থা। অবশ্য একটা কথা মনে রাখতে হবে, হাসির ব্যাপারটা হল জীবনের চটুল দিক। যে মানুষ হ্যা হ্যা করে হাসে বা হাসায় তার ব্যক্তিত্বকে আমরা অন্য চোখে দেখি। একটু তাচ্ছিল্যও মেশানো থাকে, লোকটা ভাঁড়, বেশি কথা বলে, বাচাল। যাঁরা জাতের মানুষ, বুদ্ধিজীবী, ইনটেলেকচ্যুয়াল, তাঁরা গম্ভীর প্রকৃতির। গোমড়ামুখো। হাসলেই তাঁদের পার্সোন্যালিটি ‘লিক’ করে যাবে এই রকম একটা ধারণা। ‘থাম্পিং পার্সোন্যালিটি’ ক্ষেত্রে হাসা হাসানো বেমানান। যে জজ সাহেব হাসেন তিনি একটু নিরেস। আশুবাবু হাসতেন না। বাঘের মতো ব্যক্তিত্বের আবরণে কোনও রকম হাসির ফাটল দেখা দিলে চলবে না। গোর্বাচভ হাসেন, ত্রুশ্চেভও হাসতেন। কালের বিচারে প্রমাণ হল, ত্রুশ্চেভ ছিলেন জোকারের মতো। তাঁর হাসি ছিল বড় আন্তরিক। সত্যিই হাসতেন, ‘কমান ম্যানস লাফ’। পলিটিক্যাল হাসির জাত আলাদা। ‘রেগুলেটেড, মেজারড, পাংচ্যুয়েটেড উইথ গ্র্যাভিটি, পাপসিভ।’ মেজারিং গ্লাসে ঢেলে মদ পরিবেশনের মতো। ডিপ্লাম্যাটিক হাসি। রেগন হাসেন। থ্যাচার হাসেন। রাজীব হাসেন। জ্যোতিবাবু কদাচিৎ হাসেন। সচেতন হাসি। সার্কাস্টিক স্মাইল। উচ্চ কোটির বুদ্ধিজীবী, ক্ষমতাশালী মানুষদের হাসা উচিত নয়। হাসবে বোকারা, সাধারণ এলেবেলে মানুষরা। স্ট্যাটাস যত বাড়বে, মুখ তত গম্ভীর হবে। চালাতে হবে ‘কনসাস এফর্ট নট টু স্মাইল।’ হাসি হল নীচুতলার জিনিস। হাসির লেখা বা রসসাহিত্যও নীচু তলার জিনিস। সাহিত্য বলা হচ্ছে ক্ষমা ঘেন্না করে, আসলে লিটারেচার নয় ‘এন্টারটেনমেন্ট’। সাহিত্যের যাঁরা জাত বিচার করেন, তাঁরা রসসাহিত্যকে হাসির লেখা বলে একটু উপেক্ষার চোখেই দেখেন। সাহিত্যের সুর যাঁরা বেঁধে দিয়ে গেছেন তাঁরা হলেন শেকসপিয়র, তলস্তয়, টমাস মান, টমাস হার্ডি, কামু, কাফকা, জিদ, সুইগ, জয়েস, প্রুস্ত প্রমুখ বরেণ্যরা। এঁদের উপজীব্য সমাজ, মনোবিকার, আশাভঙ্গ, প্রেম, বিচ্ছেদ, যৌনতা, রাজনীতি অজস্র জটিল সব ব্যাপার। জীবনের ‘গেল গেল’ দিক নিয়েই ছিল তাঁদের কারবার। এর মধ্যে রাশিয়ানদেরই বলা হয় উপন্যাসের জনক। আগের সারিতে আর দুটি নাম যোগ করতে হবে, ডস্টয়েভস্কি আর শেখভ। শেকসপিয়র তাঁর নাটকে যখনই লঘু সুর আনতে চেয়েছেন, তখনই এনেছেন এক বোকাকে, ‘এন্টার এ ফুল’। অথবা ‘জেস্টার’। তাঁরা ভালো ভালো সুন্দর সুন্দর কথা বললেও হীন পার্শ্ব চরিত্র। সাহিত্যে নায়ক হবার যোগ্যতা তাঁদের ছিল না, দার্শনিক হওয়া সত্বেও। চরিত্রের সঙ্গে চরিত্রকারের অবস্থারও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সাহিত্যের অঙ্গনে রসসাহিত্যের লেখকদের একটু হাসির চোখেই দেখা হয়—আরে ও তো হাসির লেখক। সমালোচকরাও খুব একটা সুনজরে দেখেন না।
অথচ হাসির লেখা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। হা হা করে হাসছে বললে হাসি আসে না। হাসির সিচ্যুয়েশান তৈরি করতে হবে। মানুষ কেন হাসে! হাসে জীবনের অসঙ্গতি দেখে। চরিত্রের অসম আচরণ দেখে। বোকামি দেখে। বিপন্ন মানুষকে দেখে হেসে ওঠার মধ্যে ভদ্রতা নেই। তবু আমরা হাসি। পিছল উঠোনে স্বামী পড়লেন, স্ত্রীর হাসি। হাসি মানে সহানুভূতির অভাব নয়। স্ত্রী এগিয়ে আসবেন হাসতে-হাসতে স্বামীকে তোলার চেষ্টা করবেন। পিছল উঠোনে সাবধান হবার উপদেশ দেবেন। তারপর নিজেই উলটে পড়বেন। তখন দুজনেই হা হা করে হাসবেন। ঘটনার যাঁরা সাক্ষী তাঁদেরও হাসি হবে অকৃত্রিম। এই দ্বিতীয় হাসিটি প্রকৃতই উঁচুদরের হাসি। মোটা হাসি নয়, সূক্ষ্ম হাসি। যে হাসির মধ্যে একটি ছোট্ট দার্শনিক স্পন্দন আছে। শেকসপিয়র যাকে একটি লাইনে অমর করে রেখে গেছেন—ফিজিসিয়ান হিল দাই সেলফ। অন্যকে সাবধান হতে বলার সময় সচেতন হওয়া উচিত, আমি সাবধান কি না। দেয়ালে পেরেক ঠোকার চেষ্টা করছে ছেলে। বাবা এসে বলছেন, আরে সর সর এখুনি বুড়ো আঙুলের মাথায় হাতুড়ি বসিয়ে দিবে, নখ থেঁতো হয়ে যাবে। সাবধানি পিতা। হাতুড়ির প্রথম ঘাটাই পড়ল তাঁর নিজের আঙুলের মাথায়। ঘটনার যাঁরা সাক্ষী তাঁরা অবশ্যই হাসবেন। যদিও ঘটনায় হাসির উপাদান নেই, আছে পিতৃস্নেহের প্রকাশ। ট্র্যাজেডি যখন কমেডির চেহারা নেয়, তখন তার চেয়ে বড় কমেডি আর কিছু হতে পারে না।
সুষম চরিত্রে হাসি থাকবে, মনোবেদনা থাকবে। আশা থাকবে, হতাশা থাকবে। সেই কারণে শুধু হাসির লেখা শুধুমাত্র কান্নায় লেখা হয় না। হাসিকান্নায় মেশানো একটা ব্যাপার হতে পারে। সমস্ত চরিত্রকে সামাজিক পটভূমিকায় ফেলতে হবে তারপর প্যারিসের ন্যাশন্যাল রিসার্চ দ্য সাইন্টিফিকের এসথেটিকস বিভাগের ডিরেক্টার মাইকেল জেরাফা যেমন বলছেন the proper way to treat a character in a novel is for him first to be conditioned by Society, and secondly to become its victim যা হয়, নায়ক মরে প্রমাণ করেন সমাজ দুষ্ট, অথবা সমাজ সুস্থতা থেকে অনেক দূরে।
সাহিত্য আর জীবনের আলোচনায় বিদেশি উদাহরণই আসে। কারণ এসথেটিকস নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত বিদেশেই। উপন্যাস গল্পের ফর্ম কী হবে, স্টাইল কী হবে, এ সব পরীক্ষা নীরিক্ষা বিদেশেই হয়েছে বেশি। কথায় কথায় প্রস্তু, সেলিন, ফকনার, স্তাঁদালচ ভসপ্যাসোস এসে পড়েন। আসেন সার্ত্র। জয়েস, কাফকা।
আমরা সাহিত্য নিয়ে সাহিত্যের নেপথ্যদর্শন নিয়ে অতটা মাথা ঘামাই না। উপন্যাসের প্রথম যুগে বঙ্কিমচন্দ্র রমেশচন্দ্রকে বলেছিলেন, তোমরা শিক্ষিত মানুষ, তোমরা যা লিখবে তাই সাহিত্য হবে। একালের একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমল কর, তাঁর অব্যবহিত আগের যুগের সাহিত্যিকদের লেখার আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আমাকে বলেছিলেন, ‘তাঁদের মনোভাবটাই ছিল এই রকম—আমি বাপের ব্যাটা লিখেছি, তোমাদের পড়তে ইচ্ছে হয় পড়ো, না ইচ্ছে হয় ফেলে দাও।’ লেখকের উদ্দেশ্য যদি পাঠকের মনোরঞ্জন হয়, তিনি যদি আত্মজীবনীমূলক লেখার মাধ্যমে নিজের মনোরঞ্জন চান, তাহলে সাহিত্য সমালোচনার প্রেক্ষিতে তিনি সেকেন্ড রেট নভেলিস্ট।
বঙ্কিমচন্দ্র কি হাসির লেখা লিখতে পারতেন না। অবশ্যই পারতেন। তাঁর সময়ে সমাজে অজস্র হাসির উপাদান ছিল, তাঁর চোখ ছিল, কলম ছিল। তিনি ও রাস্তা মাড়ালেন না। কারণ তিনি নভেল লেখার সময় বিদেশি একটি মডেল সামনে রাখলেন, স্যার ওয়াল্টার স্কট। সময় সময়ে তিনি সরে গেলেন স্যাটায়ারের দিকে। গোপাল ভাঁড়ের চেয়ে ডিকেনস কি সারভানটেস অনেক উঁচুদরের। ভাঁড়ামি হল দিশি ব্যাপার, মাটির খুরির মতো। স্যাটায়ার হল বিলিতি ব্যাপার। প্লেষ আর ব্যঙ্গের চাবুক মেরে সমাজকে শায়েস্তা করা। বিলিতি হান্টার। দীনবন্ধু, অমৃতলালের হাতে এই স্যাটায়ার আরও খুলেছিল। তবে বঙ্কিম ছিলেন অনেক হিসেবি পরিশীলিত, ট্রু আর্টিস্ট। অমৃতলালকে রসরাজ বলা হত। তিনি ছিলেন জনপ্রিয়, তবে সূক্ষ্ম রস বা পরিমিতি বোধের অভাব ছিল। আধুনিক চিত্রশিল্পীদের মতো মানুষের মুখের আদলকে বড় বেশি বিকৃত করে ফেলতেন। হাসির সঙ্গে অপরিমিত বা একসেসের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে আছে।
শরৎচন্দ্র ইচ্ছে করলে অসাধারণ হাসির লেখা লিখতে পারতেন। তাঁর হাতে চরিত্র ছিল। শ্রীকান্তের প্রথম পর্বে সে ক্ষমতা তিনি দেখিয়েছিলেন জায়গায় জায়গায়, সরে এসেছেন কারণ তিনি সাহিত্য করতে চেয়েছিলেন, স্যোশাল ইনজাস্টিসকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কজালিটি আর ডেস্টিনির সমন্বয়। শরৎচন্দ্রকে আমরা বলি জীবনশিল্পী। তিনি জানতেন উপন্যাস হল যা ঘটেছে তার উপস্থাপনা, সেই ঘটনার ব্যাখ্যা আর কোন ভবিষ্যতের দিকে চলেছি তার দিকনির্দেশ। The novel thus assumes the guise of oracle. সমাজ ও সময় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না, সর্বোপরি সব মানুষেরই একটা অতীত আছে। বর্তমান আছে। ভবিষ্যৎ আছে। সাহিত্যে স্বাক্ষর রেখে যেতে হলে উপন্যাসের ব্যাকরণ মানতেই হবে। প্ট, ক্যারেকটার, সেটিং আর থিম। আর এই চারটি উপকরণই চিরকাল লেখকের সঙ্গে শত্রুতা করে। স্ট্রাকচারের কথাও ভাবতে হয়। উপাদান হল ভাষা আর মনস্তত্ব। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছে করলে অসাধারণ হাসির লেখা লিখতে পারতেন। অজস্র হিউমার ছড়িয়ে রেখে গেছেন।
আসলে হাসির একটা সংজ্ঞা তৈরি করেছে মোটা দাগের সিনেমা ও নাটক। যার সঙ্গে হিউমার বা স্যাটায়ারের যোগ নেই। মানুষের চলা বলা উদ্ভট কর্মকাণ্ড থেকে যে হাসি তাতে মাথা নেই, আছে শরীর। ইংরেজি স্ল্যাপস্টিক কমেডি দেখলে মনে হতে পারে, এ আবার কী? উদাহরণ লরেল হার্ডি। দানবীয় সব ব্যাপার স্যাপার। সার্কাসের ক্লাউন মগজধারী মানুষকে হাসাতে পারে না। হাসে শিশুরা। চার্লিচ্যাপলিন বিশ্ববিশ্রুত, সোশ্যাল স্যাটায়ারের জোরে। মানুষ হাসে তাঁর প্রতিভার প্রকাশ দেখে। একটি চরিত্র আর সমাজ তার বিড়ম্বনা তার নিষ্পেষণ কোনওটাই সুখের নয়। ব্যক্তিগত দু:খ ইউনিভার্সাল হয়ে আনন্দের হাসি টেনে আনছে। আইডেন্টিফিকেশানের আনন্দ। লেখক অথবা অভিনেতা ধরে ফেলেছেন। তাঁর সাফল্যের আনন্দে আমরা হাসি।
মজা বা আনন্দ মোটা দাগের ঘটনায় নেই। আছে বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায়। ত্রৈলোক্যনাথ, রাজশেখর, কেদারনাথ যাঁদের আমরা হাসির লেখক হিসেবে আলাদা একটা জাতে সরিয়ে রেখেছি, তাঁরা সকলেই ছিলেন হিউমারিস্ট স্যাটায়ারিস্ট। কেদারনাথ ছিলেন নির্ভেজাল হিউমারিস্ট। তাঁর লেখা আজকাল আর কেউ পড়ে না। কিন্তু ইংরেজ-বাঙালির তিনি খুব প্রিয় লোক ছিলেন। যখন বাঙালি অ্যাটর্নিদের খুব দাপট। বাঙালি যখন গর্ব করে বলতে পারত, হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে। যখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী বলতে বাঙালিকেই বোঝাত। তাঁর ‘আই হ্যাড ভাদুড়িমশাই’ ‘কোষ্ঠীর ফলাফল’ ‘চীন যাত্রার ডায়েরি’ একসময়ে বাঙালির খুব আদরের গ্রন্থ ছিল। একসেন্ট্রিক কিছু চরিত্রের কাণ্ড কারখানা ছিল তবে সেইটাই সব নয়, আসল মজাটা ছিল বাঙালির প্রাচুর্যের চিত্রে, সাফল্যের চিত্রে আর হিউমারে। ছোটখাটো স্যাটায়ার ছিল; তবে চাবুক নয় চিমটি। কেদারনাথের লেখা ভয় পাইয়ে দিত না। ভাঙনের চিত্র ছিল না। পড়তে ভালো লাগত। তিনি যাঁদের নিয়ে লিখতেন তাঁদের জীবন ছিল সুখের।
ত্রৈলোক্যনাথ পুরোপুরি স্যাটায়ার করেছেন। রক্তমাংসের চরিত্র সৃষ্টির প্রয়াস তাঁর ছিল না। তিনি এমন একটা ফর্ম ও স্টাইল খুঁজে নিয়েছিলেন যা তাঁর নিজস্ব। তাঁর ব্যঙ্গবিদ্রূপের উপযোগী। ‘ডমরুচরিত’ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। ডমরুধর টিপিক্যাল একটি বাঙালি চরিত্র। কৃপণ, স্বার্থপর, ধান্দাবাজ, হামবড়া, গুলবাজ। এই চরিত্রের মুখ দিয়ে গল্পের আকারে তিনি সে যুগের সমাজ ও লোকাচারকে ব্যঙ্গ করেছেন। সুন্দর টেকনিক সুন্দর ফর্ম অপূর্ব পর্যবেক্ষণ। ডেসমন্ড মরিস, জন বারজার, গফম্যান অবলোকনকে বিজ্ঞান করে তোলার আগেই ত্রৈলোক্যনাথ পর্যবেক্ষণকে সুন্দরভাবে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর রচনায়। অশিক্ষিতের পয়সা হলে তার কেমন দেখাবার প্রবণতা বাড়ে। গ্রামপণ্ডিতদের চালচলন। স্বামীস্ত্রীর আচরণ। ডমরুধর শিক্ষিত হয়ে অনেক পরে ফিরে এসেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র ও গৌরকিশোর ঘোষের কলমে। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মহাস্থবির জাতকের প্রথমপর্বের কোনও তুলনা হয় না। ইংরেজ আমলের পিতা ও তার সংসার। বিপদ হল, প্রথম খণ্ড অন্য খণ্ডগুলিকে ম্লান করে দিয়েছে। প্রেমাঙ্কুর হাসির লেখক ছিলেন না। জীবন ধরে টানতে গিয়ে যেখানে-যেখানে হাসি ছিল সেইখানে-সেইখানে বেরিয়ে এসেছে। শরদিন্দু দ্বিতীয় দাদার কীর্তি লেখেননি। বিমল কর লেখেননি দ্বিতীয় বালিকা বধূ। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় মূলত মিষ্টি পারিবারিক ও রোমান্টিক গল্পলেখক। তাঁর কলম থেকেও একটি বরযাত্রীই বেরল। আসলে জাত খোয়াবার ভয়ে অনেক শক্তিশালী লেখক হাসি থেকে সরে গেছেন। কারণ সম্মান নেই, পুরস্কার নেই। পরশুরাম রাজশেখর একমাত্র স্যাটায়ারিস্ট যিনি কখনও হাসির উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেননি। তিনি জানতেন হাসির উপন্যাস হয় না। তিনি কাতুকুতু নিয়ে হাসাবারও চেষ্টা করেননি তবে একজাজারেট করেছেন। মানুষের দুর্বল দিককে ম্যাগনিফাই করেছেন। বাস্তব থেকে সরে এসে কল্পবাস্তব তৈরি করেছেন প্রয়োজনে। তাঁর নিজস্ব ফর্ম ও স্টাইলে সেটা মানিয়ে গিয়েছে। ফ্যাবুলেশান। লেস রিয়ালিস্টিক অ্যান্ড মোর আর্টিস্টিক। একজন আর্টিস্টের সে স্বাধীনতা আছে। The art of fiction has something in common with the art of painting.
হাসির ব্যাপারটা পুরোপুরি ভিস্যুয়াল। চরিত্রের বিড়ম্বনা চোখের সামনে দেখতে হবে। তার মুখ চোখের ভঙ্গি, হাঁটা চলা, কথাবলা। যে কারণে চার্লি হলেন চিরকালের ক্লাউন। ছায়াছবির পর্দা আর মঞ্চ নিজস্ব ঢঙে হাসির একটা ব্র্যান্ড তৈরি করেছে। ছাঁচ তৈরি করে ফেলেছে, যে ছাঁচের আদলে বুদ্ধির হাসি, স্মিত হাসি আসে না। অক্ষরের শরীরে হিউমার স্যাটায়ার খোলে ভালো। হা হা হাসির রেখা তেমন ফোটে না। ভূত দেখা এক অভিজ্ঞতা, ভূতের গল্প অনেক জলো। গতানুগতিক। আমাদের হাসি কমেনি, ধরন পালটেছে। উপাদান ভিন্ন হয়েছে। বাজার থেকে বেরিয়ে এসে ভদ্রলোক হেসে কুটোপাটি। কারণ? আরে মশাই গিরীশবাবু, ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’—বলে কাঁদতেন না, হা হা করে হাসতেন। কান্নাকে হাসি করে তোলার আর্ট বড় কঠিন। তা ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর উপন্যাস বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মন নিয়ে। রাজনীতি নিয়ে। সেক্স নিয়ে। We live in an age in which fiction has conspicuously grown more provisional more anxious more self-questioning than it was a few years ago.—Malcolm Bradbury.