হাসি-কান্না

হাসি-কান্না

অধরোষ্ঠ প্রসারিত করিয়া দন্তনিষ্কাশনপূর্বক সশব্দে অথবা নিঃশব্দে মুখের একপ্রকার ভঙ্গি করার নাম হাসি। আবার, ঠিক উক্ত প্রকারে অধরোষ্ঠ প্রসারণ ও দন্ত বিকাশ করিয়া অনুরূপ মুখভঙ্গি করিলে উহা কান্না নামে অভিহিত হইয়া থাকে। উভয়বিধ অভিব্যক্তির মধ্যে সীমারেখা অতিশয় সূক্ষ্ম। তবে মৎসদৃশ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা সহজেই উহাদের পার্থক্য ধরিয়া ফেলিতে পারেন।

অপিচ, হাসির সহিত আনন্দ নামক মনোভাবের একটা নিত্য-সম্বন্ধ আছে এইরূপ অনেকে মনে করেন, এবং কান্নার সহিত তদ্বিপরীত। এরূপ মনে করিবার সঙ্গত কারণ আছে বলিয়া আমার মনে হয় না। আমি একটি মহিলাকে জানিতাম, মনে কোনপ্রকার ক্লেশ উপস্থিত হইলেই তিনি হাসিতেন; এমন কি মৃত্যুকালেও তিনি হাসিয়াছিলেন। কিন্তু সে যাক।

আজ রুচিরার হাসি-কান্নার কাহিনী বলিব। রুচিরা মেয়েটি সামান্য নয়। তাহার বয়স ঊনিশ বছর, কলেজের বি. এ. ক্লাসের ছাত্রী এবং—কিন্তু সে কালো। তাহাকে কালো বলিলেই সে হাসিত।

কালো মেয়ে বাংলাদেশে অনেক আছে, সেজন্য ক্ষতি ছিল না। কিন্তু দৈব-পরিহাস এই যে, রুচিরার খুড়তুত বোন ছন্দা অপূর্ব সুন্দরী, ডানাকাটা পরী বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। দু’জনে সমবয়স্কা, একসঙ্গে পড়ে, এক বাড়িতে থাকে, দু’জনেরই পিতা বর্তমান এবং একান্নবর্তী। ইহাতেও বোধ করি ক্ষতি ছিল না, কিন্তু একটি আগন্তুক কোথা হইতে আসিয়া রুচিরার হাসি-কান্নার সহিত মিশিয়া গিয়া ব্যাপারটা যৎপরোনাস্তি জটিল করিয়া তুলিয়াছিল।

এই আগন্তুকের কথা আনুপূর্বিক বলা প্রয়োজন। একদিন সন্ধ্যাকালে ছন্দা ও রুচিরা কোনও একটি কৃত্রিম হৃদের উপকণ্ঠে বসিয়া নিজেদের পড়াশুনার অসম্পূর্ণতার কথা লইয়া তর্ক করিতেছিল। বাৎসরিক পরীক্ষা সমাগতপ্রায়, অথচ দু’জনেরই এমন অ-প্রস্তুত অবস্থা যে, পরীক্ষায় প্রকাশ্যভাবে অপ্রস্তুত হইবার সম্ভাবনা অনিবার্য হইয়া উঠিয়াছে। এরূপ ক্ষেত্রে একজন গৃহ-শিক্ষকের সাহায্য যে একান্ত প্রয়োজন, ইহাই দুই বোনে একমত হইয়া তর্ক করিতেছিল। মেয়েদের তর্ক করিবার ইহাই রীতি, তাহারা একমত হইলেও তর্ক শেষ হয় না।

ছন্দা বলিল, ‘ইংরেজী আর বাংলা কোনও রকমে চালিয়ে নেব, কিন্তু আমার মাথা খাবে—সংস্কৃত। মৃচ্ছকটিক পড়েছিস? কিছু বুঝতে পারিস?’

রুচিরা আকাশের দিকে তাকাইয়া বলিল, ‘আমার মাথা খাবে—ফিলজফি। ভোলিশান আর রিফ্লেক্‌স্‌ অ্যাকশনের তফাৎ বুঝতে পারিস?’

ছন্দা বলিল, ‘কিছু না; ঝাড়া মুখস্থ করেছি।— কিন্তু সংস্কৃত যে ছাই মুখস্থও হয় না।’

গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া রুচিরা বলিল, ‘মাস্টার—একটা মনের মতন মাস্টার না হলে দু’জনেই গেলুম—’

তাহাদের পিছনে রাস্তার পাশে মোটর দাঁড়াইয়া ছিল। মোটরে তাহারা বায়ু সেবন করিতে আসিয়াছে, মোটরেই ফিরিবে। রুচিরা উঠিবার উপক্রম করিল।

ছন্দা তাহার আঁচল ধরিয়া বসাইবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘কিন্তু এমন মনের মতন মাস্টার পাবি কোথায়?’

রুচিরা মাথা নাড়িল, ‘নেই। আমার সঙ্গে ইয়ার্কি দেবার চেষ্টা করবে না, তোর পানে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে না—কেবল সংস্কৃত আর ফিলজফি পড়াবে—এমন মাস্টার ভূ-ভারতে নেই। চল, বাড়ি যাই।’

দু’জনে উঠিয়া দাঁড়াইল, তারপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বসিয়া পড়িল।

অনতিদূরে আর একটা বেঞ্চির উপর যে একজন লোক বসিয়া আছে, তাহা ইতিপূর্বে কেহই লক্ষ্য করে নাই। এখন লোকটি তাহাদের সম্মুখে আসিয়া একবার করযুগল যুক্ত করিয়া দাঁড়াইল, গম্ভীর স্বরে বলিল, ‘মাফ করবেন, আপনারা কি মাস্টার রাখতে চান?’

ছন্দা ও রুচিরা নির্বাক হইয়া লোকটির পানে তাকাইয়া রহিল। টুইলের হাফ-শার্ট পরা যুবক, মাথার চুল এলোমেলো। চোখের দৃষ্টিতে গাম্ভীর্য, অধরোষ্ঠে একটু ছেলেমানুষী ভাব।

কিছুক্ষণ দম লইয়া রুচিরা ক্ষীণস্বরে প্রশ্নের উত্তর দিল; বলিল, ‘হ্যাঁ।’

যুবক বলিল, ‘তাহলে যদি আপত্তি না থাকে, আমি আপনাদের পড়াতে পারি। মৃচ্ছকটিক একটি বস্তুতান্ত্রিক নাটক; ইব্‌সেন অমন নাটক লিখতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতেন। আর, ভোলিশান এবং রিফ্লেক্‌স অ্যাক্‌শনের তফাৎ আমি এক মিনিটে বুঝিয়ে দিতে পারি।’

ছন্দা আচ্ছন্নের মতো বলিল, ‘আপনি—আপনি কে?’

যুবক বলিল, ‘আমার নাম সরিৎ হালদার। আমি একজন বেকার যুবক; অর্থাৎ কোনও কাজই করি না। তবে, সুযোগ পেলে কাজ করতে রাজী আছি।’

রুচিরা দ্বিধা-জড়িত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি কি এম. এ. পাস করেছেন?’

সরিৎ বলিল, ‘দু’বার। ফিলজফিতে এবং সংস্কৃতে।’

দুই বোন পরস্পর মুখের পানে চাহিল।

ছন্দা বলিল, ‘বেশ। কাল আমাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করবেন।’ বলিয়া নিজেদের ঠিকানা দিল। যুবকের চোখের গাম্ভীর্য ও অধরোষ্ঠের ছেলেমানুষী গাঢ়তর হইল; সে একবার মাথা ঝুঁকাইয়া প্রস্থান করিল।

গাড়িতে বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে ছন্দা একসময় ভিতরকার আলো জ্বালিয়া রুচিরার দিকে চাহিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। রুচিরাও মুখ টিপিয়া হাসিল।

রুচিরার হাসিটি বড় মিষ্ট। আর ছন্দার—ছন্দার কথা বলিতে গেলেই রবীন্দ্রনাথের রামেন্দ্র-প্রশস্তির কথা মনে পড়ে—তোমার হাস্য সুন্দর, তোমার চাহনি সুন্দর—ইত্যাদি।

পরদিন হইতে সরিৎ হালদার ছন্দা ও রুচিরার মাস্টার নিযুক্ত হইল। কর্তারা বুঝিলেন, ছোকরা দুঃস্থ এবং পণ্ডিত। মেয়েরা দেখিল, দুঃস্থ এবং পণ্ডিত হইলেও মাস্টার সাধারণ লোক নয়। সে রুচিরার সহিত ইয়ার্কি দিবার চেষ্টা করিল না, ছন্দার দিকে ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া রহিল না—চোখে গাম্ভীর্য ও অধরোষ্ঠে ছেলেমানুষী ভাব লইয়া ছাত্রীদের সংস্কৃত ও ফিলজফি শিখাইতে লাগিল।

মাস্টারের বয়স বোধ করি চব্বিশের বেশী নয়। মাথার চুল এলোমেলো, বেশভূষার পারিপাট্য নাই, প্রত্যহ দাড়ি কামাইবার কথাও স্মরণ থাকে না। কিন্তু অদ্ভুত তাহার পড়াইবার ক্ষমতা; শুধু যে সে কঠিন বিষয়কে সহজ করিয়া বুঝাইয়া দিতে পারে তাহাই নয়, শিক্ষার্থিনীদের মনের মধ্যে কঠিন বস্তুকে তরল করিয়া তাহাদের সত্তার সহিত মিশাইয়া দিতে পারে। বিদ্যা তখন কেবল জ্ঞানের পর্যায়ে থাকে না, উপলব্ধির পর্যায়ে গিয়া উপস্থিত হয়। ছাত্রী দু’টি লেখাপড়ার মধ্যে তন্ময় হইয়া গেল।

কিন্তু চিরন্তনী শবরী তো লেখাপড়ার মধ্যে তন্ময় থাকে না। পরমা প্রকৃতির বিধি-বিধান অন্যরূপ। ছন্দা ও রুচিরার সুগহন অন্তর্লোকে হয়তো গোপনে গোপনে যে দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইয়া যায়, তাহা তাহারা নিজেরাও ভাল করিয়া জানিতে পারে না।

জলের ভিতর দিয়া বৈদ্যুতিক স্রোত প্রেরণ করিলে জল বিপরীতধর্মী দুটি বাষ্পে পরিণত হয়; হাইড্রোজেন আগুনের সংস্পর্শে জ্বলিয়া উঠে, অক্সিজেন নিজে না জ্বলিয়া অগ্নিকে আরও দীপ্তিমান করিয়া তোলে। আশ্চর্য প্রকৃতির ইন্দ্রজাল। ছন্দা ও রুচিরা এতদিন জলের মতো ওতপ্রোতভাবে পরস্পর মিশিয়া ছিল, এখন যেন বিদ্যুতের সংস্পর্শে দ্বিধা হইয়া গেল। কবে এবং কখন এই সব বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ঘটিল, তাহা কেহ জানিল না।

দু’জনের পড়িবার ঘর একই; একটি টেবিলের দু’পাশে বসিয়া দু’জনে পড়াশুনা করে। মাস্টার আসিয়া তৃতীয় দিকে বসেন, এবং নিরপেক্ষভাব দুই ছাত্রীর পানে পর্যায়ক্রমে তাকাইয়া শিক্ষা দান করেন। মাস্টারের এই অটল নিরপেক্ষতা বুঝি বা অন্তরে অন্তরে অনর্থের সৃষ্টি করে। নিরপেক্ষতা খুবই উচ্চ অঙ্গের চিত্তবৃত্তি; কিন্তু পক্ষপাতিত্বের একটা সুবিধা এই যে, কোনও পক্ষের মনেই সংশয়ের অবকাশ থাকে না।

মাস্টার সকালবেলায় পড়াইতে আসেন। ছাত্রীরা আগে হইতেই পড়ার ঘরে বসিয়া তাঁহার জন্য প্রতীক্ষা করে। কোনও দিন হয়তো ছন্দার একটু দেরি হইয়া যায়, সে তাড়াতাড়ি পড়ার ঘর প্রবেশ করিয়া দেখে, মাস্টার তখনো আসেন নাই, রুচিরা একটা নোটের খাতা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছে।

ছন্দা একবার রুচিরার মুখের দিকে তাকাইয়া নিজের চেয়ারে বসিতে বসিতে বলে, ‘রুচি, তোর নাকের পাশে পাউডার লেগে আছে মুছে ফেল।’

রুচিরা আঁচল দিয়া নাকের পাশে ঘষিতে ঘষিতে হাসে, বলে, ‘কালো রঙের ওপর পাউডারের জেল্লা খোলে বেশী। তোর কিন্তু কিছু বোঝা যায় না।’

ছন্দা একটা বইয়ের পাতা খুলিয়া বলে, ‘নেয়ে উঠে একটা কিছু মুখে না মাখলে মুখটা যেন চটচট কর।’

রুচিরা বলে, হ্যাঁ। আজকাল রোজ সকালে নাওয়া আরম্ভ করেছিস দেখছি। আমি ভাই পারি না।’

ছন্দা ঈষৎ তপ্তমুখে বলে, ‘সকালে না নাইলে চুল শুকোয় না। এলোচুলে কলেজে যাওয়া একটা অসভ্যতা।’

দুই ভগিনীর মিষ্টালাপ শেষ হইবার পূর্বেই মাস্টার প্রবেশ করেন। ছাত্রীরা সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া আবার বসে।

মাস্টার একটা বই তুলিয়া লইয়া বলিলেন, ‘ছন্দা, ক’দিন ধরে লক্ষ্য করছি, ফিলজফি পড়াবার সময় তুমি মন দিয়ে শোন না।’

ছন্দা ক্ষীণ কণ্ঠে বলিল, ‘শুনি তো।’

মাস্টারের চোখের গাম্ভীর্যের কাছে অধরের ছেলেমানুষী পরাভূত হইয়া পলায়ন করে। তিনি বলেন, ‘শোন বটে, কিন্তু মন দাও না। —আর, রুচিরা, তুমিও দেখছি সংস্কৃত পড়ানোর সময় অন্যমনস্ক হয়ে পড়।’

রুচিরা অপরাধিনীর মতো চক্ষু নত করিয়া থাকে, তারপর আস্তে আস্তে বলে, ‘আর অন্যমনস্ক হব না।’

মাস্টার বলেন, ‘বেশ! এস, আজ তোমাদের এথিক্‌স্ পড়াব।’

পাঠ আরম্ভ হয়।

কিন্তু ছাত্রীযুগল মাস্টার বিরক্ত হইয়াছেন মনে করিয়া মনে মনে যেন কাঁটা হইয়া থাকে।

আশ্চর্য। একদিকে দুইটি ধনীর কন্যা—অভিজাত সমাজের মধ্যমণি বলিলেও মিথ্যা বলা হয় না, অন্যদিকে দুঃস্থ বেকার মাস্টার। ইহাদের মধ্যে মাস্টার-ছাত্রী সম্বন্ধ ছাড়া অন্য কোনও সম্বন্ধ কল্পনা করাও যায় না। অথচ—

ভারি আশ্চর্য।

কিন্তু মাস্টার যদি শেষ পর্যন্ত দুঃস্থ বেকার মাস্টারই রহিয়া যায়, তাহা হইলে নিমর্ম কান্না অথবা নির্মমতার হাসি ছাড়া এ কাহিনীর অন্য পরিসমাপ্তি সম্ভব হয় না। তাহা হইলে রুচিরার হাসি-কান্না আসে কোথা হইতে? এবং মাস্টারের পরিপূর্ণ পরিচয়ই বা দেওয়া যায় কি করিয়া? যে মাস্টার চিরদিন দুঃস্থ ও বেকার রহিয়া যায়, তাহার পরিচয় দিবার আগ্রহ আর যাহার থাকে থাক, আমার নাই। আমি রূপকথা বলিতেই ভালবাসি।

বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হইয়া যাইবার পর একদিন মাস্টারের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ হইয়া পড়িল।

কলেজে পড়ার তাড়া নাই, মাস্টার সাধারণভাবে ছাত্রীদের সহিত কাব্য ও দর্শনের যোগাযোগ সম্বন্ধে আলোচনা করিতেছিলেন, এমন সময় ছন্দার বাবা ঘরে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার হাতে কয়েক কেতা নোট।

মাস্টারের মাহিনা তাহার হাতে দিতেই সে তাহা পকেটে রাখিয়া আবার আলোচনা আরম্ভ করিল।

ছন্দার বাবা হাইকোর্টের উকিল, তিনি একটি চেয়ারে বসিয়া কিছুক্ষণ মনঃসংযোগে আলোচনা শুনিলেন; তারপর সহসা মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমার বাবার নাম কি?’

মাস্টার একটু চমকিত হইল। কিন্তু বাপের নাম ভাঁড়াইতে কাহারও কাহারও চক্ষুলজ্জায় বাধে। সরিৎ হালদার যথার্থ পিতৃনাম বলিল। নামের পুরাভাগে যে একটা রাজকীয় খেতাব ছিল তাহাও বাদ দিল না।

ছন্দার বাবা বলিলেন, ‘হুঁ। কিন্তু তুমি এ ভাবে—?’

সরিৎ বলিল, ‘আপনারা একটু ভুল বুঝেছিলেন। আমি বেকার বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলুম বটে, কিন্তু নিজেকে দুঃস্থ বলিনি। সে সময় আমি বেকারই ছিলুম।’

ছন্দার বাবা বলিলেন, ‘হুঁ—Suggestio falsi! কিন্তু এ অবস্থায়—’

সরিৎ বলিল, ‘অবস্থার কোনও পরিবর্তনই ঘটেনি। বড়মানুষের ছেলে হয়ে জন্মানো শিক্ষক হবার অযোগ্যতা প্রমাণ করে না। তাছাড়া ছন্দা আর রুচিরাকে পড়াতে আমার ভাল লাগে, ওরা খুব মেধাবিনী ছাত্রী।’ বলিয়া নিরপেক্ষ স্নিগ্ধ চোখে দু’জনের পানে চাহিয়া হাসিল।

ছন্দা ও রুচিরা এই বাক্যালাপের শুরু হইতেই মাস্টারের দিকে বিস্ফারিত নেত্রে তাকাইয়া ছিল, এখনও তেমনি তাকাইয়া রহিল।

ছন্দার বাবা বলিলেন, ‘তা বটে, কিন্তু—’

সরিৎ বলিল, ‘আমি যেমন মাইনে নিচ্ছি, তেমনি নেব। আপনার ভয় নেই।’

সঙ্কোচ কাটিয়া গেল। ছন্দার বাবা হাসিলেন, বলিলেন, ‘বেশ কথা।’

তিনি প্রস্থান করিলে ছন্দা হঠাৎ দাঁড়াইয়া উঠিয়া উত্তপ্ত-মুখে বলিল, ‘আপনি এতদিন একথা লুকিয়ে রেখেছিলেন কেন?’

সরিৎ বলিল, ‘না লুকোলে তোমাদের পড়াত কে?’

‘কেন, আর কি লোক ছিল না?’

‘ছিল। কিন্তু তারা রুচিরার সঙ্গে ইয়ার্কি দেবার চেষ্টা করত কিংবা তোমার পানে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। ফলে তোমরা পরীক্ষায় ফেল করতে।’ মাস্টারের স্বর গম্ভীর।

রচিরার অধর একটু স্ফুরিত হইল, চোখের কূলে কূলে হাসি ভরিয়া উঠিল। মাস্টারের অধরে কিন্তু ছেলেমানুষীর চিহ্নমাত্র নাই।

ছন্দা যেন পরাস্ত হইয়া বসিয়া পড়িল; তারপর মিনতির স্বরে বলিল, ‘বলুন না মাস্টার মশাই, সত্যি কেন লুকিয়েছিলেন?’

এতক্ষণে সরিতের অধরে ছেলেমানুষীর ভাব ফিরিয়া আসিল। সে বলিল, ‘মিথ্যাকে সত্য করে তোলার নাম রোমান্স। রোমান্সের চূড়ান্ত হচ্ছে রূপকথা। আমি রূপকথা বড় ভালবাসি। ছদ্মবেশী রাজকুমারের কথা পড়েছ তো।? আমি রাজকুমার নই, কিন্তু ছদ্মবেশের পরিপূর্ণ আনন্দ ভোগ করে নিয়েছি। এমন কি, ছদ্মবেশ ত্যাগ করবার পরও সে আনন্দ শেষ হয়নি।’

ছন্দা বলিল, ‘ছদ্মবেশ?’

‘হ্যাঁ। এইটেই জীবনের সব চেয়ে বড় রোমান্স। অধিকাংশ মানুষই জানে না যে সে ছদ্মবেশ পরে বেড়াচ্ছে, পদে পদে নিজের মিথ্যা পরিচয় দিচ্ছে। তাই তারা রূপকথার আনন্দ থেকে বঞ্চিত।’

ছন্দা সুন্দর অধর বিভক্ত করিয়া, দুই চোখে মুগ্ধ বিস্ময় ভরিয়া চাহিয়া রহিল; কালো মেয়ে রুচিরার কালো চোখে নিগৃঢ় হাসি টলমল করিতে লাগিল।

সেরাত্রে শয়নের পূর্বে রুচিরা অনেকক্ষণ ধরিয়া আয়নায় নিজেকে নিরীক্ষণ করিল। তারপর তাহার দৃষ্টি গিয়া পড়িল আয়নায় পাশে টাঙানো ছন্দার একটি ফটোর উপর। সে একটু একটু হাসিতে লাগিল। চকিতের জন্য তাহার দৃষ্টি আবার আয়নায় ফিরিয়া গেল। হঠাৎ সে একটু জোরে হাসিয়া উঠিল। তারপর ক্ষিপ্রহস্তে আলো নিবাইয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল।

ছন্দা তাহার পাশের ঘরে শোয়। অনেক রাত্রে সে আসিয়া গা ঠেলিয়া রচিরার ঘুম ভাঙাইয়া দিল, ‘এই রুচি, ওঠ্‌—ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ফোঁপাচ্ছিস কেন?’

ঘুম ভাঙ্গিয়া রুচিরা কিছুক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিল; তারপর অস্ফুট স্বরে বলিল, ‘স্বপ্ন দেখছিলুম। ভারি মজার স্বপ্ন। শুগে যা ছন্দা, আর ফোঁপাব না।’

দিন যায়। মাস্টার আসেন এবং যান। রুচিরা সমস্ত দিন হাসে; রাত্রে ঘুমের ঘোরে তাহার চোখের জলে বালিশ ভিজিয়া যায়। কি স্বপ্ন দেখে, কে জানে!

রুচিরা চালাক মেয়ে। অপ্রাপ্য বস্তুর পানে হাত বাড়াইয়া সে নিজেকে খেলো করিতে চায় না। ছন্দার গালদু’টিতে গোলাপ ফুটিয়া থাকে, চোখের চাহনিতে রূপকথার স্বপ্নাতুরতা। রুচিরা দেখিয়া হাসে; সে-হাসি ছন্দার কাছে ধরা পড়িয়া যায়। ছন্দার কপাল হইতে বুক পর্যন্ত রাঙা হইয়া ওঠে। কিন্তু মুখ ফুটিয়া কেহ কিছু বলে না।

রুচিরা আগের মতো ঘরে বসিয়া মাস্টারের প্রতীক্ষা করে না। মাস্টার আসিয়াছেন খবর পাইলে, কোনও মতে হাত-ফের দিয়া চুলগুলা জড়াইয়া নীচে নামিয়া যায়। নতনেত্রে বসিয়া অখণ্ড মনোযোগে মাস্টারের বক্তৃতা শোনে; তারপর পাঠ শেষ হইলে, একটু হাসিয়া দু’জনের প্রতি চকিত দৃষ্টিপাত করিয়া চলিয়া যায়।

মাস্টার হয়তো সবই লক্ষ্য করেন, কিন্তু তাঁহার তুলাদণ্ডের মতো নিরপেক্ষতা তিলমাত্র বিচলিত হয় না, চোখের গাম্ভীর্য ও অধরের চটুলতা আরও পরিস্ফুট হয় মাত্র।

একদিন সকালে মাস্টার পড়াইতে আসিলেন না। ছন্দা টেবিলের সম্মুখে বসিয়া ছটফট করিতে লাগিল, মুহুর্মুহুঃ দেওয়ালের ঘড়ির সঙ্গে চোখাচোখি হইল। ঘড়ি নির্বিকার মুখে টিক টিক শব্দ করিয়া চলিল। রুচিরা নিবিষ্ট চিত্তে মৃচ্ছকটিক পড়িতে পড়িতে মৃদু হাসিতে লাগিল। সকাল কাটিয়া গেল।

ছুটির দিন ছিল। বৈকালবেলা রুচিরা পড়ার ঘরে অলসভাবে বসিয়া একটা খাতায় হিজিবিজি কাটিতেছিল, অযত্নবদ্ধ চুলগুলা কাঁধের উপর খসিয়া পড়িতেছিল।

অন্যমনস্কভাবে সে খাতায় লিখিল—

যাহার ঢল ঢল নয়ন শতদল

তারেই আঁখিজল সাজে গো।

আজ সকালে সে হঠাৎ ছন্দার চোখে জল দেখিয়া ফেলিয়াছে।

নানা আবোল-তাবোল চিন্তা মাথায় আসিতে লাগিল। মগ্ন-চৈতন্য জিনিসটা কি? যত নিগৃহীত আশা-আকাঙক্ষা সব কি ডানা-ভাঙা পাখির মতো সেইখানে গিয়া আশ্রয় লয়?…মৃচ্ছকটিকে ধূর চরিত্রটি কেমন? নিজের স্বামীকে বসন্তসেনার হাতে তুলিয়া দিল! কিন্তু—

ছন্দা বাহিরে যাইবার বেশে ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল, ‘রুচি, আমি মাসীমার বাড়ি যাচ্ছি; তাঁর কি হয়েছে, ডেকে পাঠিয়েছেন।’

কবিতার পংক্তিগুলি কাটিতে কাটিতে রুচিরা বলিল, ‘আচ্ছা।’

ছন্দা যেন আরও কিছু বলিবে এমনিভাবে একটু ইতস্তত করিয়া চলিয়া গেল।

…রূপকথার রাজপুত্রেরা ছদ্মবেশ পরিয়া কিসের খোঁজে বাহির হন? সাতশ’ রাক্ষসীর প্রাণ এক ভোমরা? সাপের মাথায় মাণিক? অপরূপ রূপসী রাজকন্যা…

পাশের ঘরটা ড্রয়িংরুম; সেখানে টেলিফোনের ঘন্টি বাজিয়া উঠিল। রুচিরা অলস পদে উঠিয়া গিয়া ফোন ধরিল।

‘কে আপনি?’

ভারি গলায় জবাব আসিল, ‘আমি সরিৎ। তুমি কে? রুচিরা?’

রুচিরার গলা যেন বুজিয়া গেল, ‘হ্যাঁ। আজ আসেননি কেন?’

‘কাজ ছিল।’

হাসিবার চেষ্টায় রুচিরার গলা কাঁপিয়া গেল, ‘আজ আপনার প্রথম কামাই। জরিমানা হবে।’

‘জরিমানা করবে কে?’

‘—ছন্দা।’

‘ও! ভাল।—শোন, তোমার বাবা-কাকাবাবু এঁরা বাড়িতে আছেন?’

‘হ্যাঁ। আজ ছুটি। কেন?’

‘দরকার আছে। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে যাচ্ছি। তোমাদের না হয় পড়িয়ে আসব।’—একটু ইতস্তত করিয়া—‘ছন্দা নিশ্চয় বাড়িতে আছে?’

‘না। ছন্দা মাসীমার বাড়ি গিয়েছে।’

মনে হইল, তারের অপর প্রান্ত হইতে একটা দীর্ঘশ্বাস ভাসিয়া আসিল।

রুচিরা হঠাৎ ধৃষ্টতা করিয়া বসিল, ‘দুঃখ হচ্ছে বুঝি?’

‘রুচিরা, তোমরা আমার ছাত্রী না?’

‘দোষ করেছি, মাপ করুন।’

‘আচ্ছা। তুমি বাড়িতে থাকবে তো?’

‘থাকব।’

‘আমি যাচ্ছি। —হ্যাঁ, শোনো! একটা কথা জানো?’

‘কি?’

‘হাসি-কান্নার মতো দীর্ঘশ্বাসেরও দু’রকম মানে হয়।’

‘বুঝতে পারছি না।’

‘হাসিতে কি খালি আনন্দই বোঝায়? কান্না কি কেবল দুঃখেরই প্রতীক?’

‘এখনও বুঝতে পারছি না।’

‘আচ্ছা—আমি যাচ্ছি—’

রুচিরা ফিরিয়া আসিয়া পড়ার ঘরে বসিল। নিতান্তই স্ত্রী-স্বভাববশত নিজের বেশভূষার দিকে দৃষ্টি পড়িল। শাড়িটা আধময়াল, ব্লাউজ এককালে নূতন ছিল, এখন ধোপার কল্যাণে স্থানে স্থানে রং উঠিয়া গিয়াছে। তা হোক, ক্ষতি কি? অসহিষ্ণু হস্তে স্খলিত চুলগুলা রুচিরা টান করিয়া পিছনে জড়াইল। চুলগুলা একটা জঞ্জাল!—মেমেদের মতো বব করিলে কেমন হয়।

দ্বৈপ্রহরিক বিশ্রাম শেষ করিয়া বাবা ও কাকা ড্রয়িংরুমে আসিয়া বসিলেন। তাঁহাদের কথার গুঞ্জন মাঝের ভেজানো দরজা দিয় অস্পষ্টভাবে আসিতে লাগিল।

আধ ঘণ্টা কাটিল। একটি পরিচিত পদধ্বনি পড়ার ঘরের সম্মুখ দিয়া গিয়া ড্রয়িংরুমের গালিচার উপর বিলুপ্ত হইল। বাবা ও কাকার সম্ভাষণ শোনা গেল, ‘এস সরিৎ।’

তারপর তাঁহাদের বাক্যালাপ আবার গুঞ্জনধ্বনিতে পর্যবসিত হইল। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট—কথা যেন আর শেষ হয় না।

রুচিরা উঠিয়া একবার ভেজানো দরজার সম্মুখ দিয়া অলস নিঃশব্দ পদে হাঁটিয়া গেল। সরিতের কণ্ঠের দুই তিনটি কথা তাহার কানে গেল। সে আবার পা টিপিয়া টিপিয়া নিজের স্থানে আসিয়া বসিল।

ও—এই কথা। টেলিফোনে কথাবার্তার ভঙ্গি হইতেই রুচিরার বোঝা উচিত ছিল। বিবাহের প্রস্তাব। পাত্রীর নামটি শোনা না গেলেও ছন্দা ছাড়া আর তো কেহ হইতে পারে না।

আরো অনেকক্ষণ তন্দ্রাচ্ছন্নের মত রুচিরা বসিয়া রহিল।…স্বপ্ন কখনও মিথ্যা হয়?…সহসা চমক ভাঙ্গিয়া সে দেখিল, সরিৎ আসিয়া টেবিলের অপর পাশে দাঁড়াইয়াছে। তাহার অধরের ছেলেমানুষী কোনও অভাবনীয় উপায়ে চোখের মধ্যেও সঞ্চারিত হইয়াছে।

রুচিরা সহাস্যে উঠিয়া দাঁড়াইল।

সরিৎ কপট-কঠোর স্বরে বলিল, ‘ফাজিল মেয়ে।’

‘কি করেছি?’

সরিৎ উত্তর না দিয় তাহার পানে কেবল কপট-কঠোর চক্ষে চাহিয়া রহিল।

রুচিরা তখন কৌতুক-তরল হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘বসুন, মাস্টার মশাই। আচ্ছা, এখনও কি আপনাকে মাস্টার মশাই বলতে হবে?’

সরিৎ বলি, ‘না।’ তারপর যেন একটু বিবেচনা করিয়া বলিল, ‘এখন তুমি আমাকে ওগো বলতে পার। কর্তারা অনুমতি দিয়েছেন।’

অদম্য আবেগে টেবিলের উপর মাথা রাখিয়া রুচিরা কাঁদিতেছে। সরিৎ তাহার পাশে আসিয়া অযত্নবদ্ধ চুলগুলি খুলিয়া দিয়া বলিল, ‘চুল খুলে কাঁদতে হয়। কালিদাস বলেছেন—বিললাপ বিকীর্ণমুর্দ্ধজা।’

অশ্রুপ্লাবিত মুখ ক্ষণেকের জন্য তুলিয়া রুচিরা বলিল, ‘কিন্তু আমি যে কালো!’

সরিৎ তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া বিকীর্ণকুন্তল মাথার পানে কিয়ৎকাল চাহিয়া রহিল, তারপর স্বপ্নাবিষ্ট কন্ঠে বলিল, ‘ওটা তোমার ছদ্মবেশ। তুমিই আমার রূপকথার রাজকন্যা।’

২২ ভাদ্র ১৩৪৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *