হারু হকার
শীর্ণ নদীর ধারের অখ্যাত শ্মশানে চন্দন কাঠের লকলকে চিতা নিবে গেল। দেবেশ এখন এক মুঠো ছাই। হারু ছাই থেকে খুঁজে-খুঁজে দেবেশের নাভিটা বের করে একতাল মাটিতে মুড়ে একটা মৃৎপাত্রে রাখল। মানুষের কর্মের মতো মানুষের নাভিও অদাহ্য বস্তু। সারা গ্রামের মানুষ শ্মশানে ভেঙে পড়েছে। মানুষের দেবতা চলে গেলেন। সাদা ধুতি পরা বলিষ্ঠ হারুকে মনে হচ্ছে অটল এক ব্রহ্মচারী। ভেতরে-ভেতরে কেঁদেছে, চোখ দুটো লাল।
চিতার সঙ্গে-সঙ্গে দিনও নিবে গেল। কলকাতা থেকে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা গাড়িতে উঠলেন। কারও কোনও অভিযোগ নেই। দেবেশ সেন তাঁর বিশাল সম্পত্তি সকলকে সমান ভাগ করে দিয়ে গেছেন। এখন তারা ইচ্ছে মতো ওড়াক, পোড়াক, যা খুশি করুক। দেবেশ অনেক আগেই বিষয় থেকে মন তুলে নিয়ে অবিষয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় অনেকেই বলেছিলেন, বিড়াল-তপস্বী। মানুষের কথায় দেবেশ বিচলিত হতেন না। মানুষ বলবে। নানা রকম কথা বলবে। যার যেমন ভাব, কথাও বলবে সেই রকম।
দেবেশ একদিন হারুকে বলেছিলেন,
—ছোকরা! পাপ না করলে পুণ্যের জন্যে মানুষের আকুতি আসে না। শুধু পুণ্য হল, নুন ছাড়া ফ্যাসফেসে তরকারি। অন্ধকার দেখেই মানুষ চিৎকার করে আলো, আলো। মরুভূমিতেই মানুষ জলের মর্ম বোঝে। এক বুঁদ পানি। আকাশে উঠলে তবেই বোঝা যায় ভূমির আকর্ষণ।
—যদি এমন হয়, কেউ সারাটা জীবনই আলোতেই থাকল!
হারুর প্রশ্নে দেবেশ হেসেছিলেন। তখন প্রায় ঋষির মতো চেহারা। ঋজু, দীর্ঘ চেহারা। তপ্ত কাঞ্চনের মতো গায়ের রং। বিশাল দুটো চোখেজ্বলছে অন্তরের আলো। মুখে অদ্ভুত একটি হাসি প্রায় সর্বক্ষণই ফুলের মতো ফুটে আছে। দেবেশ হারুর মাথায় একটা হাত রেখে বলেছিলেন,
—কেতাবি গুরুরা এমন কথাই বলবেন। অন্তরের উদ্ভাসিত আলো, যে দীপ আপনি জ্বলে। বৎস! আলো কথাটা আছে কেন। অন্ধকার আছে বলে। অন্ধকার না থাকলে আলোর কথা কেউ কোনও দিন বলত কি! এইবার দ্যাখো, অন্ধকার আগে, না আলো আগে?
—কী জানি কোনটা আগে।
—আরে বোকা, অন্ধকার আগে। অভাব না থাকলে প্রয়াসটা আসবে কোথা থেকে! সেই সৃষ্টিকর্তা বিধাতা প্রথমেই দুটো বোধ মানুষকে দান করেছেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে। মাত্র দুটো বোধ, তার থেকেই সব আসছে। সেই দুটো হল, আছে আর নেই। সূর্য আছে, দিন আছে। সব প্রকাশিত। সূর্য নেই, রাত গভীর অন্ধকার, অপ্রকাশ। প্রতিদিন এই খেলা তিনি খেলছেন জগৎ জুড়ে। জীবনে আমি আছি, মৃত্যুতে আমি নেই। এইবার বলো, মৃত্যু আগে, না জীবন আগে।
—জীবন।
—না, হল না। মৃত্যু আগে। জড়েই চৈতন্য যুক্ত হয়েছিল, চৈতন্যে জড় যুক্ত হতে পারে না। প্রাণের কোনও পাত্র নেই। প্রাণ দেহকে আশ্রয় করে কিছুকাল চলায় ফেরায়, নাচায় কাঁদায়। বাউল বলছেন, দেহ-খাঁচায় প্রাণপাখি। দেহ-নশ্বর, প্রাণ অবিনশ্বর।
—আমরা এভাবে কেউ ভাবি না।
—তার কারণ আমরা পরে দেখি, পরে ভাবি। এপাশ থেকে ওপাশটা দেখছি। ওদিক থেকে এদিকটা দেখার উপায় নেই। পেছনে কী আছে! নিজের পেছন দেখতে পাও! পিঠে কটা তিল আছে? কারও সাহায্যে জানতে হবে। সেটা হল ইনফরমেশান। সে বললে, গুণে দেখছি সাতটা লাল তিল। তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। সন্দেহও আসতে পারে, ঠিক বলছে তো! তুমি তখন একটা আয়নায় হয়তো নিজের পিঠটা প্রতিফলিত করলে, এইবার সেই ইমেজটাকে কায়দা করে সামনের আয়নায় নিয়ে এলে। কী পেলে, ইমেজের ইমেজ। দূর থেকে ঘুরপথে দেখা। আঙুল দিয়ে একটা একটা করে গুণে নিতে পারবে না। যেটা খুব সূক্ষ্ম সেটাকে তো দেখতেই পাবে না। পেছন না ফিরলে পেছনটা দেখা যায় না, আবার যে পেছন তোমার পেছনে লেগে আছে, সেটা তো তুমি ফিরলেও পেছনেই থেকে যাবে। তুমি যে-ই ঘুরলে সে-ও ঘুরে গেল। সামনেটা জানা যায়, পেছন অজ্ঞাত। অনুমান চলতে পারে, অন্যের দর্শন থাকতে পারে, তোমার কিছু নেই। প্রত্যক্ষ, অপ্রত্যক্ষ। জীবন দিয়ে জীবন বুঝলে, মৃত্যুকে বুঝবে কী করে! মৃত্যুর ভেতর দিয়ে জীবন তো যেতে পারে না।
—আপনি সব গুলিয়ে দিলেন। পাপ, পুণ্য, আলো, অন্ধকারের কথা হচ্ছিল।
—সেই কথাতেই আছি গো! জীবনের দিক থেকে দেখছি বলে, সামনেটাই দেখছি; কারণ চোখ দুটো সামনে, হেডলাইটের আলো সামনেই পড়ছে। ভেতরে বসে ঘড়ির মতো যে কাল হাঁটছে অবিরত, সে সামনেই হাঁটছে। তার চলে যাওয়াটাই আছে, ফিরে আসাটা নেই। সময় শামুক দেহের খোলটা নিয়ে সামনেই চলেছে। একসময় খোলটা খসে যাবে, শামুকের চলা শেষ হবে না। সময় এক বিশাল রেলগাড়ি, অনন্ত তার যাত্রাপথ। যাত্রীরা উঠছে, কিছুদূর গিয়ে নেমে পড়ছে। আবার উঠছে, আবার নামছে। মানুষ মাপছে। ঘড়ি বলছে চব্বিশ ঘণ্টা, তোমার একটা দিন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যোদয়। সময়ের হিসেব দিচ্ছেন সূর্য। কাকে দিচ্ছেন, পৃথিবীর মানুষকে। তুমি যদি সূর্যের কাছে যাও, তাঁর তো উদয়ও নেই অস্তও নেই। সেখানে সব দিনই একদিন। সোম, বুধ, শুক্র নেই। দিন, মাস, বছর নেই। মানেটা তাহলে এই হচ্ছে, সেই বিন্দুতে একবার হাজির হতে পারলে সময়ের হাত থেকে অর্থাৎ কালের হাত থেকে তোমার মুক্তি। তোমার শৈশব, যৌবন, জরা, মৃত্যু নেই। দূরে আছ, তাই এই ভ্রান্তি। আবার এটাও তো ভাবতে হচ্চে, তোমার ছায়াটাই অন্ধকার। বোঝো ভালো করে। আলো তোমার সামনে, পেছনে ফিরলে, আলোটা আছে না নেই!
—আলোটা আছে।
— তুমি কী দেখছ?
—অন্ধকার।
—অন্ধকার নয়, দেখছ তোমার ছায়া। তোমার স্থূল দেহ দিয়ে আলোটাকে আড়াল করলে। পৃথিবী রোজ এই কান্ডটাই করছে। নিজের অক্ষরেখার ওপর ঘুরে যাচ্ছে। আলোর দিকটা চলে যাচ্ছে অন্ধকারে। অন্ধকারের দিকটা চলে আসছে আলোয়। মানুষের মনও ঘোরে। এই আলোয় তো এই অন্ধকারে। কখনও প্যাঁচা, কখনও রাজহংস। কখনও মাছি, কখনও মৌমাছি।
শ্মশান থেকে দেবেশের প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব প্রায় মাইল দুয়েক। হারু হাঁটছে আর ভাবছে। নানা রকম কথা মনে আসছে। ছেলেবেলাতেই বাবা মারা গিয়েছিলেন। তেমনভাবে চিকিৎসা হলে বাঁচানো যেত। পয়সা ছিল না। শক্ত, সমর্থ, কর্মক্ষম মানুষ। গাড়ির ইঞ্জিনের কাজ ভালোই জানতেন। পাকা মিস্ত্রি ছিলেন। এক বড়লোক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে একটা গ্যারেজ করেছিলেন। টাকা তার, অভিজ্ঞতা নিজের। ব্যাবসাটা যেই দাঁড়িয়ে গেল বন্ধু মারলে ল্যাং। সেই ধাক্কায় মানুষটা অকালে চলে গেল। পড়ে রইল একগাদা দেনা। সামান্য একটুকরো ভিটে। একটা ভাঙা চালা। চারটে ছাগল। একটি গরু। অভাবের সঙ্গে, লোভী নিষ্ঠুর সমাজের সঙ্গে শুরু হল বিধবা এক মহিলার সংগ্রাম। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন। নারীমাংসলোভী সারমেয়ের দল দিবারাত্র উৎপাত শুরু করল। ‘তোমার ভালো চাই আমরা। জগন্নাথ, বোকা জগন্নাথ মারা গেছে তো কী হয়েছে গো! আমরা তো আছি। শৈলবালা, নিজেকে অসহায় ভাবছ কেন, একলা ভাবছ কেন!’ রাত-বিরেতে শেয়ালের চিৎকার, আমরা আমরা।’ আমরা তোমার উপকারী বন্ধু গো। এই নাও চাল, এই নাও ডাল, এই নাও ফুলকপি। লাল গাজর। বসিরহাটের দই। মাথাটা দেখেছ, তিন ইঞ্চি পুরু। এ সব তোমার শৈলবালা। দেখো, রাতটা বড় নিশুতি। বিপদ-আপদের তো শেষ নেই। আমরা তো পালা করে তোমাকে পাহারা দিতে পারি।
সব যেন মাছি। ডুমো নীল মাছি। শৈলবালা পাকা টুসটুসে আমটি। সব ভ্যান-ভ্যান করছে। ঝাপটা মেরে কত আর সরান যায়! শেষে শৈলবালা একটা বুদ্ধি বার করলে। ঘরের কোণে মা মঙ্গলচন্ডীর একটা ঘট স্থাপন করলে। মঙ্গলবার ভর হল। ভীষণ রকমের ভর। আসনে বসে আছে। মাথা দুলছে। এল চুল পিঠের ওপর ঘোড়ার লেজের মতো এ-পাশে, ও-পাশে আছড়া-আছড়ি করছে। বিস্ফারিত চোখ। এ-পাশে ও-পাশে ফুল আর বেলপাতা ছুঁড়ছে।
শৈলবালা প্রথমে অভিনয় করতেই চেয়েছিল; কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল। অভিনয় সত্য হল! একটি শক্তি সত্যসত্যই ভর করল। নিজের পরিচয় মুছে গেল কিছুকালের জন্যে! মুখের চেহারা বদলে গেল। চোখে আগুন। সারা শরীর ঝলমলে। গলার স্বর পর্যন্ত বদলে গেছে। অনর্গল সংস্কৃত স্তোত্র বেরোচ্ছে শঙ্খের মতো সুরে। প্রতিবেশীরা ভিড় করে এল দরজার সামনে।
—অ হারু, তোর মায়ের এ কী দশা হল র্যা!
কথা তাদের শেষ হল কী হল না। ছট করে গায়ে এসে লাগল গঙ্গাজলের ছিটে। মাঝখানে এসে পড়ল জবা আর বেলপাতা। সবাই কেমন যেন হয়ে গেল, ভয়ে অথবা ভক্তিতে। ঘোর লেগেছে। নেশার মতো। কেউ-কেউ টলতে লাগল মাতালের মতো। একজন চোখ উলটে চিৎকার করছে, মা, মা, রক্ষ করো মা জননী আমার। পয়সাওয়ালা কুন্ডুদের বাড়িতে অন্নপূর্ণা পুজো। ঢাকিদের একটা দল ঢাক বাজাতে যাচ্ছিল সামনের পথ দিয়ে। তারা এক ঝলক তাকিয়েই কী যে হল, সুড়সুড় করে সেই জমায়েতের মধ্যে ঢুকে পড়ল। শুরু হল ঢাকের বাদ্য। তিনখানা ঢাকের উদ্দাম বাজনা। আর তেমনি নৃত্য। ঢাকে বোল ফুটছে কী! রক্ত চনমনিয়ে ওঠে।
শৈলবালা সেই সময় কী করছেন। তিনি নিজেই জানলেন না। একজন একটু সাহস করে এগিয়ে গেল, ‘মাগো, একটু আশীর্বাদ করো।’ শৈলবালা ডান পাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এইখানে তোর মুক্তি আছে। ফুল দিয়ে পুজো কর, মামলা ওরা তুলে নেবে! মিথ্যে-মিথ্যে তোকে ফাঁসাতে চাইছে।’
সে বললে, ‘তুমি কী করে জানলে মা!’
একটি মেয়ে এসে দড়াম করে পায়ে পড়ে গেল, ‘উদ্ধার করো মা।’
‘তোকে কে উদ্ধার করবে! তোর স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলেটাকে নষ্ট করছিস! লজ্জা করে না!’
মেয়েটি হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল। গ্রামসুদ্ধ লোক ছুটে এসেছে। ভয়ংকর কান্ড। শৈলবালাকে দেবী ভর করেছেন। মানুষের ভেতরের কথা সব জানতে পারছে। যাকে যা বলছে সব মিলে যাচ্ছে। কারও গায়ে একটু ফুল ছুঁড়ে মারলেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে সঙ্গে-সঙ্গে।
ওই অবস্থাটা প্রায় চার ঘণ্টা রইল, তারপর শৈলবালা আসনের ওপরেই অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। এক ঘণ্টা পরে স্বাভাবিক হলেন। দেখতে-দেখতে জীবনের ধরন-ধারণ বদলে গেল। চেহারায় সত্য সত্যই একটা দেবীভাব ফুটে উঠল। চোখে-মুখে একটা জ্যোতি এল। তবু সেই বদের দল চেষ্টা ছাড়েনি। কুন্ডুবাড়ির কমল ধর্মকর্ম, ভূত ভগবান মানে না কিছুই। যত বুজরুকি! শিকার ভয় দেখিয়ে পালাতে চাইছে। অতই সোজা। চিল যখন পড়েছে, কুটো না নিয়ে উড়ছে না।
রাত তখন প্রায় দেড়টা। গ্রামের রাত, একেবারে নিস্তব্ধ, নিশুতি। তায় আবার অমাবস্যা। শৈলবালা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমচ্ছিল। বেহুঁশ ঘুম আর হয় কই। সামান্য শব্দেই চমকে ওঠে, ওই বুঝি এল। কোনও এক অজানা কারণে কানের শক্তি খুব বেড়ে গেছে। দূরে গাছের পাতা পড়ার শব্দও শুনতে পায়। চোখে দেখার আগেই বুঝতে পারে, বিপদ আসছে। নাকে বিপদের গন্ধ এসে লাগে।
কমল এল। শরীর বেশ বেজুত। সন্ধে থেকেই চলছিল। কয়েক বোতল শেষ হয়েছে। মোসায়েবরা ঘিরে ছিল। কমল টলছে। মনে আগুন। পয়সা তাকে একটা প্রবৃত্তিই দিয়েছে। ভোগের প্রবৃত্তি। অবৈধ ভোগ। কমল দাওয়ায় উঠেছে। নড়বড়ে দরজাটা এইবার ভাঙবে। আর তর সইছে না। বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে শৈলবালার ঘাড়ে। মনে-মনে ভাবছে, ঘুম জড়ানো, গরম শিথিল একটা শরীর। সেই শরীরের ক্রম উন্মোচন।
কমল দরজা ভাঙার আগেই দরজাটা খুলে গেল। সামনেই শৈলবালা। ঘরে লন্ঠনের আলো। সেই মৃদু আলো আড়াল করে শৈলবালা দাঁড়িয়ে। হাত দুটো ওপরে তুলে দরজার পাল্লা ধরে আছে। কমল কী দেখছে কে জানে। শৈলবালাকে না অন্য কারোকে! কমলের শরীর পাথরের মতো ভারী। ভাবছে এতটা নেশা করা ঠিক হয়নি। ভাবছে, মদ খুব খারাপ জিনিস। ভাবছে, মদের সঙ্গে মেয়েমানুষ জড়িয়ে আছে। ভাবছে দুটো ম-এই মানুষের সর্বনাশ। ভাবছে, বাপের ব্যাবসাটা তার জন্যেই লাটে উঠবে। ভাবছে, বয়েস তো ক্রমেই বাড়ছে, এইভাবে চললে মরণটা হবে রাস্তার কুকুরের মতো। ভাবছে, বউ আছে, ছেলেমেয়ে আছে, ভবিষ্যৎ আছে, তাদের কী হবে! ভাবছে, একটা বংশমর্যাদা আছে। সেটা কী ধুলোয় লুটোবে!
এর পর কমল যে-কান্ডটা করল তা যেন স্বপ্নেও ভাবা যায় না। কমল শৈলবালার পা জড়িয়ে ধরে হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগল। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে; কিন্তু পারছে না। শৈলবালাও কেঁদে ফেলেছেন। মানুষের পশুটাকে মেরে ফেলে মানুষ যখন বেরিয়ে আসতে পারে মানুষ তখন আনন্দ পায়। মানুষের বিজয় দেখে। শৈলবালা কমলকে দু-হাত দিয়ে ধরে তুললেন। আঁচল দিয়ে চোখ মোছালেন। বললেন, ‘প্রতিজ্ঞা করো মদ ছাড়বে! প্রতিজ্ঞা করো বদসঙ্গ ছাড়বে, ব্যবসায় মন দেবে!’
কমল লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘাড় নাড়ল। তারপর দাওয়া থেকে নেমে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। রাতের এই ঘটনাটা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। কমল কুন্ডু একদম বদলে গেছে। শুধু বদলায়নি, ব্যাবসাটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছে। রোজ একবার করে শৈলবালার কাছে আসে। খোঁজখবর নিয়ে যায়। কমলের চেহারা পালটে গেছে। সংসার সুখে ভাসছে। আনন্দ, হাসি, গান।
হারু ভাবছে। অতীতের অস্তিত্ব মানুষের চিন্তায়। হারু চিন্তাভাবনাকে অতিশয় ঘৃণা করে। পয়সাওয়ালা অকর্মণ্য, অলস মানুষই সাত-পাঁচ ভাবে। জগৎ কর্মের। কাজ করো, খাটো, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই রোজগার করো সৎপথে। তারপর পরিশ্রান্ত শরীর তুলে দাও নিদ্রার কোলে। দু-চারটে সদগ্রন্থ পড়ো। গ্রন্থও গুরু। মানুষকে পথ দেখায়। কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘ভয় পেয়ো না, বিশ্বাস রাখো, দৃষ্টি খোলো, তখন তোমার দর্শন হবে, দেখবে, মানুষ সব দেখতে একরকম, কিন্তু কারুর ভেতর ক্ষীরের পোর! যেমন পুলির ভেতর কলাইয়ের ডালের পোরও থাকতে পারে, ক্ষীরের পোরও থাকতে পারে, কিন্তু দেখতে একরকম। মানুষের ভিতর যখন ঈশ্বরদর্শন হবে, তখন পূর্ণজ্ঞান হবে। দেখবে তিনিই এক-এক রূপে বেড়াচ্ছেন। কখন সাধুরূপে, কখন ছলরূপে, কোথাও বা খলরূপে। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই, সাধুরূপ নারায়ণ, খলরূপ নারায়ণ, ছলরূপ নারায়ণ, লুচ্চরূপ নারায়ণ।’
হারুর হাতে মৃৎভান্ড। ভেতরে এক মুঠো ছাই। একজন মানুষের দুরন্ত বেঁচে থাকার অবশেষ। কামনা, বাসনা, অহংকার, আত্মপরতা, পরার্থপরতা, সবকিছুর অবসান। হারু আপনমনে হাঁটছে। হারুর কাছে দু মাইল পথ কিছুই নয়। সে যখন হকার ছিল, তখন কুড়ি-পঁচিশ মাইলের একটা চক্কর মারা তার কাছে কোনও ব্যাপারই ছিল না। এখন বয়েস বেড়েছে। অভ্যাসটাও নষ্ট করে ফেলেছে। দেবেশই নষ্ট করে দিয়েছেন সেই অভ্যাস। ‘তোমার মতো একজন সাঁচ্চা যুবককে আমি যখন খুঁজে পেয়েছি তখন সহজে ছাড়ছি না। তুমি আমার জীবন্ত শাস্ত্র। শাস্ত্রে মানুষের আদর্শের কথা লেখাই থাকে, মানুষ তার থেকে শত যোজন দূরে থাকে। একটা পথ এদিকে যায় তো আর একটা পথ ওদিকে; কিন্তু তুমি? শাস্ত্র যেন তোমাকে অনুসরণ করছে। তুমি হলে জীবন্ত উদাহরণ। আমি আমার প্রাসাদ ছেড়ে এবার পথে নামছি। এতকাল তুমি কী বিক্রি করে এসেছ জানি না। এইবার তুমি আমাকে বিক্রি করো।’
হারু তখন অতশত শক্ত কথা বুঝতে পারেনি। বড়-বড় লোকদের বড়-বড় বুলি। শুধু মনে হয়েছিল, মানুষটা সত্য কথা বলছে, যে-কথা কেউ বলে না। নেতারা জনগণ জনগণ করে, সে হল কথার কথা। নেতা মানেই সু-উচ্চ মিনারের বাসিন্দা। দেবেশ কী তাহলে বোকা ছিল। কত কান্ড করে, কত কী করে, শেষে সব নিবেদন করে দিলেন অখ্যাত এক জনপদের অনগ্রসর মানুষদের। যে-প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুললেন, সে না কি পৃথিবীর আদর্শ। দেশ-বিদেশের মানুষ দেখতে আসে। যে-প্রতিষ্ঠানের ধর্ম হল কর্ম। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৃত্তি, জীবিকা, সংস্কৃতি, নীতি, অর্থনীতি, সব মিলিয়ে এক মহা কর্মকান্ড। বিশাল এক যজ্ঞ। প্রতিদিন প্রাতে সমবেত কণ্ঠে সেখানে একটি মন্ত্রই গীত হয়,
ওঁ সহ নাববতু, সহ নৌ ভুনত্তূ, সহ বীর্যং করবাবহৈ
তেজস্বি নাধবীতমস্তু, মা বিদ্বিষাবহৈ।।
ওঁ শান্তি: শান্তি: শান্ত:।।
আমাকে নয়, আমাদের সকলকে আপনি রক্ষা করুন সমভাবে। আমাদের সকলকে সমানভাবে বিদ্যা দান করুন। আমরা যেন সমভাবে বিদ্যালাভের সামর্থ্য অর্জন করতে পারি, আমাদের সকলের বিদ্যা সফল হোক, আমরা যেন পরস্পরের বিদ্বেষ না করি, ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।
সেই বিশাল পাকুড় গাছ। রাস্তার তিন মাথায় ডালপালা মেলে অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছে মহাপাকুড়। সেই জায়গাটায় এসে হারু দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশিরভাগ সময় এই পাকুড়ের তলাতেই দেবেশ বসে থাকতেন দীন-হীনের মতো। অদূরেই যাঁর অত বড় কান্ড, একরের পর একর জমি। বিদ্যাভবন। কর্মশালা। মাঝখানে বিশাল এক আলোকস্তম্ভ। দেবেশের প্রাণের পরিকল্পনা। মিনারের মতো উঠে গেছে আকাশের বহু ঊর্ধ্বে। সেখানে একটি স্ফটিক। দিনে বিচ্ছুরিত করে সূর্যের আলো। রাতের বিদ্যুতের আলো। বহু-বহু দূর থেকে চোখে পড়ে এই আলোর খেলা।
পাকুড়ের তলে বসে পড়ল হারু। এইবার একটু কষ্ট হচ্ছে। বুকের কাছটা কেমন করছে। শৈলবালা যেদিন চলে গেলেন, সেদিন হারুর মনে হয়েছিল, জীবনটা মরুভূমি হয়ে গেল। গাছ-পালা-পাখি-জল-ফুল-ফল কিছুই আর রইল না। উট চলেছে মুখটি তুলে। দেবেশের মধ্যে পিতাকে, বন্ধুকে, গুরুকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। কাজের ঘোর লেগে গিয়েছিল মনে। সেবা, নি:স্বার্থ সেবা। দেবেশের নির্দেশ ছিল, পকেটে একটাও পয়সা রাখবি না, একটা মানুষ, একটা পৃথিবী। এইবার লড়ে যাও। তোমার টাকা হল ভালোবাসা, সেবা। সব ছাড়োয়ে, সব পাওয়ে। যা আছে সব ফেলে দাও। যা পাও সব তুলে নাও। অহংকারের আল ভাঙলে তবেই প্রেমের পানি আসে। সূর্য চাঁদ হয়ে যায়।
অন্ধকারে বসে থাকতে-থাকতে হারু বললে, আমার জ্ঞান সামান্য, আপনার অনেক কথা আমি বুঝিনি, যা বলেছেন করেছি, এখন তো আর বলবেন না, আমার করারও আর কিছু রইল না। এই ভস্মাধার ওই মিনারের তলায় প্রতিষ্ঠিত করে আমার বিদায় নেওয়ার পালা। হারু হকার আবার ফিরে যাবে তার আগের জীবনে। কবিরাজি ওষুধ, হাজার মলম, উকুন মারা তেলের জগতে।
গালে জলের ফোঁটা। জন্মও নেই মৃত্যুও নেই, গীতা বলছেন। সে একটা ব্যাপার বটে। সহজে মাথায় ঢোকে না। প্রাণের মানুষ জলে গেলে প্রাণ কাঁদে। মরে যেতে ইচ্ছে করে। কী করা যাবে।
হারু একটু সচেতন হল। সাইকেল চেপে কে একজন আসছে। সাদা আলখাল্লা পরা। সাইকেলটা সামনে এসে থামল। হারু চমকে উঠল, ভুল দেখছে না তো! সাইকেলে বসে আছেন দেবেশ। তা কেমন করে হয়! কোলের মৃৎপাত্রে যাঁর ভস্ম, তিনি কেমন করে সাইকেলে চেপে সামনে এসে দাঁড়াতে পারেন! এই পোশাকে, এই বাহনেই তিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরতেন। হারু কোনও ভয় পেল না। অন্ধকারে তাকিয়ে রইল সেই সাদা মূর্তির দিকে।
—কিছু বলবেন আপনি?
—বসে আছিস কেন?
—এই তো সব শেষ হয়ে গেল।
—শেষ হয়নি, শুরু হল। শেষ আছে না কি! অনন্ত সময় অনন্ত কালের দিকে ছুটছে। আমি আমার অতীতে ফিরে যাচ্ছি। সেই শুরু থেকে আবার শুরু করতে। একটা কথা, আমার কোনও স্মৃতি রাখবি না। ওই ভস্ম এখনি নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আয়। এই মুহূর্তে। প্রাচীন সংস্কার বিসর্জন দে। জেনে রাখ, দেবেশ মরেনি। হারুই এখন দেবেশ। আমি তোমায় ছাঁচ দিয়েছি, তুমি এখন মূর্তি বানাও।
সাইকেল আরোহী দেবেশ ওই যে চলে যাচ্ছেন ধীরে-ধীরে। দূর থেকে দূরে পথের বাঁকে।
হারুর চটকাটা ভেঙে গেল। এ কী হল! চোখের ভুল? ঘুমিয়ে পড়েছিল? স্বপ্ন! হারু উঠে দাঁড়াল। হারু নদীর দিকে ফিরছে। আবার সেই দুমাইল পথ।
নির্জন নদী। রাত অনেকটা এগিয়েছে। তারাগুলো সব হেলে পড়েছে। রাতের নি:শ্বাসের মতো দীর্ঘ বাতাস। হারু একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে। জল যেন জপের মন্ত্র পড়তে-পড়তে মোহনার দিকে এগোচ্ছে। ধীরে-ধীরে হারু কোমরজলে।
এইবার সে ভস্মাধারটি বিসর্জন দেবে। ফেললেই হয়, ফেলতে পারছে না। জোয়ার এসেছে নদীতে। জল বাড়ছে হুহু করে। কোমর থেকে বুক। বুক থেকে গলা। তবু মৃৎপাত্রটি ফেলতে পারছে না হারু। বুকের কাছে ধরে রেখেছে। ‘ছাঁচ আমি ভেঙে ফেলব।’ হারু মনে-মনে এই কথাটাই বলছে। সাইকেলের কেরিয়ারে একজন বসতে পারে। দুজন আরোহী। পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে কত দূরই বা গেছে দেবেশের সাইকেল! এখনও ধরা যায়। এখনও ধরা যায়। নদীর জল মাথা ছাপিয়ে উঠল।
কেউ কোথাও রইল না আর। শুধু নদী, শুধু রাত, অজস্র তারার আয়ত চোখ আর শেষ রাতের বাতাসের ফুসফুস শব্দ।