1 of 2

হারানো কথাটা – নীলিমা মুখার্জি

হারানো কথাটা – নীলিমা মুখার্জি

ব্যবস্থা যা হয়েছে, এর মধ্যে কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। এখন একটা জিনিসের শুধু দরকার, সে হচ্ছে শক্ত নার্ভ-এর। নার্ভ মিঃ চৌধুরীর যথেষ্ট শক্ত। ভারতের অন্যতম বিখ্যাত ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান মেহতা ইন্ডাস্ট্রিজ (ইন্ডিয়া) লিমিটেডের তিনি সুদক্ষ জেনারেল ম্যানেজার, নিজের নার্ভের উপর সেটুকু বিশ্বাস তাঁর আছে।

একটা জায়গায় চৌধুরীর একটু ভয় ছিল। ঘরে ঢুকতে-না-ঢুকতেই প্রাইভেট সেক্রেটারি নটরাজ যা বলল, তাতে সে-ভয়টাও কেটে গেল। নটরাজ বলল, ‘এম. ডি. আপনাকে ফোন করেছিলেন স্যার, আপনি আসবার একটু আগেই।’

যেন কিছুই জানেন না এইভাবে চৌধুরী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে, ম্যানেজিং ডিরেক্টর? মিঃ মেহতা নিজে?’

‘হ্যাঁ, স্যার। বললেন, দুটোর পর থেকে তিনি থাকবেন, আপনি যেন সময়মতো তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করেন। বোর্ড মিটিং-এর আগেই।’

‘আপনি ঠিক বলছেন তো, মিঃ মেহতা নিজেই ফোন ধরেছিলেন?’

‘বাঃ, মিঃ মেহতার গলা আমি চিনি না? প্রায়ই তো তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলছি। তা ছাড়া তাঁর গলার স্বর তো ভুল হওয়ার মতো নয়।’

‘তা বটে।’

একটা গভীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিঃ চৌধুরী নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। তাঁর এই প্রাইভেট সেক্রেটারিটিকে প্রায়ই ফোনে কথাবার্তা বলতে হয় ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিঃ মেহতার সঙ্গে। সে যখন মিঃ চৌধুরীর গলার স্বরকে মিঃ মেহতার গলা বলে ভুল করতে পারে, তখন আর ভাবনা কী? অফিসের বাকি লোককে ধোঁকা দেওয়া খুবই সহজ। বোর্ড মিটিং-এর ঘরে ফোন করাই ভালো, ততক্ষণে ডিরেক্টরদের অনেকে এসে হাজির হবে। তাদের ধোঁকা দেওয়া তো আরও সহজ। কলেজে একসময় ভালো অভিনেতা বলে নাম ছিল, গলার স্বর নকল করার দক্ষতা এইবার কাজে লাগবে। বিপদের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার যে-প্ল্যানটি মিঃ চৌধুরী ছকে রেখেছেন, তার মধ্যে এইটেই সবচেয়ে শক্ত ধাপ। আর বাকি সব তো তুচ্ছ খুঁটিনাটির ব্যাপার—আপনা থেকে যন্ত্রের মতন ঘটবে।

খুন ব্যাপারটা আসলে খুবই সহজ, আর নিজের গায়ে আঁচড়টি না লাগিয়ে নিরাপদে পার পেয়ে যাওয়া, হিসেব করে চলতে জানলে তাও খুব শক্ত নয়। অন্তত এ-ক্ষেত্রে। হিসেব পাকা, বন্দোবস্ত নিখুঁত।

মিঃ চৌধুরীর প্ল্যানটি সত্যিই ভালো। হাজাররকম হিসেব করে তিনি দেখেছেন, কোনওদিক থেকেই কোনও ত্রুটি নেই। সব রকমের সম্ভাবনাগুলিকেই বিচার করে দেখা হয়েছে, কোনও ফাঁক নেই। সত্যি কথা বলতে কী, লোকে ধরা পড়ে বুদ্ধির দোষে, হিসেবের গলদে। চৌধুরীর হিসেবে আজ পর্যন্ত কোনওদিন কোনও গলদ বেরোয়নি, আজও বেরুবে না। গরিবের ছেলে তিনি, সামান্য অবস্থা থেকে ধাপে-ধাপে এগুতে-এগুতে আজ তিনি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। কীসের জোরে? বুদ্ধি, হিসেব আর শক্ত নার্ভ।

ভয় পেলে চলবে কেন? আর তা ছাড়া অন্য উপায়ও তো কিছু নেই। এতগুলি টাকা তিনি এখন জোগাড় করবেন কোথা থেকে? অথচ দুদিন বাদেই ডিসেম্বর-অডিট শুরু হবে। তার আগে যা হোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। এখন ব্যবস্থা বলতে এই একটিই,—উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। গত আটমাস বোম্বাই’র ফাটকাবাজারে বেনামিতে জুয়া খেলে তিনি কোম্পানির প্রায় এগারো লাখ টাকা উড়িয়ে দিয়েছেন। কাজটা অবশ্য ঠিক হয়নি, কিন্তু শেয়ারবাজার যে এমন একটা ডিগবাজি খাবে তা কে জানত? সে যাই হোক, অ্যাকাউন্টের মারপ্যাঁচে এই চুরিটা তিনি এতদিন বেশ কৌশলে ঢেকে রেখেছিলেন। কিন্তু আর বোধ হয় পারা গেল না… অডিট শুরু হতে আর মোটে দু-সপ্তাহ বাকি!—বাঁচার একমাত্র পথ এখন…।

এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। মাথার ওপর অন্য কেউ আর থাকবে না। মেহতাকে বাদ দিলে, আর বাকি যে-সব ডিরেক্টর তাদের মধ্যে এমন মুরোদ কারওই নেই যে চৌধুরীকে রুখতে পারে। মিঃ মেহতা অবশ্য সাংঘাতিক ধূর্তৃ—যাকে বলে বাস্তুঘুঘু।

পরিকল্পনাটি গোড়া থেকে হিসেব করে দেখা যাক, সত্যিই কোনও খুঁত কোনও ফাঁকে রয়ে গেছে কি না। প্রথম কথা হচ্ছে, মেহতার ঘরে ঢুকবার বা বেরুবার সময় কারও নজরে না পড়ে যাওয়া। সেটা এমন কিছু শক্ত নয়। লম্বা করিডর; তার ডান দিকটাই বন্ধ থাকে। আর বাঁ-দিকটা লন, তারপর দেওয়াল, তারপর রাস্তা, ওদিক থেকে দোতলার ব্যাপার কিছুই দেখা যায় না, কেউ দেখবারও থাকবে না। যেতে পনেরো সেকেন্ড, আসতে পনেরো সেকেন্ড। মিঃ চৌধুরী ঘড়ি ধরে হেঁটে দেখেছেন। কুড়ি পা, বড়জোর তিরিশ পা…not more than thirty paces। তিরিশ পা বলতে কী-একটা খারাপ কথা যেন মনে পড়ল?

‘From the condemned cell to the scaffold was not more than thirty paces.’—সে কবেকার কলেজে-পড়া একটা ইংরেজি কবিতার লাইন! ফাঁসির সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চ মোটে তিরিশ পায়ের পথ। আচ্ছা ঝকমরি! এই কি এসব কথা ভাববার সময়? এসব এলোমেলো ভাবনা মনকে দুর্বল করে দেয়। চৌধুরীর মন অবশ্য এত সহজে দুর্বল হওয়ার মতো নয়,—চৌধুরী হচ্ছেন হিসেবি লোক, পাকাপোক্ত লোক—ধুরন্ধর বিজনেসম্যান।

আচ্ছা, তাহলে মেহতার কামরায় ঢোকা গেল, এ-পর্যন্ত পাকা। কিন্তু নটরাজ? চৌধুরীকে নিজের ঘর থেকে বাইরে কাটাতে হচ্ছে মোট সাড়ে চার মিনিট। এই সময়টুকু নটরাজকেও সরিয়ে রাখতে হবে। অন্তত মিনিট পাঁচ-ছয়। তার ব্যবস্থাও মিঃ চৌধুরী করে রেখেছেন। বেশ কিছু দিন থেকেই তিনি নটরাজকে একবার করে রোজ নিয়মিত রেকর্ডরুমে পাঠাচ্ছেন,—ফাইল-পত্তর খুঁজে-খুঁজে আনতে। কাজেই নটরাজকে রেকর্ডরুমে পাঠালে সন্দেহ করবার কিছু নেই।

পাঁচমিনিট নটরাজ অনুপস্থিত থাকবে। তাকে রেকর্ডরুমে যেতে হবে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের করিডরের উল্টোদিকের বারান্দা দিয়ে। চৌধুরীর দরজায় ‘এনগেজড’ বোর্ডটা ঝুলিয়ে দিয়ে যাবে, কাজেই সে-সময়টা কেউ উঁকি মারবে না। ঠিক পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে চৌধুরী ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঘরের দরজায় হাজির। কাছেপিঠে কেউ থাকবে না, অন্তত না-থাকাই স্বাভাবিক। তবু, যদি থাকেই, হিসেব করে রাখা ভালো।

যদি থাকে, কাজটা তা হলে আর একদিনের জন্য স্থগিত রাখতে হবে। গোটা কার্যক্রমটার আগাগোড়া প্ল্যান করে ছকে রাখো, ভবিষ্যতের প্রত্যেকটি ধাপ কল্পনায় চোখের সামনে দেখে নাও।—ব্যস, বাকিটা জলের মতো সহজ।

ধরা যাক, সব ঠিক আছে। ঘরে ঢোকা গেল। দরজাটি সঙ্গে-সঙ্গে বন্ধ করে দিতে হবে, ভুল হলে চলবে না।

তারপর

‘এ-সপ্তাহের প্রোডাকশন চার্টটা দেখবেন, স্যার?’

দৈবাৎ যদি এমন হয় যে মিঃ মেহতা সঙ্গে-সঙ্গে প্রোডাকশন চার্টটা দেখতে নিলেন না, একটু দেরি করলেন? না, সে সম্ভাবনা নেই। চার্ট দেখবার জন্যে বুড়ো যে-রকম উতলা হয়ে বসে থাকে! তবু দৈবের কথা কিছু বলা যায় না। সাবধানের মার নেই। স্থগিত রাখো, আর-একদিন হবে।

আচ্ছা ধরা যাক এ-পর্যন্ত ঠিক আছে। ঘরে ঢোকামাত্র মিঃ মেহতা চার্টটি দেখতে চাইলেন। চার্টটি হাতে নিয়েই ডানদিকের দেরাজটি টেনে খুললেন, সেখানে আগের সপ্তাহের চার্টগুলি থরে-থরে সাজানো। আগের সপ্তাহের সঙ্গে এ-সপ্তাহের চার্ট যথারীতি মিলিয়ে দেখতে লাগলেন।

এম. ডি. চেয়ারে বসা, শরীরটা টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, দৃষ্টি চার্টে নিবদ্ধ। ঠিক পিছনে একটু ডানদিক ঘেঁষে চৌধুরী দাঁড়ানো, হাতের খুব কাছে খোলা ড্রয়ার। এই ড্রয়ারেই ফাইলের তলায় রয়েছে এম. জি.-র গুলি-ভরা রিভলবার। গত ধর্মঘটের পর থেকে গুলিভরা রিভলভারটা এম. জি. এখানেই রাখেন…শ্রমিকদের মতিগতি তো ভালো নয়। তারপর? তারপর মোটে এক সেকেন্ড!

চৌধুরীর ডানহাতে দস্তানা পরা থাকবে, রিভলবারে নিজের আঙুলের ছাপ থাকলে চলবে না। কিন্তু দস্তানা দেখে মিঃ মেহতা যদি কিছু প্রশ্ন করে বসেন? তা হলে জবাব হবে, ডানহাতের একটা আঙুল একটু ছেঁচে গেছে, দস্তানা পরলে ব্যান্ডেজটা ঠিক থাকে।

এ-পর্যন্ত তো বেশ হল, এইবারে টেলিফোন। ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ‘কল’…জবাব সঙ্গে-সঙ্গেই আসবে। শুনে অন্তত মিনিটখানেক তো সবাই স্তম্ভিত হয়েই থাকবে! তারপর শুরু হবে হাঁকডাক, ছুটোছুটি। বোর্ডরুম থেকে অফিস-ঘরে আসতে অন্তত দেড়মিনিট—খুব জোরে ছুটে এলে। সেখান থেকে ছুটে মিঃ চৌধুরীর কামরা পর্যন্ত আসতে আরও ষোলো সেকেন্ড। মোট একশো ছয় সেকেন্ড। ফোন সেরে নিজের ঘরে ফিরে আসতে পনেরো সেকেন্ড। তা হলে ঘরে এসেও একানব্বই সেকেন্ড সময় হাতে থাকছে। অর্থাৎ, দেড় মিনিটের ‘সেফটি-লাইন।’ যথেষ্ট সময়, তাড়াহুড়ো করার কিচ্ছু নেই।

আর কিছু? কোনও পয়েন্ট বাদ রইল কি? করিডরে অথবা এম. জি.-র ঘরে যদি কিছু পড়ে-টড়ে থাকে? থাকলেই বা কি? সন্দেহ করবার কিছু নেই। দিনের মধ্যে অনেকবারই চৌধুরীকে করিডরে অথবা এম. জি.-র ঘরে যেতে হচ্ছে… অনায়াসে কিছু একটা পড়ে থাকতে পারে।

নিজের ঘরে ফিরে এসে মিঃ চৌধুরী একেবারে ফাইলপত্তরে ডুবে যাবেন। পাইওনিয়ার-এর টেন্ডার খোলা থাকবে। সকলে ব্যস্তসমস্তভাবে এসে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়বে। গোলমালে মিঃ চৌধুরীর ধ্যান ভেঙে যাবে, ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে চড়া গলায় তিনি ধমকে উঠবেন ‘ব্যাপার কী! আগুন লেগেছে? না, ডাকাত পড়েছে? এত শোরগোল কীসের?’

তারপর? তারপর যা ঘটার আপনা থেকে ঘটে চলবে। আসল কাজটা তখন সমাধা হয়ে গেছে। অডিটে সবই পরিষ্কার হয়ে যাবে; কিন্তু মিঃ চৌধুরীর ওপর একটু দোষও পড়বে না। যার ওপর পড়বে, তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে কোথায়!

মিঃ চৌধুরী একটু মুচকি হাসলেন। এক ঢিলে দুই পাখি বর্তমানের বিপদ থেকে উদ্ধার আর ভবিষ্যতের পথও চিরকালের জন্য নিষ্কণ্টক! একটু বুদ্ধি, একটু হিসেবে, একটু দূরদৃষ্টি।

ঠিক আছে। জলের মতো সহজ।

মিঃ চৌধুরী ঘড়িটি একবার দেখে নিয়ে কলিংবেলে আঙুল রাখলেন। টেবিলে পাইওনিয়ারের টেন্ডার।

‘স্যার?’ নটরাজ ঘরে ঢুকল।

‘হ্যাঁ দ্যাখো, গতমাসে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে যে টেন্ডারগুলি এসেছিল, সেগুলো সব নিয়ে এসো তো। সেই সঙ্গে পাইওনিয়ারের গত বছরের পেপারসগুলিও এনো—ওদের কেসটা আজই শেষ করব।’

নটরাজের ফিরতে অন্তত দশ মিনিট। নটরাজ চৌধুরীকে টেন্ডারের কাজ করতে দেখে গেল। ‘ওরা’ যখন আসবে তখনও চৌধুরীকে টেন্ডারের কাজ নিয়েই মগ্ন দেখতে পাবে। সাক্ষীতে-সাক্ষীতে মিল হয়ে রইল। পাকা কাজ।

আধমিনিট অপেক্ষা করা যাক। কী জানি, নটরাজ যদি কিছু জানার জন্য আবার ফিরে আসে! মিঃ চৌধুরী সেই অবসরে দস্তানাটা হাতে পরে নিলেন।

তিরিশ পা, not more than thirty paces, ফাঁসির সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চ—না-না, এখন ওসব ভাবনা নয়।

মিঃ চৌধুরী ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দরজায় নক করলেন।

‘ভেতরে আসুন—’ মিঃ মেহতার ভাঙা-গলার আওয়াজ।

ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে চৌধুরী মেহতার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সৌম্যদর্শন পক্বকেশ বৃদ্ধ, মুখে সেই অমায়িক হাসি, শুধু চোখ দুটোয় ধূর্ততা মাখানো।

বুড়ো ঘুঘু!—মিঃ চৌধুরী মনে-মনে বললেন। মুখে বললেন, ‘এ-সপ্তাহের প্রোডাকশন চার্টটা একবার দেখবেন, স্যার?’

‘ভালো রিপোর্ট তো হে?’

‘বেশ ভালো স্যার। আগের হপ্তা থেকেও কিছুটা উন্নতি হয়েছে।’

‘বেশ, বেশ!’ মিঃ মেহতা আরও অমায়িক, আরও হাসিখুশি হয়ে উঠলেন, ‘তোমার এফিসিয়েন্সি আমাকে ক্রমেই বেশি করে ইমপ্রেস করছে, চৌধুরী। রোসো, আগের হপ্তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি।’

এম. ডি. ডানদিকের দেরাজটা খুলে একতাড়া কাগজ বের করলেন। কয়েকটা ফাইল দিয়ে রিভলভারটা চাপা দেওয়া রয়েছে। কালো বাঁটটা মিঃ চৌধুরীর নজরে পড়ল। মিঃ মেহতা ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করছেন চার্টটা। চট করে রিভলভারটা চৌধুরী তুলে নিলেন। এক, দুই, তিন—ব্যস।

ট্রাফিকের শব্দপ্রবাহে আওয়াজটা অনেকখানি চাপা পড়ে গেছে। বুড়ো মেহতার দেহ নিঃশব্দে এলিয়ে পড়ল রিভলভিং চেয়ারের ওপর। কার্পেটের একটা অংশ রক্তে লাল হয়ে উঠেছে।

মেহতার ডান হাতের মুঠোয় রিভলভারটা পুরে দিয়ে হাতটাকে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিলেন মিঃ চৌধুরী। তর্জনীটাকে ট্রিগারের সঙ্গে মানানসই করে লাগিয়ে দিলেন। ঠিক হয়েছে। তাড়াহুড়ো কোরো না, ধীরে-ধীরে, ধাপে-ধাপে এগুতে হবে—ঠিক প্ল্যানমাফিক।

রক্ত! সাবধান, হাতে বা কাপড়ে যেন রক্ত না লাগে!

এইবারে আসল কাজ, টেলিফোন। গলাটা দুবার খাঁকারি দিয়ে মেহতার গলার আওয়াজটা এনে নিলেন নিজের গলায়। তারপর টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিলেন।

‘এক্সচেঞ্জ, স্যার,’ এক্সচেঞ্জের বিনয়াবনত কণ্ঠ।

‘বোর্ডরুম দাও।’ মেহতার গলায় চৌধুরী বললেন।

‘বোর্ডরুম? মেহতা স্পিকিং। কে, গণেশপ্রসাদ? বেশ, বেশ। তোমরা সকলেই হাজির আছো তো? দ্যাখো, আজ একটা কথা—আঃ, আমাকে বাধা দিয়ো না, চুপ করে শোনো—আজ একটা কথা তোমাদের বলব। গত দু-বছর ধরে তোমাদের আমি ঠকিয়ে আসছি, গত দু-বছর ধরে আমি কোম্পানির টাকা দু-হাতে চুরি করে আসছি। ডিসেম্বর-অডিটে সবই প্রকাশ পেয়ে যাবে। অবশ্য তাতে আমার কিছু আর এসে যাবে না তখন, কারণ তখন আমি আর এ-পৃথিবীতে নেই। শোনো, আমার বাঁচবার শেষ পথ যেটা ছিল, আজকে তাও বন্ধ হয়ে গেছে…টাকাটা জোগাড় করতে পারলাম না। …হ্যাঁ, সুইসাইড ছাড়া আর পথ নেই। একহাতে ফোন ধরে কথা বলছি, আর-এক হাতে পিস্তল। আর পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই আমি…।’

ফোনটা ছেড়ে দিয়ে মিঃ চৌধুরী একবার মুচকি হাসলেন, গলার স্বরটা ভারি নিখুঁত হয়েছে!

ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে মিঃ চৌধুরী একবার চারদিকে ভালো করে দেখে নিলেন। সব ঠিক আছে। সব শান্ত, নিস্তব্ধ, যেমন ছিল তেমনি, শুধু রিভলভিং চেয়ারে মিঃ মেহতা—একটা অসাড় দেহ—মৃতদেহ। যাক, মৃতদেহকে ভয় করবার কিছু নেই। পরিশ্রম তা হলে সফল হল! কত সহজ—একটু হিসেব, একটু দূরদৃষ্টি—ব্যস, সিদ্ধি!

ঘর থেকে বেরুবার জন্য মিঃ চৌধুরী দরজার হ্যান্ডেলটা ধরলেন। টান দিতেই হ্যান্ডেলটা তাঁর হাতের মধ্যেই খুলে চলে এল। এক সেকেন্ডের জন্য মিঃ চৌধুরী হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইলেন। যে ‘পিন’-টার সঙ্গে হ্যান্ডেলটা লাগানো ছিল, তার একটু মুখ বেরিয়ে আছে, দরজার বাইরের দিকের ভারি হ্যান্ডেলটার সঙ্গে সেটা সংযুক্ত। এদিকটা খুলে যেতেই বাইরের হ্যান্ডেলের ভারে বেরিয়ে-থাকা ‘পিন’-টুকু ক্রমে গর্তে ঢুকে যেতে লাগল। চট করে হাত বাড়িয়ে সেই পিনের মুখটুকু চৌধুরী ধরতে গেলেন, হাতের ধাক্কায় সেটা আরও ভেতরে ঢুকে গেল! বাইরের ভারি হ্যান্ডেলটা পিনসুদ্ধ দরজার সামনে বাইরের মেঝেতে ঝনঝন করে পড়ে গেল।

হুড়কোটা ঠেলে সরাতে হবে—একটা কিছু দিয়ে দরজার হুড়কোটাকে চাড় দিয়ে খুলে ফেলতে হবে—একটু কিছু চাই যা দিয়ে চাড় দেওয়া যায়। একটা কিছু চাই! কিছুই নেই নাকি? একটা লোহার শিক-টিক কিছু। আধমিনিট কেটে গেছে। ছুরি-টুরি কিছু নেই?—জানলা? জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায় না? অসম্ভব, জানলার কথা ভেবে মিছিমিছি সময় নষ্ট করা—জানলা দিয়ে বেড়ালটা পর্যন্ত গলে যেতে পারে না।

মিঃ চৌধুরী দরজা ধরে জোরে টানতে গেলেন, হাত ফসকে আসে। তাছাড়া, ল্যাচ আটকে আছে, টানলে কী হবে? রেগে গিয়ে জোরে একটা ধাক্কা মারলেন দরজায়। কী আহাম্মক, ধাক্কা মারলে খোলে কখনও? রাগ করে লাভ হবে না, জবরদস্তির সময় এখন নয়, ভেবে বের করো, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে একটা উপায় বের করো। এখনও তিরিশ সেকেন্ড সময় আছে। তিরিশ! তিরিশ সম্বন্ধে কী একটা কথা যেন খানিক আগে ভাবছিলেন মিঃ চৌধুরী? ‘ফাঁসি-সেল থেকে ফাঁসি-কাঠ—’ দুর ছাই, যা-তা সব এলোমেলো ভাবনা!…কাগজ-কাটা ছুরি নেই?

একটা কাগজ-কাটা ছুরি পাওয়া গেল একটা মেহতার টেবিলের ওপর। ল্যাচের ফাঁকে ঢুকিয়ে চাড় দিতেই ছুরিটা বেঁকে গেল!

শান্ত হয়ে একটু ভাবো, এখুনি উপায় বেরিয়ে যাবে। পথ একটা আছেই,…এত ভালোভাবে হিসেব করে প্ল্যান করা হয়েছে!

পাওয়া গেছে, উপায় পাওয়া গেছে…হঠাৎ পথ! একটা আইডিয়া…।

বারান্দায় পায়ের শব্দ, দরজায় ঘন-ঘন করাঘাত। ওরা এসে পড়েছে! ওদের শোরগোলে মিঃ চৌধুরীর ভাবনাগুলি আবার গুলিয়ে গেল। একদম গুলিয়ে গেল সব। উপায় একটা ছিল, মিঃ চৌধুরীর ভেবে বের করেছিলেন, হারিয়ে গেল। আইডিয়াটা এসেই আবার চলে গেল, মরীচিকার মতো! আবার ভেবে বের করতে হবে। ভাবো, মাথা ঠান্ডা করে ভাবো।

জোরে-জোরে ঘা পড়ছে দরজার ওপর। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার করঞ্জিয়ার গলা শোনা যাচ্ছে…আহাম্মকটা প্রাণপণে চিৎকার করছে। এত শব্দ করে কেন? মানুষকে ওরা একটু ভাবতেও দেবে না? দুমদাম-দুমদাম—মৃতের প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধা নেই। জানে যে এম. ডি. ঘরে শুয়ে আছেন! এত শব্দ কীসের!

‘শিগগির, মিঃ চৌধুরীকে কেউ একজন গিয়ে ডেকে নিয়ে এসো।’

ভাবো, ঠান্ডা মাথায় ভাবো, সেই উপায়টাকে ভেবে বের করো, সেই মোক্ষম যুক্তি যা বললে কেউ আর তাকে কিছু বলবে না। …এম. ডি. কেমন শান্ত হয়ে শুয়ে আছেন! রক্ত, কত রক্ত!…নাঃ! কিছুতেই মাথায় এল না হারানো কথাটা।

‘দরজা ভেঙে ফ্যালো।’

একমুহূর্তে মিঃ চৌধুরী মন ঠিক করে ফেললেন। এই শেষ পথ তো এখনও খোলা।

এম. ডি.-র শরীর এখনও গরম রয়েছে দেখছি, আশ্চর্য তো! শিথিল মুঠো থেকে সহজেই রিভলভারটা বেরিয়ে এল। পাঁচটা গুলি এখনও অটুট। আর মোটে একটি খরচ হবে।

আর-একবার রিভলভারের আওয়াজ হল। বাইরের লোকজন আর্তনাদ করে উঠল।

অবসর, ভাববার অনন্ত অবসর।—চকিতে সেই হারানো কথাটা বিদ্যুৎঝলকের মতো মনে পড়ে গেল! বললেই হত, ‘ঘরে ঢুকে পড়বার সঙ্গে-সঙ্গেই কাণ্ডটা ঘটে গেল! ঠেকাবার সময় পেলাম না।’

দরজা ভেঙে সবাই যখন ঘরে ঢুকল, মিঃ চৌধুরীর দেহে তখনও ক্ষীণ একটু প্রাণের স্পন্দন ছিল। মুখে তৃপ্তির হাসি, হারানো কথাটা শেষ পর্যন্ত তিনি ভেবে বের করতে পেরেছেন!

রহস্যমালা (সাপ্তাহিক)

২৮ নভেম্বর, ১৯৪৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *