হাঁদা গঙ্গারাম

হাঁদা গঙ্গারাম

ট্যাঁ করে জন্মে আপনি কী পেলেন?

‘প্রথমে মাসিপিসি তারপর ঘুংরি কাশি, তারপর হাম, তারপর টনসিল, মায়ের দয়াও একবার হল। গরমে ঘামাচি, লোমফোড়া, শীতাকালে গা ফাটা।’

‘এহ বাহ্য আগে কহ আর। এ তো সব দৈহিক। মানসিক বলুন। মনের দিন থেকে কী পেলেন?

‘বাল্যবস্থায় কেবল মনে হত খাই, এটা খাই, ওটা খাই, চেয়ে খাই, চুরি করে খাই। পেটে খাই, পিঠে খাই। তখনই বুঝে গেলুম, পৃথিবীতে দুটো ক্লাস।—বড় ক্লাস, ছোট ক্লাস। আর বুঝে গেলাম, পৃথিবীতে একটাই তন্ত্র—আধিপত্য—ছোটদের উপর বড়দের আধিপত্য। ছোটলোক হল বড়লোকের ফুটবল।’

‘ছোটলোক বলতে কী মিন করছেন?’

‘ছোট ছোট লোক। আকারে এবং প্রকারে। সেটা আমি বয়েসকালে বুঝেছি, যেমন অশিক্ষিত পেল্লায় হাতি ইচ্ছে করলে শিক্ষিত সম্পদশালী রাজকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে পায়ে পিষে ফেলতে পারে। শৈশব মানে শাসন, শাসন হল দুটি জিনিসের সমন্বয়, বচন ও ধোলাই! মুখ চলছে, হাত চলছে, হাত চলছে মুখ চলছে। আমার অনেক শাসনকারীর এক শাসনকারী আক্ষেপ করে বলেছিলেন এর পিঠটা যদি একটু চওড়া হত তা হলে এক-একটা থাপ্পড়ের এফেক্ট আরও ভালো হত। প্রগেস অনেক বেটার হত। একজন বলেছিলেন—ইঁদুরের মতো কান, মলে তেমন সুখ হয় না!’

‘শিক্ষা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?’

‘শিক্ষা হল, বিভিন্ন রকমের প্রহারের র‌্যান্ডাম একটি সিলেবাস! স্কুলে গিয়ে আমি শিখেছিলাম, হাঁটু দিয়েও হাঁটা যায়। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার পা আছে, পায়ের পাতা আছে।’

‘কীভাবে?’

‘সব সময় ক্লাসের বাইরে নিলডাউন। পা ব্যবহারের সুযোগ প্রায় ছিলই না। তখনই বুঝেছিলাম ক্লাসলেস সোসাইটিটা কী?’

‘কী সেটা?’

‘অতি সহজ, ক্লাসের বাইরে যারা তারাই ক্লাসলেস। আমি, পঞ্চা, মানকে, নাড় আমরা ছোটবেলা থেকেই হোপলেস, ক্লাসলেস। পায়ের ব্যবহার ভুলিয়ে দেওয়ার ফলে নিজের পায়ে আর দাঁড়ানোই হল না। সব সময় হাঁটুগাড়া নাড়ুগোপাল। দাঁড়াতে না পারায় পৃথিবীর অনেকটাই দেখা হল না, দিগন্ত ছোট হয়ে গিয়েছে।’

‘আর কী শিখলেন?’

‘যা শেখা যায় না, তার নামই শিক্ষা, যে চৌবাচ্চা জীবনে ভরা যাবে না, সেইটাকে ভরার চেষ্টা হল অঙ্ক, যা কখনওই পাওয়া যাবে না, তারই নাম জ্ঞান, যা নেই তারই নাম সংসার, যার কোনওদিন নাগাল পাওয়া যাবে না, তারই নাম সুখ যে কোনওদিন উপুড় হবে না, তার পিঠের নাম শান্তি। মা কালীর ব্যাখ্যা জানেন?’

‘না।’

‘বুকের ওপর চির অশান্তির নৃত্য। মুর্ছা গেলেই শান্তি। চৌবাচ্চার মানে জানেন?’

‘না।’

‘দশরহস্য চৌবাচ্চা। চৌবাচ্চা মানে সংসার। দারাপুত্র হল ছিদ্র। ছেলেবেলায় সেই ছড়া—

ধিনতাকের ব্যাটা তিন তাক,

আমার মা রেঁদেছে পুঁইশাক,

তুই দিতে থাক আমি খেতে থাকি।

তুমি জল ঢেলে যাও, ছেঁদা দিয়ে সব বেরিয়ে যাক। ভর ভর, খালি, খালি, এরই নাম সংসার পাঁচালি। হিস্যা বুকে নিয়ে চলি!’

‘স্ত্রী-পুত্র সুখের নয়! কত আপনজন!’

‘অবশ্যই! কাবুলিওয়ালা পরিবেষ্টিত—আসলি নেহি মাংতা, চোখ চাওয়া মাত্রই —বাজার! টাকা। ছেলের স্কুলের মাইনে। মেয়ের হাতখরচ। অমুকের বার্থ ডে, তমুকের ম্যারেজ অ্যানিভারসারি। জমাদার কাজ করে গিয়েছে, ইলেকট্রিক বিল, ডাক্তার, ওষুধ, অতিথি আপ্যায়ন, বিয়ে, অন্নপ্রাশন। চৌবাচ্চার ছত্রিশ ফুটো।’

‘আচ্ছা স্বদেশ কাকে বলে?’

‘একমাত্র বিদেশে গেলে যেটা আছে বলে মনে হয়।’

‘মা কী জিনিস?’

‘বউয়ের লাথি খেলে যাঁকে মনে পড়ে।’

‘আর বাবা!’

‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আনাড়ি ভাস্কর। যতবার শিব গড়ার চেষ্টা করেন ততবারই বাঁদর তৈরি হয়।’

‘আচ্ছা, আত্মা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা!’

‘আত্মা হল ফোঁপরা চিনে বাদাম। ফট করে ফাটাও, ভেতর ফাঁকা।’

‘আপনার ভেতরে আপনি আছেন টের পান?’

‘খুবই পাই। ব্যাড ভাড়াটে, একপয়সাও ভাড়া দেয় না। কেস করে ওঠানো যায় না, মাস্তান দিয়ে ঠেঙালেও গেড়ে বসে থাকে।’

‘ওঁকার কাকে বলে?’

‘হুঙ্কারের স্ত্রীলিঙ্গ।’

‘ব্রহ্ম সম্পর্কে কী ধারণা?’

‘চা, চিনি ও দুধ ছাড়া চা হল ব্রহ্ম।’

‘প্রেম কাকে বলে?’

‘লাফ মেরে বাসের হাতল ধরতে না পারাকে বলে।’

‘বিবাহ কাকে বলে?’

‘পড়ন্ত যাত্রীর কান ধরে কন্ডাকটরের টেনে তোলাকে বলে।’

‘মানুষের কর্তব্য কী?’

‘স্ত্রীকে খুশি রাখা।’

‘স্ত্রীকে খুশি রাখার উপায়?’

‘জীবম্মৃত হয়ে থাকা।’

‘স্ত্রী সম্পর্কে আপনার অভিমত?’

‘খুব সহজ—স্ত্রী আর ইস্ত্রিতে বিশেষ তফাত নেই। একটা বায়োমেকানিজম আর একটা ইলেকট্রিক্যাল। একটা মাছ, মাংস, ডাল, ডিম খায়, অন্যটা কারেন্ট। জল ছিটিয়ে গরম মেরে সব কোঁচকাঁচ ঠিক করাই হল কাজ, তারপর প্রয়োজনমতো ভাঁজ ফেলা। অসাবধান হলেই ঝেড়ে দেবে শক আর ছেঁকা। স্ত্রীর ছেঁকায় ফোস্কা পড়বে মনে, ওষুধও দেখা যাবে না, ওষুধও নেই, ইস্ত্রিতে পড়বে শরীরে, দেখা যাবে, আছে। এটা নিজেই চলে, ওটাকে চালাতে হয়। ওটার জন্য বিল আসে, এটা নিজেই বিল, নিজেই আবার ক্যাশ বাক্স।’

‘এতই যখন বুঝলেন, তখন বিয়ে করে মরলেন কেন?’

‘তা হলে শুনুন বলি, আমার নয়, মধ্যযুগের সন্ত জোহারের কথা, The holy spirit can rest only upon a married man, because an unmaried man is but half a man, and the Holy spirit does not rest upon, that which is imperfect.

শ্রীরামকৃষ্ণ, কামকাঞ্চনত্যাগী অবতার, বিবাহ করলেন কেন? হিন্দুর দশবিধ সংস্কারের বিবাহ একটি সংস্কার। ওই জোহারের কথা—আত্মাকে ঈশ্বর পৃথিবীতে পাঠালেন—কম্বাইনড, মেল ফিমেল পৃথক নয়, এক—it is a combined male and female soul. The male part enters the male child and the female part enters the female. If they are worthy, God causes them to reunite in marriage. This is true mating.’’

শ্রীরামকৃষ্ণ উদাহরণ দিচ্ছেন—’ মেয়েরা এক একটি শক্তির রূপ। পশ্চিমে বিবাহের সময় বরের হাতে ছুরি থাকে। বাংলাদেশে জাঁতি—অর্থাৎ ওই শক্তিরূপা কন্যার সাহায্যে বর মায়াপাশ ছেদন করবে। কন্যা শক্তিরূপা। বিবাহের সময় দেখো নাই—বর বোকাটি পিছনে বসে থাকে—কন্যা কিন্তু নি:শঙ্ক।

‘‘A good wife is a jewel in the crown’’.

‘হঠাৎ এমন চিৎকার!’

‘রান্নাঘরে রয়েছে যে। গোঁপ-দাড়িওলা চুনো মাছ এনেছি। গঙ্গার চিংড়ি, আনামাত্রই দক্ষযজ্ঞ, এখন ছাড়াতে বসেছেন। তাই একটু জোরে বললুম, মডার্ন ল্যাঙ্গোয়োজে বলে—এনথু। গীতা পড়েছি তো—যোগ কর্মসু কৌশলম—বিপজ্জনক সময় আসছে।’

‘সেটা কী?’

‘এখনই দু’কাপ চা চেয়েই দু’কানে আঙুল দেবো।’

‘আসবে অবশ্যই আসবে, তবে মন্ত্রপূত: চা।’

‘মানে?

‘মানে আমার পিণ্ডিচটকানো চা।’

‘আমারটা না হয় নাই হল। চা আমি তেমন পছন্দ করি না!’

‘অ্যায়, একেই বলে গুড এফেক্ট অফ স্ত্রী! চা ছাড়িয়ে দিলে। সংসারের লিভার এবং লিভার টনিকও, একটাই ব্যাড এফেক্ট—টাক পড়ে যায়, আর টাকা ফুরিয়ে যায়।’

‘তবে সব ওষুধের গুড আর ব্যাড আছে। আপনার চুলের অবস্থা চুলোচুলিতে কেমন আছে?’

‘পাতলা হয়ে আসছে!’

বিশ্ববিদ্যালয়কে বলুন—ডোমেস্টিক সায়েন্সের বদলে ডোমেস্টিক সাইলেন্স পড়াতে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *