হলুদ আলোটি
অদ্ভুত এক আলোর ভিতরে ঘুম ভাঙে মনোরমার। রোজকার আলো নয়। পাকা যজ্ঞিডুমুর ভাঙলে যেমন রং তেমন এক আলো। মনোরমার পায়ের দিককার জানালার ধারে ডুমুর ফল রোজ এসে ঠোঁটে ভাঙে বুলবুলি। সেই রংটাই এখন পৃথিবীময় ছড়িয়ে গেছে এই বৈশাখের বিকেলে।
শানুর থুতনিতে ঘাম, নাকের নীচে ঘাম, বুকে গলায় মুক্তোফল ফুটে আছে ঘামের। বড্ড ঘামে মেয়েটা। কোমরের জাঙিয়ার ইলাস্টিক আঁট হয়ে কোমরে বসেছে। ঘুমের আগে বাতাসা খেয়েছিল, বিছানায় সেই বাতাসার গুঁড়ো, আর লাল পিপড়ে। কামড়েছে সারাক্ষণ, তবু নিপাট ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। মনোরমা শানুর জাঙিয়া খুলে দেয়, বিছানাটা হাত দিয়ে ঝাড়ে, তারপর হঠাৎ নিঃঝুম হয়ে আলোর দিকে চেয়ে থাকে। এ কি পৃথিবী? এ কি পৃথিবী নয়?
পৃথিবীর কি–ই বা সে জানে। একটা শ্বাস ফেলে। কিছু না। তবু মনে হয় তার ঘুম ভেঙেছে এক স্বপ্নের ভিতরে। মাঝে-মাঝে গাছপালা, মাটি, আকাশ পালটে যায়। যজ্ঞিডুমুরের গাছে একটা বুলবুলি ডুমুর ভাঙছে। পাখির গায়ের রোঁয়া উলটে যাচ্ছে হাওয়ায়! মনোরমা ঝুঁকে দেখল, আকাশে ঝড়ের মেঘ। গুমোট ভেঙে দমকা হাওয়ায় ধুলোবালি আর পুকুরের আঁশটে গন্ধ উড়ে এল।
জানালার জালের নীচে একটুখানি ফোকর দিয়ে সাবধানে হাত বাড়িয়ে মনোরমা জানালা বন্ধ করে। উঠে বাইরে আসে। হাওয়ায় তারের ওপর শুকোতে দেওয়া শাড়ি ঝুলে উঠোনে লুটোচ্ছে, শানুর ফ্রক উড়ে গেছে বাগানে, কয়লার স্তূপের ওপর পড়ে আছে ব্লাউজ। সেগুলো কুড়িয়ে নেয় মনোরমা, আর তখনও তার নিবিড় এলোচুলে ঝড়ের বাতাস এসে লাগে, ছুটে আসে বৃষ্টির গন্ধ, তামাটে মেঘে থেকে অদ্ভুত আলোটি ধীরে-ধীরে বহুদূর পর্যন্ত রঙিন করে দিচ্ছে। এই হচ্ছে ঝড়ের রং। এখুনি রেলগাড়ির মতো ঝড় এসে যাবে। তবু দু-দণ্ড মনোরমা দাঁড়ায়। কত অচেনা জায়গা ছুঁয়ে আসে ঝড়, কেমন পুরুষ স্পর্শ তার। মনোরমা দু-দণ্ড দাঁড়ায়, তার কপালের ওপর বড় একটা বৃষ্টির ফোঁটা এসে পাখির ডিমের মতো চড়াৎ করে ফাটে। অমনি দৌড়ে ঘরে আসে মনোরমা, মনে পড়ে–ওই যাঃ অনুপমার ঘরের জানলা তো সে বন্ধ করেনি! কত ধুলো ঢুকে গেছে। দিদি চেঁচাবে ঠিক।
.
অনুপমার ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ, সমস্ত বিছানাময় বালি কিরকির করছে, দাঁতে ধুলো, চুলে ধুলো। বিছানার চাদর উলটে গেছে হাওয়ায়। জানালার পাল্লাগুলো মড়মড় করছে, একটা পাল্লা ব্যাং খুলে ঠাস করে শব্দ করল। খড়কুটো উড়ে পড়েছিল কিছু, ভেন্টিলেটারে পাখির বাসা দমকা হাওয়ায় খসে পড়ল বিছানায়! চমকে উঠে মনোরমার নাম ধরে চেঁচাতে যাচ্ছিল সে, ঠিক সে সময়ে বাইরের রংটা চোখে পড়ল। শালিকের পায়ের মতো হলুদ এ কেমন রং? হলুদ রংটাই কেমন শিরশিরানি তুলে দেয় শরীরে। মনে পড়ে হুলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ, মাঘের দুপুরে উঠোনে পিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে শীতল জলে সেই রোমাঞ্চকর স্নান। হলুদ সেই রংটা কে ঢেলে দিয়েছে চারধারে এখন! পাখির বাসাটা আপনিই গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝেয়। আজকাল বড্ড মনে পড়ে। বাতাস বয় উলটোবাগে, ঠিক সেইসব পুরোনো কথা ধুলো বালির মতো উড়িয়ে আনে, ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে যায়! সে এক বাতাস অনুপমার বুকের ভিতরে দমকা মেরে ঘোরে, ঝড় ওঠে। আজকাল বড্ড মনে পড়ে।
পাশ ফিরতে অনুপমা কুসি ছানাটাকে দেখতে পেল। আহা রে, কতটুকু চড়াইয়ের ছানা। একটা, মুখে বোল ফোটেনি তবু বারবার হাঁ করছে। সদ্য জন্মেছে বলে গায়ের পাতলা চামড়ায়। এখনও রোঁয়া ওঠেনি, রাঙা শরীর কাত করে পড়ে আছে বিছানায়, অনুপমার পায়ের পাতার পাশেই। আর একটু হলে চাপা পড়ত।
অনুপমার উঠে বসতে বড় কষ্ট হয়। বুক ধড়ফড় করে। পাখির ছানাটার দিকে হাত বাড়ায়। ঠিকই, ধরতে সাহস হয় না। কতটুকু ওর শরীর। ডিমসুতোর গুলির মতো একটুখানি। এমন পলকা জীব ধরতে ভয় করে। যদি হাতের চাপে মারা যায়!
বৈশাখী ঝড়ের একটা ঝাঁপটা এসে লাগে বড় নারকেল গাছে। ডগাশুদ্ধ বিশাল একটা শুকনো নারকেল পাতা টিনের চালের ওপর হুড়মুড় করে খসে পড়ে। অনুপমা আজকাল আর চমকায় না।
চড়াইয়ের ছানাটা হাঁ করে আছে। তেষ্টা পেয়েছে নাকি? তোর মা মুখপুড়ি কোথায় রে? আহা কাঁপছে দ্যাখো থিরথির করে। অনুপমা সাবধানে হাত বাড়িয়ে চড়াই ছানাটাকে তুলে নেয়!
সরু কাঠির মতো দু-খানা পা, ছুঁচের মতো সরু নখ তাই দিয়ে ছানাটা অনুপমার একটা আঙুল আঁকড়ে ধরল। শিউরে উঠে বে–খেয়ালে হাত ঝেড়ে ছানাটাকে ফেলে দিল অনুপমা, চেঁচিয়ে ডাকল–মনো, শিগগির আয়।
কেউ শুনল না, শুকনো পাতা উড়ছে, বৃষ্টির ফোঁটা ফাটছে চড়বড় করে টিনের চালে–তার শব্দে অনুপমার গলা ডুবে গেল। জানলার জালের নীচে ছোট্ট ফোকর, সেই ফোকরটা দিয়ে পাখির ছানাটা গলে বাইরে গিয়ে পড়েছে। বাইরে ঝড়।
অনুপমা ঝড়ের বাতাস উপেক্ষা করে বিছানায় কষ্টে হাঁটু গেড়ে বসে জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখছিল। জানালার ধারে নর্দমা, নর্দমার পাশে-পাশে ডুমুরের গাছ কচুর ঝোঁপ, ভাঙের জঙ্গল। কোথায় গিয়ে পাখিটা পড়ল!
বাইরে সেই অদ্ভুত আলোটি, হলুদ। পাখিটা খুঁজতে-খুঁজতে অনুপমা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। আলোটা তার গায়ে কেমন আভা ছড়িয়েছে! ইচ্ছে করল এই আলোতে হাত–আয়নায় একবার নিজের মুখটা দেখে।
অনুপমার ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করেছে মনোরমা। এখন বিছানাটা ঝাড়ছিল।
অনুপমা নিস্তেজ গলায় জিগ্যেস করে–শানু উঠেছে?
–না! ঠান্ডা বাতাস পেয়ে ঘুমোচ্ছে। আরও একটু ঘুমোবে আজ।
অনুপমার একবার বলতে ইচ্ছে হল–শানু উঠলে ওকে সবজির ঝোলটা খাওয়াস মনে করে। তারপর ভাবল, মনোই তো খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, সব করে। বলার দরকার কী? গত দু-মাস ধরে মননাই তো সব করছে! শানু অনুপমার কাছে বড় একটা আসে না আজকাল।
–একটা পাখির বাসা বিছানায় পড়েছিল, একটা চড়াইছানা শুদ্ধ। চড়াইছানাটাকে ধরতে গিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি। বৃষ্টিটা থামলে একটু ঘরের পেছনে গিয়ে দেখিস তো?
–ফেলে দিলে? কাকগুলো ঠুকরে কিছু রাখবে নাকি? নইলে বেড়াল মুখে করে নিয়ে যাবে।
–ধরতে গিয়েছিলাম, আঙুলটা সরু পায়ে আঁকড়ে ধরল এমন! মাগো বলে চমকে হাত ঝাড়লাম, ছিটকে বাইরে পড়ে গেল। বাঁচবে না ঠিকই, তবু দেখিস তো একটু। কুসি ছানাটা, মা পাখিটা রাতে এসে কাঁদবে হয়তো।
মনোরমা বলে–এ পাশটা বৃষ্টির ছাঁটে একটু ভিজে গেছে দিদি।
–ভিজুকগে। বড় বিছানা, আমি তো একটা পাশে পড়ে থাকি।
–ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে, তুমি একটা কিছু গায়ে দিয়ে শোও। একটা কাঁথা বের করে দেব?
–থাকগে, একটু জুড়োই কিছুক্ষণ। পিঠটা ঘামাচিতে ভরে গেছে। চা করবি নাকি? করলে একটু দিস।
–এক্ষুনি করব? চা খাওয়ার একজন লোক তো বিকেলে আসেই, সে এলে একেবারে করতাম।
–তোটন কি আজ আসবে? যা বৃষ্টি!
পালকের ঝাড়নে খাটের বা জ্বর মিহি ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে মনোরমা মুখ লুকিয়ে হাসে। আসবে না আবার! না এসে পারে নাকি?
–তোর জামাইবাবুর ছবিটা মুছিস। মালাটা শুকিয়ে গেছে, ফেলে দিস।
ছবিটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনোরমার বুকটা কেমন করে। অভিরামদা তেমন সুন্দর ছিল না। মোটাসোটার ওপরে চেহারা, প্রকাণ্ড গোঁফ ছিল, মুখখানা সাধারণ। কিন্তু এসবে কিছু যায় আসে না। পৃথিবীতে কোটি–কোটি পুরুষ আছে, তবু তার মধ্যে ওই একজনই ছিল অনুপমার মানুষ। আলাদা মানুষ, একার মানুষ, নিজের মানুষ। মাসদুই আগে অভিরামদা মারা গেছে, অনুপমা তারপর থেকে আজও বিছানা ছাড়েনি। সেই কালিকাপুর থেকে মনোরমা এসে আছে টানা দু মাস। শানুকে রাখে, অনুপমার দেখাশুনা করে। অভিরামদা বাড়িটা করে না গেলে দিদি আজ অবশ্যই কালিকাপুরে বাপের বাড়ির গলগ্রহ হয়ে থাকত। অল্পবয়সেই বাড়ি করেছিল অভিরামদা। তোটন পারবে কি? ছাই পারবে। এখনও চাকরিই পেল না।
বৃষ্টির সাদা চিক–এ ঢেকে গেল কয়েকজন ফুটবল খেলোয়াড়। মাঠে দুধের মতো সাদা–সাদা ফেনা তুলছে বৃষ্টি। বাতাসে বলটা ঘুরে যায় এদিক-সেদিক, জলের মধ্যে থপ করে পড়ে আটকে যায়, আবছা হয়ে গেল মাঠ। খেলোয়াড়রা দৌড়ে মাঠ ছেড়ে চলে আসতে থাকে। সবার আগে তোটন, তার বুকে ধরা বল।
চারধারেই পুকুর, মাঠ, ঘাট, আর শহরতলির নতুন না-হওয়া বাড়ির ভিত। তারা কেউ একসঙ্গে ছোটে না। দু-চারজন একটা বাড়ির নীচের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাদবাকি সবাই শিবাজীর চায়ের দোকানে।
দাঁড়ায় না একমাত্র তোটন, বুকের বলটা শিবাজীর চায়ের দোকানের ভিতরে ভিড়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলে–সন্ধের পর দেখা হবে গণেশ।
গণেশ পিছন থেকে চেঁচায়–কোথায় যাচ্ছিস?
তোটন জবাব দেয় না। তার চারধারে ঝড় আর ঝড়। এক পাল পাগল হরিণের মতো বৃষ্টি ছুটছে। জলপ্রপাতের মতো পড়ছে। তার ভিতরে দেখা যায়, মজা পুকুরের কচুরিপানার পাতাগুলো উলটে দিচ্ছে বাতাস। তার পায়ে বুট, গায়ে কলারওয়ালা সাদা গেঞ্জি, পরনে খাটো প্যান্ট। ঝড়ের প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো নিজেকে বোধ করে সে। কোথায় যাবে? কোথাও না, তোটন দৌড়োবে একা, অনেক দূর।
নীল আগুন ঝলসে ওঠে অকাশে। গুড়গুড় করে মাটি কাঁপে। তোটন হা–হা করে হাসে। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়োয়।
আজ স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে একটা রিগ্রেট লেটার এসেছে। চাকরিটা তার হল না। না হোক। তোটন এখন যে ঘাসপাতা, যে মাটির ওপর দিয়ে দৌড়োচ্ছ, চারধারে যে বৃষ্টির ঝরোকা,
উদ্ভিদের স্বেদগন্ধ, যে শব্দ ও স্পর্শ–এসবের মধ্যে ঠিকই থেকে যাবে তোটন। থাকবে আনন্দ। সে কখনও কাউকে কষ্ট দেবে না। কী ভালো এই ঝড় এবং একাকী সে! অনেকক্ষণ দৌড়োবে তোটন! একা একা।
.
সন্ধেবেলায় বীণা তার দোতলার অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে রোজ। মোটা কালো বীণার স্বামী আশু পোদ্দার পয়সা করেছে। দু-দুটো দোকান। কিন্তু এক দুঃখ, তাদের ছেলেপুলে নেই। স্বামীর তেমন টান নেই বীণার দিকে। রাত করে ফেরে, কাকভোরে আবার বেরোয়। সারাদিন বীণা একা। প্রেতচক্ষু মেলে সে দোতলা থেকে নীচের লোকালয়টির দিকে লক্ষ রাখে। পাড়ার সব কুমারীর খবর রাখে সে, সব বউয়ের। কোন কুমারীর পেটে জ্বণ এল, কোন বউকে স্বামী নেয় না, কে পরপুরুষের সঙ্গ করে, কার বা আছে বাঁধা মেয়েছেলে–কাকের মতো এইসব নোংরা খোঁটে সে, তারপর এ-বাড়ি ও-বাড়ি ছড়ায়।
সন্ধের পর নীচের রাস্তা দিয়ে তোটন যায়। টেরিলিনের প্যান্ট–শার্ট, চুল আঁচড়ানো, ঠোঁটে সিগারেট।
বীণা অন্ধকারে হেসে নেয়। তারপর গলা বাড়িয়ে ডাকে–তোটন। তোটন মুখ তুলে বলে–কী বউদি?
–কোথায় যাচ্ছ?
–অভিরামদার বাড়ি।
–রোজ যাও?
–যাই! দেখাশোনা করি, আমরা আত্মীয়রা কাছাকাছি আছি, আমরা না দেখলে কে দেখবে? বীণা হাসে-আত্মীয় আবার কী? তুমি তো অভিরামবাবুর পিসতুতো ভাইয়ের শালা, ওকে আত্মীয়তা বলে নাকি?
তোটন সিগারেটটা এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিল পিছনে। হঠাৎ মেয়েমানুষটার প্রতি একটা ঘেন্না বোধ করে সিগারেটটা বের করে একটা টান দিয়ে বলল –যা ভাবেন।
–ভাবাভাবির কী আছে ভাই? যার যেখানে ভালো লাগবে যাবে।
–তাই তো যাচ্ছি।
বীণা একটা শ্বাস ফেলে। তোটন চলে গেলে আবার প্রেতচক্ষু মেলে চেয়ে থাকে। তার চোখে ঝড়ের আগের হলুদ আলোটি কখনও বিস্ময় সৃষ্টি করেনি। সে অনুভব করেনি বৃষ্টির সৌন্দর্য। নীচের লোকালয়টির মানুষগুলির পচনশীল শরীরের মাংস কৃমির কথা সে শুধু ভাবে। তার ভারী আনন্দ হয়।
.
শানু ঘুম থেকে উঠে ডাকে–মাসি।
–যাই! রান্নাঘর থেকে সাড়া দেয় মনোরমা।
–আমাকে মশা কামড়াচ্ছে। চুলকে দাও। কেটলির জল ফুটে গেল, ভোটন এখনও এল না। আবার বাবুর জন্য জল চড়াতে হবে নাকি? ভারী বিরক্ত বোধ করে মনোরমা।
রান্নাঘরে হাতজোড়া বলে মনোরমার উঠতে দেরি হচ্ছিল। অনুপমা ও-ঘর থেকে ডাকল–শানু, মাসি কাজ করছে, আমার কাছে আয়, গা চুলকে দেব।
পরিষ্কার রাগের গলায় শানু বলল না, মাসি দেবে।
বোধহয় অভিমানে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল অনুপমা, তারপর হতাশ গলায় বলল –মনো, শানু আমার পর হয়ে যাচ্ছে।
কেটলিটা নামিয়ে ও-বেলার তরকারি গরম করতে বসিয়ে মনোরমা বলল –কী যা তা বলল , মাসি কি কখনও মা হয়!
অনুপমা ও-ঘর থেকে গুনগুন করে বলে–তোর ওপর আমার হিংসে নেই রে মনো, শানু বরাবরই আমার পর ছিল। বাপ বেঁচে থাকতে বাপকেই চিনত, মার কাছে ঘেঁষত না।
শানুকে কলতলায় নিয়ে গেল মনোরমা। মুখ-চোখ ধুইয়ে যখন জামা পরাচ্ছে তখন এল তোটন।
–চা হয়ে গেছে নাকি! বলে গোটা দুই হাঁচি দিল পরপর।
অনুপমা বিছানায় উঠে বসল, বলল –তোটন, আজ একটা চড়াইয়ের বাচ্চা আমার হাতে মরল। মনো, তোটনকে নিয়ে একবার যা না, কুসি বাচ্চাটা, একটু খুঁজে আন।
–এনে কী হবে? ঝঙ্কার দেয় মনোরমা!
–একটু মাটি চাপা দিয়ে রাখ উঠোনে! অন্ধকার হয়ে গেছে, টর্চটা নিয়ে যা।
–যাচ্ছি বাবা, একটু রোসো। মেয়েকে খাওয়াই, তরকারিগুলো গরম করে দিই, তোমার যে কী সব বাতিক!
–বাতিক না রে, আমার হাতেই মরল তো! কষ্ট হয়। কাকে বেড়ালে ছিঁড়ে খাবে, একটু মাটি চাপা দে। হরিনাম করে দিস, ওতে গতি হয়।
খুক করে একটু হাসল তোটন, বলল –চড়াইয়েরও গতি আছে নাকি! অল্পবয়সেই আপনি বড় বুড়ো হয়ে গেলেন বউদি!
–হলাম। বলে পাশ ফেরে অনুপমা।
মেঘ কেটে আকাশ এখন বড় পরিষ্কার। ঝলমলে নক্ষত্র আকাশময়। চাঁদও উঠবে একটু পরে। বাতাস ঠান্ডা, ভেজা। বাইরের ফিকে অন্ধকারের দিকে অভিমানভরে চেয়ে শুয়ে আছে। অনুপমা। শিশুর মতো শোওয়ার ভঙ্গি।
সেদিকে চেয়ে বড় কষ্ট হল মনোরমার। ভগবান ওর সব কেড়ে নিলেন। বর্ষার পর গাছে। যেমন পাতা আসে তেমনি ওর সুখ সদ্য ফুটতে শুরু করছিল। তখনই–
তোটন চায়ে চুমুক দিয়ে বলল –সর্দি লেগে গেল।
মুখ ফিরিয়ে গিন্নির মতো মনোরমা বলে বৃষ্টিতে ভেজা কেন?
তোটন বলল –এমনিই। নতুন বর্ষা, প্রথম ঝড় দেখে ভাবলাম, একটু ঝড় খাই। ঠান্ডা লেগে গেল, ফ্যারিংসের দোষও আছে। জ্বর না এসে যায়!
শরীর যতটা খারাপ তার চেয়ে বেশি ভান করা হচ্ছে। মনোরমা বোঝে। পুরুষদের কায়দা কৌশল সবই পুরোনো এবং বোকার মতো, সেই কারণেই ভালো লাগে মনোরমার।
শানু ডাকে–মাসি!
–উমম!
শানু রাগের গলায় বলে আমাকে আবার মশা কামড়াচ্ছে।
–এ ঘরে এসো।
–না। তুমি আমার কাছে এসো।
অনুপমার ঘর থেকে ওই ঘরে চলে যাওয়ার এই একমাত্র অজুহাত এবং সুযোগ। মনোরমা শানুর কাছে উঠে গেল। শানু বিছানায় ছবির বই খুলে বসেছে, কোলে পুতুল। পুতুলকে ফ্রক দিয়ে ঢেকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ওর পাশে বসে পিঠে হাত বোলাতে-বোলাতে উৎকর্ণ হয়ে থাকে মনোরমা। তোটন আসবে। অনুপমার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে ঠিক উঠে আসবে। রোজই আসে।
তোটন বলল –যাই।
–এসো।
তোটন ও-ঘরে গেল। অনুপমা চিৎ হয়ে শুয়ে ওপরের দিকে চেয়ে দেখছিল। মা–পাখিটা ফিরে এসেছে। ভিজেছে খুব, থরথর করে কাঁপছে। ভেন্টিলেটর থেকে বাসাটা বাচ্চাসুদ্ধ খসে গেছে। শূন্য জায়গাটায় বসে পাখিটা ডাকছে। ভাষাটা বোঝা যায় না। কিন্তু অনুপমা বুঝতে পারে। বুঝতে কষ্ট হয় না।
তোটন আর মনোরমা পাখির বাচ্চাটাকে খুঁজতে গেল না। ভুলে গেছে। ও-ঘরে বসে কথা বলছে দুজন। হাসছে। অনুপমা এখন আর হাসে না! হাসবে না বহুদিন। পৃথিবীর হলুদ রংটা মুছে গেছে। বাতাস এখন উলটোবাগে বয়, যত রাজ্যের পুরোনো কথার ধুলোবালি ছড়িয়ে যায় ঘরময়। বড্ড মনে পড়ে আজকাল।
ভেজা চড়াইটা ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। ডাকল ‘চিড়িক’ করে। অনুপমা চেয়ে থাকে। হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় ভালো দেখা যায় না। অনুভব করা যায়। পাখিটা কাঁপছে। ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। ঝড়ের রংটা নিঃশেষে মুছে গেছে। রং মুছে গেলেই পৃথিবীটা কেমন গভীর হয়ে যায়।