হনুমান
মানুষ নিজের ভবিষ্যৎ জানতে চায়। জীবজগতের অন্য প্রাণী তা চায় না। তারা বাঁচে, সংগ্রাম করে, কালে মরে যায়। কারণ, তাদের স্থিতি, অস্থিতি আছে; কিন্তু কোন প্রশ্ন নেই। আমরা সবাই কালের অধীন—
“কালঃ ক্রীড়তি গচ্ছত্যায়ুস্তদপি ন মুঞ্চত্যাশাবায়ুঃ।।”
কাল খেলা করছেন। মহাকাল। খেলা করছেন আমাদের জীবন নিয়ে। আমরা আছি বলেই কালের গতি। নশ্বর আছে বলেই অবিনশ্বরের অনুভূতি। আসলে কাল হলো স্থির। তার নিজস্ব কোন গতি নেই। আজ-কাল-পরশু আপেক্ষিক শব্দ। কালের আজ, কালের পরশু নেই। আমার আছে। ‘আজ’ আমার; কারণ আমার অবস্থিতি সময়ের অনুভূতিতে বাঁধা। দৃশ্য জগৎ সেই অনুভূতির স্রষ্টা। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত আবার সূর্যোদয়—মানুষ ভাবে চলে গেল একটা দিন! আমার জীবনের একটা দিন। ভাবনার কারণ—আমি অমর নই। আমার জীবন দিনের সংখ্যায় বাঁধা। সেই সংখ্যা আমার জানা নেই। ব্যাঙ্কে আমার কিছু পুঁজি আছে; কিন্তু পাসবই আমার হাতে থাকলেও আপ-টু-ডেট হিসাব আছে আমার ব্যাঙ্কারের কাছে। আমি রোজ চেক কাটছি, কবে বাউন্স করবে আমি জানি না। জানি, আমি একটা ঘড়ি। টিক্টিক্ করে চলছি। কাঁটা ঘুরে যাচ্ছে। কবে দম ফুরোবে আমি জানি না। আমার চলাটাই কাজ। তাই চলছি। বা আমার নিয়তি হলো—থামা চলবে না। থামতে দেবে না আমাকে। দম ফুরোবে, তবেই আমি থামব। আর তার নামই হলো আমার মৃত্যু। মোমবাতির সঙ্গে তুলনীয় আমি। আমি জ্বলব, আমি গলব। গলতে গলতে নিঃশেষ হয়ে যাব একদিন। জ্বলাটাই আমার ধর্ম, গলাটাই আমার নিয়তি।
মৃত্যুই যদি আমার ভবিষ্যৎ, তাহলে ভবিষ্যৎ নিয়ে এত উদ্বেগ কেন? কেন আমার এত মৃত্যুভয়। কারণ, আমি মানুষ। আমি চিন্তাশীল। আমার মৃত্যুভয় চাপা পড়ে যায় আমার অস্তিত্ব রক্ষার ভয়ে। এই মরণশীল সংসারে আমি মূর্খের মতো বাঁচতে চাই অনন্তকাল। আর এই ইচ্ছাই তৈরি করে আমার অহঙ্কার। ‘আমি’র অহঙ্কার। বড় ‘আমি’র পাশে ছোট আমি। জীবের আমি। তামসিক আমি। আর এই আমি আবার মায়ার বশীভূত।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের শরণাপন্ন হই। ঠাকুর বলুন, আমার ‘আমি’ কবে ‘তুমি’ হবে? ঠাকুর বলছেন, শোন, শোন। অত সহজ নয় যে, এক ঝাড়ফুঁকে তোমার ‘আমি’ চলে যাবে! যে জানতে পারে তাকে ভূতে ধরেছে, তার ভূত ছেড়ে যায়। সে তো জানতেই পারবে না। ‘আমি’ সেইরকম এক ভূত। “কলিতে অন্নগত প্রাণ, দেহ বুদ্ধি যায় না। এ-অবস্থায় সোহহং বলা ভাল নয়। সবই করা যাচ্ছে, আবার আমিই ব্রহ্ম বলা ঠিক নয়। যারা বিষয় ত্যাগ করতে পারে না, যাদের ‘আমি’ কোন মতে যাচ্ছে না, তাদের ‘আমি দাস’ ‘আমি ভক্ত’ এ-অভিমান ভাল। ভক্তিপথে থাকলেও তাঁকে পাওয়া যায়।“
ঠাকুর বলছেন, জ্ঞান-অস্ত্র দিয়েও ‘আমি’কে কাটা যায়। কি রকম? “জ্ঞানী নেতি নেতি করে বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ করে, তবে ব্রহ্মকে জানতে পারে। যেমন সিঁড়ির ধাপ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে ছাদে পৌঁছানো যায়। কিন্তু বিজ্ঞানী, যিনি বিশেষরূপে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেন, তিনি আরো কিছু দর্শন করেন। তিনি দেখেন, ছাদ যে-জিনিসে তৈরি—সেই ইঁট, চুন, সুরকিতে সিঁড়িও তৈরি। নেতি নেতি করে যাঁকে ব্রহ্ম বলে বোধ হচ্ছে তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন। বিজ্ঞানী দেখে, যিনি নির্গুণ তিনিই সগুণ। ছাদে অনেকক্ষণ লোক থাকতে পারে না, আবার নেমে আসে। যাঁরা সমাধিস্থ হয়ে ব্রহ্মদর্শন করেছেন, তাঁরাও নেমে এসে দেখেন যে, জীবজগৎ তিনিই হয়েছেন। সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি। নি-তে অনেকক্ষণ থাকা যায় না। আমি যায় না, তখন দেখে, তিনি আমি, তিনিই জীবজগৎ সব। এরই নাম বিজ্ঞান।”
তাহলে আমি কি করব ঠাকুর?
তুমি কি করবে? তাই না! ‘আমি’ কি করবে? তাই তো? শোন তবে। “জ্ঞানীর পথও পথ। জ্ঞান-ভক্তির পথও পথ। আবার ভক্তির পথও পথ। জ্ঞানযোগও সত্য, ভক্তিযোগও সত্য—সব পথ দিয়ে তাঁর কাছে যাওয়া যায়। তিনি যতক্ষণ আমি রেখে দেন, ততক্ষণ ভক্তিপথই সোজা।”
কিছু অস্ত্র তোমার হাতে তুলে দিই।
এক নম্বর—”সেব্য-সেবক ভাব। সেব্য-সেবক ভাবই ভাল! ‘আমি’ তো যাবার নয়। তবে থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে। হনুমান হও। রাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হনুমান তুমি আমায় কিভাবে দেখ?’ হনুমান বললে, ‘সে ভারি মজা। রাম! যখন আমি বলে আমার বোধ থাকে, তখন দেখি, তুমি পূর্ণ, আমি অংশ, তুমি প্রভু, আমি দাস। আর রাম। যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি, তুমিই আমি, আমিই তুমি।’ ‘“ তাহলে তুমি হনুমান হও।
দুম্বর—”মৃত্যুকে সর্বদা মনে রাখা উচিত। মরবার পর কিছুই থাকবে না এখানে কতকগুলি কর্ম করতে আসা। যেমন পাড়াগাঁয়ে বাড়ি—কলকাতায় কর্ম করতে আসা।
তিন নম্বর—”হাম্বা, হাম্বা করো না। কর তুঁহু তুঁহু। গরুকে স্মরণে রাখ। গরু হাম্বা হাম্বা করে, তাই তো অত যন্ত্রণা। লাঙলে জোড়ে, রোদবৃষ্টি গায়ের ওপর দিয়ে যায়। আবার কসাইয়ে কাটে, চামড়ায় জুতো হয়, ঢোল হয় তখন খুব পেটে। তবুও নিস্তার নেই। শেষে নাড়িভুঁড়ি থেকে তাঁত তৈয়ার হয়। সেই তাঁতে ধুনুরির যন্ত্র হয়। তখন আর ‘আমি’ বলে না; তখন বলে তুঁহু, তুঁহু। তখন নিস্তার।”
তুমিও বল, হে ঈশ্বর, আমি দাস তুমি প্রভু, আমি ছেলে তুমি মা। আগেই বল। শমন এসে ধরার আগেই বল।