স্মর-গরল

স্মর-গরল

ভোরবেলায় রান্নাঘরের মেঝেয় উপু হইয়া বসিয়া শশী ঝি চা তৈয়ার করিতেছিল এবং মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিতেছিল। তাহার সম্মুখে দুটি সুশ্রী গড়নের ভাল পেয়ালা, একটা মোটা চীনা-মাটির শক্ত পেয়ালা এবং একটি পিতলের গেলাস। গেলাসে দুধ রহিয়াছে। সৌখীন পেয়ালা দুটি মামাবাবু ও নবীনা মামীমার জন্যে; মোটা পেয়ালাটি রতনের; এবং পেয়ালায় দুধ ঢালিয়া গেলাসে যাহা বাকি থাকিবে তাহাতেই অবশিষ্ট চায়ের জল ঢালিয়া শশীর নিজের চা হইবে। শশী চা ছাঁকিতে ছাঁকিতে নিজের মনে হাসিতেছিল, যেন এই চা ছাঁকার ব্যাপারে অনেকখানি দুষ্ট রসিকতা জড়িত আছে।

এক জাতীয় লঙ্কা আছে যাহা কাঁচা বেলায় কালো থাকে, পাকিলে কালোর সহিত লাল মিশিয়া একটা গাঢ় ঘন বেগুনী বর্ণ ধারণ করে। শশীর গায়ের রঙ ঠিক সেই রকম; যেন তাহার চামড়ার নীচেই লাল এবং কালোর একটা দ্বন্দ্ব চলিতেছে। শশীর বয়স তেইশ-চব্বিশ; আঁটসাঁট কঠিন কর্মঠ যৌবন তাহার দেহে—এবং মনে তাহার একটা আদিম ভাবনা। লঙ্কার সহিত উপমাটা টানিয়া লইয়া গেলে বলা যায়, তাহার মনের মধ্যেও লঙ্কার ঝালের মতো একটা দাহ অহরহ জ্বলিতেছে। তাহার চোখের দৃষ্টি কেরাসিনের কুপির ধূম-দৃষিত শিখার মতো যেন অন্তরের ঐ অনির্বাণ দহনই প্রকাশ করিতেছে। সেকালে এই জাতীয় স্ত্রীলোকের একটি সংজ্ঞা ছিল—হস্তিনী।

চা ছাঁকা শেষ করিয়া শশী নিজের গেলাসে বেশ করিয়া চিনি মিশাইল, তারপর আঁচল দিয়া গেলাস ধরিয়া এক চুমুক চায়ের আস্বাদ লইয়া গেলাস হাতে উঠিয়া গেল।

রান্নাঘরের পাশের ঘরটিতে রতন থাকে। রতন গৃহস্বামীর ভাগিনেয়; বয়স ষোল কি সতেরো। বয়সের হিসাবে তাহার দেহের পরিপুষ্টি বেশী হইয়াছে—দীর্ঘাঙ্গ স্বাস্থ্যবান ছেলে। কিন্তু তাহার দেহের পরিণতি যে পরিমাণ হইয়াছে মনের পরিণতি সে পরিমাণ হয় নাই; বুদ্ধিও খুব ধারালো নয়। সে এখন স্কুলে পড়ে। তাহার গোলগাল, নূতন গুম্ফরেখাচিহ্নিত মুখ দেখিয়া মনে হয় তাহার দেহ তাহার মন বুদ্ধিকে অনেক দূর পিছনে ফেলিয়া আগাইয়া গিয়াছে।

রতন নিজের দোরগোড়ায় দাঁড়াইয়া দাঁতন করিতেছিল, শশী আসিয়া খাটো গলায় বলিল—‘দাদাবাবু, চা হয়েছে, মামবাবু আর মামীমাকে দিয়ে এস গে।’

রতন চকিত হইয়া দাঁতন থামাইল। নূতন পরিস্থিতি অনুধাবন করিতে তাহার একটু সময় লাগিল, তারপর সে বলিল—‘কেন, তুমি দিয়ে এস না।’

শশী ফিক করিয়া হাসিয়া জিভ কাটিল—‘বাপ্‌রে, আমি কি ওঁদের ঘুম ভাঙাতে পারি! পাপ হবে যে।’

চোখ নাচাইয়া শশী চলিয়া গেল। রতন তাহার ইঙ্গিত কিছুই বুঝিল না, বিস্মিত হইয়া ভাবিল, ঘুম ভাঙাইলে পাপ হইবে কেন? যাহোক একটা কিছু করা দরকার। মামাবাবু প্রত্যহ চা তৈয়ার হইবার আগেই ওঠেন, আজ তাঁহার শয্যাত্যাগ করিতে দেরি হইয়াছে। অথচ চা ঠাণ্ডা হইয়া গেলেও তিনি বিরক্ত হন। রতন একটু ইতস্তত করিয়া মামাবাবুর শয়নকক্ষের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। দ্বার ভিতর হইতে বদ্ধ, কিন্তু বদ্ধ দরজার ওপার হইতে যেন চাপা কথা ও হাসির গুঞ্জন আসিতেছে। আতপ্ত বিছানার ক্রোড় হইতে ভাসিয়া আসা মিহি-মোটা মেশানো অর্ধস্ফুট কাকলি কানে আসিল কিন্তু কথাগুলি সে স্পষ্টভাবে ধরিতে পারিল না।

কিন্তু মামাবাবু জাগিয়াছেন তাহাতে সন্দেহ নাই; রতন দ্বারে মৃদু টোকা দিয়া বলিল—‘মামাবাবু, চা তৈরি হয়েছে।’

ভিতরের কূজন ক্ষণকালের জন্য নীরব হইয়া আবার আরম্ভ হইল, তারপর মামাবাবুর উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল—‘নিয়ে আয় রতন।’

খুট করিয়া দরজার ছিট্‌কিনি খুলিয়া গেল, দরজা একটু ফাঁক হইল। ফাঁক দিয়া কাহাকেও দেখা গেল না, পাশের দিক হইতে একটি রমণীর বাহু বাহির হইয়া আসিল। শুভ্র নিটোল বাহু, প্রায় কাঁধ পর্যন্ত দেখা গেল; শাড়ির পাড় বা আঁচল তাহাকে কোথাও আবৃত করে নাই। বাহুটি রতনের হাত হইতে একটি পেয়ালা লইয়া ভিতরে অদৃশ্য হইয়া গেল, আবার ফিরিয়া আসিয়া দ্বিতীয় পেয়ালাটি লইয়া ধীরে ধীরে দ্বার ভেজাইয়া দিল।

রতন ক্ষণকাল অনড় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। প্রথম সিগারেট খাওয়ার তীব্র উত্তেজনার সহিত যেমন মাথা ঘুরিয়া পেটের ভিতরটা গুলাইয়া উঠে, তেমনই রতনের শরীরের ভিতরটা যেন পাক দিয়া উঠিল, হঠাৎ শীত করার মতো একটা রোমাঞ্চ তাহার গলায় বুকে বগলে ফুটিয়া উঠিল।

শশী ঝি কলতলায় বাসন মাজিতে আরম্ভ করিয়াছে। রতন ফিরিয়া গিয়া মুখে চোখে জল দিয়া রান্নাঘরের মেঝেয় উপু হইয়া চা খাইতে বসিল। সকালবেলার এই চা’টি তাহার অতিশয় প্রিয় কিন্তু আজ একচুমুক খাইয়া চা তাহার মুখে বিস্বাদ ঠেকিল। তাহার মনে হইল, অকস্মাৎ তাহার জীবনে একটু নূতন কিছু আবির্ভাবের ফলে সমস্তই যেন ওলট-পালট বে-বন্দোবস্ত হইয়া গিয়াছে।

আর একটু আগে হইতে বলা দরকার।

বিয়াল্লিশ বছর বয়সে শশাঙ্কবাবু—অর্থাৎ মামাবাবু—দ্বিতীয় পক্ষ বিবাহ করিলেন। প্রথমা পত্নীর মৃত্যুর পর সাত বৎসর তিনি নিষ্কলঙ্ক নিষ্কাম জীবন যাপন করিয়াছিলেন, লোকে মনে করিয়াছিল তিনি আর বিবাহ করিবেন না। তিনি কলিকাতায় থাকিয়া ভাল চাকরি করেন; পাড়ায় মানসম্ভ্রমও আছে। শরীর বেশ তাজা ও মজবুত। নিজের সন্তানাদি না থাকায় প্রথমা পত্নীর মৃত্যুর পর মাতৃ-পিতৃহীন ভাগিনেয় রতনকে নিজের কাছে আনিয়া রাখিয়াছিলেন। কলিকাতার একটি ক্ষুদ্র বাড়িতে তাঁহার জীবনযাত্রা একরকম নিরপদ্রবেই কাটিয়া যাইতেছিল। কিন্তু বিয়াল্লিশ বছর বয়সে কেন জানিনা তাঁহার মনের গতি পরিবর্তিত হইল, তিনি আবার বিবাহ করিয়া নূতন বধু ঘরে আনিলেন। পুন্নাম নরকের ভয়ে এই কার্য করিলেন কিংবা অন্য কোনও মনস্তত্ত্বঘটিত কারণ ছিল তাহা বলা শক্ত। শোনা যায়, এই বয়সটাতে নাকি যৌন প্রকৃতির নিবন্ত প্রদীপ একবার উজ্জ্বল হইয়া জ্বলিয়া উঠে।

বধূটির নাম শান্তি; বয়স উনিশ-কুড়ি। মুখচোখ তেমন ভাল না হইলেও গায়ের রঙ বেশ ফরসা। তন্বী নয় কিন্তু দীর্ঘাঙ্গী। রূপ যত না থাক, তাহার দেহে যৌবনের ঢলঢল প্রাচুর্যই তাহাকে কমনীয় করিয়া তুলিয়াছিল। পুরন্ত বুক, পূরন্ত ঠোঁট; সারা দেহে যেন পূর্ণ যৌবনের শ্লথমন্থর মদালসতা। শশাঙ্কবাবু তাঁহার সাত বৎসরের সংযম জীর্ণ-বস্ত্রের মতো ফেলিয়া দিয়া যৌবনের এই ভরা নদীতে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিলেন।

রতনের মনের উপর এই বিবাহের প্রতিক্রিয়া প্রথমে কিছুই হয় নাই। সে শান্তশিষ্ট ভালমানুষ ছেলে, মামার সংসারে থাকিয়া পড়াশুনা করিত ও মাঝে মাঝে মামার দুই-চারিটা ফরমাস খাটিত। তাই, সংসারে দুইটি মানুষের স্থলে যখন তিনটি মানুষ হইল তখনও তাহার জীবনের ধারা আগের মতোই রহিল।শান্তির মনটি ভাল, আসিয়াই স্বামীর গলগ্রহটিকে বিষচক্ষে দেখে নাই, বরং তাহাকে স্বামীগৃহের একটি অপরিহার্য অঙ্গ বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছিল। শান্তির প্রকৃতি একটু মন্থর, আরামপ্রিয় ও আত্মকেন্দ্রিক, তবু বিবাহের মাস দেড়েকের মধ্যে রতনের সহিত তাহার অল্প ভাব হইয়াছিল। রতন একে বয়সে কনিষ্ঠ, তার উপর সম্পর্কেও ছোট, শান্তি তাহাকে নাম ধরিয়া ডাকিত, মাঝে মাঝে ছোটখাটো ফরমাস করিত। একদিন তাহাকে বলিয়াছিল—‘রতন, ইস্কুল থেকে ফেরবার সময় আমার জন্যে চকোলেট কিনে এনো তো।’ রতন পরম আত্মাদের সহিত চকোলেট আনিয়া দিয়াছিল।

তারপর একদিন ফাল্গুন মাসের সকালবেলা রতনের অন্তর্জীবনে অকস্মাৎ কী এক বিপর্যয় হইয়া গেল; বারুদের অন্তর্নিহিত নিষ্ক্রিয় দাহিকাশক্তি আচ্‌মকা আগুনের স্পর্শে প্রচণ্ডবেগে বিস্ফুরিত হইয়া উঠিল।

সেদিন স্কুলে গিয়াও রতনের মন সুস্থ হইল না, একটা অশান্ত উদ্বেগ শারীরিক পীড়ার মতো তাহার দেহটাকে নিগৃহীত করিতে লাগিল; মাঝে মাঝে কান দুটা গরম হইয়া অসম্ভব রকম জ্বালা করিতে লাগিল। আর তাহার চোখের সামনে ভাসিতে লাগিল—একটি নিটোল শুভ্র নগ্ন বাহু…

পরদিন সকালবেলা যখন চা তৈয়ার হইল, মামাবাবুর দরজা তখন খোলে নাই। শশী ঝি মুচকি হাসিয়া বলিল—‘কাল আবার শনিবার গেছে, আজ কি আর এত শিগ্‌গির ঘুম ভাঙবে! যাও দাদাবাবু, ওঁদের চা দিয়ে এস।’

শশীর কথার মধ্যে কিসের যেন ইঙ্গিত আছে, না বুঝিলেও তাহা মনকে বিক্ষিপ্ত করিয়া তোলে। রতন চায়ের পেয়ালা দুটি হাতে লইয়া শশাঙ্কবাবুর দরজার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল; দেখিল দরজা একটু আল্‌গা হইয়া আছে। সে একবার গলা ঝাড়া দিয়া ডাক দিল—‘চা এনেছি।’

ভিতর হইতে ঘুমজড়িত কণ্ঠস্বর আসিল—‘ভেতরে রেখে যাও রতন।’

রতনের বুকের ভিতরটা ধড়াস্ করিয়া উঠিল। সে পা দিয়া দরজা ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। ঘরের বদ্ধ বাতাস সমস্ত রাত্রির নিশ্বাসের তাপে ঈষদুষ্ণ হইয়া আছে; সেন্ট-ক্রীম-কেশতৈল মিশ্রিত একটি সুগন্ধ তাহাকে যেন আরও ভারী করিয়া রাখিয়াছে। বাহিরের ঠাণ্ডা বাতাস হইতে এই আবহাওয়ার মধ্যে প্রবেশ করিয়া রতনের স্নায়ুমণ্ডলী যেন কোনও এক অনাস্বাদিত রসের আভাসে তীক্ষ্ণ সজাগ হইয়া উঠিল। তাহার বুকের ধড়ফড়ানি আরও বাড়িয়া গেল।

বদ্ধ জানালার কাচের ভিতর দিয়া অল্প আলো আসিতেছিল। রতন শয্যার দিকে না তাকাইয়াও শয্যার খানিকটা দেখিতে পাইল….ঠুন্ করিয়া চুড়ির মৃদু আওয়াজ আসিল। রতন নিশ্বাস রোধ করিয়া ঘরের মাঝখানে একটি টেবিলের দিকে চলিল। টেবিলের উপর চায়ের পেয়ালা রাখিতে গিয়া সে দেখিল, শান্তির গলার হার, ব্লাউজ ও কাঁচুলি অবহেলাভরে সেখানে ছড়ানো রহিয়াছে। রতন হঠাৎ চোখ বুজিয়া পেয়ালা দুটি ঠক্ করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। তাহার বুকের রক্ত তখন এমন তোলপাড় করিতেছে যে মনে হইতেছে হৃৎপিণ্ডটা বুঝি এখনি ফাটিয়া যাইবে।

কলতলায় গিয়া তপ্ত মুখখানা ধুইয়া ফেলিবার জন্য জলের চৌবাচ্চায় ঘটি ডুবাইতেই শশী বাসন মাজিতে মাজিতে মুখ তুলিয়া চাহিল; তাহার মুখ দেখিয়া শশী অনিমেষ তাকাইয়া রহিল, তারপর চাপা হাসিয়া বলিল—‘ওমা, তোমার মুখ অমন রাঙা কেন, দাদাবাবু! কিছু দেখে ফেললে নাকি?’

রতন বিহ্বলভাবে বলিল—‘না না—’

বলিয়াই শশীর দিকে চাহিয়া সে স্তব্ধ হইয়া গেল। শশী বাসন মাজার প্রয়োজনে দুই বাহু হইতে কাপড় কাঁধ পর্যন্ত তুলিয়া দিয়াছিল, রতন দেখিল—সেই বাহু! নিকষের মতো কালো বটে কিন্তু তেমনি নিটোল চিক্কণ সাবলীলতায় যেন ময়লা সাপের মতো দুলিতেছে!

শশীর অভিজ্ঞ চক্ষু রতনের পরিবর্তন আগেই লক্ষ্য করিয়াছিল; সে বুঝিয়াছিল। নিজের দিকে আড়চোখে তাকাইয়া সে হাতের পোঁচা দিয়া কাঁধের কাপড় একটু নামাইয়া দিল, চোখ নীচু করিয়া গদ্‌গদ স্বরে বলিল—‘দাদাবাবু, তুমি আর ছেলেমানুষটি নেই—বড় হয়েছ।’

রতন আর সেখানে দাঁড়াইল না, হাতের ঘটি ফেলিয়া দুড়দুড় করিয়া ছাদে উঠিয়া গেল।

ছোট এক ফালি ছাদ, বুক পর্যন্ত পাঁচিল দিয়া ঘেরা। রতন গিয়া দক্ষিণ দিকের পাঁচিলে হাত রাখিয়া দাঁড়াইল। ফাল্গুন প্রভাতের গায়েকাঁটা-দেওয়া নরম হাওয়া তাহার উত্তপ্ত মুখে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। কিন্তু, ঐ হাওয়ার স্পর্শে কী ছিল, রতনের মন ঠাণ্ডা হইল না, বরং আরও অধীর উদ্বেল হইয়া উঠিল।

জীবনের এই সন্ধিকালটি সুখময় সময় নয়; নবলব্ধ এক দুর্দম হর্ষবেগের তাড়নায় শান্তি সৌম্যতা সব নষ্ট হইয়া যায়। যাহাদের জীবনে এই রিপুর অভিযান অকস্মাৎ আসে, নিরস্ত্র অভিজ্ঞতাহীন বয়সে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাহা মারাত্মক হইয়া ওঠে।

রতনের চোখে পৃথিবীর চেহারা বদলাইয়া গেল; যাহা এতদিন নিষ্কাম নিষ্কলুষ তপোভূমি ছিল তাহাই সাক্ষাৎ কামরূপী হইয়া দাঁড়াইল। যেদিকে সে চক্ষু ফিরায় সেই দিকেই যেন কামের লীলা চলিতেছে। বাহ্য জগৎ হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া মনের মধ্যে লুকাইয়াও রক্ষা নাই; সেখানে কল্পনার ক্রিয়া এতই বাড়িয়া গিয়াছে যে বাস্তব জগৎ তাহার কাছে বর্ণ গরিমায় ম্লান হইয়া যায়,—একটি বাস্তব বাহু কল্পনা সৃষ্ট দেহের সংযুক্ত হইয়া দুর্দমনীয় উন্মাদনার কারণ হইয়া ওঠে।

রতন কল্পনাপ্রবণ ছেলে নয়, বরং বিপরীত; কিন্তু তাহার কল্পনাতে ইন্ধন যোগাইবার মতো যথেষ্ট উপকরণ বাড়িতেই ছিল। বাঁধভাঙ্গা বন্যার প্রথম প্রবল উচ্ছ্বাস যেমন ক্রমশ প্রশমিত হয়, রতনের তরুণ জীবনে প্রবৃত্তির এই প্রথম প্লাবন হয়তো কালক্রমে শান্ত হইয়া স্বাভাবিক আকার ধারণ করিত, কিন্তু বাড়ির রিরংসাসিক্ত আবওয়ায় তাহার সে সুযোগ মিলিল না। শশীর ‘চলন-বলন’ কটাক্ষ-ইঙ্গিত তো ছিলই, তাহার উপর নব পরিণীত মামা-মামীর আচরণ তাঁহাদের অজ্ঞাতসারেই রতনের পক্ষে সাংঘাতিক হইয়া উঠিয়াছিল।

শশাঙ্কবাবু মধ্য বয়সে যৌবনবতী ভার্যা বিবাহ করিয়াছিলেন, হয়তো বয়সের বৈষম্যের জন্য তাঁহার অন্তরের গোপন কোণে একটু আত্ম-সংকোচ বা inferiority complex ছিল, তাহাই চাপা দিবার উদ্দেশ্যে তাঁহার আচরণে একটু মৃদু রকম exhibitionism প্রকাশ পাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। প্রথম লজ্জা কাটিয়া যাইবার পর তিনি তাঁহার দাম্পত্য জীবনকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখিবার জন্য আর বিশেষ যত্নবান রহিলেন না। রতনকে হয়তো নেহাত ছেলেমানুষ মনে করিয়াই তিনি তাহার সম্মুখে সমস্ত সাবধানতা ত্যাগ করিলেন। শান্তি প্রথমটা সংকোচ করিত, কিন্তু তাহার লজ্জাও ক্রমে উদাসীনতায় শিথিল হইয়া পড়িল। একদিন রবিবার অপরাহ্নে শশী কাজ করিতে আসিয়া চুপি চুপি রতনের ঘরে প্রবেশ করিল। রতন পড়ার টেবিলে বসিয়া কি একটা করিতেছিল, শশী তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া ফিসফিস করিয়া বলিল—‘দাদাবাবু, মামা-মামীর ঘরের খবরটা একবার নিয়ে এলে না? সেখানে যে—’ বলিয়া গলার মধ্যে হাসিয়া রতনের গায়ে ঢলিয়া পড়িল। রতন শিহরিয়া বলিল—‘কেন, কি হয়েছে?’

‘মুখে আর কত বলব, নিজের চোখেই দেখে এস না, চোখ সার্থক হবে।’ বলিয়া শশী সারা অঙ্গ হিল্লোলিত করিয়া হাসি চাপিতে চাপিতে চলিয়া গেল।

কিছুক্ষণ মূঢ়ের মতো বসিয়া থাকিয়া রতন আস্তে আস্তে উঠিয়া বাহিরে গেল। লম্বা বারান্দার অন্য প্রান্তে মামাবাবুর ঘর। ঘরের দরজা খানিকটা ফাঁক হইয়া আছে, তাহার ভিতর দিয়া শয্যা দেখা যায়…দুইজন আত্মবিস্মৃত নরনারী—তাহারা ছাড়া পৃথিবীতে যে আর কেহ আছে সে জ্ঞান তাহাদের নাই…

রতন ছুটিয়া নিজের ঘরে ঢুকিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল, বালিশে মুখ গুঁজিয়া ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল।

শশী-কখন নিঃশব্দে আসিয়া তাহার বিছানায় বসিয়াছে সে জানিতে পারে নাই, গালের উপর শশীর করস্পর্শে চমকিয়া আরক্ত চোখ মেলিল। শশী তাহার মুখের উপর ঝুঁকিয়া প্রায় গালের উপর মুখ রাখিয়া বলিল—‘কি হয়েছে দাদাবাবু? অমন করছ কেন?’

রতন কাঁপা গলায় বলিয়া উঠিল—‘কি হয়েছে—আমি জানি না—’

শশী তেমনি ভাবে গালে গাল রাখিয়া বলিল—‘কি হয়েছে আমি বুঝিয়ে দেব। —এখন নয়; রাত্তিরে মামা-মামী ঘুমোলে চুপি চুপি উঠে সদর দরজা খুলে দিও। আমি আসব। —বুঝলে?’

দুই সপ্তাহ কাটিয়াছে।

প্রবল জ্বরের তাড়সে অঘোর অচৈতন্য হইয়া রতন বিছানায় পড়িয়া ছিল। তাহার দেহ যেন কোনও বিষের জ্বালায় পুড়িয়া যাইতেছে; সারা গায়ে চাকা চাকা রক্তবর্ণ দাগ ফুটিয়া উঠিয়াছে।

শশাঙ্কবাবু ডাক্তার ডাকাইলেন। ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া শশাঙ্কবাবুকে আড়ালে ডাকিয়া যাহা বলিলেন তাহা শুনিয়া শশাঙ্কবাবু একেবারে আকাশ হইতে পড়িলেন, তারপর ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া উঠিলেন। নবপরিণীতা পত্নীর সম্মুখে তাঁহার বাড়িতে এমন কুৎসিত ব্যাপার ঘটিল, ইহাতে তাঁহার ক্রোধ আরও গগনস্পর্শী হইয়া উঠিল। কাঁপিতে কাঁপিতে রতনের ঘরে গিয়া তিনি চিৎকার করিয়া বলিলেন—‘বেরিয়ে যা এই দণ্ডে আমার বাড়ি থেকে, হতভাগা কুলাঙ্গার।’

রতন বিহ্বলভাবে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল, তারপর অবরুদ্ধ স্বরে বলিল—‘মামাবাবু, আমার জ্বর হয়েছে—’

‘জ্বর হয়েছে! নচ্ছার পাপী কোথাকার।—যাও—এখনি বিদেয় হও। আমার বাড়িতে ও পাপের বিষ ছড়াতে দেব না। —উঃ, দুধকলা খাইয়ে আমি কালসাপ পুষেছিলুম—’ রতন টলিতে টলিতে উঠিয়া দাঁড়াইল, দেয়াল ধরিয়া ধরিয়া স্থলিতপদে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল।…রাস্তায় লোকজনের ব্যস্ত যাতায়াত… পৃথিবীটা কোন্ যাদুকরের মন্ত্রবলে লাল হইয়া গিয়াছে… রক্তাভ কুয়াশার ভিতর দিয়া রাক্ষসের মতো একটা মিলিটারি লরি ছুটিয়া আসিতেছে রতন ফুটপাথ হইতে নামিয়া তাহার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল…।

রতনের মৃত্যুটা অপঘাত কিংবা আত্মহত্যা তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না।

২৭ অগ্রহায়ণ ১৩৫২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *