1 of 2

স্বপ্নলীনা – আশাপূর্ণা দেবী

স্বপ্নলীনা – আশাপূর্ণা দেবী

একটু আগে ঘড়ি দেখেছে কঙ্কা। রাত আড়াইটে।

বিমানের মাথার কাছ থেকে আস্তে উঠে এল, গলির দিকের জানলাটা খুলে দাঁড়াল। নিচের তলার ঘর, জানলাটায় তারের জাল, তবু বিমান খুলতে দেয় না। বলে, জানলার নিচের খোলা ড্রেন থেকে গ্যাস উঠে ওর জীবনীশক্তি কমিয়ে দেবে।

জীবনীশক্তি!

জানলার দিক থেকে বিমানের দিকে একবার চোখ ফেরাল কঙ্কা।

পা থেকে গলা পর্যন্ত চাদর ঢাকা রয়েছে বিমানের, কঙ্কাই ঢেকে দিয়েছে একটু আগে। ঢেকে দিয়ে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে পাতলা ওই চাদরটার নিচে ঠিক যেখানটায় বিমানের হৃৎপিণ্ডটা, সেখানটা সামান্যতমও একটু ওঠাপড়া করছে কিনা। চাদরটা নড়ে নড়ে উঠছে কিনা।

না, নড়ছে না।

অদ্ভুত রকমের স্থির হয়ে গেছে যেন।

আর একবার ভাবল, জীবনীশক্তি!

হাসল একটু।

আবার মুখ ফেরাল গলির দিকে।

কঙ্কার জীবনীশক্তি এত প্রচুর কেন! কঙ্কা যে সারাজীবন খোলা ড্রেনের মুখোমুখি বসে আছে, তার পাঁক থেকে নিশ্বাস নিচ্ছে, তবুও কঙ্কার জীবনীশক্তি কমে যাচ্ছে না। তবুও সমস্ত দিন অকথ্য পরিশ্রম করে সমস্ত রাত জেগে ঘুরে বেরাতে পারে কঙ্কা ।

রাত আড়াইটে।

সাহাবাড়ির ছাতের পাঁচিলের কোণ থেকে আস্তে উঁকি মারল সে। ক্ষয়রোগগ্রস্ত পাণ্ডুর মুখে এক চিলতে মৃত বিবর্ণ হাসি হেসে ইশারায় হাতছানি দিল কঙ্কাবতীকে।

কঙ্কা দেখতে পেল সেই পাণ্ডুর মুখের বিবর্ণ হাসিটা যেন অশরীরী আত্মার হতাশ নিশ্বাসের মত ছড়িয়ে পড়ল সাহাবাড়ির ছাত থেকে মল্লিকদের ভাঙা দেয়ালে, বিমলাদের রোয়াকের কিনারায়। আরো নেমে এল। কঙ্কাদের জানলার নিচের কাঁচা নর্দমার অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

আজ রাত আড়াইটে।

সব দিন একরকম না। দুটো, আড়াইটে, তিনটে যেদিন যখন সময় হয় তার, এমনি করে ছাতের কোণ থেকে ইশারা করে কঙ্কাকে।

কঙ্কা আস্তে পা টিপে ছাতে উঠে যায়।

সে বলে, আমার এই অসুখ-মুখটা দেখতেই তুমি ভালবাসা দেখি, আমি যেদিন ভাল থাকি, অনেক হাসতে পারি, সেদিন তো কই আমার দিকে তাকাও না। অনবরত বিমানের ওই গাল বসা চোখ কোটরে পড়া রোগে কুৎসিত মুখটা দেখতে দেখতে ওইটেই বুঝি অভ্যাস হয়ে গেছে তোমার? উজ্জ্বল কিছু ঝকঝকে কিছু সহ্য করতে পার না।

কঙ্কা কিছু বলে না।

শুধু স্বপ্নাচ্ছন্নের মতন তাকিয়ে থাকে। না, মাঝে মাঝে কিছু ভাবেও কঙ্কা। ভাঙা-চোরা এবড়ো-খেবড়ো আলসেয় ঘেরা ওদের ওই একতলা ঘরের ছাতটায় স্বপ্নাচ্ছন্নের মত ঘুরতে ঘুরতে ভাবে, সাহাদের বাড়ির ছাতের কোণ থেকে নিঃশব্দ পায়ে কে যেন নেমে আসছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না তার, আগাগোড়া কেমন যেন একটা কালো কাপড়ে মোড়া। সে নেমে এল, কঙ্কার ওই তারের জাল ঘেরা জানলার নিচে থমকে দাঁড়াল, দেখল কঙ্কা ঘরে নেই, বিমান শুয়ে আছে। ঘুমচ্ছে ঘুমের ওষুধ খেয়ে। ওর পাতলা প্লাস্টিকের চাদরের মত টান-টান পাতলা চামড়া-ঢাকা হাড়ের খাঁচাখানার মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা ধুকধুক করছে।

কঙ্কা ঘরে নেই তা তো দেখেই এসেছে কালো কাপড় মুড়ি দেওয়া লোকটা। দেখে এসেছে ছাতে বেড়াচ্ছে কঙ্কা। তাই সাহস বেড়েছে।

জানলার ধার থেকে অদ্ভুত কৌশলে ঢুকে গেল ও ঘরের মধ্যে। বিমানের মাথার কাছে দাঁড়াল, বিমান টের পেল না। ও ছায়ার মত হালকা হাতখানা বাড়াল, বিমান জানতে পারল না, ধুকধুক করা হৃৎপিণ্ডটা মুঠোয় করে চেপে ধরল, চাপ দিল, আরও চাপ দিল, হিঁচড়ে টানল, ছিঁড়ে তুলে আনল। তারপর মুঠোয় চেপে নিয়ে যেমন করে এসেছিল তেমনি করে বেরিয়ে গেল।

বিমান বুঝতে পারল না।

অনেকক্ষণ পরে কঙ্কা নিচে নামল। ঘরে ঢুকল, বিমানের মাথার কাছে দাঁড়াল একটুক্ষণ, তারপর হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল,—”ও মাগো, কখন এমন হল, আমি তো বুঝতে পারিনি!

ওর চিৎকারে সবাই উঠে এল বাড়ির মধ্যে থেকে। অনেকে ছুটে এল বাড়ির বাইরে থেকে। সবাই বলল, ‘আহা, চোরের মতন কখন এসে অমূল্য ধন চুরি করে নিয়ে গেল বউমা!’

ছাতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এইসব ভাবে কঙ্কা। অগাধ ছাত নয়, দু’খানি ঘরের মাথা। এরই এক কোণে আবার গোছানো তরঙ্গিণীর সংসারের কয়লার গুঁড়ো, নারকেলের মালা, তালের আঁটি, আখের খোলা, ভাগ করে করে জড় করা আছে।

ওইগুলো বাঁচিয়ে হাত কয়েক জায়গায় ঘোরাঘুরি।

কিন্তু ভাবনাটাকে যত ইচ্ছে দৌড় করাতে তো আর জায়গা লাগে না। আরো পাঠিয়ে দেয় কঙ্কা ভাবনাটাকে। ভাবে তারপর কঙ্কাও এক রাতে অমনি কালো কাপড় মুড়ি দিয়ে গলির দিকের দরজাটা খুলে ফেলবে, ছায়ামূর্তির মত নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়ে দৌড়তে থাকবে ঘুমন্ত রাস্তার ওপর দিয়ে।

দৌড়বে, শুধু দৌড়বে।

কোথায় গিয়ে থামবে তা জানে না। আর ভাবতে পারে না। আকাশের ওই মরা মরা আলোর ওপর নতুন দিনের আলোর আভাস এসে পড়ে। কোথায় যেন কাক ডাকতে থাকে বিশ্রী সুরে। রাস্তায় জল দেবার সাড়া পাওয়া যায়। ময়লা-ফেলা গাড়িগুলোর চাকার শব্দ ওঠে।

কঙ্কা নেমে আসে।

বিমানের ঘরে ঢোকে।

আর কোথা যাবে, আর ঘর নেই। আর একটা ঘরে তরঙ্গিণী আর বিজয় তিন-চারটে ছেলেমেয়ে নিয়ে শুয়ে আছে। অনেকটা বেলা না হলে ও-ঘরের দরজা খুলবে না।

হ্যাঁ, আরও একটা ঘর আছে বটে, রান্নাঘর। রাতের রান্না আর খাওয়ার কদর্য কুৎসিত চিহ্ন নিয়ে পড়ে আছে। একটু পরে ঠিকে ঝিটা এসে ওই নোংরা নোংরা বাসনগুলো ঝনঝন করে টেনে নামাবে, ঝাঁটার শব্দ তুলে জল ঢেলে ঢেলে ঘরের মেজেটা ধোবে, তারপর কখন এক সময় যেন চেঁচিয়ে ডাক দেবে—‘অ ছোটবউদি, উনুন ধরে খাঁ-খাঁ করছে যে গো!’

কঙ্কা ঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বলবে, ‘যাচ্ছি’, তারপর বিমানের হাতে তোয়ালেটা ধরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি ওর মুখ ধোওয়ার জল-ভর্তি পিকদানিটা তুলে নিয়ে স্নানের ঘরে চলে যাবে।

বিমান পিছন থেকে বিশ্রী ভাঙা গলায় বলবে, ‘এত রান্নার তাড়া কিসের! এত পিণ্ডি গেলে কে?’

তা ওর কথাটা কেউ শুনতে পায় না।

তরঙ্গিণী তখনও ওঠে না।

তরঙ্গিণী কেন উঠবে? খোলা ড্রেনের গা-ঘেঁষা এই ইট বার-করা একতলা বাড়িটার সম্রাজ্ঞী নয় সে? এ সংসারের যত কিছু খরচ সব বিজয়ের টাকায় নয় ?

কিন্তু আজকের কথা আলাদা।

আজ একটু আগে বিমানের গায়ের চাদরটা গলা পর্যন্ত টেনে দিয়েছে কঙ্কা, মাথার কাছে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে, ঢাকা দেওয়া চাদরের নিচে, ঠিক যেখানে বিমানের হৃৎপিণ্ডটা ধুকধুক করত সেখানটা কি রকম অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে গেছে।

কিন্তু, ‘ও মাগো, কি করে এমন হল গো’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেনি কঙ্কা। উঠবেও না এখন। এই রাত আড়াইটে থেকে সেই ভোর হয়ে যাওয়া পর্যন্ত নিথর থমথমে রোমাঞ্চময় সময়টুকু আস্তে আস্তে বুঝে বুঝে তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করবে কঙ্কা।

ছাতে উঠে গেল কঙ্কা।

আস্তে পা টিপে।

সাহাদের বাড়ির ছাতের কোণটা আরো কাছাকাছি এল। কঙ্কাকে যে ইশারায় হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, সে নিষ্পলক দৃষ্টি মেলে কঙ্কার দিকে চেয়ে রইল।

কঙ্কার মনে হল ও দৃষ্টি কি ব্যঙ্গের? না কি শুধু সকরুণ মমতার?

ও দৃষ্টি কি বলছে, ‘কঙ্কা, তুমি এইবেলা পালাও।’ বলছে, ‘কঙ্কা, পৃথিবী বড় শক্ত ঠাঁই, হয়তো আর কোনদিন পালাতে পারবে না তুমি।’

কিন্তু না, কঙ্কা আর ভয় খাবে না।

ও অনুভব করতে পারছে, এরপর গলির দিকের দরজাটা যখন ইচ্ছে খুলতে পারবে। ঘরে কেউ তাকিয়ে থাকবে না তো কষ্কার দিকে।

বিমানের সরু চৌকিতে পাতা বিছানাটা ফেলে দেবার পর আর কিছু পাতা হবে না চৌকিটায়।

দরজাটা খুলে রেখে এসে আর একবার শুধু চৌকিটায় বসবে কঙ্কা, আস্তে নিজেকেই বলবে, ‘আমি চেষ্টা করেছিলাম, অনেক চেষ্টা করেছিলাম।’

এ সমস্তই তো এরপর কঙ্কার হাতের মুঠোয় এসে যাবে। তবে এখন এই অদ্ভুত রোমাঞ্চময় সময়টুকু বুঝে বুঝে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে না কেন কষ্কা?

সাহাদের বাড়ির দিকের আলসেয় মুখ রেখে দাঁড়াল কঙ্কা। দেখল সেই ক্ষয়রোগগ্রস্ত পাণ্ডুর মুখটা কোথায় যেন সরে গেছে। ওদের চিলেকোঠার আড়ালে না কোথায়।

দেখল সাহাদের মেজো বউয়ের ঘরে মৃদু ঘুমন্ত নীল আলো জ্বলছে। দেখল ঘরের সিলিঙে বন্‌বন্‌ করে পাখা ঘুরছে। ওই হাওয়ার ঠেলাঠেলিতে জানলার নেটের পর্দাটা উড়ছে।

জানলার ধারেই মেজো বউয়ের বাপের বাড়ির পাওয়া বিয়ের খাট, মোটা মোটা ছত্রি, ভারী ভারী বাজু,কালচে লাল গাঢ় মেহগিনি পালিশ। তাতে সাদা ধবধবে বিলিতি নেটের মশারি ঝুলছে। বাতাসে দুলছে, উড়ছে, তবু ভিতরের রহস্য ভেদ হয়ে পড়ছে না। মশারির ঝালরে ভারী ভারী সুতোয় বোনা লেস্‌।

চোখ ঠিকরোতে ঠিকরোতে চোখে জ্বালা করে উঠলেও কিছু দেখা যায় না। তা এখন আর দেখতে চেষ্টাও করে না কঙ্কা, আগে করত, ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত।

তখন বিমানের অসুখ করেনি।

তখন সারারাত বিমানের মাথার কাছে বসে থাকতে হত না কঙ্কাকে। বিমান তখন অর্ধেক দিন রাতে ফিরত না।

তখন মাঝে মাঝে সাহাদের মেজো বউ ওদের খিড়কির দরজা খুলে পচাগলি ডিঙিয়ে এ-বাড়ি বেড়াতে আসত। হাতিপাড় শাড়ি পরা ভারীসারি দেহখানি নিয়ে এসে বসে বলত, ‘দেখতে এলাম ভাই তোমাকে। জলজ্যান্ত দু’দুটো পাস করা মেয়েমানুষ কেমন দেখতে হয় তাই দেখতে এলুম।’

সেই দেখতে আসাটা অবশ্য ছল, দেখাতেই আসত মেজো বউ। গহনা কাপড়, স্বামীর সোহাগ। দেখাত, আর মুহূর্তে মুহূর্তে বিস্ময়ের পাথারে ডুবে যেত।বলত, ‘ওমা খাট পালঙ্ক কিছু নেই তোমার? কেন ভাই, বিয়ের সময় হয়নি? দেননি তোমার বাবা? কী আশ্চর্য! খাট বিছানা শাড়ি গহনা না দিলে আবার বিয়ে হয় ?’

আবার বলত, ‘বিমানবাবু কাল অত রাত্রে কোথা থেকে ফিরলেন ভাই? নেমন্তন্নে গেছলেন বুঝি? আমরা তো অবাক! রাত দুটো বেজে গেছে, তখন বিমানবাবু দোর ঠেলাঠেলি করছেন।’

কঙ্কা বলত, ‘কি কাণ্ড, আপনারাও অত রাত অবধি জেগে ছিলেন? বাড়িতে তো তাহলে আপনাদের দারোয়ান না রাখলেও চলে।’

সাহাদের মেজো বউ রাগ করে উঠে যেত।

কিন্তু বেশিদিন রাগ করে থাকতে পারত না। নতুন কোনও গহনা গড়ান হলেই রাগ ভেঙে চলে আসতে হত তাকে। দুটো পাস করা মেয়েকে নইলে পেড়ে ফেলবে কিসের জোরে ?

এসে বসত আর বলত, ‘তুমি তো আর যাবে না ভাই, আমিই এলাম মান খুইয়ে।’

এখন আর সাহাদের মেজো বউ আসে না।

বিমানের অসুখে ওইটুকুই লাভ। পাড়ার কেউ আর আসে না।

বিমানের অসুখটা যে নোংরা কুৎসিত ইতর! ভদ্র সভ্য পরিচ্ছন্ন রঙ্গিণী নাক কুঁচকে কুঁচকে পাড়ায় পাড়ায় জানিয়ে এসেছে সে খবর।

কিন্তু কঙ্কা জানে কাল ওরা সবাই আসবে। বিমানের ওই গলা পর্যন্ত ঢাকা চাদরটা টেনে মুখ পর্যন্ত ঢেকে দেওয়া হয়েছে, এ খবর পেলে সবাই আসবে।

সাহাদের মেজো বউ বলবে, ‘ওমা এত অসুখ করেছিল? কই টের পাইনি তো! ডাক্তারের গাড়ি-টাড়ি আসা চোখেই পড়েনি। তা কোন কোন ডাক্তার দেখল ভাই?’

আর বিমলা এসে বলবে, ‘আহা, সামান্য দু’গাছি কাঁচের চুড়িতেও কত শোভা ছিল। তা একগাছা করে হাতে কিছু রেখো বউদি, নইলে বড্ড যেন খাঁ-খাঁ করে।’

মল্লিক-গিন্নি ওকে কিছু বলবেন না, তরঙ্গিণীকে বলবেন। উনি তরঙ্গিণীর বন্ধু।

তরঙ্গিণী এসে বলবে, ‘যা হবার তা তো হয়েই গেল ছোট বউ, তা বলে না খেয়ে তো আর চিরকাল থাকতে পারবে না? উঠতেও হবে, মুখে দিতেও হবে। ঘরে বসে থেকে আর কি করবে বল? ওঠ, তবু কাজেকর্মে মনটা ভাল থাকবে।’

এসব কথা কেউ কোনদিন বলেনি কঙ্কাকে, তবু কঙ্কা জানে, কাল থেকে ওরা এইসব বলবে।

কিন্তু কঙ্কা তো আর এই ভোলা ড্রেনের গা-ঘেঁষা তারের জাল-ঢাকা জানলাটায় দাঁড়িয়ে থাকবে না তখন। গলির দিকের দরজাটা খুলে নেমে যাবে। নেমে গিয়ে দৌড়বে, কেবল দৌড়বে। জীবনটাকে নিয়ে যা খুশি করবে।

সবই কঙ্কার হাতের মুঠোয় এসে গেছে এখন, যে কঙ্কার প্রচুর জীবনীশক্তি আছে। সারাজীবন পাঁক থেকে নিশ্বাস নিয়েও যার সে শক্তি ফুরোয়নি।

সাহাদের বাড়ির দিক থেকে সরে এল কঙ্কা। সিঁড়ির ঘরের দেয়ালটায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ল।

নিচের তলার ঘরটার কথা কিছুতেই আর ভাববে না ঠিক করলে, তবু কি করে যেন ঘুরেফিরে সেইটাই মনে পড়ছে।

এখন রাত আড়াইটে, কি তিনটে, কি জানি কত! হয়তো আরও বেশি। হয়তো এই এক্ষুনি রাস্তায় জল দেবার শব্দ পাওয়া যাবে। বিশ্রী সুরে কোথায় যেন কাক ডেকে উঠবে। আর ময়লা ফেলা গাড়িগুলো ঝড়াং ঝড়াং করে ঘুমন্ত শহরের চেতনায় ধাক্কা মারবে।

কিন্তু তখন রাত ছিল মাত্র বারোটা।

তরঙ্গিণী আর বিজয় দরজায় খিল দিয়েছিল, অনেকক্ষণ আগে। এ-ঘর থেকেও বিজয়ের নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।

বিমান মশায় ছটফট করছিল।

মশারির ভেতর শোবার উপায় নেই বিমানের—নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে। অনেকদিন ভেবেছে কঙ্কা একদিন জোর করে মশারিটা টাঙিয়ে দিয়ে দেখবে, সত্যিই বিমানের ওই ধুকধুক করা দমটা বন্ধ হয়ে যায় কিনা।

কিন্তু কিছুতেই সেইটা আর দেখা হয়ে ওঠেনি কঙ্কার। বিমান তার ওই হাড়ের খাঁচাখানার মধ্যে এখনো যেটুকু জীবনীশক্তি আগলে রেখে দিয়েছে তার জোরেই কঙ্কার হাত থেকে পাখার বাতাস খয়, যতক্ষণ না ঘুম আসে।

কিন্তু সব দিনই কি ঘুম আসে?

আসে না।

ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে হয়।

কিন্তু আশ্চর্য, গোড়ায় কিছুতেই সে ওষুধ খেতে চায় না। যেন কঙ্কাকে খাটাবার জন্যেই, নিজে যতক্ষন পারবে কষ্ট সইবে।

কঙ্কা শিশিটায় হাত দিতে গেলেই খিঁচিয়ে ওঠে বিমান। কর্কশ গলায় বলে, ‘হয়ে গেল? পতিব্রতা সতীর পতিসেবা হয়ে গেল? আর পাঁচ মিনিট বাতাস করলে হাত ক্ষয়ে যাবে?’

কঙ্কা আবার পাখাখানা তুলে নেয়।

আজও তাই নিয়েছিল।

গরম আর মশা দুইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল সেই আধভাঙা পাখাটা দিয়ে।

বিমান বলল, ‘জল দাও।‘

কঙ্কা উঠল, জল দিল।

বিমান বলল, ‘গায়ের ঢাকাটা খুলে দাও।’

কঙ্কা খুলে দিল ঢাকাটা।

আরো খানিকক্ষণ উঃ আঃ করল বিমান। তারপর হঠাৎ রেগে উঠে বলল, ‘দাও, চুলোর ছাই ওষুধটাই গিলিয়ে দাও।’

কঙ্কা উঠল। ওষুধের শিশিটা আনল। জল নিল। দেখল ওষুধটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। নতুন এসেছে, প্রায় পুরো শিশিই রয়েছে।

‘এত দেরি কিসের?’ খেঁকিয়ে উঠল বিমান, ‘ওষুধে মন্তর পড়ছ নাকি?’

কঙ্কা কথা বলল না, ঢেলে দিল বিমানের মুখে।

ওষুধ খেল বিমান। মুখটা একবার বিকৃত করল। ‘চাদরটা পায়ে ঢেকে দাও’ বলল খিঁচিয়ে।

একটু নীরবতা।

চোখটা জড়িয়ে এসেছে বিমানের, জড়িয়ে জড়িয়ে কি যেন বলছে, কঙ্কা হাতের পাখা থামিয়ে দেখছে, রেগে উঠছে কিনা বিমান।

রেগে উঠছে না।

কাঠ হয়ে বসে আছে কঙ্কা, দেখছে গায়ে মশা বসলে নড়ে উঠছে কিনা বিমান।

নড়ে উঠছে না।

মশারিটা টাঙিয়ে দেবে কঙ্কা?

আজকে দেখবে পরীক্ষা করে?

না, মশারি কঙ্কা টাঙাল না।

সকাল বেলা তরঙ্গিণী ঢুকবে এ-ঘরে, বিজয় ঢুকবে। বলবে, ‘মশারি কে টাঙাল?’ বলবে ‘মশারির মধ্যে শুলে ওর দমবন্ধ হয়ে আসে না?’

তাই শুধু বসে থাকল কঙ্কা।

নিজের নিশ্বাসটাও সহজভাবে ফেলছে না, পাছে বিমানের স্বাস-প্রশ্বাসের গতিটা ধরা না পড়ে।

একটু পরেই স্তব্ধ হয়ে গেল বিমান। শান্ত হয়ে গেল। সেই হাড়ের খাঁচার মধ্যেকার পাখিটা আর নড়ল না।

কঙ্কা ওর পায়ের কাছ থেকে চাদরটা টেনে গলা অবধি ঢাকা দিয়ে দিল। দেহের সমস্ত স্নায়ুকে চোখের দৃষ্টিতে কেন্দ্রীভূত করে তাকিয়ে রইল। নিঃসন্দেহ হল।

তখন ঘড়ির দিকে তাকাল কঙ্কা।

দেখল রাত আড়াইটে।

গলির দিকের জানলাটা খুলল। দেখল সাহাদের বাড়ির ছাত থেকে কৃষ্ণা-অষ্টমীর পাণ্ডুর চাঁদের মরা আলো অশরীরী আত্মার হতাশ নিশ্বাসের মত ছড়িয়ে পড়েছে মল্লিকদের ভাঙা দেয়ালে, বিমলাদের রোয়াকের ধারে, কঙ্কাদের জানলার নিচের খোলা ড্রেনে।

ছাতে উঠে গেল কঙ্কা আস্তে পা টিপে।

এখন সিঁড়ির ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেসিয়ে বসে সব দেখতে পাচ্ছে। নিজেকেও দেখছে। দূরে থেকে, সিনেমার ছবির মত।

এইবার কি তবে নিচে নেমে যাবে কঙ্কা? সকাল না হতেই? ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে উঠবে ‘ও মা গো। এমন কখন হল গো?’

অনেক লোক ছুটে আসবে সে কান্নায়।

বারবার উচ্চারণ করতে লাগল কঙ্কা ওই কথাটা। আস্তে, জোরে, তাড়াতাড়ি, থেমে থেমে।

কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না।

কানে খট্‌ খট্‌ করে বাজছে।

বেসুরো হয়ে যাচ্ছে।

তবে কি নেমে গিয়ে, ঘরের কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা গোটানো মাদুরটাকে টেনে নিয়ে মাটিতে বিছিয়ে শুয়ে পড়বে? ঠিকে ঝিটা যখন ডাক দেবে ‘অ ছোটবউদি, উনুনটা যে জ্বলে খাঁ-খাঁ করছে—’ তখন সাড়া দেবে না। ভয়ঙ্কর গভীরভাবে ঘুমিয়ে থাকবে।

ঝি আবার ডাকবে।

তখন তরঙ্গিণী উঠবে বিরক্ত হয়ে। এ-ঘরের দরজায় এসে বলবে, ‘হ্যাঁ গা ছোট বউ, আক্কেলটা কি তোমার? এখনো পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছ? এক-উনুন কয়লা পুড়ে গেল! এ কী মরণঘুম ঘুমনো গো!’

বলেই সত্যিই তেমন ঘুমওলা মানুষটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলবে ‘ঠাকুরপো!’ আর তক্ষুনি আবার চিলের মত চেঁচিয়ে ডাকবে ‘ও গো, শিগগির একবার এ-ঘর এসো তো!’

বিজয় ছুটে আসবে।

কঙ্কা তখন হঠাৎ জেগে ওঠার মত উঠে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে।

একদণ্ডে পাড়ার লোকে বাড়ি ভরে যাবে বিজয়ের হাউমাউ চিৎকারে, আর তরঙ্গিণীর মড়াকান্নায়। পাড়ার লোক বলবে, ‘হ্যাঁ, ভাই ভাজ ভালবাসতো বটে লোকটাকে। ওই তো গুণের অবতার ভাই!’

পাড়ার লোক আরও বলবে ‘বউটার কী কাঠ প্রাণ গো, কাঁদল না!’

তা বলুক। এই পদ্ধতিটাই সোজা মনে হল কঙ্কার। উঠল কঙ্কা। সিঁড়ির মুখের কাছে দাঁড়াল। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। কঙ্কা একটু আগে ওই সিঁড়িটা দিয়েই উঠে এসেছে ভেবে অবাক হয়ে গেল, পিছিয়ে এল!

চোখ বুজে নামবে?

কিন্তু শুধুই তো সিঁড়িটা পার হওয়া নয়। কঙ্কাকে গিয়ে সেই ঘরেই তো ঢুকতে হবে, যে-ঘরে একটা শক্ত কাঠ হয়ে যাওয়া মানুষ শুয়ে আছে—চাদর ঢাকা দিয়ে। যে মানুষটাকে এখন আর মশা কামড়াচ্ছে না। যার এখন গরমও হচ্ছে না। গায়ের চাদরটা মুখ অবধি ঢেকে দিলেও হবে না।

না, না, ও-ঘরে গিয়ে ঢুকতে পারবে না এখন কঙ্কা।

রাত শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবেই কঙ্কাকে। ভোর হলে নেমে গিয়ে তরঙ্গিণীকে চেঁচিয়ে ডাক দেবে ‘ও দিদি, শিগগির এসো একবার, দেখ বুঝি সর্বনাশ—’

তরঙ্গিণী ছুটে আসবে। কেঁদে উঠবে।

জিগ্যেস করতে ভুলে যাবে, ‘তুমি কোথায় ছিলে ছোটবউ!’

তবে এখন একটু শুয়ে নিতে পারে কঙ্কা।

ছাতের মেজেটা ধুলো ভর্তি।

তা হোক। দেয়াল ঘেঁষে গুটিসুটি শুয়ে পড়ল কঙ্কা।

কিন্তু কঙ্কা তো ভাবেনি ঘুমবে।

তবু এত ভয়ঙ্কর ভাবে ঘুমিয়ে পড়ল কি করে? ঘুমের ওষুধ না খেয়েও।

কখন যে রাস্তায় জল দেওয়ার শব্দ উঠে শেষ হয়েছে, কখন কাকগুলো বিশ্রী বিশ্রী করে ডেকেছে, আর কখন ময়লা ফেলা গাড়িগুলো ঝড়াং ঝড়াং আওয়াজ তুলে শহরের ঘুমন্ত চেতনায় আঘাত হেনে বেড়িয়েছে, কিছুই টের পায় নি।

টের পায় নি কখন পুবের আকাশ থেকে খানিকটা সাদা রঙের রোদ কঙ্কার গায়ে এসে ছড়িয়ে পড়েছে।

হঠাৎ কে কোথায় যেন একটা কাচের বাসন ভেঙে ফেলল! খনখন করে শব্দ উঠল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল কঙ্কা।

কাচের বাসন নয়, তরঙ্গিণীর বড় মেয়ের গলা।

‘ধন্যি বটে ছোটকাকিমা, এইখানে পড়ে মজা করে ঘুম মারছ। ওদিকে ছোটকাকা ঘুম থেকে উঠে মুখ ধোবার জল না পেয়ে রেগে হাত-পা ছুঁড়ছে!

অভিনয় নয়, সত্যি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কঙ্কা।

তরঙ্গিণীর মেয়ে ফের বলল, ‘ওঃ, ঘুমের ঘোর কাটেনি বুঝি এখনো? কথা মগজে ঢুকছে না? ছোটকাকা উঠে মুখ ধোবার জল না পেয়ে রাগারাগি করছে, বুঝতে পেরেছ?’

গায়ের আঁচলটা ঠিক করে নেয় কঙ্কা। সিড়ি দিয়ে নেমে যায় তাড়াতাড়ি। মনে মনে বলে, ‘আমি জানতাম! আমি জানতাম! এই রকমই একটা কিছু হবে জানতাম আমি। গলির দরজা খুলে দৌড়ে পালান আমার হবে না।’

নিচে এসে ঘরে ঢুকল।

বিমান ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘ছিলে কোথায় এতক্ষণ? একটা রোগা মানুষ যে গলা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে তার খেয়াল থাকে না?’

কঙ্কা কথা বলল না।

পিকদানিটা এগিয়ে দিল। কলাই-করা মগে করে জল দিল টেবিলে, মাজন দিল। তোয়ালে দিল। তারপর শেল্‌ফের ওপর সাজানো ওষুধের শিশিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল। ঘুমের ওষুধের শিশিটা নতুন এসেছে। প্রায় পুরো শিশিই রয়েছে।

শিশিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠল কঙ্কা, ‘চেষ্টা করেছিলাম। অনেক চেষ্টা করেছিলাম আমি পারিনি।’

১৩৬৮ (১৯৬১)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *