স্ত্রী শিক্ষা ও গঙ্গাবাঈ
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে কলকাতার স্ত্রীশিক্ষার আঙিনায় ঘটেছিল এক বিপ্লব। এক রাজকুমারী কলকাতায় স্থাপন করেছিলেন এক আদর্শ স্ত্রীশিক্ষা বিদ্যায়তন, বাঙালী মেয়েদের স্কুলের সাধারণ পাঠক্রমের সঙ্গে হিন্দুর পূজা-অর্চনা শিক্ষা দেবার জন্য। তিনি ছিলেন রায় বেলুড়ের রাজা নারায়ণ রায়ের কন্যা গঙ্গাবাঈ। ওঁর মাসিমা ছিলেন ইতিহাস প্রসিদ্ধা ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ। দু’জনে ছিলেন অল্পবিস্তর সমন্বয়কা। ছেলেবেলায় দু’জনেই অশ্বারোহণে অসিচালনা করতেন প্রান্তরে প্রান্তরে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় লক্ষ্মীবাঈয়ের পাশে অশ্বারোহণে থেকে এই রমণী দেখিয়েছিলেন অসামান্য সাহস ও তেজস্বিতা। বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পর নানাসাহেবের সঙ্গে তিনি পালিয়ে যান নেপালে। সেখানে আত্মগোপন করেছিলেন ত্রিশ বৎসর ।
আশির দশকের শেষে তিনি আবির্ভূতা হন ভারতের রাজধানী কলকাতায়। দুর্গাপূজার বিজয়ার দিন পথে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা। পাশে কতগুলি স্কুলের মেয়েকে বলতে শুনলেন, ‘প্রতিমা পূজার কোন সার্থকতা নেই।’ বুঝলেন খ্রীষ্টান স্কুলের শিক্ষা থেকেই এসব বিরূপ ধারণা হয়েছে হিন্দু মেয়েদের মনে। হিন্দু মেয়েদের মনে হিন্দু ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাবার জন্য নিজেই একটা স্কুল খোলার সঙ্কল্প করলেন।
১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ এপ্রিল তারিখে মাতাজী মহারানী গঙ্গাবাঈ (সেই নামেই তখন তিনি পরিচিত) ‘মহাকালী পাঠশালা’ নামে এক অবৈতনিক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন কাশিমবাজারের মহারানী স্বর্ণময়ীর আপার সারকুলার রোডের বাড়িতে। কিন্তু ছাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্কুলটি স্থানান্তরিত করলেন চোরবাগানে রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ির পূর্বদিকের এক বাড়িতে। তারপর সুকিয়া স্ট্রীটে (বর্তমানে কৈলাস বোস স্ট্রীট) এক বিঘা এগার কাঠা জমি কিনে স্কুলের চিরস্থায়ী ভবন নির্মাণ করলেন। স্কুল আরম্ভ করেছিলেন মাত্র কয়েকটি ছাত্রী নিয়ে। নূতন ভবনে স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা হল প্রায় দু’শ। বেথুন কলেজের মত মাতাজীর স্কুলেরও দুটো বলবান ঘোড়ায় টানা দু’খানা বাসগাড়ি ছিল, দূরের মেয়েদের আনবার জন্য। তাছাড়া, মেয়েদের হিন্দু ধর্ম বিষয়ক শিক্ষা দেবার জন্য বই ছাপার নিমিত্ত ছিল একটা ছাপাখানা। একটা পত্রিকাও ছিল।
ছেলেবেলায় যদিও ওই স্কুলের গাড়ি কলকাতার রাজপথে প্রত্যহ দু’বেলাই দেখতাম, তা হলেও পরে ওই স্কুলের কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। সম্প্রতি ওই স্কুলের কথা মনে আবার জাগ্রত হল, এক প্রাক্তন ছাত্রীর স্মৃতিচারণ পড়ে। তিনি হচ্ছেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠা ভগিনী জীবনতারা দেবী। জীবনতারা ও তাঁর জ্যেষ্ঠা জীবনচণ্ডী, দুজনেই ওই স্কুলের গোড়ার দিকের ভাল ছাত্রী ছিলেন।
জীবনতারা লিখেছেন সাধারণ পাঠক্রম ছাড়া ওই স্কুলের বৈশিষ্ট্য ছিল বারো মাসে তর পার্বণ করা, রন্ধন শিক্ষা করা ইত্যাদি। তিনি লিখেছেন যে ওই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী হতে প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাস ছিল। পাঠ্যপুস্তক ছিল বোধোদয়, সীতার বনবাস, বদুগোপালের পদ্যপাঠ, কবিতা প্রসঙ্গ, রঘুবংশ, অল্পস্বল্প গীতা, পাজপাঠ, মহাভারতে ‘সতীধর্ম’, মনু হতে ‘সাধ্বী সদাচার’ ধর্মশিক্ষার জন্য নানা বই, নিত্যপাঠ্য স্তবের বই ইত্যাদি। এছাড়া পড়তে হত দীনেশ সেনের ‘সতী’, ‘বেহুলা’, ‘ফুল্লরা’ ও ‘রামায়ণী কথা’।
পূজা-অর্চনার মধ্যে বোশেখ মাসের প্রথম দিন হতে প্রত্যহ এক মাস প্ৰতি মেয়েকে নিজ হাতে শিবঠাকুর তৈরি করে শিবপূজা করতে হত। দুপুরে কুমারী ভোজন চলত চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয়ের সঙ্গে। আষাঢ় মাসে গুরুপূর্ণিমার দিন খুব উৎসব হত। আশ্বিন মাসে তিনদিন দুর্গাপূজা ও মহাষ্টমীতে বিরাট ভোগ রাগ, আর খাওয়ানো হত। বসন্ত পঞ্চমীতে সরস্বতী পূজাও ছিল এক বিরাট উৎসব। সব উৎসবেই মধ্যাহ্ণে পরিপাটিরূপে ভোজের ব্যবস্থা ছিল। দুধের পায়েস, ক্ষীরের মিষ্টান্ন অঢেল পরিমাণে তৈরি করা হত। বছরের শেষের দিকে প্রতি বৎসর পুরস্কার বিতরণ করা হত। বর্ধমানের মহারাজা, দ্বারভাঙ্গার মহারাজা, ছোটলাট, বড়লাট ও সেকালের অনেক পদস্থ ব্যক্তিরা পুরস্কার বিতরণী সভায় পৌরোহিত্য করতেন। পুরস্কার ছিল সোনার মেডেল, রূপার মেডেল, সোনার গহনা, বই, পূজার বাসন, বাক্স, ভাল সিল্কের কাপড় ইত্যাদি। সকলেই পুরস্কার পেত, তা সে পরীক্ষা দিক, আর না দিক। স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা সকলেই এই স্কুল পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। বোধ হয় নিবেদিতা এখান থেকেই প্রেরণা পেয়েছিলেন নিবেদিতা স্কুল স্থাপনে।
মাতাজী সব সময়ই পুরুষের বেশে থাকতেন, পরতেন ধুতি, পাঞ্জাবি, পাগড়ি ইত্যাদি। বোধ হয় আত্মগোপনের সময় এই বেশই তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
মাতাজীর স্কুল আজও জীবিত আছে। তবে তার নতুন নাম হয়েছে ‘আদি মহাকালী পাঠশালা’।