স্ট্রেঞ্জার – ৬২

বাষট্টি

প্রাইভেট কেবিনের বেড়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। তাকে প্রায় ঘিরে রেখেছে রিপবিপ আওয়াজ তোলা মেশিন, মনিটর ও টিউব। বামহাতের পিঠে ক্যানোলা। কাঁধ থেকে কবজি পর্যন্ত ডানহাত প্লাস্টার করে তুলে দেয়া হয়েছে একটা রেস্ট-এ। বয়স্ক চেহারাটা আগের মতই তিক্ত। তবে ঝিলিক দিচ্ছে দুই চোখের মণি। অফিসার জেনি লরেন্স রানাকে নিয়ে কেবিনে ঢুকতেই হাসি-হাসি হয়ে গেল শেরিফের মুখ।

এখন কেমন বোধ করছেন?’ কাছে গিয়ে জানতে চাইল রানা।

‘জঘন্য!’

‘বিশ মিলিমিটারের গোলা লাগলে এমনই তো হবে।’

‘সেজন্যে না! হারামি ডাক্তার আমাকে অফিসে ফিরতে দিচ্ছে না!’

‘তো আমাকে ডাকলেন কেন?’

‘আমাদের জন্যে যা করলে, বাছা, সেজন্যে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছি। তুমি এ দেশে না এলে ক্লোভিস প্যারিশের সমাজ থেকে নোভাকদের মত শুয়োরের বাচ্চাগুলোকে আমরা বিদায় করতে পারতাম না।’

ধন্যবাদ দিচ্ছেন বলে আপনাকেও ধন্যবাদ। নিজে তো মস্ত ঝুঁকি নিয়েছেন।

মাথা দোলাল স্যাম শেরিড্যান। ‘অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। প্রাণ হারাল একদল ভালমানুষ।’

সায় দিল রানা, ‘তা ঠিক।’

‘এবার বোধহয় ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে, বাছা?’ ওপর-নিচ মাথা দোলাল রানা। ‘প্রথম সুযোগে ফিরছি আমার দেশে।’

‘আরও একটা দিন রয়ে যাও। আগামীকাল কবর দেয়া হবে লিয বাউয়ারকে। মনে হলো, তুমি হয়তো শেষকৃত্যে যেতে চাইবে। এ ছাড়া, আরেকটা ব্যাপারও রয়ে গেছে

‘শেষকৃত্যে থাকছি। অন্য ব্যাপারটা কী?’ জানতে চাইল রানা।

‘ও, তুমি তা হলে শোনোনি,’ বলল শেরিফ। ‘আসলে এত কিছু ঘটতে লাগল যে পরে আর বলতে মনে ছিল না।’

‘কী বলবেন? কী শুনতে পাইনি?’

‘যতদূর মনে পড়ে, তুমি বলেছিলে ক্লোভিস প্যারিশে এসেছিলে একটা বাঁশির অনুষ্ঠান শুনতে। আমি কি ঠিক বললাম?’

‘খবরটা চেপে রেখে আর কষ্ট না-ই দিলেন, শেরিফ।’

‘তোমার কপাল ভাল, রানা। রেডিয়ো তো শোনো না, তাই জানো না গত কয়েক দিন আগে পণ্ড হয়েছে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার অনুষ্ঠান। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। বাজে স্মোকি ক্রিয়োল গাম্বো খেয়ে পেট নেমেছে শিল্পীর। তাই কিছুই মিস করোনি।

‘আহা, কত কষ্টে আছেন তিনি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।

‘সেরে গেছেন তো,’ বলল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান, ‘তবে শুনলাম আর কখনও খাবেন না ওই জিনিস। দু’দিন হাসপাতালে ছিলেন। আর আগামীকাল সন্ধ্যার পর হচ্ছে তাঁর সেই অনুষ্ঠান।’

‘সেক্ষেত্রে পরশু দিন রওনা হব,’ সিদ্ধান্ত নিল রানা। ‘আগামীকাল পর্যন্ত এখানেই আছি।’

‘তার মানে বাঁশি শুনতে তোমারও ভাল লাগে, তাই না?’ রানার দিকে চেয়ে হাসল জেনি।

‘তুমিও ওই ভারতীয় বংশীবাদকের ভক্ত?’ জানতে চাইল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল জেনি। তবে অনুষ্ঠানে যেতে পারব না। আগামীকাল সন্ধ্যায় আমার ডিউটি।’

‘আপাতত ডিউটি করতে হবে না,’ মানা করে দিল শেরিফ। ‘একসপ্তাহের ছুটি দিচ্ছি তোমাকে। অফিসের ধারে- কাছে আসবে না, এটা আমার অর্ডার, অফিসার লরেন্স।’

খুশি হয়ে রানার দিকে তাকাল জেনি। ‘শুনলে? তুমি বোধহয় একটা ডেট পেতে পারো। কী বলো, রানা?’

বিসিআই এজেন্ট কিছু বলার আগেই জানতে চাইল শেরিফ, ‘রাতে কোথায় থাকবে, রানা?’

চট করে রানার দিকে তাকাল জেনি লরেন্স। লালচে হয়ে গেছে দুই গাল।

‘অত লজ্জার কিছু নেই, অফিসার লরেন্স,’ বলল শেরিফ। ‘এককালে আমরাও…’ খুক খুক করে কেশে উঠে থেমে গেল সে।

‘আপাতত আমি বাস্তুহারা,’ বলল রানা।

‘ছুটি কাটাবার জন্যে বৌরবেউক্স লেকের তীরে আমার স্ত্রীকে একটা কেবিন কিনে দিয়েছিলাম,’ বলল শেরিফ। ‘আমার অফিসের ডেস্কের ড্রয়ারে বাড়তি চাবি আছে। জেনি, চাবিটা নিয়ে রানাকে পৌছে দেবে ওই কেবিনে। ঠিক আছে?’

.

পরদিন সকালে ফ্রেশ হয়ে নয়টায় রানা পৌঁছল ফার্স্ট ব্যাপটিস্ট চার্চে লিয বাউয়ারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে

ওখানে বিষণ্ণ, বিষাদময় পরিবেশ। বেশ ভিড় হলো চার্চের ভেতর। কৃষ্ণাঙ্গদের ভেতর কয়েকটা শ্বেতাঙ্গ মুখও দেখল রানা। ওকে চিনতে পেরেছে কেউ কেউ, তবে কথা বলল না তারা। অনুষ্ঠান শেষে দ্রুত ফাঁকা হয়ে গেল চার্চ।

মন খারাপ নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে টোকা পড়ল ওর কাঁধে। ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক হলো রানা। বড়মা এবি পামবো!

বয়স্কা মহিলাকে প্রায় ঘিরে রেখেছে তাঁর দেহরক্ষীরা। তাদের ভেতর রয়েছে চার্লস। এখন হাতে গুলিহীন রাইফেল নেই। কর্কশ স্বরে কথাও বলছে না।

‘ভাল করেছ, বাছা,’ বললেন এবি পামবো। ‘গিয়েছিলে ওখানে।’

‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, বড়মা,’ মৃদু হাসল রানা। ‘আপনার কবচ নিরাপদ রেখেছিল আমাকে।’

মৃদু মাথা দোলালেন বৃদ্ধা।

তাঁর গালে ছোট্ট করে চুমু দিল রানা। ‘গুডবাই, বড়মা। আবারও হয়তো কখনও দেখা হবে।’

‘দেখা হবে স্বর্গে, বাছা, মিষ্টি হাসলেন এবি পামবো। ‘আসি। তুমি যে তোমার বড়বোনকে শেষবিদায় দিতে এসেছ, সেজন্যে আমি খুব খুশি হয়েছি, রানা।’

চার্চ থেকে বেরিয়ে অপেক্ষমাণ গাড়িতে গিয়ে উঠলেন তিনি। তাঁর গাড়ির পিছু নিল কালো একটা গাড়ি। ওটাতে উঠেছে দেহরক্ষীরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *