চার
শেরিফের চোখের মণি ধূসর। দোকানের ভেতরটা দেখল সে। দৃষ্টি স্থির হলো মেঝেতে অচেতন জর্জি ডানের ওপর। কয়েক সেকেণ্ড পর দৃষ্টি থামল গিয়ে মহিষের সঙ্গীর ওপর। আরও কয়েক মুহূর্ত পর রানাকে দেখল শেরিফ। যেন মেপে নিল অচেনা যুবককে।
রানা দেখল, শেরিফের কোমরে সার্ভিস গানবেল্ট বা সাইডআর্ম নেই। বদলে রয়েছে সৌখিন বাস্কেডেরো কাউবয় রিগ। হোলস্টারে ঝুলছে পুরনো স্টাইলের কোল্ট রিভলভার। ফুলের কারুকাজ করা বাস্কেডেরো কাউবয় রিগের সঙ্গে সুন্দর মানিয়ে গেছে শেরিফের দামি বুট। ডিউটির সময় ওটা পায়ে থাকার কথা নয়। অবশ্য সভ্য এলাকা থেকে এত দূরে কে কী পরছে, তা দেখতে আসে না কর্তৃপক্ষ।
রানার চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে জিজ্ঞেস করল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান, ‘এখানে কী হয়েছে, হেকেথন?’ একেকটা শব্দ চিবিয়ে চিবিয়ে ধীর গতিতে উচ্চারণ করেছে। বোধহয় ভাল করেই জানে, কানে প্রায় কিছুই শোনেন না বৃদ্ধ হেকেথন। এই শহর যেমন ছোট, এর সমাজও ছোট। সবার গোপন সব কথাই সবার জানা।
‘এরা ডাকাতি করতে এসেছিল,’ বললেন হেকেথন। ‘এই ছেলে সেটা ঠেকিয়ে দিয়েছে। তাতে সময় নিয়েছে ঠিক এক সেকেণ্ড। তোমার কপাল মন্দ, ব্যাপারটা দেখতে পেলে না, শেরিড্যান। আমার বুকে বন্দুক ঠেকিয়েছিল জর্জি। তার ঠিক পরের মুহূর্তে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। আগে কখনও এমন কাণ্ড দেখিনি!’
‘ওরা কি মারা গেছে?’
‘না, বেঁচে আছে,’ জবাব দিল রানা। ‘আপাতত ঘুমাচ্ছে। তবে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। একজনের কবজি ভেঙেছে। অন্যজন গুলি খেয়েছে গোপনাঙ্গে। অনেক রক্ত যাচ্ছে।’
‘অ্যাম্বুলেন্স আসছে, গলা চড়িয়ে ধীর ভঙ্গিতে কথা বলছে শেরিফ শেরিড্যান। বলার ভঙ্গিতে কর্তৃত্ব। কড়া পড়া তর্জনী তাক করল রানার দিকে। ‘কে গুলি করল? তুমি?’
রানার আগেই জবাব দিলেন বৃদ্ধ হেকেথন, ‘নিজেই নিজেকে গুলি করেছে, শেরিড্যান। উড়িয়ে দিয়েছে নিজের বিচি।’
কথাটা শুনে অসন্তুষ্ট চেহারা করল শেরিফ। একপাশে ফিরে হাতের ইশারা করল দুই ডেপুটিকে। তাদের একজন পিস্তল বের করে তাক করেছে দুই ডাকাতের দিকে। তার ভাব দেখে রানার মনে হলো, যে-কোনও সময়ে গ্রেফতার এড়াতে চাইবে অচেতন দুই তস্কর। অন্য ডেপুটি তাদের কবজিতে আটকে দিল হ্যাণ্ডকাফ। এত রাতেও রাস্তায় জড় হয়েছে জনাকয়েক দর্শক। কেউ কেউ দোকানের ভেতর উঁকি দিচ্ছে জানালা দিয়ে।
জানালার দিকে পিঠ রেখে হাতকড়াওয়ালা ডেপুটির উদ্দেশে বলল শেরিফ, ‘জার্ভিস, ওদেরকে বিদায় করো!’ দর্শক তাড়াতে দোকানের বাইরে গেল ডেপুটি। অন্য ডেপুটিকে বলল শেরিফ, ‘কনরাড, রেডিয়োতে জিজ্ঞেস করো অ্যাম্বুলেন্সের এত দেরি কেন! ওই বিচিফাটা হারামজাদা তো আমাদের চোখের সামনেই নিজের রক্তে ডুবে মরে যাচ্ছে!’
পিস্তলওয়ালা ডেপুটির নাম কনরাড। মাথায় হ্যাট নেই। বাদামি চুল পেরেকের মত চোখা। মেরিন সৈনিকের মত চেঁছে নিয়েছে মাথার দু’পাশ। রোদে পোড়া, ফোলা দু’গালে দুইপোয়া বাড়তি মাংস। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। নার্ভাস চোখে শেরিফ শেরিড্যানকে দেখল সে। ‘আর এই দুই ডাকাতের কী হবে?’
‘ওরা অচেতন, কনরাড,’ শান্ত গলায় বলল শেরিফ, ‘মনে হয় না ঝামেলা করবে। এবার গাড়িতে গিয়ে রেডিয়ো ব্যবহার করে অ্যাম্বুলেন্সকে তাগাদা দাও।’
অস্ত্রটা হোলস্টারে রেখে দৌড়ে দোকান ছাড়ল ডেপুটি কনরাড। আফসোসের শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল শেরিফ। বেচারার মাথাটা ক্রিকেট বলের মতই নিরেট।’ ঘুরে চোখ সরু করে রানাকে দেখল সে। ‘আমি স্যাম শেরিডান। ক্লোভিস প্যারিশের শেরিফ। মনে হয় না তোমাকে আগে কখনও দেখেছি, মিস্টার।’
‘নামটা রানা। মাসুদ রানা।’
‘এদিকের লোক নও মনে হয়?’
‘আমারও তা-ই মনে হয়, বলল রানা। ‘গতকাল নিউ অরলিন্সে এসেছিলাম বন্ধু হ্যারি জন্সটনের বিয়ে উপলক্ষে। আর এই শহরে এসেছি আজই দুপুরের দিকে।’
‘কারণ?’
‘পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি শুনব বলে।’
‘আচ্ছা! এতই বিখ্যাত লোক নাকি ওই বাঁশিওয়ালা?’
‘পৃথিবী-সেরা।’
মাথা ঝাঁকাল প্রৌঢ় শেরিফ।
‘তা, ওঠা হয়েছে কোথায়?’
‘আপাতত বাইয়ু ইন-এ।’ পকেট থেকে পাসপোর্ট নিয়ে এগিয়ে দিল ও।
অসংখ্য সীল-ছাপ্পর মারা পাসপোর্টের পাতাগুলো ওল্টাল শেরিফ দ্রুতহাতে। মনে হলো সন্তুষ্ট। ফিরিয়ে দিল রানার হাতে। ‘তার মানে বাংলাদেশি?’ কথার ভেতর তাচ্ছিল্য।
‘হ্যাঁ, সেই দেশের মানুষ, যারা যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। যারা মায়ের মুখের ভাষার জন্যে লড়াই করেছে অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে।’
‘পেশা কী তোমার?’ জানতে চাইল শেরিফ।
‘টুকটাক গোয়েন্দাগিরি।’
সন্দেহের চোখে রানাকে দেখল শেরিড্যান। ‘তোমাকে তো টিকটিকি বলে মনে হচ্ছে না! একাই কাত করে দিয়েছ দুইজন সশস্ত্র লোককে। থুতনি নেড়ে মেঝেতে শোয়া অচেতন মহিষটাকে দেখাল সে। ‘ক্লোভিস প্যারিশ পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ওর বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগ আছে। অন্তত দশজনকে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। আমাদের ধারণা, নোভাক দ্বীপের শয়তানগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক আছে ওর। সঙ্গের লোকটাকেও পাক্কা হারামি বলেই মনে হচ্ছে। অথচ, হেকেথর্নের কথা ঠিক হলে, নিজের
শরীরে একটা আঁচড় না লাগিয়ে দুটোকেই ধরাশায়ী করেছ তুমি। এবার বলো দেখি, ঠিক কী ধরনের কাজ করো তুমি?’
‘ছোটখাটো একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাই,’ বলল রানা। ‘ছোটবেলায় শখ করে সামান্য জুডো-কারাতে শিখেছিলাম বলে সেটা কাজে লেগে গেছে আজ।’
কড়া চোখে কিছুক্ষণ রানাকে দেখল শেরিফ, তারপর নিচু গলায় বলল, ‘ভাল চাইলে সত্যি কথা বলো, বাছা। নইলে কপালে জুটবে জেলের রুটি।’
হুমকি শুনে রেগে গেল রানা। নিষ্পলক চোখে সরাসরি তাকাল শেরিফ শেরিড্যানের ধূসর চোখে।
আড়ষ্ট কয়েকটা মুহূর্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর বাঁকা হাসি ফুটল শেরিফের ঠোঁটে। ‘সবই বুঝতে পেরেছি। আগে ছিলে মিলিটারিতে।’
চুপ করে থাকল রানা।
‘তুমি আর্মিতে ছিলে, চোখ বুজে বলে দিতে পারি। তোমার চোখ, দাঁড়ানোর ভঙ্গি সেই কথাই বলছে।’ সময়টা উপভোগ করছে শেরিফ শেরিড্যান। ‘কী, ভুল বললাম, মিস্টার রানা? তুমি সৈনিক ছিলে।’
‘কখনও সৈনিক ছিলাম না,’ বলল রানা। মিথ্যা বলছে না। ‘আর তা যদি হতামও তাতে তোমার কী?’
রেডিয়োতে কথা শেষ করে দোকানে ঢুকেছে মাথা-মোটা ডেপুটি কনরাড। শেরিফকে জানিয়ে দিল, এখুনি পৌঁছুবে অ্যাম্বুলেন্স।
থমথমে পরিবেশে দাঁড়িয়ে থাকল রানা ও অন্যরা।
বেশ কয়েক মিনিট পর বাইরের রাস্তায় থামল দুটো অ্যাম্বুলেন্স। ওগুলো থেকে নামল কয়েকজন প্যারামেডিক আহত দুই ডাকাতকে স্ট্রেচারে তুলে হাসপাতালে নেবে। চিকিৎসা শেষে লোকদুটো সোজা যাবে জেলহাজতে।
স্ট্রেচারে তোলার সময় হঠাৎ করেই জ্ঞান ফিরল জর্জি ডানের। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। তবে আগেই ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে বলে আবারও শুয়ে পড়ল মেঝেতে। গড়গড় করে মিরাণ্ডা রাইট বলে শেষ করার আগেই ঘুমিয়ে গেল সে। অ্যাম্বুলেন্সে করে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্যে ডেপুটি জার্ভিসকে পাঠিয়ে দিল শেরিফ। ওদিকে এখনও ডিম ফাটা ডাকাতের জ্ঞান ফেরেনি। তাকে নিয়ে বাতি জ্বেলে, ‘অ্যাঁ-ওঁ, অ্যাঁ-ওঁ’ ডাক ছেড়ে উধাও হলো দ্বিতীয় অ্যাম্বুলেন্স।
‘এবার?’ শেরিফের কাছে জানতে চাইল রানা।
‘আগামী পরশু রাত পর্যন্ত শহরে থাকছ, তাই না?’
‘তার পরদিন সকালেও থাকছি,’ বলল রানা। ‘কোনও তাড়া নেই।’
‘গুড। একবার স্টেশনে এসে লিখিত বক্তব্য দেবে। দু- চারটে ব্যাপারে জানতে চাইব।’
‘কী বিষয়ে?’ প্রশ্ন রানার।
‘বলতে পারো, কৌতূহল মেটানো। এই প্যারিশে যা ঘটে, সবই আদ্যোপান্ত জানতে হয় আমার। যেমন: কে আসছে শহরে, কে বেরিয়ে যাচ্ছে— এইসব আর কী! মিস্টার রানা, আমার সঙ্গে দেখা না করে এই শহর ছেড়ে কোথাও যাবে না। কথাটা বুঝতে পেরেছ?’
‘বিদায় নেবার আগে নিশ্চয়ই একবার দেখা করব,’ বলল রানা।
একফালি তিক্ত হাসি হাসল শেরিফ। হেকেথনের দিকে চেয়ে হ্যাট স্পর্শ করল। ‘আশা করি বাকি রাতে আর কোনও সমস্যা হবে না।
পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার পর নীরবতা নামল দোকানের ভেতর। দাবড়ি খেয়ে রাস্তা ছেড়ে বিদায় নিয়েছে দর্শকরা। তবে দোকানের মেঝেতে থকথক করছে রক্ত। রানা ও বৃদ্ধকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, একটু আগে কী ঘটেছে। বুড়ো মানুষটা এখন কষ্ট করে রক্ত পরিষ্কার করবে ভাবতে খারাপ লাগল রানার। কাজেই পরের একটা ঘণ্টা মেঝে ও দেয়াল সাফ করতে হেকেথনকে সাহায্য করল ও। কাজটা শেষ হলে বৃদ্ধ জানতে চাইলেন, ‘একটা কথা, রানা, তুমি কি সত্যিই সৈনিক ছিলে?’
‘জীবনেও ছিলাম না,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল রানা। ‘আপনাদের শেরিফের কাঁধে কল্পনার দুটো পাখা আছে। যখন যেদিক খুশি উড়াল দেয়।’
মোটেলে ফেরার পথে কোনও ছিনতাইকারী বা ডাকাতের খপ্পরে পড়ল না রানা। রাত দেড়টায় পৌঁছে গেল বাইয় ইনে। এখন বাম বগলে নতুন একটা পনেরো বছর বয়সী গ্লেনমোরেঞ্জির বোতল। বারবার টাকা সেধেও ওটার জন্যে পয়সা নিতে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি বৃদ্ধকে। নিজে গিয়ে র্যাক থেকে বোতলটা এনে কাপড় দিয়ে মুছে ধরিয়ে দিয়েছেন রানার হাতে। ছলছলে চোখে ওকে জানিয়ে দিয়েছেন, ওটা না নিলে মনে খুব কষ্ট পাবেন।
মাঝরাত পেরিয়ে গেছে সেই কখন। বাতাসে ফুলের বুনো সুবাস। নীরব শহরের কোথাও অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না। নিজের রুমে ঢুকে আনমনে রানা ভাবল, যাক্, মিটে গেছে সব ঝামেলা। পরশু রাতে বাঁশি শোনার পর লম্বা একটা ঘুম দিয়ে সকালে ফিরবে নিউ অর্লিপ্স শহরে। এরপর দশটার বিমানে চেপে ত্যাগ করবে লুই আর্মস্ট্রং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।
এমনই সহজ-সরল হওয়ার কথা মানুষের জীবনটা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কখনও কখনও কোথা থেকে যে উটকো সব ঝামেলা এসে হাজির হয় ওর জীবনে!