1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৪৯

ঊনপঞ্চাশ

কয়েক মিনিটে চাউর হলো, নতুন কিছু প্রমাণ হাতে পাওয়ায় মুক্তি দেয়া হচ্ছে মাসুদ রানাকে। কোর্ট ভবনের বাইরে ভিড় করল সাংবাদিকরা। তার আগেই গ্রেফতারকৃত বিলি এস. কনরাডকে নেয়া হয়েছে বেইসমেন্টের সেলে। লিয বাউয়ার খুন, মানব-হত্যা প্রচেষ্টা, কিডন্যাপিং এবং বেআইনি ডিসটিলারির দায়ে রিচি নোভাক এবং তার ভাই হ্যাঙ্ক নোভাকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা তৈরি করল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। আইনি কাগজপত্র পাঠানো হলো জাজ উইলিয়াম ডাব্লিউ. মুরের কাছে। তাঁর অনুমতি পেলেই কাজে নামবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

প্রাক্তন ডেপুটি শেরিফ কনরাডের স্বীকারোক্তি পড়ার পর মাত্র পাঁচ মিনিটে নিজের সই করা অনুমতি-পত্র শেরিফের অফিসে পাঠিয়ে দিলেন জাজ।

ফলে আর কোনও বাধা থাকল না আইনি ব্যবস্থা নেয়ায়। মানসিক প্রস্তুতি নিতে লাগল শেরিফ স্যাম শেরিড্যানের ডেপুটিরা।

এদিকে গ্রেফতারের সময় যেসব জিনিস ওর কাছ থেকে নেয়া হয়েছে, সেসব ফেরত পেল রানা। দেখা করল জোসেফ গুডরিচের সঙ্গে। ভীষণ বিভ্রান্ত চোখে ওকে দেখল মানুষটা। ফ্যাকাসে হয়েছে চেহারা। চোখের নিচে কালি। সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে জোসেফের পিঠ চাপড়ে দিল রানা। ‘চিন্তার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আসলে কী হচ্ছে এসব, রানা?’ প্রায় ফিসফিস করে জানতে চাইল জোসেফ। ‘তোমাকে ছেড়ে দিল কেন? আমার পরিবারের সবাই এখন কোথায়? কেউ তো কিছুই বলছে না!’

‘ব্যাপারটা জটিল,’ বলল রানা। ‘তবে সুস্থ অবস্থায় এলিসা আর বাচ্চাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে। সেজন্যেই শেরিফের সঙ্গে কাজ করছি। দেখো, ওদের কোনও ক্ষতি হবে না।’

‘জানি না শেরিড্যানের সঙ্গে কী চুক্তি করেছ, তবে তাকে একদম বিশ্বাস করি না। তুমি তো জানো সে কী ধরনের লোক।’

‘অতীতের ওই দুর্ঘটনার জন্যে সে অনুতপ্ত,’ বলল রানা। ‘নিজের সাধ্য মত সবই করবে।’

‘এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।’

‘আমি তাকে মাফ করতে বলছি না। তবে নিজের চেষ্টায় লোকটা কোনও ত্রুটি রাখবে বলে মনে হয় না।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল জোসেফ। কুঁচকে গেল মুখ। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কান্না চেপে রাখতে। নিজের মস্ত দুই হাতে রানার ডানহাত ধরল সে। ‘তুমি তো ওদের সঙ্গে যাবে, তাই না? প্লিয, দেখো, এলিসা আর বাচ্চাদের যেন কোনও ক্ষতি না হয়।’

‘সেদিকে খেয়াল থাকবে আমার,’ বলল রানা।

‘কী করবে ভাবছ, রানা?’

‘ফিরিয়ে আনব তোমার পরিবারের সবাইকে।’

ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলল জোসেফ, ‘আগেও আমার ছেলেটাকে বাঁচিয়েছ। আশা করি এবারও তুমি সফল হবে।’

আস্তে করে হাতটা ছুটিয়ে নিয়ে জোসেফের বাহু ধরল রানা। ‘তুমি বরং বাড়ি ফিরে যাও, জোসেফ। কাজ শেষ হলে তোমাকে ফোন দেব। তোমার উঠানে পুলিশের পোড়া গাড়ি দেখে ঘাবড়ে যেয়ো না।’

‘ওদেরকে না নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারব না।’

‘তা হলে এখানেই অপেক্ষা করো। বেশিক্ষণ লাগবে না ওদের ফেরত আনতে

জোসেফকে রেখে ওঅর রুমে ঢুকল রানা। ওখানেই জড় হয়েছে শেরিফের সহকর্মীরা। রানা, শেরিফ এবং ডেপুটি মিলে ওরা বিশজন। ষোলোজন পুরুষ ডেপুটি, দু’জন মহিলা। এদের কেউ পেটমোটা, ঘুষখোর পুলিশ নয়। চোখে- মুখে কঠোরতা। ভাল করেই জানে, চলেছে যুদ্ধে। দুই মহিলা অফিসারের একজন কৃষ্ণাঙ্গিনী, অন্যজন শ্বেতাঙ্গিনী। চোখের দৃষ্টি পাথরের মত কঠিন। শক্তপোক্ত শরীর। আঙুলে কোনও আংটি নেই।

রানা ঘরে ঢুকতেই ওর দিকে তাকাল অফিসাররা, চোখে স্পষ্ট অপছন্দ। ধূসর চুলের এক অফিসার কড়া গলায় বলল, ‘একেই না আমরা একটু আগে গ্রেফতার করে আনলাম?’

ওর পাঁজরে কনুই দিয়ে গুঁতো দিল অফিসার লট সুয়ের ‘ওকে ছেড়েও দেয়া হয়েছে। আমাদের সবার সামনে দোষ হিসেবে স্বীকারোক্তি দিয়েছে বিলি এস. কনরাড।’

‘বলো কী! কনরাড?’

‘আমি ওখানে উপস্থিত ছিলাম। নিজের কানে ওর স্বীকারোক্তি শুনেছি। আমরা সবাই ভুল লোকের পেছনে দৌড়েছি। আসল খুনি কনরাডও না… অন্য কেউ।’

‘হোলি কাউ!’

‘তোমাদের কি জানা আছে উনি কে?’ রানাকে দেখিয়ে জানতে চাইল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান।

মাথা নাড়ছে অফিসাররা।

শেরিফ স্যাম শেরিড্যান বলল, ‘ইনি বিখ্যাত রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির চিফ। আগেও কিডন্যাপড্ মানুষকে উদ্ধার করেছেন। তিনি অবযার্ভার হিসেবে আমাদের সঙ্গে নোভাক দ্বীপে যেতে রাজি হয়েছেন। জাজ এরই ভেতর ওয়ারেন্ট জারি করেছেন। ভীষণ ঝুঁকির ভেতর রয়েছে নিরীহ ক’জন মানুষ। আমাদের কাজ হবে তাদেরকে নোভাকদের হাত থেকে ছুটিয়ে আনা। সেইসঙ্গে রিচি আর হ্যাঙ্ক নোভাককে গ্রেফতার করা।’

প্রথম থেকে শেরিফ বলে গেল কীভাবে কিডন্যাপ করা হয়েছে এলিসা গুডরিচ এবং তার বাচ্চাদেরকে। হতবাক হয়ে শুনল অফিসাররা। শেরিফ আরও জানাল, কীভাবে মাসুদ রানার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয় খুনের দায়। আর এখন বেইসমেন্টের সেলে বিচারের জন্যে ভেজা প্যান্ট পরে অপেক্ষা করছে বিলি এস. কনরাড।

শেরিড্যান চুপ হওয়ায় ঝোপের মত গোঁফওয়ালা এক ডেপুটি মাথার ওপর হাত তুলল। ‘পার্ডন, শেরিফ। আমরা কি তা হলে সত্যিই নোভাক দ্বীপে রেইড দিচ্ছি?’

নীরবতা নামল ঘরে। সবক’টা কান খাড়া।

বহু বছর ওই দ্বীপে পা রাখেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ। শুঁয়োপোকা ভরা জায়গার মত ওটা এতকাল এড়িয়ে চলেছে সবাই।

‘তোমরা আমার কথা শুনেছ, চাক,’ বলল শেরিফ।

নিচু গলায় আলাপ শুরু করল অফিসাররা। মাথা নাড়ছে কেউ কেউ। তবে হাত ওপরে তুলে সবাইকে নীরব হতে বলল শেরিফ। ‘মন দিয়ে শোনো। তোমরা আমার দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অফিসার। এতদিন আইনের শাসন বজায় রাখতে প্রাণের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করোনি। কখনও ভয় পাওনি। আশা করি এবারও দায়িত্ব পালনে কোনও ত্রুটি করবে না। সহজ হবে না আমাদের কাজ। নোভাকরা পাকা বদমাশ। ক্লোভিস প্যারিশের সমাজে ওরা পচা গ্যাংগ্রিনের মত। তাদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে নিরীহ ক’জন মানুষকে। এবার সময় হয়েছে শয়তানগুলোকে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলার। তোমরা কি আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’ রানাকে দেখাল শেরিফ। ‘বেশি কিছু বলব না মিস্টার রানার সম্পর্কে। এরই ভেতর তোমরা জেনেছ, তিনি ছিলেন আর্মিতে। একজন মেজর হিসাবে। নতুন করে কিছু বলার নেই তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে।’

‘ও, শুকনো গলায় বলল ঝোপের মত গোঁফওয়ালা চাক।

অস্বস্তি কাটাতে গিয়ে হাসল কয়েকজন অফিসার। ‘কিন্তু উনি আমাদের সঙ্গে যাবেন কেন?’ জানতে চাইল পেছনের সারির এক অফিসার।

‘ওই যে বললাম অবযার্ভার হিসেবে,’ বলল শেরিফ। ‘জানি এটা নিয়ম নয়। তবে আপাতত ওই নিয়ম ভাঙছি। আমাদের সঙ্গে তিনি থাকলে নানান সুবিধা পাব বলেই মনে হয়েছে আমার। মাথার ওপর হাত তুলেছে একজন অফিসার। তার দিকে তাকাল শেরিফ। ‘অফিসার রবার্টস?’

ধূসর চুলের অফিসার বলল, ‘বুঝতে পারছি না আমাদেরকে কেন যেতে হবে, এ ধরনের দায়িত্ব তো পালন করে এফবিআই।’

‘ভুল বলোনি,’ বলল শেরিফ। ‘তবে এখন এফবিআই- এর জন্যে অপেক্ষা করার সময় আমাদের হাতে নেই। ভার্জিনিয়ার কোয়ান্টিকো বহু দূরের পথ। তারা লোক পাঠাবার অনেক আগেই খুন হবে জিম্মিরা। সুতরাং প্রাণের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে আমাদেরকে। …তবে তোমাদের কারও দায়িত্ব পালনে আপত্তি থাকলে তাকে জোর করে নিয়ে যাব না আমি।’

হঠাৎই দৃঢ়কণ্ঠে বলল শ্বেতাঙ্গিনী অফিসার, ‘আমরা সবাই যাব, শেরিফ।’

‘আমারও একই কথা,’ সায় দিল আরেক অফিসার।

কঠোর মুখে মাথা দোলাচ্ছে সবাই।

‘তা হলে এবার শেষ কয়েকটা কথা বলবেন মাসুদ রানা,’ পোডিয়ামে এক পা বামে সরল শেরিফ। ‘এ বিষয়ে আগেই তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে।’

শেরিফের পাশে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে একনজর দেখল রানা। ‘লেডিয অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, মনে রাখবেন, এটা গোপন রেইড। প্রথম কাজ হবে রাতের আঁধার নামার আগেই নোভাক দ্বীপের খুব কাছে পৌঁছে যাওয়া। খুঁজে নিতে হবে কোথায় আছে জিম্মিরা। দেরি না করে সরিয়ে নেয়া তাদেরকে। আমার মনে হয় পাঁচজনের ইউনিট গড় ভাল। সবমিলিয়ে আমরা বিশজন। সুতরাং চারটে দণে বিভক্ত হব। ওয়ান, টু, থ্রি ও ফোর। শেরিফের সঙ্গে যে-কথা হয়েছে, তাতে তিনি থাকতে চান দুইনম্বর টিমের প্রধান হিসেবে। আমাকে বলেছেন, আমি যেন নেতৃত্ব দিই টিম ওয়ান-কে।’

‘আবার বলে এ নাকি অ্যাডভাইযার!’ ঠোঁট বাঁকা করে একটু জোরেই বলল শ্বেতাঙ্গিনী অফিসার। ‘হাগু মাখিয়ে ফেলল গোটা রেইডের গায়ে!’

‘বাজে কথা বলবে না, লরেন্স,’ ধমকের সুরে তাকে বলল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। ‘মন দিয়ে শোনো ওঁর কথা।’

‘ওই দ্বীপটা দুর্গের মত। ওখানে পা রাখার মাত্র একটাই পথ,’ বলল রানা। ‘সময় নেই বলে বাইয়ুতে নৌকা বা ভেলা ভাসিয়ে ওখানে যেতে পারব না আমরা। আওয়াজের কারণে ব্যবহার করা যাবে না হেলিকপ্টার। দ্বীপে উঠব কাঠের সেতু পেরিয়ে। এরপর কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে পযিশন নেব।’

জেনি লরেন্সের পেছন থেকে কৃষ্ণাঙ্গ এক অফিসার জানতে চাইল, ‘সেতু পেরিয়ে দ্বীপে উঠতে দেবে নোভাকরা?’

‘ধরে নিন দেবে না,’ বলল রানা। ‘আপনি নিজে হলেও দিতেন না। আর সেজন্যে সবধরনের ইকুইপমেন্ট থাকবে আমাদের সঙ্গে ‘

পোডিয়াম থেকে কাগজ নিয়ে ওটার ওপর চোখ বোলাল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। ‘প্রত্যেকের সঙ্গে থাকছে সেমি- অটোমেটিক কারবাইন আর দুটো করে ম্যাগাযিন। তার মানে ষাটটা গুলি। এ ছাড়া, সবাই পরবে নাইট ভিশন গগল্‌স্ আর ব্যালিস্টিক ভেস্ট। ওই ভেস্ট ঠেকাতে পারে ন্যাটোর ৭.৬২ বুলেট। ট্র্যান্সপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করব নোভাকদের অচেনা পাঁচটা ফোর্ড এক্সপ্লোরার ইন্টারসেপ্টর। একবার জিম্মিদেরকে পেলে তাদেরকে তুলে দেয়া হবে সোয়্যাট ভেহিকেলে। নোভাকরা বন্দি হলে অপারেশন শেষ করে দ্বীপ ছেড়ে শহরে ফিরতে সময় লাগবে না আমাদের।’

ঝোপ-গুঁফো অফিসার বলল, ‘মিস্টার রানা বললেন এটা গোপন রেইড, কিন্তু কথা শুনে মনে হচ্ছে আমরা যাচ্ছি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ করতে!’

‘তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই,’ বলল অফিসার জেনি লরেন্স। লড়াইয়ের জন্যে মানসিকভাবে তৈরি।

রানা মনে মনে নোট নিল, ওর দলে রাখবে মেয়েটাকে। ঝোপ-গুঁফো আর ধূসর চুলের ওপরেও চোখ রাখতে হবে। এই তিনজনের মাথা গরম। মাথা ঠাণ্ডা লোক হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ দীর্ঘদেহী অফিসার।

‘বাধা আসবে ধরে নিতে পারেন,’ বলল রানা। ‘আহত হবে দুই পক্ষের অনেকে। তবে ঠিকভাবে হামলা হলে ঠেকাতে পারবে না আমাদেরকে।’

রানা থেমে যাওয়ায় সবার ওপর চোখ বোলাল শেরিফ ‘আর কারও কোনও প্রশ্ন?

কয়েক সেকেণ্ড পেরোলেও কথা বলল না কেউ। সবার চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ। আগে ভাবেনি সত্যিই পা রাখবে নোভাক দ্বীপে, প্রাণপণ লড়াই করতে হবে ওখানে।

‘আপনি কি আর কিছু বলতে চান, মিস্টার রানা?’ রানার দিকে তাকাল শেরিফ।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘মাত্র একটা কথা জানতে চাই: কতক্ষণ লাগবে ইকুইপমেন্ট জোগাড় করতে?

‘খালি করা হচ্ছে আমারি,’ বলল শেরিফ। তৈরি হতে ধরুন আরও দশ মিনিট। তারপর রওনা হচ্ছি আমরা।’

‘গুড,’ মাথা দোলাল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *