ছেচল্লিশ
গুডরিচদের কিচেনে অস্থায়ী কমাণ্ড সেন্টার করেছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। কয়েকটা বিস্ফোরণের আওয়াজের পর এ মুহূর্তে বাইরের কাণ্ড দেখে চোয়াল ঝুলে গেছে তার। বুঝতে পারছে না কীভাবে গুবলেট হলো সুষ্ঠুভাবে সাজানো গুছানো নিখুঁত অপারেশন। চোখের সামনে দুঃস্বপ্ন দেখছে ভীত পুলিশ অফিসাররা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেডিয়োতে আলাপ করছে। কারও জানা নেই কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। শেরিড্যান ভাবতে শুরু করেছে, স্পেশাল ফোর্সের বন্ধু-বান্ধবদেরকে নিয়ে খামারে হামলা করেছে বদমাশ মাসুদ রানা। অথচ, এটা ছিল কল্পনাতীত!
‘সাক্ষাৎ শয়তান!’ বিড়বিড় করল শেরিফ। নিজ চোখে যা দেখছে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কোনও দিকে খেয়াল নেই বলেই একটু দেরিতে টের পেল, এইমাত্র তার হোলস্টার থেকে তুলে নেয়া হলো প্রিয় রিভলভারটা।
ঝট্ করে ঘুরেই চমকে গেল সে। গানবেল্ট হাতড়ে দেখল খালি হয়েছে তার হোলস্টার। কর্কশ স্বরে বলল শেরিড্যান, ‘তুমি!’ নিজের .৪৫ কোল্ট এখন তাক করা ত বুকের দিকে!
‘আপনি তো অপারেশন কমাণ্ডার, তাই ভাবলাম এখানেই আপনাকে পাব,’ কিচেনের ওঅর্কটপে হেলান দিল রানা। মাত্র একদিন আগেও এ ঘরে বসে রনকে অ্যালজেব্রা করতে দেখেছে। রান্না করছিল জোসেফ গুডরিচ। তবে এখন রন, রব, টিনা আর ওদের মা বন্দি নোভাকদের দ্বীপে। জেলহাজতে রাখা হয়েছে জোসেফ গুডরিচকে।
কথাগুলো ভাবতে খারাপ লাগল রানার। ওর রাগটা গিয়ে পড়ল শেরিফের ওপর। ভারী ক্যালিবারের রিভলভারের হ্যামার কক করে লোকটার পেটে নল তাক করল রানা। অস্ত্রটা খাপে খাপে বসেছে ওর মুঠোয়। ভারসাম্যও চমৎকার। আধুনিক পলিমার ও অ্যালয়ের মিশ্রণ নয়, সত্যিকারের ওয়ালনাট ও নীল ইস্পাতের পুরনো অস্ত্র। ওটার নল সামান্য ওপরে তুলল রানা। ‘আপনি তো কাউবয়ের মত রিভলভার ব্যবহার করেন। বোধহয় বাস করেন ঊনবিংশ শতকে?’
‘আমারই অস্ত্র আমার দিকে তাক করে মস্ত ভুল করেছ, মাসুদ রানা!’ রাগী গলায় বলল শেরিফ।
‘অন্য কারও অস্ত্র তাক করলে খুশি হতেন?’ জানতে চাইল রানা।
এজন্যে চরম শাস্তি পাবে,’ জানালা দেখাল শেরিড্যান। বাইরে ছোটাছুটি করছে ক’জন পুলিশ অফিসার। গুলি করছে জঙ্গল লক্ষ্য করে। অন্যরা কাভার নিয়েছে নানান জায়গায়। প্রাথমিক হামলা শেষ হলেই একত্র হবে। ‘ওরা একবার টের পেলে আর পালাতে পারবে না কোথাও।’
‘চেয়েছি ওদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে,’ বলল রানা। ‘খুব খারাপ করিনি নিজের কাজে, কী বলেন?’
‘কী চাও তুমি? এখানে এসেছ কেন?’
‘চাই আপনার খানিকটা একান্ত ব্যক্তিগত সময়,’ বলল রানা। ‘সেজন্যেই এসেছি। পালাতে পালাতে বিরক্ত হয়ে গেছি। তাই ভাবলাম, উল্টে কিছু করে দেখাই। তাই নিজেই এলাম।’
মাথা নাড়ল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। দেখা দিতে গিয়ে অনেক ঝামেলায় জড়িয়ে গেছ। হয়তো মরবেও সেজন্যে।’
‘আমি এসেছি আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে,’ বলল রানা। ‘আপনি তো আর এমন লোক নন যে নিরীহ মানুষের ওপর গুলি ছুঁড়বেন— অবশ্য আপনার হাতে কোনও অস্ত্র থাকলে তবেই সে প্রশ্ন উঠত, তাই না?’
তিক্ত হাসল শেরিড্যান। ও, নিজেকে এখন নিরপরাধ বলে মনে হচ্ছে তোমার?’
‘আপনি ভাল করেই জানেন, আমি সত্যিই নিরপরাধ। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন। নষ্ট করেছি কয়েকটা গাড়ি, আর আমার ওপর হামলে পড়েছে বলে ছেঁচে দিয়েছি আপনার এক ডেপুটির নাক-মুখ, এ ছাড়া কারও কোনও ক্ষতি করিনি। মন দিয়ে শুনুন, শেরিড্যান, আমি খুন করিনি লিয বাউয়ারকে। মহিলা ছিল আমার বড়বোনের মত। পছন্দ করতাম। আর পছন্দের কাউকে খুন করা আমার অভ্যেস নয়। আরও একটা কথা মন দিয়ে জেনে নিন, আমি নিজে লিয়কে খুন না করলেও ভাল করেই জানি, কে বা কারা খুন করেছে ওকে।’
চুপ করে রানাকে দেখছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান।
‘একটু ভেবে দেখুন,’ বলল রানা, ‘আপনি নিজেই ওখানে গিয়ে দেখেছেন কী ঘটেছে নোভাকদের ডিসটিলারিতে।’
জিভ দিয়ে ওপরের ঠোঁট ভেজাল শেরিফ। চোখ সরু করে দেখছে রানাকে। মুখটা পাথরের ক্লিফের মত রুক্ষ। চাপা স্বরে বলল সে, ‘তার মানে হামলা করেছিলে তুমিই? অবশ্য আমিও তাই ভেবেছি।’
‘আপনার মনে হয়নি, কেন ওখানে হামলা করলাম?’ বলল রানা। ‘ওটা যৌক্তিক নয়। অথচ, ঠিকই গেলাম তিন নোভাককে বন্দি করতে। এখন তারা বেঁচে আছে দু’জন। আর সেজন্যে নিজেকে দোষও দিচ্ছি।’
‘বলতে চাইছ লিয বাউয়ারকে খুন করেছে নোভাকরা?’
‘আপনার তো অনেক বুদ্ধি! এজন্যেই বোধহয় আপনাকে শেরিফ করেছে ওরা। মাথায় কথাটা ভালো করে গুঁজে নিন, মিথ্যা বলছি না। নিজেও সেটা বুঝতে পারছেন। নইলে আপনার চোখে-মুখে বিস্ময় নেই কেন? আপনার জানা আছে, কত বড় জানোয়ার ওই নোভাকরা। অথচ, তাদের বিরুদ্ধে কিছুই না করে বছরের পর বছর ধরে তাদেরকে বেড়ে উঠতে দিয়েছেন। তবে এবার সময় হয়েছে কিছু করার।’
‘তা-ই?’ ঠোঁট বাঁকা করে রানাকে দেখল শেরিড্যান।
‘হ্যাঁ, শেরিফ। ওই খুনের ব্যাপারে আরও কিছু বিষয় জানলে ভাল লাগবে না আপনার।’
শুনে দেখি সেসব কী?’
‘আপনার ডেপুটি শেরিফ বিলি এস. কনরাড প্রথম থেকেই এসবে জড়িয়ে আছে। সে নোভাকদের লোক।’
তিক্ত চেহারা করল শেরিড্যান। ‘তুমি কি পাগল হলে?’
নিষ্কম্প হাতে রিভলভার ধরেছে রানা। বামহাতে শার্ট তুলে দেখাল পেটের ক্ষত। ‘আপনার ডেপুটির কাজ।’
কুঁচকে গেছে শেরিফ শেরিড্যানের ভুরু।
‘এজন্যেই সে রাতে লিযের বাড়ি থেকে বহু দূর পর্যন্ত রক্তের চিহ্ন পেয়েছেন,’ বলল রানা। ‘বুটের খাপ থেকে ছোরা নিয়ে আমার বুকে গেঁথে দিতে চেয়েছিল কনরাড। তবে তার আগে গুলি করতে চেয়েছে বেআইনি অস্ত্র দিয়ে। ফাইল মেরে তুলে ফেলা হয়েছিল এটার সিরিয়াল নম্বর। নিজেকে তখন জিজ্ঞেস করেছি, এ ধরনের অস্ত্র একজন ডেপুটির হাতে কেন? এ ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়, শেরিফ?’
চুপ করে থাকল শেরিড্যান। শান্ত হয়েছে বাইরের পরিবেশ। পুলিশ অফিসাররা বুঝেছে, আর হামলা হবে না।
‘রিচি আর হ্যাঙ্ক নোভাক কিনে নিয়েছে কনরাডকে বলল রানা। ‘ওরা আমাকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল, যেন ফেঁসে যাই খুনের দায়ে। আর আপনার ডেপুটির কাজ ছিল চিরকালের জন্যে আমার মুখটা বুজে দেয়া, যাতে আদালতে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে না পারি। ওখানেই কেস খতম। কিন্তু সফল হলো না কনরাড। আপনার বোধহয় জানা নেই, তাকে আরেকটা কাজ দিয়েছে নোভাকরা। হয়তো ভাবছেন, খামারে কেন নেই এলিসা গুডরিচ আর তার সন্তানরা। এর জবাবে বলব, আজ সকালে তাদেরকে কিডন্যাপ করে নোভাকদের ওখানে নিয়ে গেছে কনরাড। আপাতত ওরা জিম্মি।
ফ্যাকাসে হলো শেরিড্যানের মুখ। ‘একমিনিট, রানা! জোসেফ গুডরিচ তো এখন আমার জেলখানায়। ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী কিডন্যাপ হলে মুখ খুলল না কেন সে?’
‘কারণ কিছু বলতে আমি তাকে নিষেধ করেছি,’ বলল রানা। ‘এটাই ভাল যে আমার কাছ থেকে শুনবেন আপনি। গোটা ব্যাপারটা খুব জটিল হয়ে গেছে।’
‘কিন্তু…’
‘শেরিফ, টাকার জন্যে গুডরিচদেরকে জিম্মি করেনি রিচি আর হ্যাঙ্ক। ওদেরকে ছেড়ে দেয়ার বদলে হাতের মুঠোয় আমাকে চায় তারা। রিচি আর হ্যাঙ্কের ধারণা আমার জন্যেই খুন হয়েছে তাদের ছোটভাই প্যাট্রিক। তবে এখন আমাকে না পেলে রাগের বশে এলিসা আর বাচ্চাদের খুন করবে তারা। আমি যাব ওদেরকে উদ্ধার করতে। তবে তার আগে এখানে এসেছি, যেন তুলে নেয়া হয় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা। সেক্ষেত্রে চারপাশ থেকে হামলা হবে না আমার ওপর।’
চুপ করে রানাকে দেখছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান।
‘যদি বেঁচে থাকি, নোভাক দ্বীপে গিয়ে বন্দি করব রিচি আর তার ভাইকে। পৌঁছে দেব আপনার অফিসে।’
যে দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শেরিড্যান, রানার মনে হলো লোকটা দেখছে ভিনগ্রহের প্রাণী।
কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নাড়ল শেরিফ। ‘তোমার একটা কথাও বিশ্বাস করছি না।’
‘তা হলে ডেকে জিজ্ঞেস করুন আপনার ডেপুটি বিলি এস. কনরাডকে, সকালে কোথায় ছিল সে।’
আবারও ভুরু কুঁচকে ফেলল শেরিড্যান। ‘সেজন্যেই কেমন অবাক লাগছে। সকালেই ম্যালয়দের সঙ্গে কথা বলার পর রেডিয়োতে কনরাডের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। আর তারপর কোথায় যেন গেছে সে। অথচ, অনেক আগেই তার এখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা।’
শ্বাস ফেলল রানা। বুঝে গেছে, প্রতিবেশী বুড়ো-বুড়ির কাছ থেকেই ওর খোঁজ পেয়েছে এরা। নরম সুরে বলল রানা, ‘কিন্তু এখানে পৌঁছে কোনও রিপোর্ট আপনাকে দেয়নি কনরাড, তাই না?’
মাথা দোলাল শেরিফ। ভয়ঙ্কর ভ্রুকুটি করেছে সে। ‘এটাও জানি না সে এখন কোথায় আছে।’
‘সে হয়তো এখন আছে নোভাক দ্বীপে, বিয়ার গিলতে গিলতে হাসছে আপনাকে বোকা বানাতে পেরে,’ বলল রানা।
ফ্যাকাসে হয়েছে শেরিফের মুখ। ‘কী জানি, মাসুদ রানা। আসলেই কিছু বুঝতে পারছি না।’
চট্ করে হাতঘড়ি দেখল রানা। ‘এন সার্কেল মোটেল থেকে আমাকে তুলে নেবে নোভাকদের লোক। ওখানে আমাকে পৌছুতে হবে রাত নামার আগেই। নইলে খুন হবে এলিসা, রন, রব আর টিনা। কাজেই কী করবেন ভেবে দেখুন। আপনাকে দেখিয়ে দিয়েছি আমার হাতের সব তাস।’
ভীষণ দ্বিধা শেরিফের চোখে। ক’মুহূর্ত পর জানতে চাইল, ‘তো তুমি চাও যেন তোমার বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেয়া হয়?’
আনকক করে শেরিফের দিকে রিভলভারের বাঁট এগিয়ে দিল রানা। কয়েক সেকেণ্ড অস্ত্রটা দেখে ওটা হাতে নিল শেরিফ। নল তাক করল না রানার দিকে। চোখ থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে সন্দেহের ছাপ।
হাতদুটো শেরিড্যানের দিকে বাড়িয়ে দিল রানা। সহজ সুরে বলল, ‘আমার কথা শুনুন, শেরিফ। ভঙ্গি করুন বন্দি করেছেন আমাকে। সোজা নেবেন ভিলেনিউভ শহরে চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়বে, বহু কষ্টে ভীষণ বিপজ্জনক এক সশস্ত্র অপরাধীকে বন্দি করেছেন দুর্ধর্ষ শেরিফ। ফলে নিজের পেশার সেরা সময় পার করবেন আপনি।’
‘তারপর কী করব?’ রানাকে দেখল শেরিফ।
‘অফিসে ডাকবেন ডেপুটি বিলি এস. কনরাডকে। ভঙ্গি করবেন সবই স্বাভাবিক আছে। সে আসার আগে অফিসেই বসে থাকব আমরা।’
‘ধরলাম তোমার কথাই ঠিক… কিন্তু নিজের দোষ স্বীকার করবে সে? জানিয়ে দেবে খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কুকীর্তি করে চলেছে? ব্যাপারটা এত সহজ নয়। কোনও প্রমাণ নেই তার বিরুদ্ধে।’
‘মুখ খুলবে, এ ব্যাপারে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই,’ বলল রানা। ‘ওর মুখেই সব শুনতে পাবেন আপনি।’