ছাব্বিশ
‘রানা, কী বুঝলে?’ বিরক্ত চোখে প্রফেসরকে দেখল জোসেফ। ‘এতবড় একজন জ্ঞানী মানুষ, নেশার খপ্পরে পড়ে শেষ হয়ে গেলেন!’
‘উনি কি এখনও বেঁচে আছেন?’ প্রাক্তন শিক্ষকের বাহুতে হালকা একটা চিমটি কাটল রন।
ভারী স্তূপের তরফ থেকে কোনও সাড়া নেই। করুণার দৃষ্টিতে প্রফেসরকে দেখছে এলিসা। ‘এভাবে মদ গিললে বেশি দিন বাঁচবেন না। ….রানা? কী ভাবছ?’
চেয়ারে হেলান দিয়ে রানা বলল, ‘বারবার মনে হচ্ছে, আমি লুইযিয়ানায় এসে গোলমালে জড়িয়ে যাওয়ার পর কেউ না কেউ বলেছে নোভাক নামটা। কিন্তু মনে পড়ছে না, কথাটা কে বলেছে।’
‘নিশ্চয়ই ক্লোভিস প্যারিশের কেউ,’ বলল জোসেফ। ‘সবাই তো সব জানে। নোভাক বংশ এদিকের এলাকায় ঘেয়ো কুকুরের মতই ঘৃণ্য। তাদের কথা এমন কী ভাবতেও চায় না কেউ।’
‘যাদের কথা বলছ, তারা কি উইলিয়াম এফ. নোভাকের উত্তরপুরুষ?’ জানতে চাইল রানা।
‘দক্ষিণের এতটা গভীরে, রানা, সবাই তো আমরা একে অপরের আত্মীয়। খেয়াল করোনি, ক্যাজুন মহিলাদের সামনের দাঁত ইঁদুরের দাঁতের মতই ছোট? কয়েক পুরুষ আগেও ওরা ছিল ফ্রেঞ্চ।’
‘বাজে কথা বলবে না তো, জো,’ ধমক দিল এলিসা।
‘সত্যি কথা হচ্ছে, আমাদের জিন বেশি দূরের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পায়নি,’ বলল জোসেফ। ‘মাত্র কয়েকটা পরিবারের ভেতর বারবার বিয়ে হয়েছে বলে রোগগুলোও একইরকম। আচরণও এক। ওই একই কারণে নোভাকরা সবাই বেপরোয়া আর সাইকোপ্যাথ। আইনের ধার ধারে না। প্রফেসরের কথাই ঠিক। উইলিয়াম এফ. নোভাকও ছিল নৃশংস খুনি। আর সেজন্যেই সেইবার দিয়ে হত্যা করে শেলি লং ল্যান্সকে। তার উত্তরপুরুষরাও একই ধরনের ইবলিশ। রানা, এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, কারা খুন করেছে লিয বাউয়ারকে?’
সরাসরি জোসেফের চোখে তাকাল রানা। ‘তুমি বরং একটু খুলে বলো বর্তমান সময়ের নোভাকদের ব্যাপারে।’
এখানে আছে ওরা তিন ভাই,’ বলল জোসেফ। ‘আমার কপাল মন্দ, একসময়ে আমি ছিলাম তাদের ছোটভাই প্যাট্রিক নোভাকের উকিল। সেটা অবশ্য কয়েক বছর আগের কথা। এখন তার বয়স তিরিশের মত। তবে মানুষ হতে পারেনি। আমার জানা সবচেয়ে নীচ লোক ওই প্যাট্রিক। ঘুমন্ত কুকুরের গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আনন্দ পেত। নিশ্চয়ই এ থেকে অনেক কিছুই বুঝতে পারছ। বিক্রির উদ্দেশে অর্ধেক আউন্স মেথামফেটামিন রাখার দায়ে তাকে গ্রেফতার করে শেরিফ শেরিড্যানের ডেপুটিরা। ওই ড্রাগ সাথে রাখা বি ক্লাস ফেলোনি। ওই অপরাধের শাস্তি হিসেবে এ দেশে সাজা হয় এক থেকে নয় বছরের জেল। আমি যখন বুঝলাম কীসে ডুবে আছে নোভাকরা, তার আগেই নিয়ে বসেছি তাদের কেস। যেদিন ধরা পড়ল প্যাট্রিক, তার দুয়েকদিন আগে গ্রেফতার হলে ডেপুটিরা পেয়ে যেত অন্তত এক কেজি মেথামফেটামিন। ধরা পড়ার দিন সকালে বেশিরভাগ ড্রাগ বিক্রি করে দেয় প্যাট্রিক। তার চেয়েও বড় কথা, তার বড় দুই ভাই আগের দিন বিক্রি করে এক ট্রাক মেথামফেটামিন। সব জানলাম দেরিতে, তখন আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। প্যাট্রিকের বড়ভাই হ্যাঙ্ক নোভাক আমাকে বলে দিল, বিনাশ্রমে তার ছোটভাইয়ের জেল না হলে গুলি করে উড়িয়ে দেবে আমার মগজ। মেনে নিলাম তার কথা। গোপনে বড় অঙ্কের টাকা পেল বিচারকরা। ফলে প্যাট্রিকের জন্যে কম শাস্তির ব্যবস্থা করল তারা। এ কারণে আমার ওপর খেপে ব্যোম হয়ে গিয়েছিল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান।’
‘ভাবতে ভাল লাগছে, তুমি এখন আর উকিলের পেশায় নেই,’ বলল এলিসা।
‘আমিও সেজন্যে খুশি, ডার্লিং,’ বলল জোসেফ। ‘মাত্র চোদ্দ দিন পর মুক্তি পেয়ে জেল থেকে বেরোল প্যাট্রিক। এরপর আঠারো বছরের এক মেয়েকে ধর্ষণ করতে গেল শ্রিভপোর্ট-এ। এবার বিচারে আদালত তাকে পাঠিয়ে দিল আট বছরের জন্যে স্টেট পেনিটেনশিয়ারিতে। পরে বিশেষ বিবেচনায় তার জেল হলো পাঁচ বছরের জন্যে। এটা সম্ভব হলো, কারণ প্যাট্রিকের বড়ভাই হ্যাঙ্ক ঘুষ দিয়েছিল কয়েকজন ডাক্তারকে। তারা সাক্ষ্য দেয় অপরাধী আসলে মানসিক ভারসাম্যহীন। এ কথা ভাবতে গেলে এখনও নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয় আমার।’
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল রানার। দু’দিন আগের কথা। ভিলেনিউভ শহরে মদের দোকানে ছিল ও। জর্জি এস. ডান ও তার সঙ্গীর বিষয়ে কথা বলছিল শেরিফ। সেসময়ে বলেছে নোভাক দ্বীপের কথা। সেটাই বলল রানা, ‘শেরিফ বলছিল নোভাক নামের একটা দ্বীপের কথা। এখন মনে হচ্ছে, ওটার মালিক ওই তিন ভাই।’
‘হতে পারে,’ মৃদু মাথা দোলাল জোসেফ। ‘ভাল করেই জানি, একদল বদমাশের সঙ্গে মিলে যা খুশি তাই করছে তিন নোভাক। তবে আমি কখনও নোভাক দ্বীপের কথা শুনিনি।
‘আমিও না,’ বলল এলিসা।
কী যেন ভাবছে রানা। একটু পর বলল, ‘জোসেফ, তুমি বলেছিলে নোভাকরা তিন ভাই। একজন হ্যাঙ্ক, আরেকজন প্যাট্রিক। তৃতীয়জনের নাম কী?’
‘জানতে চেয়ো না,’ বলল জোসেফ। ‘ওর চেয়ে খারাপ মানুষ পৃথিবীতে নেই।’
‘তৃতীয় নোভাকের নাম আমার জানা দরকার, জোসেফ।’ অস্বস্তির ভেতর পড়ল জোসেফ। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘ওর নাম রিচি নোভাক। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ওটা। বুদ্ধিও বেশি। কখনও গ্রেফতার হয়নি। রিচির তুলনায় প্যাট্রিক বা হ্যাঙ্ক রীতিমত সাধু। হ্যাঙ্ক আমাকে বলেছিল, আগে নিউ অর্লিন্সে একটা ডাকাত দলের সদস্য ছিল রিচি। তার হাতে খুন হয়েছে বেশ ক’জন নিরীহ মানুষ। ডিক্সি মাফিয়া, টেনেসি আর মিসিসিপির বর্ণবাদী টেরোরিস্ট নিও নাযিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে রিচির। তার হাতের চেটোয় এমনি এমনি আঁকা হয়নি স্বস্তিকার টাট্টু।’
‘দারুণ ভাল মানুষ বলে মনে হচ্ছে,’ গম্ভীর স্বরে বলল রানা।
‘এরপর পেশা পাল্টে ফেলল সে। বিক্রি করতে থাকল মেথামফেটামিন ড্রাগ্স্। সঙ্গে চালু করল জুয়ার আখড়া। এ ছাড়া জড়িয়ে গেল ডাকাতি, গাড়ি চুরি, মানি লন্ডারিং, কিডন্যাপিং-এ। একদল বদমাসকে দিয়ে বিক্রি করতে থাকল চোরাই মদ আর ইলেকট্রনিক্স্ সামগ্রী। উনিশ শত ত্রিশ সালে বেআইনি মদ নিষিদ্ধ করেছিল আমেরিকান সরকার। এ রাজ্যে তা এখনও প্রযোজ্য। ট্যাক্স না দিয়ে খুব কমদামি মদ তৈরি করে নোভাকরা। দক্ষিণে এই কাজে সেরা তারা। ওই বাজে মদ খেয়ে নষ্ট হয়েছে অনেকের চোখ, লিভার। দু’হাতে লাখ লাখ ডলার লুঠছে নোভাকরা।’
‘এসব জেনেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাওনি কেন?’ জানতে চাইল রানা।
কাঁধ ঝাঁকাল জোসেফ। ‘মক্কেলের গোপন বিষয়ে মুখ খোলার নিয়ম নেই উকিলদের। তার ওপর, নিরাপদ রাখতে হবে আমার পরিবারকে। জেনে বুঝে তিন হারামি নোভাক বা তাদের সঙ্গীদের বিরুদ্ধে টু শব্দ করবে না সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ। দলে ওরা অনেক। সত্যি বলতে, গোটা প্যারিশের সবাই ভয় পায় নোভাকদেরকে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল জোসেফ, ‘তা ছাড়া, ওপরে-নিচে নানান জায়গায় হাত আছে তাদের। শিয়োর হতে পারবে না, তাদের পয়সা শেরিফের পকেটে যাচ্ছে কি না।’
ডেপুটি বিলি এস. কনরাডের কথা মনে পড়ল রানার। তখনই ঠিক করল, ধরে নিয়ে গিয়ে তার পেট থেকে জরুরি তথ্য বের করবে। বলল, ‘কারও না কারও উচিত নোভাকদের মোকাবিলা করা।’
মাথা নাড়ল জোসেফ। ‘আগেও এ বিষয়ে কথা বলেছি। ওদের বিরুদ্ধে লাগতে গেলে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে।’
‘প্রয়োজনে এ ধরনের লোকের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দ্বিধা করি না আমি।’ গম্ভীর হয়ে গেল রানা।
‘ওরা কিন্তু বেপরোয়া খুনি। নিশ্চয়ই সেটা বুঝতে পেরেছ?’
‘ওরা হয়তো দেখবে তাদের চেয়েও বেপরোয়া আরও কিছু লোক আছে দুনিয়ায়।’
‘আমি হলে মুখ বুজে সরে পড়তাম,’ বলল জোসেফ। ‘তবে আমি তো আর তুমি নই। ধরলাম, তাদেরকে ধরবে তুমি, তারপর কী করবে?’
‘খুন করবে, আর কী!’ চকচক করছে রনের দুই চোখ।
‘রন! একদম চুপ!’ ধমক দিল এলিসা।
‘খুন করা উচিত বলে মনে করছি না,’ বলল রানা। ‘খুন করিনি তবু মিথ্যা খুনের দায়ে আমাকে খোঁজা হচ্ছে। আরও তিনটে খুনের দায় যোগ হলে সেটা আমার জন্যে ভাল কিছু হবে না। আমি চাই তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে। হয় ঝামেলা ছাড়াই আমার সঙ্গে আসবে তারা, নইলে বাধ্য হব আঙুল বাঁকা করতে।’
‘তুমি ভাবছ ভাল মানুষের মত নিজেদের দোষ স্বীকার করবে তারা?’ অবাক চোখে রানাকে দেখছে জোসেফ।
‘শুরুতে রাজি হবে না,’ বলল রানা। ‘তবে মুখ খোলাবার অনেক পথ আছে।
‘কী ধরনের পথ?’ জানতে চাইল জোসেফ।
‘আমার নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করব,’ বলল রানা।
নিচু সুরে শিস দিল জোসেফ। ‘কেন যেন মনে হচ্ছে, ফুর্তির দিন ফুরিয়ে এসেছে নোভাকদের। তুমি যে বিপদে পড়েছ, তার চেয়ে অনেক বড় বিপদে পড়বে তারা।’
‘শুনেও ভাল লাগছে,’ বিড়বিড় করল রন।
উঠে হ্যাণ্ডশেক করার জন্যে জোসেফের উদ্দেশে হাত বাড়িয়ে দিল রানা। ওর হাতটা দেখল জোসেফ, তারপর শুকনো, দৃঢ় হাতে চেপে ধরল।
রানা বলল, ‘আমার জন্যে অনেক করেছ, সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ।’ এলিসার দিকে তাকাল ও। ‘এলিসা, আমি কৃতজ্ঞ তোমাদের কাছে। ঋণী। এই ঋণ কখনও শোধ করতে পারব না।’
চেয়ার ছেড়ে রানাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল এলিসা। ‘তার মানে, এবার বিদায় নেবে, এই তো?’
আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। ‘চলব একা পথে।’
উঠে দাঁড়িয়ে রানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল রন। হ্যাণ্ডশেক করল ওরা দু’জন। দৃঢ়হাতে রানার হাত ধরেছে কিশোর ছেলেটা। রানা বুঝে গেল, বড় হয়ে শক্তিশালী পুরুষ হবে রন। ওর বাবার মত। কঠোর অথচ অত্যন্ত ভদ্র একজন মানুষ। নরম সুরে বলল ছেলেটা, ‘আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন বলে আবারও আপনাকে ধন্যবাদ, মিস্টার রানা। তবে ঋণী থাকতে চাই না। তাই সঙ্গে করে একটা জিনিস এনেছি।’