সৌভাগ্য-চতুর্থী ব্রত
শরৎকালে দেবীপক্ষের শুভ চতুর্থীর দিন এই ব্রত নিতে হয় এবং পরপর চার বছর পালন করে ব্রত উদযাপন করতে হয়।
সৌভাগ্য-চতুর্থীর কথা
এক রাজা, তাঁর ছিল দুই রানি। সুয়ো আর দুয়ো। দুয়োরানিকে ভালোবাসতেন না রাজা মোটেই। এমনকি তাঁর মুখ অবধি দেখতে চাইতেন না তিনি। মনের দুঃখে দুয়োরানি রাজবাড়ি ছেড়ে উঠলেন গিয়ে বাগানের এক গোয়ালঘরে। সেখানেই রইলেন তিনি মনের দুঃখ মনে চেপে। দুয়ো চলে যাওয়ায় সুয়োর আর আনন্দ ধরে না। আমোদ-আহ্লাদ নিয়েই সুয়ো থাকেন মেতে অষ্টপ্রহর। তবুও কিন্তু পারেন না সহ্য করতে রাজ্যের মাঝে দুয়োর অস্তিত্ব। সখীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাই স্থির করলেন সুয়ো রাজাকে হাত করে দুয়োকে বনবাসে পাঠাতে। প্রজাদের কিন্তু ছোটো বড়ো সবাই ভক্তি করতো বড়োরানিকে। ছোটোরানি ছিল তাদের দুচোখের বিষ।
এদিকে বড়োরানি যা পান কোনোরকমে তাই সেদ্ধ করে খান আর একলা ঘরে ছেড়া কাঁথায় শুয়ে নিজের দুঃখের কথা ভগবানকে জানান। কত কষ্টে কাটে তাঁর দিন। দাসী এসে একদিন বড়োরানিকে জানায় ছোটোরানির অভিসন্ধির কথা। শুনে সেদিন বড়োরানির বড়োই দুঃখ হল। তিনি আর রান্না করতে পারলেন না সেদিন। মনের দুঃখে ছেঁড়া কাঁথাখানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলেন। রানি কেঁদেই চলেছেন—বিরাম নেই। দিন যায়, সন্ধ্যে হয়, ওঠেন না তিনি—কেঁদেই চলেছেন। সারাদিন খাওয়া হয়নি—শরীর দুর্বল। রাত অনেক হয়ে গেল কিন্তু রানি উঠলেন না। কাঁদতে কাঁদতে শেষে ঘুমিয়ে পড়লেন। শেষরাতে স্বপ্ন দেখেন রানি, অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে এসে তাঁকে বলছে,—‘দুঃখ কেন রে তোর? ওঠ, কাঁদিসনে। এবার হবে তোর দুঃখের শেষ। আজ চতুর্থী। রাত পোহালে চতুর্থীর পারণ করিস—সব দুঃখ কেটে যাবে।’ কথায় যেন স্নেহ-মায়া উপচে পড়ছে—এমন মিষ্টিকথা শোনেননি রানি কোনোদিন। প্রাণ তাঁর জুড়িয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলেন রানি,—‘কে তুমি, মা? তোমার কথায় প্রাণ আমার জুড়িয়ে গেল। কিন্তু আমি তো পারণের কিছুই জানিনে, মা! বলে দাও কী আমায় করতে হবে।’ মেয়েটি বললে,—‘দেখ তোর এই গোয়ালের পেছনে ছাইগাদা থেকে দুখানা মানের পাতা এনে ধুয়ে তার একখানায় সব রকমের গয়নার ছবি পিটুলিগোলা দিয়ে এঁকে তাতে আতপচাপের নৈবেদ্য সাজিয়ে, আর অন্যখানায় ঘি দিয়ে ওই রকম গয়না এঁকে তাতে চিনির নৈবেদ্য সাজিয়ে একমনে মা দুর্গাকে ডেকে তাঁর পুজো করবি। তারপর আতপ চালের ভাত রান্না করে ঘি দিয়ে আঁকা পাতাখানায় ঢেলে সেই ভাত মা দুর্গাকে নিবেদন করে প্রসাদ খাবি। সেই এঁটো পাতা জলে ভাসিয়ে আঁচিয়ে আসবি। এতেই ফিরবে তোর ভাগ্য। মা দুর্গার আশীর্বাদ। এতেই হবে তোর চির সৌভাগ্যের উদয়।’
ব্রহ্মমুহূর্তে জেগে ওঠেন রানি। মা দুর্গাকে স্মরণ করে স্বপ্নের নির্দেশমতোই মানের পাতায় ভোগ নিবেদন করে প্রসাদ পেয়ে পাতা ভাসিয়ে আঁচিয়ে আসেন। এমনি ভাবেই দেবীপক্ষের শুভ চতুর্থীর পারণ করেন রানি তিন বছর। দুঃখের কিন্তু অবসান হয় না। রানি হতাশ হন না। আরও একাগ্রমনে নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেন ব্রত। প্রাণ দিয়ে ডাকেন মা দুর্গাকে।
দিন যায়। রাজ্যে শুরু হয় মহামারি। রাজার হাতি শালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া মরতে থাকে। শুরু হয় রাজ্যময় চুরি, ডাকাতি, লুঠতরাজ। দাস-দাসী ছোটোরানির ব্যবহারে যায় চলে কাজ ছেড়ে। প্রজারা ঘোষণা করে বিদ্রোহ। দেশ হয় অরাজক।
রাজাকে মন্ত্রীর সঙ্গে যেতে হয় প্রজাদের কাছে। তারা সবাই বলে বড়োরানির কথা। বলে তারা, বড়োরানিই ছিলেন রাজ্যের লক্ষ্মী,—তারই অবর্তমানে নাকি হয়েছে রাজ্যের এই দশা। রাজাও ভাবেন সে কথা। ছোটোরানির ব্যাপারে রাজাকে প্রজারা স্ত্রৈণ বলে দেয় ধিক্কার। তারা আবেদন করে বড়োরানিকে ফিরিয়ে আনতে। ভাবতে ভাবতে রাজা ফিরে আসেন রাজ্যে।
আবার আসে শরৎকাল। কিন্তু রাজ্যের শ্রী ফেরে না। বড়োরানি এবারও করলেন মা দূর্গার পুজো—ভোগ দিলেন মানের পাতায়। প্রসাদ পেয়ে রানি পাতা জলে ভাসিয়ে আঁচিয়ে ঘাট থেকে উঠে আসতেই দেখতে পান রাজা তাঁর পথ আগলে রয়েছেন দাঁড়িয়ে। রানি রাজাকে গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করেন। রাজা আদর করে তাঁর হাত ধরে নিয়ে যান রাজপুরীতে।
বড়োরানি এসেছেন ফিরে—সবাই এলো ছুটে। দাস-দাসী, পাত্র-মিত্র-পরিজন সকলেই খুশি। রাজ্যময় আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। সুবৃষ্টি হল, মহামারি গেল, দেশে শান্তি ফিরে এল, বিদ্রোহী বশ্যতা স্বীকার করল,—বড়োরানির জয় জয়কার পড়ে গেল চারিদিকে।
ছোটোরানির কান্নাকাটি, আবেদন-নিবেদনে রাজা মোটেই ভ্রূক্ষেপ করলেন না। তাঁকে বনবাসে যেতে হল।
আবার এল শরৎ। বড়োরানি ঘটা করে মা দুর্গার পুজো করলেন আর প্রচার করে দিলেন দেশে দেশে সৌভাগ্য-চতুর্থী ব্রতের মাহাত্ম্য-কথা। দেখতে দেখতে সব দেশেই এই ব্রত প্রচার হল। ভক্তিমনে সকলে সৌভাগ্য-চতুর্থী ব্রত করতে লাগলেন।
সৌভাগ্য-চতুর্থী ব্রতকথা সমাপ্ত।