সৌদি আরবের কীর্তিকলাপ
১. সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রী খালিদ আল-ফালিহ বলেছেন, মিনায় পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা আল্লার ইচ্ছেয় ঘটেছে। এ ধরনের দুর্ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না, এ তাঁর মত। তেরোশ হাজির মৃত্যুর জন্য হাজিদেরই দায়ী করেন খালিদ আল-ফালিহ। হাজিরা নাকি হজ্বের নিয়ম অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মরেছেন। আসল ঘটনা যা শোনা যাচ্ছে, তা ভয়াবহ। এক সৌদি প্রিন্সের প্রাসাদে যাওয়ার পথ সুগম করতে দুটো রাস্তা, লক্ষ লক্ষ হাজিদের সাধারণত যে দুটো রাস্তা ব্যবহার করতে হয়, বন্ধ করে দেওয়া হয়, সে কারণেই এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। রাস্তা বন্ধ না করলে এ ঘটনা ঘটতো না। অনেকে বলছে, হাজিদের বিপরীতমুখী দুটি স্রোত পরস্পরকে অতিক্রম করার সময় দুর্ঘটনাটি ঘটে। যুক্রাজ্যের ওমরা হজ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের মোহাম্মদ জাফরি অবশ্য বলেছেন, এ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বাদশাহ, তাঁর প্রাসাদ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও গাল্ফ কো অপারেশন কাউন্সিলের সদস্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল, এ কারণে দুটো রাস্তা তারা বন্ধ করে দিয়েছিলো, ওই দুটো রাস্তাই শয়তানের উদ্দেশে পাথর নিক্ষেপ করার জায়গায় যাওয়ার রাস্তা। রাস্তা বন্ধ থাকার কারণেই ভিড় আর জটলার সৃষ্টি হয়। ভিড় আর জটলার কারণেই পদদলনের ঘটনা ঘটে।
এসব খবর থেকে যা অনুমান করতে পারি, তা হলো, এতগুলো হাজিকে প্রাণ দিতে হলো তার কারণ, ১. সৌদি রাজপরিবারের খামখেয়ালি ২. সৌদি রাজপরিবার হজুকে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাবে না। ৩. হাজিদের প্রাণের মূল্য আছে বলে মনে করে না।
সৌদি আরব প্রতিবছর ৮.৫ বিলিয়ন ডলার পায় শুধু হজ্ব থেকেই। অথচ হাজিদের নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি নেই। হাজিরা নিতান্তই সৌদিদের ধর্ম ব্যবসার খদ্দের। তেল থেকে যেহেতু বেশি টাকা আসে, তাই তেল ব্যবসার খদ্দেরদের সৌদি আরব বেশি খাতির করে, তাদের নিরাপত্তার দিকেও কড়া নজর তাদের।
জাফরি বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রীর আল্লাহকে দোষ দেওয়াটা ঠিক হয়নি। প্রতিটি দুর্যোগের সময় সৌদি সরকার বলে, আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটেছে। এটি আল্লাহর ইচ্ছায় নয়, এই মানুষের হেঁয়ালির কারণে ঘটেছে।
এবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০ লাখের বেশি মানুষ মক্কায় হজ্ব পালন করতে গেছেন।এক বাংলাদেশ থেকেই নাকি এক লক্ষেরও বেশি।
২. মোহন কুমার মণ্ডল আমার ফেসবুক বন্ধু। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কারণ সে নিজের মত প্রকাশ করেছিল ফেসবুকে, যে মতটি বাংলাদেশ সরকারের পছন্দ হয়নি। সৌদি আরব যেভাবে রাস্তা বন্ধ করে হাজারো মুসলমানকে খুন করেছে, তা এতই নৃশংস আর হৃদয়বিদারক যে মোহন কুমার মুসলমান না হয়েও মুসলমানের গণহত্যার প্রতিবাদ করেছে। শয়তানকে মারা যদি প্রতীকী ব্যাপার হয়ে থাকে, তবে সেই প্রতীকী ব্যাপারটি নিজের দেশেই ঘটাতে পারে। ওটির জন্য অত দুর সৌদিতে যাওয়ার কোনও দরকার পড়ে না। মোহন এমনই বলেছিল। এতে নাকি আওয়ামী লীগের কোন লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে।
ধর্মীয় অনুভূতিকে এমন একটা ভয়ংকর অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করছে দেশের খারাপ লোকগুলো যে, কোনও ভালো লোককে তারা আর বাঁচতে দিতে চাইছে না। খারাপ লোকের মিছিলে যোগ দিয়েছে দেশের সরকারও।
সারা পৃথিবী সৌদি আরবের নিন্দে করছে। কিন্তু বাংলাদেশ করছে না। বরং কেউ সৌদি সরকারের বর্বরতার প্রতিবাদ করলে তাকেই শাস্তি দিচ্ছে। শত শত হাজির মৃতদেহ কী করে বুলডোজার দিয়ে আবর্জনার স্তূপে ফেলা হয়েছে দেখলে গা শিউরে ওঠে। কোনও সভ্য দেশ কি এই আচরণ করতো!
সৌদি আরব সভ্য দেশ নয়। বাংলাদেশও সভ্য দেশ নয়। তাই বাংলাদেশেও সৌদির অসভ্যতা নিয়ে প্রতিবাদ নেই। গাঁজায় ইহুদিদের বুলডোজারে মুসলমান মরলে। বাংলাদেশের মুসলমান উন্মাদ হয়ে ওঠে। কিন্তু আইসিস, বোকো হারাম, আল শাবাবরা হাজারো মুসলমান হত্যা করলেও মুসলমানদের রাগ হয় না। সৌদি আরবের অব্যবস্থার কারণে হজ্ব করতে আসা শত শত মুসলমানের মৃত্যু হলেও তারা রাশব্দ করে না। এই হলো মুসলমানের চরিত্র।
হজ্ব করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ১৩০০ হাজির করুণ মৃত্যুর প্রতিবাদ অনেকে করছেন বাংলাদেশে, কিন্তু সবাইকে বাদ দিয়ে মোহন কুমারকে গ্রেফতার করা হলো কেন? মোহন কুমার হিন্দু বলে? হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করলে অধিকাংশ মুসলমান চুপচাপ মেনে নেয় বলে?
৩. জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিল প্যানেলের প্রধান হতে যাচ্ছে আমাদের সৌদি আরব। এ কী করে সম্ভব। সৌদি আরব– যে দেশে মেয়েদের, অমুসলিমদের, সমকামীদের, রূপান্তরকামীদের কোনও মানবাধিকার নেই, সেই দেশকে কী করে মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান নির্বাচন করে জাতিসংঘ?
এর প্রতিবাদ কি কেউ করবে না? আমরা যারা প্রতিবাদ করি, আমাদের শাস্তি পেতে হয়। যতক্ষণ মুখ বুজে থাকি, ততক্ষণ সব ঠিকঠাক। মুখ খুললেই বিপদ। সৌদি আরব অন্যায় করলেও অন্যায় করেছে বলা যাবে না। মানবাধিকার লংঘন করলেও সৌদি আরব মানবাধিকার লংঘন করেছে, এ কথা বলা যাবে না। চীন দেশ মানবাধিকার লংঘন করেছে বলে রাস্তায় নেমে মিছিল করাটা সহজ। সৌদি আরবে ইসলামের পয়গম্বরের মুহাম্মদ জন্মেছেন। সুতরাং এ দেশের সাত খুন মাফ। ১৩০০ মানুষকে নিজেদের খামখেয়ালির কারণে মেরে ফেললেও বলতে হবে সৌদি আরবের দোষ নেই, যা হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছেয় হয়েছে, যারা পবিত্র স্থানে মারা গিয়েছে, সবাই বেহেস্তে যাবে, সুতরাং কারও দিকে অভিযোগের আঙুল যেন না ওঠে।
লজ্জা সৌদি আরবের হবে না। কারণ দেশটির শাসকরা ভয়ানক নির্লজ্জ। আমি অনুরোধ করছি, সৌদি আরবকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল প্যানেলের প্রধান যেন না করা হয়। মানবাধিকারে বিশ্বাস না করা কাউকে মানবাধিকারের মাথায় বসিয়ে দিলে যা দাঁড়ায়, তাই দাঁড়াবে এখন। মানবাধিকারের মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে, মানবাধিকারের বারোটা বাজাবে অথবা একে নিশ্চিহ্ন করে ছাড়বে। ধর্মের সঙ্গে যেমন মানবাধিকারের সম্পর্ক নেই, সৌদি আরবের সঙ্গেও তেমন মানবাধিকারের সম্পর্ক নেই।