৮
যে বছরের কথা বলছি—প্রায় বিশ বছর আগে, সেবার কিন্তু ‘পর্যন্তদেব’ বা ‘পর্জন্যদেব’- -ও করুণা করলেন না। এমনটি কখনো হয়নি আতঙ্কে সবাই হিতাহিত জ্ঞান হারাতে বসল।
হঠাৎ একমুঠি-বাবা এসে বললে, ঐসিন নেহী হোগা! যবতক্ বড়ামাঈ নহী আয়েগি, পূজা নহী চড়ায়েগি, তত্তক বাবা খুশ নেহি হোগা!
একমুঠি-বাবা এক পাগল সন্ন্যাসী। ভোলাবাবার মন্দিরের গায়ে যে
যে ভবানী মন্দির—সেখানেই আছে আবহমানকাল। কেউ বলে তার বয়স সওয়া শ, কেউ বলে দেড়শ। গ্রামের প্রাচীনতম অশীতিপর বৃদ্ধও বলেন, বাল্যকালে একমুঠি-বাবার চেহারা ঠিক একই রকম দেখেছেন—এক মাথা জটা, একবুক দাড়ি, হাতে ত্রিশূল, কানে মাকড়ি আর ডান হাতের অনামিকায় একটা অষ্টধাতুর প্রকাণ্ড আংটি। বিদেশী নিশ্চয়—সেটা তাঁর বাচন-ভঙ্গিতেই বোঝা যায়। ‘কিন্তু কোথা থেকে যেন এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছেন কেউ জানে না।
পাগল মানুষটার কথা মানাও চলে না, ফেলাও চলে না। তাঁর কথাটা অবশ্য সত্য। জমিদার গৃহিণী আজ মাসখানেক শয্যাশায়ী। তিনি বারোয়ারীতলায় আসেননি, আসতে পারেননি। লোকমুখে একমুঠি-বাবার ঐ নিদান শুনে ব্রজসুন্দরী জিদ ধরলেন তাঁকে পূজাতলায় নিয়ে যেতে হবে। পাল্কি চেপে তিনি এলেন; কিন্তু বাবাকে অর্ঘ্য নিবেদন করার সময় তাঁর মাথা টলে উঠল। তিনি মূর্ছিতা হয়ে পড়ে গেলেন বাবার সামনে। হস্তধৃত নৈবেদ্যের থালাটা ঠিকরে গিয়ে পড়ল মূর্তির চরণে।
ধরাধরি করে মূর্ছিতাকে সবাই বার করে আনল।
নিতান্ত কাকতালীয় ঘটনা! সেরাত্রেই প্রবল বর্ষণে মাঠঘাট ভেসে গেল!
সেই দিন থেকেই আপামর জনসাধারণের বিশ্বাস ব্রজসুন্দরী কোন শাপভ্রষ্টা স্বর্গের দেবী। জমিদারবাড়িতে এসে একটা নিষ্পাপ জীবন কাটিয়ে গেলেন। আজ মেয়াদ অন্তে শাপভ্ৰষ্টা স্বর্গে ফিরে যাচ্ছেন!
আর সেই জন্যেই খবরটা যখন গ্রামে গ্রামে প্রচারিত হয়ে গেল তখন দূর-দূরান্তর থেকে গোযান আসতে শুরু করল সোঞাই অভিমুখে। ওরা ‘বড়মাকে শেষ প্রণাম করতে আসছে।
দুরন্ত অভিমানে জগুঠাকুরুণ বাক্যালাপ বন্ধ করেছেন তাঁর ভাইপোর সঙ্গে। দুর্গা গাঙ্গুলীর বাড়িতে ঠিক কী ঘটেছিল তা জানেন না, তবে উপসংহারে দুজনে যে দুজনার মুখ দেখাদেখি বন্ধ করেছেন এটুকু সংবাদ পাওয়া গেছে। ওর ‘একবগ্গামির’ একটা সীমা থাকবে তো!
জগু তাঁর কন্যাটিকে বলেন, তোর দাদাকে জিজ্ঞেস কর—ও কি যাবে আমাদের সাথে?
রূপেন্দ্রনাথ ছিলেন শ্রুতিসীমার মধ্যেই। প্রশ্ন করেন, কোথায় পিসি?
কিন্তু জগু তো কথা বলবেন না। তাই কাত্যায়নীকেই বলেন, বল না তোর দাদাকে সব বিত্তান্ত। জেনে নে—ওর শান্তর কী বলে! জ্যেঠিকে পেন্নাম করাটা কি শাস্তর-সম্মত হবে? নাকি তার শাস্তরে মানা!
কাত্যায়নী অতি দ্রুত বাধা দিয়ে বলে, কাল সকালে বড়মা শেষ যাত্রা করবেন। মা আর আমি যাচ্ছি তাঁকে পেন্নাম করতে। তুমি আসবে?
রূপেন্দ্রনাথ বলেন, আপনি আমার উপর অহেতুক রাগ করে আছেন, পিসিমা। আমি অন্যায় কিছু করিনি…
জগুপিসি কাতুকেই নির্দেশ দেন, তোর দাদাকে বলে দে, আমরা এগুচ্ছি। তার মন চায় তবে সে যেন আসে, না চায় নেই! আমার সব সইবে!