১৬
কুসুমমঞ্জরী অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। তার রুক্ষচুল এখন খোঁপা বাঁধা যায়। মূর্ছা আর হচ্ছে না। পথ্যি পেয়ে গায়ে তাগদও এসেছে। গোযানটা অপেক্ষা করছে। সেই প্রহরীটি ফিরে গেছে রূপনগরে। বোধকরি বারম্বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে সম্ঝে নিয়েছে, কবিরাজ-মশায়ের কু-মলব আছে। তা তো হতেই পারে—কুসুমকে দেখলে মুনিঋষিরও মতিভ্রম হয়ে যায়, আর ও তো সামান্য কবিরাজ। দূর থেকে সে লক্ষ্য করেছে সব কিছু। কুসুম মাঝে মাঝে বাইরের দাওয়ায় এসে নিশ্চুপ বসে থাকে। অথচ কবিরাজ মশায়ের সানাই-এ সেই এক পৌঁ।
একদিন সুযোগমতো কুসুমমঞ্জরী বললে, শুনুন।
নাড়ি দেখে ঔষধপথ্যের ব্যবস্থা করে রূপেন্দ্র ফিরে যাচ্ছিলেন। ঘরে তখন কাত্যায়নী ও আছে। পিছন থেকে ওর ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, কিছ বলবে?
—আমাকে আপনি বাঁচিয়ে তুললেন কেন?
প্রশ্নের অন্তর্নিহিত জ্বালাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বলেন, সেটাই যে চিকিৎসকের ধর্ম।
—ও, ধর্ম! আপনারা সবাই খুব ধার্মিক, নয়?
এ তিরস্কারের কী জবাব?
—কিন্তু আমি তো বাঁচতে চাইনি। বলুন, কেন তাহলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে এভাবে বাঁচালেন?
অপরাধীর মতো রূপেন্দ্র অধোবদন।
কাত্যায়নী তাঁকে নীরব দেখে বলে ওঠে, তুমি তো তখন অজ্ঞান অচৈতন্য ছিলে ভাই! দাদা কেমন করে বুঝবে, তুমি কী চাও?
—কিন্তু এখন তো আমি সজ্ঞানে আছি। এখন তো উনি জানেন, আমি কী চাই।
রূপেন্দ্র অত্যন্ত অসহায় বোধ করেন। শান্ত স্বরে বলেন, কিন্তু আত্মহত্যা যে মহাপাপ, মঞ্জরী।
—ও! আত্মহত্যা করলে অনন্ত নরকবাস বুঝি? আপনাদের ধর্ম তাই বলে?
এবারও প্রত্যুত্তর করতে পারলেন না।
—আর সেই ধর্মগুরুর সেবাদাসী হলে? অনস্ত বৈকুণ্ঠ-লোক? কী? বলুন? জবাব দিচ্ছেন না কেন?
রূপেন্দ্র তাকিয়ে দেখলেন মেয়েটির দিকে। ওর চোখ দুটি জ্বলছে। বড় বড় নিশ্বাস পড়ছে। আর হাপরে ফুঁ পড়লে কামারের চুল্লিতে যেমন অঙ্গারখণ্ড জ্বলে-জ্বলে ওঠে তেমনি প্রতি শ্বাসে ওর চোখ দুটিতে আগুন জ্বলছে।
রূপেন্দ্র বলেন, তুমি কী চাও?
—মরতে। আমাকে এক পুরিয়া বিষ এনে দেবেন?
কাত্যায়নী স্তম্ভিত হয়ে গেল দাদার উত্তর শুনে। তিনি স্পষ্টাক্ষরে বললেন, দেব। আজ নয়, যেদিন তুমি রূপনগরে ফিরে যাবে, সেদিন তোমার আঁচলে বেঁধে দেব। কিন্তু কথা দাও—একেবারে চরম মুহূর্তের আগে তা মুখে দেবে না?
অদ্ভুত হাসল মেয়েটি। উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ। যুক্তকরে অসঙ্কোচে বললে, আপনি আমাকে মার্জনা করবেন, গৌর। মরতে আমি চাই না, কেই বা মরতে চায়?—মিছে কথা বলেছিলাম তখন। তাই কথা দিতে পারছি।
রূপেন্দ্রনাথ আর দাঁড়ালেন না। স্থানত্যাগ করেন তৎক্ষণাৎ।
না, মরতে কেউ চায় না—যে মর্মন্তুদ হেতুটা মানুষকে আত্মঘাতী হতে প্রেরণা যোগায় সেটা অপসারিত হলে কে মরতে চায়? পরমাত্মার মতো জীবাত্মাও শুধু আনন্দের অভিসারী—আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। ঐ অজগরের নাগপাশ থেকে মেয়েটিকে যদি মুক্ত করা যেত, তাহলে ঐ কুসুমমঞ্জরীও ফুলে-ফুলে মুঞ্জরিত হয়ে উঠত। কিন্তু তা হবার নয়। স্বহস্তে তিনি ওর অঞ্চল প্রান্তে বেঁধে দেবেন মুক্তিপথের চাবিকাঠি!
হ্যাঁ, আয়ুর্বেদশাস্ত্রের নির্দেশ লঙ্ঘন করেছেন আজ। গুরুর আদেশ অমান্য করেছেন। ‘মা প্রদেয়ম্’ তালিকায় যে প্রাণহানিকর বিষ আছে তার থেকে বেছে নিয়ে একটি তীব্র কালকূট দিতে হবে ঐ মেয়েটিকে।
শাস্ত্রীয় নির্দেশ নয়, গুরুবাক্য নয়—সবার বড় তাঁর বিবেকের সঙ্কেত।
সত্যশিবসুন্দরকে খুঁজে পেতে হলে ‘আত্মদীপ’ হতে হবে।
.
গৌর!
সম্বোধনটা শুনে অবাক হননি—প্রতিবাদও করেননি। তত্ত্বটা ওঁর জানা। কাত্যায়- বলেছে। মেয়েটি স্বীকার করেছিল কাত্যায়নীর কাছে। দুজনে প্রায় সমবয়সী। কদিনেই সখী গড়ে উঠেছে একটা। কাত্যায়নীর কাছে সে স্বীকার করেছে।
সে নাস্তিক!
না, জ্ঞান হবার পর থেকেই সে ঈশ্বরে বিশ্বাস হারায়নি। শৈশবেই হারিয়েছে বাবা-মাকে—কাকার কাছে মানুষ। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের বাড়ি—নিত্যপূজার ব্যবস্থা ছিল। বাড়িতেই আছে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি। বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপূজো, শিবরাত্রির উপবাস, বৈশাখে ‘পুণ্যিপুকুর’ সব রকমই করেছে বাল্যে ও কৈশোরে। দেবতার উপর তার বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে গত বৎসর রাসপূর্ণিমায়—যখন শুনল, আগামীবছর রূপনগরের সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী হওয়ার জন্য সে নির্বাচিতা হয়েছে। এই একটি বছর সে সব দেবতার দ্বারে মাথা কুটেছে—কারও দয়া হয়নি! দেবদেবী, ঠাকুরঠুকুর সব ফক্কিকারী—সব মিথ্যা! ঠুটো জগন্নাথ আর্তের ডাকে সাড়া দেন না—ধনী যজমানের মালপো-ভোগের দিকে তাঁর দৃষ্টি! মা-কালী শুনতে পান না ছাগশিশুর আর্তনাদ! যূপকাষ্ঠে বৃথাই ধড়ফড় করে শান্ত হয় ছিন্নশির হতভাগ্য!
কাত্যায়নী আস্তিকের ঘরে লালিত। আজন্ম সংস্কারে আঘাত লাগায় শিউরে উঠেছিল সে—কিন্তু মেয়েটিকে ঘৃণা করতেও পারেনি। বোঝে—কী মর্মান্তিক যন্ত্রণায় হতভাগিনী নাস্তিক হয়ে যেতে বসেছে। আকুল হয়ে কাতু বলে উঠেছিল, কিন্তু শিব? আশুতোষ?—না, আকাশের কোন দেবতাকে বিশ্বাস করি না আমি। আমার দেবতা মর-মানুষ! আমার ইষ্ট—শ্রীগৈারাঙ্গ মহাপ্রভু। তাই সর্বজীবে গৌরকে খুঁজি আমি।
—কিন্তু তিনিও তো বিষ্ণুপ্রিয়াকে ত্যাগ করেছিলেন?
—জানি। ত্যাগ দুজনেই করেছেন। মা বিষ্ণুপ্রিয়াও মহাসাধিকা। স্বামীর কোল থেকে সরে গেছিলেন যাতে তিনি সর্বজীবে কোল দিতে পারেন।
রীতিমতো অবাক হয় গিয়েছিলেন রূপেন্দ্রনাথ। কাতুর কাছ থেকে সব কিছু শুনে। ঐ মেয়েটি কে? ওর কি অক্ষর-পরিচয় আছে? না হলে এমন তত্ত্বজ্ঞান ওর হল কী করে?
বুঝতে পারেন—আর বুঝতে পেরে নিরতিশয় লজ্জায় মুখখানা কোথায় লুকোবেন ভেবে পান না—কেন সে সেদিন ঐ কথা বলেছিল! ওঁর অঙ্কশায়িনী সেই মেয়েটি সেদিন—ছি ছি, কী লজ্জা-ওঁর মুখে দেখতে পেয়েছিল তার প্রাণের ঠাকুরের প্রতিচ্ছবি! অচেতনের অন্ধকার রাজ্য থেকে চেতনার সীমান্তে পৌঁছে অত কাছে ওঁকে দেখতে পেয়ে ও ভুল করেছিল। ওঁর নয়, ওর প্রাণের ঠাকুরেরই কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরেছিল। বলেছিল, এসেছো এত দেরী হল যে?
ভেবেছিল, মৃত্যুদেবতার রূপ ধরে ওকে কোলে তুলে নিয়েছেন ওর সেই প্রাণের ঠাকুর, প্রেমের ঠাকুর—গৌর!