সেবাই ধর্ম

সেবাই ধর্ম

একটা প্রশ্নের মুখে যুগ থমকে দাঁড়িয়েছে। কেন আমারা বেঁচে আছি, কী কারণেই বা বেঁচে থাকব! এই আমরার মধ্যে অসংখ্য আমি ঢুকে আছে। আমির বহুবচন আমরা। এখানে আমিটাই প্রবল। আমার জীবিকা, আমার ভোগ-সুখ, আমার দু:খ, আমার ক্রোধ। আমার আমার করতে-করতে আমরাটা ভুলে বসে আছি।

একা আমি বাঁচতে পারে না। একটা সমাজ চাই। আমরার মধ্যেই আমিকে বাঁচতে হয়, তা না হলে বাঁচা যায় না। পরার্থপর মানুষ আছে বলেই আত্মপর, স্বার্থপর মানুষ বেঁচে আছে। এই যে পরার্থপরতা, এই যে সামাজিক দায়বদ্ধতা, এটা মানুষের সহজাত। এ ভোলা যায় না। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলে, সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বৃত্তি প্রবল হবে, সেটি হল মানুষের বিবেক।

স্বার্থপর মানুষরা বড়লোক হয়, বিষয় সম্পত্তি প্রচুর হয়; কিন্তু সুখী হয় না। একটা অসুস্থতার বোধ তাকে ঘিরে থাকে। যে শুধু ধরতেই শিখেছে, ছাড়তে শেখেনি, সে অসম্পূর্ণ মানুষ। আমরা ভাবি মদ মানেই বোতল। তা নয়, ঐশ্বর্যমদ, ক্ষমতামদ, মদের অনেক রূপ। যে-কোনেও একটাকে ধরলেই মানুষ আর স্বাভাবিক থাকে না। রেশমকীটের মতো নিজের চারপাশে একটা গুটি তৈরি করে ফেলে।

একালের সমস্ত শিক্ষার লক্ষ্যই হল মানুষকে স্বার্থপর করে তোলা। অনেকের কথা ভাববে রাষ্ট্র, তুমি তোমার কথা ভাবো; অর্থাৎ মানুষ তুমি রেসের ঘোড়া হও। তোমার জীবনের উদ্দেশ্যই হল, বাজি জেতা। কেউ তোমার বন্ধু নয়, সবাই তোমার প্রতিযোগী। তুমি তোমার দৌড়পথের দিকে তাকাও, আর কোনওদিকে তোমার তাকাবার প্রয়োজন নেই।

ফল কী হল! ভালোবাসার মৃত্যু। চুক্তির জগৎ তৈরি হল। সংসার হয়ে গেল রণাঙ্গন। দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, হয়ে গেছে কথার কথা। বড়লোকেরাও দান করে, তবে তার মধ্যে একটা মজা আছে। সেই মজাটা হল, ইনকাম ট্যাক্স। টাকাটা সরকারকে না দিয়ে আশ্রমকে দেওয়া হল। কী লাভ হল? নাম। আর কী হল, আশ্রমকে কেনা হল। প্রভুত্বের পরিধি বড় হল। কারণ, শাস্ত্রই বলছেন, কাম্য বস্তু তিনটি—ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ, কাম। মোক্ষটাকে ফেলে দিয়েছি। ধর্মটাকে খুব সহজ করে রেখেছি, একজন নামজাদা গুরু দীক্ষা, জপের মালা, গলায় লকেট, ক্যাসেট ইত্যাদি। অর্থাৎ বাইরের সাজ-পোশাক। ভেতরে প্রবেশ করছে, কী করছে না, দেখার প্রয়োজন নেই।

 ভেতরে ধর্ম ঢুকলে মানুষ প্রেমিক হবে। সকলের সঙ্গে নিজের জীবন ভাগ করতে শিখবে। তার ত্যাগ আর তিতিক্ষা আসবে। দান সম্পর্কে শাস্ত্র বলছেন, বাঁ-হাত জানবে না ডান হাত কী করছে। দাতার চেয়ে গ্রহীতাকে বড় মনে করতে হবে। সেই কারণে অহঙ্কারী বড় মানুষের দান, দান নয় দয়া। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, জীবে দয়া! তুই দয়া করার কে! বল শিবজ্ঞানে জীবসেবা।

স্বামী বিবেকানন্দ সব ছেড়ে গুরুর এই আদেশটিকে বেদবাক্য করেছিলেন। বলেছিলেন ঘণ্টা, মালা, নামাবলি সব জলে ভাসিয়ে দাও। সংঘবদ্ধ হয়ে লড়াই করো। দারিদ্র্যের সঙ্গে অশিক্ষার সঙ্গে, কুসংস্কারের সঙ্গে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। আর বলেছিলেন, ঈশ্বর আছেন, এই বোধই জ্ঞান, বাকি সব অজ্ঞান। আগে এক তারপর যত শূন্য বসাবে ততই ভারী হবে অঙ্ক। একটাকে সরিয়ে নিলে শূন্য শূন্যই। বৌদ্ধরা সেই কারণে প্রথমেই বলেন, সংঘং শরণং গচ্ছামি। সৎকাজে সংঘবদ্ধ হও, তারপরে ধর্ম। কর্ম থেকেই ধর্ম আসে, ধর্মই কর্ম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *