2 of 3

সেতুর ওপরে

সেতুর ওপরে

গড়বন্দীপুরের ছেলেরা আমাকে একটা সাইকেল দিতে চেয়েছিল। কিন্তু রাস্তায় যা জল কাদা। সাইকেল আনলেই বরং বিপদ হত, সে সাইকেল ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে যেতে হত। তারচেয়ে নিজের দুটো পায়ের ওপর ভরসা করাই অনেক বেশি নিরাপদ।

কাদার রাস্তায় হাঁটার অভ্যেস আমার কাছে। সুন্দরবনের চেয়ে বেশি কাদা তো আর কোথাও নেই। সে একেবারে এঁটেল মাটি, কোথাও কোথাও হাঁটু ডুবে যায়। সেই তুলনায় এই রাস্তা এমন কিন্তু ভয়ের নেয়।

পাজামা গুটিয়ে নিয়েছি ঊরু পর্যন্ত, পাঞ্জাবিটি কোমরের কাছে গিঁট দিয়ে নিয়েছি। হাতে একটা লাঠি থাকলে ভালো হত তাল সামলানো যেত, অন্ততপক্ষে একটি ছাতা। বৃষ্টি এখনও পড়ে চলেছে ঝিরিঝিরি সকাল-সন্ধে নেমে আসছে।

বৃষ্টির মধ্যেই পথে মানুষজন প্রায় নেই। তা ছাড়া আজ হাটবার নয়। সন্ধের সময় হাঁটাহাঁটি করার কারই বা গরজ পড়েছে! গড়বন্দীপুরে ওরা আমাকে রাতটা থেকে যাওয়ার জন্য খুব অনুরোধ করছিল। কিন্তু আমার আজ রাতের মধ্যেই মুক্তিপুরে পৌঁছোতে হবে। সেখান থেকে ট্রেন ধরতে হবে খুব ভোরে।

মাঝখানে আছে দ্বৈধা নদী। এমনিতে এলেবেলে ছোট্ট একটা শাখা নদী। জেলার ম্যাপে সুতোর মতন একটা দাগ আছে, দেশের ম্যাপে নামগন্ধও নেই। অন্য সময় হেঁটেই পার হওয়া যায়, কিন্তু বর্ষার কয়েকটা মাস বড় জ্বালাতন করে। এতটুকু নদী, তবু কোনও-কোনও বছরে জল উপছে। বন্যায় দু-দশখানা গ্রাম ভাসায়। নদীটার ভালো নাম ছিল দ্বিধা। সবাই সেটা ভুলে গেছে। এখন দ্বৈধা বলেই ডাকে।

বেলাবেলি ওই দ্বৈধার ব্রিজটা পেরিয়ে যেতে হবে। পুরোনো আমলের কাঠের ব্রিজ, নড়বড় করে, কোথাও-কোথাও তক্তা খুলে গেছে, আচমকা সেখানে পা পড়লে আর রক্ষে নেই। অনেকদিন থেকেই ব্রিজটার এই দশা দেখে আসছি।

আকাশে এখনও একটু-একটু আলোর ইশারা আছে, তার মধ্যে ব্রিজটা পার হয়ে যেতে পারলে হয়। একটু পরেই তো চরাচর একেবারে মিশমিশে অন্ধকারে ডুবে যাবে।

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ব্রিজটা। একবার পেছন ফিরে দেখলুম গড়বন্দীপুরের দিকে আকাশ আবার ঘন কালো, আবার নতুন উৎসাহে ঝড়বৃষ্টি তেড়ে আসবে। লম্বা-লম্বা গাছগুলোর মাথা নুয়ে-নুয়ে পড়ছে।

আমার পাশে-পাশে টোকা মাথায় একজন লোক হাঁটছিল, সে হঠাৎ ডান দিকের মাঠে নেমে গেল। এবারে সামনের দিকে আমাকে একাই যেতে হবে। কাদার মধ্যে যতটা সম্ভব জোরে পা চালালুম।

বৃষ্টির মধ্যে সিগারেট ধরানো যায় না এই একটা অসুবিধে। সিগারেটের বদলে গুনগুন করে গান ধরলে সময়টা তাড়াতাড়ি কেটে যায়।

ব্রিজের কাছাকাছি এসে একটা খ্যাস-খ্যাস শব্দ শুনতে পেলুম যেন। এদিকে কোথাও কাঠ চেরাই কল আছে নাকি? মনে তো পড়ে না। চোখ দুটোকে এবারে সতর্ক করে নিলুম। এবারে সাবধানে মেপে-মেপে পা ফেলতে হবে। এই সন্ধেবেলা আমি পা ফস্কে নদীতে পড়ে সাঁতার দিতে চাই না। দ্বৈধা নদী বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে।

ব্রিজের মাঝামাঝি জায়গা উঁচু হয়ে বসে আছে একটা লোক। খ্যাস-খ্যাস শব্দটা আসছে ওখান থেকেই। কী করছে লোকটা?

কাছে এসে দেখি সে একটা করাত নিয়ে ব্রিজের তক্তা কাটছে মন দিয়ে। আমি যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছি তাতে তার হৃক্ষেপ নেই।

প্রথমে আমার মনে হল, ও বুঝি পি ডবলু ডি-র লোক। সেতু সারাই করতে এসেছে।

ওকে পার হয়ে একটুখানি যাওয়ার পর আমার খটকা লাগল। গভর্নমেন্টের লোকের কাজে এত দরদ? এই দুর্যোগের দিনে সন্ধেবেলা একা-একা কাজ করে যাচ্ছে? কাছাকাছি দেখবার কেউ নেই তবুও? এই সময় তো ওর নিশ্চিন্তে বাড়িতে বসে তেলেভাজা আর মুড়ি খাবার কথা!

তাহলে লোকটা নিশ্চয়ই চোর। কাঠ চুরি করছে। এই সন্ধেবেলা কেউ দেখবার নেই এই তো সুযোগ!

ঝপাং করে একটা শব্দ হল। একটা বড় কাঠের টুকরো পড়ল নদীর জলে; আর কোনও সন্দেহ নেই। লোকটা কাঠ কেটে-কেটে নদীতে ফেলে দিচ্ছে। কাছাকাছি নিশ্চয়ই ওর কোনও স্যাঙাৎ লুকিয়ে আছে, সে ভাসমান কাঠগুলো তুলে নেবে।

আমার মনে এক ধরনের বাষ্প ছড়িয়ে গেল, সেটা তিক্ততা আর বিষণ্ণতার মাঝামাঝি। এরা কি নিজেদের ভালো মন্দ কোনওদিন বুঝবে না? দ্বৈধা নদীর মধ্যে এই একখানি মাত্র সেতু, সামান্য কাঠের লোভে সেটা ওরা নিজেরাই ধ্বংস করছে? এই সরু রাস্তায় শহরের লোক আর কটা আসে, গ্রামের মানুষই তো এটা ব্যবহার করে।

একবার মনে হল, আমার কী দরকার, যা হয় হোক। আমি তো আর এখানকার বাসিন্দা নই! এরা নিজেরাই ফল ভোগ করবে।

তবু থমকে দাঁড়ালুম, আমরা অনেক কিছু দেখে যাই, মনে-মনে সমালোচনা করি, কিন্তু প্রতিবাদ বা সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিই না। এখানে যদি তিন-চারটে চোর এক সঙ্গে থাকত, তাহলে আমার পালানো ছাড়া পথ ছিল না। কিন্তু ওই লোকটা একা, আমিও একা, সুতরাং ওকে আমার ভয় পাওয়ার কী আছে?

ফিরে এসে বললুম, ওহে, তুমি এ কী করছ? আজকাল চোরেরা অনেক বেশি দুঃসাহসী। বাবু শ্রেণির মানুষদের গ্রাহ্যই করে না।

লোকটি মাঝবয়সি, মোটামুটি স্বাস্থ্যবান, মুখ ভরতি দাড়ি। পরনে একটা লুঙ্গি আর খালি গা। আমার কথা শুনে মুখ না তুলে অবহেলার সঙ্গে বলল, দেখতেই তো পাচ্ছ, কাঠ কাটছি?

আমি বললুম, কিন্তু এটা কি কাঠ কাটবার জায়গা? কাঠ কাটতে চাও তো জঙ্গলে যাওনি কেন, এটা ব্রিজ!

লোকটি বলল, তোমার যেমন চক্ষু আছে, আমারও তেমন চক্ষু আছে। আমি জানি এটা একখানা সেতু। একটা বট গাছ নয়কো!

—তা জেনেও তুমি এটাকে কাটছ? এটা ভেঙে পড়বে যে?

—তা জেনেই তো কাটছি, আর দু-খানা খুঁটির জোড় সরাতে পারলেই এটা ভেঙে পড়বে! প্রায় হয়ে এসেছে!

অ্যাঁ, জেনে শুনে তুমি এটার সর্বনাশ করছ? এই বর্ষায় লোক নদী পার হবে কী করে? তোমাদের মতন গ্রামের মানুষরাই তো…

আর একখানা কাঠ শব্দ করে জলে পড়ল, লোকটা এবারে আমার দিকে ফিরে বলল, তোমার বয়স কত? তুমি এই সেতুটি আগে দেখেছ, না নতুন এসেছ?

আমি বললুম, একেবারে নতুন নয়। আগে দু-তিনবার এসেছি!

—আগে যখন দেখেছ, তখন কি এটা টাটকা, মজবুত ছিল?

—না, তা ছিল না বটে!

—মাঝে-মাঝে একখানা দু-খানা তক্তা খসে পড়ে, লোকে বাড়ি নিয়ে যায়। এই সেতু সারাই করার কথা কেউ ভাবে না। সরকার বাহাদুরও ভাবে না। বাপের আমল থেকে যেমন নড়বড়ে দেখেছি, এখনও তাই। কী বলো? এবারে আমি একে একেবারে শেষ করে দিচ্ছি, আর একটু পরে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে!

—কী সর্বনাশ, আমি ঠিক সময়ে এসে পড়েছি! একটু দেরি হলে—

—হ্যাঁ, তুমিই শেষ মানুষ পার হলে!

—তবু এটাতে কাজ চলে যাচ্ছিল, তুমি শেষ করে দিচ্ছ কেন?

—এ কাজ চলছিল বলেই তো গন্ডগোল! কোনও মতে কাজ চলে গেলে কেউ আর নতুনের কথা ভাবে না। এবারে দেখবে, আর কাজ চলবে না, লোকে নতুন চাইবে!

আমি শিউরে উঠলাম এ-লোকটা চোর না দার্শনিক! কিংবা অতিপ্রাকৃত কেউ নয় তো? এই বৃষ্টির মধ্যে সন্ধেবেলা বসে-বসে একটা সেতু ধ্বংস করছে?

আমি জিগ্যেস করলুম, ওহে কর্তা, তুমি কোন গ্রামে থাকো? তোমার বাড়ি কোথায়?

 লোকটি বলল, আমার বাড়ি নেই। থাকি এই কাঠখানা পেরিয়ে যে গ্রাম সেখানে!

—গ্রামে থাক, তোমার বাড়ি নেই মানে? অন্য বাড়িতে কাজ করো?

-না, তা নয়। ঠিক আমার একখানা বাড়ি। এই সেতুটার মতনই লজঝরে। এখানে সেখানে মেরামত করে আর কুলোয় না। একদিক ঢাকি তো আর একদিক দিয়ে জল পড়ে। তাই ভাবলুম, ধুর, এ দিয়ে আর কী হবে? একদিন আগুন দিয়ে বাড়িটা পুড়িয়ে দিলাম!

—নিজের বাড়ি পুড়িয়ে দিলে? আবার নতুন বাড়ি বানাওনি।

–বানাব, বানাব! সরকার বাহাদুর যখন এখানে নতুন ব্রিজ বানাবে, তখন আমিও আমার নতুন বাড়ি বানাব!

আমার আর তাড়াতাড়ি মুক্তিপুরে ফেরার কথা মনে পড়ে না। আমি লোকটির পাশে বসে পড়ে জিগ্যেস করলুম, তা তুমি যে এই মাঝখানটায় বসে খুঁটির জোড়গুলো কাটছ, তো এটা ভেঙে পড়লে তো তুমি এটার সঙ্গে ডুববে!

লোকটি হেসে বলল, না, সে আমার হিসেব আছে। এই দ্যাখো না, এখুনি এই এক দিকটা। ভাঙবে। এটা গড়বন্দীপুরের দিক। তারপর ওদিক খানিকটা সরে গিয়ে আবার বাকিটা সেরে ফেলব। আমার কি ডুবলে চলে, আমাকে দেশে বউ-এর জন্য নতুন বাড়ি বানাতে হবে না?

—তুমি বুঝি এই পুরোনো ব্রিজের কাঠ দিয়ে তোমার নতুন বাড়ি বানাবে?

—আরে রাম-রাম ছি-ছি! এমন কথা ভাবলে! তুমি, বাবুদের বাড়ির ছেলে বলেই এইসব কথা তোমাদের মনে আসে। এই কাঠের আর আছে কী? এত পচে গেছে! তা ছাড়া, আমাদের গ্রামে সবার মাটি-বাঁশের বাড়ি, সেখানে কি আমি কাঠের বাড়ি হাঁকতে পারি? আমার নতুন বাড়িও ওই মাটি বাঁশেরই হবে! তবে টাইম লাগবে!

—এ দ্যাখো, কারা যেন আসছে!

গড়বন্দীপুরের দিক থেকে কারা যেন আসছে ব্রিজের ওপর। দুটি ছায়ামূর্তি। মাথায় কীসের যেন বোঝ।

লোকটি ভয় পেয়ে বলল, আরে-আরে, ওরা মারা পড়বে যে। এই রোখো-রোখো এদিকে আর এসোনা!

ছায়ামূর্তি দুটি থামল না, এগোতেই লাগল।

আমার পাশের লোকটি করাত সরিয়ে রেখে একটা কাঠ প্রাণপণে চেপে ধরল। আমাকে বলল, ও বাবু, তুমি পাশের খুঁটিটা ধরো। ওরা পা দিলেই ভেঙে পড়বে সব। ছায়ামূর্তি দুটি কাছে এল একজন নারী ও পুরুষ, তাদের কাঁধে ও মাথায় কয়েকটা পোঁটলা-পুটলি। আমাদের ওইরকম অবস্থায় দেখে তারা থমকে দাঁড়াল।

ব্রিজ ধ্বংসকারী লোকটি বলল, তোমরা পার হতে পারবে না। এই সেতু ভেঙে পড়ছে। খুব বিপদ, তোমরা ফিরে যাও।

যুবতী মেয়েটি কান্না-কান্না গলায় বলল, ওগো আমাদের যে যেতেই হবে!

—না পারবে না; এই সেতু পার হতে পারবে না।

যুবতীর সঙ্গের পুরুষটি বলল, ওগো, আমাদের যে আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই।

—কেন, ফেরবার উপায় নেই কেন? যে গ্রাম থেকে এসেছ, আজ রাত্তিরটার মতন সেখানে ফিরে যাও।

পুরুষটি বলল, না গো, সে উপায় থাকলে কি আর বলি। মহাজন আমাদের সর্বস্বান্ত করেছে। আমাদের ঘর-বাড়ি সব গেছে। একটুকরো জমি ছিল, তাও বেচে দিয়েছি!

—তাহলে এদিকে কোথায় যাবে? এদিকে কি তোমাদের কোনও ভরসা আছে?

—দেখি মুক্তিপুরে কোনও ঠাঁই মেলে কি না!

যুবতীটি বলল, পুরোনো জায়গা ছেড়ে এসেছি, ওখানে আর যাব না। এদিকে গিয়ে দেখি কী হয়। দুজনে মিলে খাটব, আবার ঘর বানাব! ওগো, আমাদের যেতে দাও। ব্রিজ ধ্বংসকারী এবারে শুয়ে পড়ে অনেকগুলি কাঠের মুখ বুকে চেপে ধরল। তারপর বলল, যাও তবে সাবধানে যাও! আমার পিটের ওপর পা দিতে পারো, তাতে কিছু হবে না! শিগগির চলে যাও, বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারব না!

নারী ও পুরুষটি তাকে ডিঙিয়ে তড়িঘড়ি চলে গেল। তারপর করাতওয়ালা লোকটি উঠে পড়তেই গড়বন্দীপুরের ব্রিজের অংশটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল একসঙ্গে।

আমি এবার তাকে জিগ্যেস করলুম, এই যে তুমি কাণ্ডটি করলে এর পর হয়তো গ্রামের লোক মহা অসুবিধেয় পড়বে তুমি জানো। কেউ আর পার হতে পারবে না। তবু তুমি এত কষ্ট করে এই মেয়েটাকে আর লোকটাকে পার হতে দিলে কেন? ব্রিজ ধ্বংসকারী তার দাড়িওয়ালা মুখখানা। আমার দিকে ঘুরিয়ে এক গাল হেসে বলল, ওরা যে নতুন জায়গায় যাবে, নতুন করে ঘর বাঁধবে ওদের কথা আলাদা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *