আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে , দৈবে হতেম দশম রত্ন নবরত্নের মালে , একটি শ্লোকে স্তুতি গেয়ে রাজার কাছে নিতাম চেয়ে উজ্জয়িনীর বিজন প্রান্তে কানন - ঘেরা বাড়ি । রেবার তটে চাঁপার তলে সভা বসত সন্ধ্যা হলে , ক্রীড়াশৈলে আপন - মনে দিতাম কণ্ঠ ছাড়ি । জীবনতরী বহে যেত মন্দাক্রান্তা তালে , আমি যদি জন্ম নিতাম কালিদাসের কালে । ২ চিন্তা দিতেম জলাঞ্জলি , থাকত নাকো ত্বরা— মৃদুপদে যেতেম , যেন নাইকো মৃত্যু জরা । ছটা ঋতু পূর্ণ করে ঘটত মিলন স্তরে স্তরে , ছটা সর্গে বার্তা তাহার রইত কাব্যে গাঁথা । বিচ্ছেদও সুদীর্ঘ হত , অশ্রুজলের নদীর মতো মন্দগতি চলত রচি দীর্ঘ করুণ গাথা । আষাঢ় মাসে মেঘের মতন মন্থরতায় ভরা জীবনটাতে থাকত নাকো কিছুমাত্র ত্বরা । ৩ অশোক - কুঞ্জ উঠত ফুটে প্রিয়ার পদাঘাতে , বকুল হত ফুল্ল প্রিয়ার মুখের মদিরাতে । প্রিয়সখীর নামগুলি সব ছন্দ ভরি করিত রব , রেবার কুলে কলহংসের কলধ্বনির মতো । কোনো নামটি মন্দালিকা , কোনো নামটি চিত্রলিখা , মঞ্জুলিকা মঞ্জরিণী ঝংকারিত কত ! আসত তারা কুঞ্জবনে চৈত্র - জ্যোৎস্না - রাতে , অশোক - শাখা উঠত ফুটে প্রিয়ার পদাঘাতে । ৪ কুরবকের পরত চূড়া কালো কেশের মাঝে , লীলাকমল রইত হাতে কী জানি কোন্ কাজে ! অলক সাজত কুন্দফুলে , শিরীষ পরত কর্ণমূলে , মেখলাতে দুলিয়ে দিত নবনীপের মালা । ধারাযন্ত্রে স্নানের শেষে ধূপের ধোঁয়া দিত কেশে , লোধ্রফুলের শুভ্র রেণু মাখত মুখে বালা । কালাগুরুর গুরু গন্ধ লেগে থাকত সাজে , কুরবকের পরত মালা কালো কেশের মাঝে । ৫ কুঙ্কুমেরই পত্রলেখায় বক্ষ রইত ঢাকা , আঁচলখানির প্রান্তটিতে হংসমিথুন আঁকা । বিরহেতে আষাঢ় মাসে চেয়ে রইত বঁধুর আশে , একটি করে পূজার পুষ্পে দিন গনিত ব'সে । বক্ষে তুলে বীণাখানি গান গাহিতে ভুলত বাণী , রুক্ষ অলক অশ্রুচোখে পড়ত খসে খসে । মিলন - রাতে বাজত পায়ে নূপুর - দুটি বাঁকা , কুঙ্কুমেরই পত্রলেখায় বক্ষ রইত ঢাকা । ৬ প্রিয় নামটি শিখিয়ে দিত সাধের শারিকারে , নাচিয়ে দিত ময়ূরটিরে কঙ্কণঝংকারে । কপোতটিরে লয়ে বুকে সোহাগ করত মুখে মুখে , সারসীরে খাইয়ে দিত পদ্মকোরক বহি । অলক নেড়ে দুলিয়ে বেণী কথা কইত শৌরসেনী , বলত সখীর গলা ধরে— ‘ হলা পিয় সহি' । জল সেচিত আলবালে তরুণ সহকারে , প্রিয় নামটি শিখিয়ে দিত সাধের শারিকারে । ৭ নবরত্নের সভার মাঝে রইতাম একটি টেরে , দূর হইতে গড় করিতাম দিঙ্নাগাচার্যেরে । আশা করি নামটা হত ওরই মধ্যে ভদ্রমত— বিশ্বসেন কি দেবদত্ত কিম্বা বসুভূতি । স্রগ্ধরা কি মালিনীতে বিম্বাধরের স্তুতিগীতে দিতাম রচি দুটি - চারটি ছোটোখাটো পুঁথি । ঘরে যেতাম তাড়াতাড়ি শ্লোক - রচনা সেরে , নবরত্নের সভার মাঝে রইতাম একটি টেরে । ৮ আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে বন্দী হতেম না জানি কোন্ মালবিকার জালে । কোন্ বসন্ত - মহোৎসবে বেণুবীণার কলরবে মঞ্জরিত কুঞ্জবনের গোপন অন্তরালে কোন্ ফাগুনের শুক্লনিশায় যৌবনেরই নবীন নেশায় চকিতে কার দেখা পেতেম রাজার চিত্রশালে ! ছল করে তার বাধত আঁচল সহকারের ডালে আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে । ৯ হায় রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল ! পণ্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ - সাল । হারিয়ে গেছে সে - সব অব্দ , ইতিবৃত্ত আছে স্তব্ধ— গেছে যদি আপদ গেছে , মিথ্যা কোলাহল । হায় রে গেল সঙ্গে তারি সেদিনের সেই পৌরনারী নিপুণিকা চতুরিকা মালবিকার দল । কোন্ স্বর্গে নিয়ে গেল বরমাল্যের থাল ! হায় রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল ! ১০ যাদের সঙ্গ হয় নি মিলন সে - সব বরাঙ্গনা বিচ্ছেদেরই দুঃখে আমায় করছে অন্যমনা । তবু মনে প্রবোধ আছে— তেমনি বকুল ফোটে গাছে যদিও সে পায় না নারীর মুখমদের ছিটা , ফাগুন - মাসে অশোক - ছায়ে অলস প্রাণে শিথিল গায়ে দখিন হতে বাতাসটুকু তেমনি লাগে মিঠা । অনেক দিকেই যায় যে পাওয়া অনেকটা সান্ত্বনা , যদিও রে নাইকো কোথাও সে - সব বরাঙ্গনা । ১১ এখন যাঁরা আছেন বর্তমানে আছেন মর্তলোকে মন্দ তারা লাগত না কেউ কালিদাসের চোখে । পরেন বটে জুতা মোজা , চলেন বটে সোজা সোজা , বলেন বটে কথাবার্তা অন্য - দেশীর চালে , তবু দেখো সেই কটাক্ষ আঁখির কোণে দিচ্ছে সাক্ষ্য যেমনটি ঠিক দেখা যেত কালিদাসের কালে । মরব না ভাই , নিপুণিকা চতুরিকার শোকে— তাঁরা সবাই অন্য নামে আছেন মর্তলোকে । ১২ আপাতত এই আনন্দে গর্বে বেড়াই নেচে— কালিদাস তো নামেই আছেন , আমি আছি বেঁচে । তাঁহার কালের স্বাদগন্ধ আমি তো পাই মৃদুমন্দ , আমার কালের কণামাত্র পান নি মহাকবি । বিদুষী এই আছেন যিনি আমার কালের বিনোদিনী মহাকবির কল্পনাতে ছিল না তাঁর ছবি । প্রিয়ে , তোমায় তরুণ আঁখির প্রসাদ যেচে যেচে কালিদাসকে হারিয়ে দিয়ে গর্বে বেড়াই নেচে ।