1 of 2

সেকালের সাকার্স

সেকালের সার্কাস 

এক মহাপুরুষকে অবলম্বন করে ‘কলকাতার সার্কাস’ প্রসঙ্গ আরম্ভ করছি। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের পনেরো তারিখ। বেলা তিনটার সময় একখানা ছ্যাকরা গাড়ি শ্যামপুকুর বিদ্যাসাগর স্কুলের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ির মধ্যে আছেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও তাঁর কয়েকজন ভক্ত। স্কুলের প্রধানশিক্ষক ‘ ম’ এসে গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি চিৎপুর রোড ধরে গড়ের মাঠের দিকে চলল। ঠাকুর আজ উইলসন-এর সার্কাস দেখতে যাচ্ছেন। 

গড়ের মাঠে গিয়ে টিকিট কেনা হল। আট আনা দামের শেষ শ্রেণীর টিকিট। ভক্তেরা ঠাকুরকে নিয়ে গিয়ে গ্যালারির উপরের এক সিটে বসালেন। ঠাকুর আনন্দে বললেন, ‘বাঃ এখান থেকে বেশ দেখা যাচ্ছে।’ 

ঠাকুর নানারকম খেলা দেখতে লাগলেন। একটা খেলা ঠাকুরকে খুব আকৃষ্ট করল। সার্কাসের গোলাকার রাস্তায় একটা ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। ঘোড়ার পিঠে এক বিবি এক পায়ে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে সামনের বড় বড় লোহার রিং বা বেড়। রিং-এর কাছে এসে ঘোড়া যখন রিং-এর নিচে দিয়ে দৌড়াচ্ছে, বিবি তখন ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে রিং-এর ভেতর দিয়ে পুনরায় ঘোড়ার পিঠে আবার এক পায়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঘোড়া পুনঃ পুনঃ বন্ বন্ করে ওই গোলাকার পথে দৌড়াচ্ছে, এবং বিবি পুনরায় ওইরকম ভাবে রিং- এর ভেতর দিয়ে লাফিয়ে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে এক পায়ে দাঁড়াচ্ছে। 

সার্কাস দেখে ফেরবার পথে ঠকুর ম-কে বলছেন, “দেখলে বিবি কেমন এক পায়ে ঘোড়ার উপর দাঁড়িয়ে আছে, আর ঘোড়া বন্ বন্ করে দৌড়াচ্ছে। কত কঠিন, অনেকদিন ধরে অভ্যাস করেছে তবে তো হয়েছে। একটু অসাবধান হলে হাত-পা ভেঙে যাবে। আবার মৃত্যুও হতে পারে। সংসার করাও এরূপ কঠিন। অনেক সাধন-ভজন দরকার।’ 

তখনকার দিনে শীতকালে কোন না কোন একটা সাহেব দল এসে গড়ের মাঠে তাঁবু ফেলে সার্কাস দেখাত। ১৯১৩ সাল পর্যন্ত এ রকমই চলেছিল। তারপর ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর, সাহেব দল আর সার্কাস দেখাতে আসেনি। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আবার এল। এবার এল এক ইটালিয়ান সার্কাস। নাম ‘রয়েল ইটালিয়ান সার্কাস।’ ওই সার্কাসে দেখেছি এক অদ্ভুত খেলা। একেবারে গোড়ার দিকেই দেখানো হত ওই খেলাটা। 

দেখি, সার্কাসের রিং-এর মধ্যে বসানো আছে একখানা টেবিল, একখানা চেয়ার, আর পাশে একটা আলনা। বসে ভাবছি, এই সরঞ্জাম দিয়ে কি খেলা দেখানো হবে। এমন সময় রিং-এর মধ্যে প্রবেশ করল এক শিম্পাঞ্জি, পুরো ইউরোপীয়ান বেশে, যেন কোন অফিসের বড় সাহেব। হাতে একটা বন্দুক। দর্শকদের মাথা নত করে অভিবাদন জানাল। তারপর বন্দুকটা রাখল টেবিলের ওপর। মাথার টুপিটা রাখল আলনার গায়ে হুকে। গায়ের কোটটা খুলে ফেলে আনলায় রাখল। গায়ে রইল শার্ট ও ওয়েস্ট কোট। ওয়েস্ট কোটের পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে টাইমটা দেখে নিল। ওর সঙ্গে সঙ্গেই রিং-এর মধ্যে প্রবেশ করল এক মেমসাহেব। মেম সাহেবের মাথায় ঠিক কপালের উপর পরিয়ে দিল একটা তারের বেড়, ঠিক টায়রার মত করে। ওই তারের বেড়-এর ওপর এক ইঞ্চি ব্যাস সাইজের খড়ি দিয়ে তৈরি দশটা চাকা লাগানো আছে। তাতে এক থেকে দশ নম্বর ইংরেজি হরফে লেখা 

রিং মাস্টার বলল, ‘নম্বর ফাইভ’। শিম্পাঞ্জি বন্দুকটা নিয়ে ঠিক লক্ষ্য করে বন্দুক ছুড়ে পাঁচ নম্বর চাকতি খসিয়ে দিল। তারপর বলল ‘নম্বর টু’। দু-নম্বর চাকাটা গেল। এইভাবে রিংমাস্টারের নির্দেশ অনুযায়ী দশটা চাকাই কপালের বেড়’-এর ওপর থেকে খসিয়ে দিল। দর্শকরা হাততালি দিতে লাগল। শিম্পাঞ্জিটা তারপর আবার নিজের কোটটা গায়ে দিল; এবং টুপিটা হাতে করে দর্শকদের নমস্কার করে চলে গেল। আমরা রুদ্ধশ্বাসে খেলাটা দেখছিলাম। প্রতি মুহূর্তেই আমাদের ভয় হচ্ছিল, যদি শিম্পাঞ্জিটার ভুল হয়, তাহলে মেয়েটার কপালে গিয়ে বন্দুকের গুলিটা বিদ্ধ হবে। 

তবে লড়াইয়ের সময় গড়ের মাঠে তাঁবু ফেলা নিষিদ্ধ হলেও সার্কাস দেখা থেকে আমরা একেবারে বঞ্চিত হইনি। বরং আমাদের শ্যামবাজার পল্লীর লোকদের সার্কাস দেখার কিছু সুবিধাই হয়েছিল। কেননা, ওই সময় ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের পূর্বদিকে শ্যামবাজর ব্রিজ রোড (এখন আর. জি. কর রোড) প্রসারিত করা ও ওর দক্ষিণে রাজা দীনেন্দ্র ষ্টীট ও দেশবন্ধু পার্কটা তৈরি করবার পরিকল্পনা করে। সেজন্য বসতবাড়িগুলোকে ভূমিসাৎ করে ওই অঞ্চলটাকে মাঠ করে দিয়েছিল। সেখানেই ‘ছাত্রেস্ সাকার্স’ এসে তাঁবু ফেলল। যদিওঁ দেশী সার্কাস, তা হলেও ওই সার্কাসে মিস্ লুরেটা নামে একটি মেয়ে এক অদ্ভুত খেলা দেখাত। একটা টাঙানো তারের ওপর দিয়ে একখানা সাইকেলে করে, সে তারের একদিক থেকে অপরদিকে পুনঃ পুনঃ যাতায়াত করত। এবং মাঝে মাঝে তার থেকে লাফিয়ে পড়ে আবার তারের ওপর ফিরে আসত। খেলাটা খুবই আকর্ষণীয় ছিল। 

এইবার ছাত্রেস্ সার্কাসের এক ঘটনার কথা বলি। ঘটনাটা আমি ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত আমার ‘কালের কড়চা’ বইয়ে বিবৃত করেছি। ওই বইয়ের একখানা কপি সত্যজিৎ রায়কে উপহার দিয়েছিলাম। কয়েক বছর পরে দেখি ওই ঘটনার ছায়া পড়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘ছিন্নমস্তার মন্দির’ গল্পের ওপর। সেই ঘটনাটা আমি আমার ‘কালের কড়চা’ বই থেকে উদ্ধৃত করছি। ‘একবার সার্কাসে বাঘের খেলা দেখাবার জন্য সার্কাসের লোকরা বাঘটাকে আনতে গিয়ে দেখে যে, বাঘটা তার খাঁচার মধ্যে নেই। খাঁচার দরজা খোলা। এই খবর রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া মাত্র দর্শকদের মধ্যে ভীষণ প্যানিক-এর সৃষ্টি হল। সবাই সার্কাসের তাঁবু ছেড়ে বাড়ির দিকে ছুটল। আশপাশের লোকেরা বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল, যদি বাঘটা ঢুকে তাদের ঘাড় মটকে দেয়। এদিকে সার্কাসের লোকেরা চতুর্দিকে বাঘ খুঁজতে বেরুল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুসন্ধান চলল। কিন্তু কোথাও বাঘটা নজরে পড়ল না। সেদিন, শ্যামবাজার পল্লীতে এক ত্রাসের সঞ্চার হল। রাত্রে নিশ্চিন্ত মনে কেউই ঘুমুতে পারল না। সকলেরই এক ভাবনা, যদি বাঘটা দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। পরের দিন সকালে বাঘটাকে পাওয়া গেল, সার্কাসের পাশেই এক হাঁড়ি- কলসির দোকানে, কয়েকটা বড় জালার আড়ালে। সার্কাসের লোক এসে কান ধরে বাঘটাকে নিয়ে গেল।’ (কালের কড়চা, পৃষ্ঠা ২৩-২৪)। 

পরের বছর ওই জায়গায় এসে তাঁবু ফেলল ‘আগাসী সার্কাস’। আগাসী সার্কাসের ছিল দুই আকর্ষণ, ‘ভীম ভবানী’ ও নারান সুরের ‘ব্ল্যাক বকস্’। ভীম ভবানীর মত শক্তির পরিচয় এদেশে খুব কম লোক দিয়েছে। ওঁর আসল নাম ভবেন্দ্রমোহন সাহা। ভীম ভবানী’ নামটা দিয়েছিল নাট্যাচার্য অমৃতলাল বসু। উত্তর ভারতের লোক ওঁকে বলত ‘ভীমমূর্তি’। উনি যেসব খেলা দেখাতেন তার মধ্যে ছিল দু’হাতে দু’টো চলন্ত মোটরগাড়ি ধরে অচল করে রাখা; সিমেন্টের পিপের ওপর পাঁচ-সাতজন লোককে বসিয়ে দাঁতের সাহায্যে শূন্যে ঘোরানো; বুকের উপর ৪০ মণ পাথর চাপিয়ে তার ওপর কুড়ি-পঁচিশজন দর্শককে খাম্বাজ খেয়াল গান করবার অবসর দেওয়া; বুকের ওপর দিয়ে হাতি চালানো ইত্যাদি। একবার ভরতপুরের মহারাজার অনুরোধে তিনটে চলন্ত মোটর গাড়িও উনি রুখে দিয়েছিলেন। 

নারান সুরের খেলাটা ছিল, একটা কালো রঙের বাক্স। রিং-এর মধ্যে এনে দর্শকদের দিয়ে সেটা পরীক্ষা করে, তার হাতে হাতকড়া লাগানো। তারপর তার সমস্ত দেহটা দড়ি দিয়ে আষ্টে-পিষ্টে বেঁধে, তাকে দর্শকরা বাক্সের মধ্যে পুরে দিত, এবং বাক্সটায় চাবি তালা লাগিয়ে দিত। কিন্তু তালা-চাবি লাগানো মাত্রই, উনি রিং-এর অপর প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে দর্শকদের অভিবাদন জানাতেন। 

দেশী সার্কাসের জন্ম হয় উনিশ শতকের শেষে যখন প্রিয়নাথ বসু একটা সার্কাস দল গঠন করে। সার্কাসের নাম ছিল ‘বোসেস্ সার্কাস’। এই সার্কাসের দলেই প্রথম এক বাঙালি মেয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে। নাম সুশীলাসুন্দরী। বাঘের মুখ হাঁ করিয়ে তার মধ্যে নিজের মাথাটা ঢুকিয়ে দিত। তার এই খেলায় ইংলিশম্যান’ পত্রিকা মুখর হত। একদিন ‘ফরচুন’ নামে এক নতুন বাঘের সঙ্গে খেলা করতে গিয়ে সে জখম হয়ে চিরকালের মত পঙ্গু হয়ে যায়। তাতেই পরে তার মৃত্যু ঘটে। প্রিয়নাথ বসুর সার্কাসের আর এক আকর্ষণ ছিল গণপতি চক্রবর্তীর ইলিউশন বক্স’, ইলিউশন ট্রী’ ও ‘কংস কারাগার’। লোকের ধারণা ছিল তিনি ‘ভৌতিক ক্ষমতা-সিদ্ধ’। মতান্তর হওয়ায় গণপতি পরে নিজেই এক সার্কাসদল গানে করেছিল, এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় খেলা দেখিয়ে সুনাম অর্জন করেছিল। 

‘বোসেস্ সার্কাস’-এ পরে হিঙ্গনবালা নামে আর একটি মেয়ে বাঘের খেলা দেখাত। তারপর থেকে বাঙালি মেয়েরা সার্কাস জগতে নিজেদের প্রতিভার অনেক ছাপ রেখে গেছে। আমি যে মেয়েটির খেলা শেষ দেখেছি, সে মেয়েটি আমার পাড়ার মেয়ে, নারান সুরের ভাগ্নী। ওর ট্রাপিজের খেলা ছিল এক রোমহর্ষণ ব্যাপার। মেয়েটি পরে সার্কাসের মালিককেই বিয়ে করেছিল। 

সার্কাসে বাঙালি যে এ দেশেই নাম করেছিল, তা নয়। বিদেশেও। তার মধ্যে ছিল সুরেশ বিশ্বাস। বাবার সঙ্গে বিরোধ ঘটায়, বিদেশে পালিয়ে গিয়ে জার্মানিতে ‘গাজেন বাক’, ‘জোগ কারল’ প্রভৃতি সার্কাসদলে যোগ দিয়ে হিংস্র জন্তুর খেলার একজন দক্ষশিল্পী হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এক জার্মান সার্কাসের নারীঘটিত ব্যাপারে, তাঁকে জার্মানি ত্যাগ করতে হয়। আমেরিকায় গিয়ে ‘উইলস’-এর সার্কাসে যোগ দেন। পরে ব্রেজিলে গিয়ে চিড়িয়াখানার রক্ষক নিযুক্ত হন। তারপর চিকিৎসাশাস্ত্রে পারঙ্গম হয়ে, শল্য চিকিৎসক হিসাবে সুনাম অর্জন করেন। ব্রেজিলের নীথরয় শহরে ব্রেজিল সৈন্যবাহিনীর বিদ্রোহ মাত্র ৫০ জন সৈন্য নিয়ে দমন করে ‘কর্ণেল’ উপাধি পান। ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে ব্রেজিলেই তাঁর মৃত্যু হয়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *