সেকালের শিবরাত্রি
আমার জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত, এই সময়কালের মধ্যে তিন-চার পুরুষের ব্যবধান ঘটেছে। এই ব্যবধানের অন্তরালে বাঙালির লৌকিক জীবনে ঘটে গিয়েছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। সেজন্য আমার ছেলেবেলার, তার মানে শতাব্দীর মুখপাতের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, পাল-পরব, আমোদ-প্রমোদ বর্তমান প্রজন্মের লোকের কাছে বিচিত্র ঠেকবে। যেমন তখনকার দিনে দোকান থেকে কিছু জিনিসপত্তর কিনলে, দোকানদার একটা ফর্দ দিতো। তাতে জিনিসের নাম পরিমাণ ও মূল্য লেখা থাকতো। আর সকলের তলায় লেখা থাকতো বৃত্তির পরিমাণ। প্রতি ক্রেতাকেই বৃত্তি দিতে হতো, ক্রীত মালের মোট পরিমাণের ওপর প্রতি টাকায় এক পয়সা হারে। এক বছরের জমানো বৃত্তির টাকাতেই সেকালে ব্যবসায়ীরা বারোয়ারি পূজা করতো। এভাবেই হতো চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজা ও কলকাতার কোন কোন বাজারে শিবরাত্রি পূজা।
আমার জন্ম কলকাতার শ্যামবাজারে। সেকালে উত্তর কলকাতায় শ্যামবাজারের বাজারের মত বাজার আর দ্বিতীয় ছিল না। সুতরাং শ্যামবাজারের দোকানদারদের ঘরে বিপুল পরিমাণ বৃত্তির টাকা জমতো। সেই টাকায় খুব ঘটা করে শ্যামবাজারের বাজারে শিবরাত্রি পূজা-উৎসব হতো। একতলা সমান উঁচু একটা প্রতিমা আসতো। বাজারের ব্যবসায়ীদের মধ্যে এসময় প্রকাশ পেত প্রচণ্ড উৎসাহ ও উত্তেজনা। তিন-চার দিন উৎসবের এই উৎসাহ ও উত্তজনার মধ্যেই তারা মেতে থাকতো। উদ্যম, উৎসাহ ও উত্তেজনা চরমে উঠত রাত্রিকালে। কেননা, প্রতিদিন রাত্রিকালে হতো যাত্রাভিনয়। ছেলেবেলায় এই যাত্রাভিনয় দেখবার জন্য আমরা বাজারে গিয়ে জমা হতাম। ভীষণ ভীড় হতো। ওই ভীড়ের মধ্যেই সুবিধামত একটা স্থান করে নিতাম। সমস্ত রাত্রি জেগে যাত্রাভিনয় দেখতাম। তবে বেশ মজা লাগতো যেদিন উড়ে যাত্রা’ হতো। সেকালের আমোদ-প্রমোদ ও বিনোদনের ক্ষেত্রে, ‘অবশ্য’ অঙ্গ হিসাবে ‘উড়ে যাত্রা’র একটা স্থান ছিল। ‘উড়ে যাত্রা’ হচ্ছে ওড়িশাবাসীদের দ্বারা অভিনীত যাত্রাভিনয়। উড়ে যাত্রার সঙ্গে বাঙালি যাত্রার অনেক প্রভেদ ছিল—যদিও এ দু’রকম যাত্রার অভিনয়ই মেঝের ওপর পাতা আসরের ওপর এ দুরকম যাত্রাতেই পুরুষরা মেয়ে সেজে অভিনয় করতো। উড়ে যাত্রার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নানা রকম বর্ণাঢ্য পোশাক পড়তো। অবশ্য বাংলা যাত্রাতেও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নানা রকম বর্ণাঢ্য পোশাক করতো, কিন্তু আলোর ঝলমলানিতে উড়ে যাত্রার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছে তা হার মানতো। সবচেয়ে বেশি মজা লাগতো ওড়িয়া ভাষায় কথোপকথন ও গান—যদিও উড়ে যাত্রায় গানের প্রাধান্য বাংলা যাত্রার মত হ’ত না।
কোথাও কোথাও আবার তিনদিনের যাত্রাভিনয়ের সঙ্গে পুতুল-নাচও হতো। যাত্রাভিনয়ে যেমন সজীব মানুষরা অভিনয় করতো পুতুল-নাচে অভিনয় করতো নির্জীব কাঠের পুতুল। কিন্তু নির্জীব হলে কি হবে। প্রতি পুতুলের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে নেমে আসত ঝুলানো দড়ি, আর সামনে মানুষ-প্রমাণ পর্দার আড়ালের পিছন থেকে প্রতি পুতুল-ধারী মানুষ ওই দড়ির সাহায্যে কাঠের পুতুলগুলোর অঙ্গচালনায় একটা সজীবতা দিতো। তবে পুতুল-নাচের নায়ক-নায়িকারা কথা বলতো না। অভিনয়টা অনেকটা নির্বাক যুগের সিনেমার মতো হ’ত। সামনের পর্দার আড়ালের পিছন থেকে যারা দড়ির সাহায্যে এই অভিনয় দেখাতো, তারা যথেষ্ট কলা-কৌশলী শিল্পী ছিল। সেকালের তরজার লড়াই, কবির গান ইত্যাদির মত, উড়ের যাত্রা ও পুতুল নাচও আজকের শহরের বিনোদন ক্ষেত্র থেকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে।
এবার শিবরাত্রি উপলক্ষে বারোয়ারী পূজা-উৎসব থেকে, জনসমাজে প্রচলিত শিবরাত্রি ব্রত পালনের কথায় আসছি। হিন্দুদের পালপার্বণগুলো চান্দ্র মাসের তিথি অনুযায়ী পালিত হয়। কিন্তু মুখ্য চান্দ্রমাস অনেক সময়েই পরবর্তী সৌরমাস পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। যেমন ঘটেছে এ বৎসর। সেজন্য শিবরাত্রি যদিও মুখ্য মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে পালনীয় ব্রত, তা হলেও এবার মুখ্য চান্দ্র মাঘ মাস সৌর ফাল্গুন মাস পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে বলে, শিবরাত্রি ফাল্গুন মাসেই পড়েছে।
হিন্দুদের যে সকল পূজাপার্বণে পুরোহিতের কোন মুখ্য ভূমিকা নেই সেগুলো অধিকাংশই আদিম অনার্য যুগ থেকে পালিত হয়ে এসেছে। শিবরাত্রিও তাই। শিব এমনি তো অনার্য দেবতা, সুতরাং শিবের উৎসব হিসাবে শিবরাত্রি আদিম অনার্য যুগের উৎসব। এটা শিবরাত্রি ব্রত পালন সম্পর্কে যে কাহিনী প্রচলিত আছে, সেটা বিশ্লেষণ করলেই পরিষ্কার বুঝতে পারা যাবে। কাহিনীটা আমি এখানে বিবৃত করছি। একদিন পার্বতী শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কিসে সবচেয়ে বেশি তুষ্ট হও?’ শিব বললেন, শিবরাত্রির দিন যদি কেউ উপবাস করে আমার মাথায় জল দেয়, তা হলে আমি খুব তুষ্ট হই।’ তখন মহাদেব পার্বতীকে একটা কাহিনী বলেন। বারানসীতে এক ব্যাধ ছিল। একদিন সে বহু পশু শিকার করে এবং তার ফিরতে রাত্রি হয়ে যায়। বাঘ-ভাল্লুকের ভয়ে সে এক গাছের উপরে আশ্রয় নেয়। ওই গাছের তলাতেই এক শিবলিঙ্গ ছিল। রাত্রিতে ব্যাধ যখন ঘুমোচ্ছিল, তখন তার এক ফোঁটা ঘাম (মতান্তরে নীহারকণা) মহাদেবের মাথায় পড়ে। সেদিন শিবরাত্রির দিন ছিল এবং ব্যাধও সারাদিন উপবাসী ছিল। মহাদেব তার ওই এক ফোঁটা ঘামেই তুষ্ট হন। যথাসময়ে যখন ব্যাধের মৃত্যু হয়, যমদূত এসে তাকে নরকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু শিবদূত তাকে বাধা দিয়ে তাকে শিবলোকে নিয়ে যায়। এইভাবে শিবরাত্রি ব্রতের প্রচলন হয়। এই কাহিনীটাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এই কাহিনীটা এমন এক যুগের যে যুগের মানুষের সাধারণ বৃত্তি ছিল পশুশিকার করা। সেটা প্রস্তর যুগের ব্যাপার।
সে যাই হোক শিবরাত্রিটা হচ্ছে একটা খুব জনপ্রিয় ব্রত-উৎসব, বিশেষ করে বাঙলাদেশে। বাঙলাদেশে এর জনপ্রিয়তার কারণ, বাঙলা শিবের দেশ। কেননা বাঙলাদেশে যত শিবমন্দির দেখা যায়, আর ভারতের কোথাও তত নয়।
শিবরাত্রি এক পঞ্চাঙ্গ ব্রতপালন। কেননা, এই ব্রত পালনের ‘অবশ্য— অঙ্গ হচ্ছে— উপবাস, গঙ্গাস্নান, নিশিজাগরণ, ব্রতকথা শ্রবণ ও পারণ।
আগেকার দিনে শিবরাত্রি ব্রতপালন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করা হতো। আজকাল এটা একটা হুজুগে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে অল্প বয়স্কা মেয়েদের কাছে। উপবাস করতেই হয়, কিন্তু মনে হয় আজকালকার মেয়েরা উপবাসের চেয়ে দলবেঁধে সাড়ম্বরে গঙ্গাস্নানে যাওয়াটার ওপরই বেশি জোর দেয়। এই ব্রতপালনে নিশিজাগরণ অবশ্য করণীয়, তবে পরদিন দিবানিদ্রা নিষিদ্ধ। উপবাসান্তে পরদিন প্রাতে শিবের মাথায় জল ঢালা হয়। এরপর ব্রতকথা শুনে উপবাস ভঙ্গ করা হয়। এটাকেই ‘পারণ’ বলা হয়।
বলা হয় শিবরাত্রি ব্রতপালন উপলক্ষে গঙ্গাস্নানে বহুশত সূর্যগ্রহণকালীন গঙ্গাস্নানের সমান ফল পাওয়া যায়। নিষ্ঠাবান লোকেরা গঙ্গাস্নানের সময় একটা মন্ত্রও পাঠ করে। মন্ত্রটা হচ্ছে—‘করতোয়া সদানীরে সরিচ্ছেষ্ঠে সুবিশ্রুতে পৌণ্ড্রান প্লাবয়সে নিতং পাপঃ হর করোদ্ভবে।’
শিবরাত্রি উপলক্ষে অনেক জায়গায় মেলা বসে। কলকাতার কাছে খুব সমারোহের সঙ্গে বড় মেলা হয় তারকেশ্বরে। বাঙলাদেশের আরও যেসব জায়গায় বিরাট মেলা বসে তার মধ্যে উল্লেখনীয় মুর্শিদাবাদ জেলার কাঞ্জনতলা গ্রামে ও ওই জেলারই বক্রেশ্বর গ্রামে, বীরভূম জেলার তারাপীঠে ও বক্রেশ্বরে, হাওড়া জেলার জগদ্বল্লভপুরে ও মেদিনীপুর জেলার জাড়া গ্রামে।