সেকালের রথ ও স্নানযাত্রা
আমাদের ছেলেবেলায় রথের যে আনন্দ ও উৎসব দেখেছি, আজ আর তা নেই। ভেঁপু বাজানো, পাঁপড় ও তেলেভাজা খাওয়া ও মাটির তৈরি খেলনার রথ কিনে রথটানা ছেলেদের খুব আনন্দ দিত। অন্যান্য আর পাঁচটা পরবের মত রথের সে আনন্দ আজ ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তার প্রমাণ, পঞ্চাশ বছর আগে রথযাত্রা (বেসরকারি অফিসে পুনর্যাত্রাও ছুটির দিন বলে গণ্য হত। আজ আর তা হয় না।
সেকালে রথযাত্রায় কলকাতায় খুব সমারোহ হ’ত। কলকাতার রথের সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন সংবাদ যা আমাদের হস্তগত হয়েছে, তা হচ্ছে শোভারাম বসাকের রথ। ওই রথটা গঙ্গার ধারে যেখানে রাখা হত, তার সামনের ঘাটটা এখনও রথতলা ঘাট নামে প্ৰখ্যাত। কলকাতার হাটখোলার মানিকচন্দ্র বসুর রথও খুব প্রসিদ্ধ ছিল। ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ জুলাই তারিখের ‘চন্দ্রিকা’ পত্রিকা থেকে আমরা জানতে পারি যে ওই সালে শিবনারায়ণ ঘোষ এক রথ নির্মাণ করে নিজ মাতার নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ওই উপলক্ষে কলকাতা ও প্রসিদ্ধ স্থানসমূহের চতুষ্পাঠীর অধ্যাপকদের নিমন্ত্রণ করে প্রত্যেককে একটা ঘড়া ও নগদ আট টাকা করে ‘বিদায়’ দিয়েছিলেন।
কোথাও ভিড় হলে এখনও বাঙলাদেশের লোক বলে ওখানে রথদোল পড়ে গেছে। কলকাতার রথে এত ভিড় হত যে ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে ‘মাঝের রাস্তা’ দিয়ে রথ নিয়ে যাওয়া পুলিস কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল। ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে কলকাতায় রাণী রাসমণির রূপার রথও বিখ্যাত রথ। ১৯৭২ খ্রীষ্টাব্দ হতে মার্কিন বৈষ্ণবদের রথেও যথেষ্ট সমারোহ হয়। আমাদের বাড়ির কাছে পাইকপাড়ার রাজাদের (লালাবাবুদের রথও খুব প্রাচীন। পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মন্ত্রী বিমল সিংহ মশাই-এর আমল থেকেই পাইকপাড়ার রাজবাড়ি পরিত্যক্ত। কিন্তু ঠাকুর দেবতা ও ধর্মানুষ্ঠান পরিত্যক্ত নয়। এখনও ওখানে ওঁদের রথ হয় ও ওঁদের বাড়ির সামনে বি. টি. রোডের ওপর মেলা বসে। তবে আগেকার জৌলুস নেই, কিন্তু ভিড় যথেষ্ট হয়।
কলকাতার অন্যান্য যে সব রাস্তায় রথ চলে সে সব রাস্তারও অনুরূপ দশা। ওইসব রাস্তার মোড়ে মোড়ে চোখে পড়বে বসানো আছে পুলিসের NO WAY বোর্ড।
রথের একটা প্রধান অঙ্গ হচ্ছে রথের মেলা। সেজন্য বলা হয়—‘রথ দেখা ও কলা বেচা’। কলকাতার শিয়ালদহের রথের মেলাই প্রসিদ্ধ। অন্যান্য জিনিসের মধ্যে এই মেলায় নানারকম গাছের চারা বিক্রি হয়—আম কাঁঠালের চারা থেকে লঙ্কা লবঙ্গ, এলাচের চারা পর্যন্ত। এটা বনোৎসবের সহায়ক। কিন্তু এ মেলার আগেকার গৌরব আর নেই। তাছাড়া, মেলা স্থানচ্যুতও হয়েছে। স্বাধীনতালাভের শর্ত হিসাবে দেশবিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত লোকেরা ওই জায়গাটা দখল করে নিয়ে ওই জায়গায় চালাঘর বানিয়ে কাপড়ের দোকান খুলে ফেলল। তারপর একদিন কর্তৃপক্ষ ওই চালাঘরগুলো ভেঙে দিল। গণ্ডগোলের পর কর্তৃপক্ষ ওখানে পাকা ঘর বানিয়ে দিল। ওই পাকা ঘরেই এখন বস্ত্রব্যবসায়ীদের অবস্থান। আর ওর আশপাশের ছিটেফোঁটা খালি জমিতে শিয়ালদহের মেলার সহবস্থান। বাঙলার অন্যত্রও রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ও হ’ত। কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতেও হ’ত। এই রথযাত্রাকে উপলক্ষ করেই বঙ্কিম তাঁর ‘রাধারাণী’ উপন্যাস লিখেছিলেন। শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্কিম জীবনী’র তৃতীয় সংস্করণের ৩০১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ‘গৃহবিগ্রহ রাধাবল্লভ জীউর রথযাত্রা প্রতি বৎসর মহাসমারোহে সম্পন্ন হইত। পূজনীয় যাদবচন্দ্র তখন জীবিত। বঙ্কিমচন্দ্র ১২৮২ সালে রথযাত্রার সময় ছুটি লইয়া গৃহে বসিয়াছিলেন। রথে বহু লোকের সমাগম হইয়াছিল। সেই ভিড়ে একটি ছোট মেয়ে হারাইয়া যায়। তাহার অনুসন্ধানার্থ বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও চেষ্টা করেছিলেন। এই ঘটনার দুই মাস পরে ‘রাধারাণী’ লিখিত হয়। সেটা ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দের কথা।”
গুপ্তিপাড়ায় বৃন্দাবন মঠের রথ অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরি তেরো চূড়া রথ। রথের ১৬টা চাকা ছিল। এখন ওই রথ ভঙ্গুর হয়ে গেলেও ওই অবস্থাতেই টানা হয়। এই রথের মেলায় হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর সংবাদপত্রসমূহে আমরা মাহেশের রথযাত্রার বিবরণ পাই। খুব সাড়ম্বরে এই রথযাত্রা হত, এবং কলকাতাবাসী ইংরেজরা এটা দেখতে যেতেন। বাঙালি ‘বাবু’রা তো যেতেনই, সেটা শিবনাথ শাস্ত্রী বলে গেছেন। শুধু তাই নয়। সঙ্গে তাঁরা বারাঙ্গ নাদেরও নিয়ে যেতেন। মাহেশের রথ সম্বন্ধে আমরা ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ জুন তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’-এ পড়ি—অনেক অনেক স্থানে রথযাত্রা হইয়া থাকে, কিন্তু তাহার মধ্যে জগন্নাথক্ষেত্রে রথযাত্রাতে যেরূপ সমারোহ ও লোকযাত্রা হয় মোকাম মাহেশের রথযাত্রাতে তাহার বিস্তর ন্যূন নহে। এখানে প্রথম দিনে অনুমান দুই লক্ষ লোক দর্শনার্থে আইসে এবং প্রথম রথ অবধি শেষ রথ পর্যন্ত নয়দিন জগন্নাথদেবের মোকাম বল্লভপুরে রাধাবল্লভ দেবের ঘরে থাকেন। তাহার নাম গুঞ্জবাড়ি। ঐ নয়দিন মাহেশ গ্রামাবধি বল্লভপুর পর্যন্ত নানাপ্রকার দোকানপসার বসে এবং সেখানে বিস্তর বিক্রয় হয়। ইহার বিশেষ কত কি লিখা যাইবেক। এমত রথযাত্রার সমারোহ জগন্নাথক্ষেত্র ব্যতিরিক্ত অন্যত্র কুত্রাপি নাই।’ মাহেশের রথযাত্রায় যে মাত্র দোকান পসার বসত, তা নয়। অনেক জায়গা থেকে অনেক লোক এসে জুয়া খেলত। জুয়ায় লোক এমন মত্ত হয়ে উঠত যে হেরে গিয়ে নিজেদের যুবতী স্ত্রী পর্যন্ত বেচে দিত। ১২২৬ সালের ৬ আষাঢ় তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’-এ লিখিত হয়েছিল—দুই জন জুয়া খেলাতে আপন যথাসর্বস্ব হারিয়া পরে অন্য উপায় না দেখিয়া আপন যুবতী স্ত্রী বিক্রয় করিতে উদ্যত হইল এবং তাহার মধ্যে একজন খানকীর নিকটে দশ টাকাতে বিক্ৰয় করিল। অন্য ব্যক্তির স্ত্রী বিক্রীতা হইতে সম্মত হইল না। তদপ্রযুক্ত ঐ ব্যক্তি খেলার দেনার কারণ কয়েদ হইল।’ মাহেশের রথ এখনও হয়, তবে আগেকার সে সমারোহ নেই, যদিও বিপুল সংখ্যক লোক এখনও মাহেশের রথ দেখতে যায়। মাহেশের কাছাকাছি চন্দননগর লক্ষ্মীগঞ্জের যাদু ঘোষের রথও খুব সমারোহের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার লোকরা এসব রথ দেখতে যেত।
রথে লোকের এত ভিড়হয় কেন? তার কারণ, ‘রথে চ বামনং দৃষ্ট্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে রথের এমনই মাহাত্ম্য যে রথে দেব দর্শন করলে পুনর্জন্ম হয় না। তবে রথ বলতে আমরা আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে অনুষ্ঠিত জগন্নাথ দেবের রথযাত্রাই বুঝি। কিন্তু রথযাত্রা মাত্র জগন্নাথদেবেরই নয়। অন্যান্য দেবতাদেরও রথযাত্রা আছে। কলকাতার লোক তো কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত জৈনদের পরেশনাথের রথযাত্রার সঙ্গে পরিচিত আছেনই। জগন্নাথদেবের রথের মত এরও পুনর্যাত্রা আছে। আমাদের ছেলেবেলায় পরেশনাথের রথটা (এটা মিছিলের শেষে থাকে) মানুষেই টেনে নিয়ে যেত। এখন রথটা মোটরে চলে। জৈনদের এই রথযাত্রা ছাড়া, বৌদ্ধদেরও রথযাত্রা ছিল। খ্রীস্ট্রীয় পঞ্চম শতাব্দীর গোড়ায় চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়ান যখন ভারতে এসেছিলেন, তখন তিনি বৈশাখী পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত বুদ্ধদেবের রথযাত্রা দেখেছিলেন। সেজন্য মনে হয় হিন্দুদের রথযাত্রা বৌদ্ধদের অনুকরণে প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
আরও যে-সব রথযাত্রা আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—পৌষমাসের শুক্লা একাদশীতে দক্ষিণ ভারতে চিদাম্বরে অনুষ্ঠিত নটরাজের রথযাত্রা, চৈত্রমাসের শুক্লা অষ্টমীতে অনুষ্ঠিত ওড়িশার ভুবনেশ্বরের রথযাত্রা, শারদীয়া বিজয়া দশমীতে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার রঘুনাথ বাড়িতে অনুষ্ঠিত শ্রীশ্রীরঘুনাথ জীউর রথযাত্রা। চব্বিশ পরগনার ঘোষপাড়ায় (কল্যাণীর কাছে) কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বৈশাখ মাসে অনুষ্ঠিত রথযাত্রা।
তবে আবার বলি বাঙলায় রথযাত্রা বলতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রাই বোঝায়। এটা কবে থেকে শুরু হয়েছে বলা কঠিন, তবে ষোড়শ শতাব্দীর স্মার্ত রঘুনন্দনের সময় এর প্রচলন ছিল। কালের আবর্তনের সঙ্গে রথযাত্রার অঙ্গ হিসাবে সম্পর্কিত রথের মেলার রূপ পালটে গেছে। আগে রথের মেলায় গৃহস্থালীর যাবতীয় দ্রব্যাদি যেমন ধামা চুবড়ি, চাল ঝাড়ার জন্য কুলো, চাল ধোবার জন্য ধুচুনি, বর্ষার দিনে মাথায় দেবার জন্য টোকা, মাছ ধরার ছিপ ইত্যাদি প্রভূত পরিমাণে বিক্রি হত। এখন রথের মেলায় সেসব জিনিস বিরল।
একালের শহুরে মানুষ রথযাত্রার সঙ্গে যতটা পরিচিত স্নানযাত্রার সঙ্গে ততটা নয়। জ্যৈষ্ঠমাসের পূর্ণিমাতিথিতে জগন্নাথদেবের স্নান উৎসবকে কেন্দ্র করে স্নানযাত্ৰা। কলকাতা এবং তার আশপাশের অঞ্চলে স্নানযাত্রা উপলক্ষে বসতো বড় বড় মেলা। দেবতার পুজোও হতো ঘটা করে। রথের মেলার চেয়ে স্নানযাত্রার মেলার আকর্ষণও কম ছিল না। কিছু কিছু এলাকায় তো রথ উপলক্ষে কোনো উৎসবই হ’ত না—যত ঘটা, জাঁকজমক সবই হ’ত জ্যৈষ্ঠমাসের পূর্ণিমায় স্নানযাত্রা উপলক্ষে
মাহেশের রথের মেলার মত মাহেশে স্নানযাত্রার সমারোহ যে কিছু কম ছিল না সে কথা জানা যায় ‘সমাচার দর্পণে’র সংবাদে—আগামী মঙ্গলবার ৮ জুন ২৭ জ্যৈষ্ঠ মোং মাহেশে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা হইবেক। এই যাত্রা দর্শনার্থে অনেক ২ তামসিক লোক আবালবৃদ্ধবনিতা আসিবেন ইহাতে শ্রীরামপুর ও চাতরা ও বহলভপুর ও আকনা ও মাহেশ ও রিসিড়া এই ক-এক গ্রাম লোকেতে পরিপূর্ণ হয় এবং পূর্বদিন রাত্রিতে কলিকাতা ও চুঁচুড়া ও ফরাসডাঙ্গা প্রভৃতি শহর ও তন্নিকটবর্ত্তী গ্রাম হইতে বজরা ও পিনিস ও ভাউলে এবং আর ২ নৌকাতে অনেক ধনবান লোকেরা নানাপ্রকার গান ও বাদ্য ও নাচ ও অন্য ২ প্রকার ঐহিক সুখসাধনা সামগ্রীতে বেষ্টিত হইয়া আইসেন পরদিন দুই প্রহরের মধ্যে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা হয়। যে স্থানে জগন্নাথের স্নান হয় সেখানে প্রায় তিন চার লক্ষ লোক একত্র দাঁড়াইয়া স্নান দর্শন করে পুরুষোত্তমক্ষেত্র ব্যতিরেকে এই যাত্রার এমন সমারোহ অন্যত্র কোথাও হয় না।’ সমাচার দর্পণ, ১৮১৯ খ্রীঃ ৫ জুন (২৪ জ্যৈষ্ঠ ১২২৬)