1 of 2

সেকালের বড়দিন

সেকালের বড়দিন 

তখন, কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। সুতরাং আমার জীবনের প্রথম অধ্যায়ে কলকাতার বড়দিন ছিল রাজধানী শহরের বড়দিন। সে বড়দিনের ছিল এক অসাধারণ জাঁকজমক ও জলুস। শারদীয়া পূজার সময় আমরা যেমন কলকাতার বাইরে যাই, সেকালে কলকাতায় চিত্ত বিনোদনের জন্য বড়দিনের সময় আসত সাহেবসুবোরা ভারতের নানা প্রান্ত থেকে। প্রথম সাহেব যিনি এখানে বড়দিন পালন করেছিলেন তিনি হচ্ছেন কলকাতর প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক। ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে চার্নক যখন হুগলি থেকে পালিয়ে এসে সুতানটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন তিনি বড়দিনের উৎসবটা এখানেই পালন করেছিলেন। 

এই শতাব্দীর মুখপাতে কলকাতা যখন ভারতের রাজধানী ছিল, তখন বড়দিনের সময় এখানে উচ্ছলিত হতো এক অবেগময় আনন্দের ঢেউ। মাত্র সাহেবসুবোরাই যে আনন্দ করতো, তা নয়, এদেশের লোকরাও। সাহেবদের কাছে বড়দিনটা ছিল যীশুখ্রিস্টের জন্মজয়ন্তী উৎসব। কিন্তু এ-সময় লোকের মনে আনন্দের ঢেউ তুঙ্গে উঠতো বলে এদেশের লোকরা এটাকে বড়দিন বলতো। বড়দিনের সময় স্কুল-কলেজ অফিস-কাছারি সবই বন্ধ থাকতো ন’দিনের জন্য—২৪ ডিসেম্বর থেকে পয়লা জানুয়ারি পর্যন্ত, আবার দোসরা জানুয়ারিটা যদি রবিবার হতো, তাহলে ফাউ হিসাবে একদিন বেশি ছুটি পাওয়া যেত। কলকাতার শেয়ার বাজার বন্ধ থাকতো পনেরো দিন—১৮ ডিসেম্বর থেকে পয়লা জানুয়ারি পর্যন্ত। হাইকোর্টেরও এরকম লম্বা ছুটি থাকতো। এখন মাত্র হাইকোর্টই এই ঐতিহ্যটা বজায় রেখেছে যদিও ওটা সংক্ষিপ্ত হয়েছে আট-দশ দিনে। 

বড়দিনের সময় কলকাতার ব্যবসাপাড়ার দোকানপত্তরগুলো সাজানো হতো আলোকমালায় ও বর্ণাঢ্য পতাকা-ফেসটুন দিয়ে। সাহেবরা তাদের ঘরবাড়িগুলোও অনুরূপভাবে সাজাতো। দেশিপাড়ায় বসবাসকারী এদেশীয় খ্রিস্টানরাও তাই করতো। সাহেবঘেঁষা বাঙালিরাও অনেকে তাই করতো। সমস্ত শহরটাই আলোকমালায় ঝলমল করতো। দেশীপাড়ার লোকরা এই আলোকমালা দেখতে সাহেবপাড়ায় যেত। এমনকি অন্তঃপুরিকারাও আস্টেপৃষ্ঠে—ঝিলমিলি-আঁটা ছ্যাকরা গাড়ি করে কালীঘাটে যেতো পৌষকালীর পুজো দিতে, আর ফেরবার পথে সাহেবপাড়ার আলোকমালা দেখে আসত। 

বড়দিনের সময় সাহেবরা যে মাত্র তাদের বাড়ির বাইরের দিকটাই সুস ি ত করতো না নয়, বাড়ির ভেতরটাও। একটা ঘরে সুস িত X-mas tree বসাতো। খাটের পায়াতে ঝুলতো সান্টা ক্লজের মোজা, আর তার ভিতর রাখতো নানা রকম খেলনা ও উপহার দ্রব্য। সকালে উঠে ছেলেমেয়েরা বিশ্বাস করতো যে সান্টা ক্লজ (সেন্ট নিকোলাসের অপভ্রংশ) রাত্রিকালে এসে তাদের জন্য এসব উপহার দ্রব্য রেখে গেছে। এরপর ছিল বাতি জ্বালার ব্যাপার ও একটা মস্তবড় ক্রিসমাস-কেক তৈরি করা। উৎসব পালনের জন্য সেটাকে কেটে উদরস্থ করা হতো। সাহেবদের দেখাদেখি দেশীপাড়ার লোকরাও বড়দিনের উৎসব পালন করতো কেক খেয়ে। মাছ-মাংস রান্নার বাহুল্য করে। অনেকে আবার বড়দিনের সময় চড়িভাতি করতে যেত। মোটকথা দেশীপাড়ার লোকদের কাছেও বড়দিনটা ছিল আমোদ- আনন্দ করবার সময়। ছেলেমেয়েদের আনন্দ দেবার জন্য অভিভাবকরা অনেকেই তাদের নিয়ে যেত যাদুঘর, পশুশালা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন-এ। এসব জায়গায় অসাধারণ ভীড় হতো। জু-গার্ডেন-এ এসময় প্রবেশ মূল্য দু-একদিন বেশি করা হতো। 

সাহেবদের আনুকূল্য লাভ করবার জন্য অনেকেই সাহেববাড়ি ভেট পাঠাতো। এটা তৎকালীন একটা রীতি ছিল। নানারকম কেক্, মিষ্টান্ন ও ফল ভেটের ঝুড়িতে থাকতো। 

বড়দিনের সময় ‘গ্রিটিং কার্ডস’ পাঠাবার রীতিও খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এখন সেটা প্রায় উঠে গেছে। তার পরিবর্তে এখন পাঠানো হয় দেওয়ালীর সময় ‘দেওয়ালীকা হার্দিক অভিবাদন’। 

সেকালের সাহেবী সমাজে এসময় উপহার দেবার রীতি ছিল, বিশেষ করে যারা বিদেশে থাকতো। বিদেশ থেকে আত্বীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধুব সকলেই ডাকযোগে এদেশের সাহেবদের উপহার পাঠাত। ডাকঘরে এসময় বিদেশ থেকে বস্তাবস্তা উপহার এসে হাজির হতো। প্রেরক রেজেস্ট্রি করে না পাঠালে অনেক সময়ই ডাকঘরের কর্মচারিরা এগুলো আত্মসাৎ করতো। 

বড়দিনের সময় কলকাতার সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল ঘোড়দৌড়ের মাঠে ভাইসরয় কাপ’-এর খেলা। অবশ্য আরও অনেক রকম খেলা হতো—কিন্তু ‘ভাইসরয় কাপ’-এর আকর্ষণই ছিল সবচেয়ে বেশি। যতদিন কলকাতা ভারতের রাজধানী ছিল, ততদিন ভাইসরয় নিজে এই খেলার দিন ঘোড়দৌড়ের মাঠে উপস্থিত থাকতেন। ১৯০৪ সালে ‘ভাইসরয় কাপ’ খেলার দিন ঘোড়দৌড়ের মাঠে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল। ভাইসরয় ওই মাঠে বসেই আদেশ দিয়েছিলেন যে নিমতলার শ্মশানঘাটেই ‘করোনারস্ কোর্ট বসুক’। ঘটনাটা এখানে একটু বিস্তারিতভাবে বলা দরকার। ‘সিউদতরায় প্রেমসুক’ নামে এক সম্ভ্রান্ত মারবাড়ি ফার্মের মালিক তাঁর অফিস থেকে নিজ ঘোড়ার গাড়ি (তখন মোটর গাড়ির চলন ছিল না) করে বড়বাজারে তাঁর বাড়ি ফিরছিলেন। কলকাতায় হ্যারিসন রোডে তখন সবে ট্রামগাড়ির প্রচলন হয়েছে। প্রেমসুকবাবুর গাড়িটা ক্লাইভ স্ট্রীট ও হ্যারিসন রোডের সংযোগস্থলে আসামাত্রই গাড়ির ঘোড়াটা ট্রামগাড়ির ঢং ঢং শব্দ শুনে বিগড়ে গিয়ে পথছুট হয়ে ট্রামগাড়িতে ধাক্কা মারে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির একটা যোয়াল গাড়ির ভেতর ঢুকে প্রেমসুকবাবুর বুকে সজোরে আঘাত হানে। অকুস্থলেই প্রেমসুকবাবুর মৃত্যু ঘটে। সংবাদ পেয়ে সেখানে ছুটে আসে কলকাতার মারবাড়ি সমাজ দুর্ঘটনায় নিহত প্রেমসুকবাবুর শবব্যবচ্ছেদ তারা বরদাস্ত করবে না। ছুটে যায় লাটভবনে বড়লাট লর্ড কার্জনের কাছ থেকে বিনা ব্যবচ্ছেদে শব ছেড়ে দেবার জন্য অনুমতি-পত্র সংগ্রহের জন্য। লাটভবনে গিয়ে শোনে বড়লাট ঘোড়দৌড়ের মাঠে গেছেন ‘ভাইসরয় কাপ’ বাজির খেলা দেখবার জন্য। সেখানে গিয়ে তারা অনুমতি সংগ্রহ করে যে বিনা ব্যবচ্ছেদেই নিমতলা ঘাটে ‘করোনারস’ কোর্ট বসুক এবং প্রেমসুকবাবুর লাশ ছেড়ে দেওয়া হউক। কলকাতার ইতিহাসে এই প্রথম ও শেষ নিমতলা ঘাটে ‘করোনারস্’ কোর্ট-এর অধিবেশন হয়েছিল। 

বড়দিনের সময়ের আর এক স্মরণীয় ঘটনা ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট পঞ্চম জর্জের সস্ত্রীক ভারত ভ্রমণ তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে। বড়দিনের সময় তিনি কলকাতায় আসেন। সে-সময় এক সাড়ম্বর উৎসব হয়েছিল। রেড রোডের ধারে গ্যালারি তৈরি করে বসবার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল স্কুলের ছেলেদের রাজদর্শন করাবার জন্য। তাদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়েছিল। আমার সহপাঠীদের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। আমাদের উপহার দেওয়া হয়েছিল একখানা করে ইউনিয়ন জ্যাক্ পতাকা ও একখানা মেডেল যার ওপর অঙ্কিত ছিল রাজারানীর যুগল মূর্তি। 

সেকালে বড়দিনের সময়টা ছিল দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের একটা মরসুমের সময়। বড় বড় সাহেবী দোকান যেমন হোয়াইটওয়ে লেডল, হল অ্যাণ্ডারসন, ফ্রানসিস্ হ্যারিসন হ্যাদাওয়ে, আর্মি অ্যাণ্ড নেভি স্টোরস’ ইত্যাদি দোকানে সাহেবমেমদের খুব ভিড় হতো পোশাক-আশাক থেকে নানারকম উপহার দ্রব্য কেনবার জন্য। ছোটখাটো সাহেবরা ভিড় করতো নিউ মার্কেট ও চাঁদনী চকে। এছাড়া বইটই উপহার দেবার জন্য সাহেবদের ভিড় হতো ডবলিউ নিউম্যান, থ্যাকার স্পিঙ্ক ইত্যাদি বইয়ের দোকানে। কলেজ স্ট্রীট পাড়ার বইওয়ালাদেরও এটা মরসুমের সময় ছিল, কেননা এসময় স্কুলের ছেলেরা প্রমোশন পেয়ে হিড়িক লাগাতো বই কেনবার জন্য। নূতন বই কেনাতে ছেলেদের খুব আনন্দ হতো। তাছাড়া, বড়দিনটা ছেলেদের কাছে একটা সুখের সময় ছিল, কেননা পূজার ছুটি ও গ্রীষ্মকালের ছুটির মত ছেলেদের বড়দিনের ছুটিতে কোনো ‘হোম্ টাসক্’ করতে হতো না। 

শাক-সবজি, মাছ-মাংস ইত্যাদি বিক্রেতাদের কাছেও বড়দিনটা মরসুমের সময় ছিল। এসময় কেনাকাটার ফলে সবচেয়ে বেশি আয় হতো কেকওয়ালাদের। ফারপো, পেলিটি, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল, কেলনার, স্পেনসার প্রভৃতি সাহেবী দোকানগুলো এসময় বেশ দু’পয়সা কামাতো। নিউ মার্কেটের কেকওয়ালাদেরও এসময়টা ছিল পোয়াবারো। 

বড়দিনের সময় সার্কাস, কার্নিভাল, হুলাহুলা ডানস্ ইত্যাদিতেও খুব ভিড় হতো। বিলাতি হোটেলগুলোরও এ সময়টা ছিল মরসুম কেননা কলকাতার বাইরে থেকে যে সব সাহেব আসত, তারা এই হোটেলগুলোতেই থাকতো। 

কলকাতাতে যেমন বাইরের লোক এসে ভিড় জমাতো কলকাতার লোকও তেমনি অনেক সময় বাইরে যেত। তার জন্য রেল কোম্পানি এসময় X-mas কনসেশন দিতো। অনেকগুলো গির্জার চত্বরে জুয়ার আড্ডা বসতো। তাছাড়া গির্জার পাদরীরাও এসময় লটারি অনুষ্ঠিত করতো ও প্রাইজ দেবার পর উদ্বৃত্ত অর্থ গির্জার উন্নয়নে কাজে ব্যয় করতো। 

এসব ছাড়া জামাইবাড়ি শীতের তত্ত্বটা লোক বড়দিনের সময়ই করতো। 

কলকাতার সেকালের বড়দিনের ছুটিটাও এখন একদিনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাও কোনো কোনো বছর বড়দিনের ছুটি পাওয়া যায় না, যেমন যে বছর বড়দিনটা রবিবারে পড়তো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *