1 of 2

সেকালের জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসব

সেকালের জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসব 

খ্রীষ্টানদের কাছে ‘খ্রীস্টমাস ডে’ যা, হিন্দুদের কাছে ‘জন্মাষ্টমী’-ও তাই। দু’টোই একই গোত্রের পরব। ‘খ্রীস্টমাস ডে’ হচ্ছে যীশুখ্রীস্টের জন্ম উপলক্ষে উৎসব, আর ‘জন্মাষ্টমী’ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব। খ্রীস্টমাস ডে’টা খ্রীষ্টানরা এখনও বেশ জাঁকজমক ও হইহুল্লোড়ের সঙ্গে পালন করে, কিন্তু হিন্দুদের জন্মাষ্টমী উৎসবটা অনেক ম্লান হয়ে গিয়েছে। অথচ এককালে হিন্দুদের জীবনে এটা একটা খুব বড় পরব ছিল। এটা আমরা জানতে পারি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দু’শো বছর আগেকার একটা নথি থেকে। ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি সরকারি ছুটির যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তা থেকে আমরা জানতে পারি যে স্নানযাত্রা ও রথযাত্রায় মাত্র একদিন করে ছুটি থাকত, কিন্তু জন্মাষ্টমীতে ছুটি দেওয়া হত দু’দিন। 

এই ছুটির তালিকা থেকে আমরা সেকালের হিন্দুদের ধর্মীয় জীবনে জন্মাষ্টমীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানটা বুঝতে পারি। কিন্তু গুরুত্বটা বুঝতে পারলে কি হবে? জন্মাষ্টমীটা কিভাবে পালিত হত, তার কোন লিখিত বিবরণ কোথাও নেই। আজকালকার দিনের লিখিত বইতেও নেই। চিন্তাহরণ চক্রবর্তী তাঁর ‘হিন্দুর আচার অনুষ্ঠান’ বইখানাতে সব রকম পরবের বর্ণনা দিয়েছেন, এমন কি ঘেঁটুপূজা পর্যন্ত, কিন্তু জন্মাষ্টমী সম্বন্ধে একটা কথাও উল্লেখ করেননি। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ বইতেও গত শতাব্দীর প্রথমার্ধের কলকাতার অনেক পুজা-উৎসবের বর্ণনা দিয়েছেন কিন্তু জন্মাষ্টমী সম্বন্ধে কিছুই বলেননি।’ 

সুতরাং সেকালের জন্মাষ্টমী সম্বন্ধে এখানে যা লিখছি, তা আমি নিজে যা শুনেছি বা দেখেছি, তার ভিত্তিতেই লেখা। 

ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলে জন্মাষ্টমীতে যখন দু’দিন ছুটি দেওয়া হ’ত, তখন জন্মাষ্টমীতে যে আমোদ-প্রমোদ ও নানারকম ঘটা হত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষিত কলকাতার বিশিষ্ট ও সম্ভ্রান্ত পরিবারসমূহে নিশ্চয়ই জন্মাষ্টমী উৎসব অনুষ্ঠিত হ’ত। কিন্তু তারও কোন বিবরণ কোথাও নেই। এরূপ পরিবারসমূহের মধ্যে ছিল পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুর, জোড়াসাঁকোর গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জানবাজারের রানী রাসমণি, মদনমোহনতলার গোকুল মিত্র ও বাগবাজারের রসিকমোহন নিয়োগীর পৌত্র ভুবনমোহন নিয়োগী যিনি কলকাতায় প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপন করেছিলেন। ভুবনমোহন নিয়োগীর জ্যেষ্ঠপুত্রের সঙ্গেই আমার সেজবোনের বিবাহ হয়েছিল। আমার আবুইমা (তার মানে আমার সেজবোনের শাশুড়ি) ভুবনমোহিনীর কাছ থেকে শুনেছি যে ওঁদের বাড়িতে জন্মাষ্টমী-নন্দোৎসব খুব ঘটা করে অনুষ্ঠিত হ’ত। ওই উৎসবে ভুবনমোহনের গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের সকল অভিনেতা ও অভিনেত্রী ও পাড়ার বিশিষ্ট লোকেরা যোগদান করত। তাঁরই মুখে শোনা ওই উৎসবে আসতেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, ক্ষেত্রমোহন গাঙ্গুলী, নগেন্দ্র, মহেন্দ্র, কিরণ, বেলবাবু প্রভৃতি শ্ৰেষ্ঠ অভিনেতারা ও বিনোদিনী, ক্ষেত্রমণি, কাদম্বিনী, হরিদাসী, যাদুমণি, রাজকুমারী প্রভৃতি অভিনেত্রীর দল, ও পাড়ার বিশিষ্ট লোকদের মধ্যে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র শিশিরকুমার ঘোষ, রসিকমোহন বিদ্যাভূষণ প্রমুখেরা। অমৃতলাল বসু ভুবনমোহন নিয়োগীর বাড়ির নন্দোৎসবের ঘটার যে একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, সেটা রসরাজ তাঁর ‘আত্মস্মৃতির’ এক জায়গায় গৌণ উল্লেখ করে গেছেন। ভুবনমোহন নিয়োগীর মৃত্যুর পর তিনি ভুবনমোহন নিয়োগী সম্বন্ধে এক স্মৃতিচারণ করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন——আজ উনিশ দিন হয়ে গেল ভুবন ইহলোক ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু তার মৃত্যুসংবাদ এ পর্যন্ত কোন সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয় নাই। এটা কিছু বিচিত্র নয়। কারণ, তখনকার অল্পসংখ্যক বাঙালি পরিচালিত সংবাদপত্রের মধ্যে যেগুলি ভুবন নিয়োগীর বড় বাড়ি দেখেছে, গাড়ি দেখেছে, জুড়ি দেখেছে, ফেটিং দেখেছে, দালানে দোল-নন্দোৎসবের ধুমধাম দেখেছে, কালে তাদের প্রায় সবগুলিরই অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে। তাঁর বাড়ির অনতিদূরেই যে প্রাচীন পত্রিকাখানি আজও সুস্থশরীরে জীবিত আছে, তার বর্তমান কর্তৃপক্ষের স্বর্গত পিতৃপিতৃব্যগণ ভুবনকে সাদরে নিমন্ত্রণ করে, নিজেদের ঘরে বসিয়েছেন, তাঁর বাড়িতে ও থিয়েটারে পদার্পণ করে নিয়োগীকুলকে সম্মানিত করেছেন, কিন্তু তখন ছিল আঙ্গুলে হীরের আংটিপরা ভুবন আর এখনকার এঁরা যদি দেখে থাকেন, তো দেখেছেন নেংটি পরা ভুবনকে। বড় মানুষ ভুবন নিয়োগী একটু আশ্রয় দিয়েছিল, তাই গিরিশের মত অসাধারণ নাট্যকবি কেরানীগিরিতে জীবন পর্যবসিত করে নাই; স্কুল মাস্টারের কেদারাই অর্ধেন্দু ও ধর্মদাস সুরের ন্যায় কলাবিদদের প্রতিভার ‘রঙ্গমঞ্চ হয় নাই”। (সাহিত্যলোক সংস্করণ পৃষ্ঠা ১৮৪-১৮৫) 

অমৃতলাল যে ধুমধামের কথা বলেছেন, সে ধুমধাম আমার ছেলেবেলায় ভুবন নিয়োগী মশাইয়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ধুমধাম ছিল না বটে, কিন্তু আনুষ্ঠানিক বাহুল্যের অভাব ছিল না। দেখেছি দালানের একপাশে সাজানো থাকত মালসাভাগের অসংখ্য বড় বড় মালসা। প্রতি মালসায় থাকত কিছু পরিমাণ ভেজানো চিঁড়া ও বহুল পরিমাণ নানারকম সুখাদ্য মিষ্টান্ন। এরকম একটা মালসা আমাদের বাড়ি আসত। নিয়ে আসত ওঁদের বাড়ির পুরোহিত ঠাকুর অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। 

উত্তর ভারতের লোকেরা কলকাতায় জন্মাষ্টমী উৎসব ব্যাপকভাবে পালন করে। কিন্তু আমাদের বাঙলাদেশের মত জন্মাষ্টমীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সংশ্লিষ্ট নন্দোৎসব এখানে নেই। 

নন্দোৎসবের আনন্দই ছিল এ উৎসবের আসল আনন্দ। জন্মাষ্টমীর পূজা হয় রাত্রে, কেননা, রাত্রেই শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। নন্দোৎসবটা পালিত হয় পরদিন সকালে। রাত্রে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের দরুন, সকালে প্রকাশ পেয়েছিল নন্দের মহা আনন্দ। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি বৈষ্ণব গায়করা একটি ছেলেকে রঙিন বসন পরিয়ে, মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়ে, ও একটা কৃত্রিম গোঁফ লাগিয়ে, কাঁধে বাঁকে করে দু’হাঁড়ি দই নিয়ে, ‘বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাচগান করতো। এখনও বোধ হয় তারা বেরোয়,কিন্তু আগেকার সে সংগীত ও চটক নেই। সুন্দর দেখতে লাগত এই সুসজ্জিত নন্দকে। তার নাচগান দেখে বাড়ির মেয়েরা খুব আমোদ করত। এভাবেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে নন্দ অর্থ সংগ্রহ করত। আর মেয়েরা বলত, ‘তালের বড়া খেয়ে নন্দ নাচিতে লাগিল।’ সেকালে ভাদ্রমাসে সুমিষ্ট খাদ্য ছিল তালের বড়া। এটা ঘরে ঘরে তৈরি হ’ত। সেইজন্যই নন্দর আনন্দ সম্বন্ধে এর উল্লেখ। 

সেকালে বিকালে বেরুত জন্মাষ্টমীর মিছিল। ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল নাকি অদ্ভুত ছিল। কিন্তু কলকাতায় আমরা আমাদের ছেলেবেলায় যে মিছিল দেখেছি তা হচ্ছে কনসার্ট পার্টির মিছিল। ওই কনসার্টে বাজানো হত স্বদেশী গান। আমাদের ছেলেবেলায় কনসার্ট পার্টির খুব সমাদার ছিল। আমাদের পাড়াতেই ছিল দক্ষিণারঞ্জন সেন মশাইয়ের কনসার্ট পার্টি। কম্বুলিয়া টোলায় ছিল আমার বড়বৌদির পিতামহ ননী নিয়োগীর বিখ্যাত কনসার্ট পার্টি। এঁরা লর্ড রিপনের দরবারে কনসার্ট বাজিয়ে খুব সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সেকালে কনসার্টের জনপ্রিয়তা, এই থেকে বোঝা যাবে যে সাধারণ রঙ্গালয়ে নাটক অভিনয়ের আগে ও প্রতি ইনটারভেলে কনসার্ট বাজানো হ’ত। এছাড়া, ইডেন গার্ডেনে ব্যাণ্ড ও কনসার্ট বাজাবার জন্য একটা বিশেষ মণ্ডপ ছিল। প্রতিদিন বিকালে সেখানে কনসার্ট বাজানো হ’ত ও বহুলোক তা শোনবার জন্য ওখানে যেত। 

জন্মাষ্টমী উপলক্ষে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে সে কনসার্ট পার্টির মিছিল যেত, তারা পাইকপাড়া বা টালা, ওই রকম কোন অঞ্চল থেকে আসত। 

‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সঙ্গে আমি বহুদিন যুক্ত ছিলাম। দেখেছি ওই প্রতিষ্ঠানের উত্তরপ্রদেশীয় পিওন ও দরোয়ানরা জন্মাষ্টমী উৎসব পালন করত। রাত্রে তারা পটে রাধাকৃষ্ণের পূজা করত ও তার পরদিন দুপুরে অফিসের প্রত্যেক কর্মচারীকে প্রসাদ বিতরণ করত। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *