সেই গাছটির নীচে
আমার বন্ধু তপন প্রথম আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেই ক্লাবে। ক্লাবের নামটি বিচিত্র, সুখী পরিবার, বিশেষ কেউ এর নাম শোনেনি। যে-কেউ এ-ক্লাবের সদস্য হতে পারে না। এখানে ভরতি হওয়ার শর্ত হল, অন্য সদস্যদের সঙ্গে কিছু-না-কিছু একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকতে হবে। অর্থাৎ সবাই এক পরিবারের মানুষ।
আসলে কিন্তু তা নয়।
বকুলবাগানে গগন ভদ্রের একটা ছিমছাম দোতলা বাড়িতে এই ক্লাবের অধিবেশন হয় প্রত্যেক শনি-রবিবার। এ-বাড়ির একতলায় বসবার ঘরটি প্রায় একটা হলঘরের মতন বড়। বাড়ির সামনেটায় বাগান ও সবুজ ঘাসের লন, এই পাড়াটাও খুব নিরিবিলি। গগন ভদ্র একটা। ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের মালিক, বেশ সচ্ছল অবস্থা, উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙালি বলা যায়, আমরা অল্প বয়েসে অবশ্য তাঁকে খুব বড়লোক ভাবতাম। গগন ভদ্রের স্ত্রী নমিতা অতি চমৎকার মহিলা, এক-একজন মানুষের দিকে তাকালেই ভালো লাগে, নমিতার মুখখানি সেরকম স্নিগ্ধ।
সারা সপ্তাহ গগন ভদ্র খুব ব্যস্ত থাকলেও শনিবার আর রবিবার কোনও কাজ করবেন না প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এই দুদিন শুধু আড্ডা, গান, কবিতা, আবৃত্তি, নাটক। সেই জন্যই ক্লাব। গগনদা এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আর নমিতাদি মধ্যমণি।
এই সুখী দম্পতিটির কোনও ছেলেমেয়ে ছিল না। আরও অদ্ভুত ব্যাপার, গগন ভদ্রের কোনও ভাইবোন নেই, নমিতাদির একটি মাত্র বোন ছিল, সে-ও মারা গেছে। এমন সুন্দর একটা বাড়ি টাকা-পয়সারও অভাব নেই, অথচ মধ্য-জীবনে পৌঁছে ওরা দুজন বুঝলেন, একটা ধূসর রুক্ষ মাঠের মতন ওঁদের সামনে পড়ে আছে নিদারুণ নিঃসঙ্গতা।
নমিতাদির যে-বোন মারা গেছে, তার দুটি ছেলেমেয়ে, পিঠোপিঠি ভাইবোন, দুজনেই তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তারা এ-বাড়িতে আসত মাঝে-মাঝে। গগনদার বাবার দুটি বিয়ে, দ্বিতীয় পক্ষের দুই বোন, তাদের তিনটি ছেলে আছে। এইসব ছেলেমেয়েদের নিয়ে শুরু হয়েছিল ক্লাবটা। তারপর ওইসব ছেলেমেয়েদের মাসতুতো-পিসতুতো ভাইবোনেরাও আসতে লাগল। আত্মীয়তার সম্পর্কটা অতি ক্ষীণ হতে থাকলেও রইল তো কিছু একটা! নমিতাদির বোনের মেয়ে। গীতালি আর মিতালির পিসতুতো জামাইবাবুর ভাই হচ্ছে তপন। তাহলে গগনদার সঙ্গে তার সম্পর্ক দাঁড়াল? সে হিসেব আমি জানি না!
তপন আমার বন্ধু, ছেলেবেলা থেকে একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। কোনও আত্মীয়তা নেই। কিন্তু আমার এক পিসতুতো দাদার বিয়েতে গিয়েছিলাম শ্রীরামপুর, সেই বিয়েবাড়িতে হঠাৎ তপনের সঙ্গে দেখা। অবাক হয়ে জিগ্যেস করলুম, তুই কোনও সুবাদে নেমন্তন্ন খেতে এলি রে? তপন। বলল, বাঃ, কনে যে আমার দিদি। আপন দিদি নয়, আমার ফুলমাসির মেয়ে। তাহলে আমার পিসতুতো বউদি হল তপনের মাসতুতো দিদি। খুব একটা দূর সম্পর্ক বলা যায় কি?
এর কয়েকদিন পরেই তপন বলল, চল, তোকে একটা ক্লাবে নিয়ে যাব।
আমার পরিচয় জানতেই নমিতাদি বললেন, বাঃ, তুমি আমাদের নতুন সদস্য হলে। নিয়মিত প্রত্যেক সপ্তাহে আসতে হবে কিন্তু।
এই ক্লাবে একটা দারুণ সম্বোধন সমস্যা থাকার কথা। সম্পর্কের সূত্র ধরে গগনদা কারুর কাকা বা মামা বা পিসে বা দাদু। সেইজন্য নিয়ম হয়েছে, সবাই শুধু গগনদা আর নমিতাদি বলবে।
গগনদার ছিপছিপে চেহারা, মাথার চুল কাঁচা-পাকা, মুখখানা গম্ভীর ধরনের হলেও হঠাৎ-হঠাৎ মজার কথা বলেন। নমিতাদির বেশ ভরা শরীর, রানি-রানি ভাব, কিন্তু একটুও অহঙ্কারী নন, ঠোঁটে সবসময় হাসি লেগে আছে।
শনি আর রবিবার আমাদের আসর বসত সন্ধে সাড়ে ছটায়, চলতে নটা-সাড়ে নটা পর্যন্ত। আমরা অনেকেই তখন ছাত্র, কেউ-কেউ সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে। এই ক্লাবের এমনই আকর্ষণ ছিল যে এই দু-দিন অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছেই করত না।
গগনদা পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও নানারকম বই পড়তেন। আমাদের না পড়া অনেক বই সম্পর্কে শুনেছি ওঁর কাছ থেকে। নমিতাদিও গগনদার অফিসের কাজকর্ম দেখেন, শিক্ষিতা মহিলা, তাঁর গানের গলাটিও বেশ ভালো। আমার দৃঢ় ধারণা, ইচ্ছে করলেই তিনি নামকরা গায়িকা হতে পারতেন। কিন্তু নাম করার দিকে ওঁর কোনও ঝোঁকই ছিল না।
ওঁদের দুজনেরই স্বভাবের আর-একটা ভালো দিক এই যে ওঁরা কক্ষনো বেশি-বেশি কর্তৃত্ব করতেন না, নিজেরাই বেশি কথা বলতেন না। ওঁরা আমাদের সমবয়েসির মতন ফড়ি-ইয়ার্কিও করতেন, প্রশ্রয় দিতেন ছোটখাটো দুষ্টুমির। আর-একটা নিয়ম ছিল প্রত্যেক সদস্যকেই মাঝে মাঝে কিছু একটা করতে হবে। হয় গল্প বলা কিংবা আবৃত্তি কিংবা গান বা নাচ। যে বলবে, কিছুই পারি না, তার পেছনে লাগা হবে। আমি যেদিন প্রথম ওই কথা বলেছিলাম, সেদিন একটি ছেলে আর একটি মেয়ে এসে জোর করে আমার হাত ধরে টেনে তুলে বলেছিল, আর কিছু না। পারো, নাচতে পারবে নিশ্চয়ই! তারপর সে কি হাসির হুল্লোড়।
তখন এই ক্লাবের সদস্যের সংখ্যা ছাব্বিশজন তার মধ্যে আঠারো-উনিশজন নিয়মিত আসে। আচ্ছা ও নাচ-গান-কবিতা ছাড়াও আর-একটা আকর্ষণ ছিল। খাওয়া-দাওয়া হত দারুণ। গগনদাদের একজন বাবুর্চি ছিল, তার রান্নার হাতখানা বাঁধিয়ে রাখার মতন! প্রত্যেক সপ্তাহে। নিত্যনতুন চপ-কাটলেট ফ্রাই আর মিষ্টি। খুব দামি চা, যতবার খুশি! চাঁদা নেই!
এই ক্লাবে বেশ কয়েকবার যাওয়ার পর আমি দুটো জিনিস লক্ষ করলুম। বেশ সুন্দর সময় কাটে, আনন্দ ও হুল্লোড় হয়, সাহিত্য-সঙ্গীতের চর্চা হয় বটে, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে কিছু কিছু সদস্যের মধ্যে একটা টেনশন আছে। এই নিঃসন্তান দম্পতিটির উত্তরাধিকারী কে হবে? সবাই যখন কিছু
কিছু আত্মীয়, তখন এদেরই মধ্যেই তা কারুর পাওয়া উচিত! সেইজন্য কার কতটা আত্মীয়তা বেশি কিংবা কে ওঁদের দুজনের বেশি প্রিয় হতে পারে, তা নিয়ে কয়েকজনের মধ্যে রীতিমতো। একটা প্রতিযোগিতা আছে! আমার অবশ্য এতে মাথা গলাবার কোনও কারণ নেই, কারণ সম্পর্কের বিচারে আমি কুড়িজনের চেয়েও পিছিয়ে!
আর একটা প্রতিযোগিতাও আছে। প্রেমের! এর মধ্যে অনেকেই অনেককে আগে চিনত না, লতায়-পাতায় আত্মীয়তা এতই দূরের যে প্রেম তো হতেই পারে, সম্বন্ধ করে বিয়েতেও কোনও বাধা নেই। কে কার পাশে বসে, কে কার দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকে, তা থেকে বোঝা যায় কী রকম প্রেমের খেলা চলছে।
উত্তরাধিকারের প্রতিযোগিতায় আমার কোনও স্থান নেই বটে, প্রেমের ব্যাপারে উদাসীন থাকব কী করে? কিন্তু আমি বোকার মতন এমনই একজনের প্রেমে পড়লুম, যার হৃদয় স্পর্শ করার কোনও সম্ভাবনাই আমার নেই। কিন্তু প্রেম যে যুক্তি মানে না!
দীপা, ভাস্বতী, রীণা, পুতুল এবং শকুন্তলা এই পাঁচজনই ছিল মোট এগারোটি মেয়ের মধ্যে বেশি আকর্ষণীয়। এদের মধ্যে আবার শকুন্তলা সবাইকে ছাপিয়ে একেবারে আলাদা। শকুন্তলা সাইকোলজি নিয়ে এম. এস. সি পড়ছে, প্রখর তার রূপ, সেই রূপ সম্পর্কে সে নিজেও খুব সচেতন। তার শরীরে ঢলঢল করছে লাবণ্য, ভুরু দুটি যেন কন্দর্পের ধনুক। সে আবার নমিতাদির বোনের বড় মেয়ে, আত্মীয়তার দিক থেকেও ওঁদের খুব কাছাকাছি। শকুন্তলাদের নিজেদের অবস্থাও বেশ সচ্ছল, এই পরিবারের সম্পত্তিও খুব সম্ভবত তার ভাগ্যেই ঝুলছে।
অন্তত চারজন যুবক শকুন্তলার কাছাকাছি সবসময় ঘুরঘুর করে। আমার বন্ধু তপনও তাদের মধ্যে একজন। ওদের মধ্যে আবার সুব্রত আর দীপকের মধ্যে খুব রেষারেষি চলছে! সুব্রত। ইঞ্জিনিয়ার, সুন্দর স্বাস্থ্য, ভালো কবিতা আবৃত্তি করে। দীপক ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ারে, দুর্দান্ত গান গায়।
অর্থাৎ আমি প্রথম থেকেই ব্যর্থ প্রেমিক।
আমি শকুন্তলার পাশে বসবার কখনও চেষ্টাও করি না। বরং একটুদূরে বসলে তার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকা যায়। সত্যিই সে দেখার মতন নারী।
শকুন্তলার ব্যবহারে অবশ্য অহংকার নেই। সকলের সঙ্গেই সে মেশে, সকলের সঙ্গেই সে হেসে কথা বলে। যদি কেউ চুপচাপ বসে থাকে, শকুন্তলাই তাকে যেচে বলে, এইভাবে সে দুবার আমাকে দিয়েও কবিতা পাঠ করিয়েছিল। এর বেশি কিছু না।
একদিন, একবারই শুধু কিছুক্ষণের জন্য আমি শকুন্তলার খুব কাছাকাছি এসেছিলাম নাটকীয়ভাবে।
সারা দিনটাই ছিল মেঘলা, বেড়াবার মতন একটি দিন। আমি অবশ্য বেড়াতে বেরুইনি, হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিলাম আমার এক কাকাকে ট্রেনে তুলে দিতে। বাসে করে ফিরছি প্রায় ঝুলতে ঝুলতে, আকাশেকড়কড়াৎ শব্দে বাজ ডাকছে, যে-কোনও সময় অঝোরে বৃষ্টি নামবে। রেড রোড ধরে আসতে-আসতে হঠাৎ মনে হল, ঠিক শকুন্তলার মতন একটি মেয়ে একলা দাঁড়িয়ে রাস্তায়। বাসটা তাকে ছাড়িয়ে চলে এসেছে, ভালো করে দেখতে পাইনি, শকুন্তলা এরকম। মাঝরাস্তায় একলা দাঁড়িয়ে থাকবেই না কেন! নিশ্চয়ই চোখের ভুল। আমার বাসটার সামনে অন্য কোনও গাড়ি আসতেই যেই একটু গতি কমিয়েছে, আমি ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে নেমে গেলাম।
তখনও বাসটার বেশ গতি ছিল, ঝোঁক সামলাতে না পেরে একটা আছাড় খেয়ে আমার হাঁটু ছড়ে গেল বটে, কিন্তু পুরস্কারও পেলাম আশাতীতভাবে।
সত্যিই শকুন্তলা দাঁড়িয়ে আছে একা। কাছেই ওদের বাড়ির গাড়ি, তার বনেট তোলা। গাড়িটা খারাপ হয়েছে, ড্রাইভার সেটা সারাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আর শকুন্তলা হাত তুলে ডাকতে চাইছে ট্যাক্সি। কিন্তু এরকম দুযোর্গের দিনে ট্যাক্সি পাওয়া অসম্ভব প্রায়, তাও মাঝরাস্তায়।
আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তার উদ্বেগমাখা মুখখানাতে আলো ফুটল। সে বলল, কী মুশকিল বলো তো, গাড়িটা কখন ঠিক হবে কে জানে, ড্রাইভার যা পারে করবে, আমি বাড়ি যাই কী করে? কোনও ট্যাক্সি থামছে না।
শকুন্তলা বলল, হাত দেখাচ্ছি তো, অন্য দু-একটা গাড়ি থামছে। তারা লিফট দিতে চাইছে। সব গাড়িতে একলা একলা লোক। তাই ভয় করল।
আমি বললাম, সেরকম কারুর গাড়িতে উঠলে তোমাকে নিরুদ্দেশে নিয়ে যাবে!
এই সময় আবার একশোটা কামান দাগার মতন শব্দ হল আকাশে।
শকুন্তলার সুন্দর মুখখানা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল। আমাকে জিগ্যেস করল, কী হবে, যদি মাথায় বাজ পড়ে?
আমি বললাম, পার্ক স্ট্রিটের দিকে গেলে তবু ট্যাক্সির চেষ্টা করা যেতে পারে।
শকুন্তলা সঙ্গে-সঙ্গে বলল, চলো, আমরা ওদিকে যাই। তুমি আমাকে তুলে দেবে।
ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে আমার পাশে-পাশে হাঁটতে লাগল শকুন্তলা। বেশিদূর যাওয়া গেল না, হঠাৎ যেন আকাশ থেকে নামল জলপ্রপাত। বৃষ্টি নয় যেন আকাশগঙ্গা। আমরা দৌড়ে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দাঁড়ালাম।
এখানে কাছাকাছি আর গাছ নেই। বৃষ্টির সঙ্গে-সঙ্গে আকাশ একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল, মাঝে-মাঝে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ।
শকুন্তলা বলল, বাজের শব্দে আমার খুব ভয় করে। ছেলেবেলা থেকেই।
শকুন্তলা নিজেই আমার একটা হাত চেপে ধরল। এই প্রথম স্পর্শ।
বাজ সামলাবার কোনও ক্ষমতা নেই আমার, তবু সান্ত্বনা দিয়ে বললাম ভয় নেই, ভয় নেই।
শকুন্তলা বলল, শুনেছি গাছতলায় দাঁড়ালে, গাছের ওপরেই বাজ পড়ে? আমি বললাম, সেটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে। শহরে কত বড়-বড় বাড়ি, টেলিগ্রাফ-ইলেকট্রিকের পোল, ওরাই টেনে নেবে। তুমি গাড়িতেই ফিরে যাবে, শকুন্তলা?
শকুন্তলা বলল, একদম ভিজে যাব যে! এখানেই ভালো।
গাছ মানুষকে আশ্রয় দেয় বটে কিন্তু এমন তীব্র বৃষ্টির দিনে তাও বেশিক্ষণ পারে না।
শকুন্তলা বলল, ভাগ্যিস তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সুনীল! আমার এমন ভয় করছিল— সেদিন এক ঘণ্টা দশ মিনিট একটানা বৃষ্টি হয়েছিল প্রবল তোড়ে। জলে ডুবে ভাসছিল কলকাতার অর্ধেকটা। পরদিন খবরের কাগজে বেরিয়েছিল নানান বিপর্যয়ের কাহিনি।
আমরা দুজনে দাঁড়িয়েছিলাম সেই গাছতলায়, আমাদের কোনও বিপদ হয়নি অবশ্য। ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছিলাম। বৃষ্টি যেন ধোঁয়ার মতন আমাদের ঘিরে ফেলেছিল, আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, আমাদেরও দেখছিল না কেউ। বেদব্যাস যখন সত্যবতীকে সম্ভোগ। করতে চেয়েছিলেন, তখন নৌকার চারদিক ঘিরে ফেলেছিলেন কুয়াশায়। আমাদের দুজনেরও যেন সেইরকম অবস্থা। তবে সম্ভোগ-টম্ভোগ কিচ্ছু না। শকুন্তলা শীতে কাঁপছিল থরথর করে, সেইজন্য আমি তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সে আমার কাঁধে মাথা রেখেছিল। চুমু খেতে চাইলে আপত্তি করত কি না কে জানে! আমি সাহস করিনি, তাকে কোনও প্রেমের কথা তো বলিনি কখনও, ওই অবস্থায় বলাও যায় না, আর প্রেমের কথা কিছু না বলে চুমু খাওয়াটা অতি বাজে ব্যাপার। শকুন্তলা যে আমার ওপর ভরসা করেছিল, আমার কাঁধে মাথা রেখেছিল, তাতেই আমি কুড়িটা চুম্বনের চেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি। দুজনের শরীরে নিবিড় স্পর্শ, আমরা খুব কাছাকাছি, শকুন্তলার এত কাছাকাছি কখনও আসব, স্বপ্নেও ভাবিনি।
তারপর কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের অমন চমৎকার ক্লাবটা ভেঙে গেল। নমিতাদি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তাঁর চিকিৎসার জন্য গগনদা তাঁকে নিয়ে গেলেন বম্বে। এক মাসের মধ্যে শকুন্তলা চলে গেল অক্সফোর্ডে পড়তে, দীপক আর সুব্রত দুজনেই গেল জার্মানি।
শকুন্তলার সঙ্গে আর মাত্র দু-একবার দেখা হয়েছিল আমার। বিদেশ যাওয়ার আগে আরও অনেকের সঙ্গে আমাকেও নেমন্তন্ন করেছিল ওর বাড়িতে। ওই বৃষ্টির দিনের ঘনিষ্ঠতার জন্যই নেমন্তন্নটা পাওয়া, নইলে ওর কাছের লোকদের মধ্যে আমি পড়ি না। শকুন্তলার ব্যবহারে অবশ্য আর তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। ছিল শুধু কৃতজ্ঞতা।
বিদেশেই বিয়ে করে সেটল করে গেছে শকুন্তলা। আর তার সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রশ্ন নেই। সেজন্য আমার কোনও হা-হুতাশও নেই। শকুন্তলার কাছ থেকে কিছুই প্রাপ্য ছিল না আমার। তবু যে এক সন্ধেবেলা ওকে এত কাছে পেয়েছিলাম, সেটাই আমার কাছে একটা পুরস্কারের মতন।
রেড রোড থেকে পার্ক স্ট্রিট যাওয়ার রাস্তাটায় সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে আমি মাঝে-মাঝে। দাঁড়াই। এই গাছটার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অনেক মানুষ যেমন মন্দিরে যায়, এই গাছটা আমার কাছে সেরকম একটা মন্দির। সেই কৃষ্ণচূড়ার নীচে আমি একা-একা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, অনুভব করি শকুন্তলার শরীরের সান্নিধ্য। আমি তার ওপর কোনও জোর করিনি, সে নিজে আমার হাত ধরেছিল। সে মাথা রেখেছিল আমার কাঁধে। এ এক বিচ্ছেদের কাহিনি। ঠিক শকুন্তলার সঙ্গে নয়। শকুন্তলাকে আমি নিজের করে পাব, তা তো আশাও করিনি। সেই এক বৃষ্টি সন্ধের মধুর স্মৃতিই যথেষ্ট। কিন্তু একদিন রেড রোড থেকে পার্ক স্ট্রিটের দিকে যেতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার বুকে যেন হাতুড়ির ঘা লাগল। সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটা নেই। কেউ কেটে ফেলেছে। একেবারে গোড়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে কোনও শয়তান। সেই শয়তানই শকুন্তলাকে আমার জীবন থেকে একেবারে কেড়ে নিয়ে গেল!