সেই আমি
ষাট বছর বয়সে কবিতা লিখিয়াছি। আধ্যাত্মিক কবিতা নয়, রসের কবিতা।
আমার কবিতা কেহ পড়ে না, পত্রিকা-সম্পাদকেরা ছাপিতে চান না; তাই ইদানীং কবিতা লেখা ছাড়িয়া দিয়াছি। শুধু গদ্য লিখি। তবে আজ কবিতা লিখিলাম কেন, তাহার একটা কৈফিয়ত প্রয়োজন।
কাল সকালে চোখে চশমা আঁটিয়া লিখিতে বসিয়াছি, দ্বারের সম্মুখে একটি ছায়া পড়িল। চোখ তুলিয়া দেখিলাম, কেহ একজন আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহার মুখ-চোখ দেখিতে পাইলাম না, কাপড়ের রঙ দেখিয়া বুঝিলাম, স্ত্রী-জাতীয় জীব।
আমার দুটি চশমা; একটি দেখার জন্য, অন্যটি লেখার জন্য। যখন লিখিতে বসি, তখন বহির্জগৎ আবছায়া হইয়া যায়। আমি লেখার চশমা খুলিয়া দেখার চশমা পরিধান করিলাম, তারপর চোখ তুলিয়া দ্বারবর্তিনীর পানে অপলকে চাহিয়া রহিলাম।
সতেরো-আঠারো বছরের একটি কুমারী মেয়ে। বর্ণনার প্রয়োজন নাই; সুশ্রী স্বাস্থ্যবতী সুনয়না মেয়ে, এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে। ভাবভঙ্গিতে সহজ স্বচ্ছন্দতা। কিন্তু আমি যে তাহার পানে নিষ্পলক চাহিয়া ছিলাম, তাহার কারণ তাহার স্নিগ্ধ-মধুর যৌবনশ্রী নয়, অন্য কারণ ছিল।
সে বলিল, ‘আসতে পারি?’
বলিলাম, ‘এস।’
সে আমার টেবিলের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। আমি নাকের উপর চশমাটা ভালভাবে বসাইয়া আরও খানিকক্ষণ তাহাকে দেখিলাম। শেষে বলিলাম, ‘কি দরকার, বল তো?’
সে একটু লজ্জিত হইয়া বলিল, ‘আপনি লিখতে বসেছিলেন, আমি এসে বিরক্ত করলুম!’ লেখার খাতা সরাইয়া রাখিয়া বলিলাম, ‘তা হোক। তোমার নাম কি?’
সে বলিল, ‘আমার নাম মল্লী—মল্লী মিত্র। আমি মা-বাবার সঙ্গে দেশ বেড়াতে বেরিয়েছি, এখানে তিন চার দিন আমরা থাকব। আপনি এখানে থাকেন জানি, তাই কলকাতা থেকে বেরুবার আগে আপনার ঠিকানা জোগাড় করেছিলুম।’
মল্লীকে একটু পরীক্ষা করিবার ইচ্ছা হইল। বলিলাম, ‘বোসো। তুমি কি বেথুন কলেজে পড়ো? আমি একবার বেথুন কলেজে গিয়েছিলাম, অনেক ছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ভাবছি, তুমি হয়তো তাদেরই একজন।’
মল্লী বসিল না; বলিল, ‘না, আমি গোখেলেতে পড়ি। আপনি আমাকে আগে দেখেননি।’
আমি আবার খানিকক্ষণ তাহার মুখখানি দেখিয়া বলিলাম, ‘ওকথা যাক। তুমি আমার মতন একটা বুড়োকে দেখবার জন্যে নিশ্চয় আসোনি। কি চাই বলো।’
তাহার হাতে একটি শ্রীনিকেতনের চামড়ার ব্যাগ ছিল, সে তাহার ভিতর হইতে একটি মরক্কো-বাঁধানো খাতা বাহির করিয়া আমার সামনে রাখিল; বলিল, ‘আমার অটোগ্রাফের খাতায় আপনার হাতের লেখা নেই।’
খাতাটি উল্টাইয়া দেখিলাম, অনেক মহাজনের করাঙ্ক তাহাতে আছে; কেহ উপদেশ দিয়াছেন, কেহ শুধুই দস্তখত মারিয়াছেন
আমি কলম লইয়া নিজের নাম লিখিতে উদ্যত হইয়াছি, মল্লী বলিল, ‘একটু কিছু লিখে দেবেন না?’
কলম রাখিয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করিলাম, শেষে বলিলাম, ‘তুমি কাল বিকেলবেলা আর একবার আসতে পারবে?’
মল্লী বলিল, ‘আসব।’
বলিলাম, ‘আচ্ছা। আমি তোমার জন্যে কিছু লিখে রাখব। আর, দেখ, কাল যখন আসবে, তোমায় খোঁপায় বেলফুলের বেণী পরে এস। বেণী কাকে বলে জানো? এদেশে খোঁপায় পরার মালাকে বেণী বলে।’
সে ক্ষণেক অবাক্ হইয়া আমার পানে চাহিল। হয়তো ভাবিল, লেখকত্ব ও পাগলামির মধ্যে বিশেষ প্রভেদ নাই। তারপর একটু হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া চলিয়া গেল।
তাহার খাতাটি নাড়াচাড়া করিতে করিতে অনেক চিন্তা করিলাম, অনেক হিসাবনিকাশ করিলাম। আঠারোতে আঠারো যোগ দিলে ছত্রিশ হয়, তাহাতে আঠারো যোগ দিলে হয় চুয়ান্ন। ঠিক ধরিয়াছি। মল্লী…বাসন্তী…মিত্র…বসু…গোত্র গোত্রান্তর…দিদিমা…ঠাকুরমা…
তারপর কবিতা লিখিলাম—
তোমার হেরিয়াছিনু একদিন কুঙ্কুম-অরুণিত সন্ধ্যায়
স্মরণ-সরণি ধরি’ আজিও সেদিন পানে মন ধায়।—
তোমার নয়নে ছিল পল্লব-ছায়া-করা স্বপ্ন-মদির সুখ-তন্দ্রা
কবরী ঘেরিয়া সখি ফুটিয়া উঠিয়াছিল মল্লীমুকুল মধুগন্ধা…
কিন্তু আর বেশী কবিতা করিব না, পাঠক-পাঠিকা চটিয়া যাইতে পারেন।
আজ সূর্যাস্তের সময় মল্লী আসিল। তাহার কবরীতে মল্লীমুকুলগুলি একটি একটি করিয়া ফুটিতে আরম্ভ করিয়াছে।
বলিলাম, ‘বোসো।’
মল্লী বসিল, উৎসুক চোখে আমার পানে চাহিল।
বলিলাম, ‘এই নাও তোমার খাতা। কবিতা লিখে দিয়েছি। এখন প’ড়ো না, ফিরে গিয়ে প’ড়ো।’
মল্লী কবিতাটি বহু যত্নে ব্যাগের মধ্যে রাখিল। তখন আমি বলিলাম, ‘তুমি কাল বলেছিলে, আমি তোমাকে আগে দেখিনি। কথাটা ঠিক নয়। আমি তোমাকে আগে দেখেছি।’
মল্লী বিস্ময়োৎফুল্ল মুখে বলিল, ‘দেখেছেন! কবে? কোথায়?’
বলিলাম, ‘সেই যে—নির্জন বালুচরের ওপর দিয়ে ছোট্ট একটি নদী বয়ে যাচ্ছিল, পশ্চিমের আকাশে সূর্যাস্তের হোলীখেলা চলছিল— সেইখানে আমি তোমায় দেখেছিলাম। তোমার মনে পড়ছে না?’
মল্লী স্বপ্নাতুর চক্ষে চাহিয়া বলিল, ‘না, আমার তো মনে পড়ছে না। কবে— কতদিন আগে—?’
মনে মনে আগেই হিসাব করিয়া রাখিয়াছিলাম, তবু হিসাবের ভান করিয়া বলিলাম, ‘চল্লিশ বছর আগে।’
মল্লীর চোখদুটি বিস্ফারিত হইয়া খুলিয়া গেল, তারপর সে কলস্বরে হাসিয়া উঠিল, ‘চল্লিশ বছর আগে! কিন্তু আমার বয়স যে মোটে আঠারো বছর।’
বলিলাম, ‘তা হবে। চল্লিশ বছর আগেও তোমার বয়স ছিল আঠারো। তখন তোমার নাম ছিল বাসন্তী।’
সে উচ্চকিত হইয়া প্রতিধ্বনি করিল, ‘বাসন্তী! কিন্তু বাসন্তী যে আমার—’
‘দিদিমার নাম।’
মল্লী কিছুক্ষণ অধরোষ্ঠ বিভক্ত করিয়া চাহিয়া রহিল, ‘হ্যাঁ। আপনি জানলেন কি করে?’
প্রশ্নের উত্তর দিলাম না, বলিলাম, ‘আমার কাছে তোমার নাম মল্লী নয়, বাসন্তী। কাল তোমাকে দেখেই চিনতে পেরেছিলাম।’
‘আপনি আমার দিদিকে চিনতেন।’
অতঃপর তাহাকে অনেক কথা বলিলাম যাহা লিখিবার প্রয়োজন নাই। কাহিনীতে প্রজনন-বিজ্ঞান বাঞ্ছনীয় নয়। শেষে প্রশ্ন করিলাম, ‘তোমার দিদি ভাল আছেন?’
মল্লী ছলছল চক্ষে বলিল, ‘দু’বছর আগে দিদি মারা গেছেন।’
অনেকক্ষণ পরে কথা কহিলাম। বলিলাম, ‘না। তোমার দিদি বেঁচে আছেন, চিরদিন বেঁচে থাকবেন। আমিও চিরদিন বেঁচে থাকব। তোমার নাতনীর বয়স যখন আঠারো বছর হবে তখনও আমরা বেঁচে থাকব। কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি। — আচ্ছা, আজ তুমি এস। আবার দেখা হবে।’
দেখার চশমা খুলিয়া লেখার চশমা পরিয়া ফেলিলাম। গদ্য লিখিতে হইবে। কবিতার দিন গিয়াছে।
২৬ বৈশাখ ১৩৬৭