ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

সূর্যাস্ত

সূর্যাস্ত

মনোরঞ্জন নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পরেশই আমাকে খবরটা দিল। কী একটা কাজে সে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিল। ফাইল সই করাতে, নাকি বিল পাশ করাতে। গিয়ে দেখে এসেছে চক্রবর্তী সাহেব চেয়ারে এলিয়ে পড়ে আছেন। গলার টাই আলগা করে দেওয়া হয়েছে, মাথার ওপরে পাখা ঘুরছে, তাও গলগল করে ঘামছেন। সকলেই বলাবলি করছে, হার্ট।

মনোরঞ্জন আমার বন্ধু। একসঙ্গেই অফিসের গাড়িতে একটু আগে অফিসে এসেছি দুজনে। আসার সময়ে তাকে খারাপ দেখিনি। রোজকার মতোই হাসছিল, গল্প করছি। হঠাৎ কী হল, কে জানে? আমার ডিপার্টমেন্ট তিনতলায়, মনোরঞ্জনের চারতলায়। মনোরঞ্জন আমাদের কোম্পানির চিফ অ্যাকাউনটেন্ট। বিলেত থেকে সি. এ. করে এসেছে। স্বাস্থ্যও বেশ ভালো।

তাড়াতাড়ি গেলুম চারতলায় তার ঘরে। ঘষা কাচের দরজার বাইরে ছোটখাট একটা জটলা তৈরি হয়েছে। ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য সবাই খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। সাহেব অসুস্থ। একটা কিছু করা দরকার। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লুম। ঘরও খালি নেই। দুচারজন সিনিয়ার অফিসার খবর শুনেই ছুটে এসেছেন। একজন দেখলুম প্রাণপণে টেলিফোন করার চেষ্টা করছেন। কোথায় করতে চাইছেন বোঝা গেল না।

মনোরঞ্জন বিনবিন করে ঘামছে। ওর ঘরে একটা কুলার লাগানো ছিল। কে যেন বলেছিল কুলার শরীরের পক্ষে খারাপ। মনোরঞ্জন সেই কথা শুনে পরের দিনই কুলারটা খুলিয়ে ঘরে পাখার ব্যবস্থা করেছিল। মনোরঞ্জনের চোখ আধখোলা। মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, বেশ কষ্ট হচ্ছে। হয় শ্বাস নিতে, না হয় শ্বাস ছাড়তে। সারা মুখটা কেমন কালচে হয়ে উঠেছে। কোম্পানির ডাক্তার এসে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে বললেন, অবিলম্বে নার্সিংহোমে ট্রান্সফার করুন। আমার খুব ভালো মনে হচ্ছে না।

আমি মনোরঞ্জনের মুখের খুব কাছাকাছি এসে জিগ্যেস করলুম, কি শরীরটা খুব খারাপ লাগছে নাকি তোমার?

এ প্রশ্ন করার অবশ্য কোনও মানে হয় না। প্রশ্নের জন্যেই প্রশ্ন। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি লোকটা ক্রমশই এলিয়ে পড়ছে। ডাক্তার একটু মৃদু ধমক দিলেন, কেন অনর্থক ভিড় করছেন? এঁকে এখুনি নার্সিংহোমে রিমুভ করুন আপনারা।

এতক্ষণে যে ভদ্রলোক টেলিফোনে কসরত করছিলেন, তিনি ফোন নামিয়ে খুব গম্ভীর গলায় বললেন, না: ওঁর স্ত্রীকে পাওয়া গেল না, স্কুলে নেই, কোথায় যেন বেরিয়েছেন, আমি মেসেজ রেখে দিয়েছি, এলেই পেয়ে যাবেন।

হঠাৎ আমার মনে হল, মনোরঞ্জন যদিও আমার বন্ধু, আমার কিন্তু এখন এই মুহূর্তে তার জন্য কিছুই করার নেই। প্রথমত, ঘরে ভিড় না করাই ভালো, দ্বিতীয়ত, কেউ না কেউ তাকে এখনই স্ট্রেচারে চাপিয়ে, অ্যাম্বুলেন্সে করে, কোম্পানির বিরাট নার্সিংহোমে নিয়ে যাবে। তারপর সেখানে যমে মানুষে খেলা চলবে। এমনকী, এই মুহূর্তে মনোরঞ্জনেরও কিছু করার নেই। ওই চেয়ারে শরীরটাকে এলিয়ে রাখা ছাড়া ওর পক্ষে আর কিছুই সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে, চেয়ারে আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে সোজা ওই নোংরা কার্পেটেই নেমে আসবে! দামি সুটফুটের মায়া ছেড়ে! অথচ আমি জানি ওর মতো শৌখিন খুঁতখুঁতে লোক পৃথিবীতে খুব কমই আছে।

বহুক্ষণ সিগারেট খাওয়া হয়নি। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এখানে একটা সিগারেট খাওয়া যায়। মনোরঞ্জন অসুস্থ বলে পৃথিবীর সব কাজ তো আর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না। এই তো এতবড় অফিস, মনোরঞ্জনের পোজিসানও তো কিছু কম নয়, চিফ অ্যাকাউনটেন্ট বলে কথা। অফিসের সকলেরই টিকি বাঁধা তার কাছে। কিন্তু কজন সহকর্মী এসেছেন এই ভীষণ মুহূর্তে; মনোরঞ্জনের দেহের ওপর এই যে জীবন-মৃত্যুর খেলা চলেছে, তাতে কার কী এসে যাচ্ছে! তার বউই বা কী করছে এই মুহূর্তে? কে বলতে পারে। বিলেত ফেরত আধুনিক মেয়ে। ববছাঁট চুল। একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালায়। সাহেব পাড়ায়। কোথায় কোন রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে আছে পার্ক স্ট্রিটে সঙ্গে কে আছে তাই বা কে জানে? এদিকে স্বামী যায় যায়। অনিমেষ ফোন করেছিল ভদ্রমহিলাকে দু:সংবাদটা দেবার জন্যে। অনিমেষের চালচলন কি খুব একটা স্বাভাবিক ছিল, ছিল না। যেন একটু বেশি মাত্রায় গম্ভীর। একটু লোক দেখানোর ভাব ছিল। আসলে মনোরঞ্জন যদি মারা যায়, এই অফিসে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে অনিমেষ। চট করে দু-বছরের মধ্যেই চিফ-অ্যাকাউনটেন্ট হয়ে বসবে। মনোরঞ্জনের বয়েস এমন কিছু বেশি নয়। চাকরিও খুব বেশি দিনের নয়। একেবারেই টপে এসে বসেছে। সাধারণভাবে রিটায়ার করতে, কি ফিনানসিয়াল কন্ট্রোলারের পোস্টে প্রাোমোশান পেতে বেশ সময় লাগত। ততদিন অনিমেষকে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হত। স্কুটারের পেছনে ইয়া স্বাস্থ্য, সেই পাঞ্জাবি বউকে নিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে ফ্রাসট্রেটেড হয়ে যেত। এখন গাড়ি কিনবে। স্ট্যাটাস আরও বাড়বে। বউকে আরও সুখে রাখতে পারবে। চেহারার জলুস আরও খুলবে। ত্বক আরও টান টান হবে। নির্ঝঞ্ঝাটে বংশবৃদ্ধি করবে। অর্থাৎ একজনের মৃত্যু আর একজনের অসীম সুখের কারণ হবে।

সাদা ধবধবে। তার মানে অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়েছে অফিসের সামনে। ঘষা কাচের দরজাটা একজন দু-হাতে ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রইল। স্ট্রেচার ঢুকবে বেরোবে। মনোরঞ্জন শুয়ে আছেন স্ট্রেচারে। ঘাড়টা একদিকে কাত হয়ে আছে। হাত দুটো দেহের দু-পাশে ছড়ানো। অনেক আগে আমি যখন যোগাসন করতুম তখন এইভাবে শবাসনে শব হতুম। স্ট্রেচারের পেছন-পেছন অনিমেষ ও আরও কয়েকজন এগিয়ে চলল। বোধহয় নার্সিংহোম পর্যন্ত যাবে। ওদের মধ্যে একজনকে জানি আমি যার কাছ থেকে মনোরঞ্জন অনেক টাকা পাবে। মেয়ের বিয়ের সময় ধার করেছিল দু-তিন বছর আগে।

সিগারেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

একেবারে শেষ করে, টুকরোটা টুসকি মেরে চারতলা থেকে নীচের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নীচে নামব। মনোরঞ্জনের ব্যাপারে আপাতত আমার আর কোনও ভূমিকা নেই। অনেক উপকারী জুটে গেছে। ভিড় বাড়িয়ে লাভ নেই। বরং সময় নষ্ট না করে হাতের কাজ সেরে ফেলাই ভালো। মনোরঞ্জন আর নো মনোরঞ্জন ডেসপ্যাচ ডকুমেন্টগুলো আজই সব তৈরি করে ফেলতে হবে নয়তো কাল আর কোনও মাল শিপিং হবে না। কোম্পানির ক্ষতি হবে। বড়কর্তা কৈফিয়ৎ চাইবেন। ইন এফিসিয়েন্সির কোনও ক্ষমা নেই। বছরের শেষে ইনক্রিমেন্ট কমে গেলে কার ক্ষতি হবে! কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গেই পা চলতে শুরু করল।

প্রায় দেড়টা বাজতে চলল।

তার মানে লাঞ্চব্রেক। লাঞ্চের আগে আর কাজে হাত দিয়ে লাভ নেই। মনোরঞ্জনের অসহায় চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে। ঘাড়টা একদিকে কাত হয়ে নড়নড় নড়ছে। ঠোঁট দুটো ফাঁক, সারা মুখে কে যেন আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছে। হার্ট সম্বন্ধে বেশ হুঁশিয়ার হতে হবে। বলা যায় না, কখন কী হয়? বেশি দুশ্চিন্তা করা চলবে না। খাওয়া দাওয়ায় ফ্যাটের অংশ কমাতে হবে। আরও বেশি কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। কোনওটাই খুব শক্ত নয়। তবু মানছে কে?

অমল এসে সামনে দাঁড়াল।

কী দাদা চলুন, লাঞ্চে যাই। কী ভাবছেন অত?

চলো যাই। না, তেমন কিছু ভাবছি না।

হার্টের অসুখ খুব হচ্ছে। ছেলে বুড়ো কাউকেই বাদ দিচ্ছে না।

চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালুম। ক্যানটিন ফার্স্ট ফ্লোরে। চক্রবর্তী সাহেব আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সেই কারণেই আপনাকে বোধহয় এত বিমর্ষ দেখাচ্ছে।

লিফটে নামতে-নামতে অমল এই একটা কথাই বলতে পারল। মনোরঞ্জন আমার বন্ধু ছিল ঠিকই, তবে সে অনেক আগে, ছাত্রজীবনে। বড়লোকের ছেলে। ছাত্রদের তো কোনও জাত থাকে না, তাই তখন মেলামেশায় কোনও বাধা ছিল না, চাকরি জীবনে সে আমার দু-তিন ধাপ উঁচুতে, প্রায় ডিরেক্টারদের কাছাকাছি, অফিসে আমরা একটু দূরত্ব বজায় রেখেই চলতুম, কারণ সেইটাই ছিল শোভনীয়।

ক্যানটিনে এই লাঞ্চের সময় সকলকেই প্রায় পাওয়া যায়, রথী-মহারথী থেকে চুনো-পুঁটি সবাই। কাঁটা, চামচ, ছুরি প্লেটে প্লেটে নাচতে থাকে। টেবিলের কানায়-কানায় রঙ-বেরঙের টাই দুলছে। হাতে-হাতে পাট করা রুমাল মাঝে মাঝে আলতো আলগোছে ঠোঁট থেকে লাল কিংবা সসের উদ্ধৃত অংশ মুছে নিচ্ছে। ইংরেজি আর বাংলার ফুটফাট খই ফুটছে।

এই কোণে জানলার ধারে, জোড়া টেবিলে মনোরঞ্জনের স্টেনো হেসে-হেসে সান্যালের সঙ্গে খুব গল্প করছেন। ভদ্রমহিলা আজকাল সান্যালের সঙ্গে খুবই যেন মাখোমাখো হয়ে উঠেছেন। অফিসে এইরকম একটা গুরুতর ঘটনা ঘটে গেল, আজকের দিনটা অন্তত হাসাহাসি না করলেই ভালো হত। যতই হোক মনোরঞ্জন ছিল ইমিডিয়েট বস, জীবনমৃত্যুর সঙ্গে একটা মানুষের টানাপোড়েন চলছে আর ওরা সামনে মুরগির ঠ্যাং রেখে রঙ্গরসিকতা করছে! মানুষ সত্যি অত্যাশ্চর্য জীব! সমাজে বাস করতে হলে অনেক সময় একটু আধটু মুখোশ পরে চলতে হয়।

হাসাহাসি করতে করতে এক সময় আমার দিকে চোখ পড়তেই যেন গম্ভীর হয়ে গেল। হঠাৎ দেখি চেয়ার ছেড়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। কী হল আবার? দেবী কি আমায় ভর করবেন? মনে হচ্ছে সেই রকমই। আগে আগে ভেসে আসছে বেশ দামি সেন্টের গন্ধ। সামনের চেয়ারে বসে মিস ঘোষ বললেন, আপনাকে একটা কথা জানাতে এলুম।

বলুন কী কথা?

সকাল থেকে দেখলাম অনেককেই খবর দেবার চেষ্টা হল। কিন্তু ওঁর বাবাকে একবার খবর দিলে হত না? বৃদ্ধ মানুষ আর ওই একমাত্র ছেলে!

কিন্তু আমি যতদূর জানি, দুজনেরই দীর্ঘদিনের ছাড়াছাড়ি। কী একটা ব্যাপারে পিতাপুত্রে বিশেষ সদ্ভাব ছিল না। সেক্ষেত্রে…

তাতে কী হয়েছে? ছেলের অসুস্থতার খবর বাবাকে জানাতে হবে না?

এসব বিলিতি প্রতিষ্ঠান, বউ ছাড়া আমাদের আর কেউ থাকতে পারে, তা এঁরা মনে করেন না।

প্রতিষ্ঠান যাই মনে করুক, আপনারা কী মনে করেন?

এখানে আমার একলার মতো খাটানো উচিত হবে কি?

দেখুন আমার যা মনে হল আপনাকে জানালাম। বন্ধু হিসেবে আপনার যদি কিছু করার থাকে করবেন।

মিস ঘোষ যেন একটু রেগেই চলে গেলেন। ভদ্রমহিলার চেহারায় বেশ একটা বাঁধুনি আছে। স্পিরিটেড, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। হাসলেও ব্যাপারটা নিয়ে মনে মনে ভাবনা চলেছে।

বিয়ের পরই মনোরঞ্জন বাড়ি ছাড়া। পদ্মপুকুরের অত বড় বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে কোম্পানির দেওয়া কোয়াটার্সেই থাকে। ব্যাপারটা ভাবতেও কেমন লাগে, কিন্তু এটাই তো জীবনের সত্য, যেমন সত্য মনোরঞ্জনের হঠাৎ অসুস্থ হওয়া। থাকগে। কে এখন মনোরঞ্জনের বাবাকে খবর দেবে।

তিনটে নাগাদ অনিমেষ নার্সিংহোম থেকে ফিরে এল। ফিরে এসেই সোজা ডিরেক্টারের ঘরে ঢুকে গেল। কানাঘুষোয় শুনলুম, মনোরঞ্জনের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। সেরিব্র্যাল অ্যাটাক। ডাক্তাররা সন্দেহ করছেন, বাঁচলেও, একটা দিক হয়তো পঙ্গু হয়ে যাবে।

বিকেলের চা খেতে খেতে বিস্তারিত সব শুনলুম। কিন্তু ব্যাপারটা মনোরঞ্জনের এতই ব্যক্তিগত যে মনে সামান্য রেখাপাত করেই সরে গেল, আমি হঠাৎ নিউমার্কেটের কথা ভাবতে শুরু করলুম। ছুটির পর কিছু কেনাকাটার জন্য সুলেখাকে আসতে বলেছি। প্যারালিসিস বড় বিশ্রি ব্যাপার, ভয়ানক পরনির্ভর হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। চা খেলে হার্টের কিছু হয় না তো! বড়বাবু ফাইল সই করাতে এসেছিলেন, জিগ্যেস করলুম। বললেন, না না চায়ে স্যার কফি আছে। হার্টের পক্ষে বরং ভালোই।

কথাটা শুনে খুশি হয়েই সই করে দিলুম। অন্য সময় হলে ভদ্রলোককে একটু ল্যাজে খেলাতুম। নিজের পার্টিকে এত টাকার একটা কাজ দিচ্ছেন! মেয়ের বিয়ে দেবেন সামনের মাঘে। টাকার দরকার। মেয়েটি দেখতে শুনতে বেশ ভালোই। একবার কি একটা ফাংশানে পরিচয় হয়েছিল। ভালো লেগেছিল। ফাইলটা সই করাবার সময় মেয়েটি চোখের সামনে ভেসে উঠল।

চারটে নাগাদ পরেশ একটা অর্ডারের কপি নিয়ে ঘরে ঢুকল। অনিমেষ চিফ অ্যাকাউনটেন্ট হিসেবে কাজ চালাবে। অর্ডারটা পড়ে মনোরঞ্জনের ওপর ভীষণ রাগ হল। কে বলেছিল তাকে হঠাৎ অসুস্থ হতে! অফিস সেটাপের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ এই ধরনের পরিবর্তন এলে মনের ব্যালেন্স ভেঙে পড়ে। এক ধরনের হিংসেতে মন পুড়ে যেতে থাকে। সেদিনের ছেলে অনিমেষ একটা হামবাগ চরিত্রহীনই বলা চলে, কেরিয়ারের তেজি ঘোড়ায় চেপে কেমন টগবগ দৌড়চ্ছে!

হঠাৎ মনে হল মনোরঞ্জনও একটা ঘোড়া। ওকে চাঙ্গা করে তোলাটাই যেন আমার একটা বাজি জেতা। তা না হলে রেসে একটা ঘোড়াই বাজিমাত করে বেরিয়ে যাবে। অনিমেষের সঙ্গে দৌড়বার ক্ষমতা একমাত্র মনোরঞ্জনেরই ছিল! মনোরঞ্জনকে দেখতে যাবার ভীষণ একটা তাগিদ ভেতর থেকে ঠেলতে লাগল! যে তাগিদ এই অর্ডারটা হাতে পাবার আগে আমার ছিল না। নিজের চোখে একবার দেখতে হবে, সে সারবে কি না! যেমন করে হোক তাকে সারাতে হবে।

অনেকেই দেখলুম অনিমেষকে কনগ্রাচুলেশান জানাতে ছুটছে। কাপ-কাপ কফি চলেছে। যেন একটা মহোৎসব! কারুর সর্বনাশ কারুর পোষ মাস। যতই হোক বড়কর্তা, খারাপ লাগলেও একবার যেতে হল। এর মধ্যেই বেশ চিফ চিফ ভাব এসে গেছে। একটু লাজুক হাসি! এ তো সাময়িক পদোন্নতি ভাই। ঈশ্বর করুন, মনোরঞ্জন সুস্থ হয়ে এসে তার চেয়ার দখল করুক। কী যে বলেন, মনোরঞ্জন জন্মের মতো ফিনিশ। এ চেয়ার আপনারই পাকা হবে। অ্যান্ড ইউ ডিজার্ভ ইট। এ চেয়ার সুটেবল ফর দি ম্যান। না না এ ম্যান সুটেবল ফর দি চেয়ার। কনগ্রাচুলেশান মিস্টার তরফদার। এক কাপ কফি মেরে নিজের ঘরে। ফোনে সুলেখাকে জানিয়ে দিলুম, একবার নার্সিংহোমে যাব। আজ তোমার মার্কেটিং থাক।

রাস্তায় নেমেই পশ্চিম আকাশ চোখে পড়ল। বেশ সমারোহ করে সূর্য ডুবতে বসেছে। বিদায়ের সময়ও কত তোমার ঘটা! একটা ট্যাক্সি ছাড়া নার্সিং হোমে যাওয়া যাবে না। অন্য কোনও যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। একটা দুটো ট্যাক্সি যাচ্ছে। সব ভরতি। একটা ফাঁকা ছিল। মিটার ফ্ল্যাগ নামানো, কিছুতেই থামল না। আধঘণ্টা নাচানাচি করে, মনোরঞ্জনকে দেখতে যাওয়ার উৎসাহে ভাটা পড়ল। মনোরঞ্জনের চেয়ারে অনিমেষকে তেমন বেমানান লাগল না। চিফ অ্যাকাউনটেন্ট হয়েছে হোক। আমার কী! আমি তো আর হতুম না। চেষ্টা করলেও হত না। আমার সে যোগ্যতা নেই।

হাঁটতে হাঁটতে স্ট্র্যান্ড ধরে, গঙ্গাকে বাঁয়ে রেখে ফোর্টের দিকে যেতে যেতে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে। জীবন কত সবুজ ছিল! চোখ কত নীল ছিল! সেই জীবনটাকে যদি আবার ফিরে পেতুম! এখন যেন একটা বকাটে ছেলের হাত ধরে বেড়াতে বেরিয়েছি! অপবিত্র একটা কিছুকে যেন বাহারি মোড়কে মুড়েছি।

এদিকে আমার উদ্দেশ্যই ছিল একটা খালি বেঞ্চিতে দুদণ্ড বসে মনটাকে একটু জুড়িয়ে নেব। বড় জ্বলছে। আমার নিজের স্বপ্ন সব অন্যের জীবনে পূর্ণ হচ্ছে। মনোরঞ্জন বন্ধু ছিল। মাঝে-মধ্যে আবদার করলে একটু আধটু সুযোগ সুবিধে দিত। আমার খোঁটো নড়ে গেল। এখন অনিমেষের যারা পেটোয়া তাদেরই বোলবালা চলবে। এই হয়। কিং ইজ ডেড, লং লিভ দি কিং।

ওয়াটার গেটের কাছাকাছি এসে দেখলুম একটা ক্রিম রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভারের সিটে বসে আছেন এক ভদ্রমহিলা। ববচুল পেছন থেকে দেখলেও চেনা-চেনা মনে হল। গাড়িটার দিকে আর একটু এগোলুম, ফিগারটা এবার স্পষ্ট হল। একটু অবাকই হলুম। মনোরঞ্জনের স্ত্রীকে এখন এখানে দেখব স্বপ্নেও ভাবিনি। দু-একবার পার্টিতে দেখেছি। চিনতে ভুল হয়নি। কাছে এগিয়ে গেলুম।

মিসেস চক্রবর্তী আপনি?

ভদ্রমহিলা এমনভাবে তাকালেন, যেন দেখেও দেখছেন না। পরে চিনতে পারলেন। তখন আমি বললুম, শুনেছেন তো, মনোরঞ্জন?

হ্যাঁ, দেখেও এলুম।

এখানে একা-একা মন খারাপ করে কী করবেন? মানুষের তো কোনও হাত নেই।

না না, মন খারাপের কী আছে? অসুখ-বিসুখ তো মানুষকে তাড়া করবেই। পৃথিবীতে বাঁচা মানেই সব রকমের সম্ভাবনার জন্যে প্রস্তুত থাকা।

তা হলে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কি একটু জিরিয়ে নেবার জন্যে? না, মনটাকে ফ্রেশ করে নেবার জন্যে

না না, ফ্রেশ-ট্রেশ নয়। আমার কি এত সময় আছে? আটকে পড়েছি, আমার এখন দুটো সমস্যা। প্রথম সমস্যা, গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। সঙ্গে আমার স্কুলের একটি ছেলে ছিল। তাকে পাঠিয়েছি, কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে এ. এ. ই. আইতে একটা ফোন করার জন্যে। দ্বিতীয় সমস্যা হল, বাড়ি ফেরার সমস্যা। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের দুটো চাবি। একটা থাকত আমার কাছে আর একটা থাকত ওর কাছে। আমার চাবিটা আমি সকালেই কোথায় হারিয়েছি। ওর চাবিটারও কোনও হদিস পাচ্ছি না। ব্যাগে নেই, পকেটে নেই। ও তো কথাও বলতে পারছে না। জিগ্যেস করেও উত্তর পাব না। আমাকে একেবারে হেল্পলেস করে দিয়েছে, সারারাত কী যে হবে?

একটা ডুপ্লিকেট চাবির ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে তো মুশকিল।

এই ব্যাপারে আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন।

চলুন দেখি কী করা যায়।

একটু অপেক্ষা করুন গাড়িটা ঠিক হয়ে যাক, তা না হলে যাবেন কী করে? এমন মুশকিলে ফেলল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে।

আমি তো নার্সিংহোমেই যাচ্ছিলুম। ট্যাক্সি পেলুম না বলে যাওয়া হল না।

ওখানে গিয়ে কোনও লাভ নেই। শুধু-শুধু উত্যক্ত করা। এখন যা করার ডাক্তাররাই করবেন। ওর আত্মীয়-স্বজনেরা এসে এখন লোক দেখানো উহু, আহা করে পরিবেশটাকে এমন গ্রাম্য করে তুলেছেন নিজের পরিচয় দিতেও লজ্জা করে। আমি তাই চলে এলাম। ধৈর্যই হল সবচেয়ে বড় কথা।

কথায় কথায় পশ্চিমের আলো দপ করে নিবে গেল। আকাশের নীচে ছায়া ছায়া অনেক মানুষ জলের কিনারা ঘেঁষে বসেছে। সবুজ মাঠের এখানে-ওখানে ওরকম সব ছায়া-ছায়া জটলা। আমার সামনে এখন তিনটে সমস্যা। গাড়িটা ঠিক করতে হবে। ঠিক হলে মিসেস চক্রবর্তীকে একটু হেল্প করতে হবে। তারপর সেই দুটো হারানো চাবির বিকল্প আর একটা চাবির ব্যবস্থা করতে হবে, তা না হলে অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকা যাবে না। আর ঢুকতে না পারলে ভদ্রতার খাতিরে আমিও বাড়ি ফিরতে পারব না। এইসব ভাবার সঙ্গে-সঙ্গেই নিজেকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হল। মনে হল কত যুগ যেন অপেক্ষা করে আছি। ইঁদুরের মতো কলে আটক হয়ে পড়েছি। কখন যে মুক্তি পাব কে জানে! পুরো ব্যাপারটার মধ্যে নিজের কোনও স্বার্থ যদি জাড়িয়ে থাকত তা হলে হয়তো এতটা খারাপ লাগত না।

ঠিক এই সময়ে মিসেস চক্রবর্তী গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় ডান পা রেখে নামতে চাইলেন। একটা সুডৌল পা বেরিয়ে পড়ল শাড়ির আড়াল থেকে। সিল্কের কাপড়ের আঁচল খসে পড়ল কোলে। একবার মাত্র তাকিয়ে দেখলুম। আর সঙ্গে-সঙ্গে মনে হল গাড়িতে পেছন ঠেকিয়ে অনির্দিষ্টকাল দাঁড়িয়ে থাকাটা বোধহয় তেমন কষ্টকর নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *