1 of 2

সূত্রসন্ধান

সূত্রসন্ধান

ছেলেবেলা থেকেই–অর্থাৎ যখন আমার বয়স ছয় কি সাত-তখন থেকেই আমার ভিতরে একরকমের অদ্ভুত অনুভূতি মাঝে-মাঝে দেখা দিত। এই অনুভূতি কীরকম তা স্পষ্ট করে বোঝানো খুব শক্ত। তবে একথা বলা যায় যে, অনুভূতিটা এক ধরনের অবাস্তবতার। একা-একা থাকলে হঠাৎ কখনও চারদিকে চেয়ে মনে হত–আমার চারদিকে যা রয়েছে–গাছপালা কিংবা ঘরের দেওয়াল, আসবাব, কিংবা মানুষ–এরা সবাই অবাস্তব, মিথ্যে। এসব জিনিসপত্র, গাছপালা এরা কোনওটাই সত্য নয়। এরকম ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ মাথা গুলিয়ে উঠত। ওই চিন্তা মুহূর্তের মধ্যে প্রবল আকার ধারণ করত, মনে হত–এই পৃথিবীতে যা আমি চোখের সামনে দেখছি তা সবই এক অদ্ভুত উদ্ভট অবাস্তব ব্যাপার, এসবের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই। আমি এই পৃথিবীর কেউ না। এই প্রত্যক্ষ বস্তুগুলি, এই আলো-অন্ধকার এই প্রিয়জন এসবই যেন আমার চারদিকের এক মিথ্যে, অলীক আবরণ মাত্র। ভাবতে ভাবতেই আমার শরীর যেন ঊধ্বদিকে উঠতে থাকত, গা শিউরোত। আমার মনে হত এক ভীষণ যন্ত্রণায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আমার মন কিছুতেই এই চিন্তা তখন আর করতে চাইত না, কিন্তু চিন্তা তখন আমাকে ছাড়তও না। বেশ কয়েকটা ঝাঁকুনি দিত আমাকে। কিছুক্ষণ আমি আমার মধ্যে থাকতাম না। এই অনুভূতি আমার শরীরে এবং মনে এত প্রকট এবং প্রবলভাবে দেখা দিত যে, আমার বিশ্বাস ছিল এটা আমার অসুখ। সাংঘাতিক ধরনের কোনও অসুখ।

অস্বীকার করা যায় না, এটা একরকমের অসুখই। অবাস্তবতার এই অনুভূতির দার্শনিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। পরবর্তীকালে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের জীবনী পড়তে গিয়ে দেখেছি, তাঁরও অনেকটা এ ধরনের অনুভূতি হত। তিনি তখন দেওয়ালে বা মাটিতে হাত চেপে ধরতেন, শরীরে ব্যথা দিতেন, এবং আস্তে-আস্তে সেই শারীরিক বেদনা তাঁর মানসিক ক্লেশকে উপশমিত করত। এ মুষ্টিযোগ আমার জানা ছিল না। তবে ওই অনুভূতি টের পেলেই আমি জলে ডোবা মানুষের মতো প্রাণপণে মনের ওপরে ভেসে থাকতে চাইতাম। বাস্তবিক ওই সময়ের অভিজ্ঞতা ছিল, যেন। আমি এক অথৈ অনন্ত জলে ডুবে যাচ্ছি।

বছরে এরকম হত দুবার কি তিনবার। প্রথম-প্রথম অনেকদিন আনতে চেষ্টা করতাম। সময়ে ছেলেমানুষি বুদ্ধিবশত আমি ইচ্ছে করেই ওই অনুভূতিটা আনতে চেষ্টা করতাম। ভাবতাম–আচ্ছা, আমার যদি এখন ওরকম হয় তবে কী হবে। এই ভেবে আমি চারদিকে চেয়ে গাছপালা, কী দেওয়াল, কী আসবাব ইত্যাদিকে অবাস্তব, অলীক ভাবতে চেষ্টা করতাম। আশ্চর্য এই যে, চেষ্টা করার সঙ্গে-সঙ্গে আমার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যেত, আমার শরীর হালকা হয়ে যেন ওপরে উঠে যেতে থাকত এবং মনের ভিতরে এক অথৈ কুলকিনারাহীন কালো জল আমাকে গভীরে আকর্ষণ করত। এরকম ভাবে স্থায়ী হত বড়জোর এক-আধ মিনিট। কিন্তু ওই এক-আধ মিনিট সময়েই আমার যন্ত্রণা এবং ভয় চূড়ান্ত জায়গায় উঠে যেত। চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করত। আবার ঘাম দিয়ে বোধটা প্রশমিত হত। আস্তে-আস্তে স্বাভাবিকতা ফিরে পেতাম। শরীর এবং মন ক্লান্ত লাগত।

বয়স বাড়ে। খেলাধুলো, বন্ধুবান্ধব, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা সবই নিয়মানুসারে বেড়ে যায়। বাইরের ব্যস্ততা যখন নিজের মনকে আচ্ছাদন দিয়ে রাখে তখন মন দিয়ে খেলা আপনিই কমে যায়। একটু বয়স বাড়লে আমারও ওই খেলা কমে গিয়েছিল। কমলেও কিন্তু ছাড়েনি। বছরে এক আধবার হতই। বড় ভয় পেতাম। মাকে গিয়ে বলতাম,–মা, আমার মাঝে-মাঝে কীরকম যেন সব মনে হয়।

মা জিগ্যেস করত–কীরকম?

ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারতাম না। মা-ও বুঝতে পারত না, কিন্তু ভয় পেত। বলত–ওসব ভাবিস কেন! না ভাবলেই হয়।

আমি নিজের ইচ্ছায় যে সবসময়ে ভাবতাম তা নয়। আমার আজও মনে আছে যে আমি ইচ্ছে করলেও কে যেন জোর করে আমার ভিতরে ইচ্ছেটাকে তৈরি করে দিত। ভাবতে চাইছি না, তবু আমার ভিতরকার এক অবাধ্য দুরন্ত তোক যেন জোর করে আমাকে ভাবিয়ে তুলছে।

আমার বাবার ছিল রেলের চাকরি। ফলে এক জায়গায় বেশিদিন থাকা আমাদের হত না। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হত। সেইসব জায়গায় সর্বত্র তখন লোকালয় ছিল না। কোনও টিলার ওপরে বা নির্জন জায়গায় বাবা কোয়ার্টার বা বাংলা পেতেন। আমাদের পরিবারে লোকসংখ্যাও ছিল সামান্য। দিদি, আমি, ছোট বোন, ভাই তখনও হয়নি। সেইসব নির্জন জায়গায় আমার বন্ধু জুটত কমই। যা-ও জুটত তারা ছিল কুলিকামিন বা বাবুর্চি বেয়ারার ছেলেরা। তারা আমার সঙ্গী হয়ে উঠত, বন্ধু হতে পারত না। ফলে মনের দিক থেকে একাকিত্ব কখনও ঘুচত না। পৃথিবীতে বন্ধুর মতো জিনিস খুব কমই আছে। যার সৎ বন্ধু থাকে তার অনেক মনের অসুখ ভালো হয়ে যায়। সেই বয়সে বন্ধুভাগ্য আমার ছিলই না। ফলে ওই মানসিক একাকিত্ব আমার ওই অসুখটাকে বাড়িয়েই তুলত। কিছু করার ছিল না। গুরুজনদের বুঝিয়ে বলতে পারতাম না বলে সেই যন্ত্রণা একা সহ্য করতে হত।

ক্রমে বড় হয়ে উঠতে-উঠতে আত্মসচেতনতা বাড়তে লাগল। খেলাধুলো করি, স্কুলে যাই, দুষ্টুমি করে বেড়াই। বাইরে থেকে দেখে স্বাভাবিক অন্য ছেলেদের মতোই লাগে আমাকে। কিন্তু ভিতরে-ভিতরে আমার বিশিষ্ট এক ‘আমি’ তৈরি হতে থাকে। সব মানুষেরই যেমন হয়। উল্লেখের বিষয় এই যে, আমার ছেলেবেলাতেই যে ‘আমি’ তৈরি হয়েছিল তার বৈশিষ্ট্য ছিল বিষণ্ণতা, অন্যমনস্কতা, চিন্তাশীলতা একাকিত্ববোধ, নিঃসঙ্গতা। এই ধরনের ছেলেরা সাধারণত বই পড়তে ভালোবাসে। খেলাধুলো বা আমোদপ্রমোদ, লোকসঙ্গে, ভিড়ে তেমন আনন্দ পায় না। বই পড়তে-পড়তে বলগাহীন কল্পনাকে ছেড়ে দেওয়া, অবাধ চিন্তার রাজ্যে প্রিয় নির্বাসন-এর চেয়ে স্বাদু আমার কিছুই ছিল না। কাজেই অনিবার্যভাবে বাস্তবতাবোধ, কর্মপ্রিয়তা বা কোনও কাজে পটুত্ব কমে যেতে লাগল। কল্পনাবিলাসীর ভাগ্য যেরকম হয়ে থাকে। চিন্তার রাজ্যে যে রাজা উজির, বাস্তবক্ষেত্রে সে প্রায় অপদার্থ।

খেলাধুলোয় আমার খানিকটা দখল ছিল। বলে শট মারতে ভালোই পারতাম, ক্রিকেটে ব্যাট চালানো আনাড়ির মতো ছিল না, হাইজ্যাম্প-লংজাম্প বা দৌড়ে পটুত্ব না থাক, অভ্যাস ছিল। অনুষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক সম্মেলনে কবিতা আবৃত্তি করতাম। কিন্তু সেগুলো ছিল আমার মনের উপরিভাগের ব্যাপার। মনের গভীরতর স্তরেও বাইরের এসব দৌড়লাফ আবৃত্তি তরঙ্গ তুলত। সেখানে ছিল এক অনপনেয় স্পর্শকাতরতা, আত্মচিন্তা, অভিমান। বাইরের জীবনের যত অকৃত্রিম রাগ ক্ষোভ সব সেখানে গিয়ে বাসা বাঁধত। এবং সমস্ত আঘাতই সেখানে বারংবার কল্পনার রাজ্যের দরজার পাল্লা উন্মোচিত করে দিত। বাইরের জগতের ব্যর্থ ‘আমি’ সেই কল্পনার জগতে আশ্রয় পেতাম। কল্পনার জগতে বহু মানুষেরই বিচরণ–তবে তার তারতম্য আছে। নিজেকে নিয়ে যার যত চিন্তা, অস্বস্তি, আত্মমগ্নতা তার বাস্তববুদ্ধি তত কম, আঘাত সহ্য করার শক্তি সামান্যই, আত্মনির্ভরশীলতা প্রায় শূন্য। আমারই সেই বিপদ দেখা দিতে লাগল। আমি আরও বেশি করে বই আর বইয়ের মধ্যে ডুবে যেতে লাগলাম। হাতে যখন বই থাকত না তখন মনে কল্পনা থাকত।

যে অনুভূতির কথা বলছিলাম তার বীজ সম্ভবত নিহিত ছিল এখানেই। চারিদিকের পৃথিবী এবং ঘটনাপ্রবাহে অবগাহন না করলে মনটা কেবলই শিকড়হীন গাছের মতো নিজের চারধারে পাক খেয়ে শুকিয়ে কুঁকড়ে যায়। বাস্তবতার জ্ঞানবর্জিত মন হচ্ছে আত্মভুক। নিজের মজ্জা-মাংস রক্ত ছাড়া সে আর খাদ্য-পানীয় পাবে কোথায়? ফলে আর দেহের পুষ্টি এবং লাবণ্যসঞ্চার হচ্ছিল না। অল্পবয়সেই আমার মুখেচোখে বিষণ্ণতা ভর করতে লাগল।

মাঝে-মাঝে কাজে-অকাজে বাল্যকালের সেই অনুভূতি দেখা দেয়। সেই অনুভূতির বিস্ময়বোধ আমাকে ভীত, চঞ্চল করে তোলে। সমাধান পাই না। বাল্যকাল চলে গিয়ে কৈশোর আসছে–টের পাচ্ছি। দেহটি যষ্টির মতো সরল সোজা ওপরে উঠে যাচ্ছে, রোগা হাড়সার দেহ, অন্যমনস্ক, চিন্তাশীল, রুগ্ন এক কিশোর। বই পড়তে ভালোবাসে, কিন্তু পড়ার বইতে তার অনীহা। অর্থাৎ যা কিছু কাজের কাজ তার কোনওটাতেই আগ্রহ নেই।

মনে আছে আলিপুরদুয়ারে এক স্পোর্টসে নাম দিয়েছি। অঙ্ক রেস। দর্শকদের মধ্যে আমার মা-বাবা ছোট দুটি ভাইবোন আর দিদিও রয়েছে। তাদের জন্যই বড় লজ্জা করছিল আমার। দৌড় শুরু হল। কুণ্ঠা জড়ানো পায়ে দৌড়ে গিয়ে কাগজের ওপর লেখা তাঁকে উপুড় হয়ে পড়লাম। যোগ শেষ করে সবার আগে উঠেছি, দৌড়ে যাচ্ছি। নিশ্চিত ফাস্ট, কেউ ঠেকাতে পারবে না। হঠাৎ মনে হল, কাগজে নাম লেখা হয়নি। নাম লেখা না হলে বিচারকর্তা বুঝবে কী করে যে অঙ্কটা আমিই করেছি! ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ফিরে যাব? নামটা লিখে নিয়ে আসব? ভাবতে-ভাবতেই আর-একটা ছেলে উঠে দৌড়ে এল। দেখতে পেলাম আমার প্রথম স্থান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অথচ কাগজে নামও লেখা হয়নি। এই কয়েক মুহূর্তের দ্বিধা–সঙ্কোচের সুযোগে ছেলেটা আমাকে পিছনে ফেলে দৌড়ে গিয়ে তার কাগজ জমা দিল। তখন বোকার মতো অগত্যা আমিও গিয়ে নামহীন কাগজ জমা দিলাম। অঙ্ক রেসের নিয়ম অনুযায়ী অঙ্ক ভুল হলে ফার্স্ট হবে না। অঙ্ক ঠিক হওয়া চাই। অত প্রতিযোগীর মধ্যে আমরা যে প্রথম দুজন, তাদেরই অঙ্ক ঠিক হয়েছিল। ফার্স্ট হল সেই ছেলেটা, আমি সেকেন্ড। পরে জানতে পারলাম যে, সেই ছেলেটাও কাগজে নাম লেখেনি। কিন্তু তার বাস্তবুদ্ধি প্রখর বলে সে নাম লেখার কথা ভাবেওনি। আমি ভাবতে গিয়ে তার অনেক আগে অঙ্ক শেষ করেও পিছিয়ে পড়েছি। সেদিনই বুঝতে পারি, আমার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে দ্বিধা। সেই অঙ্ক–রেসের শেষে মা খুব হতাশ হয়ে বলেছিলেন–সবার আগে তুই উঠেছিস দেখে ভাবলাম যাক রুনু এবার ফাস্ট হবে। ওমা মাঝরাস্তায় দেখি ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস হাঁ করে। কী অত ভাবছিলি? বলে রাখা ভালো যে সেই রেসে সেকেন্ড প্রাইজ ছিল না।

পরবর্তীকালে বহুবার দেখেছি সবার আগে উঠেও দৌড় শেষ করতে পারছি না। পৃথিবীতে সঠিক জায়গায় নিজেকে নিয়োগ করতে হলে খানিকটা আবেগহীন দ্বিধাশূন্য নিষ্ঠুরতা দরকার। জানা দরকার বাস্তব কলাকৌশল। নিজের ভুলত্রুটি নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে সর্বদা নিজেকে এগিয়ে রাখার চেষ্টাই ভালো। কিন্ত তা তো হল না।

বাঙালি ছেলেদের যে ভাবপ্রবণতার কথা শোনা যায় তা মিথ্যে নয়। আমার ভিতরে এই ভাবপ্রবণতার বাড়াবাড়ি বরাবর ছিল। সহজ আবেগে উদ্বেলিত হই, সহজ দুঃখে কাতর হয়ে পড়ি। চোখের সামনে পুজোবাড়ির বলি দেখে ভয়ঙ্কর মন খারাপ হয়। মনের এই ন্যাতানো স্বভাব থাকলে বড় হওয়ার পথে নানারকম বাধাবিপত্তির সৃষ্টি হয়। ভাবাবেগ জিনিসটা খারাপ নয়, অনেক আঘাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে। কিন্তু ভাবাবেগের নিজস্ব কিছু আঘাত আছে তা থেকে আত্মরক্ষা করা খুব দুরূহ।

ছেলেবেলা থেকেই আমি রোগা। হিলহিলে শরীর, বারোমাস পেটের অসুখ, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড-একটা-না-একটা কিছু লেগেই থাকত। বাড়িতে রেলের ডাক্তারদের আনাগোনার বিরাম ছিল না। যখন বড় হয়েছি তখনও সেইসব ছেলেবেলায় আমার চিকিৎসা যাঁরা করেছিলেন সেইসব ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা হলে তাঁরা বলতেন–কেমন আছিস রে?

–ভালো।

–খুব ভুগিয়েছিলি ছেলেবেলায়।

মা-বাবার আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল খুব। আমার দশবছর বয়স পর্যন্ত আমি ছিলাম মা বাবার একমাত্র ছেলে। আমার দু-বছরের বড় দিদি, আটবছরের ছোট বোন, কাজেই দশবছর বয়স পর্যন্ত বাড়ির সবটুকু আদর আমি নিংড়ে নিতাম। বড় মাছ, দুধের সরটুকু, ভালো জামা কাপড় সবই পেতাম। সেই একমাত্র ছেলে কীরকম হবে না হবে বাঁচবে কি বাঁচবে না-এই নিয়ে মা-বাবার ছিল নিরন্তর ধুকপুকুনি। বাবা অনেক সাধু-সন্ন্যাসীকে বাসায় আনতেন, মা-ও জ্যোতিষ বা পশ্চিমা সাধু দেখলে ডেকে আনতেন। দাতাবাবা, আমেরিকাপ্রবাসী রামকৃষ্ণ মঠের সন্ন্যাসী, ভিখিরি সাধু কত এসেছে গেছে। তাদের অনেকে আমার হাত বা কোষ্ঠী বিচার করে বলেছে-এর সন্ন্যাসের দিকে টান। এক কোনও সুন্দর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। নেপালের রাজজ্যোতিষী পরিচয় দিয়ে এক কালা জ্যোতিষ আসতেন আমাদের বাড়িতে। আমাকে দেখে বলেছিলেন–এই ছেলে মাঘ মাসে মারা যাবে।

বাবা ভীষণ ঘাবড়ে বললেন–কিন্তু আমি তো কোনও পাপ করিনি।

জ্যোতিষ মাথা নেড়ে বললেন–তবু মরবেই।

–উপায়?

–উপায় আর কী? মাদুলি। বাবা আর আমি দুজনেই দুটো মাদুলি ধারণ করলাম। আমি মরলাম না।

যা বলছিলাম, আমার দশবছর বয়সের সময়ে আমার ছোট ভাই হয়। তাতে অবশ্য আমার আদর কমেনি। রোগেভোগা ছেলে বলেই বোধহয় বরাবর সমান তালে আদর পেয়ে এসেছি। আজও পাই। আমার রোগও হত এক-একটা মারাত্মক। মাল জংশনে সেবার হল সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া। ঘোর জ্বরের মধ্যে দেখেছি দুধারে উঁচু পাহাড়। দুই পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে। দড়ি দোলনার মতো টাঙানো হয়েছে। সেই দড়িতে আমি বসে আছি। নীচে গভীর-গভীর এক খাদ। সেই খাদে পাহাড়ি নদী বয়ে যাচ্ছে। একটু দূরে একইরকম আর-একটা দোলনা। সেই দোলনা থেকে আমাদেরই পরিচিত এক ভ ভদ্রলোক বন্দুক হাতে আমার দিকে গুলি ছুড়ছেন। গুলি গায়ে লাগছে না। দোলনাটা দুলছে। আমি দু-হাতে দোলনার দড়ি ধরে চেঁচাচ্ছি ভয়ে। এ তো স্বপ্নের দৃশ্য। ওদিকে বাস্তবে আমার জ্বর তখন একশো ছয়ের ওপর। মাথায় তীব্র রক্তস্রোত জমা হচ্ছে। যে-কোনও মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে। মাল জংশন তখন ছোট জঙ্গলে জায়গা। ডাক্তার বদ্যি ওষুধ কিছু পাওয়া দুষ্কর। রেলের ডাক্তার বক্কর খান সুচিকিৎসক নন। তাঁর ওপর কারও ভরসা নেই। ভাগ্যক্রমে বাবা বাসায় ছিলেন। বক্কর খানকে সময় মতোই খবর দেওয়া হল। তিনি যখন এসে পৌঁছলেন তখন আমার খিচুনি উঠে গেছে। বক্কর খান অন্য রোগের চিকিৎসা জানুন বা না জানুন, ম্যালেরিয়াটা খুব ভালো চিনতেন। আবার অবস্থা দেখেই কোন ধরনের ম্যালেরিয়া তা বুঝতে পেরেই চিকিৎসা শুরু করেন। আমি মৃত্যুর কয়েকঘণ্টা দূরত্ব থেকে ফিরে আসি।

এইরকম রোগে ভুগে–ভুগে আমার শরীর যেমন নষ্ট হয়েছিল, তেমনই নষ্ট হয়েছিল আমার মন। মনের জোর কাকে বলে তা জানতামই না। অল্পে ভয় পাওয়া, হাল ছেড়ে দেওয়া, আত্মবিশ্বাসের অভাব–আমি এগুলোই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এসব নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। বাস্তবে অপদার্থ বলেই বোধহয় মনটা দিন–দিন অবাস্তব কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। আমার বাস্তবের অপদার্থতা কল্পনা দিয়ে পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করতাম। কল্পনার রাজত্বে আমি ছিলাম বীর, সাহসী, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক মানুষ। কল্পনায় বাস করার, বিপদ হচ্ছে এই, কল্পনার বাইরের এই বাস্তবজীবনে সামান্যতম দুঃখ বেদনা অপমান সহ্য করার মতো, ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার মতো জোর অবশিষ্ট থাকে না। কল্পনাপ্রবণ মানুষ তাই দিশেহারা হয়ে যায় সামান্য বিপদ বা দুঃখে। কিছু ঘটলেই তার মনে ঝড় ওঠে এবং দীর্ঘকাল সেই ঝড়ের প্রতিক্রিয়া থেকে যায়।

স্কুলে পড়ার সময়ে আমাকে ঘর ছেড়ে অচেনা ছেলেদের মধ্যে যেতে হল। সেখানে এল মানিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন। হুল্লোড়বাজ ছেলেরা খ্যাপায়, পিছনে লাগে, অশ্লীল কথা বলে, ঝগড়া করে, গাল দেয়। মাস্টারমশাইরা নিষ্ঠুর। মারকুটে, স্নেহহীন এই পরিবেশে মন অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্কুলে যাওয়ার নামে গায়ে জ্বর আসে। টিফিনে চাকর খাবার নিয়ে যায় দেখে ছেলেরা খ্যাপায়। আমার খেতে লজ্জা করে। স্কুলে যাওয়ার পথে রেলগাড়ির শান্টিং দেখে সময় নষ্ট করি। দেরি হয়ে যায়, বাড়িতে ফিরে এসে মাকে বলি–স্কুল বসে গেছে। ঢুকতে দিল না।

ঢুকতে দিচ্ছে না, আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। প্রচণ্ড এক প্রতিযোগিতার জগতে আমি ঢুকতে পারছি না। ঢুকতে না পাওয়ার সেই প্রথম বোধ। ঠিকই টের পেয়েছিলাম, প্রতিদ্বন্দ্বীময় এক অদ্ভুত রূঢ় জীবন সামনে পড়ে রয়েছে।

আমার জীবন এইভাবে শুরু হয়েছিল, ভয়ে, বিষণ্ণতায়, অনিশ্চয়তার সঙ্গে।

ক্রমে অবশ্য পৃথিবীকে সয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু জানতাম, সম্মুখস্থ যুদ্ধে আমার নিশ্চিত হার, হারতে-হারতেই বেঁচে থাকতে হবে, পৃথিবীতে আমার অস্তিত্বের কোনও গভীরতা থাকবে না।

যখন আমরা আমিনগাঁওতে থাকি তখন আমাদের বাসাটি ছিল ঠিক ব্রহ্মপুত্রের ধারে একটা টিলার ওপরে। খাড়া টিলা, তার নীচে ব্রহ্মপুত্র বাঁক নিয়েছে। ওপাশে নীলপর্বত, দুই পাহাড়ের মাঝখানে ব্রহ্মপুত্র সফেন গর্জন করে বয়ে চলে। ফেনশীর্ষে জলরাশি গম্ভীর ক্রোধের ধ্বনি বর্ষাকালে দুই পাহাড়ের মাঝখানের শূন্যতায় প্রতিধ্বনি তোলে ভয়াবহ। ফেরি যখন পেরোয় তখন তীর ঘেঁষে অনেকটা সাবধানে উজিয়ে স্রোত ধরে ভাঁটিয়ে গিয়ে ওপারের জেটিতে লাগে। নৌকো চলে খুব কম, বেচাল হলেই নৌকো ওলটায়। আমার বয়স সে সময়ে বছরে তেরো, সেই বয়স যখন মা-বাবার ওপর বন্ধু বা প্রিয়জনের ওপর নানা তুচ্ছ কারণে রাগ বা অভিমান বুকের পাঁজরা ভেঙে উঠে আসতে চায়। মাকে খুব ভালোবাসতাম। সেই ভালোবাসার মধ্যে আবার নির্দয় প্রতিশোধের চিন্তাও থাকত। মার ওপর রাগ করে একদিন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে টিলা থেকে নামলাম। ইচ্ছে বাড়ি ছেড়ে পালাব, খুব দূরে কোথাও চলে যাব। অনেকবার এমন ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু সাহস হয়নি। রাস্তায়–রাস্তায় ঘুরে সন্ধে পেরোলেই ঠিক বাড়ি ফিরে গেছি। বরাবর, কিন্তু এবারের রাগটা একটু চড়া, কী করছি ভেবে দেখিনি।

সকালের ফেরি ছেড়ে গেছে। বর্ষার ভয়াবহ নদী মাতালের মতো টলতে টলতে যাচ্ছে। তার জলের দোলা দেখে প্রাণ গম্ভীর হয়ে যায়। তীরে কয়েকটা নৌকো বাঁধা। সকালের স্টিমার ধরতে

পারা কিছু লোক ওপারে পাণ্ডুতে যাবে বলে জড়ো হয়েছে। আমি তাদের দলে ভিড়ে গেলাম। কোথায় যেতে চাই এখনও তা স্পষ্ট নয়, যাব, চলে যাব চিরদিনের মতো এইটুকুই জানি। হয়তো সন্ন্যাসী হয়ে যাব, হয়তো হব মস্ত মানুষ। কে জানে আমার বুকে থমথমে অভিমান আছে, আছে। প্রতিশোধস্পৃহা। আর কিছু নেই, তবু ওইটুকু তখনকার মতো যথেষ্ট।

আমাদের টিলাটা বেড় দিয়ে নৌকো চলল প্রথমে উজানে। অনেকটা দূর গিয়ে স্রোতে গা ছেড়ে পেছিয়ে আসবে। আসতে-আসতে স্রোতকে ফাঁকি দিয়ে ওপারের ঘাটে বাঁধবে। বিপজ্জনক কৌশল। সাঁতার জানি, কিন্তু আত্মবিশ্বাস নেই, নদীর স্রোত ক্ষুরধার, একধারে বসে জল দেখছি। স্রোতের বেগ নৌকোয় ঝাঁকি দেয়, গুড়গুড় করে কাঁপায়। নৌকো ওঠে, নৌকো পড়ে। মানুষজন। ছবির মতো স্থির বসে, মন চঞ্চল। মাঝিরা ঘেমে যাচ্ছে উজানে নৌকো নিতে। তাদের দাঁতে দাঁত, টান–টান দড়ির মতো হাত-পায়ে ছিঁড়ে আসা ভাব।

অনেকদূর উজানে গেলাম, টিলার ছায়ায়-ছায়ায়, তখনও আমাদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে না। নৌকো যখন স্রোতের মুখ ছাড়ল তখন একটানে ঘুরপাক খেয়ে মাঝদরিয়ায় চলে গেছি। মাঝি হাঁকছে–সামাল! জল নৌকোর কানার সমান। অন্যধার উঁচু হয়ে আছে। পৃথিবীটা সে-সময়ে বাঁকা হয়ে ঝুলে আছে। আকাশ বুকের ওপর। সেই সময়ে দিকের জ্ঞান ছিল না। বেভুল নৌকোটা যে কোনদিকে যাচ্ছে বোঝাবার চেষ্টাও করিনি। নৌকোর কানা আঁকড়ে প্রাণপণে জীবনের সঙ্গে, আয়ুর সঙ্গে লেগে আছি। সাঁতার জানি, কিন্তু আমার কোনও জ্ঞানই যে সম্পূর্ণ নয়। অভিমান ভেসে যায়, ভয়ে চেঁচিয়ে ডাকি ‘মা’।

ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ অলৌকিকভাবে মাকে দেখতে পাই। নীল আকাশের গায়ে একটা টিলার কালচে সবুজ মাথা জেগে ওঠে বাতিঘরের মতো, আমাদের বাসাটার লাল টিনের চাল দেখা যায়। বারান্দায় বাঁশের জাফরি। তার সামনে সিঁড়ির উঁচু ধাপটায় মা দাঁড়িয়ে আছে। সকলের রোদ পড়েছে চোখে। মা হাতের পাতায় চোখ আড়াল করে নিবিষ্ট মনে চেয়ে আছে নদীর দিকে। বিশাল এক অথৈ পৃথিবী তার সামনে। সেই সীমাহীন পৃথিবীর কোন দিকে গেল তার অভিমানী ছেলে! মা নিবিষ্টভাবে, আকুলভাবে দেখছিল, বুক থেকে আটকে থাকা শ্বাসের একটা পাখি বেরিয়ে গেল। নৌকো সোজা হয়ে চলতে থাকে। অভিমান ভুলে গভীর তৃষ্ণায় মার

মূর্তিটার দিকে চেয়ে থাকি। দূর থেকে দূরে ক্রমে ছোট হয়ে আসে মূর্তিটা। কিন্তু স্থির থাকে, বাতিঘরের মতো।

সেবার নিরুদ্দেশে যাওয়া হল না। ব্ৰহ্মপুত্ৰ পেরিয়ে কামাখ্যা পাহাড়ে উঠে দুপুরের আগেই ফিরে এলাম।

বাসার বাইরে যে পার্থিব সংসার সেইটাই ছিল ভয়ের। সংসারের ভিতরে আমি মা-বাবার আদুরে ছেলে, ভাইবোনের প্রিয় সহোদর কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে আমি কেউ না। একবার এক বুড়ো চিনে–বাদামওয়ালার কাছে একটা অচল সিকি গছানোর চেষ্টা করেছিলাম ছেলেমানুষি বুদ্ধিবশত। মনে হয়েছিল, লোকটা বোধহয় চোখে ভালো দেখে না। বাদাম নিয়ে সিকিটা দিতেই সে সেটা হাতড়ে দেখল, তারপর আমার হাত চেপে ধরে সে কী চিৎকার-এ-ব্যাটা চোট্টা আমাকে সাট্টা পয়সা দিতে এসেছে। পুলিশ…পুলিশ! বাজারের এক ভিড় লোক ছুটে এল। অচেনা পৃথিবীর বিরুদ্ধতা দেখে এমন ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়েছিলাম সেদিন! আর একবার বন্ধুদের সঙ্গে হাটে গেছি। হাট থেকে চুরি করা ছিল বন্ধুদের একটা খেলা। আমি করতাম না, ভয় করত। সেবারই প্রথম সাহস করে একটা টিনের বাঁশি নিয়ে দোকান থেকে বেশ কিছু দূর চলে গেছি, হঠাৎ সেই লোকটা এসে আমার হাত ধরল, একটিও কথা না বলে পকেট থেকে বাঁশিটা বের করে নিয়ে চলে গেল। কেউ কিছু বুঝল না, কিন্তু আমি সেই লোকটার ওই আচরণের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলতে পারিনি। লজ্জায় ভিড় ভেঙে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর একা-একা সেই ঘটনার কথা ভেবে কতবার এবং আজও গা শিউরে ওঠে লজ্জায়, আধোঘুমে চমকে উঠি। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার সময়ে কাটিহারের খালাসিটোলার রাস্তায় একজন মুসলমান ছেলে আমাকে অকারণে গাল দিয়ে একটা চড় মেরেছিল। সে জানত না তার ওই চড়টা আমার আত্মার গায়েতে দীর্ঘকাল তার হাতের ছাপ রেখে দেবে। ভুলতে পারি না, কিছুতেই সেই চূড়ান্ত গাল আর চড়টি ভুলতে পারি না। সংসারে স্নেহচ্ছায়ায় বাইরে নিষ্ঠুর ও উদাসীন এই পৃথিবীটি রয়েছে। অচেনা মানুষের হৃদয়হীনতা রয়েছে, তাদের আক্রমণ আক্রোশ, নিষ্ঠুরতা আমি কী করে ঠেকাব!

এই মানসিকতা থেকেই একটা অসুস্থ বৈরাগ্য জন্ম নিয়েছিল আমার শক্তিহীনতা, অনুজ্জ্বল মন, লড়াইয়ের আগেই পরাজয়ের মনোভাব আমাকে ক্রমশ সমাজ-সংসারের বাইরের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীতা নেই, অচেনা মানুষ নেই, অপমান নেই, যেখানে আমি তৃপ্ত একাকী সেই নির্জনতার দিকে টান পড়তে থাকে। এই বৈরাগ্য শক্তিমানের সন্ন্যাস নয়, দুর্বলের পলায়ন।

একবার এই সুখী বাড়িতে গেছি মা-বাবা-ভাই-বোনদের সঙ্গে। বড়লোকের বাড়ি, বিলিতি আসবাব, বৈঠকখানায় মদের বার, ছেলেমেয়েদের মুখে ইংরেজি। তারা আমাদের খুবই সমাদর করেছিল। সে বয়সে আমি ছিলাম ভীষণ রোগা। সেই রুগ্নতা বোধহয় সেই বাড়ির কর্তার খারাপ লেগেছিল। একটা ছেলে এত রোগা হবে কেন? তিনি তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের সামনে

বারবার জিগ্যেস করেছিলেন, তুমি কি খাও না? ছোট না? খেলো না? তুমি অত রোগা কেন? সে ভারী অস্বস্তিকর একটা অবস্থা। আমার রুগ্নতা এমনিতেই আমার মা-বাবার দুশ্চিন্তার কারণ ছিল, তার ওপর ওই সব প্রশ্ন মা-বাবারও ভালো লাগছিল না। প্রশ্ন করার ভঙ্গিটা ছিল অন্য ধরনের। তাতে সমবেদনা নেই, অনুকম্পাও না। বরং চাপা একটু ঘেন্না আর শ্লেষ ছিল। সে কেবল আমিই টের পাচ্ছিলাম। সূচীমুখ যন্ত্রণা। নানা কথার মাঝখানে ঘুরে ফিরে তিনি আমাকে অপমান করতে লাগলেন। জিগ্যেস করলেন স্ট্রেট লাইনের ডেফিনেশন কী। পড়া ছিল, কিন্তু ঘাবড়ে যাওয়ায় সে মুহূর্তে মনে পড়েনি। বলতে পারলাম না দেখে তিনি সপরিবারে হাসলেন। আমি ঘামছি। আমার ভাইবোনেরা তখন সে বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কলের গান বাজাচ্ছে, ছবির বই দেখতে দেখতে অবাক হয়ে যাচ্ছে, কুকুরকে বল  ছুঁড়ে দিয়ে খেলছে, আর আমি মায়ের কাছ ঘেঁষে কাঠ হয়ে বসে নিজের অপদার্থতার কথা ভাবছি। মনে হচ্ছিল, সমাজ সংসারে আমার জন্য নয়। পালাও পালাও। এরা সবাই তোমার শত্রু, প্রতিদ্বন্দ্বী, তোমার প্রতি এরা সবাই দয়াহীন। সংসারের বাইরে কোনও নির্জনতায় চলে যাও, সন্ন্যাসী-বৈরাগী হয়ে যাও। বেঁচে থাকা মানেই প্রতি মুহূর্তে বৃশ্চিক দংশন, সূচীমুখ যন্ত্রণা, বেঁচে থাকা মানে আত্মায় মলিন হাতের ছাপ। সুতো হেঁড়ো, পালাও।

অর্গান্ডির মতো পাতলা নেটের পরদা উড়ছে বাতাসে। কলের গান বাজছে, কী সুন্দর ঠান্ডা ঘর, নরম সোফা কৌচ, মহার্ঘ আসবাব, তবু এই পরিবেশে মানুষ কত নিষ্ঠুর ও হীন হতে পারে।

মা সবচেয়ে বেশি আমার ব্যথা বোঝে। চিরকাল মায়েদের এই ক্ষমতা। মা আমাকে একটু ঠেলে দিয়ে চাপা গলায় বলল , বাইরের বাগানটা তো সুন্দর, একটু ঘুরে-টুরে আয় না।

বেঁচে গেলাম।

সেই সুন্দর বাগানে প্রজাপতির খেলা দেখছি, আর মনে-মনে নিজের জন্য লজ্জা হচ্ছে। কোথায় পালাব? কেমন করে? সংসারের বাইরে যাওয়া ছাড়া আমার যে উপায় নেই!

ভদ্রলোকের দশ বছর বয়সের মেম চেহারার মেয়েটি ছুটে আসে। ভয়ে ত্রস্ত হয়ে তার দিকে চাই। সে কাছে চলে আসে বাতাসের মতো সাবলীল, কী সুন্দর জোরালো চেহারা তার, কী সদগন্ধ তার গায়ে। চোখে বিদ্যুৎ। নতুন অপমানের জন্য মনে-মনে প্রস্তুত হতে থাকি। অপমান বা নিষ্ঠুরতা ছাড়া আমি বাইরের লোকজনের কাছ থেকে আর কিছুই আশা করতে পারি না যে! সে বোধহয় তার ইস্কুলে নিঃসঙ্কোচে ব্যবহার করতে শিক্ষা পেয়েছিল। এসে আমার হাতখানি ধরে বলল –চলল, ওই কোণে আমার পড়ার ঘর, সেখানে বসি। তোমার গলার স্বর খুব সুন্দর, নিশ্চয় তুমি খুব ভালো কবিতা পড়তে পারো!

সে তার পড়ার ঘরে নিয়ে গেল আমাকে, কত বই তাদের! সে একটা ডিভানে আমার পাশে বসে রবি ঠাকুরের কবিতার বই খুলে বলল –একদম বাংলা পড়তে পারি না স্কুলে। ইংরিজি স্কুল তো, শেখায় না, অথচ কবিতা পড়তে আমি যে কী ভালোবাসি!

জড়তা কাটাতে সময় লেগেছিল, তবু ওই একটা বিষয় আমি পারতাম। ভাব ও অর্থ অনুসারী কবিতা পাঠ। পড়লাম। তার চোখে মুগ্ধতা দেখা দিল, তারপর করুণতর কবিতাগুলি পড়ার সময়ে অশ্রু। একটা বেলা কেটে গেল তার সঙ্গে।

–তুমি আমাকে শেখাবে? উঃ কী যে পড়ো তুমি, শুনতে-শুনতে যেন ভূতে পায়!

সংসারের বাইরে আর যাওয়া হয়নি। সুতো আজও ছিড়ি, কিন্তু কে যেন নতুন সুতোয় নতুন বঁড়শি অলক্ষে গিলিয়ে দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *