সুনেত্রার কথা
পিন্টু আর আমি যমজ ভাইবোন। আমার জন্মের ঠিক সাত মিনিট পরে পিন্টু হয়েছিল, সেই হিসেবে আমি পিন্টুর বড়, কিন্তু ও কখনও আমাকে দিদি বলে না।
যমজ হলেও কিন্তু আমরা একরকম দেখতে নই। বাবার বন্ধু রতনকাকার দুই ছেলে যমজ, ওরা কিন্তু হুবহু একরকম, কে যে অজয় আর কে যে সুজয় তা আমরা বুঝতে পারি না। আমাদের দুজনের চেহারা দুরকম। মা অবশ্য বলেন, আমাদের ভাইবোনের মধ্যে চেহারার একটা মিল আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা আর কেউ বুঝতে পারে না। পিন্টুর গায়ের রং ছেলে-ছেলে মতন, ফরসা নয়, আবার কালোও নয়, মুখখানাও চোখা ধরনের। সেই তুলনায় আমাকে সবাই ফরসাই বলে। আমাদের নামেও মিল নেই। ও পিন্টু, আমি বাবলি, ওর ভালো নাম জয়দীপ, আমার সুনেত্রা।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার ঠিক তেরো বছর এক মাস বয়েস পর্যন্ত আমি আর পিন্টু ছিলুম সবদিক থেকে সমান। বরং খেলাধুলোতে আমি একটু বেশি ভালো ছিলুম, পিন্টুর চেয়ে আমার স্বাস্থ্য ভালো, আমার গায়ের জোর বেশি ছিল। আর-একটু ছোট বয়েসে যখন আমরা মারামারি করতুম, পিন্টু কোনওদিন আমার সঙ্গে পারেনি। দুজনের আলাদাইস্কুল হলেও আমরা একই ক্লাসে পড়ি, রেজাল্টও দুজনেরই ভালো হয়।
মনে পড়ে, সেবারে সেই দেওঘরে বেড়াতে যাওয়ার কথা। আমরা যে-বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলুম, সেই বাড়ির উঠোনে একটা মস্ত বড় পেয়ারা গাছ ছিল, তাতে অনেক পেয়ারা ফলেছিল। চমৎকার মিষ্টি পেয়ারা, ভেতরটা লালচে রঙের। পিন্টু তো তরতরিয়ে উঠে গেল গাছে। সাতটা পেয়ারা পেড়ে নেমে এসে আমাকে আর দিদিকে মাত্র একটা করে দিয়ে পিন্টুটা কিপ্টের মতন নিজে রেখে দিল বাকিগুলো। তখন আমিও চড়লুম গাছে। মা বারণ করলে বলেছিলুম, বাঃ, পিন্টু গাছে। উঠতে পারে তো আমি উঠব না কেন? আমিও সাত-আটটা পেয়ারা পেড়েছিলুম।
দেওঘরে বাবা একটা গাড়ি ভাড়া করেছিলেন, সেটাতে চড়ে আমরা জসিডি, ত্রিকুট, রিখিয়া বেড়াতে যেতুম। নন্দন পাহাড়টা খুব ছোট, সেটার একদম ওপর পর্যন্ত গাড়ি করে যাওয়া যায়। বাবা-মায়েরা গাড়িতে করেই যাচ্ছিলেন, পিন্টু বলল, ও নীচ থেকে দৌড়ে উঠবে। আমিও নেমে পড়লুম গাড়ি থেকে। তারপর দুজনে ছুটে-ছুটে প্রায় একইসঙ্গে পৌঁছে গেলুম ওপরের মন্দিরের কাছটায়। সেবার ছোট মাসি ছিলেন আমাদের সঙ্গে, তিনি বলেছিলেন, ওরা যমজ তো, তাই সব। ব্যাপারেই সমান।
কিন্তু তেরো বছর এক মাস বয়েসে আমি পিন্টুর থেকে অনেক আলাদা হয়ে যাই।
তারিখটা আমার মনে আছে, কারণ তার এক মাস আগেই আমাদের দুজনের জন্মদিন ছিল। তারপর, এক মাস বাদেই আমার শরীরে একটা পরিবর্তন এল! আমি ভয় পেয়েছিলুম খুব, কিন্তু মা বললেন, ভয়ের কিছু নেই, মেয়েদের ওরকম হয়। এখন থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে, বুঝলি? এই পৃথিবীতে মেয়েদের অনেক বিপদ।
সেইদিন বুঝলুম, পিন্টু ছেলে আর আমি মেয়ে। আমাদের জীবন একরকম নয়।
আমার শরীরে আরও কতগুলো পরিবর্তন এল। আমার বুকে ঢেউ খেলে গেল। পিন্টু হাফ প্যান্ট পরে আমি ফ্রক পরি। আমি লক্ষ্য করলুম, পিন্টুর তুলনায় আমার উরু কেমন যেন গোল-গোল। হয়ে আসছে। আমার খুব বিচ্ছিরি লাগত, আমার এই পরিবর্তন আমার একটুও পছন্দ হচ্ছিল না।
আমি আরও লক্ষ্য করলুম, মা আর দিদির সবসময় আমার দিকে নজর। অথচ পিন্টু ক্রমশ আরও বেশি স্বাধীন হতে লাগল। পিন্টু এখন একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিকেলবেলা বিবেকানন্দ পার্কে। বল খেলতে যায়। আর ইস্কুল থেকে ফেরার পর বিকেলবেলা বাড়িতেই থাকতে হয় আমাকে। সপ্তাহে দুদিন আমি গানের ইস্কুলে যাই, আমাদের কাজের লোক রঘু আমার সঙ্গে, আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে। অথচ পিন্টুও কোনও পাহারা লাগে না।
পিন্টুও আজকাল আর ভালো করে মেশেনা আমার সঙ্গে। আগে দুজনে কত গল্প হত। এখন বাড়িতে থাকলেই ও মুখের সামনে গল্পের বই নিয়ে বসে থাকে আর একটু ফাঁক পেলেই বন্ধুদের কাছে ছুটে যায়।
ছোট মাসি, আমার এক পিসতুতো দাদা-বউদি প্রায়ই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তাঁরা জিগ্যেস করেন, পিন্টু কোথায়? পিন্টুকে তো আজকাল দেখতেই পাই না। তারপর নিজেরাই। উত্তর দেন, ওই বয়েসের ছেলে, ওকে কি আর এখন বাড়িতে ধরে রাখা যায়?
কিন্তু আমারও তো ওই একই বয়েস, তবে আমায় কেন ওঁদের সামনে বসে থাকতে হবে?
চোদ্দো বছরে পা দিয়ে ক্লাস নাইনের পরীক্ষায় পিন্টু আমার চেয়ে অনেক ভালো রেজাল্ট করল। পিন্টু সেকেন্ড হয়েছে, আর আমাদের ক্লাসে আমার পজিশন হল সেভেনটিনথ। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। আমি কি পিন্টুর চেয়ে পড়াশুনায় খারাপ? সব দোষ ওই মাস্টারমশাই আর চন্দনদার!
মাস্টারমশাই বেশ বয়স্ক লোক, প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েস। আমাকে আর পিন্টুকে ক্লাস
ফোর থেকে পড়াচ্ছেন। সেই মাস্টারমশাই হঠাৎ কীরকম বদলে গেলেন এবছর। হয়তো আমাকে আর পিন্টুকে কিছু লিখতে দিয়েছেন, একসময় আমি হঠাৎ মুখ তুলে দেখি, মাস্টারমশাই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আমার বুকের দিকে। একেবারে আমার ফ্রকের ভেতর দিকে তাঁর চোখ। আগে কোনওদিন মাস্টারমশাইয়ের এরকম দৃষ্টি তো দেখিনি। ক্রমশ। মাস্টারমশাইয়ের স্বভাব আরও বদলাতে লাগল। পিন্টু একটু উঠে গেলেই উনি আমার উরুর
ওপর হাত রাখেন। প্রথম-প্রথম ভাবতুম, এমনিই বুঝি অন্যমনস্কভাবে উনি হাতটা রেখেছেন, খেয়াল করেননি। কিন্তু কদিন বাদেই বুঝলাম, পিন্টু উঠে গেলেই উনি ওইরকম হাত রাখেন, একটু-একটু চাপ দেন। একদিন আমার হাত থেকে কলমটা নেওয়ার সময় উনি একেবারে স্পষ্ট ইচ্ছে করে আমার বুক ছুঁয়ে দিলেন।
কত কষ্ট যে পেয়েছি মাস্টারমশাইয়ের এই ব্যবহারে, তা একমাত্র ভগবান ছাড়া আর কেউ জানে না। রাত্তিরে একা-একা কেঁদে-কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি। যেদিন মাস্টারমশাই আসেন, সেদিন বিকেল থেকেই আমার মনে আতঙ্ক জাগে। এইরকম মনের অবস্থায় পড়াশোনা হয়? অথচ এ কথা কাকে বলব? বাবা-মাকে জানালে মাস্টারমশাইয়ের অপমান হবে না? অথচ মাস্টারমশাই এমনিতে কত ভালো লোক। পিন্টুকে তো উনি বিরক্ত করেন না, শুধু আমি মেয়ে বলেই
দিদি একদিন ধরে ফেলেছিল। সেদিন মাস্টারমশাই খুব অসভ্যতা করেছিলেন। রাত্তিরে আমি শুয়ে-শুয়ে কাঁদছিলুম। দিদি হঠাৎ জেগে উঠে বসেছিল, এই বাবলি, তোর কী হয়েছে রে? তুই কাঁদছিস কেন?
আমি কোনও উত্তর দিইনি, আমার কান্না আরও বেড়ে গিয়েছিল।
দিদি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল, কাঁদিস না। এ-বয়েসে এরকম হয়, আমি জানি তো! এমনি এমনি মন খারাপ হয়, এমনি-এমনি কান্না পায়। আমারও এরকম হত। দেখিস, আর কয়েক বছর বাদেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাড়িতে যেসব পুরুষ মানুষ আসে, যাদের কারুকে দাদা বা কাকা বা মামা বলি, তাদের। অনেকেরই একটা নতুন রোগ হয়েছে। আমাকে দেখলে তাঁরা আমার কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। কেউ-কেউ বুকের কাছে টেনে নিয়ে যেতে চান। এরা তো আগে এরকম ছিলেন না। কেউ তো পিন্টুর কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলে না। পুরুষদের কথা বাদ দিলুম, অত যেসব মহিলারা আসেন, তাঁরা তো কেউ পিন্টুকে বুকের কাছে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেন না। পিন্টুও মেয়েদের এড়িয়ে চলে। আজকাল যেন ও মেয়েদের কথা বলার যোগ্যই মনে করে না। পরীক্ষার রেজাল্ট ওরকম হওয়ার পর আমি বাধ্য হয়ে বাবা-মাকে বললুম, ওই মাস্টারমশাই আর পড়াতে পারছেন না দুজনকে। আমি আর ওঁর কাছে পড়ব না।
পিন্টুও বলল, পুরোনো মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ে কোনও লাভ হচ্ছে না।
পিন্টু কি কিছু বুঝতে পেরেছিল? তাহলে আমাকে কিছু বলেনি কেন? এখন আর পিন্টুর মনের কথা আমি বুঝতে পারি না।
মাস্টারমশাইকে ছাড়িয়ে দেওয়ার পর কিন্তু ওঁর জন্য আমার কষ্ট হতে লাগল খুব। নিশ্চয়ই উনি মনে খুব আঘাত পেয়েছেন। শেষদিন যাওয়ার সময় ওঁর মুখখানা কীরকম শুকনো বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। মাস্টারমশাই আর আসবেন না ভেবে বেশ কয়েকদিন ওঁর জন্য কেঁদেছি।
চন্দনদাটার জন্য অবশ্য আমার একটুও কষ্ট হয় না, বরং রাগ হয়। চন্দনদাকে দেখলেই আমার গা জ্বালা করে!
আমাদের বাড়ির ঠিক উলটো দিকেই থাকে মৌটুসি। আমার সাত-আট বছয় বয়েস থেকেই ও আমার বন্ধু। মৌটুসি আমার থেকে বয়েসে একটু বড়, বোধহয় দু-বছরের। একবার ওর। টাইফয়েড হয়েছিল বলে ও পরীক্ষা দিতে পারেনি। আর-একবার কী যেন গণ্ডগোল হয়েছিল, তাই ও এখন আমার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। মৌটুসি খুব ভালো মেয়ে, বেশ ঠান্ডা মতন স্বভাব, তবে বেচারি পড়াশোনার জিনিস ঠিক মনে রাখতে পারে না। মাসিমা তাই বলেছিলেন, বাবলি, তুই এসে মাঝে মাঝে মৌটুসির সঙ্গে বসে পড়লেও তো পারিস! ওকে একটু দেখিয়ে দিতে। আমার বেশ ভালোই লাগে। পিন্টু আগে ইতিহাস-ভূগোলে কাঁচা ছিল, তখন আমিই তো পিন্টুকে ইতিহাস-ভূগোলের অনেক কোয়েশ্চন-আনসার বলে দিয়েছি। আমি তো ঠিকই করেছি বড় হয়ে আমি কোনও কলেজে পড়াব।
মৌটুসিদের বাড়িতে গিয়ে পড়াশুনো করলে আমার মা-ও কোনও আপত্তি করেন না। কখনও। দরকার হলে মা রঘুকে পাঠিয়ে আমায় ডেকে আনতে পারেন।
বেশ চলছিল, কিন্তু সব গণ্ডগোল করে দিল ওই চন্দনদা। আচ্ছা, চন্দনদা, আমায় কত বাচ্চা বয়েস থেকে দেখছে, মৌটুসি যেমন ওর বোন, তেমন আমিও তো ওর বোনেরই মতন। তবু চন্দনদা কেন আমার সঙ্গে ওরকম অসভ্যতা করবে?
আমি আর মৌটুসি ওদের তেতলার ঘরে বসে নিরিবিলিতে পড়ি, মাঝে-মাঝে চন্দনদা সেই ঘুরে। ঢুকে পড়ে। কোনও কথা বলে না, দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে কিংবা একটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে। তারপর একটু বাদে আবার বেরিয়ে যায়। আমি মাঝে-মাঝে অবাক হয়ে তাকাই। চন্দনদা কোনও কথা বলে না কেন? এমনকী আমি নিজে থেকে কোনও কথা বললেও দায়সারা উত্তর দিয়ে চলে যায় ঘর থেকে! এর মানে আমি বুঝতে পারি না। কোনও কথাই যদি বলার না থাকে, তাহলে চন্দনদা কী দেখতে আসে?
এইরকম ভাবেই চলছিল।
একদিন চন্দনদার আসল চেহারাটা টের পেলুম। মৌটুসি বাথরুমে গেছে, আমি মন দিয়ে একটা অঙ্ক কষছি, সেই সময় চোরের মতন সট করে ঘরে ঢুকল চন্দনদা। চোরের মতন বলছি, কারণ চন্দনদার মুখচোখ একদম অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল। দরজার পাশে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চন্দনদা ফিসফিস করে বলল, এই বাবলি, শোন! চট করে এদিকে আয়।
আমি অবাক হয়ে বললুম, কী?
—এদিকে আয় না।
—কেন? কী বলবে, বলো।
—তুই আমার কাছে আসবি না?
–না।
চন্দনদা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। প্রথমেই হাত দেওয়ার চেষ্টা করল আমার বুকে। আমি দুহাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করে মুখ নীচু করলুম, তবু চন্দনদা জোর করে আমাকে চেয়ার থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করল।
ঘরের পাশেই বাথরুম। আমি চিৎকার করলেই মৌটুসি শুনতে পাবে। কিন্তু লজ্জায় ভয়ে আমি চিল্কার করতে পারিনি। চন্দনদা জোর করে আমাকে বুকে চেপে ধরে, হাত দিয়ে আমার থুতনি তুলে ধরে আমার ঠোঁট কামড়ে দিল। তার পরই হঠাৎ আমায় ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল ছুটে।
আমার এত বিচ্ছিরি লেগেছিল, এত ঘেন্না করছিল যে ইচ্ছে করছিল তক্ষুনি মরে যাই। চন্দনদার গায়ে বিকট ঘামের গন্ধ। মনে হয়েছিল, সেই মুহূর্তে চন্দনা মানুষ নয়, একটা জানোয়ার, আমার গা থেকে মাংস খেতে এসেছিল।
অনেকক্ষণ আমি স্বাভাবিক হতে পারিনি। আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। মৌটুসী এসে বোধহয় কিছু বুঝতে পেরেছিল, ও জিগ্যেস করল, তোর কী হয়েছে রে, বাবলি?
মৌটুসিকে আমি বলতে পারিনি। বলেছিলাম, কিছুনা।
আমি ভাবতে চেষ্টা করেছি, চন্দনদা বা অন্য পুরুষরা যে এইরকম করে, এতে ওরা কী আনন্দ পায়? এই যে হঠাৎ একটু উরুতে হাত রাখা, কিংবা বুক ছোঁওয়া, কিংবা ঠোঁট কামড়ানো, এর মধ্যে কী সুখ আছে? আমার তো এসবে একটুও আনন্দ হয় না। বরং অসভ্য, নোংরা, ঘিনঘিনে মতন লাগে।
আমি যে কিছুই জানি না, তা তো নয়। আমি বায়োলজি পড়েছি। আমি জানি, নারী ও পুরুষের পরস্পরের প্রতি একটা জৈব আকর্ষণ থাকে। এটা প্রকৃতির বিধান। কিন্তু মানুষ তো পশু নয়। বহু শতাব্দী ধরে মানুষ একটু-একটু করে সভ্য হয়েছে। শারীরিক মিলন একটা পবিত্র, সুন্দর। ব্যাপার। এতে পরস্পরের সম্মতি থাকা দরকার। এ কি জোর করে কেড়ে নেওয়ার জিনিস?
ডায়েরি, তুমি বলো তো, চন্দনদার মতন গাধা ধরনের পুরুষরা কেন এটা বোঝে না?
আমার সবচেয়ে বেশি রাগ হয় একটা কথা ভাবলে। আমি মেয়ে বলেই কেন ওরা আমার ওপর জোর করবে? মেয়েরা তো পুরুষদের ওপর জোর করে না! পিন্টু আর আমি সমান বয়েসি, অথচ পিন্টু কত স্বাধীন। সে যে-কোনও জায়গায় যেতে পারে, যার সঙ্গে খুশি মিশতে পারে, যেমন
ইচ্ছে খেলাধুলো করতে পারে। আর আমায় কেন শাড়ি পড়লেই সবসময় বুকের আঁচল টানতে হবে, আমি ইচ্ছে মতন অন্যদের সামনে পা ছড়িয়ে বসতে পারব না, কোনও পুরুষের চোখের। দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারব না, আর একা ঘরে কোনও পুরুষ মানুষের সঙ্গে থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রকৃতির চোখে মেয়েরা আর ছেলেরা কী আলাদা? তবে কেন শুধু মেয়েদের ওপরেই। এত বাধা-নিষেধ?
এইসব ভাবলে এমন গা জ্বালা করে যে ইচ্ছে হয় বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। চলে যাই সেই সব দেশে, যেখানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার আছে।
চন্দনদা আরও তিন চারবার ওইরকম অসভ্যতা করেছিল। আমি একদিন বলেছি, তুমি যদি আর-একবার আমার ওপরে জোর করো, তাহলে আমি আত্মহত্যা করে চিঠি লিখে যাব যে তুমিই আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী।
তারপর অবশ্য মৌটুসির বিকোলাই হল। পড়াশোনা বন্ধ। আমি আর ও-বাড়িতেই যাই না।
এর মধ্যে একটা নতুন অভিজ্ঞতা হল।
গ্রীষ্মের ছুটিতে পিন্টু ওর বন্ধুদের সঙ্গে গেল কালিম্পং। আমি যদি আমাদের ক্লাসের কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে এরকম বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে চাইতাম, আমাদের বাবা-মা রাজি হতেন না। চতুর্দিকে বাঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমাদের একা পেলেই খেয়ে ফেলবে। পিন্টুর যা পারে, আমরা তা পারি না।
যাই হোক, পিন্টু চলে যাওয়ায় আমার এক বিপদ হল। সন্ধেবেলায় বাবা-মায়ের প্রায়ই কোথাও-না-কোথাও নেমন্তন্ন থাকে। বাবার অফিসের পার্টি, কিংবা কোনও বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা! সেসব জায়গায় আমাকেও যেতে হবে, কারণ, আমার বয়েসি মেয়েকে নাকি বাড়িতে একলা রেখে যাওয়া যায় না! আমার পড়াশোনায় ক্ষতি হোক, তাতেও কিছু যায় আসে না, আমাকে যেতেই হবে। অথচ ওসব জায়গায় যেতে আমার একটুও ভালো লাগে না। অনেক বাড়িতেই আমার বয়েসি কোনও ছেলেমেয়ে থাকে না। বড়রা মদ খেয়ে হ্যা-হ্যা করে। আমার বিচ্ছিরি লাগে। আর জানি তো, বাবার বন্ধুরা একটু সুযোগ পেলেই আমাকে স্নেহ দেখাবার অছিলায় আমার কাঁধে হাত দিয়ে বুকে টানবার চেষ্টা করবে!
এবার আমি বেঁকে বসলুম। মাকে স্রেফ জানিয়ে দিলুম, আমি আর কিছুতেই যাব না। নিজের বাড়িতে দরজা বন্ধ করে বসে থাকলে, তাতেও তোমাদের ভয়?
মা আমার রাগ দেখে আমার কথা মেনে নিতে বাধ্য হলেন। তবে বারবার বলে দিলেন, অচেনা কেউ এলে যেন আমি কিছুতেই দরজা না খুলি।
একদিন এল একজন।
ঠিক অজানা নয়, অনেকদিন আগে আসানসোলে দেখেছিলুম একবার! আমার এক পিসতুতো বউদির ভাই। ওর নাম রণজয়। আসানসোল থেকে বি. এস. সি. পাস করে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছে। এসেছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে!
দরজা খুলে আমি ভেতরে বসালুম। বেশ লম্বা হয়েছে ঝন্টুদা। চমৎকার স্বাস্থ্য। সাদা প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরা। আমায় বলল, তোমার নাম কী যেন, তোমায় খুব ছোট্ট দেখেছিলাম।
আমি বললুম, আমার নাম সুনেত্রা। আপনার নাম কিন্তু আমার মনে আছে। ভালো নাম রণজয়, ডাকনাম ঝন্টু। আপনিও তখন বেশ ছোট ছিলেন।
বাড়িতে রঘুও নেই। শুধু আমি একা। ঝন্টুদা আমার পড়ার টেবিলের বইগুলো উলটে-পালটে দেখতে-দেখতে বলল, তুমি চা বানাতে পারো? খুব চা খেতে ইচ্ছে করছে! দোকানের চা আমার মোটেই ভালো লাগে না। আমি চা মোটামুটি তৈরি করতে জানি। যদিও আমি নিজে চা খেতে ভালোবাসি না। আমার তৈরি চায়ে চুমুক দিয়ে ঝন্টুদা বলল, বাঃ! তারপর ফস করে একটা সিগারেট ধরাল।
এরপর ঝন্টুদা রইল প্রায় দু-ঘণ্টা। কতরকম গল্প করল। ঝন্টুদার বাবা একটা বড় কয়লা খনির ম্যানেজার, সেই কয়লা খনির কত রোমাঞ্চকর কাহিনি।
এই দু-ঘণ্টা একলা ঘরে থেকেও ঝন্টুদা কোনওরকম অসভ্যতা করল না। একবার আমার গায়ে হাত ছোঁয়াল না, এমনকি আমার বুকের দিকেও স্থিরদৃষ্টিতে তাকায়নি। যেন দুজনেই সমান সমান মানুষ।
আমি অভিভূত হয়ে গেলুম ঝন্টুদার ব্যবহারে। তাহলে তো সব পুরুষ মানুষ একরকম নয়। কেউ কেউ তো মেয়েদের সম্মান দিতেও জানে। ঝন্টুদার ব্যবহার একেবারে সাবলীল।
বিদায় নেওয়ার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঝন্টুদা হঠাৎ বলল, ও একটা কথা বলা হয়নি। তোমার নাম সুনেত্রা কে রেখেছে?
আমি খুবই অবাক হয়ে জিগ্যেস করলুম, কেন?
—নামটা তোমায় খুব মানিয়েছে। তোমার চোখ দুটি খুব সুন্দর!
আমার শরীর যেন ঝনঝন করে উঠল, পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল।
কথাটা বলেই ঝন্টুদা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল তরতরিয়ে। আমি দরজার কাছে একা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম। আমাকে অনেকেই দেখতে ভালো বলে। কিন্তু কোনওদিন এত আনন্দ পাইনি।
তারপর থেকে ঝন্টুদা আমাদের বাড়িতে মাঝে-মাঝেই এসেছে। যাদবপুরের হোস্টেলে জায়গা পায়নি, ঝন্টুদা তার এক বন্ধুর সঙ্গে ঘর ভাড়া করে আছে। নিজেরাই রান্না করে। ঝন্টুদা সেইজন্য প্রায়ই আমার মায়ের হাতের রান্না খেতে আসে। লজ্জা-টজ্জা কিছু নেই, দুপুরের দিকে এসে বলে, মাসিমা, আমি নিজেই নিজেকে নেমন্তন্ন করলুম। আজ এখানে খাব।
আমার আর পিন্টুর সঙ্গে ঝন্টুদার খুব ভাব হয়ে গেছে। ঝন্টুদা এলেই বেশ ভালো লাগে। বাড়িতে যেন বেশ একটা টাটকা হাওয়া ঢুকে পড়ে।
আমার গানের ইস্কুল হাজরা পার্কের কাছে। একদিন সেখান থেকে ফেরার সময় যদি বসুশ্রী। সিনেমার কাছে ঝন্টুদা দাঁড়িয়ে আছে তার এক বন্ধুর সঙ্গে। আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, এই তো বাবলিকে পাওয়া গেছে। তাহলে আর চিন্তা নেই!
আমি বললুম, কী ব্যাপার?
ঝন্টুদা বলল, আমি আর সুমিত এক্ষুনি টস করব ভাবছিলুম যে কে এখন বাড়িতে গিয়ে চা বানাবে। তোমায় পাওয়া গেল, তুমি বানিয়ে দেবে। চলো, আমাদের ওখানে চলো।
আমার সঙ্গে রঘু ছিল। ঝন্টুদা তাকে বলল, তুমি যাও। বাড়িতে গিয়ে বলে দিও, আমি একটু বাদে ওকে পৌঁছে দেব।
ঝন্টুদারা অদ্ভুত জায়গায় থাকে। জগুবাবুর বাজারের ওপর একটা ঘর। বাজারের ওপর যেন। মানুষ থাকে, তা আমি জানতুম না আগে। কতরকম দোকান, কত হইচই। অবশ্য ঘরের সামনে একটা চওড়া বারান্দা আছে।
পাশাপাশি দুটো খাট। ওই ঘরের মধ্যেই স্টোভে রান্নার ব্যবস্থা। শুনলুম ওরা দিনের-পর- দিন শুধু ভাত, ডাল, আলু সেদ্ধ আর ডিম সেদ্ধ খায়। খুব যেদিন মাছ বা মাংস খাওয়ার ইচ্ছে হয়, সেদিন ওরা বাজারেরই কোনও হোটেলে খেতে যায়।
আমার বেশ মজা লাগল। দিব্যি ছন্নছাড়া জীবন। অবশ্য এই ধরনের ছন্নছাড়া জীবনের স্বাদ শুধু ছেলেরাই পেতে পারে। এই বয়েসি দুটি মেয়ে কি এরকম বাজারের ওপর ঘরভাড়া করে থাকতে পারবে? তাহলে অমনি বাঘ-ভাল্লুকের উৎপাত শুরু হয়ে যাবে।
আমি ওদের চা তৈরি করে খাওয়ালুম। চা খেতে-খেতে অনেক গল্প হল। ঝন্টুদার বন্ধু সুমিতও বেশ খোলামেলা ধরনের ছেলে।
একসময় সুমিত বলল, এই রে, ঘরে তো ডাল নেই, রাত্তিরে কী রান্না হবে?
ঝন্টুদা বলল, ডাল দরকার নেই। আলু সেদ্ধ ডিম সেদ্ধ দিয়ে চালিয়ে দেব।
শুকনো-শুকনো ভাত আমি খেতে পারি না। তোরা বোস, আমি একটু ডাল কিনে নিয়ে আসি।
ঝট করে সে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল টেনে।
তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। ঝন্টুদা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ঝন্টুদা তো
আগে কখনও কথা না বলে এরকমভাবে তাকিয়ে থাকেনি। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। শরীরটা শিরশির করছে। একটু বাদে আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আমি এবার যাই। ঝন্টুদা বলল, আর একটু বোসো, আমি তোমায় পৌঁছে দেব।
–পৌঁছে দিতে হবে না। আমি নিজেই যেতে পারব।
—শোনো বাবলি।
—কী?
ঝন্টুদা উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে-আসতে বলল, তোমাকে একটা কথা বলব?
এ কি, ঝন্টুদার গলার আওয়াজটা চন্দনদার মতন হয়ে গেল কী করে? অবিকল সেইরকম শোনাচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে গেলুম। তবু জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললুম, কী কথা?
ঝন্টুদা আমার দুই কাঁধে হাত রাখল। তারপর নির্নিমেষ চেয়ে রইল আমার চোখের দিকে।
আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললুম, কী কথা, বললেন না তো?
—সেকথা তোমাকে পরে বলব। তার আগে তোমায় একটু আদর করি।
বলেই এক ঝটকায় আমায় বুকে টেনে নিয়ে ঝন্টুদা পাগলের মতন আমার ঠোঁট খুঁজতে লাগল।
আমার সমস্ত হৃদয় যেন আর্তনাদ করে উঠল। ছি, ছি ঝন্টুদা, শেষপর্যন্ত তুমিও? তোমাকে আমি কত সম্মানের আসনে বসিয়েছিলুম, তুমিও অন্যদের মতন হয়ে গেলে? তুমি আমার স্বপ্ন ভেঙে দিলে!
মুখে বললুম, প্লিজ, প্লিজ, আমায় ছেড়ে দাও, আমি আর কোনওদিন তোমাদের এখানে আসব না, প্লিজ,ওরকম কোরো না, ছেড়ে দাও।
কোনওরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমি দৌড়ে বেরিয়ে গেলুম ঘর থেকে।
তার পরেও ঝন্টুদা আমাদের বাড়িতে এসেছে। ব্যবহারের কোনও তফাত হয়নি। সেই রকমই হাসি আর গল্প। শুধু আমি আর ওর চোখের দিকে তাকাই না, দুটো-একটার বেশি কথাও বলি না।
তারপর সেই ঘটনা ঘটল।
ডায়েরি, তোমার কাছে তো আমি মিথ্যে কথা বলব না। তোমার কাছে সব সত্যি কথা বলতেই হবে।
সেদিন আমাদের কলেজ এক পিরিয়ড হওয়ার পরই ছুটি হয়ে গেল। কী একটা কারণে অন্য সব কলেজে সেদিন স্ট্রাইক ছিল, আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার পর অন্য জায়গার ছেলেমেয়েরা এসে গেটের সামনে হইচই লাগিয়ে দিল।
কলেজ থেকে বেরিয়ে আমি হাঁটতে লাগলুম একা একা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। আপন মনে হাঁটছি, কোথায় যাচ্ছি, তা জানি না। হঠাৎ মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। সেই যে দিদি বলেছিল, এমনি কষ্ট হয়, এমনি-এমনি মন খারাপ লাগে! আমার মনে হচ্ছে, আমার কোনও বন্ধু নেই, পৃথিবীতে আমার কোনও যাওয়ার জায়গা নেই, আমি যদি মরে যাই, তা হলেও কারুর কোনও ক্ষতি হবে না।
হাঁটতে-হাঁটতে একসময় দেখলুম, আমি জগুবাবুর বাজারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।
এ কী, আমি এখানে এলুম কেন? এদিকে তো আমাদের বাড়ির রাস্তা নয়। কে আমাকে এখানে আসতে বলল?
ঝন্টুদার সঙ্গে যদি দেখা হয়, নিশ্চয়ই আগের দিনের সেই ব্যবহারের জন্য লজ্জা পেয়ে ক্ষমা চাইবে। সেদিনের আগে পর্যন্ত ঝন্টুদা আমার বন্ধু ছিল। অবশ্য এখন তো ঝন্টুদার দেখা পাওয়া যাবে না, ওরা তো কলেজে গেছে।
পায়ে-পায়ে উঠে গেলুম সিঁড়ি দিয়ে। ওদের দরজার বাইরে তালা নেই, একটু ঠেলতেই খুলে গেল। দুটো খাটের ওপর শুয়ে-শুয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে দুজনে। শুধু পাজামা পরা, খালি গা।
আমাকে দেখেই ঝন্টুদার মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বলল, এসো, এসো, কলেজ স্ট্রাইক তো?
ওর বন্ধু বলল, ভালোই হল, ও আমাদের আজ ভাত রান্না করে দেবে।
ঝন্টুদা বলল, যাঃ, কেন ভয় দেখাচ্ছিস। না গো বাবলি, আমাদের আগেই ভাত রান্না হয়ে গেছে।
তাহলে ও আমাদের চা তৈরি করে দিক।
আমি স্টোভ জ্বেলে গরম জল চাপালুম। একটু আগেকার মন খারাপটা হাওয়া উড়ে গেছে এরই মধ্যে, বেশ একটা ফুরফুরে ভাব লাগছে। চা খেতে-খেতে খানিকক্ষণ এটা সেটা গল্পের পর ঝন্টুদার বন্ধু বলল, এই রে, নুন নেই তো। ভাত খাব কী করে?
ঝন্টুদা বলল, ওই যা আছে তাতেই চলে যাবে।
যাঃ, কাল রাত্তিরেই সব নুন ফুরিয়ে গেল, মনে নেই? নুন ছাড়া কি ভাত খাওয়া যায়। দাঁড়া, এক্ষুণি আমি নুন কিনে আনছি।
ঝট করে গায়ে একটা জামা গলিয়ে সে বেরিয়ে গেল, দরজাটা টেনে দিয়ে।
কথাগুলো আমার চেনা-চেনা লাগল, আগের দিনও ডাল ফুরিয়ে গিয়েছিল। এদের ঘরে কোনও মেয়ে এলেই এদের একজন কোনও একটা জিনিস আনবার ছুতো করে বেরিয়ে যায়। আমি এত ছেলেমানুষ নই যে এটা বুঝব না।
ঝন্টুদা সেইরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
ভালোই হয়েছে, ওর বন্ধু চলে গেছে। ঝন্টুদার সঙ্গে আমি একা কথা বলতেই চাই। আমি তির্যক ভাবে জিগ্যেস করলুম, তোমাদের ঘরে এখনও অনেকটা নুন আছে, তাই না?
উত্তর না দিয়ে ঝন্টুদা অদ্ভুতভাবে হাসল।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বললুম, ঝন্টুদা, তুমি সেদিন আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছিলে–
আমাকে থামিয়ে দিয়ে ঝন্টুদা বলল, বাবলি, তোমাকে দেখলেই আমার কষ্ট হয়।
আমি অবাক হয়ে বললুম, কষ্ট?
—হ্যাঁ বাবলি। ভীষণ কষ্ট হয়। তুমি এত সুন্দর, তোমাকে আমার এত ভালো লাগে যে তোমাকেই দেখলেই–
ঝন্টুদা উঠে এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে।
–ছাড়ো, ছাড়ো, প্লিজ, ওরকম করো না, আগে আমার একটা কথা শোনো।
—এখন কোনও কথা নয়, সব কথা পরে শুনব।
ঝন্টুদার আলিঙ্গনের মধ্যে আমি ছটফট করতে লাগলুম। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছি না, আমার মুখে, বুকে, হাতে যেন আগুনের আঁচ। নিজেকে বারবার ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করল আমার। আমি নিজেই তো এসেছি এখানে। কেন এসেছি? আমি কি জানতুম না যে এরকম আবার হতে পারে? কেন আমি ঝন্টুদার কাছ থেকে জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছি না?
সেই মুহূর্তে আমি প্রতিজ্ঞা করলুম, আমি আর কোনওদিন কোনও পুরুষের বন্ধুত্ব চাইব না। ওরা যদি এসে আমায় পায়ে পড়ে, কাতর গলায় ভালোবাসার কথা জানায়, তাহলে ওদের কখনও কখনও একটু দয়া করতে পারি। বেশি না, একটুখানি। কোনও পুরুষ কোনওদিনই আমার মনের সঠিক সন্ধান জানতে পারবে না। এই ওদের শাস্তি!