সুধাসাগর
মাকে চিনেছি।
তিনি সমর্পণ। তিনি প্রেম। তিনি সেবা। তিনি সহিষ্ণুতা। তিনি উদারতা। তিনি প্রসারতা। কালাতীত। কালজয়ী কালী।
অগ্নি তেজোময়ী, কিন্তু একটি আধার চায়। দীপের উপমা। দীপের আধার, তেল, সলতে, একটি স্ফুলিঙ্গ; তবেই না দীপশিখা! রামকৃষ্ণরূপী শিখার দীপাধার মা সারদা। আমি তোমাতে জ্যোতির্ময় হব।
হও।
তুমি আমাকে লালন করবে, সংরক্ষণ করবে, পরিমার্জনা করবে। সংস্কার করবে। চর্চা করবে।
তুমি আমার কে?
আমি তোমার জীবনসঙ্গিনী তো বটেই, কিন্তু তোমার জীবনে ধর্ম ও ধর্মের সাধন ছাড়া তো আর কিছুই নেই, তাই আমি তোমার ধর্মসঙ্গিনী, সহধর্মিণী। তোমার সাধনপথের সহায়। না, আমার কোন কামনা-বাসনা নেই। ও দুটো আমি ফেলে এসেছি। আমি তৈরি সৈনিক। যে-যুদ্ধের তুমি ফিল্ড মার্শাল, আমি সেই যুদ্ধের শিবির। দিনান্তে শান্ত সমরাঙ্গন থেকে ফিরবে ক্লান্ত সৈনিকের দল আমার আশ্রয়ে। আমি কিছু নিতে আসিনি, আমি দিতে এসেছি, ঠাকুর।
তুলসীদাসজী যেমন বলেছিলেন : “সব ছোড়োয়ে সব পাওয়ে।” সব ছেড়ে দাও, দেখবে সব পেয়ে গেছ। মা সব ছেড়ে দিলেন—এমনকি দেহবোধও, ধীরে ধীরে সব পেয়ে গেলেন। ঠাকুরকে অন্যদের সব সংস্কার করে নিতে হয়েছিল। স্বামীজীর অহঙ্কারকে মারতে হয়েছিল, শ্রীম-র অধীত জ্ঞানকে ছাঁটতে হয়েছিল, কেশবচন্দ্রে ভক্তির প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল, বিজয়কৃষ্ণকে সাধু চেনাতে হয়েছিল, রাসমণিকে বিষয়মুক্ত করতে হয়েছিল, মথুরমোহনকে স্বরূপ দেখাতে হয়েছিল। মাকে ওসব কিছুই করতে হয়নি।
কারণ—”Come empty”। এক জেন সন্ন্যাসীর কাছে এক মেজর জেনারেল এসেছেন। ফুল ইউনিফর্মে। কাঁধে, বুকে যাবতীয় ক্ষমতার পদক সাঁটা। কোমরে চওড়া বেল্ট। খাপে ঢাকা তরোয়াল ঝুলছে—প্রভুত্বের প্রতীক। উদ্ধত ভাবভঙ্গি। গটগট করে ঢুকলেন। সামনেই বসে আছেন জেন ধর্মগুরু। শান্ত, শিষ্ট, সৌম্য। জেনারেল কোমরবন্ধনী থেকে তরোয়াল খুলে খটাস করে টেবিলে রাখলেন। আসন টেনে নিয়ে পায়ের ওপর পা আড় করে বসলেন।
-–শুনলাম, মানুষকে আপনি জ্ঞান দিচ্ছেন, সে-জ্ঞানে কাজও হচ্ছে। শুনি কী জ্ঞান! আমাকেও কিছু দিন তো। পরীক্ষা করে দেখি!
মহাপুরুষের ঠোঁটের কোণে খেলে গেল স্মিত হাসি।
—দূর থেকে এসেছেন। পরিশ্রান্ত আপনি। আগে এক পেয়ালা চা খান।
-বেশ! মন্দ প্রস্তাব নয়। চা চলতে পারে।
সন্ন্যাসী চা নিয়ে এলেন। ডানহাতে চা ভর্তি একটি পেয়ালা আর বাঁহাতে একটি টি-পট। ভর্তি পেয়ালাটি জেনারেলের সামনে টেবিলে রাখলেন। তারপর টি-পট থেকে সেই ভরা পেয়ালায় আরো চা ঢালছেন। পেয়ালা উপচে চা পড়ল ডিসে, ডিস থেকে টেবিলে, টেবিল থেকে মেঝেতে।
জেনারেল উঠে দাঁড়ালেন। ব্যঙ্গের সুরে বললেন, বুঝেছি, আপনি আমাকে কি জ্ঞান দেবেন! আপনার তো সামান্য এই জ্ঞানটুকুই নেই যে, ভরা কাপে চা ঢালা যায় না। ঢাললে উপচে পড়ে যায়!
সন্ন্যাসী হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক তাই। আপনি এটা বুঝেছেন। এখন বলছি—Please come empty। অহঙ্কারে টইটম্বুর হয়ে এলে, আমি আপনার পাত্রে যা ঢালব সব উপচে পড়ে যাবে। খালি পাত্র নিয়ে আসুন—Come empty ।
মা ঠাকুরের কাছে এলেন শূন্য আধার নিয়ে। তিনি এলেন, না ঠাকুর তাঁকে আনলেন—সংশয় আছে। ঠাকুর বললেন, কোথায় খুঁজতে যাচ্ছ? সে যে জয়রামবাটীতে আছে ‘কুটো বাঁধা’ হয়ে। ঠাকুর নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে রেখেছিলেন। সারদা সরস্বতী। দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছিলেন, আধারটি কেমন। ধারণ করতে পারবে। ঠাকুর তো ছক সাজিয়ে এসেছিলেন। অখণ্ডের ঘর থেকে নরেনকে নামালেন। মথুরকে করলেন রসদদার। রাখাল হলেন মানসপুত্ৰ। সাধন-গুরুরাও নির্বাচিত ছিলেন। পীঠস্থান রচনা করবেন রাসমণি। আর সারদা! সহধর্মিণী। তাঁকে তৈরি করবেন, পূর্ণ করবেন, রামকৃষ্ণজননী করবেন, মন্দিরের মা, চন্দ্রমণি মা আর মা সারদা এক হবেন। তাঁকে পূজা করবেন, সব সমর্পণ করবেন, এমনকি জপের মালাটিও। তিনি হবেন ফলহারিণী, জগজ্জননী। নির্বিচারে সকলের মা। রামকৃষ্ণ-পরিবারের জননী।
ছেলেপুলে! একটি কি দুটি! মা বলে ডাকবে, পায়ে পায়ে ঘুরবে।
একটি, দুটি কি গো! শত সহস্ৰ সন্তান লক্ষকণ্ঠে তোমাকে ‘মা’ বলে ডাকবে। তোমার এমন সন্তান হবে, যার ভাষা তুমি বুঝবে না। আমি আগে যাব, তুমি পরে আসবে। জীবনের অন্ধকারে পোকার মতো যারা কিলবিল করছে, তাদের বড় কষ্ট গো! তুমি তাদের একটু দেখো। আমি যেমন কয়ে গেলুম, থেকে থেকে ভাবসমাধিতে লীন হলুম, কীর্তনানন্দে কেশবাদির সঙ্গে মাতোয়ারা হলুম; তুমি তেমনি তোমার নীরব, নিভৃত জীবনের মধুর মহিমায় হিত করবে, মোহিত করবে। যারা আমার কাছে সাহস করেনি তারা দুঃসাহসে তোমার কাছে যাবে। তুমি সতেরও মা হবে, অসতেরও মা হবে।
আমাদের মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের গান-
“অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্ৰাণ
তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান।।
শুষ্ক হৃদয় মম কঠিন পাষাণসম,
প্রেমসলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান।।
যে তোমারে ডাকে না হে তারে তুমি ডাকো ডাকো।
তোমা হতে দূরে যে যায় তারে তুমি রাখো রাখো।
তৃষিত যেজন ফিরে তব সুধাসাগরতীরে
জুড়াও তাহারে স্নেহনীরে, সুধা করাও হে পান।।”
নরেনকে বলেছিলুম, তুই হবি বটবৃক্ষের মতো। তোমাকে বলছি, তুমি হবে সুধাসাগর। তোমার তীরে তৃষ্ণার্ত মানুষ, যারা সংসারে সুখ খুঁজতে গিয়ে কাঁটাগাছে ক্ষতবিক্ষত কশ, যারা সুধার বদলে কষায় চেখেছে, সুখের সন্ধানে বেতাল হয়েছে, ফাঁসিয়ে ফেলেছে চরিত্র, যারা অবশেষে বুঝেছে–
“পড়িয়ে ভবসাগরে ডুবে মা তনুর তরী।
মায়া-ঝড় মোহ-তুফান ক্রমে বাড়ে গো শঙ্করী।।
একে মন-মাঝি আনাড়ি, তাহে ছজন গোঁয়ার দাঁড়ী;
কুবাতাসে দিয়ে পাড়ি, হাবুডুবু খেয়ে মরি।
ভেঙে গেল ভক্তির হাল; ছিঁড়ে পড়ল শ্রদ্ধার পাল,
তরী হলো বানচাল উপায় কি করি—
উপায় না দেখি আর, অকিঞ্চন ভেবে সার;
তরঙ্গে দিয়ে সাঁতার, শ্রীদুর্গানামের ভেলা ধরি।।”
তারা ছুটে আসবে “তরঙ্গে দিয়ে সাঁতার” সারদানামের “ভেলা ধরি”। তুমি হবে শ্রীরামকৃষ্ণ ক্লিনিকের সিস্টার, রেড ক্রশ। সংসার সমরাঙ্গনের পাশে তোমার সেবাশিবির। ক্ষতবিক্ষতে তোমার মাতৃমঞ্জুষার স্পর্শ। শূন্যকে পূর্ণ, পূর্ণকে বিপুল শূন্য করে তোলাই হবে তোমার কাজ। মনে রেখো, আমিও এসেছি, তুমিও এসেছ। আমি আমার মতো, তুমি তোমার মতো। দুজনে মিলে হয়েছি—আমি তুমি, তুমি আমি। তুমি তোমার জিনিস নিয়ে এলে, আমি আমার জিনিস।
অতঃপর!
নরেন্দ্র-অগ্নিতে রামকৃষ্ণ-নির্যাসে সারদা-দুগ্ধ ও শর্করায় যে-আরক বিগলিত হলো তা ঘরে ঘরে, ঠোঁটে ঠোঁটে—কেউ বলছে ‘চা’, কেউ বলছে ‘চায়ে’, কেউ বলছে, ‘টি’। জীবরূপী পেয়ালায় পেয়ালায়। সারদা তুমি প্রমাণ করবে— “Self-sacrifice is the real miracle out of which all the reported miracles grew.” [Emerson]