সুত-মিত-রমণী

সুত-মিত-রমণী

গায়ে গায়ে দুটি বাড়ি। একটিতে আমি বাস করি, অন্যটি গুরুচরণ। প্রায় কুড়ি বছর এইভাবে বাস করিয়াছি; প্রথম যখন ডাক্তারি পাস করিয়া প্র্যাক্‌টিস্ আরম্ভ করি তখন হইতে। তখন আমার বয়স ছিল ছাব্বিশ, গুরচরণের হয়তো দু’-এক বছর বেশী। গুরুচরণ সম্প্রতি বিবাহ করিয়াছিল, আমি তখনও অবিবাহিত। এই জেলা শহরটি বাছিয়া লইয়া ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছিলাম, সংকল্প ছিল প্র্যাক্‌টিস্ না জমাইয়া বিবাহ করিব না।

আজ কয়েকদিন হইল গুরুচরণের মৃত্যু হইয়াছে। তাহার ফলে কিছু দায় আমার ঘাড়ে পড়িয়াছে; এই কাহিনী লিপিবদ্ধ করাও হয়তো তাহারই একটা অংশ। বন্ধুকৃত্য নয়, কারণ এত বছর ধরিয়া পাশাপাশি বাস করার ফলে যে ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়াছিল তাহাকে বন্ধুত্ব বলিতে পারি না। কিন্তু মাঝে মাঝে সত্য কথা বলারও একটা দায় আছে, নহিলে আত্মসম্মান থাকে না।

গুরুচরণের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের অন্তরায় ছিল আমাদের প্রকৃতিগত বৈষম্য। চেহারা এবং চরিত্র, কোনও দিক দিয়াই আমাদের মধ্যে মিল ছিল না। তাহার চেহারা ছিল ঝড়ে পালক-ছেঁড়া ছাতারে পাখির মতো; রোগা ন্যুব্জ শরীর, অস্থিসার মুখ, পুরু কাচের চশমার ভিতর দিয়া চোখ দুটি মাছের চোখের মতো দেখাইত। তাহার সরু পা’ দুটি অত্যন্ত ক্ষিপ্রভাবে চলিত; মুখ দিয়া অত্যন্ত তাড়াতাড়ি কথা বাহির হইত। মোটের উপর তাহাকে দেখিয়া মনে হইত, সে সর্বদাই উত্তেজিত হইয়া আছে। আমি ডাক্তার তাই জানিতাম, তাহার শরীরে মারাত্মক রোগ না থাকিলেও স্নায়ু সুস্থ ছিল না।

প্রথম যেদিন বাসা ভাড়া লইয়া সদর দরজার পাশে নিজের নামযুক্ত ধাতুফলক লটকাইয়া দিলাম সেইদিন বৈকালে গুরুচরণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল। আমি আসর সাজাইয়া প্রথম রোগীর প্রতীক্ষা করিতেছি, সে ক্ষিপ্রপদে প্রবেশ করিয়া বলিল—‘আপনি ডাক্তার অবনী রায়? নতুন প্র্যাক্‌টিস্ আরম্ভ করেছেন? বেশ বেশ, পাড়ায় একজন ডাক্তার পাওয়া গেল। নতুন এসেছেন, যদি কিছু দরকার হয় বলবেন। আমি পাশের বাড়িতে থাকি।’ বলিয়া দ্রুত প্রস্থান করিল।

প্রথম দর্শনে তাহাকে রোগী ভাবিয়া মনে যে আশ্বাস জাগিয়াছিল তাহা রহিল না বটে, কিন্তু একটি সজ্জন প্রতিবেশী পাওয়া গিয়াছে দেখিয়া কতকটা নিরুকণ্ঠ হইলাম। নবাগত অপরিচিত ডাক্তারকে প্রতিবেশীরা উপেক্ষাই করিয়া থাকে, অযাচিতভাবে সাদর সম্ভাষণ করে না।

ক্রমে পরিচয় হইল। গুরুচরণ স্থানীয় ম্যুনিসিপাল অফিসে চাকরি করে। উপরন্তু অবসরকালে বীমার দালালি করে। মন্দ রোজগার করে না। বছর দেড়েক আগে বিবাহ করিয়াছে। বৌএর নাম সুরমা। আকৃতি প্রকৃতিতে গুরুচরণের ঠিক বিপরীত। দেহে যৌবনশ্রী আছে, মুখে শান্ত মন্থর নিরুদ্বেগ ভাব। বয়স বোধকরি কুড়ি-একুশ, এখনও সন্তানাদি হয় নাই।

গুরুচরণ রোজই আমার ডিসপেন্সারিতে আসে, তড়বড় করিয়া দু’চার কথা বলিয়া চলিয়া যায়। একদিন সে একজন লোককে হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে লইয়া আসিয়া বলিল—‘ডাক্তারবাবু, একে দেখুন তো, এর অসুখ করেছে।’

লোকটিকে পরীক্ষা করিলাম, ঔষুধ দিলাম। দু’তিন দিনের মধ্যে রোগ সারিয়া গেল। পয়সা অবশ্য বেশী পাইলাম না, শুধু ঔষধের দাম। কিন্তু আমার প্র্যাক্‌টিস্ আরম্ভ হইয়া গেল। ক্রমে দুটি একটি রোগী স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আসিতে লাগিল।

তিন চার মাস পরে গুরুচরণ আমাকে তাহার বীমা কোম্পানীর ডাক্তার করিয়া লইল। আমার কিছু আয় বাড়িল, গুরুচরণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িল। সে সামান্য লোক ছিল, শহরে তাহার প্রভাব প্রতিপত্তি কিছুই ছিল না। লোকে তাহাকে অবজ্ঞা মিশ্রিত কৌতুকের চক্ষে দেখিত; আড়ালে গুরুচরণ না বলিয়া সরুচরণ বলিত। কিন্তু ঐহিক ব্যাপারে আমি তাহার কাছে ঋণী ছিলাম। একথা ভুলিতে পারি না। আর ভুলিতে পারি না একটা উন্মত্ত ঝড়ের রাত্রি। কিন্তু ঝড়ের রাত্রির কথা পরে বলিব।

দিন কাটিতেছে, পসার বাড়িতেছে। আগে নিজেই ঔষধ প্রস্তুত করিতাম, এখন একজন কম্পাউন্ডার রাখিয়াছি। আমার বাসাটি একতলা, পাঁচটি ঘর আছে; সামনের দুটি ঘর লইয়া ডাক্তারখানা, পিছনের তিনটি ঘর বাসস্থান। একজন পাচক-ভৃত্য গোড়া হইতেই ছিল।

একদিন সকালবেলা গুরুচরণ হন্তদন্ত হইয়া আসিল—‘ডাক্তারবাবু, কাল রাত্রি থেকে সুরমার গা গরম হয়েছে, গায়ে ভীষণ ব্যথা। একবার দেখবেন?’

তৎক্ষণাৎ দেখিতে গেলাম। গুরুচরণের স্ত্রীকে পূর্বে বহুবার দেখিয়াছি। গুরুচরণের অফিস যাওয়ার সময় সে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইত; সেই আমার সঙ্গে কদাচ চোখাচোখি হইয়া গেলে তাহার চোখ সম্ভ্রমে নত হইত, খোঁপায় আটানো মাথার আঁচলটা সিঁথি পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া আসিত। কথা বলিবার উপলক্ষ কখনও হয় নাই। তখনকার দিনে মফঃস্বল প্রতিবেশিনীর সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশার রেওয়াজ ছিল না, একটু আড়ষ্টতার ব্যবধান থাকিত।

সুরমা চাদর গায়ে দিয়া মুদিতচক্ষে শুইয়া ছিল, গুরুচরণ বলিল— ‘সুরমা, ডাক্তারবাবু এসেছেন।’

সুরমা চোখ মেলিল, তারপর আবার চোখ বুজিয়া জড়সড় হইয়া শুইল।

পরীক্ষা শেষ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম—‘শরীরে কষ্ট কিছু আছে?’

একটু নীরব থাকিয়া সুরমা বলিল—‘গায়ে ব্যথা।’

‘আচ্ছা, আমি ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

রাস্তায় নামিয়া গুরুচরণ ব্যগ্রস্বরে বলিল—‘ভয়ের কিছু নেই তো?’

বলিলাম—‘ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে, ভয়ের কি থাকতে পারে? তবে দেখাশুনো করা দরকার। আপনি আজ আর অফিস যাবেন না।’

সে বলিল—‘অফিসে একবারটি যাব, ছুটি নিয়ে চলে আসব। রান্নাবান্নাও তো আজ আমাকেই করতে হবে।’

বলিলাম—‘তার দরকার নেই। আমার পদ্মলোচন আছে, সে দু’জনের রান্না রাঁধবে। রোগীর সাবু আর বার্লির ব্যবস্থা হবে। এখন আসুন, আপনাকে একটা গুলি খাইয়ে দিই। ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগটা ছোঁয়াচে।’

ডিসপেন্সারিতে গিয়া গুরুচরণকে একটি প্রতিষেধক বড়ি খাওয়াইলাম। সে বলিল—‘আপনি সুরমার জন্যে ওষুধ তৈরি করে রাখুন, আমি দশ মিনিটের মধ্যে অফিস থেকে ফিরব। বিয়ে হয়ে পর্যন্ত ওর একদিনের জন্যেও শরীর খারাপ হয়নি, এই প্রথম। তাই একটু—’ বলিতে বলিতে সে তাহার কাঠির মতো পদযুগল অফিসের দিকে চালিত করিয়া দিল।

গুরুচরণ স্ত্রীকে ভালবাসিত, তাহার পরিচয় বহুবার বহুভাবে পাইয়াছি। কিন্তু বৈচিত্র্য কিছু নাই; যৌবনকালে নিজের স্ত্রীকে কে না ভালবাসে। তাহার পত্নীপ্রেম যৌবনের অবসানেও টিকিয়াছিল। ইহাও বোধকরি খুব বড় কথা নয়। বরং তাহার পত্নীপ্রেম আমার কাছে তুচ্ছ হইয়া যায় যখন ভাবি তাহার পুত্রস্নেহের কথা। কিন্তু পুত্র এখনও আসে নাই; রাম না জন্মিতে রামায়ণ কথা আরম্ভ করিব না।

সুরমা কয়েকদিনের মধ্যে সারিয়া উঠিল। কিন্তু গুরুচরণের আশঙ্কা যায় না, সে বলিল—‘ডাক্তার, ওকে একটা টনিক লিখে দিন, যাতে শিগ্‌গির চাঙ্গা হয়ে ওঠে।’

আমি হাসিয়া বলিলাম—‘ওর টনিকের দরকার নেই। স্বাস্থ্য খুব ভাল, আপনিই চাঙ্গা হয়ে উঠবে। বরং আপনি যদি টনিক চান তো দিতে পারি।’

সে ব্যস্ত হইয়া উঠিল—‘না না, আমার টনিক কি হবে। আমি দেখতে একটু রোগা বটে, কিন্তু রোগ নেই। মাঝে মাঝে হাঁপানিতে কষ্ট পাই, কিন্তু সে কিছু নয়। আমার পনরো হাজার টাকার ইন্সিওর আছে, যদিই ভালমন্দ কিছু হয় সুরমাকে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে না। —যাই, অফিসের বেলা হল। আপনি কিন্তু ওকে একটা ভাল টনিক লিখে দেবেন—’

তারপর সুরমা মাঝে মাঝে মাছ তরকারি রাঁধিয়া আমার জন্য পাঠাইয়া দেয়, কখনও নিজের হাতে মিষ্টান্ন তৈরি করিয়া পাঠায়। সে ভারি সুন্দর দরবেশ তৈরি করিতে পারে।

বিবাহ করিবার ইচ্ছা হইয়াছে। কিন্তু এখনও অবস্থা অনুকূল নয়। শহরে যাঁহাদের সহিত পরিচয় হইয়াছে তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ ঘটকালি আরম্ভ করিয়াছেন। কিন্তু আমি এড়াইয়া যাইতেছি। আগে অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত পাকা হোক, তারপর বিবাহ—

আমি প্র্যাক্‌টিস্ আরম্ভ করার পর দেড় বছর কোন দিক্ দিয়া চলিয়া গেল। তারপর একদা রাত্রিকালে আসিল দুরন্ত ঝড়। ইহার উল্লেখ আগে করিয়াছি। মানুষের মনে ত্রাস জাগাইয়া, অনেক পুরানো বাড়ি ভূমিসাৎ করিয়া দিয়া চলিয়া গেল। আমার বাসাটা অক্ষত ছিল বটে কিন্তু গুরুচরণের রান্নাঘরের মটকা উড়িয়া গিয়াছিল।

ইহার পর বছর ঘুরিবার আগে গুরুচরণের জীবনে অপরূপের আবির্ভাব ঘটিল। সুরমা একটি পুত্রসন্তান প্রসব করিল।

ছেলে পাইয়া গুরুচরণ পাগল হইয়া গেল। আনন্দে দিশাহারা হইয়া সে যত্রতত্র নাচিয়া বেড়াইতে লাগিল; তাহার জিহ্বা এবং পদদ্বয় আরও দ্রুত হইয়া উঠিল। রাস্তায় চেনা পরিচিত কাহারও সহিত দেখা হইলে পুত্রজন্মের সংবাদ তৎক্ষণাৎ দেওয়া চাই। ছেলে আঁতুড়ঘর হইতে বাহির হইতে না হইতে তাহাকে কোলে লইয়া আমার কাছে উপস্থিত—‘দ্যাখো ডাক্তার, কী ছেলে! কী স্বাস্থ্য! আট পাউণ্ড ওজন। ওর নাম রেখেছি পঙ্কজ। কেমন নাম?’

‘খাসা নাম।’

‘গণৎকারকে দিয়ে কুষ্ঠি করিয়েছি। লেখাপড়ায় ভাল হবে, দীর্ঘজীবী হবে, হাকিম হবে।’

‘বেশ বেশ।’

ছেলের বয়স ছয় মাস, অর্থাৎ ঘাড় শক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুরুচরণ তাহাকে ট্যাঁকে লইয়া সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। একদণ্ড ছেলেকে ছাড়িয়া দিয়া থাকিতে পারে না। যদি চাকরি যাইবার ভয় না থাকিত বোধকরি ছেলেকে লইয়া অফিস যাইত। সুরমার কিন্তু আবাহন বিসর্জন নাই, সুস্থ দেহ ও শান্ত নিরুদ্বেগ মন লইয়া সে যেমন ছিল তেমনিই রহিয়া গেল।

মনে আছে এই সময়, অর্থাৎ গুরুচরণের ছেলের বয়স যখন ছয়-সাত মাস তখন আমি বিবাহ করিয়াছিলাম। তার বছরখানেক পরে আমারও একটি পুত্রসন্তান জন্মিয়াছিল। বলা বাহুল্য, ছেলে লইয়া আমি মাতামাতি করি নাই। কিন্তু এটা আমার গার্হস্থ্য ইতিবৃত্ত নয়, গুরুচরণের কাহিনী, তাই নিজের কথা যথাসম্ভব বাদ দিয়া যাইব।

গুরুচরণের মনে অন্য চিন্তা নাই, মুখে অন্য কথা নাই, শুধু পঙ্কজ পঙ্কজ। পঙ্কজ একটু হাঁচিলে কি কাশিলে অমনি ডাক্তর। ছেলের স্বাস্থ্য ভাল, বেশ গোলগাল নধর, তাই ঔষধপত্র বেশী দিতে হয় না। গুরুচরণ আহ্লাদে আটখানা হইয়া ছেলেকে কখনো পিঠে কখনও কাঁধে লইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। দেখিয়া আমারই যেন লজ্জা করে।

কিন্তু গুরুচরণের বাৎসল্য রসের ইতিহাস আগাগোড়া লিপিবদ্ধ করিতে গেলে মহাভারত হইয়া দাঁড়াইবে, তাহাতে কাজ নাই। পঙ্কজের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন গুরুচরণ তাহাকে স্কুলে ভর্তি করিয়া দিল। ছেলে হাকিম হইবে, সুতরাং হাকিমকে গোড়াপত্তন একটু তাড়াতাড়ি করাই ভাল। ছেলেটা লেখাপড়ায় ভাল দাঁড়াইয়া গেল। তাহার স্বভাব কতকটা মায়ের মতো; পড়াশুনায় অখণ্ড মনোনিবেশ; খেলা করে, তাও ধীর শান্তভাবে।

এই সময় গুরুচরণের কিছু ভাবান্তর লক্ষ্য করিয়াছিলাম। মনে হইয়াছিল, পুত্রকে স্কুলে পাঠাইবার পর পুত্রের প্রতি তাহার বাৎসল্যের উগ্রতা প্রশমিত হইয়াছে। সে তড়বড়ে ছিল বটে, কিন্তু খিটখিটে ছিল না; এই সময় তাহার মেজাজ খিটখিটে হইয়া উঠিয়াছিল। একদিন আমার সামনেই পঙ্কজের কান মলিয়া দিয়া গালে একটা চড় মারিল। তাছাড়া আমার সঙ্গেও যেন একটা দূরত্ব আসিয়া পড়িয়াছিল। আগে প্রত্যহ কারণে অকারণে আমার কাছে আসিত, এখন কাজ না থাকিলে আসে না। সম্প্রতি তাহার কাজের চাপ বাড়িয়াছিল; অফিসের কাজ তো ছিলই, বীমার কাজও খুব বাড়িয়া গিয়াছিল, তাই সকলের সহিত তাহার ব্যবহার খিটখিটে ও অসামাজিক হইয়া উঠিয়াছিল। অন্তত তখন আমার এইরূপই ধারণা হইয়াছিল।

কিন্তু এ ভাব তাহার বেশী দিন রহিল না। দুই-তিন মাস পরেই দেখিলাম, সে ছেলেকে হাত ধরিয়া স্কুলে লইয়া যাইতেছে। একবার খেলা করিতে করিতে পঙ্কজের আঙুল কাটিয়া গিয়াছিল, গুরুচরণ উদ্বেগ ও উত্তেজনায় দিশাহারা হইয়া গেল। তাহার ব্যাকুলতা দেখিয়া হাসি পায় অথচ উপেক্ষা করা যায় না। শেষ পর্যন্ত ছেলেটাকে একটি এ. টি. এস. ইঞ্জেকশন পর্যন্ত দিতে হইল।

যেদিন পঙ্কজ স্কুলে প্রাইজ পাইল সেদিন গুরুচরণ পাড়ায় মিষ্টান্ন বিতরণ করিল। প্রায় নাচিতে নাচিতে আমার কাছে আসিয়া বলিল—‘দেখেছ ডাক্তার, কী ছেলে! একেবারে হীরের টুকরো। এ ছেলে বাঁচবে তো?’

হাসিয়া বলিলাম—‘তুমি যে রকম আদর দিচ্ছ, বাঁচা শক্ত।’

সে হঠাৎ লজ্জিত হইয়া পড়িল—‘না না, আদর কোথায় দিই। এই তো সেদিন খুব বকেছি। সুরমাও খুব শাসন করে। —তা তুমি তোমার ছেলেকে স্কুলে দিচ্ছ কবে?

‘এবার দেব।’

অতঃপর দিন কাটিতেছে। পসার বাড়িয়াছে, সংসারও বাড়িয়াছে, দুটি ছেলে, একটি মেয়ে। গুরুচরণের কিন্তু সংসার বাড়ে নাই, ঐ এক ছেলে পঙ্কজ। পঙ্কজ কিন্ডারগার্টেন উত্তীর্ণ হইয়া বড় স্কুলে ঢুকিয়াছে। আমার বড় ছেলে কিন্ডারগার্টেনে ঢুকিয়াছে। আমরা যৌবনের সীমান্ত ছাড়াইয়া প্রৌঢ়ত্বের দিকে অগ্রসর হইতেছি।

এইবার গুরুচরণের পুত্রপ্রীতির শেষ দৃষ্টান্ত লিপিবদ্ধ করিয়া এই প্রসঙ্গের উপসংহার করিব।

পঙ্কজের বয়স তখন বারো-তেরো বছর। পরীক্ষার দিন আগত। পরীক্ষায় সে প্রতি বছর প্রথম স্থান অধিকার করে, এবারও না করিবার কারণ নাই। আমার ছেলে কানুও বড় স্কুলে ভর্তি হইয়াছে, সেও পরীক্ষা দিবে। কানু একটু ভীরু প্রকৃতির ছেলে, তাই পরীক্ষার প্রথম দিন মোটরে করিয়া তাহাকে স্কুলে পৌঁছাইয়া দিতে গিয়াছিলাম।

স্কুলের প্রাঙ্গণে ছেলেদের ভিড়, দশ হইতে কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত নানা বয়সের ছাত্র চারিদিকে কিলবিল করিতেছে। তখনও ঘন্টা বাজে নাই, কিন্তু বাজিতে বেশী দেরিও নাই।

স্কুলের ফটকের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই কানু বলিল—‘বাবা, এবার তুমি যাও।’

তাহাকে সাহস দিবার জন্য পিঠ চাপড়াইয়া দিয়া বলিলাম—‘আচ্ছা। কোথায় সীট পড়েছে খুঁজে পাবি তো?’

‘পাব।’ সে ছুটিয়া চলিয়া গিয়া অন্য ছেলেদের মধ্যে মিশিয়া গেল। আমি কিছুক্ষণ তাহাকে লক্ষ্য করিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া ফিরিয়া চলিলাম।

এই সময় ফটকের পাশের দিক হইতে চাপা তর্জন শুনিয়া চমকিয়া ঘাড় ফিরাইয়া দেখি, গুরুচরণ আর পঙ্কজ। গুরুচরণও পঙ্কজকে স্কুলে পৌঁছাইতে আসিয়াছে। সে বাঁ হাতে পঙ্কজের একটা হাত ধরিয়াছে এবং ডান হাতের তর্জনী তুলিয়া বলিতেছে—‘তোকে ফার্স্ট হতে হবে মনে রাখিস। ফার্স্ট হতে হবে—ফার্স্ট হতে হবে—’

পঙ্কজ লজ্জায় লাল হইয়া দাঁড়াইয়া আছে; কয়েকটা স্কুলের ছেলে তাহাদের ঘিরিয়া দন্তবিকাশপূর্বক পঙ্কজের দুর্গতি দেখিতেছে।

গুরুচরণ বলিল—‘ঘণ্টা বাজতে দেরি নেই। শিগ্‌গির আমার পায়ের ধুলো নে, তাহলে নিশ্চয় ফার্স্ট হবি। ফার্স্ট হওয়া চাই—’

পঙ্কজ নত হইয়া তাহার পদধূলি গ্রহণ করিল। অমনি গুরুচরণ তাহার মাথায় হাত রাখিয়া বোধকরি ইষ্টমন্ত্র জপ করিতে লাগিল। ছেলেরা অট্টহাস্য করিয়া উঠিল।

এই সময় পঙ্কজ আমাকে দেখিতে পাইয়া করুণ মিনতিভরা চক্ষে আবেদন জানাইল। আমার আর সহ্য হইল না; আমি গিয়া গুরুচরণের হাত ধরিয়া টানিলাম, প্রায় রূঢ়স্বরে বলিলাম—‘এস এস, কী পাগলামি করছ!’

অতঃপর স্কুলে পরীক্ষারম্ভের ঘণ্টা বাজিল, পঙ্কজ দড়ি-ছেঁড়া বাছুরের মতো পালাইল। আমি গুরুচরণকে লইয়া রাস্তায় বাহির হইলাম, তাহাকে আমার গাড়িতে তুলিয়া লইয়া গাড়ি চালাইয়া বাড়ির দিকে চলিলাম। গুরুচরণ তখনও উত্তেজনায় হাঁপাইতেছে। আমি বেশ বিরক্তভাবেই বলিলাম—‘ছেলেটাকে সহপাঠীদের কাছে অপদস্থ করবার দরকার আছে কি?’

গুরুচরণ ব্যাকুল স্বরে বলিল—‘অপদস্থ! তুমি বুঝছ না ডাক্তার, ওকে ফার্স্ট হওয়াই চাই; নইলে সব গণ্ডগোল হয়ে যাবে। আমি ওর নামে দশ হাজার টাকার ইন্সিওর করেছি, ষোল বছর বয়স থেকে মাসে মাসে টাকা পাবে। নিজে না খেয়ে প্রিমিয়ামের টাকা দিয়েছি। আমি যদি মরে যাই, তবু ওর কলেজে পড়া আটকাবে না।’ এই পর্যন্ত বলিয়া সে হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিল।

তাহার কথা ও আচরণের মাথামুণ্ড নাই। কিন্তু ভালবাসা বস্তুটা চিরদিনই মাথামুণ্ডহীন।

মৃত্যুচিন্তা গুরুচরণের মনে লাগিয়া আছে। নিজের স্বাস্থ্যের উপর তাহার ভরসা ছিল না; বয়স যত বাড়িতেছিল ভরসা ততই কমিতেছিল। তাই সে স্ত্রীপুত্র সম্বন্ধে যথাশক্তি ব্যবস্থা করিয়াছিল।

তাহার মৃত্যুচিন্তা যে ভিত্তিহীন নয় তাহার প্রমাণ হইল উপরের ঘটনার বছর তিনেক পরে। পঙ্কজ তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়া মামার বাড়ি বেড়াইতে গিয়াছে। গুরুচরণের হাঁপানির ধাত, জীবনশক্তিও হ্রাস পাইয়াছিল। একদিন বৃষ্টিতে ভিজিয়া সে অসুখ বাধাইয়া বসিল; হাঁপানি নিউমোনিয়া ব্রঙ্কাইটিস মিশিয়া এক বিশ্রী ব্যাপার।

কয়েকদিন চিকিৎসা করিয়া দেখিলাম গতিক ভাল নয়। আমি প্রত্যহ অবসর পাইলেই তাহাকে দেখিয়া আসি; একদিন সকালে তাহাকে দেখিয়া ফিরিতেছি, সুরমা সদর দরজা পর্যন্ত আমার সঙ্গে আসিল। আমি রাস্তায় নামিয়া ফিরিয়া দেখিলাম, তাহার নিরুদ্বেগ চোখে প্রশ্ন রহিয়াছে। আমি একটু ইতস্তত করিয়া বলিলাম—‘পঙ্কজকে আনিয়ে নিলে ভাল হয়।’

সে আরও কিছুক্ষণ প্রশ্নভরা চোখে চাহিয়া রহিল, তারপর আমার কথার মর্মার্থ যেন বুঝিয়াছে এমনিভাবে একটু ঘাড় নাড়িল।

চলিয়া আসিলাম। সুরমার সহিত আমি কতবার কথা বলিয়াছি—হিসাব করিলে বোধ হয় আঙ্গুলে গোনা যায়। আন্দাজ কুড়ি বছর পাশাপাশি বাড়িতে বাস করিতেছি। আমার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ, সুরমার বোধ হয় চল্লিশের কাছাকাছি।

পরদিন গুরুচরণের অবস্থা একটু ভাল মনে হইল। শ্বাসকষ্ট আছে, কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম। পিঠের নীচে বালিশ দিয়া বিছানায় অর্ধশয়ান ছিল; আমাকে দেখিয়া বালিশের পাশ হইতে চশমা লইয়া পরিধান করিল, তারপর বিছানায় হাত চাপড়াইয়া আমাকে বসিতে ইঙ্গিত করিল। আমি বসিলাম। সুরমা দ্বারের কাছে কপাট ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আমি এবং গুরুচরণ যখন একত্র থাকি তখন সে কাছে আসে না, কথাও বলে না।

গুরুচরণ দু’চারবার দীর্ঘনিশ্বাস টানিয়া ধীরে ধীরে কথা বলিল। কথা বলিবার তড়বড়ে ভঙ্গি আর নাই, কণ্ঠস্বর বসিয়া গিয়াছে; কঙ্কালসার মুখে হাসি আনিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া সে বলিল—‘ডাক্তার, এ যাত্রা আর রক্ষে পাব না মনে হচ্ছে—’

আমি আশ্বাস দিতে গেলাম, সে হাত নাড়িয়া আমাকে নিবারণ করিল—‘যদি আমার ভালমন্দ কিছু হয় তুমি খোকা আর সুরমাকে দেখো; ওরা যেন কষ্ট না পায়। তোমাকেই ওদের গার্জেন করে গেলাম।’

আমার বুকের ভিতরটা চমকিয়া উঠিল। সামলাইয়া লইয়া বলিলাম—‘কি মুশকিল, এখন ওসব কথা কেন? আগে তুমি সেরে ওঠো—’

সে বলিল—‘এখনি এসব কথা বলা দরকর। যদি না বাঁচি। টাকার জন্যে ভাবনা নেই, সে ব্যবস্থা আমি করেছি। তুমি শুধু ওদের অভিভাবক থাকবে।’

আমি অসহিষ্ণু হইয়া বলিলাম—‘কিন্তু আমাকে কেন? পঙ্কজের মামারা রয়েছেন—’

সে বলিল—‘মামাদের অনেক ছেলেপিলে, সেখানে খোকা আদর পাবে না। ওরা এই বাড়িতে থাকবে, তুমি ওদের দেখবে।’

‘কিন্তু—’ আমি তাহার মুখের পানে চোখ তুলিলাম। পুরু চশমার ভিতর দিয়া সে একদৃষ্টে আমার পানে চাহিয়া আছে। চোখাচোখি হইলে সে আস্তে আস্তে বলিল—‘ডাক্তার, আমি জানি।’

তাহার অপলক চোখের সামনে আমাকে চক্ষু নত করিতে হইল। দ্বারের দিকে চাহিলাম। সুরমা শান্ত অবিচলিত মুখে দাঁড়াইয়া আছে, কেবল তাহার গণ্ড বহিয়া নিঃশব্দ অশ্রুর ধারা ঝরিয়া পড়িতেছে।

ষোল বছর পূর্বের একটা রাত্রির দৃশ্য চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিল। সেই অন্ধ ঝড়ের রাত্রি। সে রাত্রিতে সুরমার সহজসিদ্ধ শান্ত সংযমের বাঁধ হঠাৎ ভাঙিয়া গিয়াছিল।

সারাদিন দুঃসহ গরম গিয়াছে। আশা করিয়াছিলাম অপরাহ্নে কালবৈশাখী উঠিবে, কিন্তু উঠিল না। কাজকর্ম বিশেষ কিছু ছিল না, কম্পাউন্ডার সন্ধ্যার পর চলিয়া গেল।

সাড়ে সাতটার সময় ভৃত্য পদ্মলোচন বলিল, সে সিনেমা দেখিতে যাইবে, ছুটি চাই। ছুটি দিলাম। আমার সংসারে পদ্মলোচন ছাড়া আর কেহ ছিল না, তখন আমি অবিবাহিত। পদ্মলোচন সাড়ে আটটার সময় আমার খাবার ঢাকা দিয়া রাখিয়া চলিয়া গেল।

বাড়িতে আমি একা। ন’টার সময় সদর দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া আমি আহারে বসিলাম।

আহার করিতে করিতে শুনিতে পাইলাম, এক পাল পাগলা হাতির মতো মড়মড় শব্দ করিয়া ঝড় আসিতেছে। আমি আহার শেষ করিয়া উঠিতে উঠিতে ঝড় আসিয়া আমার বাড়ির উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল, বাড়ির খোলা জানালাগুলা দড়াম দড়াম শব্দে আছাড় খাইতে লাগিল। ছুটিয়া গিয়া জানালাগুলা বন্ধ করিলাম।

ঝড়ের মাতন ক্রমশ বাড়িয়া চলিয়াছে। চারিদিকে রৈ-রৈ মচ্‌মচ্‌ মড়মড় শব্দ। ‘ভূতনাথ ভূতসাথ দক্ষযজ্ঞ নাশিছে।’ আমার বাড়িটা থাকিয়া থাকিয়া ভিত পর্যন্ত দুলিয়া উঠিতেছে। বিদ্যুতের আলো কাচের গোলকের মধ্যে শিহরিতে লাগিল।

তারপর আসিল বৃষ্টি বজ্র বিদ্যুৎ। বজ্রের ক্কড়ক্কড় অট্টহাসি, বৃষ্টির ঝরঝর কান্না। আমি বাড়ির এঘর-ওঘর ঘুরিয়া বেড়াইতেছি; ভয় হইতেছে, বাড়িটা মাথার উপর ভাঙিয়া পড়িবে নাকি?

পরে আবহ মন্দিরের বিবরণে জানা গিয়াছিল, এমন দুরন্ত সাইক্লোন চল্লিশ বছরের মধ্যে আসে নাই। নব্বই মাইল বেগে বায়ু বহিয়াছিল, শহরের টিনের এবং খোলার চাল সমস্ত উড়াইয়া লইয়া গিয়াছিল, দশ-বারোজন লোক মারা পড়িয়াছিল। রাত্রি সাড়ে ন’টা হইতে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ঝড়ের এ প্রলয়ঙ্কর মাতামাতি চলিয়াছিল।

দশটা বাজিয়া গিয়াছে। দরজা জানালা সব বন্ধ, তবু খড়খড়ির ফাঁকে বাহিরের বাতাস আসিয়া বাড়িটাকে ঠাণ্ডা করিয়া দিয়াছে। আমি বিছানায় শুইয়া একটা ডাক্তারি বই-এর পাতা উল্টাইতেছি, কিন্তু মন এবং কান বাহিরের দিকে পড়িয়া আছে।

এক ঝলক বিদ্যুৎ, সঙ্গে সঙ্গে বিকট বাজ পড়ার শব্দ। খুব কাছে কোথাও বাজ পড়িয়াছে। বিছানায় উঠিয়া বসিলাম।

বাজ পড়ার পর কিছুক্ষণ ঝড়ের শব্দ যেন নিস্তেজ হইয়া গেল। এই সময়—ঠক্‌ ঠক্‌ ঠক্‌। কে যেন আমার সদর দরজায় ধাক্কা দিতেছে।

এই ঝড়ের রাত্রে কে আসিল! রোগী? কিংবা পাড়ার কেহ জখম হইয়াছে! কান পাতিয়া রহিলাম। পদ্মলোচন কি ফিরিয়া আসিল? না, ঝড় না থামিলে সে ফিরিবে না—

আবার ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দ। উঠিয়া গিয়া সন্তর্পণে হুড়কা খুলিলাম। কিন্তু বাতাসের ঠেলায় দরজা আমার হাত ছিনাইয়া সম্পূর্ণ উদ্‌ঘাটিত হইয়া গেল। সেই সঙ্গে প্রবেশ করিল—সুরমা!

আমি প্রাণপণ শক্তিতে দরজা আবার বন্ধ করিয়া দিলাম। সুরমার দিকে ফিরিয়া দেখিলাম সে ভিজা কাপড়ে অসম্বৃত অবস্থায় দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছে; চোখে ভয়ার্ত বিস্ফারিত দৃষ্টি। আমি স্তম্ভিত হইয়া চাহিয়া রহিলাম, মুখ দিয়া বাহির হইল—‘এ কি! ব্যাপার কি?’

তাহার ঠোঁট খুলিয়া গিয়া কাঁপিতে লাগিল। সে বলিল—‘রান্নাঘরের চালা উড়ে গেছে। তারপর দক্ষিণ দিকের নারকেল গাছে বাজ পড়ল। বাড়িতে আমি একা—’

‘গুরুচরণ কোথায়?’

‘সন্ধ্যের ট্রেনে কলকাতা গিয়েছে—’

এই সময় বজ্র আর একবার হুঙ্কার দিয়া উঠিল। সুরমা দু’হাতে কান ঢাকা দিল, তারপর বলিল—‘পৃথিবী কি উল্টে যাবে?’

বলিলাম—‘তুমি বড় ভয় পেয়েছ। এস, ওষুধ দিচ্ছি।’

ডাক্তারখানায় লইয়া গিয়া তাহাকে এক আউন্স ব্রাণ্ডি খাওয়াইয়া দিলাম। তারপর তাহাকে শয়নকক্ষে লইয়া গিয়া বলিলাম—‘তুমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাক, ভয় কেটে যাবে। আমি বাইরের ঘরে আছি।’

এই সময় হঠাৎ দপ্ করিয়া আলো নিভিয়া গেল। সুরমা আর্ত কাতরোক্তি করিয়া অন্ধকারে ছুটিয়া আসিয়া আমাকে খামচাইয়া ধরিল। …

ভগবান জানেন, দুরভিপ্রায় আমাদের কাহারও মনে ছিল না। যোগাযোগ দেখিয়া মনে হয় যেন দুইজন অতি সামান্য নরনারীর অযাচিত মিলন ঘটাইবার জন্য সে রাত্রে নিয়তি এমন বিপুল ষড়যন্ত্র করিয়াছিল। কিন্তু সে যাক। নিয়তির অভিপ্রায় বুঝিবার চেষ্টা করিব না। এবং নিজের দুর্বলতার দায় নিয়তির ঘাড়ে চাপাইয়া সাধু সাজিবারও ইচ্ছা নাই।

সুরমাকেও আমি বিচার করিব না। চিরদিন তাহার যে শুদ্ধ-শান্ত রূপ দেখিয়াছি তাহা তাহার ছদ্মবেশ, একথা স্বীকার করি না। ইহাই তাহার প্রকৃত স্বরূপ। কিন্তু প্রকৃতির শান্ত নিরুদ্বেগ অন্তরে অলক্ষিতে যেমন ঝড়ের বাষ্প জমিয়া একদিন বিস্ফোরণের আকারে ফাটিয়া পড়ে, তেমনি মানুষের অন্তরেও যে অনুরূপ ব্যাপার ঘটে না তাহা কে বলিতে পারে।

সে রাত্রে ঝড় থামিবার পর রাত্রি সাড়ে তিনটার সময় সুরমা গৃহে ফিরিয়া গিয়াছিল। তারপর—তারপর—

পঙ্কজ আমার ছেলে। যেদিন তাহাকে প্রথম দেখিয়াছি সেইদিন হইতে জানি সে আমার ছেলে।

মৃত্যুশয্যায় শুইয়া গুরুচরণ হাঁপাইয়া কথা বলিতেছে। আমি শয্যার পাশে বসিয়া শুনিতেছি। সুরমা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া নিঃশব্দে কাঁদিতেছে।

—‘খোকার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম…সুরমাও অস্বীকার করেনি…কয়েক মাস বড় অশান্তিতে কেটেছিল…ভেবেছিলাম…ওদের ত্যাগ করব…কিন্তু ত্যাগ করতে গিয়ে দেখলাম খোকাকে ছেড়ে আমি মরে যাব। —সুরমা, খোকাকে আসতে লিখেছ? মরার আগে তাকে দেখতে পাব তো?…’

এ কাহিনী কোথায় শেষ করিলে ভাল হয় জানি না। ইহার কি শেষ আছে? আমি যখন থাকিব না, সুরমা যখন থাকিবে না, হয়তো তখনও এ কাহিনীর রেশ চলিতে থাকিবে। সুতরাং এখানেই ছেদ টানা ভাল।

২৬ পৌষ ১৩৬৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *