সুখের লাগিয়া
ইহুদিদের ধর্মশাস্ত্রে একটি কথা আছে, মুখরা কলহপ্রবণা স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করার চেয়ে বাড়ির কার্নিসে পাখির মতো বসবাস করাই ভালো। প্রশ্ন হল, স্ত্রী কেন স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করেন? তার আগে জানা দরকার, কীভাবে স্ত্রী হয়। কোনও মেয়ে জন্মেই স্ত্রী হতে পারে না। স্ত্রীলোক হয়ে জন্মায়। তারপর ব্যাঙাচি যেমন লেজ খসে ব্যাং হয়, সেইরকম স্ত্রীলোকের লেজ খসে স্ত্রী হয়। লোক জিনিসটা কী? পিতৃলোক ছেড়ে শ্বশুরলোকে আগমন মানেই লেজখসা। জন্মসূত্রে পাওয়া টাইটেল মাইটেল সব গেল। ঘোষ হল বোস। মুকুজ্যে হল চাটুজ্যে। নিজের বাবা, মা গেল ভেসে। শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়েই ব্যস্ত।
।। স্ত্রী হয় কি ভাবে?।।
সাবেক প্রথা হল, মেয়ে বড় হল। যাকে বলে যুবতী। শুদ্ধ বাংলায় অরক্ষণীয়া। বাপ-মা কেমন করে বুঝবেন মেয়ে অরক্ষণীয়া! বনে যখন ফুটল কুসুম, ফুল ফুটলে ভ্রমর এসে ভোঁভোঁ করবে। লোকে থমকে দাঁড়াবে, আড়ে তাকাবে। ছেলেরা সিটি মারবে। মানে, ছেলেদের কাজ ছেলেরা করেছে। টেরিফিক সিটি মেরেছে। কাগজের গুলিফুলি মারতে পারে ছুঁড়ে। সাইকেল নিয়ে চক্কর মারতে পারে, প্রজাপতির মতো, ফুলের চারপাশে। ইলিবিলি করে এসের মতো, জেডের মতো কেরামতি করতে পারে, নর্দমার পড়ে যেতে পারে। শাড়ির আঁচল উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। করবেই তো, করবেই তো।
বারে বারে চলে যায় জানালার কাছে
উদাস চোখে তাকায় আকাশের পানে
কখনও মেজাজ ভীষণ ভালো দয়াময়ী
কখনও সপ্তমে খেঁকী।
তখনই বুঝতে হবে, মেয়ে পড়েছে প্রেমে।।
মেয়ের যখন এমতো অবস্থা তখনই শুরু হবে গৃহিণীর তাড়া। পার করো নাইয়া। নাইয়া নয়, ভালো একটা ছেলে ধরে মেয়েকে পার করো।
।। ছেলেধরা ।।
পিতা-মাতার ছেলেধরার একালের সহজ পদ্ধতি হল কাগজে বিজ্ঞাপন, যতটা সম্ভব কমখরচে। প্রায় কোড ল্যাঙ্গোয়েজে। কন্যা বি.এ, দ: রা:, পাঁ ফু: বয়স কুড়ি, উজ্জ্বল শ্যাম, গান জানে, ব্রা: পাত্র চাই, ব্যাঙ্ক কর্মী, সরকারি চাকুরে, নিজেদের বাড়ি থাকলে ভালো হয়। পোস্টবক্স। কন্যাপক্ষ অবশ্য আধ পাতার একটা বিজ্ঞাপন লিখে নিয়ে থাকেন, তাতে অজস্র বিশেষণ থাকবে, গৃহকর্মে সুনিপুণা, নৃত্যগীতে পারদর্শিনী, সুহাসিনী মৃদুভাষিণী। বিজ্ঞাপনকর্মী বলবেন, ছাঁটুন, ছাঁটুন, কদম ছাঁট মারুন, বিজ্ঞাপনেই তো দেউলে হবেন। সব বিসর্গ মারুন। বিজ্ঞাপনের ঠেলায় ছেলে জুটলেও বিয়ে দেওয়ার রেস্ত থাকবে না। মেয়ের বাবা যেমন ছেলে খোঁজেন, ছেলের বাবা-মা সেইরকম মেয়ে খোঁজেন।
।। মেয়েধরা।।
ছেলেদেরও পালক গজায়, উড়তে শেখে। প্রথমে গলার স্বর ভাঙে। প্রবীণরা বলেন, বয়সা লেগেছে। গোঁফ চাড়া দেয়। মন চনমন করে। বাথরুমে গান ধরে, আঁধারে আমি তোমায় খুঁজে বেড়াই। বারেবারে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চুলের পাশ ফেরায়, সাজগোজের ঘটা বাড়ে। গদ্যের চেয়ে পদ্য পড়তে ইচ্ছে করে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। পাড়ার বউদিদের দিকে তেড়ে যায়। টিউশনি করলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের দিকেই মন যায়। কুছ পরোয়া নেহি, বিনা মজুরিতেই পড়াব শেলি, তুমি অঙ্কে বড় উইক।
তখন সবাই বুঝতে পারেন। ছেলেকে জুততে হবে জোয়ালে। ছেলে এখন পার্টনার খুঁজছে। শুরু হবে অনুসন্ধান। শুধু ছেলেকে একটা বউ জোগাড় করে দিলে তো হবে না। একটু বাণিজ্যও করে নেওয়া যাক।। রথদেখা কলা বেচা।
।। ছেলে যেন মাছ ।।
রুই, কাতলা, চিংড়ি, ইলিশ। মেয়ের বাবা কিনতে আসবেন। যাঁর যেমন রেস্তো? বেশ ভালো চাকুরে হল রুই। মার্চেন্ট অফিসের একজিকিউটিভ। কাতলা হল সরকারি চাকুরে। মাথাটা মোটা। মাইনে কম। কাজ বেশি, কিন্তু পেনশান আছে। তাই মাথা মোটা কাতলা। খুব বড় ব্যবসায়ী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার চিংড়ি। আর বিদেশে প্রবাসী হল ইলিশ। একেবারে ভিন্ন স্বাদ। বহুত তেল। মেয়ের পিতা মেয়ের জন্যে মার্কেটে বেরোবেন। দেওয়ার ক্ষমতা থাকলে ভালো পাত্র জুটবে। নইলে, যেমন তেমন, চুনোপুঁটি।
।। চুনোপুঁটির খেল ।।
কিছু হল না তো একটা বিয়েই করি। প্রবাদ আছে, স্ত্রীভাগ্যে ধন। তেমন রোজগারের জোর নেই। ছেলে লড়িয়ে দিলে বিয়ে। লক্ষ্য মেয়ে নয়, শ্বশুর। একটু স্কুইজ করব, মানে নেঙড়াব। স্ত্রীকে চাপ দেব, আঁআঁ করবে, শ্বশুরমশাই টাকা ছাড়বেন। অর্থাৎ শ্বশুর হল দুধেল গরু চ্যাঁক চোঁক দুইব। শ্বশুরমশাই ফেল করলে—দুটো রাস্তা (১) বউকে বের করে দাও। (২) নয়তো ঝুলিয়ে দাও।
।। প্রশ্ন ।।
এত ছেলে? দেশে নো চাকরি। যৌবনের ধর্ম। বেকারও তো রক্তমাংসের মানুষ। প্রচ্ছন্ন বেকারিই তো সব। চাকরি একটা করে। উদয়াস্ত খেটে মরে। মাইনে মেলে সাকুল্যে পাঁচশো। সব কি ব্রহ্মচারী হয়ে যাবে। তাই প্রেম বাড়ছে। বিয়ে কমছে।
।। প্রেম বাড়ছে ।।
সভ্যতা বাড়ছে। অসভ্যতা বাড়ছে। সভ্যতার বয়স বাড়ছে। নেতা বাড়ছে, গুরু বাড়ছে, চেলা বাড়ছে, জন্মের হার বাড়ছে, জিনিসের দাম বাড়ছে, কালো টাকা বাড়ছে, খুন বাড়ছে, গুণ্ডামি বাড়ছে। সেই রকম প্রেমও বাড়ছে। চারের দশক, পাঁচের দশকে এত প্রেমিক, প্রেমিকা ছিল না। যত লোডশেডিং বাড়ছে, তত প্রেম বাড়ছে। যত ফ্ল্যাট বাড়ছে, তত প্রেম বাড়ছে। যত বেকার বাড়ছে, তত প্রেম বাড়ছে। ছয়ের দশক পর্যন্ত প্রেম ইঁদুরের মতো বইয়ের কলে, রূপালি পরদার ঘেরাটোপেই আটকে ছিল। হঠাৎ বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, আ হা, হা হা হা হা।
এখন ঘরে ঘরে প্রেমিক-প্রেমিকা।
যদি প্রশ্ন করা হয় ছেলে কী করে?….
‘আজ্ঞে প্রেম করে।’
‘চাকরি বাকরি?’
‘দেশে তো চাকরি নেই, আছে সংরক্ষণ। যা নেই, তার সংরক্ষণ।’
‘খালি বাটি চাপাচুপি দিয়ে রাখা। খুলে দ্যাখো ফক্কা।’
‘তাহলে প্রেম ছাড়া করে কী? জীবনের ছক বাতলান।’
।। ফুরফুরে জীবন ।।
এই সকাল আটটা, সাড়ে আটটা, কখনও ন’টার সময় ঘুম থেকে ঠেলেঠুলে তোলা হয়। ভীষণ বেজার মুখে ভুরু কুঁচকে চা খায় এক কাপ। বেড টি। ইংলন্ডের লর্ড আর্ল ব্যারনদের মতো। বাপ কখনও বেডটির নাম শোনেনি। ছেলের কথাই আলাদা। বাপ ফকির, ছেলে প্রিন্স। তারপর আড়মোড়া ভাঙে। হেলাফেলা করে কাগজের হেডলাইনে চোখ বুলিয়ে চলে যায় সোজা খেলার পাতার। তিনটে অ্যারিস্টোক্র্যাটিক খেলা ভীষণ ভালো বোঝে। ব্যাট বগলে জন্মেচ্ছে। ফুটবল কিক করে বড় হয়েছে, টেনিস সম্প্রতি দেশের অবস্থা ভালো হওয়ার পর বুঝতে শিখেছে? মাঠে নামে না, সেটা আলাদা কথা। বিছানায় বসে এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দেয়। এরপর সে দ্বিতীয় কাপ চা খেয়ে পিতা ও মাতার শ্রাদ্ধ করে, কারণ জনক-জননী তার চেতনা উদ্বোধনের জন্যে গাধার মতো উপদেশ দিয়ে থাকতে পারেন। বা বলে থাকতে পারেন, পুত আলস্য আর আঁতলামো ত্যাগ করে বিষয়কর্মে মন দাও। কঠিন সময়। বুদ্ধিজীবীরা, বুদ্ধির টিকি নাড়তে গিয়ে পরনের কাপড়টিও হারাতে বসেছে। বিষয়, সম্পত্তি, জমিজিরেত, দানাপানি সবই বৈশ্যকুলের দখলে। কালো টাকার তোশকে গড়াগড়ি যায়, কিতনা ভাওয়ের দল। পদযাত্রা, পথসভা, দেওয়াল-লিখনে কপালের লিখন পালটাবে না। বড় দু:সময়। এম. এল.এ., এম. পি. মন্ত্রী—এ ছাড়া আর কোনও পদ খালি নেই। সেখানে উঠতে হলে, কাঁচা খেতে হবে, কচি খেতে হবে কচরমচর। দেশ আর দশের ভবিষ্যৎ ভুলতে হবে, পুরোনো চালের জমিদারি মেজাজ অভ্যাস করতে হবে। জননী বলে থাকতে পারেন, বাছা, জমিদারের বেটার মতো ন’টায় বিছানা ছাড়ছ আর হার্টের রুগি বাপ বাজার, দোকান, রেশন, কেরাসিন করে হাঁপিয়ে মরছে। কুটোটি নেড়েও তো সাহায্য করো না। একটু করতে পারো তো। এবম্বিধ অশালীন ব্যবহারের বিরুদ্ধে পার্টিসুলভ প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি চলে গেলেন সমাজসেবায়। রক আছে, চায়ের দোকান আছে। ফরাসি জীবনে যেমন কাফে, সেইরকম আমাদের যুবজাগরণ-কেন্দ্র হল রক, চায়ের দোকান। এইখানে বসেই আমাদের জাতি জাগছে। ফুটবলে, ক্রিকেটে, সিনেমায়, থিয়েটারে, সঙ্গীতে, সহবতে, সমালোচনায়, রাজনীতিতে। এই হল আমাদের মহামানবের সাগরতীর। এখানেই ফুটবে ব্রহ্মকমল।
দুপুরে তিনি সাবেক প্রথায় লাঞ্চ করবেন। ভাত, ডাল, মাছের ঝোল। দিবানিদ্রা হল বিউটি স্লিপ। সন্ধের ঝোঁকে সামান্য প্রেম। ইলা, পলা, নীলা, লীলা—অভাব নেই। ফল পাকার মতো গৃহে গৃহে প্রেম পেকেই আছে। একটু নাড়া কি ঝাড়া দিলেই টুপটাপ। অভিভাবকদের দাঁতের জোর কমে গেছে। মুঠো আলগা, ছেলে, মেয়েরা সব স্বাধীন। যা খুশি তাই করব। মরতে হয় মরব। অনেক আগেই গান গেয়ে প্রেমের ফ্লাট গেট খুলে দিয়েছেন কবি :
প্রেম করেছি বেশ করেছি, করবই তো!
প্রেমিকা বারান্দায়, প্রেমিক রাস্তায়। বম্বে ছবির ডিরেক্টররা টিন এজ লাভ স্টোরির বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। সেই ধারাতেই প্রেমিক গাইবে।
প্রেমিকা : সুরঞ্জনা নেমে এসো না।
তোমার ওই বারান্দা থেকে।।
প্রেমিকা : বাবা বকবে, মা মারবে।
প্রেমিক : সুরঞ্জনা প্লিজ নেমে এসো না
তোমার ওই বারান্দা থেকে।
আর কতকাল দাঁড়িয়ে থাকব
ল্যাম্প পোস্ট ধরে।
প্রেমিকা : মা মারবে, বাবা বকবে।
প্রেমিক : তোমার বাবা বেহেড মাতাল
মা তো খিটখিটে ডাইনি।
কেন আছ ওই কারাগারে
এখনও কি সময় হয়নি!
সুরঞ্জনা প্লিজ নেমে এসো না।
তোমার ওই বারান্দা থেকে।
।। প্রেমের তিনপর্ব ।।
ঘোরাঘুরির পর একটু বিয়ের মতো ব্যাপার হবে। রেজেস্ট্রি। মেয়ের মা তেলে, বেগুনে জলে উঠবেন। বলবেন, ও মুখপুড়ীর মুখ আর আমি দেখতে চাই না। মেয়ের বাবার মাইলড হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। মেয়েরা বাবার খুব প্রিয় হয়। মেয়ের সে দিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ থাকবে না। প্রেমের প্লাবনে তার তখন যায়, যাক, সব যাক, শুধু থাক প্রিয়তম। বছরখানেক খুব হল্লাগুল্লা। তারপর দ্বন্দযুদ্ধ। শ্বশুর, শাশুড়ির মুখ নাড়া, ননদের অন্তর্টিপুনি। তারপর বাচ্চাকোলে শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ। প্রেম, বিবাহ, পথ—প্রেমের তিনপর্ব ফিনিশ।
প্রতিষ্ঠিত প্রেম : ছ্যাঁচড়া প্রেমের পাশাপাশি আছে প্রতিষ্ঠিতের প্রেম। ভালো চাকরি। উচ্চ শিক্ষিত। সংসার করার মুরোদ রাখে। সহকর্মী বা সহপাঠীর সঙ্গে ভাব ভালোবাসা। বা কোনও উৎসবে কারোর সঙ্গে দেখা। এক পলকের একটু দেখা। মন আনচান, প্রাণ আঁকুবাঁকু। একটু কথা। একটু হাসি। নির্জনে মিলন। দামি রেস্তোরাঁয় ভোজন। ইংরিজি সিনেমা। হঠাৎ বাইরে গিয়ে সব্বাইকে ছেড়ে আগে একটি বিশাল প্রেমপত্র। সাহিত্য আর কবিতার মশলা দেওয়া। নমুনা,
মানসপ্রিয়া / সুচরিতা / স্বপনচারিণী / জগদম্বা,
অফিসের কাজে হায়দ্রাবাদ চলে আসতে হল হঠাৎ। দেহ এখানে, হৃদয় তোমার কোলে। এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, মনে হচ্ছে শূন্য একটা খাঁচা কর্তব্যের দায় টেনে চলেছে। পাখি বসে আছে তোমার মিষ্টি কাঁধে। কানের কাছে গান শোনাচ্ছে— আমি তোমায় ভালোবাসি—চিরাপ, চিরাপ, আমি তোমায় ভালোবাসি। অনেক ভেবে শেষে এই বুঝলুম—প্রেমই সব। প্রেম ছাড়া পৃথিবীতে কিছু নেই। মানুষ জন্মায় প্রেম করবার জন্যে। ব্রিফকেস ধরে আছি। মনে হচ্ছে তোমার হাত। বুকপকেটের কাগজপত্র মনে হচ্ছে তোমার হৃদয়। হটব্যাগের মতো টলটল করছে। তোমাকে বুকের কাছে চেপে ধরে আমার এই বোধিই হয়েছিল। আকাশে তাকাই তোমার মুখ। বাতাসে তোমার কণ্ঠস্বর।
[এরপর নিজেকে একটু জাহির করা, কারণ দেখাতে হবে আমি কত বড় একজিকিউটিভ। সারা জীবন তোমাকে দানাপানি দিয়ে বয়ে বেড়াবার ক্ষমতা আমি রাখি সোনা। মধ্যযুগের মেয়েদের সামনে বীরত্ব দেখাত পুরুষ ‘নাইট’ হয়ে, ঘোড়ায় চেপে, তরোয়াল ঘুরিয়ে, বর্ম পরে। পুরুষরা একটু শিভ্যালরি দেখাবেই।]
এ. সি ফার্স্টক্লাসে চলেছি। হাতে একটা থ্রিলার। অক্ষর দেখতে পাচ্ছি না। তোমার মুখ। এখন প্রায় মাঝরাত। পাঁচতারা হোটেলের টঙের ঘরে বসে আছি। যেন ইন্দ্রপুরি। পুরু কার্পেটে পা ডুবে যাচ্ছে। আকাশের গায়ে বানজারা হিলস—আলোকমালা। পেটে সুস্বাদু খাবার একটু বিলিতি পানীয়। উপায় ছিল না সুচরিতা। যে খেলার যা নিয়ম। টপের দিকে গেলে ড্রিঙ্ক একটু করতেই হয়। প্রথা। কেরিয়ারের স্বার্থে। তুমি রাগ কোরো না সুইট। আমার পেছনে অপেক্ষা করছে, ফোমে ঢাকা বিশাল বিছানা। কেবলই মনে হচ্ছে, তুমি যদি থাকতে আমার পাশে। আলো যেমন থাকে প্রদীপ ঘিরে। ধূপকে ঘিরে ধুপের ধোঁয়ার মতো। যদি তুমি রাখতে আমায় ঘিরে। ভাবছি আজ আর শোব না। উলের বলের মতো তোমার স্মৃতি কোলে ধরে বসে থাকব সারা রাত।
[আবার একটু নিজেকে জাহির-দেখা, আমি একটা কেউকেটা।]
অবশ্য কাল আমার খুব হেকটিক ডে। সকাল থেকেই সেমিনার। হোল ডে। সাদার্ন রিজিয়নের সব টপ বসেরা আসবেন। মন্ত্রী-টন্ত্রী। আমাকে একটা পেপার পড়তে হবে। তুমি আমার পাশে আছ (বাবা নয়, মা নয়, ভগবান নয়। তুমি আছ। একে বলে ‘তুমি ফেজ’ পরে হবে আমি। প্রথমে তুঁহুঁ, তুঁহুঁ। বিগলিত অবস্থা। বিয়ের পরে হাম্বা, হাম্বা। আমি, আমি। বছর না ঘুরতেই তুম্বা, তুম্বা। তুমি আর আমি লাগাও লাগাতার ঠোকাঠুকি। রসগোল্লার সব রস বেরিয়ে গেল, পড়ে রইল ছানা)
একটা সুন্দর জিনিস দেখেছি তোমার জন্যে, যাওয়ার সময় নিয়ে যাব। তুমি যে আমার ওগো, তুমি যে আমার।
।। দাম্পত্য জীবন ।।
প্রেমই হোক আর সম্বন্ধ করেই হোক বিবাহ হবেই। শয়ে একজন নয় তো ব্যাচেলার থাকবেন। বিবাহের পেছনে একটা মহাযুক্তি হল। ব্যাচেলার লিভস লাইক এ প্রিন্স অ্যান্ড ডাইজ লাইক এ ডগ। ভেবে দেখো, শেষের সেদিন কী ভয়ঙ্কর! শেষের সেইদিনের কথা ভেবেই বিবাহ। শেষকালে কে দেখবে? না, বউ দেখবে? কে কাকে দেখে!
ফ্রয়েডকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নরনারীর মনোজগতের খবর আপনার চেয়ে ভালো আর কে জানে? তা আপনার সঙ্গে আপনার স্ত্রীর কি কখনও মনোমালিন্য হত? ফ্রয়েড বলেছিলেন না। একবার হব, হব হয়েছিল, খুব জোর সামলে নিয়েছিলুম।
কী ভাবে? কোন কৌশলে?
।। কলহহীন দাম্পত্যজীবন ।।
গীতা বলছেন, যোগ কর্মসু কৌশলম। কৌশলটাই সব। কিছু নিয়ম মানতে হয়। ব্যবহারিক জ্ঞান আয়ত্ত করতে হয়। দুটো মানুষের বোঝাপড়া সহজ কথা! তাও আবার কেমন মানুষ, স্বামী-স্ত্রী। ইংরেজিতে যাকে বলে, সোর্ন এনিমি, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শক্র। কিছু জীবনদায়ী ওষুধ আছে, অল্প মাত্রায়, ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারলে মৃতসঞ্জীবনী। মাত্রার সামান্য হেরফেরে মৃত্যু। ধরা যাক, আর্সেনিক কী ওপিয়াম! ভয়ঙ্কর পেটের গোলমালে অব্যর্থ ওষুধ। ভোল পালটে দিতে পারে পেটের। মাত্রার সামান্য ঊনিশ-বিশে মৃত্যু। স্ত্রী-ও সেই রকম জীবনদায়িনী। ব্যবহারবিধি জানা চাই।
।। ব্যবহার-বিধি ।।
সেকালে দোকান বিশেষে প্ল্যাকার্ড ঝুলত ‘খরিদ্দার প্রভুর সমান।’ সংসারেও মনে রাখা প্রয়োজন, ‘স্ত্রী প্রভুর সমান।’ এই ‘সার্মনটি’ ভুললেই বিপদ। পদে পদে ঠোক্কর। দুজন সমান মাপের নেতা পাশাপাশি থাকলে কী হয়? চারপাশে তো দেখতেই পাচ্ছি। ভি.পি. চন্দ্রশেখর কেস। ন’মাসও সরকার টেঁকে না। সংসারও তো এক সরকার। দুজনেই নেতা হলে চলে কী করে! আগে বুঝে নিতে হবে, স্ত্রীটি কোন পদের!
।। স্ত্রী যেন নারকোল ।।
যেমন? বাজার থেকে নারকোল কিনে আনলুম। সব নারকোলই একরকম দেখতে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। সবই প্রায় একরকম দেখতে। ভাঙতে হবে। ভেঙে দেখা গেল একটা বেশ নরম, মিষ্টি। আর একটা কাঠের চাকলা। নরম হলে মুড়ি মাখো আচ্ছা করে সরষের তেল দিয়ে। নরম দুরমো নারকোলের সঙ্গে জমে গেল। আর যদি শক্ত হয়, ডুমো ভুমো করে টুকরো হল। চলে গেল মুগের ডালে। কী কুরুনিতে কুরে হয়ে গেল মোচারঘণ্ট। বোঝার তো উপায় নেই। ভাঙতে হবে। স্ত্রী তো খাদ্য নয়। জীবনের সঙ্গী। নরম, মিষ্টি হলে তার ওপর তুড়ুম ঠোকা যায়। তখন কর্তাই সংসার-গদির পি.এম. কী সি. এম হলে গদি ওলটাবে না। আর স্ত্রী যদি কম রসালো, কঠিন হয়, তাহলে খরিদ্দার প্রভুর সমানের মতো, স্ত্রী প্রভুর সমান নীতিটি স্মরণে রেখে কেঁচো হয়ে থাকাই ভালো।
।। স্বামী তো খরিদ্দার ।।
তবে একটু তফাত আছে। ধারের ক্রেতা। তিনি চান ‘সাভির্স’। সেবা, মনোযোগ, বন্ধুত্ব। যা ট্যাঁকের কড়ি দিয়ে কেনা যায় না। পোষ মেনে আদায় করতে হয়। অনেকটা ভিখিরির স্ট্যাটাস। মালকিনের মুড বুঝে হাত পাততে হয়। বেশি হম্বি তম্বি করে লাভ নেই, Love হয় না।
।। স্বামী হবে পেট-ডগ ।।
পোষা কুকুরকে অনুসরণের চেষ্টায় সুখ বই দু:খ নেই। কুকুর বাধ্য হলে আদর পায়। কোলে ওঠে। বিস্কুট খায়। বিছানায় শোওয়ার অধিকার পায়। মালকিনের আদরের কুকুর। নিজে ভালো কিছু খেতে গিয়ে কুকুরের কথা মনে পড়ে যায়, অমনি নাম ধরে ডাকে। কুকুর অমনি ছুটে এসে পুটপুট করে লেজ নাড়তে থাকে। নরম একটা হাত এসে কুকুরের মাথায় পড়ে। চুড়ি বেজে ওঠে রিনঝিন। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। আদরে-সোহাগে জরজর। কুকুর হল বাড়ির পাহারাদার, কর্তাও হল বাড়ির চৌকিদার। অতন্দ্র প্রহরী। কুকুরকেও যেমন বিশ্বস্ত হতে হয়, গৃহীকেও সেইরকম হতে হয় বিশ্বস্ত। তা না হলে মানুষ ছিছি করবে। পাঁচজনে চরিত্র ধরে টানাটানি করবে। বলবে, লোকটা চরিত্রহীন, বিয়ে-থা করেছে, সংসার করেছে; কিন্তু উড়ুউড়ু স্বভাব, উদাসীন, নিশ্চয় অন্য কোথাও অন্য কিছু আছে। সংসার আমাদের কাছে বিশ্বস্ততা চায়।
।। দাস হও।।
সংসার করেছে, বাপু, আর তো কোনও উপায় নেই। সেই গানটি মনে রাখতে হবে। সদাই গাইতে হবে মনে মনে জাতীয় সঙ্গীতের মতো। সংসারিও একটা জাতি। সেই জাতির সংসার-সংগীত।
লোহার বাঁধনে বেঁধেছে সংসার, দাসখত লিখে নিয়েছে হায়।
আমার খেটে খেটে খেটে জনম গেল কেটে, তবুও খাটা না ফুরায়।।
আলস্য অসুখ রোদ বৃষ্টি নাই, কাঁধেতে জোয়াল না আছে কামাই,
চোখে জল ঝরে, মুছি এক করে, অন্য করে বোঝা তুলি মাথায়।
বড় শ্রান্ত হলে পাছে ঘুমাই বলে, রেখে দেছে তারা শত্রুর মহলে,
মায়া-ছাঁচে-ঢালা আগুনের ঢেলা বুকে পিঠে চড়ে সতত বেড়ায়।।
চিরকালের কথা—সংসার মানেই দাসত্ব। দাস হাওয়ার জন্যেই সংসারে ঢোকা। বিনামাইনের চাকর! একজন বলেছিলেন, ‘মশা কামড়াবার আনন্দটা কোথায় জানো ভাই?’
‘কোথায়?’
‘বেশ ফুলে ওঠে, তখন হাত বোলাতে টেরিফিক ভালো লাগে!’
সংসারের দংশনেরও অদ্ভুত একটা আনন্দ আছে।
।। যেন কচি বেড়াল ।।
বাচ্চা বেড়াল কোলে শুয়ে আছে। মাথায় কি পেটে হাত দিলেই নরম থাবার নরম নখ দিয়ে খুরখুর করে আঁচড়ায়, কচিকচি দাঁত দিয়ে কুটুস কুটুস কামড়ায়। বেশ মজা লাগে। একটু আঁচড়, অল্প রক্তপাত, সামান্য জ্বালা। পরিবার পরিজনের দংশনকে সইয়ে নিতে পারলে ভালোই লাগবে। প্রেমসে বলতে হবে, মেরেছ কলসির কানা তা বলে কী….?
।। লো থেকে হাই ।।
আজকাল নানা থেরাপির কথা শোনা যায়, ওয়াটার থেরাপি, মাড থেরাপি, শক থেরাপি। বহুতর চিকিৎসা-পদ্ধতি। প্রচলিত হয়েছে আকুপাংচার। সর্বাঙ্গে ছুঁচ ফোটানো। ভালোই উপকার হয় অনেকের। তেমন লাগেও না। মশার কামড়ের মতো। পরিবারের বাক্যবাণ, যা নিয়ে শুরু হয় শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ, সে বাণ হল আকুপাংচার! আমরা বুঝতে ভুল করি। ওয়ার্ড থেরাপি। কথার কাঁটা ফুটিয়ে চনমনে করে তোলার চেষ্টা। যাঁদের লো-প্রেসার, লেথার্জি, কাজে মন লাগে না, অতিরিক্ত ধুম্রসেবনে ফুসফুস ক্লান্ত, বাক্যপাংচারে তাঁদের অশেষ উপকার। একরাউন্ড কাজিয়ার লো প্রেশার হাই। চিৎকারে ফুসফুসের ব্যায়াম। পরিবারকে সময় সময় শত্রু ভেবে আমরা বিরাট ভুল করি। তাঁরা স্বভাব-চিকিৎসক। ‘যতই করিবে ঝগড়া ততই /আয়ু যাবে বেড়ে।।’
।। প্রতিভার উন্মেষ ।।
এই যে দাম্পত্য-কলহ, এর একটা মস্ত দিক হল, প্রতিভা ফেটে বেরোয়, প্রতিভা ফুটে বেরোয়। দূর থেকে লক্ষ্য করতে হবে নিরপেক্ষ ভাবে। গিন্নি এক ডোজ করে চাপাচ্ছেন, কর্তা তেড়ে ফুঁড়ে উঠছেন। তেজিয়ান মোরগের মতো খড়খড় করে এদিক যাচ্ছেন, ওদিক যাচ্ছেন। যেন বঙ্গ-রঙ্গমঞ্চে এক নতুন কার্ভালো। যে এমনি মিউমিউ করে তার ডায়লগের কী তেজ! কী হাত-পা নাড়া! কত রকমের ভাষা! কর্তা আর গিন্নি দুজনকেই স্টেজে তুলে দিলেই হল। একস্টেম্পোর অভিনয়। ফটাফট হাততালি। মারকাট ব্যাপার। এটাকে একটা কালচারাল পারফরমেন্স, সাংস্কৃতিক উৎসব ভাবাই উচিত। ঘরে ঘরে চলুক না। ক্ষতি কী!
।। জাত কাকে বলে!।।
আমরা মনে করি, জাত হলঃ ব্রাহ্মণ, শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয়। তা নয়। জাত হল এই রকম, কেউ বলবে, কেউ শুনবে। কেউ গালাগাল দিয়ে ভূত ভাগাবে, কেউ সেই গালাগাল হাসিমুখে সহ্য করবে। কেউ লেনেওয়ালা, কেউ দেনেওয়ালা। কেউ মারনেওয়ালা, কেউ মারখানেওয়ালা। কেউ ভোগ করবে, কেউ শুধুই দুর্ভোগ ভুগবে। কেউ গাড়ি চড়বে, কেউ গাড়ি চালাবে। কেউ হুকুম করবে, কেউ তমিল করবে। কেউ পরিষ্কার করবে, কেউ নোংরা করবে। কেউ বাঁশ দেবে, কেউ সেই বাঁশ খাবে। কেউ বাড়িওয়ালা, কেউ ভাড়াটে। নির্যাতক, নির্যাতিত, অপহারক, অপহৃত, দলনকারী, দলিত, বক্তা, শ্রোতা, ল্যাং মারনেওয়ালা, ল্যাংখানেওয়ালা। পৃথিবীর মানুষের এই হল সঠিক জাতি-বিভাগ। তাহলে নতুন দৃষ্টিতে স্বামীর জাত কী? মারখানেওয়ালা। এইটা মনে রাখলেই সব সমস্যার সমাধান। স্ত্রীজাতি হল শক্তি। পুরুষ জাতি হল শায়িত শব। শিবের বুকে কে? মা কালী। মানেটা কী?
।। সারেন্ডার ।।
মানেটা হল ‘সারেন্ডার’। খোঁচাখুঁচি নয়। হম্বিতম্বি নয়। বুক পেতে দাও। এই পাতা আছে মোর পাষাণ বেদি। ধেই নাচ নাচো। নো প্রবলেম। আমি ভোলানাথ। নড়বও না, চড়ব না। স্রেফ পড়ে থাকব শক্তির পদতলে। কত ভোল্ট শক্তি চালাবে, চালাও। মহাদেব ছিলেন মস্ত বড় ইলেকট্রিসিয়ান। তিনি জানতেন ‘আর্থিং’ কাকে বলে? জমি নাও। বজ্রপাত হলেও পৃথিবী টেনে নেবে। মহাদেব জানতেন, স্ত্রী হলেন হাইভোল্টেজ ইলেকট্রিসিটি।
।। দুটো কান কেন?।।
সব কিছুর একটা মানে আছে। আমাদের কান দুটো কেন? এক কান দিয়ে ঢুকবে, আর এক কান দিয়ে বেরিয়ে যাবে। পথ পরিষ্কার রাখো। সারাদিন, সারা জীবন কত কথাই শুনতে হবে। বয়েসকালে কানের শক্তি কমে কেন? একটাই কারণঃ রোজগারপাতি কমবে, দায়দায়িত্ব বাড়বে, অপর পক্ষের ঝাড়ফুঁকও প্রবল হবে, তখন আর ছোটকথা কানে নিয়ো না! তখন যেন এই অবস্থা স্বাভাবিক ভাবেই হয়—এই ছেলেটা ভেলভেলেটা ফ্যালফ্যাল, ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
‘শুনছ, মেয়ের বিয়ের কী করলে? খুব তো বসে বসে মোয়া খাচ্ছ?’
‘কি বলছ? কিছু বললে?’
‘ মেয়ের বিয়ে।’
‘বিয়ে। আবার বিয়ে এই বয়সে?’
‘ তোমার বিয়ে নয়। মরণ আমার। মেয়ের বিয়ে।’
‘যাবে, গচ্চা যাবে। বিয়ে মানেই তো শাড়ি। শ’তিনেক টাকা।’
‘এই লোকটা আমাকে পাগল করে দেবে। হাড়মাস কালি কালি। যবে থেকে এর হাতে পড়েছি। অন্য স্বামীদের দ্যাখো, চোখ জুড়িয়ে যায়।’
।। সব স্ত্রী এক রা ।।
কী ধরনের কথা শ্বশুর মহাশয়ের কন্যারা বলতে পারেন, তার একটি তালিকা;
দ্যাখো, দেখে শেখো, অরুণার স্বামী। সব কাজ করে। আর তুমি? এক গেলাস জল গড়িয়ে খাওয়ারও মুরোদ নেই।
তোমার মতো অপদার্থ পৃথিবীতে দুটো নেই। অমন একটা চান্স ছেড়ে দিলে?
কুম্ভকর্ণের দ্বিতীয় এডিসান। কানের কাছে ঢাক-ঢোল পেটালেও ঘুম ভাঙে না।
আর কবে বুঝবে নিজের আখের? সবাই কেমন গুছিয়ে নিচ্ছে। তুমি কেবল হ্যাহ্যা করেই জীবন কাটালে।
মাথা মোটার বংশ।
কাজের মধ্যে দুইঃ খাই আর শুই।
বচনের ঝুড়ি।
মুখেন মারিতং জগৎ।
থাক, আমার কথা আর ভাবতে হবে না। তুমি স্বার্থপর। তোমার বাবা স্বার্থপর। তোমার বাবার বাবা, তার বাবা, তোমার ওপরের চোদ্দো পুরুষ। তোমার নীচের চোদ্দো পুরুষ। সব স্বার্থপর।
বেইমানের ঝাড়।
আমার জন্যে তুমি কী করেছ? কী ঘোড়ার ডিম তুমি করেছ? সারাটা জীবন কেবল ধামসেছ।
পড়তে অন্য কোনও মেয়ের পাল্লায়, তোমার বাবার নাম ভুলিয়ে দিত।
নিজেকে পুরুষ বলে দাবি করো। তুমি মেয়েছেলেরও অধম।
যা কচ্ছ করো, আমার ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হবে না। যে ভালো করেছ কালী আর ভালোত কাজ নাই। এখন ভালোয় ভালোয় বিদায় দে মা। আলোয় আলোয় চলে যাই।
তোমার থাকাও যা, না থাকাও তাই। শালগ্রামের আবার ওঠাবসা।
কথার খোঁচা মারা ছাড়া, তোমার আর কী মুরোদ আছে?
অশান্তি ছাড়া তুমি আর কী করতে শিখেছ? আর কী শেখানো হয়েছে তোমাকে।
আমার বাপের বাড়ি! তাদের নখের যুগ্যি তোমরা হতে পারবে না।
তোমাদের থাকার মধ্যে আছে বড় বড় কথা। বাইরে কোঁচার পত্তন ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন।
গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করে তোমার গণধোলাইয়ের ব্যবস্থা করব।
তুমি ভালো তো, আমি ভালো। জগৎ হল আয়নায় মুখ দেখা।
।। কানে দিয়েছে তুলো পিঠে বেঁধেছি কুলো ।।
কী অতীতে, কী বর্তমানে, কী ভবিষ্যতে স্ত্রীরা স্বামীকে এইভাবেই আকুপাংচার করেছেন, করছেন, করবেন। খোঁচালেও উত্তেজিত হবেন না। মনে করবেন, সোহাগ যে করে, শাসন তারই সাজে। একে বলে, জীবনের চাটনি। অম্লে আর মধুরে মিশে স্বাদু একটা ব্যাপার। আবার এরকম মনে করা যায়,
পাগলে কি না বলে
ছাগলে কি না খায়!
অমৃতং স্ত্রীভাষিতং।।
আবার এ-ও মনে রাখতে হবে,
কথায় কথা বাড়ে
টাকায় বাড়ে সুদ।
একপক্ষ সরব হলে আর এক পক্ষকে নীরব থাকতে হবে। মনে মনে আওড়াতে হবে, ‘ মেরেছ কলসির কানা, তা বলে কী প্রেম দেব না।’ স্ত্রী যখন বিড়বিড় করবে তখন মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কথা বেশি করে বলতে হবে। প্রথমে গরম তেলে বেগুন পড়ার মতো, আরও চিড়বিড় করে উঠবে। ভয় পেলে চলবে না। ভাই রে! ভালোবাসায় বাঘও পোষ মানে। বাঘের মাসিও মানে। সহধর্মিনী মানবে না?
ইহুদিশাস্ত্রে একটি প্রবাদ আছে :
[It is better to live in corner of the housetop
Than to share a spacious house with a quarrel some wife.]
ঝগড়ুটে স্ত্রীর সঙ্গে বিশাল একটা বাড়িতে একত্রে বসবাসের চেয়ে
ছাদের এক কোণে ঝুপড়ি তৈরি করা থাকা ঢের ভালো।।
।। ডিম আগে না মুরগি আগে?।।
ধ্যান দিন। বিয়ে করার সময় নিশ্চয় কেউ দেখেশুনে ঝগড়ুটে স্ত্রী বিয়ে করে না। মেয়েরা আগে স্ত্রী হয় তারপর প্রেমের লাইন থেকে বাধ্য হয়ে ঝগড়ার লাইনে চলে যায়। কী ভাবে? খোঁচা খেতে খেতে। যে কারণেই স্ত্রীজাতির উক্তি—খোঁচা খেতে খেতে একসময় ঢোঁড়া সাপও ফোঁস করে ওঠে। অনেকেই মনে করেন, পরের মেয়েটি হল, পিন ফোটাবার পিন-কুশান। কুটুস কুটুস কামড়াব, গর্তের ভেতর সিঁধবো। শ্বশুর খোঁচাবে, শাশুড়ি খোঁচাবে, ননদ খোঁচাবে, আর তিনি ঊনিশ শতকী বউ হয়ে বসে থাকবেন। কবি লিখবেন—
বাংলার বধূ বুকে তার মধু
নয়নে নীরব ভাষা।
সাহিত্যিক লিখবেন—এই আমাদের বঙ্গ রমণী, বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। সে মামার বাড়ি আর নেই। নারী-প্রগতি বহু দূর এগিয়ে গেছে, ভাই। স্বামীর পা ধুইয়ে, চুল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে, সকালে জামবাটিতে জল এনে বলছে—পায়ের বুড়ো আঙুলটা ডুবিয়ে দাও নাথ, পাদোদম পান করে দিন শুরু করি। আবদার আর ধরে না। একালের স্ত্রীর গায়ে লেখা থাকে না, বুঝে নিতে হয়—হ্যান্ডল উইথ কেয়ার।
মেয়েরা অভিমানী হয়, স্পর্শকাতর হয়। ওই দুটো একত্রে একটা ডিনামাইট। মেয়েরা হল আগুন। নির্দেশই আছে—ডোন্ট প্লে উইথ ফায়ার। আগুনে যেমন রান্না হয়, তেমন আগুনে আগুনও লাগে। নারী হল শক্তি। পুরুষ তো ভ্যাদামারা জীব। যেমন দেখতে, মুশকো ষণ্ডামার্ক। হেঁড়ে গলা। গোঁফ দাড়ি। চেহারা যেমন স্বভাবও তেমন। বলদ! আবার গান গায়—মা আমায় ঘুরাবি কত! এমন চোখবাঁধা কলুর বলদের মতো! আচ্ছা মুশকিল তো! বলদকে বলদের মতো ঘোরাবে না। এতকাল স্রেফ টাকার জোরে ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছে। এখন মেয়েরাও উপার্জনশীল। অনেকে আবার বউয়ের পয়সায় বিলাইতি খায়, কারণ একটাই, মেয়েরা যাকে ভালোবাসে তার জন্যে জান লড়িয়ে দেয়। মেয়েরা হুহু করে প্রেম করতে পারে বলেই অনেক অপদার্থের নারীসঙ্গ হয়। কোনও শ্বশুর তা না হলে, অমন রাঙা মুলো কিনত না। গোয়ালভাঙা বাছুরের মতো মেয়ে দুদ্দাড় করে বেরিয়ে গেল গুলের গলায় মালা পরাতে। বাপ হার্টফেল। জীবজগতে নারীর চেয়ে সুন্দর কী আছে! দেহ নরম মন নরম। পরোটার মতো হৃদয়। সরোবরের মতো চোখ। মেঘের মতো চুল। বাঁশির মতো গলা। কত ছেলেই তো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। কেউ তাকায়। একটি মেয়ে হেঁটে গেল? জোড়া, জোড়া চোখ। চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল পুরুষ। কাপ ঠোঁটে আসার আগেই কাপ হেলিয়ে দিলে—বুক ভেসে যায় চায়ে—
মা আমার সাধ না মিটিল
আশা না পুরিল
বুক ভেসে গেল চায়ে।।
কুকুর তবু বিশ্বস্ত হয়, পুরুষ মানুষ! বিয়ে হল। বছরতিনেক খুব হল, হ্যাঁ গো, শুনছ, তুমি আমার হৃদয়শ্বরী, প্রাণেশ্বরী, দিলকা চমচম। যেই বউ একটু পুরোনো হল, প্রেম পটকে গেল। শুরু হল একস্ট্রা-কারিকুলার অ্যাকটিভিটি। এর দিকে দৌড়োয়, তার দিকে দৌড়োয়। একেবারে ভিখিরির জাত। কোনও আত্মসম্মানবোধ নেই। হুলো বেড়ালের ছোঁচকা স্বভাব। মেয়েদের হৃদয় জয় করার জন্যে গুঁপোরা যে সব কথা বলে, শুনলে গা জ্বলে যায়। লজ্জা করে। কেউ ভাঁড় হয়ে যায়, কেউ বাজারসরকার, কেউ ডাকপিওন, কেউ মুটে, কেউ কবি, কেউ অভিনেতা, কেউ দার্শনিক, কেউ ধর্মগুরু। সবই এক দুজেকে লিয়ে। মেয়েরা এই মালেদের পাত্তা দেয়, এই না কত। মেয়েরা বেসিক্যালি সরল, বোকা বালিকা-স্বভাবের। না, মেয়েরা প্রকৃতই ধার্মিক। কারণ তুলসীদাস বলেছেন ভালো করে বোঝার চেষ্টা করুন—
পন্নগারি অসনীতি শ্রুতিসম্মত সজ্জন কহহি।
অতি নীচ হুঁসন প্রীতি করিয়ে, জানি নিজ পরম হিত।।
পাটকীটতে হোয় তাতে পাগম্বর রুধির।
ক্রিমিপালে সবকোয় পরম অপাওন প্রাণসম।।
ভুষণ্ডী কাক একদিন গরুড়কে বলছেন—হে পন্নগারে। শ্রুতিজ্ঞ, সজ্জন কী বলেন জানেন, নীচ, অতি নীচ মানুষের সঙ্গেও প্রেম ভালোবাসা করবে, কারণ তাতে নিজেরই উপকার হবে। যেমন? উদাহরণটা শুনুন রেশম-কীট, বিশ্রী দেখতে, ঘেন্নাই করে, সেই কীট লোকে যত্ন করে পালন করে। ফল? রেশম-গুটি। সেই গুটি থেকে রেশম। রেশম থেকে কাপড়। তার আবার অনেক দাম। নীচ মানুষ থেকেও ভালো ফল পাওয়া যায়।
কী ফল? সংসার চেনা যায়। জ্ঞান বাড়ে। পুরুষ জাতটা কেমন মেয়েরা চিনতে পারে। সেই চেনাটা কেমন? না—
গোউয়া দোকে কুত্তা পালে ওসকি বাছুর ভুখা।
শালেকে উত্তম খিলাওয়ে বাপ না পাওয়ে রুখা।।
ঘরকা বহুরি প্রীত না পাওয়ে চিত চোরাওয়ে দাসী।
ধন্য কলিযুগ তেরি তামাসা দুখ লাগে ঔর হাসি।।
পুরষের রূপ—বাছুর দুধ না পেয়ে শুকিয়ে মরছে, গরু দুয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে পোষা কুকুরকে। পরমারাধ্য পিতৃদেবের বরাতে হয়তো শুকনো একটা রুটিও জোটে না, এদিকে শ্যালক চর্ব্য-চুষ্য খাচ্ছে। আর বউকে ছেড়ে পুরুষ ছুটছে দাসীর কাছে, বারাঙ্গনার কাছে, প্রেম নিবেদনে।
সেই তুলসীদাসের কাল আর এই কাল—হালচিত্রে কোনও পরিবর্তন নেই। পুরুষের মতিভ্রম, নারীর সর্বস্ব ত্যাগ। এইবার আইন করা উচিত, স্ত্রী বিয়োগের পর ছেলেরা, মানে স্বামীরা বিধবা হবে। বহু বছর ধরে অত্যাচার করেও আশা মেটেনি। নিজেদের বেলায় আঁটিসুঁটি পরের বেলায় দাঁতকপাটি।